March 1, 2022

ভাব ও সুরের মেলবন্ধনে রবীন্দ্রনাথের গান

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড.শ্রাবণী সেন

সঙ্গীতের দুটি অংশ – ভাব ও রূপ অর্থাৎ বাণী ও সুর। বলা যায় সেই বাণী ও সুরের সমানুপাত থেকে শুদ্ধসঙ্গীতের সৃষ্টি। বাণী ও সুরের সমানুপাতের সঙ্গে মিশে থাকে তাল ও লয় এবং গায়কের নিজস্ব ঢঙ। গায়কের যথেচ্ছ সুরবিহারের ফলে গানের ভাব তথা বাণী তার আপন ভাবরসের মহিমা হারাতে পারে। এই প্রবণতার কথা মনে রেখেই রবীন্দ্রনাথ রাগরাগিণীর দাপট থেকে গানের ভাবকে মুক্তি দিতে সচেষ্ট ছিলেন তাঁর সমগ্র গীতরচনার সু্দীর্ঘ পর্বে। ফলে একমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভাবের এক নির্দিষ্ট অভিমুখ স্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করা সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের গানে প্রচ্ছন্ন আছে তাঁর মনের ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, প্রথম বয়সে তাঁর গান রচনা ছিল ‘ভাব বাৎলানোর জন্য’ আর পরবর্তী যে সব গান তা ‘রূপ দেবার জন্য’। বলা যায় রবীন্দ্রনাথের গানের জীবন অনেকটাই জড়িয়ে গেছে শেষের দিকে শান্তিনিকেতনের নাচ আর গানের দলের সঙ্গে৷ সংগীত ভবন আর কলাভবনের যৌথ প্রেরণায়  ভাব ও রূপের চর্চা, নতুন নতুন গানের সঙ্গে নাচের লাবণ্য মেশা অভিনয়, নৃ্ত্যনাট্যের সদ্যতন উৎসার এবং তাতে অনুশীলন ও পরিশীলনের  রূপান্তর ও পরিমার্জনের সুযোগ  ঘটেছে। নতুন নতুন গানকে আবার বাধা হয়েছে নাচের তালে ও ছন্দে। ফলে স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি কাজে পেয়েছেন নিত্য নতুন উৎসাহ আর প্রেরণা। বসন্তোৎসব, বর্ষামঙ্গল, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি নানা অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে লেখা হয়েছে অজস্র গান। বাঁধা গানের সুর ও তালকে  বদলে দিয়েছেন। তাই স্বরলিপিতে একই গানের ভাব ও সুরান্তরের দু-রকম রূপ ও বাণী পাওয়া যায়। শেষ বয়সের সৃষ্টিনেশাভরা দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ যে শুধু একই গানের সুরান্তর করেছেন তা নয়, বাণীও  পালটেছেন। সুরান্তরের নমুনা দেখ যায় -‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদরদিনে’- গানটির একটা সুর ও তালগঠন সম্পূর্ণ তালবিহীন, অন্যটি দ্রুততালে বাঁধা – দুটি সুরই তিনি তুলে ধরেছেন। এ রকম সুরান্তরের খেলায় রবীন্দ্রনাথ মেতে থাকতেন। আসলে রবীন্দ্রনাথের গানে মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় এক গভীর শিল্পের তত্ত্ব। একটি কবিতায় তিনি বলেছেন –

তাঁহার কাজ ধ্যানের রূপ

বাহিরে মেলে দেখা।

– কথাটি রবীন্দ্রনাথ পরমস্রষ্টা সম্পর্কে বলেছেন। বলা যায় তাঁর অন্তরের সৃজনশীলতার ধ্যানে যে মূর্তি উদ্ভাসিত হয়েছে তাকে তিনি তাঁর লেখনীতে বা সুরে রূপ দিয়েছেন। তাই শুধু সুরান্তর নয়, পাঠান্তরও ঘটেছে। সেক্ষেত্রে এক গান দু-রকম বাণীতে বাধা হয়েছে। আবার তাঁর লেখা কবিতাকে যেমন সুরারোপ করেছেন, তেমনি গানকেও পরিবর্তন করেছেন কবিতায়। এ সবই ছিল রবীন্দ্রনাথের  পরিণত বয়সের সৃষ্টিশীলতার  লীলা। এই জন্যই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন প্রথম বয়সের গানে ভাব বাতলেছেন আর পরিণত বয়সে জেগেছে রূপের নেশা। তাই বলা যায় তাঁর ভেতরে প্রধান স্রষ্টা রূপকার প্রকৃতই একজন কবি, তাই গানের সুরান্তরের চেয়ে  পাঠান্তরের সংখ্যা বেশী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় –

হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।

বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে,

তোমার মোহন এল ভীষণ বেশে,আকাশ ঢাকা জটিলকেশে-

বুঝি এল তোমার সাধনধন চরম সর্বনাশে।

বলা যায় গানের ভাবগত দ্যোতনা, নির্মাণ ও পুননির্মান, সবই রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্দর মহলে প্রবেশের চাবিকাঠি। তাঁর গানের প্রতিটি পাঠান্তর গুরুত্বপূর্ণ। যেমন -‘হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর’ গানে ভাবান্তরে আসন্ন গ্রীষ্মের আগমন বার্তা বদলে গেছে আগত বসন্তের সংকেতে। গানের ভাব ও রূপে ধরা পড়েছে আসন্ন কালবৈশাখীর দৃশ্য। বেড়াভাঙার উদ্দামতায়  শুধু বহিঃপ্রকৃতি নয়, হৃদয়েও জেগে ওঠে প্রলয় মাতন। তাই চোখ পড়ছে মোহনমূর্তি নিসর্গের অন্তর্গত ভীষণরূপের। কবির হৃদয় বলছে আসন্ন প্রলয় চরম সর্বনাশের রূপে আনবে সাধনাগত প্রাপ্তি। পাশাপাশি এক পাঠান্তর ধরা পড়েছে –

           হৃদয় আমার, ওই বুঝি      তোর বৈশাখী ঝড় আসে।

বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে।

তোমার মোহন এল ভীষণ বেশে,  কুয়াশাভার গেল ভেসে

এল তোমার সাধনধন     উদার আশ্বাসে।

এখানে গানের অভিমুখ বদলে গেছে আসন্ন কালবৈশাখীররুদ্র রূপের পরিবর্তনে,  বেড়া ভাঙার মাতন আর উদ্দাম উল্লাসে প্রকৃতি যেন বাঁধনহারা। মোহনের ভীষণ বেশ রূপান্তরিত হয়েছে আর ঘনমেঘের পুঞ্জিত-সমাবেশ ম্লানায়মান কুয়াশাছিন্ন করে উদার আশ্বাসের বাণী শোনাচ্ছে। আবার গানের সঞ্চারী অংশেও পাঠান্তর করেছেন-

মূল পাঠ

বাতাসে তোর সুর ছিল না, ছিল তাপে ভরা।

পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা।

পাঠান্তর

অরণ্যে তোর সুর ছিল না, বাতাস হিমে ভরা।

জীর্ণ পাতায় কীর্ণ কানন, পুষ্পবিহীন ধরা।

মূলপাঠে আসন্ন গ্রীষ্মের পিপাসাতুর বেসুর বাতাস আর শুষ্ক কঠিন মাটির দৃশ্যের পাশাপাশি গীতিকার সদ্যশীতের জড়িমাচ্ছন্ন আর বেসুরো বাতাসকে করলেন হিমানীসম্পৃক্ত।  শীতের  অনিবার্য পাতাঝরা আর পুষ্পবিহীন প্রকৃতি চিত্রের রূপ –  জীর্ণপাতার কীর্ণকানন যেন চোখের সামনে ধরা দেয়। গানে বলেছেন-

মূলপাঠ

এবার জাগ্ রে হতাশ,আয়রে ছুটে অবসাদের বাঁধন টুটে-

বুঝি এল তোমার পথের সাথি বিপুল অট্টহাসে।

পাঠান্তর

এবার জাগ্ রে হতাশ, আয়রে ছুটে অবসাদের বাধন টুটে-

বুঝি এল তোমার পথের সাথি উতল উচ্ছাসে।

মূল আর পাঠান্তরের মিল থাকলেও বিপুল অট্টহাস বদলে গেছে উতল উচ্ছাসের সঙ্গে।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমুদ্রে ডুব দিলে পাওয়া যাবে অসংখ্য মণিমুক্তো, তাতে লেগে রয়েছে গভীর সাগরের স্বাদগন্ধ। পৃথিবীর আর কোন সংগীতকার রবীন্দ্রনাথের মতো এরকম ভাবতরঙ্গে  লীলা করেন নি। তাঁর গানের মধ্যে আছে মননের দীপ্তি, কবিতার ব্যাপ্তি ও সুরের গভীর রহস্যলোক।

   তথ্যসূত্র

১। শান্তিদেবে ঘোষ – রবীন্দ্রসঙ্গীত।

২। কিরণশশী দে – রবীন্দ্রসঙ্গীত সুষমা।

৩। প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী – রবীন্দ্রসঙ্গীত-বীক্ষা কথা ও সুর।

 ৪। শ্রী অমল মুখোপাধ্যায় – রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিক্রমা।

 ৫। সুভাষ চৌধুরী -রবীন্দ্রনাথের গান ও অন্যান্য।

ড.শ্রাবণী সেন-সহকারী অধ্যাপিকা, সঙ্গীত বিভাগ,তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ,তারকেশ্বর,হুগলী

e-mail- srabanisn1@gmail.com  Mobile no- 6290242709