বাংলার শক্তি সাধনা ও বাঙালির শাক্তগীতি
তমাল দাস, গবেষক, কণ্ঠসংগীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাগান বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়কে বহন করে। সুদীর্ঘ এক হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার সাথে সুর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই এক হাজার বছর ধরে একটি সুদীর্ঘ অঞ্চলের মানুষের মনের ভাব সুরের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার দরুন বাংলাগান সুর-ভাব-কথার বিচিত্রতায় বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে। এতে বাংলা গানের সম্ভার ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছে। বাংলাগানের বিভিন্ন ধারার মধ্যে ‘পদাবলী গান’ একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংগীত। এই পদাবলী গানের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথমটি হলো ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ যা বাংলাভাষার মধ্যযুগের সূচনায় রচিত হতে শুরু করে। আর দ্বিতীয়টি হল ‘শাক্ত পদাবলী’, যা মধ্যযুগের অন্তিম পর্যায়ে রচিত হতে শুরু করে। ‘পদাবলী’ সংগীতের দুটি ধারাই ভক্তিভাবে আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। এদের মধ্যে শাক্তগীতিগুলি রচনার দিক থেকে বৈষ্ণব পদাবলীর তুলনায় নবীন। প্রধানত মাতৃশক্তির বন্দনার উদ্দেশ্যে শাক্তপদগুলি রচিত হয়। শাক্তপদগুলি ভাবে-ভক্তিতে, স্নেহে-বাৎসল্যে এমনভাবে পরিপূর্ণ হয়েছে যে বাংলার আপামর জনমানসে এগুলি চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। শাক্তপদাবলীর প্রচার ও প্রসার শুরু হতে থাকে সাধক কবি শ্রী রামপ্রসাদ সেনের হাত ধরে। এরপর আরেকজন সাধক তথা কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যও এই ধারার অনেক গান রচনা করেন। সাধনালব্ধ বাণীর গভীরতা ও কথার সারল্য ছিল এই গানগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এদের পরবর্তী পর্যায়ে গানগুলি এত জনপ্রিয় হয় যে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সংগীতকার এমন ধরনের গান লিখতে শুরু করেন। এদের মধ্যে কবিয়াল, পাঁচালীকার, যাত্রাপালাকার সবাই এই ধরনের গান রচনা করেছেন। ফলস্বরূপ শাক্তগীতিগুলির পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনই সুরের বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সমগ্র শাক্তগীতিগুলিকে একত্রিত করে শাক্তপদাবলী নামকরণ করা হয়। শাক্ত পদাবলীর মত বৈচিত্র্যপূর্ণ মাতৃবন্দনামূলক গান সমগ্র ভারতের মাতৃসংগীত জগতে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বিষয় সূচক শব্দ:
বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী, মাতৃসংগীত, কবিয়াল, পাঁচালীকার, চর্যাপদ, সান্ধভাষা, গীত গোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, যজুর্বেদ, মার্কেন্ডেয় চন্ডী, চামুন্ডা তন্ত্র, মহানির্বাণ তন্ত্র, যোগ দর্শন, কৈবল্য, সুষুম্না নাড়ী, উমাসংগীত, শ্যামাসংগীত।
বাংলার শক্তি সাধনা ও বাঙালির শাক্তগীতি
বাংলা ভাষা ও বাংলার গান :
বাংলার সংস্কৃতির একটি বড় অংশ হলো সংগীত। বাংলার গান বাংলার মানুষজনের মনের ভাবকে ব্যক্ত করে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে স্থিত একদা অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন ধারার সংস্কার তথা বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি বাঙালির গানকেও বৈচিত্রে পরিপূর্ণ করেছে। ফলস্বরূপ বাংলাগানের সম্ভার সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাই বাংলা অঞ্চলের মতো গানের এত বৈচিত্র্য সম্ভবত ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে পাওয়া যায় না।
কণ্ঠসংগীতের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় রচিত যেকোনও গানকে সহজ সরলভাবে বাংলাগান বলা যেতে পারে। অবশ্য অনেক বাংলাগানেই আমরা বিদেশি বা ভিন রাজ্যের শব্দের প্রয়োগ দেখতে পাই। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গানগুলিতে বাংলা ভাষার আধিক্য থাকার জন্য তাকে বাংলাগানই বলা হয়। তাছাড়াও বাংলার বিভিন্ন মানুষের স্থায়ী বসবাস হওয়ার ফলে বাংলা ভাষাতেও এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাভাষী মানুষ অন্যান্য ভাষাভাষীর শব্দকে গ্রহণ করে তাকে ব্যবহারিক প্রয়োগ করার ফলে সেগুলিরও বাংলা শব্দের অভিধানে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। যেমন- কাগজ (ফারসি শব্দ), চাবি (পর্তুগিজ) ইত্যাদি শব্দ।
বাংলায় রচিত বাঙালির শাক্তগান বাংলাগানের জগতে এক বিশেষ সম্পদ। বাংলার বিভিন্ন ধরনের গানকে একত্রে বলা হয় বাংলাগান। এখন প্রশ্ন হলো এই বাংলাগানের উৎস কি? এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে যে তথ্য-প্রমাণাদি পাওয়া যায় তা থেকে মনে করা হয় খ্রিস্টীয় দশম-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদই বাংলাগানের উৎস।
এই চর্যাপদের সময়কে বলা হয় সান্ধ্য ভাষার যুগ। অর্থাৎ এই সময়তেই পুরাতন ও নতুনের সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা তার নতুন অবয়ব ধারণ করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের সাথে সাথে গানও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মূলত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাদের আধ্যাত্মিক চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন গান বা এই চর্যাপদগুলির মাধ্যমে। তাই একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে বাংলা ভাষা ও গান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার আদি যুগ থেকে গান তার বিবর্তনের সঙ্গী হয়েছে।
আসলে চর্যাগীতিগুলি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের উপাসনা গীত। বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনগুলি বৌদ্ধাচার্য্যদের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। বৌদ্ধ দর্শনের একটি নমুনার সামান্য অংশ নিচে দেখানো হলো-
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চী এ পইঠা কাল।।
অর্থাৎ বৃক্ষ রূপ শরীরে পঞ্চ ইন্দ্রিয় হল শাখা-প্রশাখা স্বরূপ। আর এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কারণে চিত্ত চঞ্চল হয়।
উপরের এই উদাহরণটি উদ্ধৃত হল শুধু এটুকু দেখানোর জন্য যে বাংলাগানের সূচনা হয় আধ্যাত্ম দর্শনের হাত ধরে। আলোচ্য বিষয়বস্তু ‘শাক্তপদ’ গুলিও আধ্যাত্ম চেতনার আরেক রূপ। বাংলা ভাষা তথা গানের প্রায় কয়েক শত বছরের বিবর্তনের পর বাংলা সাহিত্যে শাক্তপদগুলির সংযোজন হয়।
বাংলাগানের প্রাচীন যুগ যেটি আনুমানিক দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল তাকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল-
১) চর্যাপদ ২) গীতগোবিন্দ ৩) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন
এবার পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বাংলাগানের যে মধ্যযুগ শুরু হয় সেটি পাঁচভাগে বিভক্ত। সেগুলি হল-১) পদাবলী সাহিত্য ২) মঙ্গলকাব্য ৩) অনুবাদ সাহিত্য ৪) লোকসংগীত ৫) অন্যান্য গান।
এদের মধ্যে পদাবলী সাহিত্যকে দুইভাগে ভাগ করা যায়-
১) বৈষ্ণব পদাবলী ২) শাক্ত পদাবলী
এইভাবে বাংলাগানের মধ্যযুগের অন্তিম পর্যায়ে শাক্তগানগুলি বাংলা সাহিত্যে সংযোজিত হতে শুরু করে।
বাংলায় শাক্তগীতির উদ্ভব :
বাংলাগানে তথা সাহিত্যে কিভাবে শাক্তপদগুলির প্রবেশ হয় সেই দিকে আলোকপাত করা যাক।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাগানের মধ্যযুগ শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। মধ্যযুগের সূচনায় পদাবলী সাহিত্যের মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীগুলি রচিত হতে শুরু করে। তাই তুলনামূলকভাবে বৈষ্ণব পদাবলী প্রাচীন। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচিত হয়। সেই সময় বাংলায় কৃষ্ণ সাধনা প্রবল হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পর বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে বাংলার মানুষ জাতির ভেদাভেদ ভুলে কৃষ্ণপ্রেমে মেতে ওঠে। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও প্রসারের একটি বড় মাধ্যম ছিল কীর্তন গান। এই গান সাহিত্যে-রসে ও কাব্যে এত উন্নত ছিল যে সমগ্র বাংলা কৃষ্ণপ্রেমে অবগাহন করল।
এক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উৎসাহে ও প্রচেষ্টায় বৈষ্ণব সাহিত্যে অসংখ্য পদাবলী কীর্তন সংযোজিত হলো, যার ধারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোভাবের পরেও কয়েক শতাব্দি যাবত অক্ষুন্ন ছিল।
কিন্তু বাংলায় ইংরেজ প্রবেশের প্রাক্কালে সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম বিশৃঙ্খলা পূর্ণ অবস্থাতে মানুষের নিত্য চাহিদা ও নিরাপত্তার চাহিদা এতটা প্রবল হয়ে উঠেছিল যে সাধারণ মানুষ অত্যাচার ও নিষ্পেষণের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য মাতৃরূপের বন্দনায় ব্রতী হল, যিনি একাধারে ভয়ঙ্করী ও শুভঙ্করী। এই দেবীর বর্ণনা আমরা পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যে পেয়ে থাকি। মনে করা হয় যে সাধক শ্রী রামপ্রসাদ সেনের হাত ধরেই বাংলায় শাক্তগানের সূচনা। আসলে রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাবের পূর্বেও কতিপয় শাক্তপদ রচিত হয়েছিল। তবে রামপ্রসাদের রচনার মানের কাছে সেগুলি নিষ্প্রভ হয়ে যায়। সাধক কবি শ্রী রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাব এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে হয়েছিল, যখন মুসলমান রাজত্বের অন্তিম সময় ও ইংরেজরা রাজত্বের সূচনার পথ প্রশস্ত করছিল। এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা রামপ্রসাদের সাধক কবি মনে দৃঢ় ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার ফলস্বরূপ শাক্ত সাহিত্যে এইসব মূল্যবান শাক্ত গানগুলি প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর এই গানগুলি যেন পুষ্পস্বরূপ মাতৃচরণে অঞ্জলি নিবেদন। গানগুলি আবেগে, আকুলতায়, সরলতায়, বীরতায় ভালবাসার অকৃত্রিমতায় যে প্রেরণা সঞ্চার করেছিল তাকে বাংলার আপামর জনসাধারণ নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে গ্রহণ করেছিল। ফলে রামপ্রসাদ সেনের সময় থেকেই লোকমুখে শাক্তগীতিগুলি প্রচারিত-প্রসারিত হতে শুরু করে।
বাংলায় শাক্তবাদের উৎস :
আমরা পূর্বে বাংলাভাষা, বাংলাগান ও শাক্তগীতির উদ্ভব সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা পেলাম। এইবার ‘শাক্তবাদ’ ব্যাপারটি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। ‘শাক্তগীতি’ কথাটি এসেছে ‘শক্তি’ এই শব্দটি থেকে। শক্তির উপাসককে বলা হয় ‘শাক্ত’। যেমন সূর্যের উপাসককে বলা হয় ‘সৌর’। বিষ্ণুর উপাসককে বলা হয় ‘বৈষ্ণব’। শক্তি বলতে বিশ্বজগতের চালিকাশক্তি যা সমগ্র বিশ্বের সমস্ত জড় যথা জীবের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে তাকে অনুভব করা। সেই শক্তিকে অন্তরে অনুভব করে তার প্রতি শ্রদ্ধা অর্পন করাই হল শক্তির উপাসনা। কথিত আছে- ‘যাহা আছে ব্রহ্মান্ডে তাহা আছে দেহ ভান্ডে’।
এই ব্রহ্মান্ডের শক্তির স্ফুরণকে নিজের দেহ-মনে চেতনায় অনুভব করাই হলো শক্তির উপাসনার প্রথম সোপান। তাই শক্তি উপাসনার মূল বিষয় বা গুঢ় অর্থ নিয়ে যে গানগুলি রচিত হয়েছে, সেগুলির উল্লেখ এই সকল গানগুলি রচনার বহু বহু পূর্বে প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতেই উল্লেখ আছে। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রের প্রায় সবগুলোতেই এর উল্লেখ আছে। বেদ, পুরাণ, যোগশাস্ত্র, তন্ত্রশাস্ত্র সবগুলিতেই শক্তির মহত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
শক্তিবাদ এর আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে যে শক্তি উপাসনা হেতু উপাসকরা নারী মূর্তিকে মাতৃশক্তি রূপে আবাহন করেছে। শুধু প্রাচীনকাল থেকেই দেখা গেছে শক্তির উপাসনার জন্য আলম্বন হিসাবে মাতৃমূর্তি স্থাপনার মাধ্যমে নিরাকার স্বত্তায় উন্নত হতে সচেষ্ট হয়েছে। মনে স্বাভাবিকভাবেই মাতৃশক্তির মাহাত্ম্য ও গুরুত্বের কারণ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ হয়।
শক্তির উপাসনায় মাতৃশক্তির মহিমা :
মাতৃশক্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যতটুকু ধারনা উপলব্ধ হয় সেগুলো নিম্নে ব্যাখ্যায়িত হল-
১। কোন নতুন প্রজন্মের বীজ গঠিত হয় মাতৃগর্ভে। বীজ সৃস্টির জন্য পুংশক্তির প্রয়োজন
হলেও সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মাতৃগর্ভে।
২। নবজাতক জন্মলাভ করার পর মাতৃস্তন পান করে প্রথম জীবনীশক্তি লাভ করে।
৩। প্রাণীকুলের যেকোনো শিশুই মায়ের মননশক্তি দিয়েই জগতকে দেখতে শেখে। মা-
ই তাকে পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়।
৪। সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে জাগতিক বস্তুই মায়া। এই মায়া হলো প্রকৃতি। সুতরাং
জাগতিক বিষয়ের ভোগ ও তার সমাপন সম্পূর্ণ বিষয়টিতেই মাতৃশক্তির বন্দনা
অপরিহার্য।
এই ভাবেই যুগ যুগ ধরে শক্তি আরাধনার সাথে সাথে মাতৃশক্তির বন্দনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে।
প্রাচীন বৈদিক যুগ পুরুষ দেবতা প্রধান হলেও মায়ের মহিমাকে ক্ষুন্ন করা হয়নি। যজুর্বেদের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো-
যথে মাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ
ব্রহ্মারাজন্যাভাং শুদায় চার্যায় চ স্বায় চারনীয়চ।।
অর্থাৎ কল্যাণময়ী মা সমাজের সকলস্তরের লোকের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, অরণ্যবাসী এবং অন্যান্য) কল্যান করেন।
আবার মার্কেন্ডেয় চণ্ডী তে দেখা যায়-
দুর্গাসি দুর্গ ভবসাগর নৌ-রসঙ্গা
অর্থাৎ দুর্গম ভবসাগরে নৌকা স্বরূপ বলে তুমি দুর্গা।
এইরকম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখন্ডে দেবীশক্তির বর্ণনা পাওয়া যায় এইভাবে-
যয়া বিনা চ বিশ্বেষু সর্ব্বং কর্মাতিনিষ্ফলম
মোক্ষদা যা মুমক্ষুনাং কামিনাং সর্বকামদা।।
অর্থাৎ সর্বপ্রকার কামনা-অভিলাষ পরিপূর্ণকারী এই দেবী বা মাতৃশক্তিই মোক্ষদায়িনী যিনি জীবন-মরনের চক্রাবর্ত থেকে জীবকে মুক্ত করতে পারেন।
আবার তন্ত্রশাস্ত্রে তো মাতৃশক্তির মহিমাই সর্বোপরি ব্যবহৃত হয়েছে, চামুন্ডাতন্ত্রে যে দশমহাবিদ্যার বর্ণনা পাই তার একটি নমুনা হলো এই রূপ-
কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মামিকা
এত দশ মহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীর্তিতাঃ।।
দশমহাবিদ্যার এই দশ দেবীই বিশেষ বিশেষ শক্তির অধিকারিনী। সাধকগণ তার অভীষ্ট সিদ্ধিহেতু উক্ত দেবীগণের শরণাপন্ন হন।
আবার যোগ সাধনায় যে কুল কুণ্ডলিনী জাগরণের জন্য ‘ষটচক্র’ সাধনার বিধান আছে সেই চক্র সাধনায় ‘ষটচক্র’ অর্থাৎ ‘আজ্ঞাচক্রে’ (ভ্রু যুগলের মধ্য স্থান) শিব ও কালীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়।
তাহলে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এইটুকু পরিষ্কার হওয়া গেল যে সাধনায় দেবী শক্তির এক বিশেষ প্রভাব রয়েছে।
উপরিউক্ত আধ্যাত্ম দর্শনবোধই পরবর্তীকালে বাংলায় শাক্তগীতিগুলি রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। এবার শাক্তগীতি গুলির বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারবো যে কিভাবে উপরিউক্ত দর্শনগুলি শাক্তগীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মহানির্বাণ তন্ত্রে কালীর কালো রূপের পিছনে যে ব্যাখ্যাটি আছে সেটি হল- ‘কাল’ অর্থাৎ ‘সময়’। বর্তমানকাল অতীত হলেই তা স্মৃতিতে পরিণত হয়। তারার বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না। জাগতিক সব ভালো মন্দই কালগর্ভে পতিত হয়। এই ‘কাল’ অর্থাৎ ‘সময়’কে যিনি হরণ করেন তিনি ‘কালী’ বা ‘মহাকালী’।
সাধক কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য এই দর্শনটিকেই তাঁর কাব্যে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন-
সদানন্দময়ী কালী
মহাকালের মনমোহিনী
তুমি আপনি নাচো আপনি গাও মা
আপনি দাওনা করতালি।।
আবার পাতঞ্জল যোগ দর্শনের কৈবল্যবাদের সর্বশেষ সূত্রে বলা হয়েছে-
পুরুষার্থশূন্যাং গুনানাং প্রতি প্রসবঃ কৈবল্যং
স্বরুপ প্রতিষ্ঠা বা চিতি শক্তিরিতি।
অর্থাৎ পুরুষ যখন ‘কেবল’ বা ‘নির্গুণ’ হন মানে যখন প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক বস্তু প্রতিবিম্বিত হয়না আত্মা যখন চৈতন্য রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকেন, বিকার হয় না এইরকম নির্বিকার হওয়াকে ‘কেবল’ বা ‘কৈবল্য’ বলা হয়। শক্তি মতে এইজন্যই শিব-কালী যুগলমূর্তি বা শায়িত শিব বা দণ্ডায়মান কালীমূর্তি এত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলম্বন। অর্থাৎ কিনা বস্তুগত ও প্রাকৃতিক যা কিছু সবই মায়ের অধীনস্থ। তাই মায়ের আরাধনা করেই জীবন মুক্ত হওয়া যায়। এরকম ভাবে ভাবিত হয়েই কবি নজরুল লিখেছেন-
কালো মেয়ের পায়ের তলায়
দেখে যা আলোর নাচন
রুপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন।।
এরকমভাবে তন্ত্র তত্ত্বের কিছু গুঢ় তত্ত্বকে রামপ্রসাদ সেন কাব্যে তুলে ধরেছেন-
এবার আমি ভালো ভেবেছি
এক ভাবির কাছে ভাব শিখেছি
যে দেশেতে রজনী নাই
যে দেশের এক লোক পেয়েছি।
এই কবিতার একটি স্থানে আছে-
‘সন্ধ্যাকে বন্ধ্যা করেছি’।
এভাবে ‘যে দেশেতে রজনী নাই’ প্রভৃতি কলীগুলি তন্ত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
‘যোগশাস্ত্র’ বা ‘তন্ত্রশাস্ত্রে’ এইরকম মনে করা হয় যে মেরুদন্ড থেকে মস্তিস্ক পর্যন্ত গঠনের মধ্যে তিনটি প্রধান নাড়ী অবস্থান করে। এদের মধ্যে মধ্যস্থিত নাড়ীটিকে বলা হয় সুষুম্না নাড়ী। এই সুষুম্না নাড়ির গতিপথ খুলে গেলে সাধকের সিদ্ধিলাভ হয়। তখন অন্তরে দিবারাত্রির মধ্যবর্তী সান্ধ্যকালীন নির্মল অবস্থা বিরাজ করে। এই কারণেই তিনি উপরিউক্ত শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন।
ভক্তি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হল শাক্তগীতি
পূর্বোল্লিখিত পদগুলির সবকটিতেই আমরা সাধন তন্ত্রের ইঙ্গিত পাই। এছাড়াও শাক্তপদগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রধানত দুই ধরনের সংগীতের মধ্যে বিরাজমান।
১) উমা সংগীত ২) শ্যামা সংগীত
সমগ্র ভারতে মাতৃশক্তি ‘মা’ রূপে পূজিত হলেও বাংলায় তিনি ঘরের মেয়ে রূপে সমাদৃতা। এই ভাব নিয়ে রচিত গানগুলি উমাসংগীত নামে পরিচিত। গানগুলিতে সাধনতন্ত্রের কথা না থাকলেও ভক্তিতে, স্নেহের পরকাষ্ঠায়, বাৎসল্যের দিক থেকে অতুলনীয়। তৎকালীন যুগ থেকে আজ অবধি গানগুলির জনপ্রিয়তা সত্যই মনে রাখার মতো ব্যাপার। এইরকম গানগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকটি গান আজও আশ্বিন মাসে শারদোৎসবের সময় ধ্বনিত হয়-
১) কবে যাবে বল গীরিরাজ গৌরীরে আনিতে।
২) এবার আমার উমা এলে আর উমায় পাঠাব না।
এইভাবে বাংলার শক্তিসাধনার সঙ্গে শাক্তগানগুলি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। কোন গানে আমরা মাতৃশক্তির বৃহৎ ব্যাপক রূপকে অনুমান করি আবার কোন গানে আমরা কন্যাস্বরূপ বাৎসল্যে পরিপূর্ণ হই। এইভাবে বাঙালির শাক্তগান বাঙালির মননে, বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। সম্ভবত সমগ্র ভারতের কোন স্থানের দেবী সাহিত্য ভক্তির আকুলতায়, ভক্তের আকুতিতে, সরলতায়, স্নেহ বাৎসল্য রসে দ্রবীভূত হয়ে এইভাবে সমৃদ্ধশালী হয়নি।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. সেন, পৃথ্বীরাজ, ভারতের ঋষি ও জীবন সাধনা, কোলকাতা, গিরিজা লাইব্রেরি, ২০১৬।
২. চক্রবর্তী, জাহ্নবী কুমার, শাক্তপদাবলী ও শক্তিসাধনা, কোলকাতা, ডিএম লাইব্রেরি,১৩৯৪ রথযাত্রা।
৩. দাশগুপ্ত, শশীভূষণ, ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য, কোলকাতা, সাহিত্য সংসদ প্রাঃ লিঃ, ১৩৬৭ ভাদ্র।
৪. বসু, অরুণ কুমার, শাক্তগীতি পদাবলী, কোলকাতা, পুস্তক বিপণি, ১৪০৮।
ছবি
https://horoppa.wordpress.com/category/এলোমেলো-ভাবনা/দর্শন/বাঙালির-লৌকিক-ভাবদর্শন/শক্তি-সাধনা/
https://bn.wikipedia.org/wiki/শাক্তধর্ম
https://www.facebook.com/tdasgupto/posts/সাধক-কবি-কমলাকান্ত-পূর্বগামী-শাক্তকবি-রামপ্রসাদের-বিপুল-ছটায়-তিনি-কিছুটা-ঢাকা-পড়/3213943828629164/