১৩ এপ্রিল : বর্ণপরিচয় দিবস
বিদ্যাসাগরই বঙ্গদেশে শিশুশিক্ষার ও জনশিক্ষার প্রকৃত সোপান রচনা করেছিলেন। এক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠ শিল্প সৃষ্টি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ‘বর্ণপরিচয়’। ১৮৫৫ সালের ১ বৈশাখ (১৩ এপ্রিল) ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ এবং ১ আষাঢ় (১৪ জুন) ‘বর্ণ পরচয় দ্বিতীয় ভাগ’ প্রকাশিত হয়।
১৮৯০ সালের মধ্যে বারংবার পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে প্রথম ভাগের ১৫২ টি মুদ্রণ/ সংস্করণ (মোটয়৩৩,৬০,০০০ কপি) এবং দ্বিতীয় ভাগের ১৪০টি মুদ্রণ/সংস্করণ (মোট ১৫,৯০,০০০ কপি) প্রকাশিত হয়। কী গভীর অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা নিয়ে তিনি এ কাজ করেছিলেন, তা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।সুহৃদ মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে সহায়তা করতে গিয়েই বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেন যে সম্পূর্ণ নতুন ঢঙে শিশুশিক্ষার পাঠ রচনা করা ছাড়া কোনও পথ নেই ।অতঃপর দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে রচিত হয় জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশের তোরণ ‘বর্ণপরিচয়’।
‘ বর্ণপরিচয়’ রচনা করতে গিয়ে তিনি উচ্চারণ ধ্বনি অনুসারে বর্ণগুলিকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজালেন ।স্বরবর্ণের স্থান হল শুরুতে। বাংলাতে যেসব বর্ণের প্রয়োগ নেই (যেমন দীর্ঘ ঋ, দীর্ঘ লি) সেগুলিকে তিনি বাতিল করলেন। ং,ঃ- কে ব্যঞ্জনবর্ণভুক্ত করলেন।ঁ ,ড়,ঢ় য়-এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করলেন।ক্ষ (ক+ষ) -কে ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে সরিয়ে নিয়ে সংযুক্ত বর্ণে তার স্থান নির্দিষ্ট করলেন। ফলে আগেকার ৫০টির জায়গায় বর্ণের সংখ্যা হল ৫২টি( স্বরবর্ণ ১২,ব্যঞ্জনবর্ণ ৪০)।শুধু বর্ণ-শৃঙ্খলা নয়। ইতিপূর্বে বাংলা হরফগুলি নানা স্থানে নানা রূপে প্রচলিত থাকায় বেশ অসুবিধা হত।গভীর চিন্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিদ্যাসাগর এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ছাঁচের প্রচলন করলেন। তা করতে গিয়ে ১৭৭৮ সালে হ্যালহেডের নির্দেশে পঞ্চানন কর্মকার ‘বাংলাভাষার ব্যাকরণ’ ছাপার জন্য যে হরফ তৈরি করেছিলেন, এবং ১৮০০ সালে উইলিয়াম কেরি বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থে যে ধরনের হরফ ব্যবহার করেছিলেন , বিদ্যাসাগর অনেক ক্ষেত্রে তারও রূপান্তর ঘটালেন।
মুদ্রণ সমস্যা সম্পর্কে এত বিশদ চিন্তা এর আগে আর কোনও বাঙালি করেননি। শব্দচয়নের ক্ষেত্রে ধ্বনি ও ব্যঞ্জনার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রেখে তিনি পাঠগুলির বিন্যাস ঘটালেন শিশুমনের সুষ্ঠু বিকাশ সাধনের লক্ষ্য সামনে রেখে। ছোটো ছোটো শব্দ,সুসংহত বাক্যের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি-জিজ্ঞাসা, সমাজ পরিচয় -এর সূত্রপাত ঘটালেন অন্তরঙ্গ আবহাওয়া রচনা মাধ্যমে।” জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে, কাক ডাকিতেছে,গরু চরিতেছে” প্রভৃতি প্রচলিত বাংলাকে স্বচ্ছন্দে অন্তর্ভুক্ত করলেন পাঠের মধ্যে। প্রবর্তন করলেন বিরতি চিহ্নের ও অর্থবহ পরিচ্ছেদ বিভাগের।
সংক্ষেপে ‘বর্ণপরিচয়’- এর বৈশিষ্ট্য হল-* শিশুদের সুকুমার মনের উপযোগী করে পাঠগুলিকে গড়ে তোলা।* উচ্চারণ ধ্বনি অনুসারে বর্ণ-শৃঙ্খলা।* হরফের সুনির্দিষ্ট ছাঁচ নির্বাচন ও মুদ্রণ। * সহজ-সরল শব্দ নির্বাচন ও পাঠ বিন্যাস। * সুসংহত যতিচিহ্নের প্রবর্তন ও অর্থবহ পরিচ্ছেদ বিভাজন।* শিশুদের মনে প্রকৃতি ও সমাজ জিজ্ঞাসার উন্মেষ ঘটানো।বিদ্যাসাগর ছিলেন বস্তুবাদী দর্শনের বিশ্বাসী একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানবতাবাদী শিক্ষক। প্রকৃত আচার্য।তাঁর এই জীবনে দর্শনের ছাপই পড়েছে ‘বর্ণপরিচয়’-এর সামগ্রিক পরিকল্পনায়।
পরবর্তীকালের সকল পাঠ্যপুস্তক-প্রণেতা বিদ্যাসাগরের এই রীতি থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে বর্ণপরিচয় সম্পর্কে লিখেছেন,” আমার জীবনে এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে, তখন বুঝিতে পারি কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন।…. এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল ।”শুধু বর্ণপরিচয় রচনা করে বিদ্যাসাগর থেমে থাকেননি। বহু যত্ন করে তিনি তৈরি করেছিলেন তার পরবর্তী পাঠের বইগুলিও।আজকের দিনে ভোগবাদের হাওয়া, ধান্দার ধণতন্ত্র ও ধর্মমোহ আমাদের সমাজ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে সুকুমার মনোবৃত্তিগুলিকে।এই অবস্থায় আমাদের নতুনভাবে শিশু, কিশোর, পরিণত বয়স্কদের মধ্যে সচেতনভাবে প্রসারিত করতে হবে বিদ্যাসাগর চর্চাকে।।