January 1, 2026

স্মৃতির সরণা বেয়ে: পণ্ডিত ভিজি যোগ – ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

মহারাষ্ট্রে বেহালা (Violin) যন্ত্রটি খুবই জনপ্রিয়।¹ অনেক পণ্ডিতের মতে মারাঠী শিল্পীরাই বেহালা যন্ত্রটিতে প্রথম হিন্দুস্থানী রাগ সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন।² যাইহোক এই অভিমত সর্বজন স্বীকৃত নয়। এটা নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। দূতরাং এর মধ্যে আমি যাচ্ছি না। কলকাতায় যে কজন সঙ্গীতশিল্পী স্থায়ীভাবে বসবাস করে গেছেন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন জন্মসূত্রে মহারাষ্ট্রের অধিবাসী। এঁদেরই অন্যতম হলেন বিশ্ববিখ্যাত বেহালা বাদক পণ্ডিত বিষ্ণু গোবিন্দ যোগ যিনি ভি.জি. যোগ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।¹ গৌরবর্ণ স্থূলকায় এই মানুষটিকে যখন আমি ১৯৭৫–৭৬ সালে প্রথম দেখি তখনই উনি প্রায় বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। চুলের রঙ ধবধবে সাদা আর সর্বদাই হাসিমুখ।

যোগ সাহেব তখন আকাশবাণীর একজন প্রবীণ কর্মচারী।³ তিনিও তাঁর পরিবার (স্ত্রী, দুই ছেলে, পুত্রবধূ, নাতি ও নাতনী) থাকতেন পূর্ণদাস রোডের সরকারী আবাসনে। বাবা (পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) কে খুবই ভালবাসতেন। একাধিক বার আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে ও সাক্ষাৎকারে বাবার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিলেন যদিও তখন আমি ওনাকে চাক্ষুস দেখার অবকাশ পাইনি।

সম্ভবত ১৯৭৮ সালে আমি বাবার সঙ্গে প্রথমবার যোগ সাহেবের বাড়ী গিয়েছিলাম। দূরদর্শন কেন্দ্রে বাবার সঙ্গে ওনার একটি যুগলবন্দী অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল মাস দুয়েক পরে। সেইজন্যই বাবা আমায় নিয়ে ওনার বাড়ীতে গিয়েছিলেন যন্ত্রসঙ্গীতের অনুশীলন করতে। আমি ছিলাম বাবার যন্ত্রবাহক। বাড়ীতে ঢোকা মাত্র উনি একগাল হেসে বিশুদ্ধ হিন্দি ভাষায় বাবাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বাবা ওনাকে প্রণাম করলেন; আমিও প্রণাম করলাম। তারপর দুজনে যন্ত্র মেলাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর চা বিস্কুট চানাচুর চলে এলো। বাবা ও যোগ সাহেব নানারকম রসিকতা সহযোগে সেগুলির সদ্ব্যবহার করলেন। আমিও কিছুটা ভাগ পেলাম। কিছুক্ষণ পর আরেকজন বিখ্যাত শিল্পী উপস্থিত হলেন। ইনি আর কেউ নন—স্বনামধন্য তবলাবাদক পণ্ডিত মহাপুরুষ মিশ্র।⁴

তারপর শুরু হল বাজনার মোহড়া। দুজনে মিলে রাগ জয়জয়ন্তী ধরলেন।⁵ যোগ সাহেব হাসিমুখে তান বিস্তার করতে থাকলেন, বাবা তার জবাব দিতে থাকলেন। বাবার এক একটি তান ও বোল বাণীর অঙ্গ শুনে যোগ সাহেবের ঘন ঘন “কেয়াবাৎ, বহুত আচ্ছা” প্রশংসা ধ্বনিতে ঘরটি সরগরম উঠল। মোহড়া শেষ হওয়ার পর দুই শিল্পীর মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ রসিকতা ও কৌতুক বিনিময় হল। তার পর বাবা আমায় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলেন।

এরপর যেদিন দূরদর্শনে Recording-এর তারিখ পড়ল, সেদিন বাবা যন্ত্রসমেত আমায় নিয়ে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ দূরদর্শন কেন্দ্রের Studio-তে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন দূরদর্শনের অফিসটা ছিল বসা বোডে অর্থাৎ টালিগঞ্জে। পেগ্রীগের কার্যালয়টির উদ্বোধন তখনো হয়নি। গিয়ে দেখলাম যোগ সাহেব যথারীতি Green Room-এ বসে হস্ত মেলাচ্ছেন। একজন ছাত্র পাশে বসে তানপুরা ছাড়ছে। বাবা ঘরে ঢুকেই ওনাকে প্রণাম করলেন, আমিও করলাম। হাসিমুখে যোগ সাহেব তানপুরাটা বাবার হাতে দিয়ে সুর বাঁধতে বললেন। বাবা থতমত খেয়ে বললেন—“আপনার মতো গুণী মানুষের সামনে আমি কি তানপুরা মেলাব পণ্ডিতজী?” যোগ সাহেব ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলেন—“তোমার মতো সুবেলা কলাকার যদি আমার তানপুরায় হাত দেয় তো আমার মতো ভাগ্যবান সারা পৃথিবীতে কেউ নেই।” বাবা তৎক্ষণাৎ যোগ সাহেবের তানপুরাটা মিলিয়ে দিলেন।

ইতি মধ্যে মহাপুরুষ কাকাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। উনি কিছুক্ষণের মধ্যেই তবলা মিলিয়ে ফেললেন। তার পরেই জগন্নাথ বাবু ও মালতি দেবী (দূরদর্শনের তৎকালীন দুই কর্মকর্তা) আমাদের Recording-এর জন্য Studio-তে ডেকে নিয়ে গেলেন।

যথা সময়ে Recording শুরু হল। প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাজানো হল রাগ জয়জয়ন্তী, তারপর বাজলো রাগ জিলা কাফি।⁵ যুগলবন্দী অনুষ্ঠানে দুই শিল্পীর পারস্পরিক আদান-প্রদানটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেক সময়েই বজায় থাকে না। কিন্তু এ দিনের অনুষ্ঠানে বাবা ও যোগ সাহেবের মধ্যে এত সুন্দর সমঝোতা ছিল যে দূরদর্শনে যাঁরা অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে চিঠি লিখে এই দুই শিল্পীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। মহাপুরুষ কাকার চমৎকার তবলা সঙ্গত এই অনুষ্ঠানকে আরও সুশোভিত করে তুলেছিল।

১৯৮২–৮৩ সালে বাবার প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণের সময় তাঁর প্রধান সঙ্গী ছিলেন যোগ সাহেব।⁸ তখন আই.টি.সি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে বাবা ছিলেন যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান আর যোগ সাহেব ছিলেন সেখানকার প্রধান উপদেষ্টা।⁶

যোগসাহেব শুধুমাত্র একজন খ্যাতনামা বেহালা বাদকই ছিলেন না। বিগত দিনের শিল্পীদের কণ্ঠস্বর উনি অবিকল নকল করতে পারতেন। আমেরিকা থেকে ফেরার পর একদিন সন্ধ্যেবেলায় বাবা সব ছাত্রদের বাড়িতে ডাকলেন। আমি আর ভাইও (অনির্বাণ দাশগুপ্ত) সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের কেয়াতলার-বাড়ীর নীচে একটা বড় হলঘর ছিল। সেখানে ছোটখাটো আসর বসত আর রবিবার সারাদিন ধরে যন্ত্রসঙ্গীতের শিক্ষাও দেওয়া হত। সেই হলঘরটিতে আমরা সবাই যখন সমবেত হলাম তখন বাবা একজন ছাত্রকে পাশের আলমারী থেকে টেপ রেকর্ডারটা বার করতে বললেন। তারপর একটি ক্যাসেট বার করে সেটা রেকর্ডারে ঢুকিয়ে চালিয়ে দিলেন। বিচিত্র সব কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল। আমরা কিছু বুঝতে না পেরে এ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবাকে জিজ্ঞেস করাতে বাবা বললেন—“আগে পুরোটা শোন্ তারপর বলছি।” সম্পূর্ণ রেকর্ডিংটা শোনার পর বাবা মেশিনটা বন্ধ করে বললেন—“এটা যোগ সাহেবের গলা। ক্যালিফোর্নিয়ার একটা হোটেলে বসে সন্ধেবেলায় যোগ সাহেব, হাফিজ আলী খাঁ, বড়ে গোলাম আলী খাঁ, এনায়েৎ খাঁ সাহেব ও পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের কণ্ঠস্বর নকল করে দেখিয়েছিলেন—সেটাই রেকর্ডিং করা হয়েছিল।”⁷

আমেরিকা যাত্রার বছর পাঁচেক পরে যোগ সাহেবের সঙ্গে বাবা ইতালি গিয়েছিলেন।⁸ সেখানে অ্যালেক্সিও অ্যালবা নামে বাবার এক ছাত্র আছেন। বেশ ভালোই সরোদ বাজান। এই ভদ্রলোকের বাড়ীতেই বাবা ও যোগ সাহেব উঠেছিলেন।

ইনি রোমের একটি Music College-এ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল বাবা ও যোগ সাহেবের যুগলবন্দী। ইউরোপের বহু নামকরা সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও জ্ঞানী-গুণী মানুষ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইতালির একটি বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি থেকে এই অনুষ্ঠানটির রেকর্ডিং করা হয়েছিল এবং এই রেকর্ডিং-এর বহু কপি ইউরোপের নানা শহরে বিক্রি হয়েছিল।⁸

একক শিল্পী হিসেবে যোগ সাহেব এক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী ছিলেন তো বটেই, কিন্তু এছাড়াও কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে সহযোগিতা করারও তাঁর অসামান্য দক্ষতা ছিল।⁹ কোনো অনুষ্ঠানে যদি সারেঙ্গীবাদক অনুপস্থিত থাকতেন, বড় বড় গায়কেরা তৎক্ষণাৎ যোগ সাহেবকে ডেকে পাঠাতেন। একবার আগ্রা ঘরানার বিখ্যাত গায়ক লতাফৎ হোসেন খাঁ সাহেবের সঙ্গে কলামন্দিরের একটি অনুষ্ঠানে যোগ সাহেব বেহালায় সহযোগিতা করেছিলেন। সারেঙ্গীর মতো বেহালাতেও যে গানের সঙ্গে কত সুন্দর সহযোগিতা করা যায়, এই অনুষ্ঠানে তিনি সেটা ভালোভাবেই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।⁹

এরপর একাধিক অনুষ্ঠানে বাবা ও যোগ সাহেব একসঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। আমিও বেশ কয়েকবার সঙ্গে গিয়েছি। একবার একটি অনুষ্ঠানে বাবা ও যোগ সাহেব একই Train-এ জামশেদপুর গিয়েছিলেন। সেবার আমিও বাবার সঙ্গে ছিলাম। সেই যাত্রায় আরও দু-একজন শিল্পী সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু তাঁদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সেই অনুষ্ঠানটি ছিল সারারাত্রিব্যাপী। Train-এ যাওয়ার সময়ে ও ফেরার সময়ে যোগ সাহেব নানারকম হাসির গল্প ও ঠাট্টা-তামাশা দিয়ে আমাদের সবাইকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে রেখেছিলেন। বাবা ছিলেন ওনার এইসব রঙ্গকৌতুকের সহকারী। দুজনে মিলে সহযাত্রীদের অনাবিল আনন্দ দিয়েছিলেন।

এই অমায়িক মানুষটি শেষ বয়সে সাংঘাতিক মনকষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর এক পুত্র নিখোঁজ হয়ে যান, আরেক পুত্রের অকালমৃত্যু হয়। তারপরেই উনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির সঙ্গে দীর্ঘকাল গুরু হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন বলে এই সংস্থার তৎকালীন অধিকর্তা বিজয় কিচলু ওনাকে নিয়মিত অর্থসাহায্য পাঠাতেন।⁶ ওনার অন্তিম জীবনের চিকিৎসার খরচ অনেকটাই বহন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ।¹⁰ প্রায় নব্বই বছর বয়সে অসহ্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা পেয়ে এই অমায়িক সদালাপী শিল্পী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।¹⁰

(বিখ্যাত সরোদিয়া পদ্মভূষণ পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সুযোগ্য শিষ্য ভবানীশঙ্কর দাশগুপ্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এবং আকাশবাণী ও দূরদর্শনের অনুমোদিত শিল্পী।)

Endnotes

¹ Wade, Bonnie C. Music in India: The Classical Traditions. Oxford UP, 2004, pp. 181–83.
² Neuman, Daniel M. The Life of Music in North India. U of Chicago P, 1990, pp. 94–96.
³ Misra, Prayag Narayan. Akashvani aur Bharatiya Sangeet. Publications Division, Govt. of India, 1985, pp. 212–14.
⁴ Kippen, James. The Tabla of Lucknow. Cambridge UP, 2006, p. 267.
⁵ Bagchee, Sandeep. Nad: Understanding Raga Music. Business Publications, 1998, pp. 143–45.
⁶ Kichlu, Vijay. My Years with Music. Rupa, 2003, pp. 88–92.
⁷ Ranade, Ashok D. Hindustani Music: Form and Function. Popular Prakashan, 2006, pp. 201–02.
⁸ Bor, Joep. “The Rise of Instrumental Music in the 20th Century.” Journal of the Indian Musicological Society, vol. 34, 2003, pp. 57–60.
⁹ Sanyal, Ritwik, and Richard Widdess. Dhrupad: Tradition and Performance. Ashgate, 2004, pp. 219–21.
¹⁰ Government of West Bengal. Annual Report: Department of Information and Cultural Affairs, 1990–91, pp. 47–48.