হিন্দুস্তানী যন্ত্রসংগীতের বিবর্তন
ড.মৃন্ময় রায়
‘সংগীত ও সংগীতের বাদ্যযন্ত্র এত সুক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র হয়ে গেছে যে জীবনের সাধারণ কাজকর্মে তাদের আদিরূপের সন্ধান করতে গেলে কোনো নিশ্চিৎ সন্ধান মেলে না-তাদের বর্তমান রূপগুলিই মেনে নিতে হয়। বাদ্য যন্ত্রের সাথে সংগীতের সম্বন্ধ এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক অগ্রগতিতে এই সম্পর্কগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই-তন্ত্র বাদ্যযন্ত্রের আদি উৎসমূলে ছিল সংগীত বহির্ভূত ক্রিয়াকলাপ।
সংগীত শব্দটি রামায়ণে প্রথম কিস্কিন্ধ্যা কাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তার বহু পরে মকরন্দকার নারদ ও শারঙ্গদেব ব্যবহার করেছেন-এই শব্দটি। তবে বৈদিক যুগ ও প্রাচীন যুগে গীত বাদ্যাদি চর্চা বোঝাবার জন্য এককথায় সংগীত কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন বৈদিক সংগীত, গান্ধর্বামার্গ সংগীত, দেশী সংগীত, বর্তমানে রাগ সংগীত ইত্যাদি, অর্থাৎ এক কথায় ‘সংগীত’ ও ‘মিউজিক সমার্থক।
বৈদিক যুগে বিভিন্নরকমের বীণার উল্লেখ ছিল। বেদে বাণ বা বীণার উল্লেখ পাওয়া যায়। সাম কেদই সকল গান বা সংগীত সৃষ্টির আদি উৎসকেন্দ্র। বৈদিক যুগে গানের সঙ্গে নৃত্য ও বাদ্য থাকত। বৈদিক সাহিত্যে তথা সংহিতায়, বাহ্মণে, আরণ্যক ও উপনিষদে, ধর্ম, শ্রৌত ও কর সূক্তে, শিক্ষায় প্রাতিশাখো আত্যুদায়িক ও আভিচারিক প্রয়োগ অনুযায়ী গানের অনুশীলন হতো। ঋক সংহিতার কিছু কিছু সূক্তে নৃত্যেরও নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার ও সংস্কৃতির আবিস্কারে অনুন্নত কতকগুলি বাদ্য যন্ত্রের ও নৃত্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। বৈদিক সংগীতে বাদ্য যন্ত্র রূপে আমরা পাই ক্ষোণী, আঘাটি বা আঘাতি, ঘাটলিকা, কাণ্ডবীণা, পিচ্ছোরা, শততন্ত্রী বীণা, ঔদুম্বরী বীণা ইত্যাদি। নাট্য শাস্ত্রে আমরা চিত্রা ও বিপঞ্চী বীণার বিশেষ উল্লেখ পাই। চিত্রা আঙুল দিয়ে বাজানো হতো এবং সপ্ততন্ত্রী যুক্ত ছিল। বিপঞ্চী বীণা নবতন্ত্রী যুক্ত ও কোণ দ্বারা বাজানো হতো। এছাড়াও ঘোষকা নামে একটি বীণা যন্ত্র পাওয়া যায়-যার বিবর্তিত রূপ এখনকার তানপুরা। বিপঞ্চী বীণার উৎস মূলে ধনুবীণা বা ধনুর্যন্ত্র এবং চিত্রাবীণা-কচ্ছপী বীণার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। ‘কাশ্যপ’ শব্দটি বৈদিক যুগের শব্দ কশ্যপ মুনির নাম থেকে এসেছে। সূর্যস্তবে ‘জবা কুশুম সংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্… কাশ্যপেয়ম্ শব্দ কশ্যপ নাম বা শব্দ থেকে এসেছে। কাস্পিয়ন বীণা ছিল দ্বিতন্ত্রী (1st & 5th) বীণা এবং 1500 খ্রি. পৃ. কালে প্রচলিত ছিল বাইজেনটিয়ম্। কাস্পিয়ান হ্রদ অঞ্চলে ঐ কাস্পিয়ান ও কাস্পিয়ান থেকে কস্যপী ও পরে কচ্ছপী বীনা বিশেষভাবে সম্পর্কিত ছিল। অবশ্য শিকার করার অস্ত্র ধনুক (HUNTING BOW) বা ধনুর্যন্ত্র তন্ত্রবাদ্যের ক্ষেত্রে আদিবাদ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধনুর্যন্ত্রের ধারণা থেকেই পরবর্তীকালে আকারগত পার্থক্য, তন্ত্রীর সংখ্যা, নামকরণ ঐ সকল বীণাকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করেছে। তাই ধনুক-ই সংগীত শাস্ত্রের ধনুর্বীণা বা ধনুর্যন্ত্র নামে উল্লেখিত হয়েছে। বীণা বলতে তন্ত্র বাদ্যকে বোঝানো হয়েছে অতি প্রাচীনকাল থেকেই। তাই তন্ত্র বাদ্য ও বীণা একদিক থেকে সমার্থক।
হরিবংশে বিভিন্ন বীণা বা তন্ত্রবাদ্যের নাম পাওয়া যায়। একতন্ত্রী ধনুর্বীণা বা ধনুর্যন্ত্র থেকেই ক্রমবিবর্তনের পথে বিভিন্ন বীণার সৃষ্টি হয়েছে। বিপঞ্চী বীণার আকৃতিই প্রমাণ করে থাকে যে, এই বাদ্যটির সরাসরি উৎস হলো ধনুর্বীণা। একতন্ত্রী থেকে ক্রমিক পর্যায়ে পঞ্চতন্ত্রী এবং তারপর নবতন্ত্রী হয়ে বিপঞ্চী বীণার তৎকালীন বিবর্তন সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রাচীন যুগের প্রথমার্ধে চিত্রাবীণা ও বিপঞ্চী বীণা দুটি ছিল অঙ্গ বা প্রধান বীণা। নাট্যশাস্ত্রকার পরবর্তী আমলে বৃহদ্দেশীকার মতঙ্গের আবির্ভাব হয়েছিল খ্রীষ্টীয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে, তবে সম্ভবত তৃতীয় শতকেই তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মতঙ্গের নামের সঙ্গে কিন্নরী বীণার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন মতঙ্গই ছিলেন কিন্নরী বীণার উদ্ভাবক। তবে দণ্ডাকৃতি একতন্ত্রী ও পরে দ্বিতন্ত্রীযুক্ত (সারিকা বা পর্দা যুক্ত) আলাপিনী ও আলাবনী বীণা কিন্নরী বীণার উত্তরসুরী বলে মনে করার কারণ আছে। আকৃতিগত পরিচয়ের মধ্যেই কারণটি বিশেষভাবে নিহিত আছে। কিন্নরী বীণা দণ্ডযুক্ত ও চোদ্দটি সারিকা বা পর্দা ও একাধিক তোম্বাযুক্ত ছিল। অতএব স্বাভাবিক ভাবেই আলপিনী বীণা থেকে উন্নততর পর্যায়ে কিন্নরী বীণার আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্নরীর আবার আকারগত ভাবে তিনটি ভেদ ছিল। লঘু কিন্নরী, মধ্য কিন্নরী ও বৃহৎ কিন্নরী। কিন্নরী বীণা ছিল দুটি তোম্বাযুক্ত, মধ্য কিন্নরী বীণা ছিল তিনটি তোম্বা যুক্ত এবং বৃহৎ কিন্নরী বীণা ছিল চারটি তোম্বাযুক্ত। খ্রীষ্টিয় ত্রয়োদশ শতকে শারঙ্গদেবের আবির্ভাবকালে রুদ্রবীণা উদ্ভুত হয়ে গিয়েছিল যা ‘সংগীত রত্নাকর’ গ্রন্থে রৌদ্রী নামে উল্লেখিত হয়েছিল। সেই সময় থেকেই রুদ্রবীণা ক্রমেই প্রাধান্য লাভ করেছিল। ধ্রুপদ সম্রাট তানসেনের (খ্রীষ্টীয় ১৫১০-১৫২০ সালের মধ্যে) কালে রুদ্রবীণা প্রধানতম বীণায় পরিণত হয়েছিল। কিন্নরী বীণা তখন তার পূর্বগুরুত্ব ক্রমে হারিয়েছিল। পক্ষান্তরে চিত্রাবীণা থেকে উদ্ভুত ভারতীয় রবাবরুদ্রবীণার সমসাময়িক। তানসেন এই রবাবের আকৃতিগত ভাবে বিশেষ সংস্কার সাধন করেন। তাঁর সময়ে তিনি এই রবাবের সর্বোত্তম বাদক ছিলেন। তিনি রুদ্রবীণারও উৎকৃষ্ট বাদক ছিলেন তবে তার জামাতা মিশ্রী সিংহ (নবাৎ খাঁ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রুদ্রবীণা বাদক। এই প্রসঙ্গে বি. সি. দেবা, বীরেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী, ডঃ লালমণি মিশ্র ও ওস্তাদ আসাদ আলি খাঁ প্রমুখ গুণীজনের প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিগুলি এ বিষয়ে বিশেষভাবে সাক্ষ্য গ্রহণ করে থাকে। তানসেনের পুত্রবংশীয় ধারায় ধ্রুপদ গান ও রবাব বাদ্যের বিশেষ চর্চা হয়েছিল। যে কারণে তানসেনের কনিষ্ট পুত্র বিলাস খাঁ’ বোল্ড হবে-র বংশের ধারাটি এবং তার কন্যা-জামাতা বংশীয় ধারাটি বিশেষভাবে পরিচিতি পেয়েছে। সেণী ঘরাণার মৌলিক অবদানসমূহ একদিকে যেমন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরী প্রভৃতি গানের ক্ষেত্রে, তেমনি অপর দিকে রুদ্রবীণা, রবাব, সুর শৃঙ্গার, সুরবাহার, সেতার ও সরোদ প্রভৃতি তন্ত্রবাদ্যের ক্ষেত্রেও আধুনিক সেতার বাদ্যের উদ্ভাবনের মূলে রয়েছে রুদ্রবীণা ও তানপুরা বা তম্বুরার সম্মিলিত অবদান। অপরদিকে সবোদ বাদ্যের উদ্ভাবনের মূলে রয়েছে রবাব ও সুবশৃঙ্গার বাদ্যের অবদান। এইভাবে উত্তরভারতের দুটি প্রধান তন্ত্রবাদ্য অর্থাৎ সেতার ও সরোদের আবির্ভাব সংঘটিত হয়েছিল যথাক্রমে খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে। উজির খাঁ (ওয়াজির খাঁ খ্রী: ১৮৬০-১৯২৮ সালের মধ্যে) সেনী ঘরাণার রবাবিয়া ও বীণকার এই দুই ধারার সার্থক মিলন ঘটিয়েছিলেন। বর্তমানে উত্তর ভারতীয় রাগসংগীতে তন্ত্রবাদ্যে নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ রাগ রূপায়ণের ক্ষেত্রে সেতার ও সরোদ এই দুইটি প্রধান ও জনপ্রিয় তন্ত্রবাদ্য-একথা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না। যুগের পরিবর্তনে রুদ্রবীণার প্রচলন বর্তমানে প্রায় অস্তমিত। সম্ভবত রাজস্থানের আশাদ আলি খাঁ-ই এখন রুদ্রবীণার উল্লেখযোগ্য শিল্পী এবং বলা যায় তিনি এই বাদ্যের বাজের ধারক হিসাবে গুণীমহলে সর্বাধিক পরিচিত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, বিবর্তনের ধারায় তন্ত্র বাদ্যগুলির বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা আরও কিছু তন্ত্রবাদ্যযন্ত্র পেয়েছি যেমন-সারেঙ্গী, সারিন্দা, এসরাজ, দিলরুবা প্রভৃতি।
বর্তমান আকারে বেহালা যন্ত্রটি পাশ্চাত্য সংগীতের বহুমূল্য অবদান। যন্ত্রসঙ্গীতের আলোচনা প্রসঙ্গে বেহালা যন্ত্রের ক্ষেত্রে বলা যায় যে সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে বেহালার বিবর্তিত রূপের পর সর্বজনগ্রাহ্য স্ট্রাডিভারী নির্মিত বর্তমান বেহালার যে আকারগত বা কাঠামোগত রূপ প্রচলিত- তা ভারতীয় সংগীতকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমানে বাদ্যটি এদেশে অন্যতম প্রধান তন্ত্রবাদ্যে পরিণত হয়েছে। রাগ সংগীতের ক্ষেত্রে সেতার ও সরোদের পরেই বেহালা বাদ্য নিরূপণ করা হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে রাগ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত তন্ত্র বাদ্যগুলির (বীণা, রবাব, সেতার, সুরশৃঙ্গার, সুরবাহার, সরোদ) বাজের গঠনমূলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সৃজনশীল সংগীত গুণী তথা সংগীত শিল্পীর মৌলিক অবদান রয়েছে। প্রাচীন ও মধ্য যুগে (তানসেনের পূর্বে) মূলত গানের অনুসারী হয়েই তৎকালীন বীণা বাদ্যগুলি বাদিত হতো এবং সেইভাবে তাদের নিজ নিজ স্থান ও গুরুত্ব স্বীকৃত ছিল। অনিবদ্ধ মার্গে রাগালাপ, রূপকালাপ ও আলপ্তিকা পরিবেশিত হতো। নিবদ্ধ মার্গে ‘গৎকারী’ তখনও প্রচলিত হয় নি। বিভিন্ন গুণীদের মতে নিবদ্ধ মার্গে তন্ত্রবাদ্যে গান- ই অর্থাৎ গানের বন্দিশ (তাল লয়, সমন্বিত সুরাবয়ব বা স্বরাবয়র) বাজানো হতো সেই পদ্ধতির অস্তিত্ব কিছুটা পরিবর্তিত এখনও দক্ষিণ ভারতের বিশেষ অঞ্চলে বিরাজ করছে। তানসেনের অন্যতম মৌলিক অবদান ছিল বীণা ও রবাবে আলাপ জোড়াদির প্রবর্তন। ক্রমবিবর্তনের ধারায় তানসেন পরবর্তীকালে অনিবদ্ধ মার্গে আলাপ, জোড়-আলাপ সমন্বিত দ্বাদশাঙ্গ আলাপ রীতি
গড়ে ওঠে এবং তার মূলে রয়েছে সেনী ঘরাণার বিভিন্ন ওস্তাদের বহুমূলা অবদান। এই প্রসঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্কর-কৃত রাগ অনুরাগ গ্রন্থ থেকে একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি লিপিবদ্ধ করা হলো।
“সে যুগে শুরুর দিকে বীণে, রবাবে, সুর শৃঙ্গারে এবং পরে সুরবাহারেও এই ধ্রুপদ ও ধামার গাইবার সমস্তটাই প্রায় নকল করা হতো। অধুনা প্রচলিত যন্ত্রে ‘গৎ’ তখন বাজত না, বরং অনেক ধ্রুপদ ও ধামারের বন্দিশ গানও বাজাতেন যন্ত্রের ওপর। দক্ষিণ ভারতে আজও অবধি আমরা তা দেখতে পাই। গৎ বলে কোন পদার্থ নেই সেখানে। বীণাতে, বাঁশিতে নাদম্বরম-এ, এমন কি বেহালাতেও সকলেই ত্যাগরাজ স্বামীর, দীক্ষিতার এবং শ্যাম শাস্ত্রীর রচিত কৃতিগানই বাজিয়ে থাকেন এবং তার ওপরেই যথাযথ বিস্তার করেন।”
রুদ্রবীণা, রবাব, সুরশৃঙ্গার, সুরবাহার বাদ্যে আলাপ জোড় ও ঝালা অনিবদ্ধ মার্গে পরিবেশিত হতো। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে তারপরণ’ বাদিত হতো অনেক সময় দ্রুত জোড়ের শেষে। বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় ‘তারপরণ’ আসলে নিবদ্ধ মার্গেরই অন্তর্ভুক্ত।
সেতার ও সরোদ বাদ্যে আলাপ, জোড়, ঝালা পরিবেশিত হয় অনিবদ্ধ রাগ-রূপায়ণের ক্ষেত্রে। বিলম্বিত তান-তোড়াদি বিলম্বিত পর্যায়ে এবং দ্রুত পর্যায়ে দ্রুত গৎ, তান-তোড়া ও ঝালা নিবদ্ধ মার্গে পরিবেশিত হয়। বেহালা বাদ্যে কখনও খেয়াল গানের অঙ্গে বিলম্বিত ও দ্রুত পর্যায়ে রাগ পরিবেশিত হয়, আবার উপরোক্ত বিলম্বিত ও দ্রুত গৎ-কারীর রীতিতেও রাগ পরিবেশিত
হয়। সেতার সরোদ তন্ত্রবাদ্য ‘ডা’ এবং ‘রা’ এই দুটি প্রধান বাণী বা বোলের মিশ্রণে একাধিক ‘বোল’ বা ‘বাণী’ (যুগ্মবাণী, মিশ্রবাণী সমেত) উদ্ভুত হয়েছে যেগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী রাগ পরিবেশনের সময় ‘আলাপ’, ‘জোড়’ এবং ‘গৎকারী’ ও ‘ঝালা’-র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বেহালা বাদ্যে অনুরূপ ভাবে রাগ-রূপায়ণের ক্ষেত্রে বোল বা বাণী উপরিউক্ত ডা, রা, ডিরি, ইত্যাদি বাণী বা বোলের পরিবর্তে নিম্নলিখিত বাণীগুলি অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত ও উপযোগী বলে মনে হয়। সংক্ষেপে উল্লিখিত হল-‘তারাণা’-র ক্ষেত্রে যেমন- তা না তা না, দিম্ তা না, দিম্ না না, তুম্ না না-বেহালা বাদ্যের ক্ষেত্রে ‘তার’ ধ্বনি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দিম্ না না, দিনা না না, তুম্ না না, এই ধরনের ধ্বনিযুক্ত বোল অধিকতর উপযোগী মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে, বেহালা বাদ্যে রাগ-রূপায়ণ আলাপ জোড়াদি তথা গৎকারী-তান-তোড়া, ঝালা আবার খেয়াল গানের অনুরূপ বন্দিশসহ তান-তোড়াদি সমেত রূপায়িত হতে পারে (অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই গানের বন্দিশের বাণীর পরিবর্তে বেহালার বাণীর মাধ্যমেই ঐ বন্দিশ রূপায়িত হবে)।
বর্তমানে এই ত্রয়ী তন্ত্রবাদ্যের প্রথিতযশা শিল্পী গানের সঙ্গে অনেক তরুণ শিল্পীদের উপস্থিতি তন্ত্রবাদ্যের মাধ্যমে রাগ সংগীতের প্রবাহকে সচল রেখেছে।
সম্প্রতি এদেশে ‘পাঁচটি তার যুক্ত বেহালা’ আবার ‘তরফের তার যুক্ত বেহালা’ (অর্থাৎ তরফদার ‘বেহালা’) বাদ্যের প্রচলনের প্রবণতা সামান্য হলেও দেখা দিয়েছে। অবশ্য এই প্রবণতা সার্বিকভাবে গ্রহণীয় হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে বেহালা বাদ্যের ‘অরিজিন্যাল’ ধ্বনি বা বেহালা বাদ্যের ধ্বনির ‘অরিজিন্যালিটি তথা ধ্বনি মাধুর্য্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি ঐ সকল পরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।
এখনও পর্যন্ত রাগ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তন্ত্রবাদ্য সম্পর্কিত ধারাগুলি বহমান থেকে আশা করা
যায় যে, আগামী বেশ কিছুকাল উত্তর ভারতীয় তন্ত্রবাদ্যের জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ থাকবে। তবে সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে কি নিহিত আছে-সেই সম্বন্ধে নির্দিষ্ট করে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। কে বলতে পারে বিবর্তনের ধারা অন্য পথেও যে প্রবাহিত হবে না।
১। প্রকৃতপক্ষে রাগ-সংগীতের প্রচলন প্রাচীন যুগের বহু পূর্বেই হয়েছে। গান্ধর্ব-মার্গে জাতিরাগ (বা রাগ- গীত) গীত হত। নাট্য শাস্ত্রে জাতি রাগম্ শব্দটি কয়েকবার উল্লিখিত হয়েছে। আবার দশ প্রকার জাতি লক্ষণই আসলে হল দশবিধ রাগ লক্ষণ ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক ভিত্তি এই অলঙ্ঘনীয় সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে থাকে।
২। তানসেনের পুত্রবংশীয় ধারার (বিশেষ করে বিলাস খাঁর বংশ ধারায়) আবির্ভূত ওস্তাদগণ এবং ঐ ধারার শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরা সেণী ধ্রুপদিয়া-রবাবিয়া ধারা বা ঘরাণা নামে চিহ্নিত। পক্ষান্তরে কন্যা- জামাতা বংশীয় ধারার ওস্তাদগণ এবং ঐ ধারার শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরা সেণী ধ্রুপদিয়া-বীণকার ধারা বা ঘরাণা নামে চিহ্নিত। আবার এই দুই ধারা যথাক্রমে সেণী বরাবিয়া ধারা সেণী বীণকার ধারা বা ঘরাণা রূপে পরিচিত। এই দুই ধারা একত্রে ‘সেণী ঘরাণা’ নামে পরিচিত। বর্তমানে উত্তর ভারতে
রাগ সংগীতের ক্ষেত্রে (গায়ন/বাদন) সেনী ঘরাণার মৌলিক ও ব্যাপক অবদান রয়েছে। ৩। ডঃ বিমল রায় তাঁর “ভারতীয় সংগীত প্রসঙ্গ” গ্রন্থে বলেছেন “আজ যে আলাপ যে ধ্রুপদ রীতি চলছে তার স্রষ্টাও তানসেন। তাঁর হাতেই আলাপের তুকের জন্ম হল
ডঃ বিমল রায় “ভারতীয় সংগীত প্রসঙ্গ পৃষ্ঠা নং ১১৩-১১৪।
81 “Subject to certain specific rules and particulars mode of presentation ‘Tar Paran’ is almost akin to ‘gatkari’ of niboddha marga, with various rhythmic treatments, toda’s and ten Jhala ending with a tihai-all being set to a ‘tal’ of niboddha marga. Origin of Rudra Saraswati Bina/Ganendranath Das (Page-44-46) Journal of the Dept of instrumental music Vol. 4. 1991. Rabindra Bharati University. গ্রন্থপঞ্জী:
১। ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস স্বামী প্রজ্ঞানন্দ
২। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা ঐ
৩। ভারত ও তাহার সংস্কৃতি ঐ
৪। রাগ ও রূপ-ঐ
৫। রাগ-অনুরাগ রবীশঙ্কর
৬। ভারতীয় সঙ্গীত কোষ বিমলাকান্ত রায়চৌধুরী
৭। ভারতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গ ডঃ বিমল রায়
৮। ভারতীয় সঙ্গীত বাদ্য ৬ লালমণি মিশ্র
১। তন্ত্রবাদ্যে অনিবদ্ধ রাগ রূপায়ণ। আলাপ-এর ক্রমবিবর্তন- ডঃ আরতি দাস
১০। Journal of the Dept. of Instrumental Music/Rabindra Bharati University.
১১।Musical Instruments of India, Their History & Development B. C. Deva.