জ্যেষ্ঠতাত
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
কোনো-এক কাজ যদি না করিয়া থাক, তবে তোমার বড়ই অন্যায় হইয়াছে, আর যদি করিয়া থাক, তাহা হইলে কাজটা ভালো হয় নাই।
একশ্রেণীর লোক আছে, তাহাদিগকে দেখিলেই চোখ বুজিতে ইচ্ছা করে, তাহারা যদি কথা কয় তবে কানে হাত দিতে ইচ্ছা হয়। অনেক ঘরের কোণে অতিশয় কদাকার একপ্রকার ব্যাঙ বাস করে, তাহারা যখন মাঝে মাঝে কট্কট্ শব্দ করিয়া উঠে তখন প্রাণ চমকিয়া যায়, হঠাৎ যদি খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে চোখের সামনে আসিয়া উপস্থিত হয়, তবে ছুটিয়া পলাইতে ইচ্ছা করে। জানোয়ারের মধ্যে এগুলি যেমন, মানুষের মধ্যে জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়েরা ততোধিক। ইহাদের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ হইলে আর জীবনে ইহাদিগকে ভুলিতে পারা যায় না।
এক নম্বরে, খবরওয়ালা জ্যেষ্ঠতাত। জগতে এমন ঘটনা নাই, যাহার কথা ইনি শুনিয়া রাখেন নাই। তুমি যদি তাহার কোনো সামান্য বিষয়ে অজ্ঞতা প্রদর্শন কর, তাহা হইলে ইনি অতিশয় আশ্চর্যাম্বিত হইবেন। যদি কোনো কথা তুমি অন্যরূপ জান বলিয়া প্রকাশ কর, তবে তোমার আর রক্ষা নাই, তোমাকে এমন একটা সার্টিফিকেট দিয়া বসিবেন যে, তেমন সাটিফিকেট সচরাচর কেহ কাহাকেও দেয় না। কিন্তু হয়তো এর পরেই তোমার নিকট হইতে উঠিয়া যাইবেন।
দুয়ের নম্বরে, পণ্ডিত জ্যেষ্ঠতাত। ইনি খবরওয়ালা মহাশয়েরই বড় ভাই। ইহার স্বভাবও অনেকটা তাঁহারই মতন। ইনি যে শ্রেণীতে পাঠ করেন, তাহার তিন-চারি ক্লাশ উপরের পাঠ্যপুস্তক লইয়া নাড়াচাড়া করেন। যে-সকল পুস্তক কোনোদিন চক্ষে দেখেন নাই, তাহাতে কি লেখা আছে, সেই কথাটা বিশেষ করিয়া তোমাকে বার বার বলিলেন। ইস্কুলে গিয়া মাস্টারমহাশয়কে যে-সকল পুস্তকের কথা বলিতে হইবে, তাহার খবর খুব কমই রাখেন। এই শ্রেণীর অনেক জ্যেষ্ঠতাত দেখিয়াছ। এরা প্রায়ই একটু নীচ-প্রকৃতির হইয়া থাকে। ছাত্রসভায় বক্তৃতা করিতে হইলে বই মুখস্থ করিয়া আইসে। এই শ্রেণীর একজন আমাকে একবার চিঠি লিখিয়াছিল, সেই চিঠিখানি মেকলে সাহেবের একখানা পত্রের অবিকল নকল।
তিনের নম্বরে, মুরবিব জ্যেষ্ঠতাত। তোমার কোন বিষয়ে কি ত্রুটি আছে, তাহা বাহির করিয়া তোমাকে তিরস্কার করা ইহার ব্যবসায়। কোনো-এক কাজ যদি না করিয়া থাক, তবে তোমার বড়ই অন্যায় হইয়াছে, আর যদি করিয়া থাক, তাহা হইলে কাজটা ভালো হয় নাই। ইনি যদি তোমার সহপাঠী হন, তবে তোমাকে এমন সকল আক কষিতে দিবেন, যাহা তাঁহার বিদ্যাতে কিছুতেই কুলায় না। তাহতে যদি তোমার একটু দেরি হয় তবে বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিবেন যে,তিনি খুব অল্প সময়েই এরূপ আক সব কবিয়া ফেলেন। যদি খুব শীঘ্রই আকটা কষিয়া ফেলিতে পার, তবে বলিলেন, ‘বড় ঘুরিয়াছ। যদি একটা কোনো সহজ উপায় দেখাইয়া দিতে বল, তবে হয়তো বলিবেন যে, তাঁর অনেক কাজ আছে, সময় কম। এই বলিয়া প্রস্থান করিবেন।
এই শ্রেণীর একটা লোক এমনভাবে কথাবার্তা বলিত যেন তাহার মতন ভালো জিনিস কিনিতে কেহ জানে না। অন্য কেহ একটা কোনো জিনিস কিনিয়া আনিলেই বলিত, “তোমাকে ঠকাইয়াছে। আমি এর চাইতে কম দামে আনিতে পারিতাম। অনর্থক পয়সাগুলি জলে ফেলিয়াছ। নিজের বিদ্যাবুদ্ধি অতি কমইছিল। কিন্তু সেই বাড়িতে যে-সকল কলেজ ক্লাশের ছেলে থাকিত তাহাদের পড়াশুনা কেমন চলিতেছে তাহার খবরটা রীতিমতো রাখা হইত। মাঝে মাঝে তাহদের বই খুলিয়া দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হইত। এই ব্যক্তি একদিন চিৎপুর রোড দিয়া যাইবার সময় দেখিল যে দুইজন লোক কতকগুলি সোনার ফুল কুড়াইয়া পাইয়াছে, আর একজন তাহাকে সেগুলি লইয়া যাইতে দিতেছে না। জ্যেষ্ঠতাতকে দেখিয়া তাহারা উভয়েই মধ্যস্থ মানিল। বিচারের মীমাংসা এই হইল যে, ফুলগুলিকে তিনভাগ করিয়া তিনজনে পাইবে, এবং যে ব্যক্তি প্রথমে কুড়াইয়া পাইয়াছিল তাহাকে অপর দুজনে সামান্য মূল্য দিবে। জ্যেষ্ঠতাতের সঙ্গে তিনটি টাকা ছিল, তাহা দিয়া সে কুড়িটি ফুল কিনিল। বাড়ি আসিয়া সে সেদিন আর আস্তে কথা কহিতেপারে না। অধিক বুদ্ধি থাকিলে ব্যাপারটা কিরূপ হয় সকলকে ডাকিয়া তাহাই বুঝাইয়া দিতে লাগিল। একজন একটি ফুল হাতে লইয়া দেখিল যে ফুলটি পিতলের, তাহার উপর সামান্য গিণ্টি। এই কথা যখন জানা গেল, তখন হাসির ধুম পড়িল। এর পরে অনেকদিন পর্যন্ত জ্যেষ্ঠতাত কোনো উৎপাত করে নাই।
চতুর্থ নম্বরে — বড়লোক জ্যেষ্ঠতাত। যাহার সমকক্ষ, তাহদের সহিত ইহারা কথা কহিবে না। যাহারা নিজের অনেক উপরে তাহদের সঙ্গে মিশিতে চাহিবে এবং তাহাদের পদলেহন করিবে। ক্লাশে মাস্টারমহাশয়ের সঙ্গে ইয়ারকি দিবে, লোকের নিকট টাকা ধার করিয়া বাবুগিরি করবে। টাকা চাহিলে বিরক্ত হইবে। নিজের যেমন অবস্থা তেমনি অবস্থার লোকদিগকে ঘৃণা করিবে, কোনো ভালো কাজের জন্য কিছু দিতে বলিলে খাতায় স্বাক্ষর করিবে না—যদি করে, তবে নিশ্চয়ই তাহা দিবে না। ঘূণায় যাহাঁদের সহিত কোনোদিন মিশে না, মাঝে মাঝে হঠাৎ এক-একবার তাহদের নিকট অত্যাধিক আত্মীয়তা দেখাইতে আসিবে। তাহদের সামান্য কোনো জিনিস থাকিলে তাহার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিয়া বেশি দাম দিয়া একটা ভালো জিনিস কিনিতে বলিবে। সেই উপলক্ষে নিজের কেমন সব উচ্চদরের জিনিস না হইলে ব্যবহার হয় না, বড়-বড় বইনা হইলে পড়া হয় না, তাহ তাহাকে বুঝাইয়া দিবে। এরপর নিজের একটা খুব বড় কাজ করিতে হইবে, আর অধিক সময় নাই, এইবলিয়া বিদায় লইবে। যাইবার সময় হয়তো বলিবে, ভাই কিছুটাকা দিতে পার? কাল দিব। নাহয় এমন একটা কোনো কাজের ভার দিবে যে তাহ হয় তাহার বিদ্যাবুদ্ধির অতীত, নাহয় তাহা নিজে করিতে সে লজ্জিত হয়, পাছে লোকে তাহাকে ছোটলোক মনে করে।
এরপর সমালোচক জ্যেষ্ঠতাতের কথা বলিয়া শেষ করিব। এমন বিষয় নাই। যাহা লইয়া এ ব্যক্তি নাড়াচাড়া না করিবে। এমন লোক নাই নিজের চাইতে সে যত বড় লোকই হউকনা কেন, যাহার সম্বন্ধে সে দু-চার কথা না বলিবে—নিজের যাহা নয়, বা নিজে যাহা করে নাই, সাধ্য সত্ত্বেও তাহার প্রশংসা করিবে না। যদি দায়ে পড়িয়া নেহাত দুই কথা বলিতে হয়, তবে এমন একটা খট্কা দিয়া রাখিয়া দিবে যে তাহাতেই তাহার নিজের কাজ সিদ্ধ হয়। এমন কিছু প্রশংসকার কাজ হইতে পারে না যাহা সে মনে করে যে সে করিতে পারে না, এতদিন যে তাহা করিয়া ফেলে নাই তাহা তাহার অনুগ্রহ। অন্যের যাহা দেখিয়া নিন্দা করিবে, সে জিনিসটা নিজের হইলে আবার তাহারই প্রশংসা করিবে।