July 1, 2023

Empowerment of the British in the Practice of Bengali Language and History in the Nineteenth Century

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Shatabdi Sadhu Mondal

Abstract:

This study delves into the multifaceted dynamics of the British presence in Bengal during the nineteenth century, specifically examining their engagement with the Bengali language and history. Focused on the empowerment of the British, the research elucidates the mechanisms through which linguistic and historical knowledge became instruments of influence and control. By scrutinizing the educational, administrative, and cultural initiatives undertaken by the British, this study aims to unravel the intricate ways in which they navigated and wielded the power dynamics inherent in language and historical narratives. Drawing on a variety of primary sources, including archival materials, official documents, and literary works of the time, the research provides a nuanced exploration of how the British not only acquired linguistic and historical proficiency but also strategically employed these skills to consolidate their authority. The analysis extends to the impact of these initiatives on local communities, shedding light on the implications of such empowerment for both the British rulers and the Bengali populace. Ultimately, this study contributes to a deeper understanding of the complex interplay between colonial powers and indigenous cultures, highlighting the role of language and history as tools of empowerment in the broader context of nineteenth-century British colonialism in Bengal.

প্রাক্‌ উনিশ শতকে ইংরেজদের বাংলা ভাষা ও ইতিহাস চর্চায় শাসকের ক্ষমতায়ন

শতাব্দী সাধু মণ্ডল 

অধ্যাপক (SACT-1) বারাসাত সরকারী মহাবিদ্যালয়, বারাসাত, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 

সারসংক্ষেপ:  শাসকের কাছে ভাষা যেকোনো ভূখণ্ডের অধিবাসীর কাছে পৌঁছে যাওয়ার বা অনুমোদন পাওয়ার পক্ষে বিশ্বস্ত এবং জরুরি গণমাধ্যম। শাসন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনে কোনো বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের বহুজন, বহুঅঞ্চল, বহুধর্ম দ্বারা ব্যবহৃত ভাষার বিচিত্র চেহারাকেও নির্দিষ্ট এক নিয়মের মধ্যে আনতে হয়। এই নির্দিষ্ট নিয়ম ভাষার এক আদর্শ এবং সর্বজনমান্য রূপ দান করে। এই সর্বজমান্য রূপ ভাষার মাধ্যমে শাসকের কাছে অনুগত হতে শেখায় তার প্রজাদের। এই নিয়মেরই ভাষিক রূপ ব্যাকরণ। যদিও ভাষার এ নিয়মকে হতে হয় শাসকের স্বার্থানুসারী। এ লেখাতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা হয়েছে প্রাক্‌ উনিশ শতকে হ্যালহেডের ব্যাকরণ এবং উইলিয়াম জোন্সের এশিয়াটিক সোসাইটিতে দেওয়া বক্তৃতাকে। এই দুই বইতে বাংলাদেশ এবং বাংলাভাষাকে এক নিয়মের নিগড়ে আনার প্রচেষ্টার ভিত্তিতে ছিলো ইংরেজ শাসক এবং বাংলাদেশের অধিবাসীর মধ্যেকার বিজেতা-বিজিত সম্পর্কের সমীকরণ। প্রাক্‌ উনিশ শতকে ইংরেজদের বাংলাভাষা চর্চায় বাংলাদেশে ইংরেজ উপনিবেশ স্থাপনের সঙ্গে যোগসাযোগকে স্পষ্ট চেহারা দিয়েছিলো। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে ইংরেজ শাসনের অনুপ্রবেশ বা এক ভূখণ্ডকে আরেক ভূখণ্ডের চোখ দিয়ে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা- সেই ইচ্ছা থেকে ভূখন্ডে ব্যবহৃত ভাষার প্রকৃতি নির্ণয়- ভাষার স্বভাবানুসারে ভূখণ্ডের অধিবাসীদের প্রকৃতি নির্ণয়- তাদের প্রকৃতি অনুসারে চিন্তা ও আবেগের লিপিবদ্ধ নিদর্শন হিসাবে বাংলা সাহিত্যকে বুঝতে চাওয়া এবং নির্মাণ করার এই দর্শন প্রাক্‌ উনিশ শতকে ইংরেজদের বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় ঘুরে ফিরে আসে। 

সূচক শব্দঃ শাসক, ভাষা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ক্ষমতায়ন। 

মঙ্গলকাব্যের বিশিষ্ট কবি ভারতচন্দ্রের ‘নতুন মঙ্গল’ ‘অন্নদামঙ্গল’-এর লিখন সাল ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দ। ভারতচন্দ্রের মৃত্যু ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ। ভারতচন্দ্রের জীবদ্দশায় পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা  বাংলাদেশে সময়ের পালাবদলের সঙ্কেত ছিলো। উল্লেখ্য যে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছিল মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, চৈতন্যজীবনী সাহিত্যের চর্চা । হয়তো ঐতিহ্যবাহী সময়ের মধ্যে এমন এক নতুন ক্ষমতার স্বর তৈরি হয়েছিলো যা এতদিনের বাংলা ভাষায় লেখা পৌরাণিক সাহিত্যের জগতের চর্চায় অনুকূল ছিলো না।  

১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌল্লার সঙ্গে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পলাশীর যুদ্ধ। যুদ্ধে পরাজিত সিরাজউদদৌল্লা পলাতক হয়েও পরে ইংরেজদের দ্বারা হত হন। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্য শুরু হল এ ঘটনার পর। আর ‘এরপর যা শুরু হল তাকে “পলাশীর লুটপাট” বলা চলে’। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধ। বাংলার শেষ নবাব মীরকাশিম, মুঘলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌল্লার ত্রিশক্তি জোট পরাজিত হল ইংরেজদের কাছে। এ ঘটনার পর ১৭৬৫ তে শাহ আলমের কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব অধিকারের ক্ষমতা দান বা দেওয়ানি দান। দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠল এই তিন জায়গা থেকে যত বেশী সম্ভব খাজনা আদায়। যার পরিণতি ১১৭৬ বঙ্গাব্দ বা ১৭৬৯-৭০ খ্রীষ্টাব্দে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ‘যার ফলে বাংলার বাসিন্দাদের এক তৃতীয়াংশ একেবারে মুছে যায়’। বিচারব্যবস্থাতে কোম্পানির আধিপত্য ঘোষিত হল ১৭৯২ খ্রীষ্টাব্দে। এসময় বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন কারণ তাঁর যুক্তিতে “এই দেশের মানুষেরা কোম্পানির সার্বভৌমত্বে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে”। আসল ‘কারণ ছিল বিচারব্যবস্থা থেকে ভারতীয় প্রতিনিধিদের সরানোর পথে সব থেকে শক্তিশালী প্রতিবন্ধকের হাত থেকে মুক্ত হওয়া’। ১৭৫৭-এর পর থেকে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এমন এক সময়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করল যার মূলে প্রথানুগত্য নেই, নেই ঐতিহ্য পরম্পরা, রয়েছে পরিবর্তন। আর এ পরিবর্তন প্রশাসনিক লাভের অঙ্ককে মাথায় রেখে যেনতেন প্রকারেণ দ্রুত আনাটাই ছিল শাসক ইংরেজদের কাছে ক্ষমতার সবথেকে জরুরী অংশ। 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয়ের জন্য, বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে লেখা হল বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ ‘A Grammar Of the Bengal Language’ (১৭৭৮)। লেখক ইংল্যান্ড থেকে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মুহুরী Bressey Halhead. ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছে এ বইয়ের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস- ‘Warren Hasting the Governor-General of the countries domination in India, placed a fragmentary specimen of a printed book before the council seeking its approval and patronage’. মনে হতে পারে বইটিতে এমন কী বিশেষত্ব ছিল যে কারণে বাংলার গভর্নর জেনারেল বইটি সম্বন্ধে এত আগ্রহী ছিলেন? ‘এই ব্যাকরণখানিতে যে কেবল ব্যাকরণ সম্বন্ধীয় বিষয় আছে তা নয়, একজন বিদেশীকে বাঙালা ভাষা শিখিতে হইলে যাহা আবশ্যক তৎসমুদয় যে ইহাতে মোটামুটি না আছে এমন নয়, কিন্তু কোন বিষয়ই ইহাতে ভালরূপে আলোচিত হয় নাই। হ্যালহেডের এই ব্যাকরণখানিকে ঠিক ব্যাকরণ আখ্যা দেওয়া যায় না…।’ তাহলে ব্যাকরণ শেখানোর একটা প্রয়াস ছিল এই বইতে কিন্তু সেটাই সম্পূর্ণ ধারণা নয় বইটি সম্বন্ধে। 

‘পঁচিশ পৃষ্ঠা ভূমিকা এবং ২১৬ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ এই ব্যাকরণে হ্যালহেড ইংরেজী ব্যাকরণের রীতিতে অধ্যায় ভাগ’… করে বাংলা ভাষার বর্ণমালা, বিশেষ্য, সর্বনাম, বাক্যের অন্বয়, ছন্দ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করলেন। তাঁর আলোচনার অবলম্বন হয়েছিল বাংলা ভাষার পুঁথিসম্ভার। ‘দৃষ্টান্ত দেবার জন্য তিনি কাশীরাম থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত কয়েকটি পুঁথি অবলম্বন করেছিলেন। বেশী দৃষ্টান্ত দিয়েছেন কাশীরাম দাসের মহাভারত থেকে তারপর ভারত চন্দ্রের অন্নদামঙ্গল’। বক্তব্য বিষয়কে যখন বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়ে সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেসময় একটা text-এ আশ্রয় পায় আরো অনেকগুলি text. এর সমর্থন আমরা পাবো চৈতন্যচরিতগুলিতে।  ‘…in all other histories, the past is a construction of the basis of facts; in literary history the text themselves constitute the past what is reconstructed here is not the text but they are relationships.’ তবে চৈতন্যচরিতে অন্যান্য text-এর fact হিসাবে ব্যবহারের সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে হ্যালহেডের ব্যাকরণে বাংলা ভাষার পুঁথির ব্যবহারের। উভয় বইতে অতীতের সঙ্গে বোঝাপড়া করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। সমসাময়িক সামাজিক ও ধর্মের দার্শনিক প্রেক্ষিতে চৈতন্যচরিতে অন্যান্য text-এর অনুষঙ্গ আসে দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে। সমাজে চৈতন্যদেবের যুগলাবতার ও তাঁর প্রবর্তিত গৌড়ীয়-বৈষ্ণব দর্শন ভারতীয় বৈষ্ণব দর্শনে স্বীকৃতি পাচ্ছে এই text গুলির উপস্থিতিতে। কিন্তু হ্যালহেডের ব্যাকরণে বাংলা ভাষার পুঁথির সঙ্গে বোঝাপড়ার জায়গা কেবল ভাষার বাচিক ও লিখন প্রণালীর কাঠামো নিয়ে,  যা নিতান্তই বহির্কাঠামো। আর এই বোঝাপড়া থেকে যে সিদ্ধান্ত তৈরি হবে এই বইতে তার ভিত্তি সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক। লেখক, পাঠকের সামাজিক অবস্থান, ভূমিকা পৃথক হওয়ায় চৈতন্যচরিত ও হ্যালহেডের ব্যাকরণে বদলে গেল ভাষার মাধ্যমের ব্যবহার, বদলে গেল সমাজের কাছে যে বার্তা তারা পৌঁছে দিতে চায় তার স্বরূপও।

‘A Grammar of Bengal Language’ (1778) এর সময়ের আগে-পরের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক পটবদলের ছবি বেশ উল্লেখযোগ্য। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ- ১৭৬৩ সালের ইংরেজদের দেওয়ানী লাভ- ১৭৭০ সালে বাংলাদেশে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও ইংরেজ শাসকদের দেশীয় পরিস্থিতিতে নেতিবাচক ভূমিকা-  ১৭৭৪ সালে Regulating Act, ইংরেজদের এদেশে উপনিবেশ বিস্তারের ইস্তেহারপত্র; দেশীয় সমাজ, সময়ে বিদেশী শাসনের এই অনুপ্রবেশগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় হ্যালহেডের ব্যাকরণের আত্মপ্রকাশ। এই বইয়ের Preface ও শেষ অংশ পড়লে এই মতকে অযৌক্তিক বলে মনে হবে না,- 

‘… that one of its most important desi derata is the cultivation of a right understanding and a general medium of intercourse between the Government and its subject; between the Natives of Europe who are to rule, and the inhabitants of India who are to obey.’১০

এবং

‘Even the credit of the Nation is interested in making the progress of her conquest by a liberal communication of Arts and Sciences, rather than by the effusion of blood and policy requires that her new subjects should as well feel the benefits, the necessity of submission.’১১

ঔপনিবেশিক সময়ের সঙ্গে আঁতাতে হ্যালহেডের ব্যাকরণে ভাষার মতো গণমাধ্যমকে ব্যাকরণের নিয়মে একক স্বরে গড়ে তোলা বা ইতিহাস রচনায় শাসকের ক্ষমতার স্বর, বিজিতদের মেরুকরণের মতো উদ্যোগ গড়ে ওঠে। ফলে দেশীয় আখ্যানে স্বপ্নের জগত, সময়ের বহুস্বর যে হ্যালহেডের ব্যাকরণে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এ বইতে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে কোনো এক ভূগোলের অধিবাসীদের মধ্যে মেরুকরণের রাজনীতি যেভাবে নির্মিত হয়েছে তা নানা রকমের- ভাষার সঙ্গে শাসন ক্ষমতার যোগাযোগের রসায়নে, পূর্ববর্তী শাসকের  স্মৃতিকে সরিয়ে নতুন শাসক ইংরেজদের সার্বিকভাবে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় ভাষার মধ্যে দিয়ে, ভাষার ভেদাভেদ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভেদের আখ্যান রচনায় এবং ভাষার উৎসগত সমীকরণে।

হ্যালহেডের ব্যাকরণে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ভূগোলে ভাষাবৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিয়ে উল্লেখ করা হল- ‘Exclusive of the Shanscrit, there are three different dialects applied (though not with equal currency) in the kingdom of Bengal vs the partition, the hindostanic and the proper Bengalese’; এরপর নির্দিষ্ট করা হল ভাষার সঙ্গে প্রশাসনিক ক্ষমতার যোগের রসায়নকে- ‘The Persian entered Bengal with the Mogul conquerors, and being the language of the court naturally gained a footing in the law and in the revenues;… as being the dialect of the former ruling power, of which the English have in some degree taken the place, and whose system they have not yet late aside’.১২ ভাষার মাধ্যমেই যে অনায়াসে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সম্ভব সে কথাই একটু ঘুরিয়ে বলা হবে এখানে- ‘From hence arises one capital impediment to the uniformity of political arrangements in Bengal; for while the summary of all public business is kept in one idiom, the detail is invariably confined to another…’১৩ আর এ কারণেই তুল্যমূল্য বিচারে বর্তমানের শাসক যে পূর্ববর্তী শাসকের থেকে অনেক বেশি উদার, উৎকৃষ্ট তাকে প্রমাণ করতে হবে সাদা-কালোর নিরিখে- ‘The internal policy of the kingdom demands an equal share of attention; and the many impositions to which the poorer class of people are exposed, in a country still fluctuating between the relics of former despotic dominion, and the liberal spirit of its present legislature, have long cried out for a remedy’.১৪ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রচলিত যুগবিভাজনে মুসলিম শাসনের মধ্যযুগ ও ইংরেজ শাসনের আধুনিক যুগকে আমরা এই আলো-অন্ধকারের রসায়নেই পড়তে অভ্যস্ত যার সূচনা এখান থেকে।  

প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ক্ষমতার হাল ধরতে যেমন ভাষার বিশেষভাবে ব্যবহার প্রয়োজন, তেমন সামাজিক ভেদ-বিভেদের নির্মাণেও ভাষা প্রধান সহায়ক। একটু এগিয়ে-পিছিয়ে নিয়ে হ্যালহেডের যুক্তিজাল সাজালে এমন দাঁড়াবে-

‘The Persian entered Bengal with the Mogul conquerors, and being the language of the court naturally gained a footing in law and in the revenues;১৫ 

‘For as the laws, the revenues and the commerce are gradually falling into new hands and are conductor by a new system, new denominations will necessarily arise to the exclusion of the old’.১৬ 

‘The Hindostanic, or Indian language, appears have been generally spoken for many ages through all proper Hindostan. It is indubitably derived from the Shanscrit…’১৭  

‘For if the Arabic language (as Mr. Jones is excellently observed) be so intimately blended with the Persian as to Ranger it impossible for the one to be accurately understood without a moderate knowledge of the other; with still more property may we urge the impossibility of learning the Bengal dialect without a general and comprehensive idea of the Shanscrit: as the union of these two languages is more close and more general; and as they bear an original relation and consanguinity to each other, which cannot even be some set with respect to the Arabic and Persian.’১৮ 

‘…the Bengal language merely as derived from its parent the Shanscrit’.১৯  

‘The Hindostanic, or Indian language, appears to have been generally spoken for many ages through all proper Hindostan. He is indubitably derived from the Shanscrit, with which it has exactly the same connection, as the modern dialects of France and Italy with pure Latin’.২০  

পাঁচশো বছর ধরে সহাবস্থানে থাকা বাংলাদেশের ভাষাবৈচিত্রে বাংলা, ফারসী ও হিন্দুস্থানীর মধ্যে ভেদ-বিভেদের আখ্যান গড়ে উঠল হ্যালহেডের ব্যাকরণে। পাশাপাশি বাংলা ভাষার উৎস নির্ণয়ের প্রাথমিক চেষ্টায় সংস্কৃতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং আরবী-ফারসীর পরিবর্তে সংস্কৃতকে উৎসগত দিক থেকে শাসকের ভাষার সঙ্গে যোগস্থাপনে বিশেষ ভাষাগোষ্ঠী নির্মাণের প্রচেষ্টা। বাংলা ভাষাভাষি মানুষে যেখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বর্তমান ছিল, সেখানে হ্যালহেডের ব্যাকরণে উভয়ের মধ্যে ভাষার দেওয়াল তুলে কোথাও যেন বাংলা ভাষা মাত্রই হিন্দু এরকম পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত রয়েছে। অনেক পরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যখন বই আকারে প্রকাশিত হবে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের দিকে, সেসময় আলাদা করে ইসলামি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রকাশের উদ্যোগ ভাষা ব্যবহারে ধর্ম পক্ষপাতিত্বের দিককে সমর্থন করে। 

হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রকাশের প্রায় বছর ছয় পরে বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সমর্থনে ও বিলাত থেকে আসা উইলিয়াম জোনস্-এর উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল (১৭৮৪) Asiatic Society. ইংল্যান্ডের Royal Society-এর অনুসরণে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হলেন উইলিয়াম জোনস্, ভদ্র শিক্ষিত ইংরাজি জানা নাগরিক বাঙালিরা হলেন এ সভার সদস্য। সভাপতির ভাষণে উইলিয়াম জোনস্ স্পষ্ট করলেন প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ ও উদ্দেশ্য নিয়ে – 

‘…it is to be necessary or convenient, that a short name or epithet be given to our society, in order to distinguish it in the world, that of Asiatick appears both classical and proper, weather we consider the place or the object of the institution, and preservable to Oriental, which is in truth a word merely relative, and though commonly used in Europe conveys no very distinct idea’.২১ 

    এবং

‘You have realized that hope, gentlemen, and even anticipated declaration of my wishes, by your alacrity in laying the foundation of a society for enquiring into the history and antiquities, the natural production, arts, science and literature of Asia.’২২ 

আর প্রকাশমাধ্যম ভাষার মধ্যেও যে ক্ষমতার বয়ান রয়ে যায় তাকে তত্ত্বের আকারে রূপ দিলেন উইলিয়াম জোনস্- ‘I have omitted their languages, the diversity and difficulty of which are a sad obstacle to the progress of useful knowledge; but I have considered languages as the mere instruments of real learning, and think them improperly confounded with learning itself; the attainment of them is, however, indispensably necessary.’২৩  পাশাপাশি ভারতীয় ভাষাকে ভূখণ্ড-ধর্ম-জাতির নিরিখে বিশিষ্টও করলেন উইলিয়াম জোনস্। ভারতীয় ভাষার ইতিহাস নির্মাণে এই পক্ষপাতিত্ব অনেকটাই গড়ে উঠবে হিন্দু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে। তাঁর যুক্তিপরম্পরা হল –

‘I shall confine my researches down-wards to the Mohammedan conquests at the beginning of the eleventh century, but extent them upwards, as high as possible, to the earliest authentic records of the human species.’২৪  

‘The five principal Nations, who have in different ages divided among themselves, as a kind of inheritance, the vast continent of Asia, with the many islands depending on it, are the Indians the Chinese, the Tattars, the Arabs and the Persians…’২৫  

‘By India, in short I mean that whole extent of country, in which the primitive religion and languages of the Hindus prevail at this day with more or less of their ancient purity, and in which the Nagari letters are still used with more or less deviation from their original form.’২৬ 

‘…for we cannot doubt that the language of the Veda’s was used in the great extent of country.’২৭ 

‘The Shanscrit Language, whatever be its antiquity, is of a wonderful structure; more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either, yet bearing to both of them a stronger affinity, both in the roots of verbs and in the forms of grammar, than could possibly have been produced by accident; so strong indeed, that no philologer could examine them all three, without believing them to have sprung from some common source, which perhaps, no longer exists; there is a similar reason, though not quite so forgeable, for supposing that both the Gothick and the Celtick, though blended with a very different idiom, had the same origin with the Shanscrit; and the old parsian might be added to the same family,…’২৮  

এশিয়াটিক সোসাইটিতে উইলিয়াম জোন্স-এর ‘The Third Anniversary Discourse’-এ পেশ করা এই মতামত যেভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসকে নির্মাণ করে তা খানিকটা এরকম- ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্থান হিন্দুদেরই কেবল আদি বসতি, হিন্দুস্থানের প্রাচীন ভাষা হিন্দুদের পবিত্র নাগরী অক্ষরে তৈরি সংস্কৃত ভাষা, হিন্দুদের প্রাচীন গ্রন্থ বেদ এবং সংস্কৃত ভাষা ইউরোপীয় বৃহৎ ভাষা গোষ্ঠী গ্রীক, ল্যাটিন-এর  অংশীদার।  

হ্যালহেড ও উইলিয়াম জোন্স-এর উদ্যোগে ভারতীয় ভাষা তথা বাংলাভাষার ইতিহাস নির্মাণ শুরু এমনটা ভাবা যেতে পারে। ভাষার এই ইতিহাস নির্মাণ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিজয়ী শাসকের নতুন ভূখণ্ডে অবস্থানের প্রকৃতি এবং তার সঙ্গে বদলে যাওয়া প্রশাসনিক-সামাজিক চালচিত্রে সংলগ্ন। আর এ কাজে ‘Fact’, প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে সাহিত্যকে। যদিও সাহিত্যের কোন ইতিহাস রচনা এ সময় হয়নি। কেননা বিজিতের গণমাধ্যম ভাষা প্রশাসনিক ক্ষমতা বিস্তারের সেই মাধ্যম যাকে না জানলে বিজয়ীর ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ের প্রকৃতিই ঠিক করে আসলে অতীতকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই, অতীত বা তার হুবহু নির্মাণ তাই ইতিহাসে কখনো সম্ভব নয়। 

তথ্যসূত্র:

১। বন্দ্যোপাধ্যায় শেখর, ‘যুগসন্ধিঃ অষ্টাদশ শতক’, পলাশি থেকে পার্টিশান ও তারপর আধুনিক ভারতের ইতিহাস, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, হায়দ্রাবাদ, ২০০৬, পৃঃ ৫৩।

২। তদেব, পৃঃ ১০০। 

৩। তদেব, পৃঃ ১১৮।

৪। তদেব, পৃঃ ১১৮।

৫। Halhed Brassey Nathaniel, A Grammar of the Bengal Language, Ananda Publishers Private Limited, Calcutta, unabridged facsimile edition, 1980, First published in 1778। 

৬। বিদ্যাভূষণ ঘোষ শ্রীঅমূল্যচরণ, ‘আদি বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও হ্যালহেড সাহেব’, প্রসঙ্গ বাংলা ব্যাকরণ, আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০৫। 

৭। বন্দ্যোপাধ্যায় অসিতকুমার, ‘হ্যালহেড ও তাঁর ব্যাকরণ’, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ২য় সংখ্যা, শ্রাবণ-আশ্বিন, ১৯ বর্ষ, ১৩৯০, কলকাতা, পৃঃ ২৫৬। 

৮। তদেব।

৯। Das Kumar Sisir, ‘The Idea of Literary History’, Literary Studies in India Literary Historiography, (Editor) Ipshita Chanda, DSA, Department of Comparative Literature, Jadavpur University, July 2004, p 43.

১০। Halhed Brassey Nathaniel, ‘Preface’, p. ii. 

১১। Ibid, p. xxv.

১২। Ibid, p. viii.

১৩। Ibid, p. ix.

১৪। Ibid.

১৫। Ibid, p. xvi.

১৬। Ibid, p. vii.

১৭। Ibid, p. xxi.

১৮। Ibid, p. ix.

১৯। Ibid, p. xix-xx.

২০। Ibid, p. xxi.

২১। Ibid, p. ix.

২২। Jones William Sir, ‘A Disclosure on the Institution of a Society’, The Works of Sir William Jones, Vol. 1, London, 1799, p.4.

২৩। Ibid, p.2.

২৪। Ibid, p.5.

২৫। Jones William Sir, ‘The Third Discourse’, p.22. 

২৬। Ibid, p.21.

২৭। Ibid, p.23.

২৮। Ibid, p.26.

ফোন নাম্বার- ৯৮৭৪৮২২৮৬৭, মেইল- shatabdisadhu@gmail.com