November 1, 2020

শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের নির্মিতি এবং ব্যাপ্তিতে বিংশ শতাব্দীর “ত্রিমূর্তি” গুরুর ভূমিকা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

তানিয়া চক্রবর্ত্তী, গবেষক, সংগীত ভবন, শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

ভারতের উত্তরপূর্ব দিকে আসাম ও ব্রহ্মদেশের সীমান্তে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। রাজ্যের নাম অনুযায়ী এখানকার নৃত্য ভঙ্গিমার নাম “মণিপুরী” – যা ভারতের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্য শৈলীগুলির মধ্যে অন্যতম এবং প্রাচীন। “এই নৃত্য, তালের কঠোর বন্ধন ও সাহিত্যের সীমিত ক্ষেত্রে আবদ্ধ ও অপেক্ষাকৃত মুক্ত নৃত্য। নৃত্যের নমনীয়তা এবং অন্তর্নিহিত ভক্তিরসই মণিপুরী নৃত্যের প্রধান উপজীব্য। অর্থাৎ সমগ্র শিল্পটিই সারল্যের দ্বারা মণ্ডিত” [১] ।  

        মণিপুরী নৃত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানতে হলে মণিপুরীদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য ও পুরাণ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। দেশে-বিদেশে সমাদৃত মণিপুরী নৃত্য – যা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু পুরাণ, ইতিহাস কিংবদন্তি এবং যুগযুগ ধরে মণিপুরীদের বহমান জীবনধারার কথা। মণিপুরে প্রাক হিন্দু যুগের সংস্কৃতির সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটেছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় সংস্কৃতির। সনাতন ধর্মের পূর্বের সময়ের লাই-হারাওবা নৃত্য থেকে মুদ্রা, তাল, লয় আহরিত হয়েছে বৈষ্ণব ধর্ম প্রভাবিত মণিপুরের রাসনৃত্যে। “সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভারত-ব্রহ্ম সীমান্তে অবস্থিত ক্ষুদ্র মণিপুর রাজ্য স্মরণাতীত কাল থেকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশিষ্ট গৌরবময় স্থানের অধিকারী যা বিচিত্র মানব সংস্কৃতির সম্পদে, সহজাত শিল্প ও সৌন্দর্যবোধের দীপ্তিতে রূপময় ভারত সংস্কৃতির অনির্বাণ শিখাটিকে উজ্জ্বলতর করেছে। প্রাচীনকালে মণিপুরের উপত্যকা অঞ্চলে সাতটি ভিন্ন জাতির লোকেরা বাস করতো। কিন্তু কালক্রমে তারা সকলেই মৈতৈ সমাজে সমাবিষ্ট হয়ে গেছে। মণিপুরী সংস্কৃতি বিষয়ের শ্রেষ্ঠতম অভিব্যক্তি নৃত্যকলায় প্রস্ফুটিত হয়েছে। সমষ্টিগত ভাবে একে “মণিপুরী নৃত্য” বা “মৈতৈ জগোই” বলা হয়”[২]

মণিপুরী নৃত্যের উৎপত্তির পিছনে রয়েছে বিভিন্ন কাহিনী। মণিপুরী প্রাচীন নৃত্য “লাই হারাওবা”-র সৃষ্টি বহু বছর আগে, যা মণিপুরের প্রাচীন সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যময় অঙ্গ। মণিপুরবাসীর কাছে নৃত্য ছিল সহজাত এবং স্বতস্ফূর্ত। যেহেতু এই নৃত্য বিভিন্ন ধার্মিক অনুষ্ঠানে মন্ডপে পরিবেশনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তাই এর গন্ডি ছিল সীমিত। পরবর্তীকালে রাজা শ্রী ভাগ্যচন্দ্র জয়সিংহের সময় থেকে প্রথম ঐতিহ্যময় শাস্ত্রীয় মণিপুরী রাস নৃত্যের সৃষ্টি হয়। এরপর ক্রমশঃ শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের প্রসার ঘটে – একের পর এক বিভিন্ন ভঙ্গিপারেং এর সৃষ্টি, অন্যান্য রাস নৃত্যগুলির সৃষ্টি এবং সংকীর্তনের প্রচলনের মাধ্যমে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের জগতে এই নৃত্যের প্রচারে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি প্রথম সিলেটে এবং ত্রিপুরাতে এই নৃত্য অনুষ্ঠান দেখে মণিপুরী নৃত্যের প্রতি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি আগরতলা থেকে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক এনে এবং পরবর্তীকালে মণিপুর থেকে নৃত্য শিক্ষক এনে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষার ব্যবস্থা শুরু করেন।

গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং, গুরু তখেলচংবম অমূদন শর্মা ও গুরু হাওবাম অতম্বা সিং

  মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রধান তিনজন গুরু গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং, গুরু হাওবাম অতম্বা সিং এবং গুরু তখেলচংবম অমূদন শর্মার দ্বারাই এই নৃত্য প্রচার ও প্রসার লাভ করে। এই তিনজন গুরু একত্রে “ত্রিমূর্তি” নামে পরিচিত। এঁনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সৃষ্টিতে কৃতি ছিলেন। এঁনাদের প্রচেষ্টায় মণিপুরী নৃত্যের মন্ডপ থেকে মঞ্চে উপস্থাপনার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বিংশ শতাব্দীতে শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের অগ্রগতিতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন এই তিনজন গুরু। মণিপুরী নৃত্যের সীমাবদ্ধতা ছিল মণ্ডপের নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে, তাই সাধারণ মানুষের কাছে বা মণিপুরের বাইরে এর জনপ্রিয়তা ছিল সীমিত।

শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে এই সকল গুরুরা ভিন্নভাবে এই নৃত্যের লালিত্য – মাহাত্মকে তুলে ধরেছেন নৃত্যের মূল ধারাকে অবিকৃত রেখে। বিংশ শতাব্দীতে যে সকল গুরুদের সাহচর্যে মণিপুরী নৃত্য বিশ্বের দরবারে স্থান করে নেয় তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং। মণিপুরী নৃত্যের উজ্জ্বল রত্ন গুরু অমুবী সিং ১৮৮১ সালে ইম্ফলে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই নৃত্যের প্রতি আকর্ষণ থাকায় গুরু অমুবী খুব ছোট থেকেই নৃত্যশিক্ষা নিতে আরম্ভ করেন – প্রথমে তাঁর মায়ের কাছে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গুরুদের কাছে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে রাসে কৃষ্ণের নৃত্য দিয়ে তার নৃত্য উপস্থাপনা শুরু হয় এবং এরপর গৌরলীলায় বাল্যকৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গের ভূমিকায় নৃত্য করে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে গুরুজী সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, থাংতার প্রশিক্ষণও নিতে শুরু করেন। তিনি থাংতা শেখেন তাঁর পিতার কাছে, পিতার সাথে সাত বছর বৃন্দাবন ধামে থাকেন, পিতার মৃত্যুর পর মণিপুরে গিয়ে প্রথম গুরু ঝুলনমাচা সিং এর কাছে নৃত্য শিক্ষা নিতে আরম্ভ করেন এবং ধীরে ধীরে তিনি মণিপুরবাসীর কাছে সঙ্গীত, নৃত্য ও বাদ্যের এক নামী গুরু রূপে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন। মণিপুরের বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এই গুরু রাজবাড়ির আমন্ত্রণে গোষ্ঠ অষ্টমী তিথিতে গোষ্ঠলীলার পুংবাদনের জন্য আমন্ত্রিত হন এবং তাঁর গুরু ঝুলনমাচা সিং এর মৃত্যুর পরে গুরুর আসন অলঙ্কৃত করেন এবং পুংবাদক রূপে রাজবাড়ির অনুষ্ঠানগুলি পরিচালনা করতে থাকেন। বসন্তরাস, নৃত্যরাস প্রভৃতি অনেকগুলি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। গুরুজী ১৯৩৯-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন উদয় শঙ্করের আলমোড়া নৃত্য শিক্ষা কেন্দ্রে নৃত্য গুরু রূপে নিযুক্ত ছিলেন। দিল্লী, কলকাতা ও আমেদাবাদ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তিনি নৃত্য শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং নৃত্য প্রদর্শনও করেছিলেন। দিল্লীতে তিনি সঙ্গীতভারতী শিক্ষায়তনে নৃত্য শিক্ষক রূপে ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মণিপুরের বাইরে কাটিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সাল থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি “জওহরলাল নেহেরু মনিপুর ডান্স একাডেমি” -তে জ্যেষ্ঠ গুরুপদে আসীন ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি অবসরগ্রহন করেন। তিনি বর্তমান গর্ভরমেন্ট ডান্স কলেজে যুক্ত ছিলেন গুরু পদে। ১৯৫৬ সালে সঙ্গীত-নাটক একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে ভারত সরকারের “পদ্মশ্রী” উপাধি দ্বারা তাঁকে সন্মানিত করা হয়। জীবনের শেষভাগে তিনি মণিপুরের ডান্স একাডেমিতে “ভিসিটিং প্রফেসর” হিসাবে কর্মরত ছিলেন। 

শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরু অমুবী সিং এর এক বিরাট অবদান ছিল। তিনি নৃত্যের ঐতিহ্য কে বজায় রেখে নৃত্যের মধ্যে নতুনত্ব সৃষ্টিতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের প্রাচীনত্বকে অটুট রেখে সেই নৃত্যের মধ্যে নতুনত্ব এনেছিলেন। তাঁর নৃত্য শৈলীতে খুব সূক্ষ অঙ্গ-ভঙ্গি ও আঙুলের কাজ ছিল। চালি নৃত্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় হস্ত, গ্রীবা, চক্ষু, আঙুল সবই একত্রে সঞ্চালিত হয়ে থাকে গুরু অমুবী সিং এর শৈলীতে। মণিপুরী নৃত্যের লাস্য ভঙ্গিমা এবং অন্তর্নিহিত রসাভিনয়ে পারদর্শী এই গুরু একক নৃত্যকেও মঞ্চস্থ করার পদ্ধতি নির্মাণ করেছিলেন।

“১৯২১ সালে মহারাজ চূড়াচাঁদের রাজত্বকালে “প্রিন্স অফ ওয়েলস” কলকাতায় আসেন। তাঁর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে রাজা চূড়াচাঁদ গুরু অমুবী সিং কে রাসনৃত্যকে ছোট করে একটি দল নিয়ে কলকাতায় নৃত্য পরিবেশন করার আহ্বান জানান। অনেক বিবেচনা করার পর গুরুজী রাজী হন। তিনি শিষ্যদের নিয়ে পাঁচ ঘণ্টার রাসনৃত্যকে পনেরো মিনিটের মঞ্চোপযোগী রাসনৃত্যে পরিণত করলেন এবং কলকাতায় প্রিন্স অফ ওয়েলস এর সামনে সেটি পরিবেশিত হল রাসনৃত্যের ঐতিহ্য ও মাহাত্ম্য অবিকৃত রেখে। এটি শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের প্রথম মন্ডপ গন্ডি পেরিয়ে মঞ্চে উপস্থাপনা। পরে তাঁর নেতৃত্বে একাধিক একক নৃত্য নির্মাণ এবং মঞ্চস্থ হয়”[৩]। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নীল কমল দল শ্যাম, শ্রীতকমল, দশাবতার, খন্ডিতা। মণিপুরী নৃত্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য গুরু অমুবী সিং “জগোই মরূপ” নামক স্বাধীন সংস্থার প্রবর্তন করেন, যা এখনও বর্তমান। গুরু অমুবী সিং এর নেতৃত্বে তা কায়ার আকার ধারন করে। এককথায় বলা যেতে পারে শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে গুরু মাইস্নাম অমুবী সিং এর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭২ সালের ২৯ শে জুন এই মহান গুরুর জীবনাবসান হয়। বর্তমানকালে তাঁর সুযোগ্য অনুগামীদের মধ্যে গুরু সূর্যমুখী দেবী, গুরু দেবযানী চালিহা, গুরু থৌরানীশাবী দেবী প্রভৃতিরা তাঁর নৃত্য ধারাকে বহন করে চলেছেন।

বিংশ শতাব্দীর শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের আরেকজন অন্যতম পথিকৃৎ গুরু ছিলেন হাওবাম অতম্বা সিং। ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে গুরু হাওবাম অতম্বা সিং এর জন্ম হয়, মণিপুরের উরিপকের হাওবাম দেওয়ানের বাড়িতে। গুরু অতম্বা সিং ৬(ছয়) বছর বয়সে জনস্টোন জুনিয়র স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, কিন্তু তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং পিতার অর্থসঙ্গতি না থাকায় ১২(বারো) বছর বয়সের পর তাঁর আর পড়া সম্ভব হয় নি। তারপর থেকে তিনি কাঠের কাজ শেখা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর কাকা হাওবাম চাউবী সিং এর কাছে পুং বাদন এবং নৃত্য শিক্ষা নিতে আরম্ভ করেন। এছাড়াও পৃথক পৃথক ভাবে বিভিন্ন গুরুদের কাছে তিনি রাসলীলা, গোষ্ঠলীলা ও গৌরলীলা শিক্ষা নেন। বহু প্রতিকুলতার মধ্য দিয়েই এভাবে তিনি একজন ভালো শিল্পী হয়ে ওঠেন। গুরু হুইদ্রম ঝুলনমাচা সিং এর কাছে তিনি পারদর্শিতার সহিত ভঙ্গী পারেং নৃত্য শেখেন। এইভাবে ধীরে ধীরে গুরু অতম্বা সিং এর নাম মণিপুর এবং মণিপুরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। মণিপুরের বিখ্যাত গুরুদের কাছ থেকে নৃত্য ও সঙ্গীত চর্চা করে মণিপুরী নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে সমর্পিত করেন।

গুরু হাওবাম অতম্বা সিং এর নৃত্য ছিল সরল সৌন্দর্যময়। তিনি নৃত্যের ঐতিহ্যকে বজায় রেখে নৃত্য নির্মাণ করেছিলেন, কখনোই তার নৃত্য নির্মিতিতে কোন কৃত্রিমতা আনেননি। প্রথমে গুরুজী তাঁর বাড়িতে এবং পরবর্তীকালে গোবিন্দজীর মন্দিরে নৃত্য শেখান। তিনি নিত্যরাস এবং বসন্তরাস শেখাতেন। মণিপুরী পাঁচ প্রকার রাসনৃত্য এবং ভঙ্গীপারেং এর ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত ঐতিহ্যপূর্ণ ধারাকেই মেনে চলতেন। মণিপুরী তাণ্ডব নৃত্যেও যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন।

তার নির্মিত নৃত্যগুলির মধ্যে গোষ্ঠলীলা, নৃত্য রাসলীলা, শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা উল্লেখযোগ্য। তার নৃত্য মঞ্চস্থ সম্পর্কে জানা যায়, মণিপুরের মহারাজ স্যার চূড়াচাঁদ সিং ইংল্যান্ডের প্রিন্স আ্যলবার্ট এর কলকাতায় আগমন হেতু ভারতীয় নৃত্য দেখানোর জন্য যে নৃত্য উৎসব আয়োজন করেছিলেন সেখানে গুরু অতম্বা সিং কে দায়িত্ব অর্পণ করে মণিপুর থেকে কলকাতায় পাঠানো হয় মণিপুরী রাসলীলা প্রদর্শন করার জন্য। কলকাতায় ঐ নৃত্য উৎসবে রাসনৃত্য দেখে যুবরাজ প্রিন্স আ্যলবার্ট এতটাই মুগ্ধ হন যে অতম্বা সিং কে মাল্য পড়িয়ে সম্বর্ধনা দেন এবং শংসাপত্র প্রদান করেন। গুরুজী সেই সময় বলেন – “আমি বিদেশে গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করলাম বলে মনে হচ্ছে”

“বাংলা ও অসমে বহু জায়গায় নৃত্য পরিচালনা ও মঞ্চস্থ করেন গুরু হাওবাম অতম্বা সিং। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে অসমে তাঁর নৃত্য দেখে মণিপুরী নৃত্য সম্পর্কে তাঁর মনে আগ্রহ জন্মায় এবং গুরুদেবের আমন্ত্রণেই ১৯৩৯-৪০ সাল থেকে সংগীত ভবনে প্রায় ১০ বছর ব্যাপী শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত থাকেন যদিও মণিপুর থেকে এসে প্রথমে তিনি কিছুদিন কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের অতিথি হয়ে ছিলেন”[৪]। এরপরে শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনি ছোট বড় সবাইকে নিয়ে উত্তরায়ণের বারান্দায় চালি নৃত্য শেখাতেন। সেই সময় গুরুজী অনেক রবীন্দ্র সঙ্গীত কে তার স্বকীয়তা বজায় রেখে নাচের ছন্দ দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন ভঙ্গি মুদ্রারও প্রয়োগ করেন।

মায়ার খেলা গীতিনাট্যও শান্তিনিকেতনে মঞ্চস্থ করান বলে জানা যায়। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর ও ভাবের গভীরতার সঙ্গে মণিপুরী নৃত্যের স্বচ্ছন্দ বিন্যাস, সাবলীল গতি ও বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধের বিশেষ সামঞ্জস্য থাকায় শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য সর্বাপেক্ষা সমাদৃত হয়। মণিপুরী নর্ত্তনধারা প্রচারের জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গা যেমন – শিলং, শান্তিনিকেতন, কলকাতায় বহু সময় কাটান। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন ১৯৪১ সালে নৃত্যগুরু রূপে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে গুরু অতম্বা সিং একটি স্বর্ণপদক ও শংসাপত্র দ্বারা সম্বর্ধিত হন বলে জানা যায়। ১৯৫৬ সালে তিনি কলকাতায় নৃত্যভারতী নৃত্য শিক্ষালয়ে নৃত্য গুরু হিসাবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি “সঙ্গীত নাটক একাডেমি” পুরস্কার এবং ১৯৭৩ সালে “ষ্টেট কলা একাডেমি” পুরস্কার পান। এরপরে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি কতৃক প্রদত্ত “পদ্মশ্রী” উপাধি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ভারতে রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে পুরস্কার পান, মণিপুরী নৃত্যের জন্যে Scientific Research for Cultural Affairs (SRCA) New Delhi র শিল্পী সদস্য হিসাবে। দীর্ঘ ষোল(১৬) বছর “জওহরলাল নেহেরু মণিপুর ডান্স একাডেমি” তে তিনি গুরু পদে আসীন ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি “ভিসিটিং প্রফেসর” হন। ইতিমধ্যে তিনি ভারতীয় কলা মন্দির (পাটনাতে) গিয়ে মণিপুরী নৃত্য শিখিয়েছিলেন পরিদর্শক গুরু হিসাবে।

শিলং এ থাকাকালীন গুরু অতম্বা সিং এর সহকর্মী ছিলেন অরাংবাম ইয়াম্বি সিং। এঁনারা দুজনেই মৃদঙ্গ বাদনে এবং নৃত্যে পটু থাকায়, নৃত্যের স্বকীয়তাকে বজায় রেখে তারা নৃত্যের মধ্যে নতুনত্ব এনেছিলেন। একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। কলকাতায় ও নৃত্য শিক্ষা দেন। মণিপুরী নৃত্য জগতের স্বনামধন্য গুরু হাওবাম অতম্বা সিং এর নৃত্য পরবর্তীকালে সারা ভারতবর্ষে প্রসারলাভ করে। ১৯৭৫ সালের ২১ এ ফেব্রুয়ারী ৯০ বছর বয়সে এই মহান গুরু পরলোক গমন করেন। পরবর্তীকালে গুরু পাকা সিং, প্রহ্লাদ দাস, রীতা দেবী তার নৃত্য ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আলোচ্য ত্রিমূর্তি গুরুদের মধ্যে তৃতীয়জন ছিলেন গুরু তখেলচংবম অমূদন শর্মা। গুরু অমূদন শর্মা ইংরাজী ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মাঘ মাসের এক বৃহস্পতিবার ব্রহ্মপুরের খোংদোন মংজিনে জন্মগ্রহন করেন। শ্রী শ্রী গোবিন্দজী মন্দিরের রাসধারী ছিলেন তাঁর পিতা গুরু খোমদোন শর্মা। পিতার কনিষ্ঠ পুত্র রূপে তিনি মণিপুরের রাজবাড়িতে নৃত্য শিক্ষা শুরু করেন এবং পরবর্তীকালে বহুল পরিচিত নৃত্য গুরু হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণ বংশের মৃদঙ্গ বাদক ছিলেন তিনি। অমূদন শর্মা তাঁর বড় দাদু কাহ্নাই শর্মার কাছ থেকে রাস নৃত্য শেখেন। তাঁরা রাজবাড়ির গুরু ছিলেন। কুঞ্জরাস, মহারাস, বসন্তরাস, গোষ্ঠলীলা, উদুখল লীলা শেখেন। অমূদন শর্মা ছোটবেলা থেকেই বংশ পরম্পরায় রাসধারীর যাবতীয় বিদ্যা শেখেন। কিন্তু অন্য লেখাপড়া শেখার তেমন সুযোগ হয়নি। অল্প কিছু লেখাপড়া করেন কিন্তু রাসধারীর বিদ্যাই বেশি আয়ত্ব করেন। তাঁর নির্মিত নৃত্যগুলির মধ্যে মৃদঙ্গের চলনের আভাস পাওয়া যায়। গোবিন্দ নর্ত্তনালয়ে তিনি নৃত্য শিক্ষা দিতেন। রাজবাড়িতে যে রাসলীলা অনুষ্ঠিত হত, প্রথমে নিজ গুরুদের সহযোগী হিসাবে সেখানে রাসনৃত্য শিক্ষা শুরু করেছিলেন, পরে তিনি হয়ে ওঠেন সেখানকার গুরু। ভাগ্যচন্দ্র মহারাজের সময় থেকেই মণিপুরে রাসধারার যে পরম্পরা চলে আসছে সেই পরম্পরারই রক্ষক ছিলেন গুরু অমূদন শর্মা। শ্রী শ্রী গোবিন্দজীর মন্দিরে অনুষ্ঠিত মহারাস, কুঞ্জরাস, বসন্তরাস প্রভৃতির পরম্পরাগত এবং ঐতিহ্যপূর্ণ নৃত্য ধারার গুরু ছিলেন তিনি। 

গুরু অমূদন শর্মা মণিপুরে শুধুমাত্র রাসলীলার রাসধারী নয়, মণিপুরী নটসংকীর্তনের মৃদঙ্গ বাদক হিসাবে যথেষ্ট জ্ঞানী ও পরিচিত ছিলেন।

গুরু অমূদন শর্মা যেহেতু রাজবাড়ির গোবিন্দজীর মন্দিরের বার্ষিক নৃত্যকলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই তাঁর নৃত্যে রাজপ্রাসাদের নৃত্যের ধারা লক্ষ্য করা যেত।

“শ্রী শ্রী গোবিন্দজীর মন্দিরে তিনি বামনপালার প্রধান এবং খুবই খ্যাতনামা গুরু ছিলেন। এর জন্যে বোধচন্দ্র মহারাজ গুরু অমূদন শর্মাকে “পালাহঞ্জ” উপাধি  প্রদান করেন এবং তাঁকে সোনার বালা, বাজুবন্ধ এবং খামেনচৎপা উপহার হিসাবে প্রদান করেন। এছাড়াও মহারাজ গুরুজীকে ১৯৫৩-৫৪ সালে “নৃত্যাচার্য্য শিরোমণি” উপাধিতে ভূষিত করে সন্মানিত করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি “নৃত্যগুরু অফ্‌ সাহিত্য পরিষদ”, ১৯৬০ সালে “সঙ্গীত নাটক একাডেমি” পুরস্কার পান। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে “পদ্মশ্রী” উপাধিতে ভূষিত করেন”[৫]

গুরু অমূদন শর্মা ১৯৫৪ সালের ২০-এ নভেম্বর বোধচন্দ্র মহারাজের মহারানী কমলাবতী দেবীর সভাপতিত্বে শ্রী শ্রী গোবিন্দজী নর্ত্তনালয়, মণিপুর (বর্তমান Government Dance College) – এর প্রধান গুরুরুপে নিযুক্ত হন এবং ইংরাজী ১৯৫৭ সাল থেকে জওহরলাল নেহেরু মণিপুর ডান্স একাডেমির গুরুরুপে কার্যভার গ্রহন করেন।

গুরু অমূদন শর্মার নৃত্যে তাণ্ডব আঙ্গিকের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়, এবং গ্রীবা সঞ্চালন খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। তাঁর নৃত্যে বোলের সাথে দেহ, গ্রীবা, হস্ত, চক্ষু সমস্ত কিছু ছন্দ ও তালের বিন্যাস অনুযায়ী করা হয়েছিল সেই সময়ে। তিনি নটপালা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাসনৃত্যে সেই পদ্ধতি বা আঙ্গিককে ব্যাবহার করে কার্যকরী করেছিলেন। গুরু অমূদন শর্মা তাঁর নৃত্য নির্মিতিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতেন, চোলমের ব্যবহার করতেন এবং সব মিলিয়ে তাঁর নৃত্যে একটি নান্দনিক ভাব সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হত। গুরু অমূদন শর্মা পুংবাদক হিসাবে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন। মৃদঙ্গের বোলের বিষয়ে তাঁর সুগভীর জ্ঞান ছিল। তানচপ, মেনকূপ এবং যেকোনো কঠিন তালের বিভিন্ন বোলের বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। ১৯৭৪ সালের ৯ই মার্চ তিনি পরলোকগমন করেন।

গুরু অমূদন শর্মা মণিপুরের রাজপ্রাসাদ (কনুং) এর নৃত্য গুরু ছিলেন। রাসলীলা অনুষ্ঠিত হত প্রথমে রাজবাড়ির রাসমণ্ডপে এবং তারপর গ্রামের বিভিন্ন খুল্লকে (মাঠে)। তিনি পরবর্তীকালে মণ্ডপ থেকে মঞ্চে নৃত্যের অবতরণ করেন তাঁর শিষ্য বিপিন সিংকে সঙ্গে নিয়ে।

গুরু অমূদন শর্মার কার্যকলাপ সীমিত ছিল মণিপুরের মধ্যে। কিন্তু মণিপুরের বাইরে থেকে অনেকেই যেতেন তাঁর কাছে নৃত্য শিক্ষার তালিম নিতে। পরবর্তীকালে তাদের অনেকেই তাঁর সৃষ্ট মণিপুরী ঘরানার নৃত্যকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গুরু বিপিন সিং, গুরু সবিতা বেন মেহতা, পদ্মশ্রী গুরু দর্শনা জাভেরী ও গুরু কলাবতী দেবী।

বিংশ শতাব্দীর এই তিনজন পথিকৃৎ গুরু সমসাময়িক হলেও নৃত্য শিক্ষা পদ্ধতি, নৃত্য নির্মাণ, নৃত্য বিষয়ক কৌশল এবং ভাবনার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ স্থানে কৃতি ছিলেন।

গুরু অমূদন শর্মা মূলত মণিপুরী নৃত্যের ধর্মীয় পরিধি অর্থাৎ মণ্ডপের পরিধি নিয়ে, গুরু অতম্বা সিং মূলত মণিপুরী নৃত্যের শান্তিনিকেতনের পরিধি অথবা প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং গুরু অমুবী সিং মূলত রঙ্গমঞ্চের পরিধি অর্থাৎ মঞ্চে মণিপুরী নৃত্যকে পরিবেশিত করা এই পরিধি নিয়ে কাজ করেছিলেন।

মঞ্চে নৃত্য উপস্থাপন করতে গেলে অনেক নিয়মনীতির মধ্যে দিয়ে তা পরিবেশিত হয় যেগুলি গুরু অমুবী সিং নজর রেখে সেই অনুযায়ী নৃত্য নির্মাণ করেন। প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকা দর্শকের কাছে নৃত্যকে মনোগ্রাহী করে তোলাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।

গুরু অতম্বা সিং শান্তিনিকেতনের মুক্ত মঞ্চে প্রাকৃতিক পরিবেশে গাছের নীচে নৃত্য পরিবেশন করতে গেলে কিভাবে নৃত্য নির্মাণ করতে হবে সেদিকে নজর রেখে নির্মিতি করেন।

গুরু অমূদন শর্মা সেই সময় মণিপুরের মণ্ডপে কিভাবে ধারাবাহিক নিয়মানুযায়ী নৃত্য পরিবেশন করা হবে সেদিকে মূলত নজর রেখে নৃত্য নির্মাণ করেন তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নান্দনিক চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে।

অর্থাৎ শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের ত্রিমূর্তি গুরু তাঁদের নিজ নৃত্য নির্মাণ, স্বকীয়তা ও কৃতিত্বের জন্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তথ্যসূত্র

১) ঝাভেরী, দর্শনা ও দেবী কলাবতী, শাস্ত্রীয় মণিপুরী নর্ত্তন, বোম্বাই-কোলকাতা-মণিপুর, মণিপুরী নর্ত্তনালয়, ১৯৯৩।

২) সিংহ, বীরমঙ্গল.এল, প্রসঙ্গ মণিপুর, ত্রিপুরা, ত্রিপুরা বাণী প্রকাশনী, ২০১২।

৩) মণিপুরী নৃত্যের বিখ্যাত তিনজন গুরুর জীবনী ও অবদান, সিলেবাস, গোবিন্দ নর্ত্তনালয়, ইম্ফল, মণিপুর।

৪) সিংহ, ইবোচাওবা, হাওবাম, গুরু হাওবাম অতোম্বা সিংহ, ইম্ফল, মণিপুর, জওহরলাল নেহেরু মণিপুর ডান্স একাডেমি, ২০১৯।

৫) শর্ম্মা, চিত্রেশ্বর, অরিবম, শ্রী, গুরু তখেলচংবম অমুদোন শর্ম্মা, ইম্ফল, মণিপুর, জওহরলাল নেহেরু মণিপুর ডান্স একাডেমি, ২০১৯।

৬)সিংহ নদীয়া তৌরাংবম, মণিপুরী নৃত্য, কোলকাতা, শ্রীভূমি পাবলিশিং, ১৯৯২।

৭) GURU ATOMBA SINGH BIRTH CENTENARY CELEBRATIONS, Souvenir, Imphal, Manipur, Published by Reception Committee, Guru Atomba Birth Centenary Celebrations, 1986.

৮) CHALIHA, DEVJANI, MAISNAM GURU AMUBI SINGH, Imphal, Manipur, Jawaharlal Neheru Manipuri Dance Academy, 2015.