May 1, 2025

স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশী গানের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও সাংস্কৃতিক প্রভাব – সাথী পাঁজা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

 

সংক্ষিপ্তসার  :
স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে একটি অঞ্চল বা জাতির মধ্যে সংগ্রামীদের দ্বারা উপনিবেশিক বা বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্য অহিংস প্রতিরোধ, আইন অমান্য এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তার মত বিভিন্ন উপায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে বোঝায়। আর এই স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার তপস্যায় হোমাগ্নির সমিধ সঞ্চয় করেছিল দেশের মানুষ । সেই রকমই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন, তার স্বদেশী সংগীত –এর দ্বারা। তার এই সংগীতের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ জাগ্রত হয়ে ওঠে। তার স্বদেশ ভাবনার মধ্য দিয়ে সমাজ এক নির্ভীকতা, পল্লীপুনর্গঠন, আধুনিক চেতনা ফুটে ওঠে। বিভিন্ন সংগীতের দ্বারা সুচিন্তিত রূপ প্রকাশ পায় সমাজে। বলতে গেলে বলা যায়, সেই সময় বঙ্গভঙ্গ ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই বঙ্গভঙ্গের ফলে সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বড়োসড়ো আঘাত ঘটে। সেই বঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিবাদে স্বদেশ বন্দনা ও প্রতিবাদী চরিত্রের গান নিয়ে তিনি নিজেকে উপস্থাপিত করেন। গানগুলির মধ্যে- ‘আমার সোনার বাংলা’,’ও আমার দেশের মাটি’,’বাংলার মাটি বাংলার জল’,’বন্দে মাতরম’,’ জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ‘ইত্যাদি। এইসব স্বদেশী সংগীতের প্রয়োগ ঘটে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। তার স্বদেশী গান আবেগ সুরে ও কথায় প্রকাশ পেয়েছে সমাজে। এই সংগীত দেশবাসীর মনে পবিত্র স্বদেশপ্রেমের দীপশিখার ন্যায় বিকশিত হয়েছে। স্বদেশী সংগীতের মূল সুর হচ্ছে নির্বিকতা, আত্মশক্তিতে বলহীন অবস্থায় না রেখে, পরাধীনতার এই বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের মুখ্য উদ্দেশ্যে নিজেকে তৈরি করা। কবিগুরু তিনি তার অসামান্য বিভিন্ন সংগীতের দ্বারা দেশকে উদ্বোধিত করতে প্রচেষ্টা করেছিল এবং দেশবাসীকে জাগ্রত করতে চেয়েছিল।
কবিগুরুর অনেক জাতীয় সঙ্গীতে স্বদেশবোধ ও বিশ্ব চেতনা মিলেমিশে এক হয়ে উঠেছে। তার স্বদেশপ্রেম ছিল বিশ্ব প্রেমেরই অঙ্গীভূত। তার স্বদেশ প্রেম মূলক গানগুলি সকল দেশের মানুষের সর্বকালের জাগরনের গান। নিজেকে দুর্বল ও অসহায় ভাবা মানুষের বড় পরাধীনতা । আত্মিক পরাধীনতা এই বন্ধন থেকেই মুক্তির প্রকৃত উপায়। তার এই স্বদেশী গানগুলিতে সুর ধ্বনিত হয়, যার প্রভাব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতিতে ব্যক্ত হয়েছে। তাই এই গান গুলির মাহাত্ম্য চিরকালই প্রস্ফুটিত হয়ে থাকবে।
সূচক শব্দ:
স্বাধীনতা, স্বদেশী সংগীত, বঙ্গভঙ্গ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ঐতিহ্য, সামাজিক প্রভাব, সংস্কৃতি।

 

স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কলমের খোঁচায় বাংলাদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবল আন্দোলন আরম্ভ হয়। দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার তপস্যায় হোমাগ্নির যে সমিধ সঞ্চয় করিয়াছিল, এই বঙ্গভঙ্গ কে উপলক্ষ করে তা আজ পুণ্য বেগে প্রচলিত হয়ে উঠল। বঙ্গভঙ্গের আঘাতে আগ্নেয়গিরির অগ্নুচ্ছ্বাসের মতো তাহাই আজ প্রচন্ড বেগে বাহির হয়ে আসিল এবং দেশব্যাপী বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করিল। নদীর বাঁধ ভাঙিয়া গেলে জোয়ারের জল যেমন প্রচন্ড বেগে বাহির হয়ে আসে, এ যেন অনেকটা সেই রুপ ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
“ স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল কে পরিবে পায় হে
কে পারিবে পায়?”
মানুষ হল জন্ম থেকে স্বাধীন, দাসত্বের শৃঙ্খল তার কাছে মৃত্যু স্বরুপ। পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে আজন্ম পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধতে পারে না। বিভিন্ন মহামানবদের অবদান ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশপ্রেমের গানগুলি।

তিনি তার সংগীতের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনার বিষয়টি বেশ কঠিন। সেখানে রয়েছে নানামাত্রিক ভাবনার বিশ্ব চরিত্র তাতে স্ববিরোধিতার অভাব নেই। তার স্বদেশ ভাবনা সমাজ ভাবনা নির্ভর, সেখানে রয়েছে ভারতের ইতিহাসে উপলব্ধির মধ্যমণি প্রাচীন ভারত। সনাতন ভারত সমাজ ভাবনায় এসে যুক্ত হয়েছে ও উন্নয়ন বিষয়ক আধুনিক চেতনা রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে। ভারতের ইংরেজ শাসনের চরিত্র বিশ্লেষণ নিয়ে যখন ভারতে ইংরেজ শাসনের আধুনিকতার পতন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির রেনেসাঁস নিয়ে রবীন্দ্র চেতনায় যথেষ্ট মুগ্ধতা, তখন ইংরেজের নিষ্ঠুর বিশ্ব আগ্রাসী তথা সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে, রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদী।

ভারতে ইংরেজ শাসনের সমর্থক ভূমিকায় বিশ্বাস শুধু ঊনিশ শতকে নবজাগরণের নায়কদেরই ছিল না। ওই রেনেসাঁসের কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনায় স্বদেশীকতার সুচিন্তিত রূপ প্রকাশ পেয়েছে তার দীর্ঘ প্রবন্ধস্বদেশী সমাজে। তার রাজনৈতিক চিন্তা সমাজ ভাবনা রূপ নিয়ে প্রতিফলিত। সেই সময় বঙ্গভঙ্গ ছিল বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উপর বড়সড় আঘাত।

বঙ্গ প্রদেশের জ্বলে ওঠা আগুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর আবেগ নিয়ে বঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে একাধিক বন্ধু সহযোগে রচনা করেন। স্বদেশ বন্দনা ও প্রতিবাদী চরিত্রের বিভিন্ন গান যেগুলোর অন্যতম “আমার সোনার বাংলা”, “ও আমার দেশের মাটি”, “বাংলার মাটি বাংলার জল”, “সার্থক জনম আমার”, ইত্যাদি।১ এ আন্দোলন উপলক্ষে তিনি হিন্দু মুসলমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন ।

উনিশ শতকের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার প্রকাশ যতটা স্বদেশে শাসকদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি বিশ্বপরিচয়ের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ ভাবনার রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে তার সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক ভাবনার জোকসূত্র গভীর। সামরাজ্যবাদী শাসনের বা আগ্রাসনের চরিত্র যেমন বিদেশে তেমনি রবীন্দ্রনাথের স্বদেশে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথ তার স্বদেশ ভাবনার রাজনৈতিক পর্যালোচনায় মানবিক চেতনায় লক্ষ্য অর্জনের প্রধান শর্ত বলেছেন।

তিনি স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং ঔ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি সংগীতের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে দেশ ও প্রেমের চেতনা তৈরি করেন। তিনি তার গানের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন যা জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। দেশ, কাল, অবস্থা ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রদ্ধেয় প্রভাতবাবু লিখেছেন – “অবস্থা ও ব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠের পরে রবীন্দ্রনাথ গিরিডি ফিরিয়া গেলেন। বঙ্গছেদ আন্দোলন লইয়া তখন দেশময় উত্তেজনা। তার তরঙ্গ কবিকেও উতলা করিয়া তুলিল”।২ “আমার সোনার বাংলা” গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রখর জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। তার গান এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ঠাকুর পরিবারে নানামুখী প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারায় স্বাদেশিকতার একটি বিশিষ্ট স্থান ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর “জীবনস্মৃতিতে” লিখেছেন “স্বদেশের প্রতি পিতৃ দেবের চেয়ে আন্তরিক শ্রদ্ধা তার জীবনের সকল প্রকার বিপ্লবের মধ্যেও ছিল। তাই আমাদের পরিবারস্থ সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করিয়া রাখিয়া ছিল”।৩ আর স্বদেশী গানগুলি তারই পরিণত প্রকাশ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলে প্রথম স্বদেশী গানে ভালোভাবে সূচনা হয় হিন্দু মেলার যুগে, ১৮৬৭ সাল থেকে। সংস্কৃতির প্রতি অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা পোষণ এর মাধ্যমে নির্জীব নৈরাশ্যের ভাবকে দূর করার প্রচেষ্টা থেকেই হিন্দু মেলা আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটে। নানা প্রদর্শনীয় শিল্পচর্চার আয়োজন এর মধ্য দিয়ে লোকের মনে দেশ প্রীতি জাগিয়ে তোলাই ছিল এই মেলার উদ্দেশ্য। বাংলায় দেশাত্মবোধক গানের প্রচার ও প্রচলন বলতে গেলে এই সময় থেকে শুরু হয়েছিল। এই হিন্দু মেলার উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে সেই সময় প্রসিদ্ধ গান হিসাবে “মিলে সবে ভারত সন্তান” সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত এই গান এবং আরো ২৮ টি গান নিয়ে জাতীয় সংগীত নামে প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দু মেলার উদ্যোগে। এইসব গানে অন্য দেশের সঙ্গে স্বদেশের তুলনা ও নিজের দেশের প্রাচীন হিন্দু গৌরব কাহিনী বর্ণনা করে ক্রমাগত দেশবাসীকে উদ্ধৃত করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। হিন্দু মেলার স্বাদেশিকতার আবহাওয়া, তাছাড়া “জীবনস্মৃতিতে” উল্লেখিত সঞ্জীবনী সভার আবহাওয়ার মধ্যে গুরুদেব সেই অল্প বয়সে কিছু গান রচনা করেছিলেন। সেই থেকে তার গানে হিন্দু গৌরবের উল্লেখের চেয়ে নির্ভর চিত্তের উন্মাদনা, সংঘবদ্ধতার শক্তিতে জীবন যাপনের দৃঢ়তা, ছন্দের ঝোঁকে সুরে সুন্দর প্রকাশ পেয়েছে।

সঞ্জীবনী সভা উপলক্ষে যে গান রচিত হয়েছে, যেমন “একসূত্রে বাঁধি আছি” এই গানটি। তিনি এই সময় আরো কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন। যেমন “তোমারই তরে মা সঁপিনু এ দেহ”, “অয়ি বিষাদিনী বীণা”, ও “ভারত রে তোর কলঙ্কিত পরমাণু রাশি” ইত্যাদি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই সভার একজন উৎসাহী সভ্য। “এক সূত্রে বাঁধিয়াছি” গানটি তার প্রথম স্বদেশী গান। ১২৯১ সালের মধ্যে তিনি আরও অনেকগুলো স্বদেশী সংগীত রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- “ঢাকোরে মুখচন্দ্র মা”, “একি অন্ধকার এ ভারত ভূমি”, “মায়ের বিমল যশে”, “ও গান আর গাস নে গাস নে”, প্রভৃতি। “শোনো শোনো শোনো আমাদের ব্যাথা” গানটি মাঘো উৎসবের গান হিসেবে প্রথম রচিত। পরে জাতীয় সংগীতে একটি স্থান পায়। বিশেষভাবে স্বদেশী গানের প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় প্রভাত বাবু লিখেছেন: “স্বদেশী যুগের এই গানগুলির অধিকাংশই হইতেছে বাউল সুরে বাঁধা, বাউল সুর বাংলার নিজস্ব সুর সম্পূর্ণরূপে লোকসংগীত ধর্মী”।৪ আমার পূর্বে বলিয়াছি- “স্বদেশী সংগীত সাধারণের সুরে গেয়, সে সুর হইতেছে বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালি, সারি গানের সুর”।৫ স্বদেশী গানের অধিকাংশই দেশী লৌকিক সুরে বাঁধা।এরপর 1299 সাল পর্যন্ত ছয়টি স্বদেশী সংগীত তিনি রচনা করেন। সেগুলি হল-“আগে চল আগে চল ভাই”, “আনন্দ ধ্বনি জাগাও গগনে”, “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে”, “আমায় বোলো না গাহিতে বলো না”, “একবার তোরা মা বলিয়া ডাক”, “তবু পারি নে সঁপিতে প্রান”,। এর মধ্যে “আগে চল” ও “তবু পারিনে সঁপিতে প্রান”, গান দুটি রচনা ১২৯৩ সালে কলকাতার ছাত্র সম্মেলন উপলক্ষে এবং তিনি নিজেই গান করেন। “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে” গানটি সেই বছরে কলকাতা দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি নিজে গিয়ে শোনান। বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত “বন্দেমাতরম” গানটি কে তিনি প্রথম সুপ্রচলিত করেন।

 

রবীন্দ্রনাথের আগে যে স্বদেশী গান প্রচলিত ছিল সেগুলোতে প্রাচীন হিন্দু গৌরবের উল্লেখ ছিল প্রধান বিষয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী গান মানুষকে নির্ভয় চিত্তে জীবন পণ করে ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়ে ধ্রুবলক্ষ্যের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তার স্বদেশী গানগুলিতে তিনটি কাল পর্বে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রথমত, কবিগুরুর কিশোর বয়স থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে পূর্ব পর্যন্ত স্বদেশী গানের সংখ্যা সীমিত থাকলেও সেই গানের ভাষা গুরু গম্ভীর প্রকৃতির এবং হিন্দুস্তানের একসঙ্গে সুর তাতে ব্যবহার করা হত। গান গুলির মধ্যে- “আগে চল আগে চল”, “জননির দ্বারে আজি ওই”, প্রভৃতি তার এই গানগুলো সামাজিক সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছিল।

দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের জীবনে ১৩১২ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় স্বদেশী গানের যে বর্ণনা এসেছিল সেটা ছিল স্বদেশী গান রচনার প্রধান অধ্যায় গানের আন্তরিকতা উন্মাদনা বড় হয়ে ফুটে ওঠে। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বছরটি রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার স্বদেশী গান গানগুলি থেকে বাউল জাতীয় পল্লী সুরের বহু গানের সূচনা হয়। এই সময় গানের আন্তরিকতা ও উন্মাদনা খুব বেশি পরিমাণে ফুটে ওঠে। গান গুলির মধ্যে “আমার সোনার বাংলা”, “যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক”, “খ্যাপা তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে”, “নিশিদিন ভরসা রাখিস”, প্রভৃতি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নবজাগরণের জোয়ার আস্তে আস্তে দেখা দিয়েছিল। সেই সময় কবিগুরুর নানা উদ্দীপনামূলক জাতীয় সংগীতে তাতে নতুন বেগে সঞ্চার ঘটেছিল। সহজ কথায় সুরে বাঁধা নানা তাদের গানের মাধ্যমে দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। “এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে”, গানটি সেই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। রাখি বন্ধন উপলক্ষে তিনি রচনা করেন “বাংলার মাটি বাংলার জল”, “বিধির বাঁধন কাটবে তুমি”, ইত্যাদি গান।
তৃতীয়তঃ ১৯০৫ এর পর তিনি জাতীয় সংগীত রচনায় আর তেমন আগ্রহ দেখাননি। তিনি ভাবার্থ গান রচনা করেছেন। “জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে”, ও “দেশ দেশ মন্দিত করি”, এই গান দুটি তিনি স্বদেশ বোধের প্রেরণা থেকে লিখেছিলেন। সব জাতীয় ভাবের গান গুলির ভাষা যুক্তাক্ষর ও গম্ভীর প্রকৃতির। তার জাতীয় সংগীতের স্বদেশবোধ ও বিশ্ব চেতনা মিলেমিশে এক হয়ে উঠেছে ।

তিনি স্বদেশ কে কখনোই আলাদাভাবে দেখেননি। তার গানগুলি সকল দেশের মানুষের সর্বকালের জাগরণের গান।নিজেকে দুর্বল ও অসহায় ভাবা মানুষের সবচেয়ে বড় পরাধীনতা। আর এই পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য স্বদেশী গান সামাজিক ক্ষেত্রেও সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে।

তথ্যসূত্রঃ-
১. https/www.kaliokalam.com
2. রবীন্দ্রজীবনী, ২য় খন্ড, ১৩৫৫ সাল, পৃ -১২৩
৩. রবীন্দ্রসংগীত পরিক্রমা, অমল মুখোপাধ্যায় পৃ- ৯৬
৪. রবীন্দ্রসংগীত, শান্তিদেব ঘোষ, পৃ- ১১৬
৫. সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, পৃ-৮৮

তথ্যসূত্র
১. ঘোষ, শান্তিদেব, রবীন্দ্রসংগীত বিচিত্রা, আনন্দ পাবলিকেশন, কোলকাতা-৭০০০০৯
২. ঘোষ, শান্তিদেব, রবীন্দ্রসংগীত, বিশ্বভারতী গ্রন্থ বিভাগ, কোলকাতা-১৭
৩. বসু, ডঃ অরুণ কুমার, বাংলার কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত, দেজ পাবলিকেশন, কোলকাতা- ৭০০০৭৩
৪. ঘোষ, ডঃ শম্ভুনাথ, রবীন্দ্রসংগীত(১ম খন্ড), কোলকাতা- ৭০০০৪২
৫. মুখোপাধ্যায়, অমল, করুণা প্রকাশনী, কোলকাতা- ৭০০০০৬
৬. প্রজ্ঞানানন্দ, স্বামী, সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান, শ্রী রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা- ৭০০০০৬