বাংলায় স্ত্রী-শিক্ষা আন্দোলন ও নারীদের বন্ধন মুক্তির সূচনা
জয়ন্তী মণ্ডল
বহুকাল ধরে সামন্ত প্রভু, জমিদার ও রাজাদের শাসন ভারতবর্ষকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এক শ্রেনীর মানুষের বিশাল বৈভবের মধ্যে কোন বিরাম ছিলনা। অন্যদিকে দেশের অধিকাংশ মানুষ হত-দরিদ্রভাবে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল। উচ্চবিত্ত থেকে বিত্তহীন সব স্তরের মানুষের মধ্যেই নারীজাতির উপর অত্যাচার অনাচারের সীমা পরিসীমা ছিলনা। কন্যা সন্তানকে মাতৃরূপে নয়- ভোগ, সন্তান ধারণ ও লালন পালনের জন্যই বড়ো করে তোলা হত। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে, শাস্ত্রের ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা করে পুরুষ শাসিত সমাজ নিজেদের মতো করে ব্যবহার করত নারীদের। বিশেষকরে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ পরিবারের নারীদের উপর অত্যাচার চরমে উঠেছিল। নারীদের এহেন অত্যাচারের মধ্যেও পরিত্রাণের কোন উপায় ছিলনা। কোন পুরুষ বা ধর্মগুরু কিংবা পণ্ডিত কেউই নারীদের মুক্তির জন্য চিৎকার করেছে বলে শোনা যায়নি।
ছোটবেলা থেকেই রূপকথার গল্পেও শোনাগেছে পুরুষদের বীরত্ব। অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যাদানের মধ্যে রাজকন্যার কোন স্বাধীন সত্ত্বা ছিলনা। খুব সুন্দরী রাজকন্যা হয়তো স্বয়ম্বর সভায় নিজের বর পছন্দকরে তাঁর গলায় বরমাল্য পরাতে পারত। কিন্তু সেই রাজকুমারের কোন গুন দোষ জানার অধিকার তাঁর ছিলনা। এহেন গল্পেও রাজকুমারী রাজপুত্রের ভোগের সামগ্রী। অনেক গল্পে এক রাজপুত্র অনেকগুলি রাজকন্যাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু কোন গল্প নেই যেখানে কোন রাজকন্যা একাধিক বিয়ে করেছ। এভাবেই শৈশব, কৈশোর থেকে নারীজাতির স্বাধীনতাকে নির্বাসিত করে রাখা হয়েছে যুগ যুগ ধরে। মধ্যযুগ থেকে নারীজাতি হয়েছে পর্দানশীল। মুশলমান নারীরা বোর্খার আড়ালে আর হিন্দুনারীরা ঘোমটার আড়ালে নিজেদের ঢেকে রেখেছে চিরকাল। তাদের পৃথিবী বাড়ির অন্দরমহলটুকু। তাদের আনন্দ স্বামী সাহচর্যে। আর তাদের যন্ত্রনা প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত। বহু নারীই হয়তো মৃত্যুবরণ করেছে অত্যাচারিত হয়ে। সংস্কার কুসংস্কারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অত্যাচারিত হয়েছে দূর্বল অংশের মানুষ। মহিলারা অত্যাচারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি করে। সব ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার শিক্ষা সামর্থ তাদের ছিলনা। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব তাদের স্বতন্ত্রভাবে বাঁচার কোন পরিকল্পনাও করতে দেয়নি তাদের। নিরাপদ আশ্রয়ের অভব ছিল।একদিকে মানুষের দুর্দশা যত বাড়ে ততই তাঁর সুযোগ গ্রহন করে ক্ষমতাশালী অভিজাত বিত্তবানেরা। তাদের মধ্যে স্বেচ্ছাচার বেড়ে যায়।
সে সময় বাংলা তথা ভারতে যে দেশজ শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল তারও সুযোগ গ্রহণ করেছিল প্রধানতঃ বিত্তবান মানুষেরাই। পিলসুজের কিছু তেল গড়িয়ে পড়েকিছু আলোর অস্পষ্ট রেখা দেখাযায় প্রদীপের নীচে। সেভাবেই উঁচুতলার শিক্ষার তলানি অল্পসংখ্যক মধ্যবিত্ত ও কতিপয় দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। তাই গ্রহন করে শিক্ষার স্বাদ পেয়েছিল তারা, কিন্তু তা সর্বত্রগামী হয়ে ওঠার কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।
আমাদের দেশে যখন রাজতন্ত্রের নব উত্থানের যুগ, সেই সময় ইউরোপে নবযুগের সূচনা হয়েছে। শিক্ষায় শিল্পের বিকাশে, মানবতায় এবং নারীজাতির প্রতি মর্যাদায় নবচেতনার উন্মেষ ঘটেছে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে। নবচেতনার আলোয় উদ্ভাসিত ইউরোপীয়রা যখন বানিজ্য করতে এসেছে, তখন ভারতের সাধারণ মানুষ অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রায়। স্থানীয় জমিদার ও ভূস্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ট কৃষক কূল। চরম দারিদ্র এবং অমানবিক পরিশ্রম করে কোন রকমে দিন চলত গরিব মানুষদের। অন্যদিকে তখন রাজা ও জমিদারদের মধ্যেকার বিরোধ, ধন সম্পদের জন্য লুঠ-পাট অবাধে চলেছে। এই রকম সময়ে আধুনিক শিক্ষায় ও সভ্যতায় উন্নত খুব সহজেই নিজেদের ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। ক্রমে ক্রমে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে বনিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে রূপান্তরিত করেছে। এতে ভারতীয় সম্পদ একটু একটু করে অধিকৃত হয়েছে ইউরোপীয়দের দ্বারা। কিন্তু সাধারণ ও গরিব মানুষেরা রাজতন্ত্রের অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হতে পেরেছ। নতুন চিন্তা চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে পুরো বাংলা তথা সারা দেশের সব অংশের মানুষ। নারীজাতিও উন্নত হয়েছে চিন্তা চেতনায়, শিক্ষা ও সামাজিকতায়। সব মানুষের সঙ্গে নারীজাতিও নিজেদের অধিকারকে বুঝতে শিখতে শুরু করেছ। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার জন্য নানা ধারা উপধারা ও ধর্মের দোহায় দিয়েছে। তবুও ঊনবিংশ শতকে হাজার বছর ধরে স্ত্রী জাতির শৃঙ্খলে আঘাত হেনেছে নতুন যুগ। পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনায় ইউরোপীয়দের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ও আদব কায়দাগুলি খুব সহজেই কিছু নব্য শিক্ষিত যুবক আয়ত্ব করে নেয়। ফলে ইংরেজদের কদর্যতার প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয় সাধারণ ভারতীয়দের। আবার তাদের ঔদার্য, শৃংখলা, মানবতা এবং আধুনিকতার প্রতিও আকৃষ্ট হয় অনেকেই। কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালীদের অনেকেই ইংরেজী শেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। ইংরেজরাও নিজেদের বানিজ্য প্রসারের স্বার্থে ভারতীয়দের ইংরেজী শেখানোর জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়। এভাবেই পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার তথা ভারতীয়দের পরিচয় হতে থাকল। ইউরোপের নারী স্বাধীনতার তরঙ্গ এসে পড়ল বাংলায় বিশেষতঃ কলকাতা শহরে। স্ত্রীশিক্ষার সূচনা ও বিকাশের মধ্যদিয়ে হাজার বছরের ভারতীয় নারীর শৃঙ্খল মোচনের সূচনা হল এই যুগে। উনিশ শতক হল নারী মুক্তি আন্দোলনের শতাব্দী। নারী মুক্তির মধ্যদিয়ে অঙ্কুরোদ্গম হল নারী স্বাধীনতা আন্দোলন। স্ত্রীজাতির যাতনাময় জীবনে কঠোর বন্ধন কঠিন কষ্টকর নিপীড়ন এবং শৃঙ্খলিত জীবন থেকে বন্ধন মুক্ত হবার প্রেরণা বা মুক্তির পথ খুঁজে পায় এই শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে। আশ্চর্যজনক হলেও একথা সত্যিযে, তখনকার পুরুষ শাসিত সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশ হয়েছিল পুরুষদের হাত ধরেই।
নারীমুক্তির ক্ষেত্রে আন্দোলনে বাংলায় সবচেয়ে অগ্রগন্য ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এরপর প্রথম সারিতে যারা ছিলেন তারা হলেন মদন মোহন তর্কালংকার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ। রামোহন পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল লক্ষনীয়ভাবে। প্রচলিত সামাজিক সংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারন করে তিনি বাংলা তথা ভারতের সমাজজীবনকে কলুষমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারের প্রধান দিকটি ছিল নারীজাতির কল্যনসাধন।
রাজা রামমোহন রায়-র সবচেয়ে বড় সংস্কার আন্দোলন হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো। ১৮১৮ সাল থেকেই তিনি সতিদাহের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠনে প্রয়াসী হন। বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রচার করেন সতীদাহ ধর্মবিরুদ্ধ। এইমত প্রচারের মধ্যদিয়ে জনমত গড়ে তুলতেও সক্ষম হন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর চেষ্টাতেই ১৮২৯ সালে সপ্তদশ-বিধি নামে ফাইল পাশকরে এই নিষ্ঠুর প্রথা নিষিদ্ধ হয়।
সতিদাহ প্রথার পাশাপাশি বহুবিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও রাজা রামমোহন রায় আন্দোলন চালিয়ে যান যা সেই যুগের অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতার পরিচায়ক। তাঁর এই প্রচেষ্টার পক্ষে বহু নব শিক্ষিত মানুষ সামিল হয়েছিলেন। সব অংশের মানুষকে চিন্তা চেতনায় যুক্তিবাদী ও আধুনিক মনষ্ক করে তোলার মধ্যদিয়ে নারীমুক্তি ও মানব মুক্তি সম্ভব একথা তিনি বুঝেছিলেন। বর্ণভেদ যেমন সমাজকে দুর্বল করে রাখে একইভাবে নারীর সমান সামাজিক অধিকার ছাড়া সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়। মাতৃজাতির সমাজে সমান অধিকার প্রয়োজন একথা রাজা রামমোহন রায় প্রথম বলিষ্ঠ কন্ঠে তুলে ধরেছিলেন সর্বসাধারনের কাছে। নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তাঁর জন্য বিষয় সম্পত্তিতে তাদের অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজা রামমোহন রায় প্রথম চেষ্টা করেন। তিনি ১৮২২ সালে ‘নারীদের প্রাচীন অধিকারের বর্তমান সংকোচনের উপর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য’ নামে একটি পুস্তক লেখেন। এই বইয়ে মেয়েদের আইনানুগ অধিকার দেওয়া এবং তাদের শিক্ষা দানের জন্য দাবি জানান। তাঁর পত্রিকা ‘সংবাদ কৌমুদী’তে দরিদ্র বিধবাদের সাহায্যের জন্যে একটি সমিতি গঠন করতে সরকারকে অনুরোধ করেন।
রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও খ্রিষ্টান ধর্মের আধুনিকতা এবং অন্যান্য ভালো দিকগুলি গ্রহন করে ভারতে তা নিজের মতো করে কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। খ্রিষ্টান ধর্মের একেশ্বরবাদ এবং বেদান্তের একেশ্বরবাদের মধ্য মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। এই তত্বের উপর ভিত্তি করে ১৮৩০ সালে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা হিন্দু ধর্মের নতুন ও আধুনিক সংস্করণ বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য ছিল সমাজ ও ধর্ম সংস্কার। এই ব্রাহ্মসমাজের নীতিগুলি নারী কল্যানে বিশেষ ভূমিকা গ্রহন করেছিল। পরবর্তীকালে তা নারী শিক্ষার ও নারীদের স্বাধীন চিন্তার পথ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ব্রাহ্ম সমাজ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব সেন প্রমুখ পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজকে প্রসারিত করেন। কেশব সেন সারা দেশে ব্রাহ্ম সমাজের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং এর জন্য তিনি প্রচেষ্টাও চালিয়ে যান। বাংলায় মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে কেশব সেন এর নেতৃত্বে ব্রাহ্ম সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য খ্রিষ্টান মিশনারীরা ভারতে এসেছিল। ধর্ম প্রচারের জন্য দেশীয় ভাষায় বাইবেল এর অনুবাদ, স্থানীয় মানুষের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বই প্রকাশের তাগিদে ছাপাখানা স্থাপন বাংলার শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মিশনারীদের কলকাতা বা বাংলায় ধর্ম প্রচারের জন্য আগে বাংলা ভাষা শিখতে হয়েছিল। কলকাতায় এসেছিল ইউরোপের বাংলা ভাষা শিখতে হয়েছিল। কলকাতায় এসেছিল ইউরোপের পর্তুগিজ, ডাচ, দিনেমার, ফরাসী, ইংরেজ প্রভৃতি মিশনারীরা। ধর্মপ্রচারের জন্য হলেও তাদের শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পর্তুগিজ মিশনারীরা এদেশে প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করেছিল। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ একজন দিনেমারকে বাংলাদেশে আনিয়ে তাকে দিয়ে কয়েকটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য শিক্ষা বিস্তারের কাজে নিয়োজিত কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের ভূমিকা বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার। কেরি অনেক ভাষা জানতেন। খুব ভাল বাংলা শিখেছিলেন। শ্রীরামপুর মিশনে এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান অধ্যাপক হয়েছিলেন। সে সময় কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বাংলার প্রায় সর্বত্র বেসরকারী উদ্যোগী প্রধানত মিশনারী প্রচেষ্টায় এবং জমিদারদের পৃষ্টপোষকতায় অনেকগুলি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। টাকী, বারাসত, চন্দননগর, ব্যারাকপুর প্রভৃতি অঞ্চলে অনেকগুলি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। বাংলায় স্ত্রী শিক্ষার বিকাশে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল মিশনারীরা। ‘রেভামের প্রতিষ্ঠিত চুঁচুড়ার বিদ্যালয় (১৮১৮), কেরি সাহেবের শ্রীরামপুর নারী বিদ্যালয় (১৮১৯), ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি (১৮২০), পরে দি ক্যালকাটা বাপটিষ্ট ফিমেল স্কুল সোসাইটি (১৮১৯), মিস কুকের চেষ্টায় মিশনারী সোসাইটির সহযোগিতায় ৪টি নারী শিক্ষার বিদ্যালয়, পরে ১৮২৮ সালে ২৪টি বিদ্যালয়, লেডিস সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন সংস্থার নারী বিদ্যালয় প্রভৃতি।
খৃষ্টান মিশনারীদের নারী শিক্ষা প্রবর্তনের সার্থক নজির। ১৮৪৯ সালে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়’।১ মিশনারীরা এদেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বেসরকারীভাবে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে অনেক স্কুল গড়ে তুলেছিল। তাদের এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামিল হয়েছিল বহু ভারতীয়। জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু স্কুল গড়ে উঠেছিল। সরকারী উদ্যোগের অভাব ছিল দীর্ঘকাল। সরকারী উদ্যোগ গ্রহন করার পরও বহুকাল ইংরেজরা দেশিয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার জাতীয় বনিয়াদ গড়ে তোলার কথা ভাবেনি।তবে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজী ভাষার মাদ্যমে শিক্ষা পদ্ধতি চালু হলে তা সাধারণ সকলে বোধগম্য হয়নি। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ভার্ণাকুলার স্কুল চালু করা হয়েছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য মাতৃভাষার কোন স্কুল ছিলনা। লর্ড বেন্টিঙ্ক ঘোষিত শিক্ষানীতি কার্যকর হওয়ায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার অবসান ঘটিয়ে পুণরায় ইংরেজী শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় চিন্তা ভাবনা ও চেতনাকে চাপিয়ে দেওয়া।
ইংরেজদের বিভিন্ন শাসক এদেশে শিক্ষা সংক্রান্ত নানা নীতি প্রনয়ন করেছে। কত মিনিট, রিপোর্ট, সুপারিশ (ডেসপ্যাচ), কমিশন,কমিটি বসিয়েছে। যাথেকে এংরেজদের বিভিন্ন সময়ের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।মনরো অ্যাডাম, থমসন প্রমুখ দেশীয় শিক্ষার ধারা অনুসরণ করে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
বাংলায় স্ত্রী শিক্ষার বিকাশ হয়েছিল ঊনবিংশ শতকেই অবশ্য এর আগেই ১৭৬৯ সালে একটি এবং এর পরে মিশনারী ও ইংরেজ শাসকদের সন্তান সন্ততিদের জন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় স্কুল গড়ে তুলেছিল। বাঙ্গালী মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল স্থাপিত হয় কলকাতায়। ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে গৌরীবেড়ে লেন-এ একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল না থাকলেও এর আগে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কিছু ব্যবস্থার কথা জানাযায়। ১৮১৭ সালে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুলে ছোট ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। স্কুল সোসাইটি প্রতিস্টহিত কতকগুলি স্কুলে একসঙ্গে পড়ানো হত। এইসব স্কুলের মেয়েদের পরীক্ষা হত রাধাকান্ত দেব এর বাড়িতে। পরীক্ষা নিতেন স্কুল সোসাইটির পণ্ডিতেরা। যাইহোক মেয়েরা পথে নামল। আগে মেয়ের স্কুলে যাবে বাইরে বেরোবে এটা সাধারনভাবে কেওই ভালোভাবে দেখতনা। তবে মিশনারীদের অনুদানে চালিত স্কুলগুলি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। এসব স্কুলে যেসব মেয়ের পড়তে আসত তারা সমাজের একেবারে নিচুতলার পরিবারের মেয়ে। খাবার, জামা-কাপড় পাওয়র জন্য এরা স্কুলে পড়তে আসত।
অভিজাত বা জমিদার শ্রেণির পরিবারে মেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা ছিল বাড়িতেই। যদিও মিশনারীদের উদ্যোগে ক্রমে নতুন স্কুল গড়ে ওঠে। উত্তরপাড়ার রাজা জয়কৃষ্ণ মেয়েদের একটি স্কুল স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে নিজের কন্যাদের সেই স্কুলে পড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সরকারী কাউন্সিল তা নাকচ করে দেয়। ক্রমে দেশীয় উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হতে থাকে। অভিজাতরা বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে থাকলে সাধারণ পরিবারে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর পথটি অনেক সুগম হয়ে যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় ছোটলাট সিসিলি বিডনের দৃঢ় প্রত্যয় হয় ঈশ্বরচন্দ্রের সহযোগিতায় স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার ঘটানো সম্ভব। ১৮৫৭ সালে এবং তার পরে বিদ্যাসাগর বাংলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ওই সব স্কুলগুলির ব্যয়ভার গ্রহন করতে না চাইলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর উদ্যোগ ও চেষ্টার পাশে এসে দাড়িয়েছিল বহু সম্ভ্রান্ত দেশীয় ভদ্রলোক এবং উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। তারা এইকাজে বিদ্যাসাগরকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। ছোটলাট বিডনও এজন্য বিদ্যাসাগরকে অর্থ সাহায্য করেছেন।
বিদ্যাসাগরে প্রচেষ্টায় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারলাভ করেছিল আবার স্ত্রীশিক্ষার উন্নতি এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য দেশীয় মানুষদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহন অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল। স্ত্রীশিক্ষার বিকাশের জন্য যারা অর্থদিয়ে বা অন্যভাবে সাহায্য করেছিল তারা স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে জনমত গড়েতুলে স্ত্রীশিক্ষা্র বিস্তারে সাহায্য করেছিল। বালিকা বিদ্যালয় গড়েতোলার পাশাপাশি শিক্ষার উপকরণ নির্মানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজে উইলিয়াম কেরি, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কেশব সেন প্রমুখেরা কলম ধরেছিলেন। শুধু স্ত্রীশিক্ষার জন্যে নয়, সকলের শিক্ষার জন্যে নানা বই তারা রচনা করেছিলেন। যা বর্ণ পরিচয় থেকে সফলভাবে বাক্য রচনা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। অনেক স্কুল গড়ে উঠলে এবং মেয়ের স্কুলে যেতে শুরু করলে ভাবনা শুরু হল মেয়েদের শিক্ষার বিষয় কীহবে? কেউ বললেন মেয়ের ঘর সংসার করার কাজে যারে আরো পরিপাটি হয় সেরকম শিক্ষার বিষয় হওয়া দরকার। তাদের মতে ‘যেসব পুস্তক পাঠ করিলে স্ত্রীজাতি উৎকৃষ্ট গৃহিনী ও মাতা হইতে পারে তাহাই তাহাদের বিশেষ পাঠ্য’। এইমতের পক্ষে ছিলেন কেশব সেন ও তার অনুরাগীরা। অন্যদিকে শিবনাথ শাস্ত্রী ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী প্রমুখ অতি অগ্রসর নব্যপন্থীরা মেয়েদের সব বিষয় পড়ার ও জ্ঞান লাভের অধিকার আছে বলে মনে করতেন।
মেয়েরয়াও অনেকে স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞান ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশের বিষয়টিকে ভালভাবে গ্রহন করেনি। মেয়েদের দ্বারা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা ‘বঙ্গমহিলা’-র সম্পাদিকা মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘তাহাদের যে স্বাধীনতা আছে তাহাই প্রকৃত স্বাধীনতা’।
এইরকম ভিন্নমতের ফলে স্ত্রীশিক্ষার উপকরণ নির্মানেও ভিন্নমত দেখা গেল। যাইহোক স্ত্রীশিক্ষার উপকরণ রচনায় মেয়েরাও হাত দিলেন। মেয়েদের পাঠক্রমের পুস্তক প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আলাদা পাঠ্যপুস্তক রচনা হল।
স্ত্রীশিক্ষার প্রতিটি পর্যায় নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে ঠিকই, তাতে শিক্ষার উন্নতির পক্ষে একটা আন্দোলনের রূপ পেয়েছে। বহু মানুষ স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেছেন। মেয়েরা প্রাথমিকের গণ্ডী পার হওয়ার পর উচ্চশিক্ষার দরজায় আঘাত হানলে সেখানেও প্রবল তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। শুধু বাংলাতেই নয় ইংলন্ডেও স্ত্রী উচ্চশিক্ষার অধিকার ছিলনা। ফলে ইংরেজ সরকার বাংলাতেও স্ত্রী উচ্চশিক্ষার অধিকার দিতে চায়নি। অনেক বাধার গণ্ডী পেরিয়ে কাদম্বিনী বসু এবং চন্দ্রমুখী বসু যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন এবং কাদম্বিনী মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করেন তাদের হাত ধরে বাংলার মেয়েদের উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে যায়। বেথুন স্কুলের উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বেথুন কলেজে পরিণত হয়, ক্রমে বিভিন্ন বিষয়ে সান্মানিক (অনার্স) পাঠক্রম চালু হয়। ধীরে ধীরে বাংলার অন্যান্য স্ত্রীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও স্ত্রী উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
স্ত্রীশিক্ষার সূচনা থেকে বিকাশের পর্বে প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা বাধা বিপত্তি দেখা দিয়েছিল। পত্র-পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে বহু মতামত প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতকে প্রভাবিত করেছে স্ত্রীশিক্ষা। সামাজিক ক্ষেত্রেও স্ত্রীশিক্ষার প্রভাব পড়েছে। লোকগান, ছড়া, পাঁচালি রচিত হয়েছে শিক্ষার স্বপক্ষে ও বিপক্ষে। ফলে স্ত্রীশিক্ষার আন্দোলন হয়েছে সুদূর প্রসারী।
মেয়ের লেখাপড়া শিখে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য কলম ধরলেন। স্ত্রীশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে বই প্রকাশিত হল। এই কাজে মহিলাদের মধ্যে যারা এগিয়ে এলেন তারা হলেন কৈলাসবাসিনী দেবী, বামাসুন্দরঈ দেবী, কামিনীসুন্দরী দেবী প্রমুখ। ফলে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটে, মূল্যবোধের পরিবর্তন দেখা দেয়। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে কলম ধরে অনেকে নিজেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা আকাঙ্খার কথা পত্র-পত্রিকায় লিখতে থাকে। রক্ষনশীল হিন্দুরাও নিজেদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে শুরু করে।
বাংলা সাহিত্যে পুরুষদের লেখার মতো মেয়েদের লেখাতেও ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব পড়েছিল। নবজাগরনের মূল মন্ত্র যুক্তি ও বাস্তববোধ শিক্ষিত বাঙ্গালী মেয়েদেরও যুক্তিশীল করেছিল। তাদের লেখার মধ্যে আবেগ, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল যা নবচেতনার স্পষ্ট বার্তা। ধারাবাহিক সাহিত্যচর্চা হতে থাকল ‘বঙ্গমহিলা’, ‘বামাবোধিনী’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকার মধ্যদিয়ে।
এই স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনের যুগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষায় তাদের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। মহর্ষি কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিচরণ করেছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখি সমিতি’ নামে একটি মহিলাদের সম্মীলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১১ বছর ধরে তিনি ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এছাড়া নাটক, গল্প, উপন্যাসের নাট্যরূপ, গীতিনাট্য, সংগীত রচনা প্রভৃতি সৃষ্টি কর্ম যুগের অগ্রগতির দাবিকে স্পষ্ট করে তোলে।
পত্র-পত্রিকা প্রকাশনার কাজেও মেয়েরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। পত্রপত্রিকার মধ্যদিয়ে নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ পেল। নিজেদের মতামত ও প্রতিভার স্ফূরণ হতে লাগল। একই সঙ্গে সমৃদ্ধ হল বাংলা সাহিত্য। পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি সম্পাদনাও করতে থাকল মেয়েরা। প্রথম মহিলা সম্পাদিত পত্রিকা ‘বঙ্গমহিলা’। প্রকাশকাল ১৮৭০। মহিলা প্রকাশিত ও সম্পাদিত পত্রিকায় বিশেষত মহিলারাই লিখত। এভাবে বহু নতুন লেখিকার আগমন ঘটেছে। তাতে নিজেদের লেখার ভিত্তি যেমন শক্ত হয়েছে তেমনি সেই যুগের নারীদের আশা-আকাঙ্খা, অন্তঃপুরের কথা,তাদের চিন্তা চেতনার জগতটি ফুটে উঠেছে।
উনিশ শতকে মুসলমান নারীরা শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে ছিল। তার মূল কারন পর্দানশীলতা, রক্ষনশীলতা, আধুনিকতার প্রতি বিতৃষ্ণা এবং দারিদ্র। কিন্তু এই নবজাগরনের যুগে শিশু-কিশোরদের জন্যে ছিল মাদ্রাসা, মক্তব। এদের বই অনেক বাড়ির মেয়েরাও পড়ত। সম্ভ্রান্ত বংশের মুশলমানরা তাদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেন। উনিশ শতকের শেষদিকে এক গোঁড়া মুসলমান পরিবারের কন্যা স্বামীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় এবং নিজের চেষ্টায় সব বন্ধন ছিন্ন করে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। তিনি বেগম রোকেয়া। নিজের মনের জোরে লেখাপড়া শিখেছিলেন নূরন্নেছা খাতুন। লেখাপড়া তাদের মনকে মুক্ত করেছিল। হিন্দু-মুসলমান ধর্মের বেড়া না ভাঙ্গলেও একটু একটু করে সবাই সবার কাছে আসতে লাগল।
ভারতীয়রা যখন নব চেতনার আলোকে দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন, শিক্ষিত মেয়েরাও থেমে থাকলেন না। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ গঠন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে এগিএ এসেছেন। কেউ পরোক্ষে আবার কেঊ প্রত্যক্ষভাবে স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইলবার্ট বিল কার্যকর করার দাবিতে মেয়েদের পক্ষ থেকে লর্ড রিপনকে একটি আবেদন পাঠানো হয়। কবি কামিনী রায় বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে এই দাবি সমর্থন করেন। মহারানী স্বর্ণকুমারী দেবী টাকা দিয়ে লালমোহন ঘোষকে বিলেতে পাঠান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের অংশগ্রহনের দাবি জানাতে। নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ নারীরা এইভাবে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮৯ সালে মুম্বাই অধিবেশনে দুজন বাঙ্গালী নারী অংশ নেয়। জাতীয় আন্দোলনে স্বর্ণকুমারীর কন্যা সরলাদেবী, মাতঙ্গিনী হাজরা, চারুশীলা দেবী প্রমুখদের অংশগ্রহণ যুগ যুগ ধরে স্মরনীয় হয়ে থাকবে।
দেশের সামগ্রিক শিক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার অনেক কমিশন গঠন করেছে। তাদের শিক্ষা সুপারিশগুলি বেশ কিছুটা অগ্রগতি ঘটলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের জন্য এই শিক্ষা সকলে গ্রহন করতে পারেনি। কিন্তু সামাজিক ও ধর্মীয় নানা সংস্কারের কারনে
মহিলাদের শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল বহুকাল। এইসব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে বহু আইন প্রণনয় করতে হয়েছে সরকারকে। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে স্ত্রীজাতি। তাদের শিক্ষা ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটেছে।
বিংশ শতকে ঊনবিংশ শতকের চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। আমরা বহু শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী বাঙ্গালীকে পেয়েছি। স্ত্রীশিক্ষার সামগ্রিক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু মহিলা নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এখনো অনেক মহিলা অন্ধকার থেকে আলোয় এসে পৌঁছোয়নি। এখনো নারীরা প্রতিদিন বঞ্চনার শিকার হন। তবুও সম্ভাবনা রয়েছে, নারীর অসম্মানের বিরুদ্ধে ধিক্কার ওঠে। প্রতিবাদে সরব হন হাজারো-লাখো মানুষ। তবুও পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই এখন নারীদের অগ্রগতি চোখে পড়ে প্রতিদিন। সব শিক্ষা আন্দোলনই স্ত্রীশিক্ষার বিকাশে সহায়ক হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে। সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, পত্র সাহিত্য ইত্যাদি।