বিচ্ছেদ-বিরহে জীবনগাথা : নকসী কাঁথার মাঠ
ড. শাশ্বতী সিনহাবাবু, সহ অধ্যাপিকা, শালডিহা কলেজ, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ
রবীন্দ্র প্রতিভা যখন বাংলা কাব্যের মধ্য গগনে প্রদীপ্ত, সেই সময়েই যতীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল , প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকগণ নূতন দার্শনিকতা নূতন আঙ্গিকে কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের সোচ্চার ধ্বনি উচ্চারণে উত্থিত, সেই সময়েই পল্লী বাংলার হৃদস্পন্দন থেকে এক মন-মাতানো রাখালিয়া সুর নিয়ে পল্লি প্রাণ কবি জসীমউদ্দীনের আবির্ভাব। জসীমউদ্দীন পল্লি বাংলার মরমি কবি, একেবারে খাঁটি ‘পল্লীকবি’ — স্বভাবকবি। বাংলার গ্রাম-প্রকৃতি, গ্রাম বাংলার মাটি-মানুষ, গ্রামের লোকসংস্কার–লোকজীবন ও লোককথা তাঁর কাব্যের মধ্যে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত রূপে ফুটে উঠেছে। অনাড়ম্বর অথচ জীবনের শিল্পমূল্যে সমৃদ্ধ তাঁর কবিতায় পল্লি বাংলার সহজ রূপটি চিত্রিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদকর্তা চণ্ডী দাসের মতো তিনি সহজ ভাবে সরল সুরে কবিতা রচনা করেছিলেন; সেজন্য তাঁর কবিতা পাঠকের মর্মমূল ছুঁয়ে যায়। অকৃত্রিম জীবনধারা, গ্রামের মানুষের দুঃখ-সুখ, আনন্দ-বেদনা, সবুজ ধানক্ষেতের শ্যামলিমা , ভাটিয়ালি গানের মধুর সুরমূর্ছনা, মন উদাস করা রাখালিয়া বাঁশি তাঁর কবিতার প্রেরণা ভূমি। ফলত সহজ সরল গ্রামের মিঠে সুরে গ্রামীণ ভাষায় পল্লি বাংলার চিত্রময়-বর্ণময় রূপকথা স্নিগ্ধ এক অপূর্ব জগৎ তাঁর কবিতায় রূপ পরিগ্রহ করেছে-পাঠককে যা এক গভীর নষ্টালজিক আবেগ-অনুভূতিতে গ্রামের প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
কবির জন্ম ১৯০৩ , মৃত্যু ১৯৭৬ মার্চ মাসে। ফরিদপুর জেলার একটি অন্তঃপাতী গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা মৌলবি আনসারউদ্দিন আহমদ, মা আমিনা খাতুন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ভাষা সাহিত্যে এম. এ। দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে গবেষণার কাজে দীর্ঘদিন সহায়তা করেছেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সুমধুর সম্পর্ক ছিল। ১৮২৭ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট উপাধিতে সন্মানিত হন। এছাড়া ছাত্রাবস্থায় জসীমউদ্দীন ‘কবর’ কবিতাটি রচনা করেন, এবং কবিতাটি সেকালের বিখ্যাত কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘কবর’ কবিতার মাধ্যমে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এক নতুন সুর ও সজ্জার উপকরণ এল :
“এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিতাটিকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে ছাত্র কবিকে দুর্লভ সম্মানের অধিকারী করেন। পরবর্তীকালে তিনি অনেকগুলি কাব্য রচনা করেন-রাখালী (১৯২৭), নক্সীকাঁথার মাঠ (১৯২৯), ধানক্ষেত (১৯৩১), বালুচর (১৯৩৪), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৪৭), এক পয়সার বাঁশি (১৯৪৮), ধানক্ষেত, সুচয়নী, ‘মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো’ ইত্যাদি। বিশেষ করে তাঁর ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পাঠক সমাজের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে।
অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে জসীমউদ্দীনের কবিসত্তা সম্পর্কে বলেছেন-“একেবারে সাদামাটা আত্মভোলা ছেলে এই জসীমউদ্দীন। চুলে চিরুনি নেই, জামায় বোতাম নেই, বেশবাসে বিন্যাস নেই। হয়তো বা অভাবের চেয়ে ঔদাসীন্যই বেশি। সরল শ্যামলের প্রতিমূর্তি। যে গ্রাম তারই পরিবেশ তার ব্যক্তিত্বে, তার উপস্থিতিতে। ………… কোনো কারুকলায় কৃত্রিমতা নেই, নেই কোনো প্রসাধনের পারিপাট্য। একেবারে সোজাসুজি মর্মস্পর্শ করার আকুলতা। কোনো ‘ইজমে’-র ছাঁচে ঢালাই করা নয় বলে তার কবিতা হয়তো জনতোষিণী নয়, কিন্তু মনোতোষিণী “-এই উক্তি এই কারণে যথার্থ যে, কবি জীমউদ্দীন পল্লি প্রকৃতির স্নিগ্ধ, কমনীয় মাধুর্য ও ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকজীবনের উপাদান দিয়ে তাঁর কাব্য জগৎ গড়ে তুলেছিলেন।
জসীমউদ্দীন জীবনে যেমন ছিলেন আত্মভোলা, অগোছালো ঠিক তেমনি তাঁর শিল্পকলাও যত্নসম্ভূত এবং সহজ সরল। অনায়াস সারল্য ও সহমর্মিতা তাঁর কবিদৃষ্টির দুই প্রধান সম্পদ। তিনি সম্পূর্ণরূপে মাটির কাছাকাছি কবি। তাই তাঁর কাব্যে লেগে আছে মাটির গন্ধ।
জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ গাঁথাকাব্য বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় এটির ইংরেজি অনুবাদ ‘The fie।d of the Embroidered Qui।t’ এবং আর একখানি একই ধরনের কাব্য ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ‘Gipsy Wharf’ নামে অনূদিত হয়ে পাশ্চাত্যদেশেও বিশেষ সমাদর ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ অসাধারণ জীবনকাব্য রূপাই ও সাজুর বিরহ-মিলনের কাহিনি এই কাব্যের বিষয়বস্তু। রূপাই-সাজুর করুণ বিয়োগাত্মক প্রণয় কাহিনি আশ্চর্য নিজস্ব কবিভাষায় , চৌদ্দটি অধ্যায়ে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত হয়েছে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র এই কাব্য সম্পর্কে সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন – ‘অনুরাগ ও মিলনে নিবিড় প্রেম, প্রতিরোধের দৃপ্ত কোরাস, অবশেষে বেদনা-বিধুর সমাপ্তি মিলে মৈমনসিংহ গীতিকার সার্থক উত্তরাধিকার।’ – এ গাঁও এবং ও – গাঁর প্রতিনিধি রূপাই ও সাজুর এবং নক্সী কাঁথার বুক ভরে আছে তাদের প্রেম ও বিরহ গাঁথা হলেও, এ গাঁও ও-গাঁও পানে অনন্ত রাত্রি-দিন অঝোরে চেয়ে থাকার নিবিড় গহীন সম্পর্কের মূক প্রকাশের বাণীবাহক হয়ে ওঠে এক চিরন্তন মানবিক প্রেম। দুই গাঁও- এর মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক এই মাঠই হল সাক্ষী দু’গাঁও এবং রূপাই ও সাজুর বিরহ-বিচ্ছেদের :
“মাঠের মাঝে জলীয় বিলের জোলো রঙের টিপ,
জ্বলছে যেনো এ গাঁর ও গাঁর বিরহেরি দীপ !”
এই মাঠকে ঘিরেই দুই গাঁও- এর মানুষের মেশামিশি। এ প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের ‘এক গাঁয়ে’ কবিতা মনে আসে – “…দুইটি পাড়া বড়ই কাছাকাছি / মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক।” এখানে মাঠের ফাঁকে পরে দুই গাঁও-এর কখনো সখ্যতা কখনো আবার কাইজা (মারামারি) , ফ্যাসাদ বেঁধে যায়-“এ গাঁর চাষী নিঝুম রাতে বাঁশের বাঁশির সুরে, ‘ওই না গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে!” এভাবেই দ্বন্দ্ব-মধুর সম্পর্কের মধ্যে এগিয়ে যায় দুটি গাঁ, তাদের সম্প্রদায়। যে ব্যথা এই দুই গাঁওকে বিরহের মধ্য দিয়ে একই সুতোয় বেঁধে দিয়েছে তা হল রূপাই ও সাজুর প্রেম-বিচ্ছেদ বিরহ-অবশেষে মৃত্যুর ইতিহাস। রূপাই সম্পর্কে কবির অসাধারণ বর্ণনায় আমাদের রূপাইয়ের জীবন্ত ছবি ফুটে ওঠে :
এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
কাঁচা ধানের পাতার মতো কবি- মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণে ছায়া।
রূপাইয়ের রূপের সাথে শ্যামল কালো মনোহর কৃষ্ণের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। চাষিদের কালো ছেলে রূপাই সবেতেই বিজয়ী। যেমন করে একদা কৃষ্ণ কালো হয়েও সমস্ত বৃন্দাবনকে তার প্রেমে নিমজ্জিত করেছিলেন — ‘কালোয় যে জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন, / তারির পদ রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।‘ আখড়াতে লাঠি খেলায় কিংবা জারি গানে রূপাইয়ের সমতুল্য মেলা ভার। এ-গাঁও এর ছেলে , বুড়ো সকলেই বিশ্বাস করে রূপাইয়ের নামেই এই গাঁ হবে নামী-দামি–
‘এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী’।
সেই রূপাই ভালোবাসল ও- গাঁও-এর মেয়ে সোনা অর্থাৎ সাজুকে। রূপাই ও সাজুর বিরহ-মিলনের কাহিনি এই কাব্যের মূল কথাবস্তু। রূপাই-সাজুর প্রেম পর্যায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরকে ছুঁয়ে গেছেন, বিশেষত বিরহিণী রাধার ভাবরূপ ছুঁয়ে গেছে রূপাই ও সাজুর অন্তরের বেদনাকে।
রূপাই-এর অসাধারণ কালো রূপ ও গুণের বর্ণনা করার পরে অপরদিকে ও-গাঁও-এর মেয়ে সাজুর রূপ সুষমা বর্ণনাকালে কবি জীমউদ্দীন পল্লির বুক ছানিয়ে পাখি-ফুল-প্রকৃতির অনুষঙ্গে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন :
“কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনায় খেলা,
তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।
গাঁদা ফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি,
চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি?”
চাষি মেয়ের রূপ দরিয়ায় রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়।‘ সেই বিশেষ অনুভব ও ভালোলাগার আবেশকে-যাতনাকে দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করে আশ্বিনের ঝড়। যে ঝড়ে রূপার রসুইঘর ও গোয়ালঘরের উড়ল চাল। রূপাই চলল ও-গাঁও-তে বাঁশ কাটতে; বাঁশ কাটার কালে সে দেখে:
“তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে-হলুদ পাখির ছা!
চাষী মেয়ের রূপ দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি।”
ওই গাঁয়ের কালো ছেলে সোনার বরণ মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি। ঘরেতে মন রয় না।, বাইরেও মন টেকে না, উদাসী-পাগলপ্রায় রূপাই-এর দেহ দিনকে দিন ক্ষীণ-মলিন হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে চণ্ডীদাসের রাধার পূর্বরাগের ভাব সাদৃশ্য চোখে পড়ে–‘রাধার কি হলো অন্তরে ব্যথা / বসিয়া বিরলে থাকনে একলে/ না শুনে কাহার কথা’। রূপাইয়ের বাঁশির সুরে গহীন ব্যথা ঝরে পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় জোর গুঞ্জন অন্যদিকে দুটি তরুণ হৃদয় যে বিনে সুতী মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছে – ‘বিভোল কুমার, বিভোল কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ।’ দুটি হিয়ার মাঝে চুপে চুপে প্রেম নিল দখল-কলঙ্কের কালি ছড়াল সাজুর মায়ের কানে–হাট-ফেরত রূপাই খালার (সাজুর মা) কাছে পেল অপমানের কশাঘাত, সাজু পেল মার। এই অপমানের দ্হন জ্বালার সাথে প্রেমের বেদনা একাকারে রূপাইয়ের কাছে fল্লির পথ-ঘাট-মাঠ সবই অচেনা ঠেকে। চোখের জলে মনের ব্যথায় মধ্যমাঠে রূপাই বসে কাঁদে – ‘ও তুই ঘরে রইতে দিলি না আমারে’(রাখালি গান) ভালোবাসার দ্হন জ্বালায় তার সকলি আঁধারময়। পিরীতের কলঙ্ক কালিতে রূপার চোখে সকলই শূণ্যময়, লোহা পারা দেহ, শাবলের সবল হাত, লাঠির লড়াই, জারি গান সকলই মনের ব্যথায়, সকলি হারায় :
“আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই,
কলঙ্ক কথা সবে জানিয়েছে, কেহ বুঝি বাকি নেই।
জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু;
উদাস দৃষ্টি যতদিকে চাহে সব যেন শূণ্য মরু।“
রূপার সমস্ত ব্যথার কান্না প্রকাশ পায় বাঁশের বাঁশিটিতে। যে বেদনা তার বুকে উপচে পড়ছে তা বাঁশিতে সুরে সুরে ভাসিয়ে দেয় পল্লি প্রকৃতিতে। উদাসী বাঁশির গহীন দুঃখ বিষাদ প্রতিমা রূপ পরিগ্রহ করে রূপাইয়ের চোখে শ্রাবণ আনে, হৃদয় ঝড়ে উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। নিশীথ রাত, নিঝুম প্রকৃতি, হাহা মাঠ, অষ্টমীর বাঁকা চাঁদ সকলি রূপাইয়ের নিবিড়তর ব্যথাসুতি হয়ে সমাসীন। রূপাই শত চেষ্টা করেও তার ভালোবাসার মর্মযাতনাকে ঢাকতে অপারগ। যেমন করে বাঁশির সুরে রাধা জাতি কুল-মান সকলকে জলাঞ্জলি দিয়ে ছুটেছিল কলিয়া বঁধুর কাছে কদম্বের তলে। কালার প্রেমে কলঙ্কের হার গলায় পরতে দ্বিধা করেনি। প্রেমের জ্বালায় জ্বলে দেহকে উপেক্ষা করে, মৃত্যুর পরোয়ানা স্বত্বেও ঝাঁপ দিয়েছে পিরীতি রূপ সায়রে। প্রেমের তীক্ষ্ম বানে যার হিয়া বিদ্ধ করেছে সেই ব্যথা। যে ব্যথা, আনজনে কি বুঝতে পারে? সেই ব্যথার কাণ্ডারী যে তাকে সে-ব্যথা বোঝানোর জন্য রাধার একান্ত প্রার্থনা – ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা’। সেরূপ রূপাইয়ের ব্যাথা পড়শিদের মতো আনজান বুঝবে। কীকরে। তাই কলঙ্কের করাত তাকে কেবলই কাটতে থাকে।
অবশেষে এল শুভদিন, এল বড়াই বুড়ি রূপার মায়ের কাছে। এখানে দ্রষ্টব্য ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী হলেও বড়াই বুড়ি ছিল মধ্যস্থতাকারী। কবি জসীমউদ্দীনের ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ কাব্যে গভীর ভাবে ছায়া ফেলেছে ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য ও বৈষ্ণবপদাবলী-র বিরহিনী শ্রী রাধার প্রেম ও বিরহ দশার, প্রেমের কলঙ্ক বিয়ের উৎসবে হল কলহাস্য মুখর:
“কানা- ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে,
ঘোর কলি কাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে;
তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে,”
নতুন ঘর বাঁধার কালে বিপত্তি, আষাঢ় মাসের বিকার জ্বরে মরল।রূপাইয়ের মা। শোক-তাপ ভুলে নতুন চাষা ও চাষ পাতণী আবার ঘর , সে ঘর যে তাসের ঘর হবে জানত না তো কেউ। এই-গাঁ ও আর ও-গাঁও সুখে-দুঃখে পরস্পরের পানে চেয়ে নীরবে ভাগ করে নেয় শূন্যতা ও পূর্ণতা – ‘আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁও টির পানে / মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে।’ আর রূপার বাঁশি হল সুখের সহচরী, অর্থাৎ বাঁশির সুরে মরণ-বাঁচন, বাঁশি তার প্রাণ — এ বাঁশের বাঁশি। কৃষ্ণের অঙ্গের ভূষণ আর কালো রূপার অন্তরদ্যুতি।রূপাইয়ের বাঁশির সুর যেন বেজে ওঠে – ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে/ আমার মন যে বেড়ায় ঘুরে ঘুরে’। এই মর্ম সহচর বাঁশিটি যেন তার মনের মুক্তি। যাইহোক রূপাই আর লক্ষ্মীমন্ত বউ সাজুর কাঁচা সংসার সুখেই চলেছিল, কিন্তু এল সেই কালো রাত, বছির মামুর মুখে রূপাই শুনে তাদের এতদিনকার রক্ত- জল করা পরিশ্রমের সোনা বন – গেঁয়োরা কেটে নিয়েছে গাজনা চরের খামার-ভূঁয়ে। রাগে রূপার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হতে থাকে।
“আলী – আলী’ হাঁকল রূপাই, হুঙ্কারে তার গগন ফাটে,
হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে!
ঘুম হতে সব গাঁ য়ের লোকে শুনল যেন রূপার বাড়ি’।
গাঁয়ের সকল লোক জড়ো হয় রূপার উঠানে। ভয়ংকর এক মারণ খেলায় প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে সকলের চোখে। রূপাই এখানে গণ-নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ, রূপাই সকল গাঁয়ের মরদদের জানায় মোল্লারা কালকে গাজনা চরের জমির অর্ধেক ধান কেটে নিয়ে গেছে, এ চর আর তাদের দখলে নেই। যারা তাদের ধান কেটেছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় সকলে তাদের নাক ভাঙতে হবে লাঠির ডগায়।
“গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোরায় লাঠি,
রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি।”
পরদিন দুপুরে হাজার লেঠেল সড়কি-লাঠি হাতে এল গাজন চরের খামার ভূঁয়ে।হাজার লেঠেল আলী আলী হজরত আলীর নাম নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে — “লাগে বন- গাঁইয়েদের সাথে তুমুল লাঠালাঠি, রূপাই যে কত লোকের লাঠির ঘাড়ে মাথা ভাঙে তার ইয়াত্তা নেই। অবশেষে রক্তনদীতে স্নান করে জয়ী হয়। রূপাইয়ের এই গাঁও।
অন্যদিকে সাজু।রূপাইয়ের জন্য ভয়ে আতঙ্কে দুরুদুরু বক্ষে পথ চেয়ে থাকে। রাত যত বাড়তে থাকে সাজু ততই ঘর-বার করতে থাকে। উৎকণ্ঠা ও বেদনাকে ভুলার চেষ্টায় ঘরের মেঝেতে সে নকসী কাঁথা খানি মেলে সূচিশিল্পে একে একে ফুটিয়ে তোলে রূপার সাথে তার প্রথম দেখা, বিয়ের বাসর, রূপার বাড়ি, এমন সময়ে রূপাই আসে শেষ-মুহূর্তে প্রিয়তমা সাজুর কাছে, কারণ বিচ্ছেদের ক্ষণ উপস্থিত কাইজার অপরপক্ষ খুন হয়েছে বহু তার জন্যে।
“থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি,
খোঁজ পেলে পরে এখনি আমার ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি।”
অগ্যতা প্রেমময়ী (সোনার সীতা) বধূকে ছেড়ে যেতে হবে অজানা পথে। দিঘল রজনি, দিঘল বরষ, দিঘল ব্যথার ভার সইবে কেমনে রূপাইহীন সাজু। রাতের মধ্যে। রূপাইকে যেতে হবে এ-গাঁও ছেড়ে।আল্লার হাতে তার সোনার প্রতিমাকে সমর্পণ করে। কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বের হয়। পিছনে বধূ কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলে তার সাথে আর কি কোনো কথা নেই ? পিছু পানে চেয়ে রূপাই (বেদনার যে বান ডেকেছে ওরে) সাজুকে বলে:
” মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোনো ব্যথা লাগে,
দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাm¡ কাজলের রাগে,
আর যদি সখি, মোরে ভালোবাস মোর তরে লাগে মায়া,
মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!”
ফেরার হল রূপাই, সাজু স্বামীর ফিরে আসার আশায় দিন গুনে যায়। দিন ক্রমে মাস-বছর ফিরে আসে, রূপাই আর ফেরে না। কাইজায় গাঁও-এর অন্য ফেরারীর দল ফিরে আসে, শহরের জজ মামলা হতে সকলকে মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু রূপাই কই? কৃষ্ণ যখন রাধাকে ছেড়ে, বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা গমন করেন তখন চান্দপুর চন্দবিনা
বৃন্দাবন অনুকার, রাধার অন্তর-বাহির সকলি শূণ্যময়। রাধা ও কৃষ্ণের আসার আশায় অপেক্ষমান। সাজু, রূপাইয়ের বিচ্ছেদের বেদনার ইতিহাস বুকের রক্ত দিয়ে, চোখের জলে লিখতে থাকে রূপাইবিহীন সাজুর উত্তাল বেদনার নীরব কান্নার গাথা।
এ কাব্যের অন্তরে আছে কিংবদন্তীমূলক করুণ কাহিনী। ফেরার স্বামীর অপেক্ষায় বিজন ক্ষুদ্র কুটিরে নকসী কাঁথার বুকে সূচীমুখে ফুটিয়ে তোলে সাজু ভালোবাসার স্মৃতিচিহ্ন, বিরহের ব্যথা :
“কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ,
কী করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান।”
তার এই হতভাগ্যের জন্য দায়ী করে নিজেকেই — তবু সাজুর প্রতীক্ষা থাকে মনে, সদা দিঘল বাটের পানে সে দিনের পর রাত, রাতের পর দিন কেবল উৎকণ্ঠায় থাকে। রূপার ঘর ছেড়ে সাজু দুঃখিনী মায়ের কাছে ফিরে আসে। বুড়ি মা দুঃখে সকল কেবলই উতলা হয়ে জিজ্ঞাসা করে তারা কেউ রূপাইকে দেখেছে কিনা? কেউ যদি বলে রূপারই মতন দেখেছে এক জনাকে ; কেউ-বা বলে সে ভাদ্র মাসে অবশ্যই আসবে খবর পেয়েছে। এত বেদনায় মাঝ দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে খড়কুটোকেই বাঁচার তাগিদে আঁকড়ে ধরে। শ্রাবণ যায় ভাদ্র আসে, কিন্তু রূপার দেখা মেলে না – বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
সাজু কেবলই অতীতের সুখ স্মৃতি মনে করে তাকে জড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছে। তাকে ভালোবাসার নীরব গভীর দাবিতে তাকে কাছে পেতে চেয়েছে কিন্তু বিধি বাম, তা আর হল কই? অন্তহীন বিচ্ছেদ বেদনা সাজুর এতটুকু বুক সইবে কেমন করে? ক্রমে সাজু ক্ষীণ-মলিন হতে থাকে, দারুণ বিরহের দহন
জ্বালায় তার শ্বাস বন্ধ হতে থাকে :
“নকসী কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি,
ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।
অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা,
তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা।”
যখন সাজু তাঁকে স্বামীর জনমের মতো ছেড়ে যাওয়ার ছবি, চোখের জলে চাহনি ঝাপসা হয়ে যায়, বুক চাপড়ে সাজু কাঁথার উপর শুয়ে পড়ে, অসহ্য ব্যথার বুক চূর্ণ-বিচূর্ণ, এত বেদনা সহা যেকোন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ভালোবাসার পায়ে সাজু আজ দারুণ রোগের শিকার, আর ওঠে না –
‘উতলা বাতাস ধীরে বয়ে যায়, সব খালি! সব খালি!’
অবশেষে সাজুর হল মরণ। যে অন্তহীন বেদনা তার সাথে লড়াই করার রসদ ফুরিয়েছে তাই সাজু অগম পারে যাত্রা করে। কিন্তু রেখে যায় তার অন্তহীন বেদনাগাঁথা নকসী কাঁথাকে। মায়ের কাছে তার বিশেষ মিনতি তার মৃত্যুর পর কবরের গায়ে যেন মেলে দেওয়া হয় কাঁথাখানি। মৃত্যুর পরও তার প্রিয়তম রূপাই যেন অনুভব করতে পারে বিরহিনীর জীবনগাঁথা – যা কোনদিন আর বলা হবে না –
“সেই ব্যথার অশ্রু যেন রূপাই ফেলে নকসী কাঁথার পরে – তাহলেই দোহাকার বেদনা একি সাথে মিলে যাবে ল ফেরার স্বামীর পরে সাজুর কোন ক্ষোভ নেই, আছে অন্তহীন বিচ্ছেদ জড়িত গভীর কান্না ল এ কাব্য ট্রাজিক, কাব্যে প্রতিফলিত সুখ- মিলনের কালে দুঃখের তাঁর রিনরিন করে বাজতেই থাকে তার চূড়ান্ত রূপ পায় রূপাইয়ের পূর্বরাগ ও সাজুর বিরহ পর্যায়ে। এ কাব্য পাঠে পাঠকের দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠবেই এ বাস্তব সত্য।
” বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশি বেদনার তালে তালে।
প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,
রোগ পাণ্ডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়
… …. ….
সারা গায়ে তার জড়িয়ে রয়েছে সেই সে নকসী- কাঁথা,” –
সেই হতে মাঠটি নাম হয় নকসী কাঁথার মাঠ। এর বুকভরা বেদনার করুন ইতিহাস – এর কথা ছেলে – বুড়ো কারোর অজানা নয়। মাঠের এ নামের ইতিহাস কলোত্তীর্ণ। মুখো- মুখি গাঁও দুটির অঝোরে চেয়ে থাকা ও মাঝে মাঠের শূন্যতা সকলই রূপাই ও সাজুর প্রেম ও বিরহের নীরব সাক্ষী। এখনো রূপাইয়ের গহীন ব্যথাঝরা বাঁশির সুর সকলেই কখনো কখনো শুনে থাকে। জীবন রঙ্গনাট্যের স্বাক্ষী দুটি গাঁও ফাটলভরা দিগন্তজোড়া নকসী কাঁথার মাঠ। রূপাই ও সাজুর ট্রাজিক পরিনতি প্রসারিত হতে হতে অতীত ইতিহাসে পরিনতি পেয়েছে। ফসলহীন মাঠের যন্ত্রণার কথা রূপাই ও সাজুর মৃত্যু বেদনার সুরে প্রকাশ করেছেন। একদিকে এ গাঁও আর ও গাঁও – প্রতিনিধি রূপাই সাজু আর মাঝে মাঠের বুক – এরা প্রত্যেকে এই প্রেম কাহিনীর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, কারণ সজীব উপস্থিতি, গভীর অনুভব, যন্ত্রণার ভাষাকাব্যে এক অন্য মাত্রা জানে।
– জসীম উদ্দিন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানবতাবাদী কবি। কবি নাগরিক সভ্যতার স্পর্শ থেকে দূর গ্রামবাংলার নদীনালা, গাছ – গাছালি, পাখ- পাখালি, ধুলো – মাটির সংস্পর্শে মানুষ হয়েছেন বলেই এগুলি হয়ে উঠেছে তাঁর আত্মার- আত্মীয়। মাটির বাণীহারা বেদনা, মাটির সঙ্গে মেশা মানুষের অন্তরঙ্গ সম্পর্কে তিনি দিয়েছেন বাণীরূপ। বর্তমানের নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার বিষবাষ্প ছোঁয়াচে রোগের মতো পল্লীর স্নিগ্ধ, সরল, মলিন বিষাদময়, কান্না – হাসি পরিপূর্ণ জীবন আপসৃয়মান প্রায়। গ্রামের সরল জীবনে দারিদ্র, বহু সামাজিক বাধা থাকলেও আজকের মানুষের মতো তাদের ছিন্নমূল কখনোই মচন হয় না। আজও ” নকসী কাঁথার মাঠ” কাব্যখানি পাঠককে গভীর দুঃখে নিমগ্ন করে, এবং তার আবেদন হারিয়ে যায় না। নাকসী কাঁথার মাঠ এর অস্তিত্ব নিয়ে কোন সংশয় নেই। নাকসী কাঁথার করুন ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী বাঁচার অংশীদার, বেদনা – করুন মৃত্যুর আবাসস্থল নীরবে চোখের অঝোর ধারে বুক ভাসাচ্ছে আর পাঁজরের রক্তাক্ত ইতিহাস শ্রুত করিয়ে চলেছে আপামর পাঠককে। পল্লী কবি ও মানবতার মহান উদগাতা রূপে তিনি দুই বাংলার মানুষের কাছে স্মরণীয় ও বরনীয় হয়ে থাকবেন শেষের সেদিন পর্যন্ত :
সহায়ক গ্রন্থ
১। জসীমুদ্দীন-নকসীকাঁথার মাঠ, বেঙ্গল পাবলিশার্স,তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৭৯
ড শাশ্বতী সিনহাবাবু, সহ অধ্যাপিকা, শালডিহা কলেজ
মোবাইল ফোন : 9775526017