বাচিক শিল্পের জন্য সর্বাধুনিক কণ্ঠ অনুশীলন প্রক্রিয়া : সাধারণ ধারণা ও বিজ্ঞান
নূর নবী মিরণ
১
আমাদের দেশে বাচিক কাজের প্রয়োজনে গলা সাধার বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। বাচিক কাজ বলতে আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে গান করা, অভিনয় করা, আবৃত্তি করা ইত্যাদি যেকোনো ধরনের কাজ যাতে কথা বলার সম্পৃক্ততা আছে এমন কাজের কথা বোঝাবার চেষ্টা করছি। এইসব কাজের ব্যবহারিক প্রক্রিয়ায় ঢোকার পর দেখতে পেলাম প্রত্যেকটা মাধ্যমের ক্ষেত্রে মাধ্যমের সাথে যারা সম্পৃক্ত, যারা যুক্ত, যারা মাধ্যম নিয়ে ভাবেন, ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন যেমন – গান, কবিতা, অভিনয় এইসব মাধ্যমে যারা কাজ করেন তাদের একটা ধারণা হলো গলার সাধার ক্ষেত্রে অর্থাৎ ভয়েস ট্রেনিং-এর বেলায় প্রত্যেকটা মাধ্যম অনুযায়ী আলাদা আলাদা ট্রেনিং প্রক্রিয়া হওয়া প্রয়োজন।
গান করা, কবিতা পড়া, অভিনয় করা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা বা সংবাদ পাঠ করা ইত্যাদি বাচিক কাজগুলোর গোড়ার দিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। এসব বাচিক কাজের গোড়ার দিকে নিগুঢ় ভাবে তাকালে দেখা যাবে প্রত্যেকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে কথা বলাটা মূলভিত্তি। বিষয়টিকে অন্যভাবে বললে দেখা যায় উল্লেখিত বিষয়গুলোর মূল কাজ হলো কথা বলা। এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে গান করা আর কবিতা পড়া তো এক নয় তাহলে কথা বলা মূল বিষয় হয় কি করে? একটুখানি ভাবলে দেখতে পাবেন মূল বিষয় কথা বলা কিন্তু কথা বলার ধরণ টা ভিন্নরূপ। কবিতার ক্ষেত্রে একরকম বলা হয় আর গানের ক্ষেত্রে একই কথাকে আরেকরকম করে বলা হয়। অভিনয়ের ক্ষেত্রে আরেকটু ভিন্নমাত্রায় কথা বলার ধরণ হয়ে থাকে। যেহেতু গান একটি মাধ্যম কবিতার একটি মাধ্যম, অভিনয় আর একটি মাধ্যম। সুতরাং এই কথা বলার মাধ্যম পরিবর্তন হওয়ার কারণেই কথা বলার ধরন পাল্টে যায়। সেই কারণে আমরা একই কথার কোন একটি কবিতাকে যখন কবিতা হিসেবে পড়ি তখন যে রূপ প্রকাশ পায় সেই কবিতায় সুর বসিয়ে গান করতে গেলে সেখানে ভিন্ন রূপ প্রকাশ পায়। কিন্তু এখানে লক্ষ্য করা দরকার যখন কবিতাটাকে কবিতা হিসেবে পড়া হয় তখন কবিতার যে শব্দচয়ন থাকে বা কবিতার শব্দগুলোকে যেভাবে উচ্চারণ করা হয় গানের ক্ষেত্রে মূল শব্দের উচ্চারণ কিন্তু ভিন্ন রকম হয় না। শুধুমাত্র কবিতার জন্য কবিতা কবিতার ঢঙে পড়া হয় আর গানের জন্য গানের আকারে বলা হয়। দেখা যায় গানের ক্ষেত্রে প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে বলা হয় কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে শব্দকে টেনে বলার মাত্রা ততটুকু থাকে না। কবিতার ক্ষেত্রে কথাতে স্বরস্থানের পরির্তনের হার কম থাকে আর গানের বেলায় স্বরস্থানের পরিবর্তনের হার বেশি মাত্রায় থাকে। এগুলিই হলো কবিতা এবং গানের ক্ষেত্রে মূল পার্থক্য।
আমাদের ধ্বনিযন্ত্র বা ভয়েস বক্স দিয়ে কিভাবে আওয়াজ তৈরি হয় তার একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা থাকা দরকার। আমাদের ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাতাসের ধাক্কা ভোকাল কর্ডের ভিতর দিয়ে বের হবার সময় ভোকাল কর্ডে এক ধরনের কম্পন সৃষ্টি করে। ভোকাল কর্ডের সেই কম্পনের ফলে একটি ধ্বনি তৈরি হয়। ফুসফুসে বাতাস ঢোকা এবং বের হবার একটিমাত্র পথ আছে আর তা হলো ভোকাল কর্ড। শ্বাসনালীর ঠিক উপরের প্রান্তে থাকে ল্যারিংস এবং ল্যারিংসের মাঝখানে থাকে ভোকাল কর্ড। যতবার আমরা শ্বাস নেই আর শ্বাস ছাড়ি প্রতিবারেই ভোকাল কর্ডের ভিতর দিয়ে বাতাস ঢুকে এবং বের হয়। তাহলে সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার সময় কোন ধ্বনি হয় না কেন? এখানে মজার বিষয় হল আমরা যখন কোন ধ্বনি তৈরি করবার জন্য মন স্থির করি কেবল তখনই ধ্বনি তৈরি হবে। মন স্থির করার সাথে ধ্বনি তৈরীর প্রক্রিয়া সচল হওয়ার একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। তা না হলে প্রত্যেকবার শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় একটি আওয়াজ হত। দেখা যায় দিনে আমরা গড়ে প্রায় ২৩ হাজার বার শ্বাস নিয়ে থাকি আর যদি প্রত্যেক বার শ্বাস প্রশ্বাসের সময় আওয়াজ হতো তাহলে ব্যাপারটা কেমন হত ভাবা যায়।
আরো একটি মজার বিষয় হল ভোকাল কর্ডের মাধ্যমে এই ধ্বনি তৈরীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া পৃথিবীর সকল মানুষের ক্ষেত্রে একই হয়ে থাকে। শুধু প্রক্রিয়াই যে এক তাও নয়। উৎপন্ন ধ্বনিও প্রায় একই রকমের হয়। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখতে পাই মানুষের কান্নার ধ্বনি, হাসির ধ্বনি, হাছির আওয়াজ, কাশির আওয়াজ ইত্যাদিতে। অর্থাৎ যে ধরনের আওয়াজে ভাষার কোন রূপ, প্রভাব বা ছাপ থাকে না সে ধরনের আওয়াজ পৃথিবীর সব মানুষের একই হয়ে থাকে। ভোকাল কর্ড এর সাহায্যে সৃষ্ট ধ্বনি আমাদের মুখের ভিতরের বিভিন্ন অংশ যেমন আলজিভ, জিভ, শক্ত তালু, নরম তালু, দাঁত, গালের ভিতরে অংশ ইত্যাদি সহ মুখের এবং নাকের ফাঁপা অংশের মধ্যে দোল খেয়ে শব্দে রূপ নেয়। অর্থাৎ ভোকাল কর্ড থেকে উৎপন্ন একটি ধ্বনি যা অনেকটা বাঁশির ধ্বনির মতো হয়ে থাকে, সেই ধ্বনি আমাদের মুখের এবং নাকের গহবরে এসে রূপান্তর ঘটায়। এখানেও দুটি অংশ আছে। একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া আরেকটি রূপান্তর প্রক্রিয়া। এই দুইটি আমাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা হল রূপান্তর প্রক্রিয়ার ফসল। ভয়েস ট্রেনিং হল সঠিক ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়া তৈরি করা এবং রূপান্তর প্রক্রিয়ার সাথে সঠিক সমন্বয় সাধন করা।
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমাদের বাচিক কাজের প্রয়োজনে কোন কোন বিষয়ের উপর আমাদের গুরুত্ব দেয়া দরকার। আমরা কথা বলি, গান করি, কবিতা পড়ি, অভিনয় করি, সংবাদ পাঠ করি কিংবা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি ইত্যাদি যত ধরনের কাজ করে থাকি তার সবকটিতেই আমরা সাধারণভাবে ধ্বনি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করে থাকি, যেটি মূলত দ্বিতীয় অংশ। বাচিক শিল্প চর্চায় আমরা এই দ্বিতীয় অংশ নিয়েই বেশি ভাবি, বেশি কাজ করে থাকি। যে প্রথম অংশের উপর ভর করে দ্বিতীয় অংশ চলে সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর থাকে না। আমরা কেবল শ্রুত অংশ নিয়েই চিন্তা করি। ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়া সঠিক থাকার পর যদি রূপান্তর প্রক্রিয়া সঠিক না থাকে তাহলে বিপত্তি ঘটে। আবার রূপান্তর প্রক্রিয়া সঠিক থাকার পর যদি ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়া সঠিক না থাকে তাহলেও সমান বিপত্তি ঘটবে। তার কারণ ধনী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গন্ডগোল হলে রূপান্তর প্রক্রিয়াতেও গন্ডগোল দেখা দেবে। সাধারণভাবে মনে হতে পারে ধ্বনি উৎপাদন প্রক্রিয়া ঠিক করে তবে রূপান্তর প্রক্রিয়া ঠিক করা যাবে। আমাদের ভয়েস বক্স নামক যন্ত্রটিতে উৎপাদন এবং রূপান্তর এই দুটি কাজ একই সাথে করতে হবে। কোন টিকে আগে বা কোন দিকে পরে করার কোন সুযোগ নেই। এই দুইটি প্রক্রিয়াকে একই সাথে সমান্তরালভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। অনেকটা রেলগাড়ির রেলের মত। সতরাং এই দুই প্রক্রিয়ার সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে যিনি যত ভালো শব্দ উচ্চারণ করতে পারবেন তার বাচনভঙ্গি, তার গানের আওয়াজ, কবিতার আওয়াজ, প্রত্যেকটি শ্রোতার কাছে অনেক গ্রহণযোগ্যতা পাবে, অনেক পরিমিত হবে, অনেক মাধুর্য সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ গান করা, কবিতা পড়া, অভিনয় করা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রের এটাই হলো মূল বিষয়। আমাদের বাকযন্ত্র দিয়ে আওয়াজ তৈরির ক্ষেত্রে বলা যায় যিনি বাগযন্ত্রের ব্যবহার যত ভালো পারবেন তার ক্ষেত্রে অভিব্যক্তি প্রকাশের উপায় তত সহজ হবে, বহু মাত্রিক হবে এবং শ্রোতার কাছে খুব সহজেই সেটা পৌঁছাবে।
ভিন্নভাবে আরেকটি উপমা উপস্থাপন করতে চাই। ধরে নেই কেউ একজন বেহালা শিখবেন অর্থাৎ বেহালা বাজানো শিখবেন। সেই ক্ষেত্রে তাকে প্রথমে শিখতে হবে বেহালায় আওয়াজ কিভাবে তৈরি হয় এবং এই বেহালা দিয়ে যত রকমের আওয়াজ তৈরি করার কৌশল আছে সেগুলো রপ্ত করতে হবে। কত ধরনের এবং কতভাবে তিনি বেহালা থেকে আওয়াজ তৈরি করতে পারেন সেটি প্রথম শিখতে হবে। তিনি প্রথমেই কোন একটি গানের সুর তোলার চেষ্টা করবেন না, এটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। বেহালা বাদ্যযন্ত্র ঠিক কি ভাবে ব্যবহার করা হয়, কত ধরনের, কত রকম ভাবে ব্যবহার করা যায় সেটাই প্রথমে শিখতে হয়। তারপরে তিনি সেই বেহালা দিয়ে তৈরি করা আওয়াজ কীভাবে কাজে লাগাবেন, কোথায় কাজে লাগাবেন সেটা নিজে ঠিক করবেন। অর্থাৎ বেহালায় তোলা সেই সুর কোন প্রয়োজনে প্রয়োগ করবেন, কোথায় ব্যবহার করবেন, কী সুর তুলবেন, কি ভাবে ব্যবহার করবেন সেটা একান্তই তার ব্যাপার। কিন্তু শুরুতেই তাকে সেই বেহালা বাদ্যযন্ত্রটিকে সঠিক ব্যবহারের প্রক্রিয়া শিখতে হবে। আমাদের বাকযন্ত্র দিয়ে আমরা কথা বলে থাকি, আওয়াজ করে থাকি, সমস্ত বাচিক কাজ করে থাকি। আমাদের বাকযন্ত্র নামক বাদ্যযন্ত্র দিয়ে যত ধরনের আওয়াজ তৈরি করা যায় পৃথিবীর আর কোন বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সেরকম আওয়াজ তৈরি করা যায় না অথচ এই বাদ্যযন্ত্রটির সঠিক ব্যবহারের প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে আমাদের জানা নেই। আর সে কারণেই যত বিপত্তি ঘটে।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে বেহালা আর আমাদের বাগযন্ত্র একরকম নিশ্চয়ই নয়। যদি বাকযন্ত্রের কে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করি তাহলে দুটি আলাদা আলাদা বাদ্যযন্ত্র। সুতরাং এই দুটি বাদ্যযন্ত্র কে আলাদা আলাদা করেই শিখতে হয়। অর্থাৎ বেহালার মত আমাদের ধ্বনিযন্ত্র নামক বাদ্যযন্ত্রটিকে আলাদা করে চিনতে হবে, শিখতে হবে, জানতে হবে। তবে যেহেতু বেহালা ছোট্ট একটি বাদ্যযন্ত্র এবং এটিকে বাইরে থেকে সম্পূর্ণটাই দেখা যায় তাই এর বাদন প্রক্রিয়া শিখে নেওয়াটা অনেক সহজতর। কিন্তু আমাদের ধ্বনিযন্ত্র বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না তাই এর শেখার বিষয়টিও কিছুটা জটিল। আরেকটি বিষয় বেহালা দিয়ে যে কয় রকমের আওয়াজ তৈরি করা যায়, আমাদের ধ্বনিযন্ত্র দিয়ে তার থেকে অনেক অনেক অনেক বেশি পরিমাণ আওয়াজ তৈরি করা যায়। আমাদের ধ্বনিযন্ত্রের বিষয় হলো যন্ত্র থেকে যে আওয়াজটা তৈরি হয়, সেটি পরবর্তীতে পরিশীলিত, পরিবর্ধিত, মার্জিত, বিভিন্ন আকরে, বিভিন্ন রূপে প্রকাশ যায়। আমাদের বাগযন্ত্র ছাড়া অন্যান্য সকল বাদ্যযন্ত্র কেবল সীমিত ধরণের আওয়াজ তৈরী করতে সক্ষম । যেমন সেতার, গীটার, সরোদ, সারেঙ্গী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র স্ব স্ব বৈশিষ্টে এক ধরণের আওয়াজ তৈরী করে।
যেহেতু উপমা হিসেবে বেহালা বাদ্যযন্ত্র টিকে আমরা এখানে উপস্থাপন করছি তাই বেহালার কথা বলা হচ্ছে। বেহালার দুটি দিক আছে। একটি হলো তার কাঠামোগত দিক আরেকটি হলো তার ব্যবহারিক দিক। তাকে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই কিন্তু তাকে ব্যবহার করতে হবে। কেবল বেহালার ক্ষেত্রে নয়, সকল বাদ্যযন্ত্রের বেলাতে কাঠামগত দিক বিবেচনা করে ব্যবহারিক দিক নির্ধারণ করা হয়। তা না অলে বাদ্যযন্ত্রটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে শুধু যে বাদ্যযন্ত্র থেকে সঠিক আওয়াজ বের করা যাবে না তা নয়, বাদ্যযন্ত্রটি অকালে নষ্টও হয়ে যেতে পারে। এইসব বাদ্যযন্ত্র যেহেতু দৃশ্যমান তাই এর বাদন প্রক্রিয়াও দৃশ্যমান হয়ে থাকে।
আমাদের বাগযন্ত্র, যার সাহায্যে আমরা সকল প্রকার আওয়াজ তৈরী করি সেটিকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট বাদ্যযন্ত্র। অন্যান্য সকল বাদ্যযন্ত্র থেকে এর মৌলিক পার্থক্য হল অন্য সকল বাদ্যযন্ত্র পুরটাই দৃশ্যমান আর এটি পুরটাই অদৃশ্য থাকে। সে কারণে এর ব্যবহারবিধি অন্য সকল বাদ্যযন্ত্রের মত হয় না। কিন্তু এর ব্যবহার আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। অথচ এর সঠিক ব্যবহার বিধি না জেনেই আমারা একে ব্যবহার করে চলেছি। অনেকটা গাড়ি চালানো না শিখে চালকের আসনে বসে পড়ার সামিল। বুঝতেই পারছেন গাড়ি চালাতে না জেনে গাড়ি চালালে কি রকম ঘটনা ঘটতে পারে। কোন যে ভালো ফল আমরা আশা করতে পারি না তা নিয়ে মনে হয় আমাদের কারো মনে কোন সংশয় নেই। তার কারণ বিষয়টি পুরোটাই আমরা দেখতে পাই।
এইরকম ঘটনা আমাদের বাচিক কাজের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। আমরা সেই ঘটনাগুলিকে কাল্পনিকতার মোড়কে ফেলে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে দায় মুক্তি পাই। এটি বাচিক কাজের যেকোনো মাধ্যমের বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য। অতি সামান্য এবং সাধারণ কিছু প্রক্রিয়া প্রতিদিন স্বল্পসময়ের জন্য চর্চা করলে কন্ঠস্বরের এহেন বিপত্তি থেকে আমরা খুব সহজেই নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হব।
আরেকটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমাদের অনেকেরই ধারণা পশ্চিমা ভয়েস ট্রেনিং এর দ্বারা আমাদের এ অঞ্চলের গান গাওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে ভারতীয় রাগ সংগীত। এই ধারণার সাথে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। কারণ আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে ভয়েস ট্রেনিং করা আর গান করা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। একটি হলো ধ্বনিযন্ত্র নামক বাদ্যযন্ত্রটিকে ব্যবহার করতে শেখা আর অন্যটি তাকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা। যেমন এর আগে বলেছি গাড়ি কে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য আগে গাড়ি চালানো শিখতে হয় তারপর তার ব্যবহার করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কম্পোজার ভি বালসারার একটি কথার উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। আমরা সকলেই জানি তার পিয়ানো বাজাবার দক্ষতার কথা। অসাধারন পিয়ানো বাজাতেন। তার ৮৩ বছর বয়সে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি বহুকাল পিয়ানো বাজিয়েছেন অনেকটা হারমোনিয়াম বাজাবার মত করে। তখনো তিনি পিয়ানো বাজাবার সঠিক নিয়ম জানতেন না। সেই অবস্থাতেই তিনি বহু হিন্দি ছবির গানে পিয়ানো বাজিয়েছিলেন। তারপর তিনি এক জার্মান পিয়ানো ট্রেইনারের কাছে গিয়ে পিয়ানো বাজাবার সঠিক পদ্ধতি শিখলেন। সঠিক পিয়ানো বাজনা শেখার পর তিনি এও বলেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার জন্য তাকে সঠিক পদ্ধতিতে পিয়ানো বাজানো চলবে না। তাকে তার নিজস্ব বাজানোর ঢঙেই পিয়ানো বাজনা ধরে রাখতে হবে। পরবর্তীতে আমরা তার সঠিক পদ্ধতিতে পিয়ানো বাজনার আসল রূপ দেখতে পাই। এখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন ভি বালসারা যেহেতু জার্মান প্রশিক্ষকের কাছে পিয়ানো বাজনা শিখেছেন আর যেহেতু সেই জার্মান প্রশিক্ষক ভারতীয় রাগ সংগীত কিছুই জানতেন না সেহেতু ভি বালসারা কে দিয়ে পিয়ানোতে রাগ সংগীতের সুর বাজানো সম্ভব হবে না। এই প্রশ্ন কতটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখেছি? জার্মান ট্রেইনারের কাছ থেকে পিয়ানো বাজানোর কৌশল শেখার পর তার বাজনা আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
(ভি বালসারার যে ভিডিও’র কথা উল্লেখ করা হায়েছে এটি – https://www.youtube.com/watch?v=thXUWWYPsMo
** লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে এই লেখার অংশবিশেষ মুদ্রণ ও প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে **
V Balsara
voicetrainermiron@gmail.com
নূর নবী মিরণ