September 23, 2019

শিল্পে নান্দনিকতা : দর্শন

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

লোপামুদ্রা চক্রবর্ত্তী, অতিথি অধ্যাপিকা, মেমরি কলেজ

শিল্প বিষয়টি মানব সভ্যতা সৃষ্টির সাথে সাথে রূপ লাভ করেছে। যতদিন মানব-সভ্যতার প্রকৃত বিকাশ ঘটেনি ততদিন সে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সাথে লড়াই করেছে শুধুমাত্র জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য কিন্তু যেদিন থেকে মানুষ তার জীবন ধারণের সমস্যা কিছুটা দূর করতে পারলো, সেদিন থেকেই সে জীবন এবং জগতের সৌন্দর্য্যতা সম্পর্কে জ্ঞাত হতে থাকলো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “শিল্প হচ্ছে তাই যা নিছক প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তাগিদ থেকে মানুষকে চালনা কোরে শিল্প সৃষ্টিতে নিযুক্ত করে”। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি শিল্প তত্ত্ব সম্পর্কে অনেকটাই যুক্তিযুক্ত সুতরাং বলা যাচ্ছে যে, কোনো সভ্যতার আমরা তখনই দিক্‌-চিহ্ন নির্ণয় করি যখন থেকে মানুষ নানা ভাবে জীবন, জগৎ ও প্রকৃতির মধ্যেকার সৌন্দর্য্য খোঁজার এবং তাকে জীবনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার সাধনায় মেতে ওঠে।

শিল্পের জগৎ এবং শিল্পের বিষয়বস্তু এত বিভিন্ন ও এত বৈচিত্র্যময় যে তাকে বিশেষ একটি কোনো সংজ্ঞা বা বিশেষণের মাধ্যমে হয়তো সঠিকভাবে বোঝানো যায় না। তাই শিল্পের সংজ্ঞা বিষয়ে অনেক মত ও মতান্তর আছে। বিভিন্নভাবে শিল্পের ব্যাখ্যা আছে, বিভিন্নভাবে শিল্প ও সৌন্দর্য্যের সম্পর্ক নির্ণয় করা আছে, বিভিন্ন বিষয়ে যেমন নাটক, গান, কবিতা, ছবি অথবা বৃহত্তর অর্থে শিল্পের নানাবিধ শাখা-প্রশাখার মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন বড় বড় সংগীতজ্ঞ, শিল্প ও কবিদের মধ্যে শিল্পের আদর্শবাদ অথবা প্রয়োজনবাদ নিয়ে বহু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তারা দুটি বিষয়ে একমত হয়েছেন। প্রথমত, তাঁদের মতানুযায়ী শিল্প হচ্ছে, মানুষের মধ্যে ভাব প্রকাশের যে একটি অবিরত তাগিদ আছে তারই বাহ্যিক রূপায়ণ এবং দ্বিতীয়ত, শিল্প মানুষকে সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের কাছাকাছি নিয়ে যায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাগেশ্বরী প্রবন্ধমালা’ গ্রন্থে শিল্পের বিষয়ে বড় সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। তিঁনি বলেছেন- “মানুষের আদিমতম শিল্পে তার প্রথম জয়যাত্রার আনন্দ ও উৎসাহের প্রভাব এবং তেজ লক্ষ্য করা যায়। জড়তা থেকে মুক্তি দেওয়ার আনন্দ ও ভোগের অধিকার বাড়িয়ে দেওয়া এবং মানুষকে ক্ষমতাবান করে তোলা, রস-সৃষ্টি ও রূপ-সৃষ্টি বিষয়ে এই হ’লো শিল্পের কাজ।” অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তি একজন বড় প্রতিভাবান শিল্পীর অন্তরের কথা এবং তা একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। এই ছোট্ট বক্তব্য থেকে আমরা শিল্প সম্মন্ধে অনেকগুলি তথ্য ও তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হই। প্রথমত, শিল্প ও আনন্দ পরস্পর অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত এবং যিনি সৃষ্টিশীল ব্যক্তি তার প্রতিভার মধ্যে সৃষ্টির শুধু উৎসাহই নেই, আছে অমিত তেজ; দ্বিতীয়ত, আমরা জানতে পারি শিল্পের একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। তার বক্তব্য অনুযায়ী শিল্প হচ্ছে জীবন্ত। শিল্প স্থবির নয়, জড় নয়; স্থবিরত্ব বা জড়ত্ব থেকে মুক্তিলাভেই শিল্পের সার্থকতা। আধুনিক যুগে বহু ইউরোপীয় পণ্ডিত এই ভারতীয় শিল্প তত্ত্বের বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত শিল্প সমালোচক Roger Fry বলেছেন – “Art demands the most complete detachment from the meanings and implications of appearances.” অর্থ্যাৎ শিল্পীর কাছে তিনি একটি নিরপেক্ষ ও নির্বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী আশা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গী Objective শিল্প সৃষ্টির পক্ষে প্রভুত সহায়ক। ভারতীয় ধারণাতেও এই নির্বিশেষ ও নিরপেক্ষ বক্তব্য বহু আগেই ঘোষিত হয়েছে। শুধুমাত্র তাই না, শিল্প সৃষ্টি কার্যে শিল্পী যে এক ধরণের বৈরাগ্য আনা প্রয়োজন সেই কথাও ভারতীয় এবং ইউরোপীয় উভয়তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে জানা যাচ্ছে।

বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু বলেছেন যে, শিল্প হলো ‘বিশেষ সৃষ্টি’, তা স্বভাবের অনুকরণ নয়। শিল্প হলো শিল্পীর ধ্যান বা চিন্তা। উদাহরণ স্বরূপ, ভারতবর্ষে আমরা ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি দেখে আসছি; বহু ভাস্কর্যের খোদাই করা মূর্তি। যেখানে সেই মূর্তি সঠিক শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সেখানে আমরা খুব সহজেই আন্দাজ করতে পারি যে শিল্পীর মানসিক গঠনে এবং শিল্প-সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মুহুর্তে বুদ্ধের ধ্যান গম্ভীর প্রকাশকে তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করেছেন। নাহলে, বুদ্ধের ধ্যানী মূর্তি সার্থকতার সাথে তিনি আমাদের উপহার দিতে পারতেন না। দর্শক যখন এই ধ্যানী বুদ্ধ মূর্তি দেখার সময় কিংবা পরবর্তী সময়ে এক বিশেষ চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন হন, তখনই শুরু হয় নান্দনিক প্রক্রিয়া। তাই আমরা দেখতে পাই যে, শিল্পতত্ত্ব এবং নন্দনতত্ত্ব একটি অপরের পরিপূরক কিন্তু যদিও সমার্থক নয়। শিল্পী যে বুদ্ধমূর্তি কল্পনা করে তাকে রূপদান করেছেন তা কোনো নির্দিষ্ট বুদ্ধ নয়। একটি নিরপেক্ষ ও নির্বিশেষ ধারণা যা একদিকে ধ্যানগম্ভীর ভাবের প্রতিরূপ, এমন কল্পনার মাধ্যমেই ধ্যানীবুদ্ধের লীলাকে শিল্পী ধরে রেখেছেন। দর্শক, শ্রোতা বা পাঠক যখন ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি প্রত্যক্ষ করছেন, শকুন্তলার পতিগৃহে যাওয়ার সময় কণ্বমুনির উপদেশ শুনছেন অথবা Hamlate-এর সেই সুবিখ্যাত স্বগোতোক্তি “to  be  or  not  to  be” ইত্যাদি নিজকণ্ঠে স্থিরচিত্তে আবৃত্তি করছেন অথবা ভারতীয় সংগীতের ধ্রুপদাঙ্গ আলাপ শুনছেন ভৈরবী রাগের মধ্য দিয়ে তখন তাদের দিক থেকেও এক ধরণের ‘কল্পনা-প্রতিভার’প্রয়োজন এই সব শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় ‘রস’-কে হৃদয়ে এবং মানসিক ভাবে ধারণ করার জন্য। শ্রোতা বা পাঠক বা দর্শকের কাছে যখন কোনো শিল্পকলা উপস্থাপিত হয় তখনই শুরু হয় শিল্পের দ্বিতীয় পর্যায় অর্থ্যাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে হয় ‘শিল্প-সৃষ্টি’ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয় ‘রস-সৃষ্টি’—তখন শিল্পকলা আর শিল্পীর নিজস্ব ভাণ্ডারে না থেকে সমগ্র কাছে ছড়িয়ে যায়।

ভারতীয় রসবাদীগণ সুন্দরকে রস, ধ্বনি এবং ব্যঞ্জনার মধ্যে খুঁজেছেন; পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকগণ শিল্পকে দর্শন, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রের মধ্য দিয়ে খুঁজেছেন আর শিল্প-রসিক হচ্ছেন একদিকে শিল্প-সৃষ্টি ও অন্যদিকে সৌন্দর্য্য খোঁজার মধ্যবর্তী সেতুবন্ধ। সৌন্দর্য্য শাস্ত্রকে I.A. Richards বলেছেন- ‘It  is  a  value’;  কোলরিজ এবং রবীন্দ্রনাথ সুন্দরকে বলেছেন- ‘রুচির প্রকাশ’; আর সর্বপ্রথম Baumgarten ‘Aesthetics’ শব্দটিকে ব্যবহার করে নন্দনতত্ত্বের বিষয়টিকে সৌন্দর্য্য-চেতনার সমার্থক অর্থে ব্যবহার করেছেন।

১। ‘কল্পনা-প্রতিভা’ শব্দটি কবি জীবনানন্দ দাস সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন কাব্য-সৃষ্টির সময়।

তাহলে আমরা বলতে পারি যে, প্রথম পর্যায়ে ঘটনাবলী শিল্পতত্ত্বকে কেন্দ্র করে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘটনাবলী নন্দনতত্ত্বকে কেন্দ্র করে। এইভাবেই শিল্পশাস্ত্র ও সৌন্দর্য্য-চেতনা তথা নন্দনতত্ত্ব পরস্পরের হাত ধরে একটি পরিপূর্ণ অখণ্ড সৃষ্টির আনন্দতত্ত্ব মানব-সমাজকে উপহার দিয়েছে। এখন শিল্পশাস্ত্র বিষয়টি সম্পর্কে বলতে গেলে বলাই বাহুল্য যে শিল্প-সৃষ্টির প্রক্রিয়া, শিল্প-বস্তু, শিল্পী এবং শিল্পীর বিভিন্ন মানসিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা। অন্যদিকে নন্দনতত্ত্ব বিষয়টি শিল্প-দর্শন সম্মন্ধিত অথবা শিল্প-আস্বাদনের ফলস্বরূপ যে রস বা আনন্দ-চেতনা দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় তাকেই কেন্দ্র করে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। এখানে শিল্প অর্থে এর বৃহত্তর পটভূমিকে কল্পনা করা হয়েছে অর্থ্যাৎ সংগীত, নৃত্য, নাটক, কাব্য, সাহিত্য, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য প্রভৃতি ক্রিয়াত্মক শিল্প-কলা সমস্তই এর অন্তর্ভূক্ত।

শিল্পের যে প্রধান ধারাগুলি আছে প্রথমে সেইগুলি সম্পর্কে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে আমরা শিল্পের একটি সাধারণীকৃত রূপ খুঁজে পাবো। প্রথম বিষয়টি নেবো চিত্রকলা বা অঙ্কন শিল্প- এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত “ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ” গ্রন্থে একটি প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। এই শ্লোকটি বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্রের টীকাকার যশোধর পণ্ডিত কর্তৃক রচিত; এখানে আলেখ্য হিসেবে বর্ণিত হলো-

“রূপভেদাঃ প্রমাণানি ভাবলাবণ্যযোজনম্‌।

সাদৃশ্যং বর্ণিকাভঙ্গ ইতি চিত্রং ষড়ঙ্গকম্‌।।”

অর্থ্যাৎ চিত্রশিল্পের যে ছয়টি অঙ্গ আছে যথা- রূপভেদ, প্রমাণ, ভাব, লাবণ্য, সাদৃশ্য এবং বর্ণিকাভঙ্গ এই ছয়টি অঙ্গ বিশেষরূপে সজ্জিত হলে একটি চিত্রকলা আমাদের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গ্রন্থে আরো জানা যায় যে তিনি ঐতিহ্যময় জাপানী শিল্পরীতিকেও অত্যন্ত মর্যাদা দিয়েছেন অর্থ্যাৎ জাপানী শিল্পরীতির যে সহজ-সরল সৌন্দর্য্য যেমন- একটি অতিসামান্য তুলির টানে যে নিরাভরণ সুন্দরের সৃষ্টি জাপানী শিল্পীরা করেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠকুর তাকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। কাব্য বা কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই ভিক্টোরীয় যুগের প্রখ্যাত কবি ও সমালোচক Mathew  Arnnold  বলেছেন- “Poetry  is  the  criticism  of  life”.  এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারছি যে কবিতা বা কাব্য মানুষের জীবনবোধের সাথে শুধু অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িতই নয়, কাব্য বা কবিতা হচ্ছে জীবণের এক বিশেষ ধরণের সম-আলোচনা বিশেষ অর্থ্যাৎ কবিতা বা কাব্যে জীবণকে শুধুমাত্র দেখে তার হুবহু প্রকাশ নয় বরং কবি বা শিল্পী জীবনকে যে ভাবে দেখতে চান, জীবনের নিগূঢ় অন্তর্নিহিত অর্থ যেভাবে খুঁজে পেলে তার মন জীবনসত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে সেইভাবেই জীবনকে কাব্যের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান করে তোলেন। সাহিত্যের প্রসঙ্গে আমরা কবিগুরুর কথা আলোচনা করতে পারি।

২। বাগেশ্বরী প্রবন্ধমালা— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবিগুরু ‘সহিত’ শব্দটির উপর বিশেষভাবে জোড় দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে- মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কই হলো সাহিত্য সৃষ্টির মূল। তিনি আরো বলেছেন যে- “আমরা যাকে বলি সাহিত্য, বলি ললিতকলা, তার লক্ষ্য এই উপলব্ধির আনন্দ, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর একাত্ম হয়ে যাওয়ার আনন্দ। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশে শিল্পকে বাস্তববাদীতার সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো হয়ে থাকে। George Lukace-এর মন্তব্য এই প্রসঙ্গে বিশেষ স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন যে- “ Art  is  one  of  the  forms  through  which  man  can  reflect  or  grasp  reality.”

এবার আমাদের শিল্পকলার আরো দুটি প্রধান শাখা নাটক ও সংগীত বিষয়ে জানা প্রয়োজন। আচার্য ভরত নাট্যশাস্ত্র নামক সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন এবং সেই গ্রন্থে নাট্যচর্চার বিশদ-বিশ্লেষণ করে নাটককে তিনি ‘পঞ্চমবেদ’ নামে অভিহিত করেছেন। এই ‘পঞ্চমবেদ’ নামকরণের পিছনে পৌরাণিক একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে। কাহিনীটির সংক্ষিপ্তসার হলো এই যে—একসময় ব্রহ্মার কাছে দেবতাগণ নিবেদন করলেন যে ব্রহ্মা এমন একটি বেদ রচনা করুন যা সর্বসাধারণ্যে জ্ঞাত হবে এবং যা দৃশ্য ও শ্রাব্য-ও হবে। এই নিবেদন শুনে ব্রহ্মা এমন একটি বেদ রচনা করলেন যা সর্বতোভাবে লোকাশ্রয়ী, যা ‘পঞ্চমবেদ’ নামে পরিচিত এবং এই ‘পঞ্চমবেদ’-ই নাট্যবেদ যা সর্বস্তরের লোকের মনোরঞ্জন করায় সক্ষম। আচার্য ভরত যে শ্লোকে এই নাট্যসৃষ্টির কথা বলেছেন তাতে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার ভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত তিনি বলেছেন যে, ত্রিলোকের অধিবাসীদের জন্য এই নাট্যশিল্প-কলা; দ্বিতীয়ত বলেছেন, নাট্য হচ্ছে লোকবৃত্তির অনুকরণ অর্থ্যাৎ ব্যক্তি-মানুষের সামাজিক ক্রিয়া-কর্মের প্রতিরূপ; তৃতীয়ত উত্তম, মধ্যম এবং অধম সর্বস্তরের মানুষ নাট্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে; চতুর্থত, এই নাট্য হচ্ছে মানব মনের ‘ভাবানুকীর্তন’। অপর একটি শ্লোকে তিনি বলেছেন যে-            

“ন তদ্‌জ্ঞানং ন তচ্ছিল্পং ন সা বিদ্যা ন সা কলা।

ন তৎ কর্মং ন যোগোহসৌ নাটকে যন্নদৃশ্যতে।।”

অর্থ্যাৎ এমন কিছু বাস্তবে নেই যা নাট্যশিল্পে নিহিত নেই বা অধিগত হবেনা। নাট্যশিল্পের এমন সার্বজনীন ও গণতান্ত্রিক ধারণা এযুগের পক্ষেও রীতিমতো আধুনিক মনে হবে। সংগীত বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে গেলে প্রথমে প্রাচীন বর্ণিত কিছু কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমত, আমরা সংগীতকে নাদবিদ্যা বলে জানি। ‘বৃহদ্দেশী’ গ্রন্থ রচয়িতা মতঙ্গমুনি এই নাদকে ব্রহ্মস্বরূপের সাথে একাত্ম করে দেখেছেন। সুতরাং সেই দিক থেকে বিচার করে আমরা সংগীতকে ব্রহ্মবিদ্যা বলে থাকি। আবার ক্রিয়াত্মক দিক্‌ থেকে সংগীতকে আমরা নৃত্য, গীত ও বাদ্যের মিলিত শিল্পজনিত সমাহার রূপেও আখ্যা দিতে পারি। তাহলে দেখা যাচ্ছে গীতের সাথে বাদ্য ও নৃত্য এই দুটি শিল্পও জড়িত। নৃত্যের মধ্যে দিয়ে অভিনয়ের ভাব, ছন্দোরূপ ও লাস্যরূপ এই তিনটিই আমরা পাচ্ছি এবং বাদ্যের মাধ্যমে লয় ও মাত্রার আশ্রয় গ্রহণ করেছি। এই ব্যাখ্যাকেও আমরা Aesthetics  Approach বলতে পারি।

প্রাচীন ভারতীয় সংগীতশাস্ত্র পড়লে আমরা দেখতে পাই সংগীতের ভিত্তি যে নাদের মধ্যে নিহিত, সেই নাদের সম্পূর্ণ দার্শনিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দিতে মতঙ্গমুনি তাঁর ‘বৃহদ্দেশী’ গ্রন্থে নাদের সম্পূর্ণ দার্শনিক ব্যাখ্যা করেছেন যাকে ভাববাদী প্রত্যয় বলে চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং সংগীতকে আমরা এমন একটি বৃহৎ শিল্প-পরিধির মধ্যে দেখতে পাই যেখানে কলা, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদির সাথে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার সম্মিলিত রূপ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের বক্তব্য অনুসারে—“শিল্প-শাস্ত্র সমূহের দ্বারা যজমান নিজের আত্মাকে ছন্দোময় করিয়া যথার্থ যে সংস্কৃতি তাই লাভ করেন এবং প্রাণের সহিত বাক্যকে, চক্ষুর সহিত মনকে,  শ্রোত্রের (কর্ণ) সহিত আত্মাকে মিলিত করেন।” এই ধারণা ঋষিগণ আধ্যাত্ম-চেতনার অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তাই বলে এই নয় যে এর সাথে লোকায়ত চিন্তা সম্পৃক্ত ছিলোনা। ভারতীয় ভাস্কর্য্য লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে ভারতীয় সমাজ ও তার বৈচিত্রময় ইতিহাসের প্রতিফলন কিভাবে তার মধ্যে দেখা গেছে। প্রেমের শরীরি অস্তিত্ত্বকে বা প্রজননের বিষয়টিকেও যে কত সহজ-সরল ভাবে বাস্তবতা এবং সৌন্দর্য্যের সাথে দেখেছেন ভারতীয় শিল্পীরা তার প্রমাণ মন্দিরগাত্রের অসংখ্য অজস্র মৈথুনচিত্র। পাশ্চাত্য শিল্প-রসিকগণ ভারতীয় শিল্পকে অনেক সময় সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি এবং সেই কারণের নীহার রঞ্জন রায় সম্ভবতঃ মন্তব্য করেছেন— “it  was  prejudiced  for  long  by  what  seems  to  me  a  wrong  approach”.  আবার রবীন্দ্রনাথও শিল্পের সংজ্ঞা বিচার করতে গিয়ে কল্পনাকেই প্রধান স্থান দিয়েছেন।

দর্শন ও শিল্প সম্মন্ধে আলোচনা করতে গেলে এদের মধ্যেকার সম্মন্ধটুকু আগে আমাদের নির্ণয় করা প্রয়োজন। দর্শন ও শিল্প উভয়ে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে অনুস্যূত। এই পারস্পারিক মিলটুকু দুটি অর্থে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, শিল্প এবং দর্শন এই দুটিকেই সৃষ্টি ও নির্মাণ বলা চলে। চিত্রশিল্পী যখন ক্যানভাসের উপর ছবি আঁকেন তখন তিনি সেই ক্যানভাসের উপর একটি ক্ষুদ্র জগতের সৃষ্টি করেন। রং, তুলি, রেখা প্রভৃতি দ্বারা তিনি মনের ভাবকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠেন অর্থ্যাৎ “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আলো, রেখা, রং তার শিল্পকর্মের উপাদান। কবি তার কাব্যে অথবা সংগীত শিল্পী তার সংগীতে অতীতে দেখা অনেক ঘটনার স্মৃতি বা অতীতে শোনা কোনো রাগ-রাগিণীর রেশটুকু যখন তাদের শিল্পে যুক্ত করেন তখন সেই কাব্য বা সংগীত হয়ে ওঠে অনবদ্য। গায়ক স্বরগ্রামের অনন্ত সীমাহীন বৈচিত্রটুকু নিজের সংগীতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তখনই জন্ম নেয় Sonata  বা Symphony। দ্বিতীয়ত, শিল্পীর মতো দার্শনিকও সবটুকু গ্রহণ না করে প্রয়োজন মতো অংশ নিয়ে নিজের আপন জগতটুকু নির্মাণ করেন। মানুষের অভিজ্ঞতার অসংখ্য, সীমাহীন ইন্দ্রিয়পাত্তের মধ্যে থেকে তিনি বাছাই করা

৩। An  Approach  to  Indian  Art.

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীকে নির্বাচন করেন এবং সেই ঘটনাবলী সাজানোর মৌল নীতিগুলির মধ্য থেকে কতগুলো নীতি বাছাই করে নেন। এই বাছাই করা নীতির মাধ্যমে তিনি তার দর্শন-সংস্থা গড়ে তোলেন; তার নীতি সংস্থার গঠন গড়েন; জীবন, জগৎ ও ভাগ্য সম্মন্ধে নিজের চিন্তা থেকে একটি সামগ্রিক দর্শনচিন্তার রূপ দান করেন। আমরা এবং অনেক শিল্পীরাও মনে করেন যে, শিল্পীরা শিল্প-উপাদান এবং ঘটনাবলীকে নির্বাচন করে ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হয়ে এদের একত্রিত শিল্প রূপটুকু সৃষ্টি করেন। অবশ্য শিল্পীর এই হৃদয়াবেগ বিবেচনার দ্বারা পরিশীলিত এবং একজন দার্শনিকও এই একই ধরণের কাজ করেন। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, একজন শিল্পী এবং একজন দার্শনিক মানব জীবন ও জগতকে নিয়ে একই ধরণের কারবার করেন। উভয়ে একই ধরণের প্রাকৃতিক সত্যকে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন, তাদের উভয়ের মধ্যে রয়েছে একটি গভীর ধ্যানমূর্তি এবং শিল্প যে দর্শনের সাথে একই আসনে আসীন সে কথা গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের উক্তির মাধ্যমে জানা যাবে যে- “দর্শন হলো একপ্রকার সূক্ষ্ম-সংগীত”। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শিল্পের সাথে দর্শনের একটি ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। সেই যোগসূত্র কখনও প্রত্যক্ষ এবং কখনও পরোক্ষ। বেনেদাত্তো ক্রোচের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে খুবই স্মরনীয় এবং সেই সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন উক্তি থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে ক্রোচের শিল্প সম্মন্ধে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা ও নান্দনিক ধারণা যে কতখানি পরিব্যাপ্ত এবং বিস্তৃত ছিলো। উক্তিটি হলো— “The  most  lofty  manifestations ,  the  summits  of  intellectual  and  of  intuitive  knowledge  shining  from  afar,  are  called  as  we  know,  Art  and  Science.  Art  and  Science  then, are  different  yet  linked  together , they  meet  on  one  side, which  is  the  aesthetic  side.”

তাহলে আমরা বলতে পারি যে একজন দার্শনিক শিল্পকে অথবা একজন শিল্পী দর্শনকে কখনও ন্যায়সঙ্গত ভাবে উপেক্ষা করতে পারেননা। দার্শনিক সামগ্রিক চিন্তার আশ্রয় নিয়ে যে বিচারটুকুর অনুধাবনে প্রত্যহ যত্নবান এবং যে প্রজ্ঞাটুকুকে তিনি আবিস্কার করেন এই সৃষ্টির মধ্যে, একজন শিল্পীও তাকেই খুঁজে ফিরেছেন তার নিজের সৃষ্টির ছোট্ট ভুবনে নিজস্ব শিল্প উপকরণটুকুকে আশ্রয় করে। শিল্পীর সৃষ্টির জগতে আমরা দার্শনিকের চিন্তা-শৃঙ্খলার মূর্তি দেখি। শিল্প দার্শনিকগণের সযত্ন-দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ দার্শনিক যে শৃঙ্খলাটুকু প্রদর্শন করার জন্য যত্নবান, শিল্পীর শিল্প-কর্মে তারই প্রতিষ্ঠা; বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড চরাচরে যে প্রজ্ঞার নিদর্শন রয়েছে শিল্প তারই অনুকার। এই প্রসঙ্গে আমরা দেখি গ্রীক দার্শনিক প্লেটো যদিও বলেছিলেন “Art  is  doubly  removed  from  reality”  অর্থাৎ শিল্প হচ্ছে অনুকরণের নিছক অনুকরণ মাত্র কিন্তু প্লেটোর প্রত্যক্ষ শিষ্য অ্যারিস্টটল reality  বলতে অন্য একটি বক্তব্য দাঁড় করিয়েছেন। Reality  প্রসঙ্গে তিঁনি বস্তুর ‘বিশেষরূপ’-কে মনে করেছেন অর্থ্যাৎ reality-র ক্ষেত্রে সামান্যীকরণের পরিবর্তে ‘বিশেষ’-এর নির্দিষ্ট এবং প্রতিভাত রূপকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শিল্প ও সত্যের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক সম্মন্ধেও তিঁনি প্লেটোর থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। প্লেটো শিল্পকে অনেকটাই মিথ্যার জগৎ মনে করতেন কিন্তু অ্যারিস্টটল শিল্পকে সত্যের আধার-রূপ বলেছেন অর্থ্যাৎ শিল্প-বস্তুর মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের এমনকিছু শাশ্বত অথচ নির্দিষ্ট মূল্যবোধে পৌঁছই যা আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে কবি Keats-এর ‘Ode  on  a  Grecian  Urn’ নামক কবিতাটি মনে করা যেতে পারে। গ্রীসের সেই শিল্প-কর্মটির মধ্যে দিয়ে Keats  শিল্পের চিরন্তন রহস্য বুঝতে পেরেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিঁনি এই সত্যে পৌঁছান যে, সত্য ও সুন্দর সমাত্মক। সুতরাং অ্যারিস্টটল প্রসঙ্গে আমরা শিল্পকে যে সত্যের আধার মনে করেছি, Keats-এর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেই উক্তি সমর্থিত হয়। অ্যারিস্টটল আমাদের কাছে- শিল্প মানুষের কাছে কি ধারণা অথবা কি ধরণের অবস্থার সঞ্চার করে- সে বিষয়ে সুন্দর একটি তত্ত্ব উপহার দিয়েছেন। যেমন- কোনো দর্শক নাটক দেখাকালীন নাটকের ঘটনাবলী, চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাতে এমনকি যাকে আমরা বলে থাকি অতি-নাটকীয় ঘটনা, সেই সমস্ত ঘটনাবলী দর্শকের মনে প্রচণ্ড আলোরণ সৃষ্টি করে যা থেকে শিল্প ও শিল্পের দৃশ্যরূপ সম্পর্কে দর্শকের মনে ভীষণভাবে অভিঘাতের সৃষ্টি হয়। গ্রীক ভাষায় এই তত্ত্বকে অ্যারিস্টটল ‘Katharsis’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে সংসারে অনেক অতিরঞ্জিত ঘটনা ঘটে যা নাটকেও প্রকাশ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু নাট্যকার যখন তাকে শিল্প-রূপ দেবেন তখন তাতে আবেগ সঞ্চারিত নিশ্চই হবে, বিয়োগান্ত নাটকে দর্শকের মন দ্রবীভূত হবে তা সত্ত্বেও নাট্যকার শেষ পর্যন্ত দর্শককে এমন এক জগতে নিয়ে যাবেন যেখানে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা এবং বিয়োগব্যাথার স্তর অতিক্রম করে দর্শকের মনের মধ্যেকার আলোরণ পরিশেষে শান্ত হবে এবং জগত সংসারকে এক স্বচ্ছ ও মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম হবে। ইংরেজ কবি John Milton  তাঁর ‘Samson Agonistes’ নাটকের শেষে বলেছেন, দর্শকের মনে যেন এই আবেগই সঞ্চারিত হয় যার স্বরূপ ‘Calm  of  mind  all  passion  spent’Milton-এর এই সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা অ্যারিস্টটলের ‘Katharsis’-এই তত্ত্বটি অনুধাবন করতে সক্ষম হই। অ্যারিস্টটল শিল্প সম্মন্ধে বলতে গিয়ে আরো বলেছেন যে— “A  beautiful  objects  depends  on  magnitude  and  order”  ‘Magnitude’ বলতে আমরা শিল্পের ভাব-সম্পদের গভীর তত্ত্বকে বুঝি এবং ‘Order’ বলতে বুঝি পরিমিতি, সামঞ্জস্য এবং রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন ‘সংযম’ তাই বুঝি। সৌন্দর্য্যস্বরূপ বলতে কবিগুরু বলেছেন— “The  beautiful  is  that  good  which  is  pleasant  because  it  is  good”  অর্থ্যাৎ সৌন্দর্য্যকে তিঁনি সম্পূর্ণরূপে বিষয়-নিরপেক্ষ সত্ত্বা হিসেবে দেখেননি। তিঁনি ‘Goodness’-এর কথা বলেছেন এবং মানব ও মনুষ্য-সমাজের মঙ্গলের কথাও শিল্পের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন।

শিল্প হল অপ্রয়োজনের প্রয়োজন। শিল্পের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুনের বাঁধা-ধরা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন। শিল্পীর সৃজনশীল আত্মা কোনো বন্ধন মানে না, কোনোরকম শৃঙ্খল-নিয়ম-কানুন মানে না। শিল্প নিজের তালেই নেচে বেড়ায়, তাই সে মুক্ত জীবনানন্দ। অবনঠাকুরের মতে এই প্রয়োজনটুকু হচ্ছে শিল্পের আন্তর প্রয়োজন। রূপকার বিশ্বপ্রকৃতির এই অধরা রূপকে রূপের আধারে ধরার জন্য একটির পর একটি সৃষ্টি করেন এই প্রয়োজনের তাগিদে। এই হল শিল্পীর লীলা। মানুষ যেখানে বন্ধনমুক্ত সেখানে শিল্প ভগবান, সে পরমব্রহ্ম। শিল্প হল মানুষের চিন্ময়ী শক্তির লীলারূপ।  শিল্পী পরম সুন্দরের হঠাৎ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যে আনন্দ অনুভব করে থাকেন তা তাঁর রূপ তৃষ্ণাকে না কমিয়ে উত্তোরোত্তর বাড়িয়ে দেয়।      

পরিশেষে তাহলে আমরা দেখতে পাই যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে শিল্প এবং দর্শন বিষয়দুটি নিয়ে আবহমান আলোচনা চলেছে। শিল্পী, শিল্প-সমালোচকগণ এবং সাধারণ শ্রোতা বা দর্শকগণও শিল্পের দার্শনিকতা ও নান্দনিকতা নিয়ে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর থেকে একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিস্কার হয় যে, শিল্পের মধ্যে এমনকিছু সাধারণীকৃত রূপ-সৃষ্টি আছে যা সমগ্র মানব-সমাজকে প্রাণোচ্ছল তথা প্রাণচঞ্চল করে তোলে। প্রাচীনযুগে আদিম অসভ্য জাতি থেকে আধুনিক যুগে অতি সুসভ্য সংস্কৃতি সম্পন্ন জাতি প্রত্যেকে শিল্পের মধ্যেকার দর্শনকে উপলব্ধি করে শিল্পকে ভালোবেসেছেন, শিল্প-চর্চা করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি যে, অত্যাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো রুচিসম্মত গৃহস্থের বসার ঘরে ঢুকলে যেমন একটা মার্জিত, পরিশীলিত সংস্কৃতির ছাপ পরিলক্ষিত হয় তেমনই অশিক্ষিত, অপরিশীলিত গ্রাম্য আদিবাসী পল্লীতে ঢুকলেও দেখা যাবে যে তাদের মেয়েদের বেণীবন্ধে ফুলের গুচ্ছ। মাঠ থেকে ফেরার পথে একে অপরের হাতে হাত রেখে একসাথে গান গাইতে গাইতে তারা ঘরে ফিরছে। আমার মনে হয় কোনো শিল্প-রসিকের কাছে এখানে তথাকথিত শিক্ষা এবং অশিক্ষার কোনো প্রভেদ থাকা উচিত নয়। রসিক দর্শকের উচিত তার শিল্প-দৃষ্টি দিয়ে এই যূথবদ্ধ গ্রাম্য রমণীকুলকে দেখা ও তাতে আনন্দ লাভ করা। এখানে সূর্যাস্তের সময় এই দলবদ্ধ গ্রাম্য রমণীদের ঘরে ফেরার ছন্দ বিশ্ব-প্রকৃতির ছন্দের সাথে কোথায় যেন একসূত্রে বাঁধা আছে, যা আমাদের শহরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রেক্ষাগৃহে বসে কখনওই সুসংস্কৃত নৃত্য-ভঙ্গীমায় অনুভব করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমারা অদ্ভুতভাবে উপলব্ধি করতে পারছি যে, শিল্পের কাছে জাতবিচার ও দেশবিচার কোনোটাই নেই। এমনকি সুপ্রাচীন ‘মায়া’ সভ্যতার অসামান্য শিল্প-নিদর্শন বা বৈদিক যুগে উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত স্থানস্বরে সাম্‌বেদের মন্ত্রপাঠ আমাদের মনে এলে এক তীব্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সময় যেন কোনো বাধা নয়, দেশ-কাল নিরপেক্ষ অথবা দেশ-কাল-অতীতের আবেদন। সেই জন্যই কবিগুরুর ভাষায় —

“আজি অকারণ বাতাসে বাতাসে যুগান্তরের সুর ভেসে আসে,

মর্মরস্বরে বনের ঘুচিল মনের ভার।

যেমনই ভাঙিল বাণীর বন্ধ উচ্ছ্বসি ওঠে নূতন ছন্দ,

সুরের সাহসে আপনি চকিত বীণার তার

অজানা খনির নূতন মণীর গেঁথেছি হার……” ।।

৪। আর্ট – অন্নদাশঙ্কর রায়।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

১। ভট্টাচার্য অরূণ – নন্দনতত্ত্বের সূত্র; বলাকা পুস্তক বিপণি(১৯৮১)।

২। বন্দ্যোপাধ্যায় হিরণ্ময় – বিশ্ব জিজ্ঞাসা; রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়(১৯৭৫)।

৩। নন্দী কুমার সুধীর – নন্দনতত্ত্ব; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ(১৯৭৯)।

৪। রায় অন্নদাশঙ্কর – এল্যায়েড অফসেট(পুনশ্চ সংস্করণ, ১৯৮৯)।

৫। চৌধুরী কান্তি বিদ্যুৎ – যোগপ্রভা প্রকাশনী(২০১১)।