টুসু গানের বাণী , ঐতিহ্য, পরম্পরা ও উত্তোরণ
-শ্যামল কুমার মন্ডল
-টুসু একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। লোকাচার সম্পৃক্ত এই উৎসবে কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এই উৎসব কখনোই ধর্ম-উৎসবে পরিণত হতে পারে নি। সমাজ-সমীক্ষকরা বলে থাকেন, ধর্ম – উৎসবগুলি প্রধানত লোকউৎসবের গর্ভসঞ্জাত। পরবর্তীকালে সেগুলি ধর্মের গন্ডিতে আবদ্ধ হয়েছে। তাসত্বেও কিছু উৎসব আছে যেগুলিকে ধর্মের ছোঁয়া থাকলেও একান্তভাবেই সাধারণ মানুষের হৃদয় বন্ধনে আবদ্ধ। টুসু উৎসব বাংলার রাঢ় অঞ্চলের এমনই একটি লোকউৎসবের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
টুসু উৎসব সর্বজনীন, কারণ এই সর্বজনীনতার শিকড় জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে। দীর্ঘ তিনমাস ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, প্রকৃতির ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে যখন সে তার শ্রমের ফসল ঘরে তোলে, সেই চরম সুখের মুহূর্তে তার ঘরে আসে টুসু। সমস্ত ক্লান্তির অবসান ঘটে তার মায়ামাখা সুরের জাদুতে। এই গভীরে আছে শস্য। পরম যত্নে বোনা, চরম সতর্কতায় পরিপাটি ও সবশেষে বিপুল আনন্দে সেই সাফল্যকে ঘরে তোলা সময়ের ক্রম ব্যাপ্তির যোগফলের প্রতীক এই উৎসব। তাই, কোড়া, ভূমিজ, মাহাতো, মুণ্ডা, লোধা, সাঁওতাল সবাই ধর্মের অনুশাসন ভেঙে, আচারের সীমানা লঙ্ঘন করে সাফল্যের অনাবিল আনন্দের অভিব্যক্তি প্রকাশে সামিল হয়।
টুসু উৎসব সর্বজনীন আরও একটি বড় উপাদানের কারণে তা হল তার গান। সকলেই এই গানকে ‘টুসুগান’ বলে জানে। টুসু গানের মধ্যে নেই সুরের কেরামতি, নেই তালের মারপ্যাঁচ, নেই ওস্তাদি কসরত দেখানোর কোন সুযোগ। তা সত্বেও টুসু গানের প্রভাবে দীর্ঘ এক মাস ধরে আচ্ছন্ন হয়ে যায় তামাম রাঢ় বাংলা। পুরুলিয়া,বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রাম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ সীমান্তবর্তী ঝাড়খণ্ড ও বিহারের কিছু অঞ্চলও টুসুর সুরে মাতাল হয়। চলে গান বাঁধার, সমবেতভাবে গান গাওয়ার চর্চা। এমনকি গানের লড়াইও চলে টুসু বনাম টুসুতে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে শত শত নরনারীর মুখে মুখে রচিত হয় অসংখ্য গান, খাতায় লেখারও প্রয়োজন পড়ে না। গাইতে গাইতে, শুনতে শুনতেই শ্রুতিধর ও স্মৃতিধর হয়ে ওঠে কুমারী এয়ো সকলেই। এমনকি পুরুষরাও গান বাঁধায় অংশ নেয়, গেয়েও থাকে। এই অসীম সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার মধ্যে বেঁচে থাকে তাদের জীবনবোধ। টুসুগান এই ঐতিহ্য বহন করে চলে বছরের পর বছর, পরস্পরা তুলে দেয় আগামী প্রজন্মের হাতে এবং সেই সব গানের উত্তরণ ঘটে সমাজ এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে। পৌষ মাসের শুরুতে টুসুর আগমন। স্বাভাবিকভাবেই টুসুর বন্দনা প্রাধান্য পায় প্রথম দিকের গানগুলিতে-
আমরা পৌষ পরবে টুসু পাতিব
আমরা টুসুর পূজা করিব।
চল সারদা, চল বরদা
কুলিতে বাঁধ বাঁধিব।
কুলির জলে সিনান কইরে
বরদা চুল শুকাব।
এক সড়পে দু’সড়পে
তিন সড়পে লোক চলে।
আমার টুসু মাঝে চলে
বিন বাতাসে গা ঢলে।।
তিরিশটি দিন রইবেটুসু
তিরিশটি ফুল পাবে গো,
রাইখতে নাইরব আর টুসুকে
মকর আইসরে নিতে গো।।
টুসু বন্দনায় এই ধরনের অসংখ্য গান রচিত হয়। এই জাতীয় গানগুলিতে একটি গভীর আশাবাদ ব্যক্ত হয়। কিন্তু যখন কোন কারণে সমাজে কোনরকম অস্থিরতা থাকে, অর্থনৈতিক মন্দা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে তখন সেই বন্দনা গানেরই ভাষা কিভাবে পাল্টে যায় তা আমরা এই গানটির বানী লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারি –
টুসুমণি আইসছে মকরে
মোরা পূজাইৰ মা ক্যামন কইরে
অনাবৃষ্টি, অনাহারে ভুইলে মরি সংসারে,
কলহে ঘেরছে সংসার লক্ষ্মী যায় সুরপুরে।
টুসুগান সাধারণত মেয়েরাই সমবেতভাবে গেয়ে থাকে। স্বভাবতই পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের জীবনযন্ত্রণার কথা টুসুগানে প্রতিফলিত হয়। নারী হৃদয়ের নানা যন্ত্রণা বিচিত্র ছবি আঁকে। যেমন এক বিবাহিতা নারী টুসু পরবে বাপের বাড়িতে না আসার বেদনা প্রকাশ করেছেন টুসু গানে-
এত বড়ো পোষ পরবে
রাখলি মা পরের ঘরে
ও মা পরের মা কি বেদন বোঝো
অন্তরে পুড়ায়ে মারে।
আমার মন কেমন করে,
মাগো আমার মন কেমন করে
যেমন তাতা কাড়ায় খই ফোটে
মাতা ঘষে রইলাম বসে,
আর আমার কে আছে
মা রইলো দুরান দেশে
প্রাণ জুড়াবো কার কাছে?
বধু নির্যাতনের চিত্র গ্রাম বাংলার আবহমান কালের, শ্বশুরবাড়ির নানা অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশিত হয় টুসু গানের সুরে। –
থাকিতে না পারি ওই শ্বশুর ঘরে
আমি থাকবো বল কি করে
খেতে দিতে দেরি হলে
ঘর থেকে বাহির করে
আবার সজনা খাড়া ভেঙে মারে
মারে মেজ দেওরে।
থাকিতে না পারি ওই শ্বশুর ঘরে।
পিতৃহীন বালিকাকে কাকা এক বয়স্ক ব্যক্তির সাথে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। সামান্য অর্থের লোভে। তার লজ্জা মেয়েটিকে কুরে কুরে খায়। পতি পরিচয় দিতে শরম লাগে। সেই লজ্জাও উঠে আসে টুসু গানের মাধ্যমে-
একশ টাকা নিলি কাকা দিলিরে বুড়া বরে।
বুড়ার সঙ্গে চলতে গেলে রাণিগঞ্জের শহরে।
রাণিগঞ্জেরে লোকে বলে, ওটি তোমার কেবটে
লাজলজ্জা সরম সজ্জা, ঠাকুরদাদা হয় বটে।
সমাজের অসহায় নিষ্পেষিত দুর্বল মানুষ চায় এমন একটি অবলম্বন যাকে কেন্দ্র করে সে ক্ষণিক শান্তি পেতে পারে। টুসু হয়ে ওঠে সেই অবলম্বন, সেই ক্ষণিকের শান্তি পেতে সে খোঁজে সমব্যাথী। পৌরানিক কাহইনী বা চরিত্রগুলি, টুসু গানে তুলে ধরা নতুন কিছু নয়। পৌরানিক কাহিনী নির্জাতিতা নারী চরিত্রগুলি সবচেয়ে গ্রহণ যোগ্য হয়ে ওঠে, নির্যাতিতা রমনীদের সমব্যথী হয়ে। এমন একটি গান
নারী জনম দিয়েছ বিধি
আমি কাঁদিগো নিরবধি।
হায়রে নিদারুণ বিধি তোর মনে কি এই ছিল
কাঁদিতে ভাবিতে আমার বিফলে জনম গেল।
সত্যযুগে লক্ষ্মী নামে নারায়ণের ঘরণি
দুর্বাশার অভিশাপে হলাম মর্তবাসিনী।
দ্বাপরেতে সীতা নামে শ্রীরামের ঘরণি।
বিমাতা কৈকেয়ীর বাদে হলাম বনবাসিনী।
ত্রেতা যুগে রাধা নামে আয়ানের ঘরণি
ননদি কুটিলার বাদে হলাম গো কলঙ্কিনী।।
এই সব ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতেই টুসু গানের স্রষ্টারা এক সময় হয়ে ওঠে সমাজ সচেতন। ফলে একদিন যে গান ছিল তার মনে শান্তি প্রলেপ দেওয়ার, আনন্দ দেওয়ার সেই গানকেই একদিন প্রতিবাদের ভাষা ও মাধ্যম হিসাবে বেছে নিতে সে দ্বিধা করল না। টুসু আসবে, কিন্তু সরকার খাজনা চেয়ে নোটিশ দিয়েছে। টুসুর আগমনের আনন্দে বাদ সাধে সেই নোটিশ। টুসু গানের পূজারিণী গায়-
পৌষ মাস পড়ল টুসু
রাজায় মাগে খাজনা।
গায়ের গয়না ঘুচাও টুসু
বুঝাও রাজার খাজনা।
টুসু হল কৃষি লক্ষ্মী। সেই কৃষিলক্ষ্মীর নিপুণ কারিগর কৃষকের মনে বেদনার অন্ত নেই। রক্তে-ঘামে বোনা ফসল জমিদার জোর করে নিয়ে যায় তার খামারে। বেদনার্ত জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রকাশ পায় পুরুলিয়ার টুসু শিল্পীর গলায়-
পৌষ আসছে সাধের টুসু
পূজব তোমায় ফুল দিয়ে
তোমার ক্ষেতের ধান তুলেছি
সে ধান যাবেক কে লিয়ে।
এরপর এল জমির লড়াই। বর্গাদার জোতদার সম্পর্কে তিন দশকের ইতিহাস। বাংলা সংগ্রামের ঐতিহ্যকে, মিহিমান্বিত করেছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে রচিত টুসু গান-
টুসু ইবার জাগছে চাষী, কাস্তেতে দেখ, দিচ্ছে সান
রক্তে রুয়া ফসল তুল্যে, খামারে আজ গাইছে গান।
কে আছে বল বাপের ব্যাটা,
সোনার ফসল কাড়বে তার
মহাজনের মুখ শুকালো,
গা ঢাকা দেয় জমিদার।
নির্গুন বাবু কৃষক নেতা
চাষীর ল্যাগে ঢালছে প্রাণ
টুসু ইবার জাগছে চাষী
রক্তে রুয়া তুলছে ধান।
মানভূমের বাঙালি অধিবাসীদের বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবী দীর্ঘদিনের। বিহার সরকারের সব অত্যাচার মাথা পেতে নিলেও তারা চাপিয়ে দেওয়া হিন্দিকে কখনো বরদাস্ত করতে পারেনি। ১৯৫৫ সালে বাঙ্গালীদের উপর এমন দমন-পীড়নের ঘটনা প্রতিফলিত হলো টুসু পরবের গানে।
শুনরে বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারী ডাঙ দেখাযং।
বাংলা ভাষা বাঙালির মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষার স্তন্য পান করেই সে বড় হয়েছে। মানভূমের টুসু ব্রতীদের কন্ঠে সেই কথাই ঘোষিত হয়েছে আর একটি গানে।
আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা
ভাই মারবি তোরা কে কাকে
বাংলা ভাষা এই ভাষাতেই
কাজ চলেছে সাত পুরুষের আমলে
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা বলে
এই ভাষাতেই পর্চা রেকর্ড
এই ভাষাতেই কেক কাটা
এই ভাষাতেই দলিল নথি
সাত পুরুষের হক পাটা।
দেশের মানুষ ছাড়িস যদি
ভাষার চির অধিকার
দেশের শাসন অচল হবে
ঘটবে দেশে অনাচার।
বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলার লোকসংস্কৃতি বাংলার অহংকার। সেই বাংলার ভাদু, টুসু, ঝুমুর, মনসার গান সহ নানা আঙ্গিক তার সংস্কৃতির ভান্ডারকে বৈচিত্রের পূর্ণতা দিয়েছে।
সেই লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও টুসু গানের শিল্পীরা বহন করে চলেছে। তাই তাদের কণ্ঠে এমন গান শোনা যায়।
আমার মনের মাধুরী
সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি
আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামে
মেঠো সুরের গান চুয়া
বাংলা গানের ছড়া কেটে
আষাঢ় মাসে ধান রুয়া।
মনসা গীতি বাংলা গানে
শ্রাবণজাত জঙ্গলে
চাঁদ বেহুলার কাহিনী গাই।
চোখের জলের গান বলে।
বাংলা গানে করিল সই
ভাদু পরব ভাদরে
গরবিনীর দোলা থামাই
ফুলে ফুলে আদরে
বাংলা গান টুসু আমার
মকর দিনে- সাঁঝরাতে
টুসুর ভাসান পরব টাঁড়ে
টুসুর গান মাতে মাতে।
আসলে টুসু গানের বাণীর মূল কথাই হলো তার বহুমাত্রিকতা। সমাজ জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত বিভিন্নভাবে গানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। যে গান কোন রাজনৈতিক মঞ্চে দৃঢ়ভাবে বলার সাহস হয়না, টুসু শিল্পীরা অনায়াসে তাদের গানে সেইসব বক্তব্য তুলে ধরার স্পর্ধা দেখায়। এই জায়গাতেই টুসু উৎসব এর সার্বজনীনতার সাফল্য আর গানকে বাদ দিয়ে টুসু উৎসবের কোনো অস্তিত্বই থাকে না এই উৎসব, মেলা সবকিছুই গান কে ঘিরে। অংশগ্রহণকারীরা সকলেই পারফর্মার এবং সরাসরি ও প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে। তাই এই লোকউৎসবের শিকড় সাধারণ মানুষের মনের গভীরে। যে ঐতিহ্য সে বহন করে চলেছে, সেই পরম্পরা আপনা থেকেই চলে আসে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কন্ঠে ও গানে এবং এভাবেই তার উত্তোরণ ঘটে চলেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আবহমান কাল ধরে।