লোক সংগীত সম্পর্কে রবীন্দ্র ভাবনা ও লোকসংগীতের বিষয় বিভাজন
ড. পুতুল চাঁদ হালদার
ঊনবিংশ শতকের বাংলায় বহু প্রতিভাবান মনীষী জন্মগ্রহণ করেছিলেন-কি সাহিত্য জগতে, কি নাট্য জগতে, কি শিল্প, সংগীত, ধর্ম ও আধ্যাত্ম জগতে। তাঁদের পুণ্য স্পর্শে বাংলাদেশ শিক্ষা, সভ্যতা ও সাংস্কৃতি উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
নদী মাতৃক বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু যেমন একদিকে বঙ্গকে শস্য শ্যামলা করেছে, তেমনি অন্যদিকে চিন্তাশীল প্রতিভা দীপ্ত মনীষীদের আবির্ভাবে বাংলার শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি সহ নানা বিষয় সরস, সুন্দর, সাবলীল ও হৃদয়স্পর্শী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববরেণ্য বিশ্বকবি রূপে বরণীয় হলেও তিনি বাংলার মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলার শিক্ষা, দীক্ষা,আচার-ব্যবহার ও ধর্ম-সংস্কারকে ভিত্তি করেই তাঁর লোকোত্তর জীবনকে সর্ব সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রবীন্দ্র পূর্ব বাংলার সাধারণ সমাজ, রাষ্ট্রজীবন, সাহিত্য চর্চা, নাটক, কাব্য, দর্শন, সংগীত, শিল্প, ধর্ম এমনকি আধ্যাত্ম ভাবধারা রবীন্দ্রনাথের জীবনকে যে প্রভাবিত করেছিল তা একান্তভাবে স্বীকার্য।
তবে তিনি সব কিছুকে তাদের নতুন রূপে, রসে ও ভাবে সুষমায়িত ও সমৃদ্ধ করেছিলেন একটি অভিনব ও স্বতন্ত্র দৃষ্টি ভঙ্গিতে। তাই তাঁর সকল সৃষ্টি আজ বাংলা তথা ভারতের সীমা অতিক্রম করে বিশ্ববাসীর অন্তর সিংহাসনে তাদের নিজস্ব আসন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
শহর কলকাতার মধ্য স্থলের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী ও বিলাসিতা বিমুখ। তখন থেকেই তাঁর জীবনে লোকায়ত জীবনের সরলতা, সহজতা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য সে সময় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গ্রাম্য জীবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন-গাছ-গাছালি, বাগান, পুকুর, ঢেঁকিশালা, পাঠশালা,
পাল-পার্বণ, ব্রত, পূজা, আলপনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ ছিল তা ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছেলেবেলা’ বই দুটি থেকে জানা যায়।
ঠাকুর বাড়িতে প্রাত্যহিক কাজ কর্মের মধ্যদিয়ে যে সমস্ত লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চা হতো তা তাঁর ভালো লাগত ও তাঁকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করত। ছেলেবেলাকার লোকায়ত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের অজান্তে তাঁর মনে লোকায়ত শিল্প সংস্কৃতির বীজ বপন করে। কবিগুরুর জীবনে শৈশবের অনুশাসনের মুক্তি ঘটে যৌবনে। শৈশবে ঘটনা চক্রে কয়েকবার পল্লী গ্রামকে সামনা-সামনি উপভোগ করার সুযোগ পান রবীন্দ্রনাথ তবে ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল এই দশ বৎসর তাঁর জীবন শিলাইদহ ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে অতিবাহিত হয়। এরপর ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে লালমাটির দেশ বীরভূমে কবি তাঁর কর্মজীবন স্থানান্তরিত করেন।
“রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর গানের যোগ্য পরিবেশ পেয়েছিলেন কলকাতা জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে একথা সকলেরই বিদিত। তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে হিন্দু-মুসলমান উস্তাদদের বসতো উচ্চাঙ্গ-সংগীতের আসর, সুতরাং সে আসরে সংগীত শোনার সুযোগ হয়েছিল তাঁর যথেষ্ট। বরোদা, গোয়ালিয়র, অযোধ্যা, দিল্লি, আগ্রা, মোরাদাবাদ ও আরো অন্যান্য দেশ থেকে সংগীত শিল্পীরা আশ্রয় নিতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। “১
‘জীবনস্মৃতি’তে জানা যায়, বড়দের সংগীতের আসরে ছোটদের প্রবেশাধিকার না থাকলেও বালক রবীন্দ্রনাথ দরজার আড়াল থেকে তা অন্তর দিয়ে শুনতেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর বাড়ির সংগীত শিক্ষকদের কাছে সংগীত শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করা হয়। কবিগুরু বিষ্ণু চক্রবর্তী, শ্রীকণ্ঠ সিংহ, যদু ভট্ট ও মৌলাবক্স প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীদের কাছে নানা রাগ-রাগিনীর তালিম নেন। তবে তা নিয়ম নিবন্ধ করে নয়। ঐ সমস্ত রাগ-রাগিনীর সুর পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্ট সংগীতকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। তবে এখানেও তিনি তাঁর স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। রাগ-রাগিনীকে নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে তিনি তাদের যথাযথ ও সার্থক প্রয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি সৌন্দর্যকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
পল্লী বাংলার সহজ সরল জীবন যাত্রা রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করত। এই আকর্ষণ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা না করে তিনি তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জারি রেখেছিলেন। ফলে একদিকে কবির প্রকৃতি প্রেম অন্যদিকে দার্শনিক ভাবনা কবিকে আরও বেশি লোকসংস্কৃতিমুখী করে তুলেছিল। পল্লীগ্রামই বঙ্গ তথা ভারতের যে ভিত্তি ভূমি তা কবি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। অন্তর দিয়ে লোকায়ত জীবনের দুঃখ, যন্ত্রনা, হাসি-কান্নাকে উপলব্ধি করতেন কবি।
কবিগুরু তাঁর জীবনের বেশ কিছু কাল অতিবাহিত করেন রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, শীলাইদহ ও পাতিসর সহ বীরভূমের নানা পল্লী অঞ্চলে। জমিদারি দেখা শোনার সুবাদে ঐ সব অঞ্চলে বসবাস কালে অগনিত লোক শিল্পীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তিনি তাঁদের গান শোনেন। ঐ সমস্ত লোক শিল্পীদের লোকসংগীত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে মূলত সুরগত ও বিষয়গত এই দুই ভাবে প্রভাবিত করেছিল। সুরগত প্রভাব অর্থাৎ লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারার গানের সুরের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানে লক্ষ্য করা যায়। আবার বাউল তত্ত্ব বা কীর্তনাঙ্গের কিছু প্রচলিত গানের বিষয়গত সাদৃশ্য ও চিত্ররূপ তাঁর গানে পরিলক্ষিত হয়।
আমরা জানি ভারতীয় রাগ-রাগিনীর মতো বাঙলার প্রচলিত লোকসংগীত গুলি সুর প্রধান। আবার রবীন্দ্রসংগীতেও কথা ও সুরের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিই প্রস্ফুটিত। গানের কথা ও সুর প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’তে কবি বলেছেন -” গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয় না সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া,সেখানে সে গানেরই বাহন মাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্য্যেই বড়, বাক্যের দাসত্ব কেন সে করিতে যাইবে।… … … বাক্য যাহা বলিতে পারে না, গান তাহাই বলে। এই জন্য গানের কথাগুলিতে কথার উপদ্রব যতই কম থাকে, ততই ভালো।”
বঙ্গ দেশের প্রতিটি প্রান্তে যে সমস্ত লোকসংগীত প্রচলিত আছে তা সহজ সরল কথা ও সুরে সমৃদ্ধ। তাই তাঁর গানে বাঙলা দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি পর্যায়ে লোকসংগীতের সুর ও কথা তথা বিষয় তাঁর গানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল একথা বলা যায়।
অনাদি কাল ধরে বিশ্ব সংগীত যেমন ভাবে তার রূপ-রসের বিস্তারে বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনই ভারতীয় সংগীতও বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী আদায় করতে সচেষ্ট হয়েছে। আমাদের ভারতবর্ষ গ্রামীণ সভ্যতাকে আশ্রয় করেই পল্লবীত হয়েছে।তাই ভারতের প্রতিটি প্রদেশে লোকায়ত সংগীত বস্তুত বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে বাংলার লোকসংগীত এতটাই বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত যে তা সমগ্ৰ বিশ্বে বিরল। একই বঙ্গে বাংলা ভাষায় কত রকমের লোকসংগীতের সমাবেশ তা আমাদের অবাক করে। বৈচিত্র্যের মধ্যে পরম একতার সন্ধান বাংলার লোকসংগীতকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। লোকসংগীতকে আশ্রয় করে এ বাংলাদেশে কত যে বিচিত্র সংগীতমালা রয়েছে তা এখনও সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হয়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী সম্প্রদায়, ধনী-দরিদ্র,
শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সুখে-দুঃখে, পতনে-উথ্বানে একই সঙ্গে আবহমান কাল ধরে বসবাস করে আসছে যে, মানুষ তার বহিঃপ্রকৃ বহিঃপ্রকৃতিতে যতোই কালের বিভিন্নতার ছাপ পড়ুক, অন্তরের ঐক্যানুভূতির ক্ষেত্রে অন্তরায় ঘটেনি আজও। নানা উৎসবে, ব্যসনে, পূজা-পার্বণে, অন্ন চিন্তায়, ধর্ম-চিন্তায়, সুখ-দুঃখের নানা অভিব্যক্তিতে গ্রাম্য কবিগণ রচনা করেছেন এই গান।
সাধারণ ভাবে আমরা বাংলার লোকসংগীতকে
নিম্নলিখিত পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।
(ক) আঞ্চলিক শ্রেণী বিভাগ-: ভাটিয়ালী,ভাওয়াইয়া, ঝুমুর,বাউল।
(খ) বিষয়গত শ্রেণী বিভাগ-:
১| প্রেম বিষয়ক-: সামাজিক-বৈধ, অসামাজিক-অবৈধ।
২| সমাজ বিষয়ক-: শস্য, উৎসব, মেলা, জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ।
৩| বৈরাগ্য বিষয়ক-: শোক, সাধারণ ভক্তি।
(গ) পরিবেশগত শ্রেণী বিভাগ-: একক, সমবেত, নৃত্য- বাদ্যসহ সংগীত।
(ঘ) আধুনিক শ্রেণী বিভাগ-: ঋতু সংগীত, শ্রম সংগীত, ভক্তি সংগীত, আচার সংগীত। সমগ্ৰ বঙ্গের লোকসংগীতের ভাষা, সুর ও ছন্দের প্রকৃতি এবং ধর্মীয় প্রভাব অনুসারে ৫টি অঞ্চলে ভাগ করা যায়।
(১) উত্তর বাংলার গান-: ভাওয়াইয়া, চটকা, গম্ভীরা, মাহুত বন্ধুর গান, মইষাল ও গাড়িয়াল বন্ধুর গান।
(২)মধ্য অঞ্চলের গান-: বাউল, বোলান, ঝাঁপান,
আলকাপ।
(৩) ভাগীরথীর পশ্চিমাঞ্চল বা রাঢ়বঙ্গের গান-: ভাদু, টুসু, ঝুমুর, লেটো, পটুয়ার গান ইত্যাদি।
(৪) পূর্বাঞ্চলের গান-: বিচ্ছেদী, সারি, ঝাঁপ, ফেরুসাই প্রভৃতি অঙ্গের ভাটিয়ালী গান।
(৫) দক্ষিণ অঞ্চলের গান-: মনসার গান, বনবিবির গান, দক্ষিণরায়ের গান, গাজী সাহেবের গান, শীতলার গান ইত্যাদি।
এবার বিশিষ্ট্য লোক সংগীত গবেষক এনামূল হক মহাশয় বাংলার লোকসংগীতকে যে যে বিষয়গত পর্যায় বিভক্ত করেছেন তা লক্ষ্য করবো এবং ঐ সকল লোকসংগীতের সঙ্গে রবীন্দ্র সৃষ্ট সংগীতের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনায় অগ্ৰসর হব।
এনামূল হক মহাশয় সমগ্ৰ বাংলার লোকসংগীতগুলিকে দশটি পর্যায় বিভক্ত করেছেন। যেমন-(১)প্রেম সংগীত -: ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বারমাসী।
(২) নৃত্য সংগীত-: ঝুমুর, ভাঁজোই, ঘাটু, লেটো।
(৩) সহেলা-: ধামাইল, যাবতীয় মেয়েলী সংগীত।
(৪) শ্রম সংগীত-:সারি, বাইচ, ছাদপেটা, কর্ম প্রেরণার গান।
(৫) কৃষি সংগীত-: জাগ, কার্ত্তিকা, পুষালি।
(৬) আনুষ্ঠানিক সংগীত-:গম্ভীরা, গাজন, ভাদু, টুসু
(৭) পটুয়া সংগীত-: দেবপট, গাজীপট ইত্যাদি।
(৮) শোক সংগীত-: জারি গান,বিজয়া, কান্নাগান।
(৯) ভক্তি সংগীত-: শাক্ত সংগীত, পীর সংগীত, মাইজভান্ডারী।
(১০) তত্ত্ব সংগীত-: বাউল, মুর্শিদা, দরবেশী, মারফতী, দেহতত্ত্ব।
১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের- ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’-গানটিতে পূর্ববঙ্গের প্রচলিত ভাটিয়ালী-
”মন মাঝি সামাল সামাল ডুবলো তরী,
ভব নদীর তুফান ভারি’ – গানটির সুর ও কথার ভাব প্রতিফলিত।
‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ’ ও আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’- গান দুটিতে বঙ্গের প্রচলিত ভাটিয়ালী – ‘মন তোর মানবতরী বোঝাই ভারী’ – গানটির সুর পরিলক্ষিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় শেষ জীবনে রচিত – ‘তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম সাড়া’- গানটিতে রাঢ় বঙ্গের ভাদু গান ‘বড় মজা গেছে গো আইন পাশে’ এবং ‘ভাদুর আগমনে’এই গান দুটির সুর বর্তমান।
ভক্তি সংগীত তথা শাক্ত পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রাম প্রসাদ সেনের-‘মায়ের এমনি বিচার বটে,
যে জন দিবা নিশি দুর্গা বলে
তার কপালেই বিপদ ঘটে’- গানটির
প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় কবিগুরু রচিত
(১) ‘আমারা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’,
(২) ‘শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা’,
(৩) ‘আমি শুধু রইনু বাকি’-এই গান তিনটিতে।
প্রচলিত কীর্তন গানের সুরের কাঠামো কবিগুরুর অনেক গানেই পাওয়া যায়, যেমন-
(১) ‘হরি তোমায় ডাকি, সংসারে একাকী’
(২) ‘সখী বয়ে গেল বেলা শুধু হাসি খেলা’
(৩) ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’,
(৪) ‘তবু মনে রেখো’ -এই গান চারটিতে লালনের কীর্তন ভাঙ্গা সুরের-‘ক্ষম অপরাধ ওহে দীননাথ, কেশে ধরে আমায় লাগাও কিনারে’ গানটির সঙ্গে
মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাহেবধনী সম্প্রদায়ভূক্ত আউল কুবীর গোঁসাইয়ের-‘ডুব্ ডুব্ ডুব্ রূপ সাগরে আমার মন’ গানটির সুর কাঠামো লক্ষ্য করা যায় কবিগুরু রচিত-‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ গানটিতে।
জানা যায় রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিলে বেদ,পুরাণ, কোরান, বাইবেল ও লালনের জীবনী গ্ৰন্থ সব সময় থাকত। জীবন সম্পর্কে বাউলদের ধ্যান-ধারণা, মন্ত্র-তন্ত্র, মন্দির, মসজিদ দেবতা নয় বরং মানব দেহ,আত্মা বা পরমাত্মাই তাদের সাধনার মূল লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িকতাহীন ঐ স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের প্রতি কবিগুরু ছিলেন বিশেষ কৌতূহলী ও উৎসাহী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ফকির লালন সাহেবর গানের সংগ্রাহক।
এ প্রসঙ্গে ড. শ্রী সুকুমার সেন মহাশয় বলেছেন-“বাউল গানের প্রচলন আমাদের দেশে চির দিনই ছিল, কিন্তু ভদ্র শিক্ষিত সমাজে তাহার কোন মূল্য ও মর্যাদা ছিল না। বাউল গান রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার বলিলে বেশি বলা হয় না। রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ রস পিপাসু কবিচিত্ত অবজ্ঞাত ও তুচ্ছ বলিয়া অবহেলিত অনেক রচনায় নব নব সৌন্দর্য্য প্রকাশিত করিয়া বাঙ্গালা সাহিত্যের রস সম্পদ বহুগুণিত করিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের দিয়াই আমরা বাউল গানের অতীন্দ্রিয় রস অনুভব করিতে শিখিয়াছি। রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে বাউল গানের প্রভাব সামান্য নয়। বাউল গানের সংগ্রহেও রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা প্রথমত ও শ্রেষ্ঠতম। “২
রবীন্দ্রনাথ বাউলগান ও বাউলতত্ত্বের প্রেরণা বাংলার রাঢ় অঞ্চল ও পূর্ববঙ্গের নানা অঞ্চলের বাউল সাধকদের রচিত গান ও ধর্ম সাধনা থেকে লাভ করলেও তাঁকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল লালন শাহের সংস্পর্শ ও তাঁর রচিত গান। বিখ্যাত লালনগীতি-“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”-গানটি তরুণ রবীন্দ্রনাথের মনে দীক্ষা মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল।
এরই সুবাদে অজস্র রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাউল গানের সুর প্রতিফলিত হয়েছে বলা যায়। যেমন-প্রচলিত বাউল গান ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা। ‘হরি নাম দিয়ে জগত মাতালে’-অনুকরণে কবি গুরুর গান ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে। ‘নদীয়া অঞ্চলের বৈষ্ণবীয় বাউল গান -‘সোনার গৌর কেন কেঁদে মরে ও নরহরি’-গানটির অনুসরণে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘ও আমার দেশের মাটি।গগন হরকরার- ‘ও মন অসার মায়ায় ভুলে’-গানটির অনুকরণে-‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, এবং ‘দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা’-গানটির আদলে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ ইত্যাদি অগনিত গান রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন।
প্রথম দিকে বাউলের সম্প্রদায়গত বন্ধন দৃঢ় ছিল না। ব্যক্তিমনের ব্যাকুলতা আর অভিযোগই প্রকাশ পেয়েছে আদি পর্বের রচনা গুলিতে। পরবর্তীকালে বাউল সম্প্রদায় একটি সংকীর্ণ ধর্মের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়েছে বলে এ থেকে লোকসংগীতের জীবন মুখিতা লোপ পেতে চলেছে।
দেহতত্ত্ব ও মানবজীবনের অসারতার গানগুলি পরবর্তীকালের রচনা। এগুলি স্বভাবতঃ লোকসংগীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেনি। আধুনিক কালের বাউল গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -“অধিকাংশ আধুনিক বাউল গানের অমূল্যতা চলে গেছে। অচলিত সস্তা দামের জিনিস হয়ে পথে বিকোচ্ছে। তা অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ।”৩
লোকসংগীতের বিষয়গত বৈচিত্র্য সহজে বোঝা যায় এর গঠনগত রূপ অনির্দিষ্টে। উচ্চতর সমাজ সৃষ্ট উচ্চাঙ্গ- বা ধ্রুপদী গানের দুই থেকে চার কলি ভাগের মতো লোকসংগীতের নিয়ম নেই। টুসু-ভাদু সহ অনেক লোকসংগীতের এক বা দুই তুক বারংবার সুরে আবৃত্তি করা হয়। আবার চার বা ততোধিক তুক বা কলিতে কিংবা বিবৃতিধর্মী ও আখ্যানধর্মী সুদীর্ঘ রচনায় নানা প্রকারের গান রচিত। যেহেতু সুর সর্বস্বতাই লোকসংগীতের ধর্ম, সেজন্য ভাষার দৈন্য, অসংলগ্নতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে অনেক লোকসংগীতে। প্রেমমূলক লোকগীতি মোটামুটি ভাবে সমৃদ্ধ রচনা, আনুষ্ঠানিক গীত দীর্ঘ ও আবৃত্তি প্রধান। বৃহৎ রচনা হয় পটুয়া ও বিবিধ আখ্যানমূলক গীত গুলিতে, এতে সুরের ভূমিকা কম।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবার আমরা লোকসংগীতের সর্বজন সম্মত প্রধান দুটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি।
১| অঞ্চল ভিত্তিক লোকসংগীত।
২| বিষয়বস্তুগত লোকসংগীত।
অঞ্চল ভিত্তিক লোকসংগীতকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
ক) পাহাড়ের গান।
খ) নদীর গান।
গ) সমভূমির গান।
বিষয়বস্তুগত লোকসংগীতকে আমরা চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি-
ক| উৎসব ও অনুষ্ঠানের গান।
খ) কর্ম ও শ্রম কেন্দ্রিক গান।
গ) প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের গান।
ঘ) ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের গান।
কর্ম ও শ্রম লোকসংগীতের একটি মৌলিক প্রেরণা। কৃষি-সমাজে কৃষির সঙ্গে কর্ম ও শ্রম জড়িত। এরই প্রেরণায় উর্বরতা তন্ত্র ভিত্তিক বহু উৎসব ও সেই সমস্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে বিচিত্র সংগীতের উৎসারিত ঘটেছে লোকসমাজে। সেই সংগীত গুলির মধ্যে একদিকে যেমন লোক সমাজের আশা ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তেমনি বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও ধ্বনিত হয়েছে রূপকের আড়ালে।
বর্তমানে বৈশিষ্ট্যহীন লোকসংগীত আমাদের মনোরঞ্জন করছে বটে তবে যথার্থ লোকসংগীত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবেশনে যথেষ্ট যত্নবান না হলে কবিগুরুর প্রিয় লোকসংগীতের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য গুলি অবলুপ্ত হবে।
তথ্যসূত্র
১|স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ ; সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান ; পৃঃ ৩
২| শ্রী সুকুমার সেন; বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৯৯২
৩|দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত ; বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, ২০০৪,পৃঃ ১৪২-১৪৩
_____________________________________
সহযোগী গ্রন্থ
১| প্রঞ্জানানন্দ স্বামী : সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ,১৯বি, রাজা রাজকৃষ্ণ ষ্ট্রীট, কলকাতা, ১৯৬৫
২| সেন শ্রী সুকুমার : বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, কোলকাতা।
৩| হক এনামুল: লোকসংগীত ও গণসংযোগ, আকাদেমি অব ফোকলোর, কোলকাতা, ১৯৯৯
৪|বড়ুয়া সুধাংশু বিমল, চৌধুরী দুলাল (সম্পাদিত) : বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, আকাদেমি অব ফোকলোর, ২০ বি,সেন্ট্রাল রোড, কোল-৬, ২০০৪
৫| সাহা রীতা: লোকসুরাশ্রয়ী রবীন্দ্র সঙ্গীত, (গবেষণা অভিসন্দর্ভ), লোকসংস্কৃতি বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের নদীয়া, ২০০৬