লোকবিশ্বাস থেকে লোকসংস্কারে সৃষ্ট কোচবিহারের লোকনৃত্যের রূপরেখা
অম্বিকা ভাণ্ডারী, গবেষক, সঙ্গীত ভবন, বিশ্বভারতী
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে বাস করতে মানুষ অভ্যস্ত। একই ভৌগলিক, সামাজিক,অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিবেশে জীবনচর্চায় অভ্যস্ত সংহত জনগোষ্ঠী যা বিশ্বাস করে অথবা সংস্কার বলে গৃহীত হয়, তাই হলো লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার। এই সংস্কারে ব্যক্তিগতভাবে কেউ আবদ্ধ নাও হতে পারে, বলাবাহুল্য তাতে গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস ও লোকসংস্কার এ কোনো প্রভাব পড়ে না। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে প্রচলিত লোকবিশ্বাস লোকসংস্কার কে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথাক্রমে,
ক) শাস্ত্রীয় লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার
খ) অশাস্ত্রীয় লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার।
এসব সংস্কার ও বিশ্বাস বিশেষভাবে শাস্ত্রসম্মত( শাস্ত্রীয় পন্ডিত প্রণীত, শ্রম প্রথার ঋষিদের মুখনিসৃত ইত্যাদি) সেগুলি হল শাস্ত্রীয় লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার। আর যে সমস্ত সংস্কার ও বিশ্বাস স্বাস্থ্যসম্মত নয় কিন্তু পূর্বপুরুষ থেকে লোকো প্রচলনের ব্যাপক বিস্তার বা প্রভাবের কারণে জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের মনে আজও বসে আছে সেগুলি হল অশাস্ত্রীয় লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার।
যেমন:- পথচারী বা যানবাহনকর সামনে বিড়াল রাস্তা কাটা, কোথাও কাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় কেউ হেঁচে দেওয়া ইত্যাদি। এই অশাস্ত্রীয় সংস্কার অপেক্ষা শাস্ত্রীয় সংস্কার অনেক বেশি দৃঢ় ও মজবুত।লোকসংস্কারের সঙ্গে ঐতিহ্যের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সংহত জনসমাজের বৃহৎ বলয়ের যেখানে লোক সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে, সেখানে প্রথা ও বাস্তবকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে। প্রাচীনকালে প্রচলিত লোকাচার গুলি ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করেছে অনুরূপভাবে লোকসংস্কৃতিকে ও সমৃদ্ধ করেছে।
সেকালের সমাজ জীবনের মধ্যে লোক দেবদেবী ও লোকাচার নিহিত আছে। দুর্ভিক্ষ রোধ, খরা রোধ, বংশবৃদ্ধি, আরোগ্য কামনায় ও বিবাহের জন্য লোকো দেবদেবীর কাছে পূজা অথবা নৃত্যের মাধ্যমে আরাধনা সঙ্গবদ্ধ জীবনের লোকাচারের ও লোকসংস্কৃতির কথাই প্রমাণ করে। অতএব সঙ্গবদ্ধ লোক সংস্কৃতির বিশ্বাস ও সংস্কার এই দুটির মাটির গন্ধ থাকা গ্রামীণ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের পরিচয় বহন করে চলেছে এমন দাবি অযৌক্তিক নয়।
এইবার এইসব তথ্যাদি সাপেক্ষে দৃষ্টান্তস্বরূপ যথাক্রমে ষাইটোল নৃত্য ও হুদুম দেও নৃত্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি। এই দুই লোকনৃত্য আমার গবেষণার কার্যের অন্তর্ভুক্ত তাই কোচবিহারের এই দুটি লোকনৃত্যের মধ্যে দিয়ে কিভাবে মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মায় ও পরবর্তী ক্ষেত্রে সংস্কার হয়ে ওঠে, সঠিকভাবে লোকায়ত সংস্কৃতির সাথে কতটা সমন্বয় সাধন করে তা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করছি।
ষাইটোল নৃত্য প্রসঙ্গে লোকপ্রচলিত ভাবনা
পৌরাণিক কাল থেকে শুরু করে আজও মানুষ বিশ্বাস করে বন্ধ্যা নারীরা ষাইটোল পূজা করে ষাইটোল দেবীকে সন্তুষ্ট করে তার কৃপাধন্য হতে পারলে সে অবশ্যই সন্তানবতী হবে। সন্তানের জন্ম এবং মঙ্গল কামনায় এখনো কোচবিহার জেলায় প্রায় প্রতিটি গ্রামের রমনীরা নিষ্ঠাভরে এই পূজা করে থাকেন। এই পূজার উৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি আকর্ষণীয় কাহিনী আছে–
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য গুলিতে দেখা যায় মর্তে নিজেদের পূজা প্রচারের জন্য দেব দেবীরা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। তাদের কৃপালাভে দুঃখীর দুঃখ মুছে গিয়েছে, তার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই দেবীর মাহাত্ম্য মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ষাইটোল দেবীর পূজা প্রচারের কাহিনীর মূলে রয়েছে নীলা। নীলার বিয়ে হয় রায়ধন সাধুর সাথে। রায়ধন সাধুরা ছিলেন সাত ভাই।
রায়ধন সাধুর সব ভাইয়ের সময় মত সন্তানের জন্ম হয় কিন্তু নীলার কোন সন্তান হয় না, তাকে নানান গঞ্জনার মুখে পড়তে হয়। শুধু তাই নয় তার ওপর মানসিক অত্যাচার চলতে থাকে, তাকে কোথাও যেতে দেওয়া হয় না, বাড়িতেই এক ঘরে করে রাখা হয় তাকে। নীলা বাপের বাড়ি যেতে চায় কিন্তু কেউ তাকে অনুমতি দেয় না শুধু মাত্র তার এক দেবর অনুমতি দান করে। তারপর সে বাপের বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয় কিন্তু নীলা বাপের বাড়ি না গিয়ে সে নদীর তীরে আসে, আত্মহত্যার জন্য দৃঢ় সংকল্প করে। এমন সময় ভোর বেলায় নীলা দেখে দেব দেবীরা নদী পার হচ্ছেন। নীলা দেবীদের কাছে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু কোন দেবী তাকে নৌকা স্পর্শ করতে দেন না। সুবচনী দেবী নিজের নৌকা স্পর্শ না করতে দিয়ে নীলাকে পরবর্তী দেবী ষাইটোলের নৌকা স্পর্শ করতে বলেন এবং তাতে তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে এই প্রতিশ্রুতিও দেন। নীলা তাই করে, দেবী ষাইটোল এর নৌকা স্পর্শ করার পর দেবী নীলার কাছে নৌকা কষ্টের কারণ জানতে চাইলেন, নীলা তখন তার মনস্কামনা সকাতরে দেবীর কাছে নিবেদন করে, সব শুনে দেবী তাকে ধুলা পড়া দিলেন এবং যমজ সন্তান এর বর দিলেন। এরপর গর্ভবতী হয় এবং দেবী ষাইটোলের আশীর্বাদে যমজ সন্তানের জন্ম দেয়। তারপর থেকেই নীলা দেবী ষাইটোল এর পূজা শুরু করে।
শোনা যায় বন্ধ্যা নারীরা এই পূজা করলে বা করালে সন্তানসম্ভবা হয়ে থাকেন এবং সুন্দরভাবে সন্তানের জন্ম দেয়। নীলার সেই বিশ্বাস থেকেই আজও একটি সংস্কার হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
ষাইটোল পূজায় সমস্ত এয়ো স্ত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। এই পূজার পুরুষদের ভূমিকা থাকেনা, শুধুমাত্র ঢাকি থাকেন একজন পুরুষ। এই পূজায় প্রথমে দেবীর আবাহন, ঘট সৃজন, সিঁদুর সৃজন, ধুপ সৃজন এবং তারপর ফুল দেওয়া হয়। নীলা ও রায়ধন সাধুর উপাখ্যান গাওয়া হয় সেখানে। এই পূজার সাথে সাথেই লোকগান ও নৃত্য চলতে থাকে। দুটি ষাইটোল গানের উদা্হরণ দেওয়া হল।
ষাইটোল বা সাইটোল
ষাইঠ মা সাটিয়া
কলা খায় আটিয়া (বিচা কলা)[১]
আবার
ষাইটোল মা ষাইটোল মা
তুই আসিনু আমার ঘরে
তোর বরে মা পুত্র পাইলাম কোলে
তোকে বানেয়া আনলাম মালাকারের ঘরে
পূজা খাবার বইসেক মা তুই আমার ঘরে। [২]
জলপাইগুড়ি জেলায় এবং বাংলাদেশের রঙপুর জেলাতে ষাইটোল নৃত্যগীতির প্রচলন আছে। রঙপুরে একে ষাইটোর বা সাইটোর বলে। অঞ্চলভেদে ষাইটোলের মঞ্জুসের আকার, উপাদান ও আচার ভিন্নতা হয়ে থাকে।
হুদুম দেও নৃত্য সম্পর্কে লোকপ্রচলিত ভাবনা:-
হুদুম দেও বৃষ্টির দেবতা। বর্ষাকালে অনাবৃষ্টি হলে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করে হুদুম দেও দেবতাকে সন্তুষ্ট করলে অবশ্যই বৃষ্টি হবে। পূজার প্রচলন শুধু যে উত্তরবঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়, দিনাজপুর অধুনা বাংলাদেশের পূর্ব দিনাজপুর, রংপুরে দেখা যায়। হুদুম দেও পূজার একটি ছোট কাহিনী রয়েছে। এই পূজার ইন্দ্র, হুদুম,বরুণ দেবতা কে স্বামী রূপে কল্পনা করে থাকেন। প্রাচীনকালে যখন বৃষ্টি হতো না তখন চারিদিকে খরা হতো, অনাহারে মারা যেত বহু লোক তখন তারা ইন্দ্র ও বরুনদেবের পূজা করতেন তার সাথে পূজা করতেন। শোনা যায় এই হুদুম হলো একটি ছেলে যে সবসময় নগ্ন হয়ে থাকতো,সে কোন মেয়েদের উপর আকৃষ্ট হতো না। আবার জোরপূর্বক বস্ত্র পরিয়ে দিলেও তার গায়ে লাল চাকার মত গোল গোল দাগ হয়ে যেত। তাই তার জামা-কাপড় পুনরায় খুলে দিতে হতো এই হুদুম তার মায়ের কুমারী অবস্থায় সন্তান। তার মা অর্থাৎ বসুমতি কুমারী অবস্থায় অনাবৃষ্টির জন্য পূজা করতে গিয়েছিলেন। ইন্দ্র দেবের আশীর্বাদে সে গর্ভবতী হয় এবং তখন চারিদিক অনাবৃষ্টি হয়েছিল। বসুমতির প্রসবের পর বৃষ্টি হয় তাই তখন থেকে এই পূজার প্রচলন হয়ে থাকে এবং এই পূজার নাম দেওয়া হয় হুদুম দেও।’হুদুম’ শব্দটি এসেছে-
উধুম> উহম>হুদুম কিভাবে। উধুম বা উদ্দাম ব্যবহৃত হয়েছে নগ্ন অর্থে।
এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু হয় হুদুম দেও পূজা।বর্তমানে এই নৃত্যটি উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামগুলি এখনো হয়ে থাকে।প্রাচীনকালের সেই বিশ্বাস থেকে ধীরে ধীরে সেটি সংস্কারে পরিণত হয়েছে যে, অনাবৃষ্টি হলে হুদুম পূজা করলে বৃষ্টি হবে। এই হুদুম পূজাতে মেয়েরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন।
সাত থেকে আটটি মেয়ে মিলে এই পূজা করে থাকেন। এই পূজায় সবাই নগ্ন অবস্থায় থাকে, চুল খুলে, উলুধ্বনি দিয়ে পূজা আরম্ভ হয়ে থাকে। হুদুম পূজার ব্যবস্থায় দেখা যায় শৃঙ্গার ভাবধারা অবলম্বন করে নৃত্যগীত সহযোগে সর্বতভাবে বৃষ্টির দেবতা কে আবাহন করা হয়।
অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে সমাজে মানুষের মনে ঘটনাক্রমে জাগরিত হয় বিশ্বাস।কোনো বিষয় বা ঘটনা কেন্দ্রীয় বিশ্বাসে আবদ্ধ মানুষ যখন তার ভাবনার সাথে বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটতে দেখে বারংবার তখনই লোকবিশ্বাস পরিণত হয় লোকপ্রচলিত সংস্কারে।এক্ষেত্রে বলি দেবদেবীর সন্তুষ্টির মূল পন্থাই হল নৃত্যের আঙ্গিকে আরাধ্য দেবতার পায়ে আত্মনিবেদন তথা আত্মসম্পূর্ণ।
প্রচলিত বিশ্বাস লোকসংস্কার লোকনৃত্য সবই লোকসংস্কৃতির আঙিনায় নিবদ্ধ। আজ আমরা লোকসংস্কৃতির মূল অঙ্গ হিসাবে লোকনৃত্যকে যেভাবে পাই তার পূর্ব অন্তর্নিহিত সত্য সেই বিশ্বাসী মনের চিরাচরিত লোকসংস্কারই।
তথ্যসূত্র-
১। https://www.facebook.com/ত্রৈমাসিক-লোকসংস্কৃতি-104332141290946/
২। তদেব ৩। দাস,অভিজিৎ।উত্তর প্রসঙ্গ,এৈমাসিক পএিকা,অক্টোবর ২০০৮।
৪। দে সরকার,দেবব্রত।প্রান্তিক প্রথম সংখ্যা,বৈশাখ ১৪১৭,আরতি দে সরকার,শিপ্রা ঘোষ, কোচবিহার। সাক্ষাৎকার-
৫। শুভাশিস শীল দুপুর ৩ টে ১৩.৬.২০১৩ মাথাভাঙ্গা
৬। ফুলতি গিদালি সকাল ১০ টা ২৭.১২.২০১৫ পুঁটিমারি,দিনহাটা
৭। মন্তরা বর্মণ বিকাল ৫ টা ১৯.৯.২০১৯ পুঁটিমারি-১, দিনহাটা- ১
৮। ননীবালা বর্মণ বিকাল ৫ টা ১৯.৯.২০১৯ পুঁটিমারি-১, দিনহাটা- ১