November 1, 2020

শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় গুরু কে. যতীন্দ্র সিংহের অবদান

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

তন্ময় পাল, এম ফিল গবেষক, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন

ভারতীয় সংস্কৃতির আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষএ হল নৃত্য, শুধু বিনোদোয়ই নয়, ঈশ্বর সাধনা, আত্ম-উপলব্ধি সবকিছুর সঙ্গে অঙ্গা-আঙ্গিক ভাবে যুক্ত নৃত্য। ভারতীয় নৃত্যের দিকে তাকালে এক উজ্জ্বল রঙিন রূপ আমরা দেখতে পায়। প্রাচীন কাল থেকেই নৃত্য চর্চা ও প্রদর্শনের কথা আমরা পায় বিভিন্ন পূরাণ ও মহাকাব্যে। নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যশিল্পীর পোশাক-অলংকার ও সাজসজ্জার প্রভৃত বর্ণনা থেকে সেযুগের নৃত্য সম্পর্কে ধারনা পায়। বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক পোশাক ও রূপসজ্জা তাদের নিজস্বতা ও নান্দনিকতাকে প্রকাশ করে।

         বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নৃত্য ছিল সাধারন ব্যাপার।তার ধার এবং এক সুনির্দ্দষ্ট রূপ ও ছিল কিছু তা সংরক্ষন ও নবীনিকরন হয় নি কখনও। বিদেশেও সামাজিক অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতি দের দ্বৈত নাচের কথা পায়। যা পরবর্তিতে ‘বলরুম- ডান্সিং’ নামে প্রচলিত। ভারতীয় সংস্কৃতিতে ও ধর্মিয় অনুষ্ঠানে নাচের ভূমিকা ছিল অনেকখানি যা এখন ও অনেকখানি বর্তমান। এই ধর্মীয় নাচগুলি সংরক্ষন ও নবীনিকরনের মাধ্যমে মঞ্চ-পরিবেশনের ভাবনা আনেন কিছু মহৎ ব্যক্তি। সেই ভাবেই দাসিআট্টাম থেকে ভারতনাট্যম এবং মাহারি নৃত্য-থেকে ওড়িশি নৃত্যের জন্ম।

        পরবর্তিতে ভারতীয় নৃত্যের চর্চা ও প্রসারের প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেন কিছু মহৎ ব্যক্তি তাদের মধ্যে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। তিনি বুঝেছিলেন ভারতীয় নৃত্যচর্চা কে খুব নিচু নজরে দেখা হত কারণ দরবরী নাচ  বা বাঈ নাচ এবং দেবদাসী নৃত্যের যুগ তখন ও কিছুটা বর্তমান, ভদ্র সমাজ নিজেদের মেয়েদের নৃত্য-চর্চায় সম্মতি দিতেন না, সেই ধারনা কে বদলাতে চেষ্টা করলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু চেষ্টায় নয় তিনি সফল ও হলেন, তার ফল স্বরূপ আমরা আজ এক নতুন নৃত্যধারাকে পায়। তিনি রচনা করলেন এদের পর এক গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য ও ঋতুনাট্য যা ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকল।

        গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছন্দের প্রকৃতি’ প্রবন্ধেনূত্য সম্পর্কে বলেছেন- “আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে মিলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে, জীবিকার প্রয়োজনে নয় সৃষ্টির অভিপ্রায়ে; দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পের রুপ। তাকে বলি নৃত্য”।

A tribute to my dance guru, the legendary K Jatindra Singh (Jitenda) –  Kaberi Chatterjee

ইউরোপ ও বিভিন্ন দেশের নাচ দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে নৃত্য-চর্চা ও শিক্ষার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেন। কিন্তু সেইযুগে বঙ্গে নৃত্য-চর্চার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। শুরুর দিকে বিভিন্ন নাটক ও ঋতুনাট্যের অভিনয়ে মুকাভিনয় ও অঙ্গ-সঞ্চলনার মাধ্যমে গানের ভাবকে প্রকাশ করা হত শান্তিনিকেতনের প্রযোজনা গুলিতে। সেসময় শান্তিনিকেতনে সে রকম ভাবে নৃত্যশিক্ষক ছিলেন না। ১৯১৯ সালে সিলেটের মছিমপুরে গুরুদেব প্রথম মনিপুরী নৃত্য দেখেন এবং সেই সময় ত্রিপুরার রাজার আমন্ত্রনে মনিপুরী রাসনৃত্য দেখেন এবং মনিপুরী নৃত্যকে তার গানের সঙ্গে প্রয়োগের ভাবনা আনেন।  শান্তিনিকেতন ফিরে ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য কে চিঠি লিখে একজন  মনিপুরী নৃত্য শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। ১৯২০ সালে গুরু বুদ্ধিমন্ত সিং শান্তিনিকেতনে আসেন মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক হিসাবে। একবছর পর বুদ্ধিমন্ত সিং ত্রিপুরা ফিরে যান। এরপর ১৯২৫ সালে নবকুমার সিং আসেন শান্তিনিকেতনে নৃত্য শিক্ষক হিসাবে এরপর থেকে শান্তিনিকেতনে ধারাবাহিক ভাবে নৃত্য চর্চা হতে থাকে। ১৯২৬ সালে প্রথম মনিপুরী নৃত্য আঙ্গিকে নটীর পূজা নাটকে “আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো” গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশিত হয়। পরিবেশন করেন নন্দলাল বসুর কন্যা ‘গৌরি বসু’ (ভঞ্জ)। এখান থেকেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্যের এক নতুন-সুচনা হল যা আজও বহমান। মনিপুরী নাচ ছাড়াও গুরুদেব অনেক ধরনের নাচের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সৌরাষ্ট্রের মন্দিরা নাচ এসেছিল,  ১৯২৪ সালে অধ্যাপক জাহাঙ্গির ভকিলের স্ত্রি শিখিয়ে ছিলেন ‘গরবা’ নাচ। এছাড়াও কেরলের কথাকলি নাচ, রায়বেশে নাচ, বাউল নাচ, জারি নাচ, শ্রীলঙ্কার কান্ডি নাচ, সর্বোপরি জাভা ও বালি দেশের নৃত্য। এপ্রসঙ্গে জানা যায় মনিপুরী গোষ্ঠলীলার কয়েকটি ভঙ্গি দিয়ে গুরুদেবের নির্দেশে “ আয় আয়রে পাগল ভুলবিরে চল আপনাকে” গানটির সঙ্গে মিলিয়ে দেন গুরু বুদ্ধিমন্ত সিংকে। এছাড়াও টুকরো টুকরো কিছু নাচের কথা আমরা পায়। যেমন- বাসুদেবনের নাচ,  ‘ঝুলন’ কবিতার সঙ্গে শ্রীমতি দেবীর ইউরোপিয় ‘Modern Dance’- এর আঙ্গিক,  হাঙ্গেরীয় নাচ,  জাপানী প্রাচীন নাচ,  কল্যানী আম্মার দ্বারা মহিনীআট্টম নাচ প্রভৃতি।

         সেযুগে ইউরোপিয় ‘Modern Dance’- এর আদলে নাচগুলি তৈরী হত, কিন্তু তার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের নাচ থাকত যা বারবার বিভিন্ন লেখায় পায়।

বিভিন্ন মনিপুরী নৃত্য গুরুরা শান্তিনিকেতন এসেছেন নৃত্য শিক্ষক হিসাবে। এখনো শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্য চর্চা ও শিক্ষার সেই ধারা অব্যাহত। বিভিন্ন জায়গায় শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্য গুরুদের যে তালিকা পাওয়া যায় সেটির নিচে দিলাম

    ১. গুরু বুদ্ধিমন্ত সিং ১৯২০ খ্রীস্টাব্দ

    ২. গুরু নবকুমার সিংহ ১৯২৫ খ্রীস্টাব্দ

    ৩. গুরু রাজকুমার সেনারিক সিং ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দ

    ৪. গুরু নিলেশ্বর মুখার্জি ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দ

    ৫. গুরু বসন্ত সিং ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দ

    ৬. গুরু হাওবম আতম্বা সিং ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ

    ৭. গুরু বৈকুন্ঠ সিং ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ

    ৮. গুরু রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিং (১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ)

    ৯. গুরু পাকা সিং

    ১০. গুরু আরাম্বাম আমুবি সিং (১৯৫৭-১৯৮৯) (যিনি মাস্টারজি  নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন)

    ১২. গুরু শ্রী মাধব মুখার্জি (১৯৪৬-১৯৫৫)

    ১৩. গুরু আরাম্বাম প্রফুল্ল সিং (১৯৮০-১৯৮৬)

    ১৪. গুরু কাব্রাবাম যতীন্দ্র সিং (১৯৬৮-২০১১) (যিনি সকলের কাছে জিতেনদা নামে পরিচিত ছিলেন)

  গুরু কাব্রাবাম যতীন্দ্র সিংহ ১৯৪৫ সালের ২২ শে এপ্রিল আসামের কাছাড় জেলায় লক্ষীপুর নামে এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কামিনী সিং, মাতা আসতলৈমা দেবী। কামিনী সিং ছিলেন মনিপুরী সমাজের ‘নটসংকীর্তন’ এর বিখ্যাত গুরু ও নৃত্যশিল্পী। মা আসতলৈমা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। পিতা কামিনী সিং-এর হাত ধরেই গুরু যতীন্দ্র সিংহের নৃত্য চর্চার হাতে খড়ি। গুরু যতীন্দ্র সিং-এর ছেলেবেলা ও স্কুল জীবন কেটেছে এই লক্ষীপুরে এখানে ‘আরল হাই সেকেন্ডারি স্কুলে’ তিনি পড়াশোনা করেন এটি ছিল বাংলা মাধ্যমের একটি স্কুল তাই বাংলাভাষার চর্চা তার প্রথম থেকেই। সেখান থেকেই মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নৃত্য চর্চার পাশাপাশি ছোট থেকেই সেতার বাদন ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ ছিলেন তিনি। ছোট থেকেই পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ   ছিল পাঁচ ভাই বোন প্রত্যেকেই ছোট থেকে নৃত্য চর্চা করত কিন্তু নৃত্য জগতে সুনাম অর্জন করেছে এবং পেশাগত দিক থেকে নৃত্য কে বেছে নিয়েছে কেবলমাত্র গুরু যতীন্দ্র সিংহ। পরিবারের সঙ্গে ‘আইপিটিএ’ বা ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘের’ এক যোগাযোগ ছিল যার সূত্র ধরে ‘ভূপেন হাজারিকা’, ‘নয়না জাভেরি’, ‘গুরু চাওবা’, ‘নীলকান্ত’ প্রমূখ বিখ্যাত লোকরা বাড়িতে আসতেন গান-বাজনার চর্চা হতো নাচের চর্চা হতো এবং এনাদের সাথে অনেক অনুষ্ঠান হতো এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হতে হতেই আনুমানিক ১৯৬৪ সালে ভারত সরকারের তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রকের প্রদত্ত বৃত্তি নিয়ে মনিপুর যান গুরু যতীন্দ্র সিং। মনিপুরের ইম্ফলে ‘গুরু মাইস্নাম আমুবী’ সিং-এর অধীনে নৃত্য চর্চা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি গুরু হিসাবে পেয়েছেন ‘স্বর্গীয় গুরু লোকেশ্বর সিংহ’, ‘স্বর্গীয় গুরু লক্ষণ সিং’, ‘স্বর্গীয় গুরু হাওবম আতম্বা সিং’ প্রমূখ প্রবাদপ্রতিম গুরুদের।

   ‘স্বর্গীয় গুরু মাইস্নাম আমুবী সিং’ এর কাছে এক বছর স্কলারশিপ শেষ করার পর উনি আসেন শান্তিনিকেতনে এখানে গুরু আরাম্বাম আমুবী সিং (যিনি সকলের কাছে মাস্টারজি নামে পরিচিত ছিলেন) এর কাছে জাতীয় বৃত্তির শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য এখানে এসেই তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে নাচ করেন সালটা আনুমানিক ১৯৬৬ সালে, এখানে এসে তিনি ‘শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ’ মহাশয় এর সান্নিধ্য পান। শান্তিনিকেতনে তার প্রথম নাচ “আজি বরিষনমুখরিত” গানটির সঙ্গে। আস্তে আস্তে তার রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে নৃত্যের পথ চলা শুরু, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নাচ মুগ্ধ করেছিল শান্তিনিকেতন বাসীদের। এক বছর পর স্কলারশিপ শেষে যখন তার শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে যাওয়ার সময় এলো তখন ‘শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ’ মহাশয় তাকে শান্তিনিকেতনে রাখার জন্য  পাঠভবনের নৃত্য শিক্ষক হিসাবে যুক্ত করলেন এই সময় থেকে শান্তিনিকেতনে গুরু জিতেন সিং এর কর্মজীবন শুরু হলো। এরপর ১৯৬৮ সালের ১৭ই নভেম্বর সঙ্গীত ভবনে মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন এরপর থেকে টানা ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক হিসাবে কাজ করে গেছেন সংগীত ভবন তথা বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন এর জন্য। পরিচালনা করেছেন একের পর এক গীতিনাট্য নৃত্যনাট্য ঋতু নাটক প্রভৃতি।

       ১৯২০ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্যের চর্চা শুরু হয়। গুরু বুদ্ধিমন্ত সিং প্রথম নৃত্য গুরু হিসেবে আসেন শান্তিনিকেতনে তারপর থেকে একের পর এক নৃত্য গুরুরা এসেছেন শান্তিনিকেতনের নৃত্য শিক্ষক হিসাবে। রবীন্দ্র্র সংগীতের নৃত্য নির্মাণে প্রত্যেক গুরু নিজেকে নিয়োজিত করেছেন প্রত্যেক গুরুর এক নিজস্ব ধারা তৈরি হয়েছে আঙ্গিকগত ভাবে, মূল কাঠামো ভাবনা এক রেখে বিভিন্ন সময়ে আঙ্গিকে বৈচিত্র এসেছে মনিপুরী ও কথাকলি  নৃত্য ছাড়াও কখনো ভারতনাট্যম কখনো ক্যান্ডি কখনো কখনো ইউরোপীয় ব্যলে কখনো বিভিন্ন লোকনৃত্যের মিশ্রণ ঘটেছে রবীন্দ্র ভাব-নৃত্য নির্মাণে। কিন্তু মনিপুরী নৃত্য এক অনন্য অবদান হিসাবে রয়ে গেছে এই মনিপুরী নৃত্য গুরু হিসাবে ১৯৬৮ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হয়েছিলেন গুরু কাব্রাবাম যতীন্দ্র সিং মহাশয়। যিনি শান্তিনিকেতনে আসার পর জিতেন নামে পরিচিত হন যেহেতু শান্তিনিকেতনের শিক্ষক মহাশয় দের কে দাদা বলার চল ছিল বা এখনও আছে তাই সবার কাছে হয়ে উঠললেন জিতেন দা। ইনি প্রধানত মনিপুরী নৃত্য গুরু হলেও ওনার নৃত্য নির্মান গুলির দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন নাচের ছোঁয়া থাকতো সেগুলিতে রবীন্দ্র গানের নৃত্য নির্মাণে কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় ওনার করা কম্পোজিশন গুলিতে।গানের তেহাই এর জায়গাগুলিতে উনি একটু পায়ের কাজ যেটা বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পায়ের ছন্দকে মিলিয়ে দেবে এরকম ভাবনার প্রয়োগ করতেন এই ভাবনা শান্তিনিকেতনে শুরুর দিকে ছিল এই পায়ের কাজের সাহায্যে ভাব প্রকাশে কিন্তু নতুন নয় শান্তিনিকেতনে এ প্রসঙ্গে শ্রীমতি প্রতিমা দেবী তার নৃত্য বইটিতে বলেছেন ‘অর্জুনের ধ্যান ভঙ্গের নাচে তেহাই তোরাপরণ কৌশল যুক্ত হয়েছে’ এইটি শুনে কারো কারো হয়তো মনে হয়েছে যে আমাদের ছাত্রীরা উত্তর ভারতের নৃত্য কলা চর্চা করেছেন কিন্তু আমারা এটি পেয়েছি মনিপুরি নাচের মধ্যে দিয়ে(১১-২)। গুরু জিতেন সিং এর একটি নৃত্য রচনা “মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি” গানটির সঙ্গে নৃত্য ভাবনাটি এর একটি উদাহরণ হতে পারে এই কম্পোজিশনটি খুবই জনপ্রিয় একটি তার ছাত্রছাত্রীরা এখনো করে চলেছেন অপরিবর্তিত রেখে এখানে তেহাই এর অংশে একটু পায়ের কাজে আছে। আঙ্গিকগত দিক থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছিল গুরু জিতেন সিং এর সময় কিছু কিছু বিষয়ে এখনও সেই ছাপ রয়ে গেছে। মনিপুরী নৃত্যের কিছু কিছু ভঙ্গিপারেঙ বা চালির মুভমেন্ট কে প্রয়োগ করতেন খুব সহজ করে।

১. চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে প্র্রথমা চিত্রাঙ্গদার স্নানের দৃশ্যে “ক্ষণে ক্ষণে শুনি”গানটির সঙ্গে মনিপুরী নৃত্যের ১ নং চালির ব্যবহার লক্ষণীয় এছাড়াও এই গানটির সঙ্গে বিভিন্ন মনিপুরী নৃত্যের ভঙ্গিমার প্রয়োগ।

২. চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে “আমর এই রিক্ত ডালি” গানটির সঙ্গে ৯ নং চালির ব্যবহার ও ১১ নং চালির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সম্পূর্ণ রূপে ব্যবহৃত না হলেও সামান্য ভেঙে ব্যবহার হয়েছে।

৩. চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে নতুন রূপ প্রাপ্ত চিত্রাঙ্গদার গান “আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়”গানটির দ্রুতলয়ের অংশ সহসা মনে জাগে আশা এই অংশটিতে মনিপুরী নৃত্যের ১৮ নং চালীর সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছেন তিনি।

৪. শ্যামা নৃত্যনাট্যের সখীদের গান “সুন্দরের বন্ধন নিষ্ঠুরের হাতে” এর সঙ্গে মনিপুরী নৃত্যের গোষ্ঠ ভঙ্গির ব্যবহার লক্ষনীয়।

৫. উত্তীয় চরিত্রের নৃত্য নির্মাণে মনিপুরী নৃত্যের সম্পূর্ণ ব্যবহার কিন্তু তা বিশুদ্ধভাবে নয় কিছুটা ভেঙে উত্তীয় চরিত্রটি আগে কথক নৃত্যের আঙ্গিক কিছুটা নির্মিত হতো।

৬. শ্যামা নৃত্যনাট্যে সখীদের সঙ্গে শ্যামার নৃত্য চর্চার দৃশ্যের মন্দিরা নাচটি নতুনভাবে তৈরি করেছিলেন গুরু জিতেন সিং।

৭.  শ্যামা নৃত্যনাট্যের আহিরিনীদের নাচটি তিনি বিভিন্ন লোকনৃত্যের সমাহার ঘটিয়ে কম্পোজিশন করিয়েছিলেন।

৮. চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যের প্রথম দৃশ্যের “নব বসন্তের দানের ডালি” গানটির সঙ্গে মনিপুরী নৃত্যের বিভিন্ন চালি ও ভঙ্গিপারেঙ ব্যবহার করেছিলেন।

৯.  চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যে দইওয়ালা চরিত্রটি কিছুটা ক্যান্ডি নৃত্যের আদলে নির্মাণ করেছিলেন।

১০.  চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যে প্রকৃতির চরিত্রটি মনিপুরী নৃত্য কে প্রয়োজন মত ভেঙ্গে কিছুটা ভারতনাট্যম ও অন্যান্য নাচের প্র্রভাব রেখে তৈরি করেছিলেন।

১১. চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যের দলগত নাচ “মাটি তোদের ডাক দিয়েছে” গানটির সঙ্গে ‘থাবলচোংবা’ (মনিপুরী লোকনৃত্য), সম্বলপুরী লোকনৃত্য, মনিপুরী নৃত্যের ‘খুবাক চোলম’ প্র্রভৃতি ভঙ্গিমার প্রয়োগ করেছেন।

এগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এছাড়াও প্রায় প্রত্যেক নৃত্যনাট্য তিনি নতুনভাবে কম্পোজিশন করেছেন আঙ্গিকগত ভাবে। তার নৃত্য রচনা এক অনন্য বিষয় হলো তিনি শুধুমাত্র মনিপুরী নৃত্য নিয়ে থেমে থাকেননি। ১৯৬৮ সালের পূর্বের ইতিহাস দেখলে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দশকের শান্তিনিকেতনের নৃত্য চর্চার ইতিহাস খুজলে দেখতে পাই বিভিন্ন বার বিভিন্ন গুরু ও ব্যক্তির দ্বারা বিশ্বনৃত্যের যে মিলবন্ধন ঘটেছিল শান্তিনিকেতনে সেই ধারাকে তিনি প্রবলভাবে অনুসরণ করতেন নিজে মনিপুরী নৃত্য গুরু হয়েও বিভিন্ন নৃত্য শৈলী এনেছেন রবীন্দ্র সংগীতের নৃত্য নির্মাণে যেমন ভারতনাট্যম, ওড়িশি, কুচিপুড়ি বিভিন্ন ভারতীয় লোকনৃত্য ও সর্বোপরি ইউরোপীয় ও রাশিয়ান ব্যালে নৃত্য। সবই সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে বজায় রেখে। এই ব্যালে নৃত্যের প্রসঙ্গে তার ছাত্রী ‘সোমঋতা চক্রবর্তী’ তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘যতদূর জানা যায়’ ঝুলন কবিতার সঙ্গে শ্রীমতি দেবীর ইউরোপীয় ব্যালে নৃত্যের আদলে নৃত্য টি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল তারপর থেকে শান্তিনিকেতন এর নৃত্য প্রয়োজনায় ব্যালে নৃত্যের প্রয়োগের খবর পাওয়া যায় না। ২০১০ সালের সম্ভবত মে মাসে শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ মহাশয় এর ১০০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে সঙ্গীত ভবনে অনুষ্ঠিত নৃত্যানুষ্ঠান টিতে “ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া” গানটির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ান ব্যালে নৃত্যের প্রয়োগ করা হয়েছিল যেটির নির্দেশক ছিলেন গুরু জিতেন সিং। এ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারটি আমি অধ্যায় শেষে সংযোজন করেছি। এটি থেকে আমরা এই ভাবনা জানতে পারি যে তিনি অল্প বিস্তর রাশিয়ান ব্যালেনৃত্য জানতেন।

   শুধুমাত্র নৃত্যনাট্য নয় প্রকৃতি, প্রেম ও পূজা পর্যায়ের বিভিন্ন গানের নৃত্য নির্মাণে তিনি বিভিন্ন নৃত্যের মিশ্রণে খুব সহজ কিছু ভঙ্গির মাধ্যমে বৈচিত্র এনে ফুটিয়ে তুলতেন। সেখানে ভারতনাট্যম, মোহিনীঅট্টম এর ভঙ্গিমা থাকতো মনিপুরী ও কথাকলি নাচের পাশাপাশি। এক্ষেত্রে আমরা আমরা অনেকটা শান্তিদেব ঘোষের নৃত্য ভাবনা বা কম্পোজিশনের সঙ্গে মিল পাই কারণ শান্তিদেব ঘোষের লেখা বইগুলি থেকে জানতে পারি তিনিও বিভিন্ন নাচ শিখেছিলেন এবং সে বিভিন্ন ধরনের নাচের সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রভাবনৃত্যে ফুটিয়ে তুলতেন।

এছাড়া একটি বিশেষ নৃত্যনাট্য এর কথা উল্লেখ করতেই হয় যার নৃত্য নির্মাণ করার পর গুরু জিতেন সিং অনেকখানি সুনাম অর্জন করেন সেটি হল ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ যদিও এটাকে নৃত্যনাট্য ঠিক বলা যায় না যেহেতু রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্য আকারে লিখে যান নি তবুও এটা নৃত্যনাট্য আকারে রূপ দেয়া হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। নৃত্যনাট্য বলা যায় কি যায় না এই বিতর্কে না গিয়ে আলোচনা করছি এই ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর নৃত্য নির্মাণ নিয়ে। ১৯৪৯ সালে প্রথম এটি নৃত্যনাট্য আকারে পরিবেশিত হয় আম্রকুঞ্জে তখন নাচ শেখানোর দায়িত্বে ছিলেন ‘নন্দিতা কৃপালিনী’ তখন এটি সম্পূর্ণ মনিপুরী নৃত্যের আঙ্গিকে হয়েছিল বলে জানা যায়। গুরু গুরুজি সিং এই নৃত্যনাট্যটিকে নতুনরূপে নৃত্য নির্মিতি ও কোরিওগ্র্রাফি করেছিলেন এই নৃত্যনাট্য নির্মাণে তার কথা বারবার আসে এই নৃ্ত্যনাট্যে যে বিশেষ দিক গুলি আমরা দেখতে পাই যা তিনি নির্মাণ করেছিলেন সেগুলো তুলে ধরেছি নিচে-

১. সম্পূর্ণ নৃত্যনাট্যটিতে মনিপুরী নৃত্যের এক বিশেষ ভূমিকা মনিপুরী নৃত্য কে প্রধান্য দিয়েই এই নৃত্যনাট্যটি নির্মিত হয়েছিল যদিও এই নৃত্যনাট্যের জন্য গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ কোন কাহিনী তৈরি করে যাননি।

২. ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ নৃত্যনাট্যটিতে অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলির ব্যবহার হয়েছিল গুরু জিতেন সিং এর কম্পোজিশনে। বাকি শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলি ব্যবহৃত হয়েছিল তার ভঙ্গি গুলি খুব সহজ করে ভেঙে ব্যবহার করা হয়েছিল কখনোই সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় নৃত্যের ভঙ্গিটি ব্যবহার করা হয়নি, প্রয়োজন অনুসারে তার ব্যবহার হয়েছিল কিঞ্চিৎ পরিবর্তনের মাধ্যমে।

৩. এই নৃত্যনাট্যে কৃষ্ণ চরিত্র টি প্রকাশ করা হয়, যদিও কোনো গানের সঙ্গে নয় মনিপুরী বাদ্যযন্ত্র পুঙ এর বোলের মাধ্যমে কৃষ্ণের নাচ পরিবেশিত হয়। গুরু জিতেন সিং এখানে মণিপুরী নৃত্যের ‘বসন্ত রাসে’র কৃষ্ণ অভিসার গানটির বাংলা অনুবাদ ব্যবহার করেছেন এবং নাচটি  বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে রেখেছেন এক্ষেত্রে।

৪. গুরু জিতেন সিং এর পরিচালনায় ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ তে “ভরা বাদর” গানটির সঙ্গে রাধার একক নৃত্য দেখতে পাই মনিপুরী নৃত্যের পাশাপাশি খুব সহজ করে ওড়িশি ও মোহিনীআট্টম নৃত্য কে ব্যবহার করেছেন তিনি।

৫. এই নৃত্যনাট্য “আজ সখি মুহু মুহু” গানটির সঙ্গে মনিপুরী নৃত্যের ২০ নং, ৭ নং, ১১ নং চালির বা চালি নৃত্যের ব্যবহার করেছেন সম্পূর্ণরূপে। এই গানের মাঝখানে কিছু কিছু জায়গায় মনিপুরী চালি নৃত্যের সম্পূর্ণ ব্যবহার গুরু জিতেন সিং এর নৃত্য নির্মাণের এক বিশেষত্ব।

৬. এই নৃত্যনাট্য “মরন রে তুহু মম” গানটি রাধার একক নৃত্য হিসেবে দেখতে পাই, এখানে ভাব নৃত্যের পাশাপাশি কিছুটা ইউরোপীয় ব্যালে নৃত্যের মত করে নাচ টি তৈরি হয়।

   এই বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলি ছাড়াও ভানুসিংহের পদাবলীর নৃত্যনাট্যে এক অনন্য রূপ দিয়েছেন গুরু জিতেন সিং। সে বিষয়ে পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব এছাড়াও এই নৃত্যনাট্যে সমবেত নৃত্য গুলিতে অর্থাৎ সখিদের নৃত্য গুলিতে খুব সহজ সাধারণ মনিপুরী ভঙ্গি গুলি দেখতে পাওয়া যায় গুরু জিতেন সিং এর কম্পোজিশনে। এছাড়াও ‘শাপমোচন’, ‘বসন্ত’, ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ প্রভৃতি নৃত্যনাট্য ও নাটিকাতে তিনি রচনা করেছেন যা আজও সমাদৃত হয়ে আছে।

এই সম্পূর্ণ চালি নৃত্যের ব্যবহারের দিকটি পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই যেখানে এই চালি গুলি ব্যবহার করা হয়েছে সেই চালির বোলের ছন্দের সঙ্গে গানে ছন্দের সঙ্গে গানে ছন্দের মিল রয়েছে। যেমন-

“সহসা মনে জাগে আশা

মোর আহুতি পেয়েছে অগ্নির ভাষা”

+                  ০

ত্রৎ  _   তা   তা । তেন তেন তা তা

খিৎ খিত্তা তেন্দা খিত্তা । তাখিৎ তাং খিৎ_

গিনাগ্র  ধে  ধে  ধে । তাক ধে ধীন গীন্নাগ্র

এই গানটিতে কাহারবা তাল ব্যবহার করা হয় যেটি আট মাত্রার  অপরদিকে এই মনিপুরী নৃত্যের এই বোলটিও আট মাত্রার। তাই গানের সাথে নাচের মুভমেন্ট এর মিল দেখে চালি গুলি নির্বাচন করে কম্পোজিশন করতেন।

                        গুরু জিতেন সিং ১৯৬৭ সাল থেকে টানা ৪৪ বছর বিশ্বভারতীতে শিক্ষকতা করেছেন শিক্ষক হিসাবে পরিচালনা করেছেন একাধিক নৃত্যনাট্য ও নৃত্যানুষ্ঠান, শুধুমাত্র শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী তাই নয় গুরুদেবের ভাবনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে তিনি ব্রতী ছিলেন। রবীন্দ্র সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ হল রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনা সেই ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে উনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি দিয়েছেন বারবার আপামোর বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কে তার গানের মধ্যে দিয়ে এবং তার নৃত্য ভাবনার মধ্যে দিয়ে। দেশের বিভিন্ন প্র্রান্তে ও বিদেশে, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ও রবীন্দ্র গানের নৃত্য পরিবেশন করেছেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গেছেন সেখানে। কখনো বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে কখনো বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে করেছেন এই সব অনুষ্ঠান গুলি সেখানে যেমন অনেকবার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে আবার পরম্পরাগত ভাবে শান্তিনিকেতনের ধারাকেও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সমান্তরালভাবে।

          এছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে উনি রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে নৃত্য যাই বলি না কেন তা প্রচার করে গেছেন বিভিন্ন উৎসব ও সেমিনার প্রভৃতি জায়গায় রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে গেছেন আমার গবেষণাপত্রে সবগুলি দেওয়া সম্ভব হলো না তাই আমি বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান গুলি সম্পর্কে এখানে দিয়েছি। উনি ‘জহর নবোদয় বিদ্যালয়েরর’ বিভিন্ন শাখায় বারবার গেছেন কর্মশালা করাতে সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে। এছাড়া কলকাতা দূরদর্শন ও শান্তিনিকেতন দূরদর্শনে নিয়মিত তার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে ২০১৫ সালে শান্তিনিকেতনে দূরদর্শন তাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে।:

            ১৯২০ সাল থেকে শান্তিনিকেতন এই যে নৃত্য চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল তার ধারা আজও বয়ে চলেছে, প্রথাগত মনিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্য শিক্ষার জন্য নয় রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে নাচ পরিবেশন এর জন্যই মূলত মনিপুরী নৃত্য শান্তিনিকেতনে পদার্পন করেছিল। এরপর একে একে অন্যান্য নৃত্যশৈলীর স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের নৃত্য নির্মিততে কিন্ত মনিপুরী নৃত্য সর্বদা অগ্যণী ভূমিকায় থেকেছে। শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্যগুরু রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেছেন আঙ্গিকগত ভাবে। গুরু নবকুমার সিং এর সময়ে ‘নটীর পূজা’ র হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যে নৃত্য চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল আজও তা হয়ে চলেছে। বিভিন্ন নৃত্যগুরু বিভিন্ন সময়ে নৃত্যনাট্য চরিত্র নির্মিতি করেছেন মনিপুরী ও অন্যান্য নাচের মধ্য দিয়ে। তেমনি গুরু জিতেন সিং টানা ৪৪ বছর ধরে রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য নিয়ে কাজ করেছেন, মনিপুরী নৃত্য গুরু হলেও উনি বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নৃত্যের ভঙ্গি  নিয়ে কাজ করেছেন যেমন ভারতনাট্যম, ওড়িশি, কথাকলি ও বিভিন্ন লোকনৃত্যের ব্যবহার করেছেন শান্তিনিকেতনের নৃত্যভাবনায় যে মিষ্টির কথা আমরা পাই সেটিকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। শুধু শান্তিনিকেতন নয় শান্তিনিকেতনের বাইরের দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় গুরুদেবের নৃত্যভাবনাকে প্রচারের লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে গেছেন বারবার। গুরুদেবের নৃত্য ভাবনাকে সমসাময়িক মঞ্চে উপযোগী করার জন্য কিছু কিছু পরিবর্তন করেছিলেন উনি আঙ্গিকের দিকে এবং সাজ-সজ্জাতেও, অবশ্য এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে তবে বেশির ভাগটাই গ্র্রহণীয় হয়েছে শান্তিনিকেতনে। এত বছর একসঙ্গে কাজ করার ফলে আঙ্গিকগত হবে গুরু জিতেন সিং এর কম্পোজিশন গুলির মধ্যে একটা নিজস্ব স্টাইল তৈরি হয়ে গেছিল। সেই ধারায় গুরু জিতেন সিং এর বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রী কাজ করছে তারা দেশ-বিদেশে রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ভাবনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি মনিপুরী নৃত্য  কে মঞ্চে পরিবেশনের জন্য পরম্পরা বজায় রেখে কিছু কিছু পরিবর্তন করেছেন সেটা অবশ্যই বর্তমান যুগের দর্শকদের কথা ভেবে ও অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের পাশে মনিপুরী নৃত্য কে তার প্রাপ্য জায়গাটুকু করে দিতে। রাজনীতিকে মনোযোগী করেছেন নতুন একক নৃত্য রচনা করেছেন পোশাক ও সাজ-সজ্জা আধুনিকরণ করেছেন।

নৃত্যগুরু যতীন্দ্র সিংহ জিতেন আর নেই, বিভিন্ন মহলের শোক

গুরুদেবর নৃত্য ভাবনাকে শুধু প্রচারই নয় বাকি শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলি পাশে তাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য এর সাংস্কৃতিক বিষয়ক তার অবদান ছিল যথেষ্ট, নতুন বউয়ের বিভিন্ন চরিত্রের নৃত্য রচনা পোশাক পরিকল্পনা ও প্রভৃতি বিষয়ে অনেক অবদান রয়েছে তার শান্তিনিকেতনের প্রযোজনা গুলিতে, শান্তিনিকেতনের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে সেগুলি। এই বিষয়গুলি সংরক্ষণের তাগিদেই গবেষণাটি করার চেষ্টা। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকায় বেশ কিছু তথ্য সম্পূর্ণরূপে দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সাক্ষাতকার থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় গুরু জিতেন সিং শান্তিনিকেতনের যে নৃত্যধারা তাকে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন গুরুদেবের ভাবনাকে বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, তিনি এমন একজন নৃত্যগুরু ছিলেন যিনি সব থেকে বেশি সময় শান্তিনিকেতনের নৃত্য শিক্ষক হিসাবে ছিলেন। শান্তিনিকেতনের নৃত্যভাবনায় পোশাক ও সাজ-সজ্জার দিকে তার অবদান অনেক খানি, পরীক্ষামূলক ভাবে অনেক কিছুর প্র্রয়োগ তিনি করেছেন তার বেশির ভাগটাই সফল হয়েছে শান্তিনিকেতনে প্রযোজনা গুলিতে। রবীন্দ্রসংগীতের নৃত্য নির্মিত তার অবদান স্বাভাববিকভাবেই অনেকখানি, তিনি শুধু পরিচালনা নয় শিক্ষক হিসাবে তৈরী করে গেছেন অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের যারা রবীন্দ্র শিক্ষার সেই আদর্শকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্রতী আছেন। ২০১৪ সালে বিশ্বভারতী সঙ্গীত ভবনে রবীন্দ্রনৃত্য বিভাগ শুরুর সময় তিনি কোর কমিটিতে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে ছিলেন। ২০১৮ সালে ২রা এপ্রিল এই মহান শিল্পী পরলোকগমন করেন রেখে যান তার বিপুল শিল্পকর্ম, সেইসব শিল্পকলার ইতিহাস। কার্ড ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এবং শান্তিনিকেতনের নৃত্যনাট্য প্রযোজনার মধ্যে দিয়ে তিনি জীবিত হয়ে থাকবেন আগামীতে।

তথ্যসূত্র:

১) বন্দ্যোপাধ্যায়, হিরন্ময়। রবীন্দ্র শিল্পতত্ত্ব। কলিকাতা: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ [১৯৭০ খ্র্রীস্টাব্দে] ।

২) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। ছন্দ। কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, জুলাই, ১৯৩০ খ্র্রীস্টাব্দে। আষাঢ় ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ।

৩) ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। জাভাযাত্রীরর পত্র। কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, জৈষ্ঠ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ [মে ১৯২৯]

৪) ঘোষ, শান্তিদেব। শুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য। কলিকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স ১লা বৈশাখ ১৩৯০ বঙ্গাব্দ [এপ্রিল ১৯৮৩]।

৬) ঘোষ, শান্তিদেব। নৃত্যকলা ও রবীন্দ্রনাথ। কলিকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, জানুয়ারী ১৯৯৯।

৮) ভট্টাচার্য, বিষ্ণুপদ। রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্য দর্শন ও অলংকার শাস্ত্র। কলিকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১লা বৈশাখ ১৩৯৬ [এপ্র্রিল ১৯৮৯]।

৯) চৌধুরি, প্রভাসজীবন। সৌন্দর্য দর্শন। কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, শ্রাবণ ১৩৬১ [জুলাই ১৯৫৪ খ্র্রীস্টাব্দে]।

১১) দেবী, প্রতিমা। নৃত্য। কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ২৫শে বৈশাখ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ

  • রায়, পান্নালাল। রবীন্দ্রনাথ ও মনিপুরী নৃত্য। কলিকাতা: একুশ শতক, ফেব্রুয়ারি ২০০৮
  • The telegraph, Kolkata, 30 August 2002
  • মরুক, এিপুরা, বর্ষ ৩৯, ১৮তম সংখ্যা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭
  • Hueiyen lanpao, Imphal, 25th may 2012
  • Hyderabad hans, Hyderabed February 3rd 2012
  • দৈনিক স্টেটসম্যান, কলকাতা ১৭ আগস্ট ২০১০
  • দৈনিক বাংলা, ঢাকা, ১৩ জুন ১৯৮০
  • Daily telegraph, printed in London and Manchester, 27th may 1986
  • Young India, Shillong, 9th july 1970
  • চিত্রালী, ঢাকা, ২০ জুন ১৯৮০
  • রাজপথ, কলকাতা ২৪ শে আগষ্ট ১৯৯৫
  • The Statesman, Kolkata, June 9, 1995
  • দৈনিক সংবাদ, আগরতলা, ২৩ শে অক্টোবর ১৯৯২
  • আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ এপ্রিল ২০০৮
  • সিলেটের ডাক, ২০ কার্তিক ১৪০৯ বাংলা, ৪ নভেম্বর ২০০২
  • হিন্দুস্থান, এলাহাবাদ, ৬ , ফেব্রুয়ারি ২০১১
  • সিলেটের ডাক, সিলেট, বাংলাদেশ, ২২ শে কার্তিক ১৪০৬ বাংলা, ৬ নভেম্বর ১৯৯৯
  • যুগশঙ্খ, শিলচর, ২৫ অক্টোবর ২০০৪
  • সাপ্তাহিক বরাককন্ঠ, শিলচর, বর্ষ ১ সংখ্যা ২১, ১৬ জুন ২০০৪ খ্র্রীস্টাব্দে
  • প্রতিদিন, কলকাতা, ৭ মার্চ ১৯৯৭