July 1, 2021

Humanistic Philosophy of Lalon and Tagore Song

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Srabani Sen, Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, Tarakeswar, Hooghly, e-mail-srabanisn1@gmail.com Mobile no- 6290242709

Dr. Srabani Sen

Assistant Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, Tarakeswar, Hooghly

e-mail-srabanisn1@gmail.com Mobile no- 6290242709

Baul is a secular sect ( Lokayata Darsana). Baul the popular cultural way of life, is mainly dependent upon songs which are written by Lalon also known as Lalongiti. Lalon Fakir is the main pioneer and the greatest
spokesperson of the Baul tradition. Baul songs reflect the Baul philosophy of Dehototto. Lalon’s philosophy of humanity rejects all distinctions of caste, class and creed and takes a stand against religious conflicts and racism. They have no social and religious hierarchy in their tradition. They always keep themselves engaged in searching for manera manusa. Rabindranath Tagore’s intimate involvement with Bauls, their philosophy and their songs. Their relationship with Bauls began when Tagore was introduced to their songs during his middle youth at Shelaidaho. Rabindranath used the Baul tunes to create a variety of songs. His association with Baul’s songs and Baul’s way of life became deeper and deeper with time, the Baul- world gradually emerged as a powerful metaphor which served him as a model for, more perfect form of human community.

রবীন্দ্রনাথের বাউল দর্শন ও সঙ্গীত

ড.শ্রাবণী সেন

বাউল বাংলার  সংস্কৃতির অঙ্গ। ঐতিহাসিকভাবে এবং তত্ত্বগতভাবে বাংলার বাউল সাধনা উপনিষদ, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব এবং ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারার সাথে যুক্ত। বাউলের বাণী ও সুর একান্তই বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ‘বাউল’ শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয় শ্রীচৈতন্যদেবের মুখে।’বাতুল’ শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উদ্ভব। আবার অনেকের মতে বাউল এসেছে ব্যাকুল শব্দ থেকে। কেউ কেউ বলেন বা অর্থে আত্ম এবং উল অর্থে সন্ধানী অর্থাৎ এই বাউল সাধকেরা হলেন আত্মানুসন্ধানী উণ্মত্ত সাধক।

 বস্তুত বাংলায় বাউলের কাল ঊনিশ শতক। প্রখ্যাত বাউল শিরোমণি লালন শাহ, পূর্ববাংলা আর পশ্চিমবাংলার রাঢ় অঞ্চলের কিছু বাউলের দ্বারা হৃদ্য এই বাউলিয়া সাহিত্য জগৎ। বস্তুত বাঙালি মানসের  প্রকাশ ক্ষেত্রের দুটি জগৎ – বৈষ্ণব পদাবলী আর বাউল পদাবলী। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত কবিতায় যার উল্লেখ পাওয়া যায় –

কীর্তনে আর বাউলের গানে

আমরা দিয়েছি খুলি

মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে

দ্বার ছিল যতগুলি।

  বাউল লোকজীবন থেকে উৎসারিত। এর বাণী ও সুর এই জীবনেরই ফসল।     গভীর বাণীকে সরল ভাষায় বলা হয়- আর গ্রামীণ সুরে ফুটে উঠে তার গীতরূপ। রবীন্দ্রনাথই বস্তুত পরিশীলিত  সাহিত্য – জগতে বাউলকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি দেন গান সংগ্রহ করে, নিজের সংগীত সষ্টিতে তার ঋণ গ্রহণ করে এবং সর্বোপরি বিশ্বের দরবারে বাউলকে পরিচিত করে। কবি সাধক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বসিয়েছেন বাউলের পাশে –

কবি আমি ওদের দলে

আমি বাত্য আমি মন্ত্রহীন।

রবীন্দ্রনাথ শুধু বাউলকে বিশ্বের দরবারে উপস্হিত করে  কিংবা নিজেকে বাউলের দলভু্ক্তই করেন নি, আপন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সারস্বত ঋণ গ্রহণ করেছেন বাউলের কাছে। গান সংগ্রহ, প্রকাশ এবং অনুবাদ কর্মের বাইরে নিজের সৃষ্টির জগতে বাউলকে বসিয়েছেন বিশেষ আসনে।

বাউল প্রেমের সাধক। তাঁদের প্রেম মানব আশ্রয়ী। মানুষের মধ্যেই তারা মনের মানুষ,অধরা মানুষ,সহজ মানুষ,রসের মানুষ,সোনার মানুষ, ভাবের মানুষ, কিংবা এদেরই প্রতীক অচিন পাখীকে খোঁজেন। বাউলের এই খোঁজা চলে মানবদেহের মধ্যেই এবং তার প্রাপ্তিতেই বাউলের সিদ্ধি।

রবীন্দ্রনাথ বাউল সম্প্রদায়ের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্র বাউল চিন্তা ও মরমী ভাবনা তাঁর জীবনীচেতনার অন্তর্গত বিষয় হিসেবে বিবেচিত। রবীন্দ্রভাবনা, চিন্তা ও আলোচনায় বাউল প্রসঙ্গ নানা ভাবে এসেছে। মূলত শিলাইদহের বাউল সম্প্রদায়ের প্রেরণা ও প্রভাবেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন ‘রবীন্দ্রবাউলে’। তাঁর শিল্পকর্ম পোষাক পরিচ্ছদ, ধর্মদর্শন চিন্তায় বাউল ভাবের পরিচয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় । অঞ্চল বিশেষে বাউল সম্প্রদায়ের  ভাবধারা, তাদের আধার, তাদের গানকে তিনি তার প্রবন্ধে, নাটকে, নৃত্যে ও সর্বোপরি দার্শনিকতায় বার বার বিভিন্নভাবে ধরার চেষ্টা করেছেন।

বাউলের দর্শন ও ধর্মচিন্তার সঙ্গে গুরুদেবের অন্তরাত্মার যোগ ঘটেছিল এবং গুরুদেব  তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টির সঙ্গে বাউলদের ধর্মসাধনা ও গানকে যুক্ত করেছিলেন। বাউলের মত রবীন্দ্রনাথও বাহ্যিক সাম্প্রদায়িক ধর্মকে অগ্রাহ্য করে অন্তরের ধর্মকেই আপন বলে মনে করতেন। বাউলের ধর্ম নিজেকে জানার ধর্ম,সহজ মানুষেরর ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – আমার ধর্ম কী, তা যে আজও আমি সম্পূ্র্ণ এবং স্পষ্ট করে জানি এমন কথা বলতে পারিনে – অনুশাসন আকারে তত্ত্ব আকারে কোন পুঁথিতে লেখা ধর্ম সে তো নয়। অন্যভাবে এই কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় লালনের গানে –

সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন

লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান

শিলাইদহে বসবাসকালে  গুরুদেব উপলব্ধি করেন এই বাউলরা  এমন একজন মানুষের কথা চিন্তা করেন, যিনি গোপনে প্রতি মানুষের অন্তরে বিরাজমান এবং   উপলব্ধি করেন উপনিষদের মানুষ, যিনি নিরাকার এবং সর্বমানবের অন্তরে বিরাজিত সেইরূপ এক মানুষের সন্ধানে এরাঁ মগ্ন, যাকে প্রেমের দ্বারা, ভালবাসার ঐকান্তিক আকাঙ্খার দ্বারা অনুভব করে গভীর এক ঐশ্বরিক আনন্দে মগ্ন হওয়া যায়। এই কারণে গুরুদেবের পক্ষে তাঁর অন্তরের অন্তর্যামী বা জীবনদেবতাকে, নিরাসক্ত প্রেমের আবেগে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকে না। বাউলদের ধর্মচিন্তা দেশবাসীকে তাঁর গানে, গদ্যে ও পদ্যের মাধ্যমে তিনি রূপ দিতে উৎসাহিত  হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের বাউল দর্শন ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে দেখা যায় আপন জনের মত তার অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছেন, আত্মীয়তা স্হাপন  করে একাত্ম হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রাণধর্মের প্রেরণা আর বাউলের প্রেরণার উৎস অভিন্ন হলেও বাউলের মনের মানুষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার ঐক্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়। বাউলদের যা ‘মনের মানুষ’ গুরুদেবের ‘জীবন দেবতা’ বা অন্তর্যামী তাই। গুরুদেব বলেছেন “অন্তরতর হৃদয়াত্মা”,উপনিষদের এইবাণী এদের  মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল। ‘মনের মানুষ’ বাউলদের অন্তরে বাস করে যেভাবে লুকোচুরি খেলা খেলে চলেছেন, গুরুদেবের ‘জীবন দেবতা’ বা অন্তর্যামীও তাঁর সঙ্গে সেই ভাবেই লুকোচুরি খেলেছেন। গুরুদেবের  পূজা, প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের গানেও তাই কোন একজনকে না-জানার, না-পাবার বেদনার প্রকাশিত  হয়েছে।

বাউলের কাছে দেহই দেবালয়, কায়া সাধনাই সারকথা। সাধারণ সহজ অথচ প্রতীকী ভাবনায় সেই তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। লালন শাহের বিখ্যাত গান- খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়। অচিন পাখী – দেহ ও আত্মার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা অন্তর্যামী, অরূপ রতনকেও সেভাবে খোঁজা চলছে সারাজীবন –

তোমার খোঁজা শেষ হবে না মোর

তোমার অন্ত নাই গো। …..

লালনের পর গগন হরকরারার দ্বারা রবীন্দ্রনাথ সবথেকে বেশী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখীর’ মতই রবীন্দ্র বাউলকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সহিত আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ ও আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি; এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর  সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন একসময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’ শিলাইদহের বাউল গানের উদাহরণ  –

“কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।”

রবীন্দ্রনাথ ক্রমে বাউল তত্ত্বের  ভিতরে প্রবেশ করেছেন। বাউলদের গোপন সাধনক্রিয়া বা আচার অনুষ্ঠানে তাঁর আগ্রহ ছিল না। বাউলের গান তাদের সাধনার বড় অঙ্গ। এই গানের ভিতর দিয়ে তাদের গভীর অধ্যাত্মজিজ্ঞাসার প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ বাউল-ধর্মকে ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখেছেন, সেই সঙ্গে বাউলতত্ত্বকে তাঁর জীবনদর্শনের সমর্থনরূপেও গ্রহণ করেছেন।এই  রবীন্দ্র বাউলতত্ত্বের  প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচিতি সার্বিকভাবে তাঁর সঙ্গীত সত্ত্বার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ  নিজেও কিছু ‘বাউল’ গান রচনা করেছেন। সেগুলো বাউলের  অনুকরণ নয় বরং বলা যায় তা ‍‍‌‌’‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍রবীন্দ্রবাউলের‍‌’ রচনা -ভাবে ও রসে তা স্বতন্ত্র। স্বদেশী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ অনেক গান রচনা করেছিলেন যার সুর বাউলের থেকে নেওয়া। এই গানগুলো স্বদেশ  প্রেমের উদ্দীপনামূলক গান।

শিলাইদহের বাউলদের গানের বাণী ও ভাবধারা  রবীন্দ্রনাথের বহু গানে প্রতিফলিত হয়েছে-

মূল বাউল গান –

১)আমি কোথায় পাব তারে।

২)কথা কয় দেখা দেয় না

৩) খাঁচার ভিতর অচিন পাখী

৪)মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষণ

রবীন্দ্রনাথের গান –

১) আমি তারেই খুঁজে বেড়াই

২) আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

৩)আমার মন যখন জাগলি নারে

৪)তোর গোপন প্রাণে একলা মানুষ  যে

বাউল সাধনার মূল দর্শন গুরুদেব নিজের জীবনদর্শন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বলা যায় রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই একজন ঋষি ও বাউল সাধক।

তথ্যসূত্র

১। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়-বাংলা সাহিত্যের    ।ইতিবৃত্ত  

২। শান্তিদেব ঘোষ­- রবীন্দ্রসঙ্গীত।

৩। সুকুমার সেন -বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস(৩য় খণ্ড)।

৪। শ্রী অমল মুখোপাধ্যায়-  রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিক্রমা।

৫। সুভাষ চধুরী- বীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্যর

৬। লীনা চাকী- রবীন্দ্রনাথ ও বাউল।