January 1, 2026

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য ও সত্যের সম্পর্ক-দ্যুতি সাঁতরা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

গবেষক, সিস্টারনিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়


সারাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নন্দনতত্ত্বে সত্য, সুন্দর এবং আনন্দ এক অভিন্ন সত্তার তিনটি দিক। তাঁর মতে, যা পরম সত্য, মানুষের হৃদয়ের গভীর উপলব্ধিতে তা-ই সুন্দর রূপে প্রতিভাত হয় এবং সেই সৌন্দর্যের আস্বাদন থেকেই জন্ম নেয় অনির্বচনীয় আনন্দ।
এই দর্শনের মূল দিকগুলো হলো:

  • তথ্যের ঊর্ধ্বে সত্য: বিজ্ঞান বা বুদ্ধি যা তথ্য (Fact) হিসেবে জানে, শিল্প সেই তথ্যকেই অনুভূতির রসে জারিত করে সত্যে (Truth) রূপান্তরিত করে। কবির কাছে বিচ্ছিন্নতা হলো তথ্য, আর ঐক্যই হলো সত্য।
  • প্রয়োজন বনাম আনন্দ: জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক শুধু প্রয়োজন বা বুদ্ধির নয়। যেখানে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, সেখানেই শিল্পের মুক্তি। শিল্পী কোনো জাগতিক লাভের আশায় নয়, বরং ‘অহৈতুকী’ আনন্দের টানে সৃষ্টি করেন।
  • চেতনার রঙ: সৌন্দর্য বস্তুর নিজস্ব কোনো ধর্ম নয়, বরং মানুষের সৃজনশীল চেতনারই প্রতিফলন। মানুষের মনই তার মাধুর্য দিয়ে জগতকে সুন্দর করে তোলে।
  • অখণ্ডতা ও সামঞ্জস্য: রবীন্দ্রনাথের কাছে সৌন্দর্য হলো একটি সুগভীর ‘সুমিতি’ বা সামঞ্জস্য। এখানে দুঃখ বা অসুন্দর বর্জিত নয়; বরং তারা সামগ্রিক সত্য ও আনন্দেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
    এক কথায়: রবীন্দ্রনাথের দর্শন অনুযায়ী, যা কিছু সত্য ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ, তা-ই সুন্দর; আর সেই সুন্দরের মাধ্যমেই মানুষ তার ক্ষুদ্র অহংবোধকে ছাপিয়ে বিশ্বমানবসত্তার সঙ্গে মিলিত হয়।

আনন্দের অনুভূতি যেমন প্রাকৃতিক দৃশ্যে জাগ্রত হয়, তেমনি মানুষের সৃষ্ট শিল্পকর্মেও তা অনুভূত হয়। প্রকৃতি ও শিল্প—উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে রয়েছে আনন্দ। শিল্পী যা সৃষ্টি করেন, তার উদ্দেশ্য একদিকে নিজের আনন্দলাভ, অন্যদিকে রসিকের আনন্দসাধন। এই আনন্দই শিল্পের মৌলিক প্রেরণা।

রবীন্দ্রনাথ মানুষের মৌলিক বৃত্তিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন—জ্ঞানবৃত্তি, কর্মবৃত্তি ও অনুভূতিবৃত্তি। এই তিনটির পাশাপাশি তিনি আরেকটি স্বতন্ত্র বৃত্তির কথা বলেছেন, তা হলো শিল্পবৃত্তি। এই শিল্পবৃত্তির ভিত্তি মানুষের সহজাত সৃষ্টিস্পৃহা বা ‘সৃষ্টির আকুতি’। শিল্পী এই আকুতির টানে সৃষ্টি করেন এবং সেই সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই তিনি আনন্দের উপলব্ধি করেন। সুতরাং যেখানে মানুষ শিল্পী, সেখানে সে নিছক ব্যবহারিক দায় বা প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে। শিল্পী শিল্পকর্ম রচনা করে যে আনন্দ পান, তা কেবল ব্যক্তিগত নয়; তিনি যেন বলেন—আমি সৃষ্টি করে আনন্দ পেয়েছি, এখন তোমরাও দেখে সেই আনন্দের অংশীদার হও।

রবীন্দ্রনাথের শিল্পতত্ত্ব একেবারেই মৌলিক ও স্বতন্ত্র। ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের ধারায় বিশ্বনাথ কবিরাজের বিখ্যাত সূত্র—“বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্”—তিনি গভীর গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এই সূত্রের মাধ্যমে তিনি কাব্যের মূল সত্তাকে রসের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি কবি কিটসের প্রসিদ্ধ উক্তি—“Truth is beauty, beauty truth”—একাধিকবার উদ্ধৃত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় কিটসের ‘truth’ বলতে কেবল তথ্যগত সত্য নয়, বরং সামগ্রিক ঐক্য, সামঞ্জস্য ও পূর্ণতার অনুভবকে বোঝায়।

রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের শিল্পের প্রতি আকর্ষণ একটি মৌলিক ও স্বাভাবিক আকর্ষণ। শিল্পী হওয়ার ডাক এতটাই প্রবল যে মানুষ তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। শিল্প মানুষকে আকর্ষণ করে, কারণ এর মধ্যে আনন্দ নিহিত। তিনি বলেন—“আমাদের সৌন্দর্যবোধ ক্রমে সমস্ত জগতকে আমাদের আনন্দের জগত করিয়া তুলিতেছে; জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত জগতে আমার মন ব্যক্ত হইবে, কর্মের দ্বারা সমস্ত জগতে আমার শক্তি ব্যাপ্ত হইবে এবং সৌন্দর্যবোধের দ্বারা সমস্ত জগতে আমার আনন্দ ব্যাপ্ত হইবে—মনুষ্যত্বের ইহাই লক্ষ্য।” এই বক্তব্যে তিনি জ্ঞান, কর্ম ও সৌন্দর্য—এই তিন বৃত্তির সমন্বয়ে মানুষের পূর্ণতার কথা বলেছেন।

সত্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়েও রবীন্দ্রনাথ গভীর দার্শনিক আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সত্যের সঙ্গে মানুষের তিন ধরনের যোগ সম্ভব—বুদ্ধির যোগ, প্রয়োজনের যোগ এবং আনন্দের যোগ। এই ধারণাটি তিনি একটি চমৎকার উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন—“এক কথায় সত্যের সঙ্গে বুদ্ধির যোগ আমাদের ইস্কুল, প্রয়োজনের যোগ আমাদের অফিস, আনন্দের যোগ আমাদের ঘর। ইস্কুল নিরালংকার, অফিস নীরাভরণ, ঘরকে কত সাজসজ্জায় সাজাইয়া থাকি।” এখানে ঘর হলো সৌন্দর্য ও আনন্দের ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ সত্যকে হৃদয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করে।

রবীন্দ্রনাথ শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘অহৈতুকতা’-র উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, শিল্পের উদ্দেশ্য কোনো বাহ্যিক লাভ নয়; শিল্পের উদ্দেশ্য শিল্পের মধ্যেই নিহিত। তিনি বলেন—“সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়। ফুল কেন ফোটে তাহা তাহার সাধ্য অনুমান করে, কিন্তু ইটের পাঁজা কেন পোড়ে তাহা সকলেই জানে।” এই বক্তব্যে শিল্প ও কারিগরি নির্মাণের মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির মধ্যেও দুই ধরনের কার্যপ্রণালির কথা বলেছেন—একটি প্রয়োজনের তাগিদে পরিচালিত কার্য, অন্যটি ভাবের প্রকাশ। প্রথমটি কর্মের জগৎ, দ্বিতীয়টি শিল্পের জগৎ। শিল্পীর কাজ হলো বিশ্বজগতের মধ্যে নিহিত ভাবকে প্রথমে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করা এবং পরে রূপের মাধ্যমে তাকে সকলের জন্য প্রকাশ করা। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিল্পীর মনে দুটি সত্তা সক্রিয় থাকে—একটি ব্যক্তিসত্তা, যা বিশ্ব থেকে ভাব সংগ্রহ করে; অন্যটি বিশ্বমানবসত্তা, যা সেই ভাবগুলির মধ্য থেকে নির্বাচিত ভাবকে রূপ দেয়। তাই শিল্পীর প্রতিভা ব্যক্তিগত হলেও তার প্রকাশ সর্বজনীন। এই ভাবনাকে তিনি কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন—

“আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে; আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে।”

‘সত্য’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। একদিকে বৈজ্ঞানিক বা তথ্যগত সত্য, অন্যদিকে শিল্পসত্য। তাঁর মতে, বিচ্ছিন্ন ও একা অবস্থায় যা থাকে তা ‘তথ্য’। কিন্তু সেই তথ্যকে বৃহত্তর সামগ্রিকতার সঙ্গে যুক্ত করলে, অর্থাৎ ঐক্যের মধ্যে স্থাপন করলে, তখনই তা সত্যে রূপান্তরিত হয়। তিনি বলেছেন—“আমাদের মন যে জ্ঞানরাজ্যে বিচরণ করে, সেটা দুমুখো পদার্থ—তার একটা দিক তথ্য, আর একটা দিক সত্য।” শিল্পী বহির্বিশ্ব থেকে যে কাঁচা উপাদান গ্রহণ করেন তা তথ্য; কল্পনা ও অনুভূতির দ্বারা তাকে রূপান্তরিত করে তিনি যে সামগ্রিক ঐক্য নির্মাণ করেন, সেটিই শিল্পসত্য।

রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রকৃত সৌন্দর্যের ভিত্তি হলো অভ্যন্তরীণ সুসামঞ্জস্য বা ‘সুমিতি’। সুন্দর বস্তুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে ঐক্য ও সামঞ্জস্য বিরাজ করে, তাকেই তিনি সুমিতি বলেছেন। ইন্দ্রধনুর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন—“ইন্দ্রধনুর রংগুলির মধ্যে কেমন মিল! তাহারা সকলেই সকলের জন্য জায়গা রাখিয়াছে, কেহ কাহাকেও দূর করিতে চায় না।” এই সুমিতিই শিল্পের শ্রী ও সম্পূর্ণতা।

রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচিন্তায় অসুন্দরও বর্জিত নয়। জীবনে দুঃখ, কষ্ট ও অসামঞ্জস্য থাকলেও, তা সামগ্রিক আনন্দের অন্তর্ভুক্ত। তাই তিনি বলেছেন—“সুখেরই বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত নয়; দুঃখ আনন্দেরই অন্তর্ভুক্ত।” সত্য ও সুন্দর সম্পর্কে কিটসের উক্তি তিনি বারবার আলোচনা করেছেন এবং নিজস্ব ব্যাখ্যায় বলেছেন—যা বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা গ্রহণ করি তা সত্য, আর যা হৃদয়ের দ্বারা গ্রহণ করি তা সুন্দর। তাঁর কাছে শ্রেয় (মঙ্গল) ও প্রেয় (সুন্দর) অভিন্ন। এই ঐক্যবোধ থেকেই তিনি বলেন—“আর পাব কোথা, দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষাতত্ত্বেও প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের পূর্ণ শিক্ষার জন্য বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি ব্যক্তিসত্তা ও সৌন্দর্যবোধের বিকাশ অপরিহার্য। তাই শিল্পের মূল্য মানুষের জীবনে সর্বোচ্চ। তিনি শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছেন—“মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিকর্তা। আজকের সভ্যতা মানুষকে মজুর করছে, মিস্ত্রি করছে, মহাজন করছে—লোভ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খাটো করছে। মানুষ নির্মাণ করে ব্যবসায়ের প্রয়োজনে, সৃষ্টি করে আত্মার প্রেরণায়।”

শিল্পীর কাজই হল যে ভাব ছিল সকলের তাকে আগে নিজের করে নেওয়া এবং পরে তাকে রূপের মধ্যে প্রকাশের সাহায্যে সকলের করে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ বলেন শিল্পীর মনে দুটি বিভিন্ন সত্তা কাজ করছে। প্রথমটি হল শিল্পীর ব্যক্তি সত্তা। তা বিশ্বকে জানছে এবং তা হতে ভাব সংগ্রহ করছে। জগত হতে যেমন শিল্পীর ব্যক্তিসত্ত্বা নানা ভাব সংগ্রহ করছে তেমন এই দ্বিতীয় সত্তা তার মনের নানা ভাব থেকে বিশেষ ভাবকে প্রকাশের জন্য নির্বাচন করেছে। তিনি বলেন এখানে যে প্রতিভার কাজ করে তা ব্যক্তিরূপী শিল্পীর নয় তা বিশ্ব মানব সত্তার, মানুষের স্বভাবই হলো প্রকৃতি তাকে কোন জিনিস যেমনটি দিয়ায় ঠিক তেমনটি গ্রহণ না করা ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পী তত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় ‘সত্য’ কথাটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন বৈজ্ঞানিক সত্য বলতে যা বুঝি তাকেও সত্য বলেছেন, আবার শিল্পকর্ম বলতে যা বুঝি তাকেও সত্য বলেছেন। তবে এই কথাটি এই দুই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এদের তাৎপর্য বিভিন্ন।

যা বিচ্ছিন্ন এবং একা তাকেই রবীন্দ্রনাথ তথ্য বলেছেন। একে বৃহত্তর বস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত করে উভয়ের মধ্যে একটা ঐক্য স্থাপিত করলে তবে তা প্রকাশ পায় তখনই তথ্য সত্যে পরিণত হয়। তিনি বলেছেন —–”আমাদের মন যে জ্ঞান রাজ্যে বিচরণ করে সেটা দুমুখো পদার্থ , তার একটা দিক হচ্ছে তথ্য , আর একটা দিক হচ্ছে সত্য। যেমনটি আছে তেমনটির ভাব হচ্ছে তথ্য, সেই তথ্য যাকে অবলম্বন করে থাকে সেই হচ্ছে সত্য।……তথ্যের মধ্যে সত্যের প্রকাশই হচ্ছে প্রকাশ” । শিল্পী বহিবিশ্ব হতে যে কাঁচা উপাদান গ্রহণ করেন তা তথ্য। কারণ তা একা এবং বিচ্ছিন্ন। তাকে যখন কল্পনা দিয়ে রাঙিয়ে অনুভূতি দিয়ে সাজিয়ে বিশ্ব মানবের আনন্দ সম্পাদনের জন্য রূপ দেন তখন তাকে অবলম্বন করে একটা সামগ্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তা মানুষের ভাব লোকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এই ভাবে ঐক্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশ হয় এবং তখন তা সত্যি পরিণত হয়।

তার মতে শিল্পকর্মের বা প্রকৃত সুন্দর বস্তুর সৌন্দর্যের ভিত্তি হল তার একটা আভ্যন্তরীণ সুসামঞ্জস্য। সুন্দর বস্তুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটা সামগ্রিক সামঞ্জস্য বা ঐক্য বিদ্যমান থাকে রবীন্দ্রনাথ এই জিনিসটার নাম দিয়েছেন ‘সুমিতি’। এই সুমিতির মূল লক্ষণ হল ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্য ও সুসামঞ্জস্য। সমিতির উদাহরণ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ইন্দ্রধনুর উল্লেখ করেছেন —- “ইন্দ্রধনুর রংগুলি প্রেমের রং তাহাদের মধ্যে কেমন মিল! তাহারা সকলেই সকলের জন্য জায়গা রাখিয়াছে, কেহ কাহাকেও দূর করিতে চায় না, তাহারা সুন্দর সুর  বালিকাদের মত হাত ধরাধরি করিয়া দেখা দেয়, গলাগলি করিয়া মিলাইয়া যায় ।”

“প্রাণের ধর্ম সুমিতি , আর্টের ধর্ম ও তাই। এই সুমিতিতেই প্রাণের স্বাস্থ্য ও আনন্দ, এই সু্মিতিতে আর্ট এর শ্রী ও সম্পূর্ণতা “। অর্থাৎ সুন্দরবস্তুর মধ্যে আকর্ষণের কারণ হলো তার অভ্যন্তরীণ সুসংগতি। এই সুমিতিম বা সুসঙ্গতিই আমাদের আনন্দের কারণ। তিনি যাকে সুন্দর বলেছেন তার মধ্যে অসুন্দরেরও স্থান আছে। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপের পরিচয় আমাদের এনে দেয়। তার অনুভূতি কোথাও সুখকর কোথাও নয়, কোথাও সুন্দর কোথাও অসুন্দর। তবু সর্বক্ষেত্রেই আমাদের মনের মানুষটি তাতে আনন্দ লাভ করে। তাই তিনি বলেছেন —”এটা মনে রাখা চাই যে সুখেরই বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত নয়; বস্তুত দুঃখ আনন্দেরই অন্তর্ভুক্ত। কথাটা শুনতে স্বতবিরুদ্ধ কিন্তু সত্য ।”

সত্যের সঙ্গে সুন্দরের তুলনায় তিনি বহুবারই কিটসের প্রসিদ্ধ উক্তি ‘Truth is beauty, beauty truth ‘এই মন্তব্যটিকে একাধিকবার আলোচনা করেছেন। বস্তুত তিনি বলেছেন সত্যের যে রূপটি আমরা বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা গ্রহণ করি তাহলো সত্য এবং যে রুপ টি হৃদয় বৃত্তির দ্বারা গ্রহণ করি তাহলে সুন্দর। তার কাছে যা শ্রেয় তাই প্রেয়। শ্রেয় অর্থে মঙ্গলময় এবং প্রেয় অর্থে সুন্দর । সেই শ্রেয় ও প্রেয় তার কাছে এক হয়ে গেছে। তাই তিনি বলেন –”আর পাব কোথা

দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা”।

তার মতে মানুষের শিক্ষাকে সম্পূর্ণতা দিতে হলে শিক্ষার্থীকে যেমন বুদ্ধিবৃত্তির ভাষার সঙ্গে পরিচিত করতে হবে তেমন ব্যক্তিসত্তার ভাষার সহিত পরিচিত করতে হবে। এইসব কারণে রবীন্দ্রনাথের ধারণায় শিল্পের মূল্য মানুষের জীবনে সবার ঊর্ধ্বে। তাই তার প্রতি অর্ঘ নিবেদন করেছেন এই বলে –”মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিকর্তা। আজকের দিনের সভ্যতা মানুষকে মজুর করছে, মিস্ত্রি করছে, মহাজন করছে, লোভ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খাটো করছে। মানুষ নির্মাণ করে ব্যবসায়ের প্রয়োজনে, সৃষ্টি করে আত্মার প্রেরণায়।”


তথ্যসূত্র

  1. Tagore, Rabindranath. Sahitya. Rabindra Rachanabali, Vol. 12, Visva-Bharati, 1961. রবীন্দ্রনাথ এখানে শিল্প ও আনন্দের সম্পর্ক এবং সৌন্দর্যবোধের দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
  2. Tagore, Rabindranath. Sadhana: The Realisation of Life. Macmillan, 1913. এই গ্রন্থে সত্য, আনন্দ ও মানবচেতনার ঐক্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।
  3. Tagore, Rabindranath. The Religion of Man. George Allen & Unwin, 1931. শিল্প, মানবসত্তা ও বিশ্বমানবভাবনার সম্পর্ক বোঝাতে এই গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ।
  4. Viswanatha Kaviraja. Sahityadarpana. Translated excerpts in Indian Poetics, Motilal Banarsidass, 1985. “বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্” সূত্রের প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত।
  5. Keats, John. “Ode on a Grecian Urn.” The Complete Poems of John Keats, edited by Jack Stillinger, Harvard UP, 1978. ‘Truth is beauty, beauty truth’ উক্তিটির মূল সূত্র।
  6. Tagore, Rabindranath. Kala o Sahitya. Rabindra Rachanabali, Vol. 13, Visva-Bharati, 1961. শিল্প, সুমিতি ও সৌন্দর্যের অন্তর্গত সামঞ্জস্য প্রসঙ্গে ব্যবহৃত।
  7. Tagore, Rabindranath. Shilpa Chinta. Rabindra Rachanabali, Vol. 14, Visva-Bharati, 1961. শিল্পসৃষ্টির অহৈতুকতা ও শিল্পীর দ্বৈত সত্তা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য।
  8. Das, Sisir Kumar. The Aesthetics of Rabindranath Tagore. Sahitya Akademi, 1964. রবীন্দ্রনাথের শিল্পতত্ত্ব ও সত্য-সুন্দর সম্পর্ক বিশ্লেষণে সহায়ক সমালোচনাগ্রন্থ।
  9. Sen, Amiya. Rabindranath Tagore: An Interpretation. Oxford UP, 2001. রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক ও নান্দনিক চিন্তার আধুনিক ব্যাখ্যার জন্য।
  10. Tagore, Rabindranath. Gitabitan. Visva-Bharati, 1960. প্রবন্ধে উদ্ধৃত কবিতাংশের মূল উৎস।