ভিন্ন গলা, ভিন্ন গান : কন্ঠসাধনার সাধারণ নিয়ম
নূর নবী মিরণ
বাংলাদেশ
গান ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু গলা সাধার ধরণ এক এই ধারণাটি অনেকের কাছেই নতুন বলে মনে হতে পারে। কেননা আমাদের দেশে এই ধরনের কথা সম্ভবত এর আগে তেমন কেউ শুনেননি। যে কথাটি বহুল প্রচলিত এবং প্রচারিত তাহলো ক্লাসিক্যাল গান অর্থাৎ হিন্দুস্থানী সংগীত চর্চা করতে হবে। হিন্দুস্থানী সংগীত চর্চা না করলে গান গাওয়ার গলা তৈরি হবে না এবং তার স্থায়িত্ব থাকবে না।
আমাদের বাংলা গানের বেশ বড় একটি অংশ দখল করে আছে রবীন্দ্র সংগীত। আরো একটি অংশ আছে নজরুল সংগীত। প্রায় বিপরীত ধারার এই দুই ধরনের গান আপন মহিমায়, রঙে, রূপে, বৈচিত্র্যে নিজস্ব আসন তৈরিতে সমর্থ হয়েছে। এ হলো এককভাবে দুইজন গীতিকবির কথা। এছাড়া আরো যে কয়টি বাংলা গানের ধারা আছে তারমধ্যে আর একটি বড় অংশ হচ্ছে বাংলার লোকসংগীত। এটিও নিজস্ব ঢঙে মহিমায় সমুজ্জ্বল। আরো অনেক রকমের গান থাকলেও আলোচনার সুবিধার জন্য আমি এই তিনটি ধারার মধ্যেই আমার উপমাকে সীমিত রাখতে চাচ্ছি। এই তিন ধরনের গানের গাওয়া ধরনের মধ্যে বাকিগুলো গায়ন পদ্ধতি অন্তর্নিহিত। এই তিন ধরনের গানের কথা সুর এবং তার উপস্থাপন প্রক্রিয়া একেবারে আলাদা প্রকৃতির। এদের কথা এবং সুর এতই স্বতন্ত্র যে গানের একটি অংশ বা শুরুটুকু শুনলেই বলে দেয়া যায় কোনটি কোন ধরনের গান।
এই তিন ধরনের গান চর্চার প্রচলিত কিছু ধারণার কথা প্রাসঙ্গিক মনে করে এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমে আসছে রবীন্দ্র সংগীতের কথা। অর্থাৎ যারা গোড়াতেই ঠিক করে রেখেছেন যে তারা কেবল রবীন্দ্রসংগীত করবেন তাদের গলার কন্ঠ ঠিক রাখার জন্য কি করা প্রয়োজন? আমাদের দেশের রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীরা সাধারণভাবে ধরে নেন যে যেহেতু রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঢং এবং ক্লাসিক্যাল গানের ঢং সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী তাই তাদের ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা করবার বিশেষ দরকার নেই। ক্লাসিক্যাল গানের প্রচলিত বিশেষ কোন ছায়া রবীন্দ্র সংগীতের উপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে বলে আমি মনে করি না। সে কারণে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের সাধারণ মতের সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলি যারা প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছেন যে রবীন্দ্র সংগীত গাইবেন তাদের হিন্দুস্থানী সঙ্গীত ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা না করলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না। ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা করলে বিশেষ কিছু লাভ হবে তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। সুতরাং যে ধরনের গানের চর্চায় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের লাভ ক্ষতির হিসাব মেলানো যায় না তা নিয়ে চিন্তিত হওয়া, তা চর্চা করা বা চর্চা করতে না পারায় কুন্ঠাবোধ করার কোন দরকার নেই।
রবীন্দ্র সংগীতে কথা এবং সুর এর সমান প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কেউ যেন কারো উপর অধিকার বিস্তার করতে না পারে সেই দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু নজরুল সংগীতের বেলাতে ভিন্নরূপ। এতে সুরের প্রাধান্য বেশি। সুরের কারুকাজে নজরুল সংগীতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। সে কারণে নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের সুরের কারুকাজের দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। যেহেতু হিন্দুস্থানি গান মূলত সুরের কারুকাজ তাই নজরুল সঙ্গীত শিল্পীদের ক্ষেত্রে এর চর্চা অনিবার্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। গানের ঢং বা সুরের কারুকাজের জন্য ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা কে অপরিহার্য বিবেচনা করা হলেও এতে গলা সাধার সঠিক কাজ হয় বলে আমি মনে করি না। তার কারণ ক্লাসিক্যাল গান ও এক ধরনের গান। এটি গলা সাধার প্রক্রিয়া হতে পারে না। এটি বিশেষ ধরনের গান সাধার প্রক্রিয়া মাত্র। ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা নজরুল সংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক স্থান তৈরি করলেও গলা সাধার বিকল্প ব্যবস্থা একেবারেই নয়।
লোকসংগীত এর বেলায় চিত্র ভিন্ন রকমের। এ গানে সাদামাটা সুরের আবর্তে কথার প্রাধান্য বেশি হয়ে থাকে। তাই এই শ্রেণীর গানের শিল্পীরা ক্লাসিক্যাল গান শেখার তাগিদ একেবারেই অনুভব করেন না। তাদের প্রয়োজন হয় না। যারা ক্লাসিক্যাল গান শেখেন তারা প্রচলিত ধারার বশবর্তী হয়েই শেখেন। সেই শেখা তাদের গানে বা কণ্ঠস্বর এর ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখে সে বিষয়েও তারা সঠিক কিছু জানেন না।
সাধারণভাবে হিন্দুস্থানী সংগীত বা ক্লাসিক্যাল গান বলতে কী বোঝায় তার অতি সাধারণ একটি ধারণা দিতে চাই। শুরুতেই বলি উপরের তিনটি ধরনের গানের মত এটিও এক ধরনের গান। এইরকম গানের ধরন উপরের তিন ধরনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বহুগুণ বিস্তৃত। এই গানে সুরের প্রাধান্যই সবচেয়ে বেশি। কথার প্রাধান্য খুবই কম হয়ে থাকে। এই ধরনের গানে নির্ধারিত ছকে সুর নিয়ে রীতিমত খেলা করার স্বাধীনতা শিল্পী পেয়ে থাকেন। এটি কোন গান নয়। এটি ভূপালী, কেদার, ইমন ইত্যাদি কাঠামো আশ্রিত সুরের গান। এইসব কাঠামোকে রাগ রাগিনী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে প্রচলিত ধারা অনুযায়ী ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা কে ধরা হয় গলা সাধার উপায় হিসাবে। কিন্তু আমি বলেছি এটি প্রকৃত অর্থে গলা সাধার উপায় হতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন হলো গলা সাধার উপায় কি
গলা সাধার মূল বিষয়ে যাবার আগে বিশেষ কয়েকটি কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রতিটি মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে যে আওয়াজ এর মাধ্যমে তার উপস্থিতি জানান দেয় তা হলো তার কান্নার আওয়াজ। এ কান্নার আওয়াজ এর কোন ভাষা থাকে না। এটি একটি আওয়াজ মাত্র। সেই আওয়াজ বিশ্বজনীন। সকল মানব শিশুর ক্ষেত্রে একই হয়ে থাকে। বাঙালি বলে বাংলায়, জাপানি বলে জাপানি ভাষায় কিংবা ইতালিও বলে ইতালি ভাষায় কান্নার আওয়াজ আমরা শুনতে পাই না। আমরা একটি আওয়াজ শুনতে পাই এবং তার অর্থ আমাদের সবার কাছেই স্পষ্ট। এর মূল কারণ কি? এর মূল কারণ মানুষের যে যন্ত্রের সাহায্যে আওয়াজ তৈরি হয় সেটি সব মানুষের জন্য একই রকমের হয়। আবার একটি প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে যে যদি সব মানুষের আওয়াজ তৈরি করার যন্ত্র একই হয়ে থাকে তবে বাঙালী হয়ে আমরা জাপানি ভাষা বুঝি না কেন? সে ক্ষেত্রে বলতে হবে ভাষা হল সে যন্ত্রের ব্যবহারিক প্রক্রিয়া যে যন্ত্রের সাহায্যে নবজাতক শিশু প্রথমে কান্নার আওয়াজ করেছিল। কথা বলার পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যেক মানব শিশুর ভাষা একই রকমের হয়। তা সে শিশু যে দেশের, যে ভাষার, যে গোত্রের বা যে বর্ণেরই হোক না কেন।,
জন্মের সময় প্রত্যেক মানব শিশু আওয়াজ তৈরি করবার জন্য একই রকমের যন্ত্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ধীরে ধীরে সে মানব শিশু যখন বড় হতে থাকে তখন সে ভাষার সাথে পরিচিত হয় এবং একসময়ের ভাষাহীন আওয়াজ তৈরীর একই যন্ত্র দিয়েই সে শিশু ভাষায় আওয়াজ বা শব্দ তৈরি করতে থাকে। এরকম ভাষা শেখার প্রাক্কালে যদি একটি বাঙালী শিশুকে জাপানে কোন জাপানি পরিবারে স্থানান্তর করা হয় তাহলে সে বাঙালি শিশুটি জাপানি ভাষা জানবে। বাংলা ভাষার কোন ছাপ তার মধ্যে থাকবে না। চেহারায় বাঙালি মনে হলেও ভাষায় সে হবে জাপানি। এ বিষয়ে আশা করি কারো মনে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
নবজাতকের বেলায় কেন এমন অনেক লোক আছেন যারা তিন চারটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। তারা তাদের মাতৃভাষার বাইরে সেসব ভাষা শিখেছেন। অন্য ভাষা শিখতে গিয়ে তারা জন্মসূত্রে পাওয়া এই ধ্বনি যন্ত্র কে ব্যবহার করেছেন। এমন তো নয় যে এক একটি ভাষা শেখার জন্য আলাদা আলাদা ধ্বনি যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে। পৃথিবীতে যত ধরনের ভাষা আছে সেসব ভাষার যত ধরনের ব্যবহার হতে পারে বা যত ধরনের গান আছে সবই হল একই ধ্বনি যন্ত্রকে ব্যবহারের ফল। সাধারণভাবে এই ধ্বনি যন্ত্রকে আমরা বলে থাকি গলা আর ধ্বনি যন্ত্রটিকে সঠিকভাবে ব্যবহারের প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে প্রকৃত গলা সাধা।
এই ধ্বনি যন্ত্রকে বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যবহার প্রক্রিয়ার কোন প্রকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে আজও গড়ে ওঠেনি। তাই এর সঠিক ব্যবহার প্রক্রিয়া আমাদের জানা হয়নি। আমরা এত কাল যেভাবে এর ব্যবহার করে আসছি তা পরম্পরায় প্রাপ্ত কিছু ধারণার ভিত্তিতে। এতে যে কাজ হয়নি তা বলা যাচ্ছে না। আবার ঠিকভাবে কাজ হয়েছে এটিও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তার মানে কারো কারো বেলাতে কাজ হয়েছে আবার কারো কারো বেলায় হয়নি। কোন একটি যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার প্রক্রিয়া না জেনে ব্যবহার করলে যা হয়ে থাকে আমাদের বেলাতেও তাই হয়ে আসছে।
বিজ্ঞানের দৌলতে সারা বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে কোথায় কি ঘটছে তার অনেকটাই আমরা ঘরে বসে দেখতে পাই। তাই আমাদের কণ্ঠসঙ্গীতের উৎকর্ষ সাধনের জন্য সর্বাগ্রে দরকার আমাদের কন্ঠ নামক যন্ত্রটি কে সঠিক ব্যবহার করার প্রক্রিয়া শেখা। এই যন্ত্রটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে কণ্ঠসঙ্গীতের সকল প্রচেষ্টাই বিফল হতে বাধ্য। তাই পৃথিবীর যে দেশে যে স্থানে যারা এই যন্ত্রটি নিয়ে শত শত বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন এবং এই যন্ত্রের সহজ-সরল উপযুক্ত ব্যবহারের কিছু নিয়ম নীতি ও উপায় ব্যবহার করে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছেন আমাদের স্বার্থে সেইসব উপায় প্রতি দৃষ্টি দেয়া একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমী বলে আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে আমাদের সনাতন প্রথাকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা পোষণ করি তবে আমাদেরই ক্ষতি।
এই বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে আমি দেশের বেশ কিছু উস্তাদ-পণ্ডিতের সাথে আলাপ করেছি। কিন্তু তারা পশ্চিমী প্রক্রিয়া বলে এক কথাতেই নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য পশ্চিমী ভয়েস ট্রেনিং প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশীয় গান করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও একটি ভুল বোঝার বিষয় আমি দেখতে পাচ্ছি। আমি অনেক ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে আমি গান গাওয়ার বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি বলতে চাচ্ছি গলা সাধার বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে অনেকেই আমাকে সযত্নে এড়িয়ে গেলেন। তারা কোনোভাবেই বুঝতে চান না যে ভয়েস ট্রেনিং বা গলা সাধার কোন ইস্টার্ন ওয়েস্টার্ন হয় না। গলা সাধা গলা সাধাই।
কেবল ওয়েস্টার্ন বলে আসল গলা সাধার প্রক্রিয়াকে যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে আমাদের অগ্রযাত্রার পথে অচলায়তন গড়ার শামিল হবে। বর্তমান সময়ে হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্র আমাদের সঙ্গীতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। সেই হিন্দুস্থানি রাগ সংগীত থেকে শুরু করে লোকসংগীত পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অনিবার্য হয়েছে। এই হারমোনিয়াম কিন্তু আমাদের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নয়। এটি ফরাসি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। এই পশ্চিমী বাদ্যযন্ত্রটিকে আমরা অবলীলায় আমাদের প্রাত্যহিক সংগীতচর্চায় ব্যবহার করে থাকি। তা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। হারমোনিয়ামকে একান্ত আমাদের বাদ্যযন্ত্র হিসেবেই মনে করি।
মানব শরীরের নানাবিধ সমস্যা, রোগ বালাই দূর করবার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রের যে প্রভূত উন্নতি হয়েছে তা কিন্তু পশ্চিমা দেশের ধারাবাহিক গবেষণার ফলে হয়েছে। নানা রোগের যে ঔষধ আবিষ্কার হয়েছে তার সিংহভাগ সেই সব দেশে হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে বিনা বাক্যব্যয়ে আমরা সেইসব পশ্চিমী ঔষধ সেবন করি। সেইসব গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পশ্চিম দেশের। তাদের গবেষণার ক্ষেত্রে সেই দেশের মানুষের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এই বিষয়টি মোটামুটি ভাবে আমরা জানি। তারপরও আমাদের মনে সেই সব ওষুধ নিয়ে কোন প্রশ্ন তো দূরের কথা বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। এ বিষয়ে প্রায় 102 বছর আগে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা উদ্ধৃত করছি।
সংগীতের মুক্তি বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন,”আমার বোধ হয় য়ুরোপীয় সংগীত রচনাতেও সুরগুলি রচয়িতার মনে এক একটা দল বাঁধিয়া দেখা দেয়। এক একটি গাছ কতকগুলি জীব কোষের সমবায়। প্রত্যেক কোষ অনেকগুলি পরমাণুর সম্মিলন। কিন্তু পরমাণু দিয়া গাছের বিচার হয় না, কেননা তারা বিশ্বের সামগ্রী- এই কোষগুলির গাছের।
তেমনি রসের জৈব রসায়নে কয়েকটি সুর বিশেষভাবে মিলিত হইলে তারাই গানের জীবকোষ হইয়া ওঠে। এই-সব দানাবাঁধা সুরগুলিকে নানা আকারে সাজাইয়া রচয়িতা গান বাঁধেন। তাই য়ুরোপীয় গান শুনিতে শুনিতে যখন অভ্যাস হইয়া আসে তখন তার স্বরসংস্থানের কোষ-গঠনের চেহারাটা দেখিতে পাওয়া সহজ হয়। এই স্বরসংস্থানটা রূঢ়ী নয়, ইহা যৌগিক। তবেই দেখা যাইতেছে সকল দেশের গানেই আপনিই কতকগুলি সুরের ঠাট তৈরি হইয়া ওঠে। সেই ঠাটগুলিকে লইয়াই গান তৈরি করিতে হয়।”
এই আলোচনার আর এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, “একটা প্রশ্ন এখনো আমাদের মনে রহিয়া গেছে, তার উত্তর দিতে হইবে। য়ুরোপীয় সংগীতে যে হার্মনি অর্থাৎ স্বরসংগতি আছে, আমাদের সঙ্গীতে তাহা চলবে কিনা। প্রথম ধাক্কাতেই মনে হয়-‘না, ওটা আমাদের গানে চলিবে না, ওটা য়ুরোপীয়।’ কিন্তু হার্মনি য়ুরোপীয় সংগীতে ব্যবহার হয় বলিয়াই যদি তাকে একান্তভাবে য়ুরোপীয় বলিতে হয় তবে এ কথাও বলিতে হয় যে, যে দেহতত্ত্ব অনুসারে য়ুরোপে অস্ত্রচিকিৎসা চলে সেটা য়ুরোপীয়, অতএব বাঙালির দেহে ওটা চালাইতে গেলে ভুল হইবে। হার্মনি যদি দেশবিশেষের সংস্কারগত কৃত্রিম সৃষ্টি হইত তবে তো কথাই ছিল না। কিন্তু যেহেতু এটা সত্যবস্তু, ইহার সম্বন্ধে দেশকালের নিষেধ নাই। ইহার অভাবে আমাদের সংগীতে যে অসম্পূর্ণতা সেটা যদি অস্বীকার করি, তবে তাহাতে কেবলমাত্র কন্ঠের জোর বা দম্ভের জোর প্রকাশ পাইবে।”
আগেই বলেছি মানুষের ধ্বনি যন্ত্রটি সকল মানুষের ক্ষেত্রে একই রকমের আর এটি আমাদের দেহেরই একটা অংশ। তাই এর আদর্শ ব্যবহার বিধিও সকল মানুষের বেলাতে একই হওয়া বাঞ্ছনীয়। যারা এই সত্যটিকে মানতে দ্বিধাবোধ করেন তারা নিজেদেরকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার পথ রুদ্ধ করেন।
কেবল বিদেশী বলে একটি ভালো ও আদর্শ বিষয় কে দূরে ঠেলে দেয়ার মানসিকতার গন্ডি থেকে আমাদের বের হওয়া দরকার। আমরা যে বেরোতে পারিনি তা কিন্তু নয়। বেশ কয়েকটি বিদেশি বাদ্যযন্ত্রকে আমরা আমাদের সঙ্গীতের অতি প্রয়োজনীয় সহায়ক করে নিয়েছি। কেবল সহযোগী যন্ত্র হিসেবে নয় একেবারে স্বমহিমায় সেই বাদ্যযন্ত্র গুলি রাগ সংগীত থেকে শুরু করে সকল প্রকার গানে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। হারমোনিয়ামের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আরো কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের কথা বলছি। বাঁশির সুর শুনে আমাদের বুকের ভেতর কেমন যেন মোচর দিয়ে ওঠে। আমরা বাঁশির সুরে কেমন উদাস হয়ে পড়ি। আবার বাঁশির কথা এলে পান্নালাল ঘোষ, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, রুনু মজুমদার এদের নাম ভেসে ওঠে। এদের মত আরো অনেকেই বাঁশিতে রাগ সংগীতের সুর বাজিয়ে বাঁশি কে স্বতন্ত্র বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সহ যন্ত্র হিসেবে বাঁশি না হলে যেন আমাদের লোকসংগীত প্রাণ পায় না। যে বাঁশি আমাদের মাটির গান লোকসঙ্গীতের এত অন্তরঙ্গ সে বাঁশি কিন্তু আমাদের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নয়। এটি এসেছে চীন থেকে।
এবার আসি বেহালার কথায়। উপমহাদেশের রাগ সংগীতের সুর বেহালায় শুনলে আমাদের চিত্ত আন্দোলিত না হয়ে কোন উপায় থাকে না। কোন কোন সুর শুনে আমাদের চোখে আপনাতেই জল আসে। সেই সুর কিন্তু আমাদের একেবারে কাছের, মাটির, আমাদের এদেশীয় সুর। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রটি ইতালিয়।
বাদ্যযন্ত্র কোন দেশের বা এর সঠিক বাদন প্রক্রিয়া কোন দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো সেই বাদ্যযন্ত্রটি কে সঠিকভাবে ব্যবহার করার উপায় শিখে তাকে নিজের করে নেয়া এবং নিজের পছন্দের সুর বাজিয়ে মনকে তৃপ্ত করা। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে বাঁশি বা বেহালা বাজানো শেখা আর তাতে সুর তোলা এক কথা নয়। প্রথমে যন্ত্রটিকে চিনতে হবে, জানতে হবে, তাকে ব্যবহার করবার সঠিক পন্থা শিখতে হবে। তারপরেই তা দিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করতে হবে। যন্ত্র দিয়ে সুর তোলা যার যার ইচ্ছা মত হতে পারে কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার বিধি সুনির্দিষ্ট থাকা চাই।
উপমার ঝাঁপি বন্ধ করে পরিশেষে এই কথাই বলতে চাই মানবকল্যাণে মানুষের ধ্বনি যন্ত্র বা ভয়েস বক্সের আদর্শ ব্যবহার বিধি যে দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে বা যারা দীর্ঘদিনের শ্রমের বিনিময়ে আবিষ্কার করেছেন তাদের সেই বিধিমালা আমরা অনুসরণ করে আমাদের কণ্ঠসঙ্গীত কে আরো বেগবান করব।