Nazrul in the Genre of Bengali Folk Songs
Tumpa Samaddar
Abstract: This exploration delves into the vibrant world of Kazi Nazrul Islam’s compositions within the realm of Bengali folk songs. Nazrul, often referred to as the “Rebel Poet,” demonstrated a profound ability to encapsulate the spirit of Bengali folk traditions in his musical creations. This study aims to unravel the intricate tapestry of his work, highlighting the fusion of poetic expression and folk melodies that characterize Nazrul’s unique contribution to the rich cultural heritage of Bengal. Through an analysis of select compositions, we uncover the socio-cultural contexts that inspired Nazrul to infuse his verses with the essence of rural life, weaving a symphony that resonates with the soulful tunes of Bengal’s folk music. Join us on this harmonious journey as we unravel the timeless allure of Nazrul’s folk-infused creations, celebrating the convergence of poetry and tradition in the Rebel Poet’s musical legacy.
বাংলা লোকগীতির ধারায় নজরুল, টুম্পা সমদ্দার, সহযোগী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারসংক্ষেপ: বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে লোকসুর প্রয়োগের বিষয়টি অতি প্রাচীন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান গীতিকবিগণ তাঁদের গান রচনার বিষয়বস্তু এবং সুর হিসেবেও লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহার করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় কাজী নজরুল ইসলামও এর ব্যতিক্রম নন। বাংলা লোকগীতির বিভিন্ন ধারা অবলম্বনে তিনি গান রচনা করেছেন এবং বৈচিত্র্যতা তুলে ধরেছেন। বাউল, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ঝাপান, কাজরী সব মিলিয়ে প্রায় একশত লোকঅঙ্গের গান রচনা করেছেন তিনি। এছাড়াও ছাদ পেটানোর গান, চরকার গান, সাঁওতালি গান, মুর্শিদি ও মারফতি গান রচনা করেছেন। কখনো বাণীর বুননে, কখনো বা লোকধারা অবলম্বনে সুর সৃুষ্টি করেছেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় রচিত এই প্রবন্ধ।
বাংলা সংগীতে লোকসংগীতের সুর অবলম্বনে গান রচনায় অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রধাণত বাউলসুর অবলম্বনে গান রচনা করেছিলেন। মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেনও লোকসংগীতের ঢঙ্গ; বিশেষ করে বাউলের সুরে গান রচনা করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ পর্বে লোকসংগীতের সুরে স্বদেশী গান রচিত হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এঁদের সঙ্গীতকর্মেও বাউল সুরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামই লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারা অবলম্বনে গান রচনা করেন।
কাজী নজরুলের জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। ছোটবেলা থেকে তাঁর বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষাগ্রহণ সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন মিলন দত্ত-
শেখ চাকর গোদা এবং মুন্সী বজলে করীমের প্রভাবে নজরুল লেটো দলের জন্য গান লিখে দিতে লাগলেন। তাঁর লেখা গান দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠল। গ্রামে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল কিশোর কবির নাম। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁর কাছে লোক আসতে লাগল গান লিখিয়ে নেবার জন্য। আর নজরুলও মুক্তহস্ত। যে এসে গান চায়, তাকেই তিনি গান লিখে দেন। আর গানই কি এক রকম? কেউ চায় সঙের গান, কেউ চায় ছড়ার গান, কেউ চায় বন্দনা গান, কেউ চায় চাপান গান, কেউ চায় ঠেস গান। নজরুল চাহিদামাফিক সকল ধরণের গানই লিখে দিতে লাগলেন। আরবি, ফার্সি, বাংলা, ইংরেজী শব্দ ও বাক্য মেশানো গানও তাকে লিখতে হতো। পরবর্তীকালে নজরুল এক অসাধারণ সংগীত রচয়িতা ও সুরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এক দিনে এক সঙ্গে চৌদ্দ পনেরোটি গান লিখে, তাতে সুর দিয়ে এবং তা সকলকে শেখানোর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তার মূল উৎস ছিল লেটোর দলের জন্য বিচিত্র অসংখ্য গান রচনার মধ্যে। এর মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন প্রানের আরাম, মনের তৃপ্তি। (দত্ত মিলন, ১৯৭৬: ২২)।
বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলে কেটেছে নজরুলের ছেলেবেলা। গ্রামীণ জীবন, বাংলার প্রকৃতি, লোক সংস্কৃতি এরই প্রভাব পড়েছে কবির লেখনীতে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে চট্রগ্রাম বুলবুল সোসাইটির পক্ষ থেকে কবি নজরুল ইসলামকে প্রদত্ত মানপত্রের উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ
আমায় সাদর সম্ভাষণ করেছে তোমাদেরই আগে তোমাদেরি গিরি-সিন্ধু-নদী-কান্তার পরিশোভিত পরিস্থান। তোমাদেরি গিরিরাজের কোলের কাছটিতে সর্ষেফুলের আঁচল বিছিয়ে যে উদাসিনী বালিকাকে নদীর ঢেউ খেলানো চুল এলিয়ে বসে থাকতে দেখেছি, আমায় সর্বপ্রথম মৌন অভিনন্দন জানিয়েছে সে। … তোমাদের কর্ণফুলির তরঙ্গে যে তরুণী তার ভরা যৌবনের স্বপ্ন বিছিয়ে, কাননের কুন্তল এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে, আমায় সর্বপ্রথম আমন্ত্রণলিপি পাঠিয়েছে সেই- তার সম্পান মাঝির হাতে। … তোমাদের বনে বনে ঘুরে ফেরে যে বালিকা বনলক্ষী- তার হলদে পাখি, বউ কথা কও, পিক-পাপিয়ার নুপুর কানন বাজিয়ে, গুবাক তরুর হাতছানি দিয়ে আমায় সবার আগে ডেকেছে সেই আলুলায়িত কুন্তলা কপালকুন্ডলা। তোমাদের উদার আকাশ মেঘের আল্পনা এঁকে আমার আসন রচনা করেছে, -বৃষ্টি-প্রপাত-ছন্দে তোমাদের আসমানি মেয়েরা আমার শিরে পুষ্পবৃষ্টি করেছে, তোমাদের জলপ্রপাত নির্ঝরিণী আমার গজল গানে সুর দিয়েছে, তোমাদের সিন্ধু-হিল্লোল আমার রক্তে নতুন দোল দিয়েছে। (নজরুল রচনাবলী, ৮ম খণ্ড ১৭-১৮)
লোকসংগীতের একটি প্রধান ধারা হল ভাটিয়ালি। আমাদের এই দেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী তীরবর্তী মানুষের সুখ- দু:খ, হাসি- কান্না, প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনা ইত্যাদি অনুভূতির আবেগ প্রকাশ পায় ভাটিয়ালী গানে। ”ভাটিয়ালি (ভাটিআলি) ‘ভাটি’ অর্থাৎ নিম্নভূমি এবং ‘আলি’ অর্থাৎ আইল বা আল (কৃষি জমিতে পানি আটকাবার বা সীমা নির্দেশের জন্য মাটির অনুচ্চ বাঁধ বিশেষ) শব্দ দুটি হতে উদ্ভূত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে ভাটিয়ালি শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ছোট ছোট আল দ্বারা বিস্তৃত নিম্নাঞ্চলের গানই হলো ভাটিয়ালি। এখানে ভাটিয়ালি শুধু একটি বিশেষ ধরণের লোকসংগীত নয়, একটি বিশেষ অঞ্চলের পরিচয়ও বহন করে”। (রহমান হাবিবুর, ১৯৮২: ১৪৪)। ভাটিয়ালি ভাটির গান, মাঝি-মল্লাদের গান। ”সুরের মধ্যেই সংগীতের প্রকৃত সৌন্দর্য-মাধুর্যের উৎস নিহিত। ভাটিয়ালি গানের সুর করুণ। এর মূখ্য ভাব প্রেম; লৌকিক ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রেমে বিচ্ছেদজনিত করুণ রস সঞ্চারিত হয়েছে। আবহমান বাংলায় মাঝি-মল্লারা নদী-বিল-হাওরে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে অতি একান্তে এই গান গেয়ে পার্থিব ও অপার্থিব জীবনের আস্বাদন লাভ করেন। ভাবের মাহাত্ম্যে ও সুরের লালিত্যে এ গান অনন্য”। (আহমেদ ওয়াকিল, ১৯৯৭)।
কবি নজরুলের বাইশ বছরের সৃষ্টিশীল জীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাঁর রচিত ভাটিয়ালি গানেও রয়েছে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের প্রেম-বিরহ-বেদনা-আশা-আকাঙ্খার প্রকাশ। আবার রয়েছে আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ।
১. ও কূল-ভাঙ্গা নদী রে,
আমার চোখের নীর এনেছি মিশাতে তোর নীরে
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৬৬
২. নাইতে এসে ভাটির স্রোতে কলসি গেল ভেসে
সেই দেশে যাইও রে কল্সি, বন্ধু রয় যে দেশে।
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৭৬
৩. পদ্মার ঢেউ রে-
মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা যারে।
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ১৬
৪. আমি কূল ছেড়ে চলিলাম ভেসে
বলিস ননদীরে সেই
শ্রীকৃষ্ণ নামের তরনীতে প্রেম-যমুনার তীরে
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৯৫
৫. তোর রূপে সই গাহন ক’রে জুড়িয়ে গেল গা
তোর গাঁয়েরি নদীর ঘাটে বাঁধলাম এ মোর না।
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ১১৮
৬. আমার গহীন জলের নদী
আমি তোমার জলে ভেসে রইলাম জনম অবধি।
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ২৮২
উপরের উল্লেখিত গান সমূহে বিরহী মনের বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। এসব গানের সহজ সরল সুর মনকে উদাস করে এবং হৃদয়ে আবেগ জাগায়।
১. কান্ডারী গো, কর কর পার এই অকূল ভব-পারাবার
তোমার চরণ-তরী বিনা, প্রভু পারের আশা নাহি আর।
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৪
২. এ-কূল ভাঙ্গে ও-কূল গড়ে এইতো নদীর খেলা
সকাল বেলা আমির, রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা।.
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ২৭০
এই ধরণের গানগুলোতে জীবনের চরম সত্যের প্রকাশ স্পষ্টভাবে ফুঁটে উঠেছে। জীবন অনিত্য। ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। কিন্তু সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। প্রভুর চরণই শেষ আশ্রয়স্থল।
কাজী নজরুল রচিত ভাটিয়ালী গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে সব গানেই প্রেমের রূপের প্রকাশ রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। কখনো বিরহের মধ্যেই মিলনের প্রবল আকাঙ্খা, আবার কখনো বা প্রিয়জনকে কাছে পাবার প্রত্যাশা। গানের সুরেও হৃদয়ের শূন্যতার প্রকাশ স্পষ্ট।
ঝুমুর গান সাঁওতালদের গান হিসেবে পরিচিত। সাধারণ অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের জীবনযাত্রা, কাহিনী নিয়ে রচিত এই আবেগ-জাত গান। ”মূলত আদিবাসী সংগীত হলেও সাঁওতালদের মাধ্যমে ঝুমুর বাংলা গানের অন্তর্গত হয়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের সীমান্তে বা তার ভিতরে সাঁওতালদের সঙ্গে বাংলা লোকসংস্কৃতির সংযোগ ঘটলে ঝুমুরের ধারা বাংলা লোকগীতিতে সংক্রমিত হয়”। ( গোস্বামী করুণাময়, ১৯৮৫: ২১৮। সহজ সরল কথা ও সুরে দলগতভাবে নেচে গেয়ে এই গান পরিবেশিত হয়। বাংলা লোকগীতির ধারায় গান রচনার ক্ষেত্রে ঝুমুরের ঢঙ্ অবলম্বনে কাজী নজরুল সর্বাধিক গান রচনা করেছেন। ”ঝুমুর গানের একটা জমজমাট আনন্দ আছে, এক ধরণের ছন্দ দোলা আছে যা হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে মনকে সজাগ করে তোলে। এর সংগীতরূপ বাউল ভাটিয়ালির মতো দীর্ঘ সুর রেখার সাহায্যে গীত নয়, টুকরো টুকরো সুরে এর রূপ রচিত। নৃত্য দোদুলতা এর অবিচ্ছেদ্য অংশ”। (গোস্বামী করুণাময়, ১৯৭৮: ৩০০)
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কয়েকটি জনপ্রিয় ঝুমুর অঙ্গের গান:
১.রাঙ্গামাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি,
বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগে না কাজে লো,
রইতে নারি ঘরে ওলো প্রান হলো উদাসী লো \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ১৯১
২.নাচের নেশার ঘোর লেগেছে নয়ন পড়ে ঢু’লে লো
বুনোফুল পড়লো ঝ’রে নাচের ঘোরে
দোলন-খোঁপা খুলে (লো) \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৭৭
৩.চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে
চোখ গেল পাখি (রে)
তোর ও চোখে কাহার চোখ পড়েছে নাকি রে
চোখ গেল পাখি (রে)
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ১৩
৪.তেপান্তরের মাঠে বধূ হে একা বসে থাকি।
তুমি যে পথ দিয়ে গেছ চলেতারি ধুলা মাখি’ হে \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ১৯২
৫.হলুদ গাঁদার ফুল রাঙ্গা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নৈলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৯২
৬.চুড়ির তালে নূড়ির মালা রিনিঝিনি বাজে লো-
খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ২০০
৭.ঝুমঝুম্ ঝুম্রা নাচ নেচে কে এলো গো সই লো দেখে আয়।
বৈচি বনের বিরহে বাউরী বাতাস বহে এলো মেলো গো \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ১৩৫
প্রতিটি গানের কথা ও সুরে ঝুমুরের ঢঙ্ স্পষ্টভাবে ফুঁটে উঠেছে। প্রথম গানে মাদলের ছন্দে মন আন্দোলিত হয়। দোল লাগে শাল পিয়াল বনে, নোটন খোঁপার ফুলে। মাতাল চাঁদের আলোয় প্রিয়জনকে বলবো ভালবাসি লো। দ্বিতীয় গানে সারাদিন কাজের শেষে রাতে দলগতভাবে মেয়েদের নাচ এবং ছেলেদের গানের চিত্র স্পষ্ট। নৃত্যের ছন্দে সকলে এগোয় আবার পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসে। নাচের নেশার ঘোর কাটলেও মনে পড়বে বাঁশরিয়ার টুলটুলে চোখ দু’টিকে। ঝুমুর অঙ্গের সব গানগুলোতেই ঝুমুরের সুরে-তালে-ছন্দে সাঁওতালী বা আদিবাসী নারীদের আবেগ ও অনুভূতির রূপ ফুঁটে উঠেছে। কবি নজরুলই প্রথম এই ঢঙটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। পাতালপুরী বানীচিত্রের জন্য তিনি সাঁওতালী ঢঙে ঝুমুর গান রচনা করেছেন এবং বাংলা গানের নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করেন।
ভাওয়াইয়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল তথা দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক গান। এই গানকে ভাব গানও বলা হয়। ভাওয়াইয়া গানে নারী মনের কান্না প্রকাশ পায়। পার্থিব সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, প্রেম-বাসনা, বিরহ-যাতনা, মিলনাকাঙ্খা বিবৃত থাকে এই গানে। এই গানের সুর করুণ। দীর্ঘ টানা সুর, সুরের ভাঁজ, হ ধ্বনির উচ্চারণ এই গানের বৈশিষ্ট্য। উচু-নিচু পথে যাত্রী নিয়ে গাড়িয়াল, মেষাল বা মাহুত এই গান গায়। উচু নিচু পথে চলতে গিয়ে টানা সুরের মাঝে গলা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এক বিশেষ ঢঙ্রে সৃষ্টি হয়, যা এই গানের স্বাতন্ত্র্য ঢঙ্ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কাজী নজরুলও ভাওয়াইয়া গানের এই বিশেষ সুর ভঙ্গিমায় আকৃষ্ট হয়েছেন। ”আব্বাস উদ্দীনের কন্ঠে ভাওয়াইয়া শুনে ভাওয়াইয়া সুরে গলাভাঙ্গার মাধুর্যে আহা আহা করে আত্মহারা হয়ে যেতেন”। (হক আসাদুল সম্পাদিত, ১৯৯৯: ২৫)। ‘নদীর নাম সই কচুয়া’ ভাওয়াইয়া গান শুনে কাজী নজরুল রচনা করলেন- ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা”। ‘তেরসা নদীর পারে’ রূপান্তরিত হলো ‘পদ্মদীঘির ধারে ধারে ঐ’।
লোকসঙ্গীতের একটি অন্যতম ধারা বাউল সংগীত। বাউল গানকে আধাত্মগীতিও বলা হয়। মানবধর্মই বাউলদের একমাত্র ধর্ম। দেহের ভিতরই পরম সুন্দরের বাস। মানব মনে যে পরম সুন্দর অবস্থান সেই সুন্দরের সাধনায় মত্ত বাউল কবিগণ। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: ‘আমার প্রানের মানুষ আছে প্রানে, তাই হেরি তায় সকল খানে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল সুরে অনেক গান রচনা করেছেন। কাজী নজরুল রচিত বাউল অঙ্গের গানে বাউল ভাবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নজরুল রচিত কয়েকটি বাউল সুরের গান:
১.আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল
আমার দেউল আমারি এই আপন দেহ।
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৬৬৩
২.আমি বাউল হলাম ধুলির পথে লয়ে তোমার নাম
আমার একতারাতে বাজে শুধু তোমারই গান, শ্যাম \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৬৬২
৩.অসীম আকাশ হাত্ড়ে ফিরে খুঁজিসরে তুই কাকে?
তোর দূরের ঠাকুর তোরই ঘরে কাছে কাছে থাকে \
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৬৬০
৪. কোন্ সুদূরের চেনা বাঁশির ডাক শুনেছিস ওরে চখা?
নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৫৫৬
সাপ, বেহুলা-লক্ষীন্দর, চাঁদ-সওদাগর, মনসা প্রভৃতি বিষয়বস্তু নিয়ে বেদ-বেদেনীর গান বা ঝাপান গান রচিত। সাপুড়ে বাণীচিত্রের জন্য কবি নজরুল কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন। স্মৃতিচারণে রাইচাঁদ বড়াল জানিয়েছেন:
বিদ্যাপতি ও সাপুড়ের চিত্রনাট্য ও সংলাপ কাজীদারই লেখা। সাপুড়ের কাহিনী ও গীতরচনা কাজীদাই করেছিলেন। বলাবাহুল্য, ঐ দুটি ছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব ছিল আমারই উপর ন্যস্ত। বিদ্যাপতি ছবির কীর্তন ও ভক্তিমূলক গানে সুর করতে আমাকে মোটেই মাথা ঘামাতে হয়নি। কিন্তু গোল বাঁধলো সাপুড়ের বেলায়। বেদ-বেদেনীর গলায় গান। আমি ওদের জীবনযাত্রা ও সংগীতের সঙ্গে এতটুকু পরিচিত ছিলাম না। অগত্যা কাজীদাকে আমার সমস্যার কথা জানালাম। … কাজীদা চলে গেলেন। … দিন দশেক পরে কাজীদার আবির্ভাব। ‘পেয়েছি: পেয়ে গেছি’ বলে বিকট চিৎকার করতে করতে কাজীদা এন.টি. ষ্টুডিওতে প্রবেশ করলেন। বললেন “সব সুর তুলে নিয়ে এসেছি। এই নাও, শোনো”। সেই সব সুরই ছিল সাপুড়ে ছবিতে- যা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। (গোস্বামী করুণাময়, ১৯৭৮: ৩০০-৩০১)।
নজরুল রচিত কয়েকটি বেদ-বেদেনীর গান:
১. আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।
ওই পাহাড়ের ঝর্না আমি, ঘরে নাহি রই গো, উধাও হ’য়ে বই \
(নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ২১)
২. সাপুড়িয়া রে
বাজাও বাজাও সাপ- খেলানোর বাঁশি।
(নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ২২)
৩. আয় লো বনের বেদেনী। (আয়- আয় – আয়)
কিংশুকে তটিনীতে জাগায়ে তরঙ্গ কাঁপাইয়া মেদিনী \
(নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ৬৬৪)
৪. বেদিয়া বেদিনী ছুটে আয়, আয়, আয়
ধাতিনা ধাতিনা তিনা ঢোলক মাদল বাজে
বাশিঁতে পরান মাতায় \
(নজরুল সংগীত সমগ্র, ২০০৬: ২১)
‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ গানটি সম্পর্কে শিল্পী কাননবালা দেবী স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন:
মনে মনে ছবি এঁকে নাও নীল আকাশ দিগন্তে ছড়িয়ে আছে। তার কোন সীমা নেই, দুদিকে ছড়ানোই তো ছড়ানোই। পাহাড় যেন নিশ্চিন্ত মনে তারই গায়ে হেলান দিয়ে গুমোচ্ছে। আকাশের উদারতার বুকে এই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোনোটা প্রকাশ করতে হলে সুরের মধ্যেও একটা আয়েম আনতে হবে। তাই একটু ভাটিয়ালির ভাব দিয়েছি। আবার ঐ পাহাড় ফেটে যে ঝর্ণা বেরিয়ে আসছে তার চঞ্চল আনন্দকে কেমন করে ফোটাবে? সেখানে সাদামাটা সুর চলবে না। একটু গিটকিরি তানে ছোঁয়া চাই। তাই বো-ও-ও-ও অই বলে ছুটলো আত্মহারা আনন্দে। এমনি করে তিনি (নজরুল) এই মিলানোর আনন্দ আমাদের হৃদয়েও যেন ছড়িয়ে দিতেন” (দেবী কাননবালা, ১৯৮৪: ৩৭৩-৩৭৪)।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন স্বার্থক সুরস্রস্টা। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কেটেছে সংগীতের জগতে। সংগীতের প্রায় সকল ধারায় তিনি গান রচনা করেছেন এবং সুর সংযোজন করেছেন। পল্লীগীতি, গ্রাম্য সুর, লেটো গান, পালা গান, কবি গান, সাম্পানের গান, সাঁওতালি, লাউনী, কাজরী, মুর্শেদী, মর্সিয়া, ধীবরের গান, ছাদ পেটার গান, চড়কার গান ইত্যাদির পর্যায়ের গানগুলোকেও লোকসংগীতের গানের ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। তবে তাঁর রচিত সকল পর্যায়ের লেখনীতেই লোক ঐতিহ্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পরিশেষে বলা যায়, বিচিত্র সব পর্যায়ের গানে বৈচিত্র্যময় সুর সংযোজন করে তিনি লোকসংগীতানুগ বাংলা গানের ধারায় স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১. মোহাম্মদ আবুল খায়ের, নজরুল সংগীতে নান্দনিকতা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৪
২. ডঃ মিলন দত্ত, নজরুল জীবনচরিত, কলিকাতা, প্রসাদ লাইব্রেরী, প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৬
৩. সন্তোষ ঢালী, নজরুলের কবিতা ও গানে লোকজ উপাদান, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ২০১৯
৪. নজরুল রচনাবলী, ৮ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
৫. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের লোক সংগীত ও ভৌগলিক পরিবেশ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮২
৬. ওয়াকিল আহমেদ, বাংলা লোকসংগীত: ভাটিয়ালি গান, মুখবন্ধ, শামসুজ্জামান খান, ঢাকা: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৯৭)।
৭. ডঃ করুণাময় গোস্বামী, সংগীত কোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫
৮. ডঃ করুণাময় গোস্বামী, নজরুল সংগীত প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৮
৯. আসাদুল হক সম্পাদিত, কাজীদার কথা- আব্বাস উদ্দীন আহমেদ, সুধীজনের দৃষ্টিতে নজরুল, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৯
১০. কাননবালা দেবী, কবি প্রনাম, সুফী জুলফিকার হায়দার সম্পাদিত, নজরুল প্রতিভা পরিচয়, সুফী জুলফিকার হায়দার ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৪
১১. মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম, নানা প্রসঙ্গে নজরুল, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ২০২০
১২. ইসরাফিল শাহীন সম্পাদিত, পরিবেশনা শিল্পকলা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭
১৩. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্, নজরুলের কাব্য ও সঙ্গীত, ধ্রপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ২০১২
১৪. সেলিম জাহাঙ্গীর, লোকায়ত নজরুল, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ১৯৯৭
১৫. রশিদুন্ নবী সম্পাদিত, নজরুল সঙ্গীত সমগ্র, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ২০০৬