Folk Life and Folk Culture of Murshidabad: Alkap, Bolan, and Associated Folk Traditions
Nazmul Hoque, Assistant Professor, Department of Music, Udaynarayanpur Madhabilata Mahavidyalaya
Abstract
The folk life and folk culture of Murshidabad occupy a significant position in the broader tradition of Bengali folk heritage. Shaped by a river-based geography, agrarian economy, historical Nawabi legacy, and long-standing religious coexistence, the region has developed a rich and diverse folk culture. This research-oriented paper examines the socio-cultural, historical, and anthropological background of Murshidabad’s folk life, with particular focus on the folk performance traditions of Alkap and Bolan. Alkap, a folk theatrical form, employs humour, satire, and parody to reflect social realities, power structures, and resistance against exploitation. Its carnivalesque nature, as conceptualized by Mikhail Bakhtin, allows marginalized communities to question authority and social hierarchies through performance. In contrast, Bolan songs are primarily associated with the Gajan festival of Lord Shiva and represent a synthesis of devotion, ritual, and communal participation rooted in the agrarian life cycle. The paper also contextualizes Alkap and Bolan within the wider spectrum of Murshidabad’s folk traditions, including Bharbol songs, Manasa Mangal pala, Kavigan, Muslim wedding songs, Ramayani pala, and Baul–Fakiri music. These traditions collectively demonstrate a unique cultural syncretism shaped by Hindu, Muslim, Buddhist, and other religious influences. In the contemporary context, rapid urbanization, changing economic structures, and the influence of mass media have led to the gradual decline of these folk forms, placing artists in conditions of economic and cultural uncertainty. The study emphasizes that preserving folk culture is not merely an act of safeguarding the past, but a vital process in sustaining cultural identity and social harmony for future generations. Institutional support, documentation, and scholarly engagement are therefore essential for the survival of Alkap, Bolan, and related folk traditions of Murshidabad.
Key Words
Murshidabad, Folk Life, Folk Culture, Alkap, Bolan Songs, Folk Theatre, Cultural Syncretism, Agrarian Society, Oral Tradition, Folk Performance
মুর্শিদাবাদের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি : আলকাপ, বোলান ও সংশ্লিষ্ট লোকরীতি
লোকসংস্কৃতি একটি সমাজের সামষ্টিক অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, আচার ও নান্দনিক চেতনার স্বাভাবিক প্রকাশ। বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারায় মুর্শিদাবাদ জেলা একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ঐতিহাসিকভাবে নবাবি রাজধানী হলেও মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ সমাজে গড়ে ওঠা লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। আলকাপ, বোলান, গাজনের গান, ঝুমুর ও পালাগানের মতো লোকরীতিগুলি এই অঞ্চলের মানুষের জীবনদর্শন ও সামাজিক মনস্তত্ত্বকে প্রকাশ করে (Sen 14)[1]।
এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে মুর্শিদাবাদের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে আলকাপ ও বোলান গানকে কেন্দ্র করে তাদের উদ্ভব, রূপ, সামাজিক ভূমিকা, সংগীতধারা ও সমকালীন সংকট বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
মুর্শিদাবাদ গঙ্গা, ভাগীরথী ও জলাঙ্গী নদীবেষ্টিত একটি উর্বর অঞ্চল। এই নদীকেন্দ্রিক ভূপ্রকৃতি কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে। গ্রামীণ সমাজে যৌথ পরিবার, কৃষিকাজ, হাট-বাজার ও ধর্মীয় উৎসব লোকজীবনের মূল উপাদান। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থান এই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিকে বহুমাত্রিক রূপ দিয়েছে।
লোকসংস্কৃতি এখানে ধর্মীয় উৎসব, ঋতুচক্র ও জীবিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যেমন—চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, শিবরাত্রি কিংবা ফসল কাটার সময় লোকগান ও লোকনাট্যের চর্চা বৃদ্ধি পায় (Chakraborty 52)[2]। ফলে লোকসংস্কৃতি মুর্শিদাবাদের সমাজজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
মুর্শিদাবাদ জেলার বিশাল ভৌগোলিক পরিসর এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক ভিত্তি, লোকজীবনের প্রধান নিয়ন্ত্রক। এই অঞ্চলটি প্রাচীন গৌড়বঙ্গের অংশ ছিল, যেখানে পাল (৮ম-১২শ শতক), সেন (১২শ শতক) এবং তারও পূর্বে গুপ্ত বংশের প্রভাব ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত এবং ১৭০৪ সালে মুর্শিদ কুলি খান কর্তৃক ঢাকা থেকে মাকসুদাবাদে (যা পরে মুর্শিদাবাদ নাম ধারণ করে) রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়া এই অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারাকে স্থায়ী রূপ দেয়।
গুপ্ত ও সেন বংশের হিন্দু রাজাদের পর এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল বৌদ্ধ ও হিন্দু ঐতিহ্যের সহাবস্থান ছিল (যেমন পাল আমলে)। ১৩শ শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম শাসন এই অঞ্চলে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ধারা যুক্ত করে। তবে, নবাবী আমলে (১৭০৪-১৭৫৭) মুর্শিদাবাদ কেবল রাজনৈতিক রাজধানীই ছিল না, বরং শিল্প-বাণিজ্য (বিশেষত রেশম শিল্প বা Sericulture) ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
রাঢ় (পশ্চিমাঞ্চল, ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ) এবং বাগড়ি (পূর্বাঞ্চল, ভাগীরথীর পূর্বে অবস্থিত উর্বর পলিমাটি) এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা, কৃষিব্যবস্থা ও আঞ্চলিক লোক-উচ্চারণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। ভাষাবিদরা বলেন, তিন ক্রোশ অন্তর অন্তর ভাষা বা মানুষের বলা সংলাপ পাল্টে পাল্টে যায়।
রাঢ় অঞ্চলের শুষ্ক, লাল মাটি এবং বাগড়ি অঞ্চলের নরম, পলিমাটির বৈশিষ্ট্য সেখানকার পানীয় জলের ব্যবস্থা, সেচ কৌশল এবং ফসল উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনেছে, যা আঞ্চলিক প্রবাদ ও লোক-রীতির জন্ম দিয়েছে।
মুর্শিদাবাদে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব, জৈন — বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের এক অভূতপূর্ব মিলনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। এই ধর্মগত উদারতা ও সহাবস্থানকে নৃ-তাত্ত্বিক পরম্পরায় এক ‘মিশ্রিত ধারার পীঠস্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে লোকনাট্য ও লোকসঙ্গীতের অঙ্গনে। মন্দির, মসজিদ ও গির্জার সহ-অবস্থান এই জেলার সামাজিক সৌন্দর্যের প্রতীক।
লোকসংস্কৃতি বলতে সাধারণ মানুষের দ্বারা সৃষ্ট, প্রজন্মান্তরে মৌখিকভাবে পরিবাহিত সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে গান, নৃত্য, নাট্য, আচার ও বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত। সুকুমার সেনের মতে, লোকসংস্কৃতি হল “শাস্ত্রীয় বিধি-বিধানের বাইরে সাধারণ মানুষের জীবনচর্চার শিল্পরূপ” (Sen 22)[3]।
লোকসংস্কৃতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বাখতিনের carnivalesque ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। লোকনাট্যে ব্যঙ্গ, উলটপুরাণ ও সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ভাঙার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় (Bakhtin 88)[4]। আলকাপের মতো লোকরীতিতে এই তত্ত্ব কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
আলকাপ মূলত মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও রাজশাহী অঞ্চলে প্রচলিত একটি লোকনাট্যধর্মী শিল্পরূপ। এর উৎপত্তি উনিশ শতকের শেষভাগে বলে অনুমান করা হয়। আলকাপের নামকরণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকের মতে ‘আল’ (কৌতুক) ও ‘কপ’ (ভঙ্গি) শব্দের সংমিশ্রণ থেকেই আলকাপ শব্দের উৎপত্তি (Mukhopadhyay 121)[5]।
প্রথমদিকে আলকাপ ছিল গ্রামীণ বিনোদনের মাধ্যম, পরে তা সামাজিক মন্তব্য ও সমালোচনার রূপ নেয়। জমিদারি ব্যবস্থা, পারিবারিক সম্পর্ক, নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব—এসব বিষয় আলকাপের কাহিনিতে স্থান পায়।
মুর্শিদাবাদের লোকনাট্য ও লোকসঙ্গীতগুলি কেবল মনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়, এগুলি সমাজের প্রতিবাদের স্বর এবং জনশিক্ষার বাহক।
আলকাপ একটি সম্পূর্ণ সামাজিক লোকনাট্য। এটি মুসলমান, তপশিলি জাতি (যেমন: চাঁই, বাউরি, বাগদি, হাঁড়ি) সহ নিম্নবর্গের মানুষের ঐক্য ও সম্প্রীতির মঞ্চ হিসেবে কাজ করত।
ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক প্রমাণ: প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাস “মায়ামৃদঙ্গ”-এ বিলুপ্তপ্রায় আলকাপ লোকনাট্যের এক মূল্যবান চিত্র পাওয়া যায়। সিরাজ আলকাপকে “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাবাহক” এবং গ্রামীণ নিরক্ষর ও শ্রমজীবী মানুষের মনোরঞ্জন ও মনোবিকাশের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
রূপক ও প্রতিবাদ: আলকাপের রাজা বা জমিদারের বেশে হতদরিদ্র শিল্পীরা আসলে সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-রসাত্মক ভঙ্গিতে প্রতিবাদ জানাত। সুদখোর মহাজন, জাত-ধর্মের ভেদাভেদ, কালোবাজারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি—এই ধরনের সামাজিক অসঙ্গতিগুলিই ছিল আলকাপের ‘কাপ’-এর (নাটকের অংশ) মূল উপজীব্য।
আলকাপ একটি দলগত শিল্প। দলের প্রধানকে ‘সরকার’ বলা হয়। তাঁর নেতৃত্বে গায়ক, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেতারা অংশগ্রহণ করেন। কিশোর ছেলেরা নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে, যা লোকনাট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
আলকাপের পরিবেশনা সাধারণত তিনটি স্তরে বিভক্ত—গান, সংলাপ ও নৃত্য। হাস্যরস ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করা হলেও এর অন্তর্নিহিত বার্তা গভীর সামাজিক তাৎপর্য বহন করে (Chakraborty 97)[6]।
আলকাপ গ্রামীণ সমাজে এক ধরনের সামাজিক আয়নার ভূমিকা পালন করে। সামাজিক অবিচার, ক্ষমতার অপব্যবহার ও নৈতিক অবক্ষয়কে কৌতুকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়।
বাখতিনের মতে, লোকনাট্যে হাস্যরস সামাজিক নিয়মকে প্রশ্ন করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম (Bakhtin 90)[7]। আলকাপেও এই প্রবণতা স্পষ্ট। ফলে এটি কেবল বিনোদন নয়, বরং এক ধরনের লোকপ্রতিবাদ।
বোলান গান মূলত শিবের গাজন উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। চৈত্র মাসে বোলান দলের সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান পরিবেশন করে। এই গানে শিবের লীলা, ভক্তি ও লোককাহিনি একত্রে প্রকাশ পায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতে, বোলান গান ভক্তি ও লোকনাট্যের সংমিশ্রণ (Mukhopadhyay 203)। মুর্শিদাবাদে বোলান গান ধর্মীয় আচারকে সামাজিক উৎসবে রূপান্তরিত করে।
বোলান গানকে আপনি কৃষি-নির্ভর লোকনাট্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এর মূল ভিত্তি হল চৈত্র মাসে শিবের গাজন বা চড়ক উৎসব উপলক্ষে শিবের বন্দনা এবং তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার। বোলান গান প্রধানত রাঢ়ভূমি (মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদীয়া) অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি সাধারণত শিবের গাজন উপলক্ষ্যে পরিবেশিত হয়। বোলান গানের পালায় পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক ও সমসাময়িক বিষয়ও উঠে আসে। এটি গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে পরিবেশিত হতো (বুলান বা ঘুরে বেড়ানো থেকে ‘বোলান’ নামটির উৎপত্তি হতে পারে), যার মাধ্যমে এক ধরনের লোকশিক্ষা চালু থাকত।
বোলান গানে ঢোল, কাঁসি ও বাঁশির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গানের সুর সহজ, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং শ্রোতাদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে।এই গানে ধর্মীয় ভাবের পাশাপাশি সামাজিক সংহতির বোধ প্রকাশ পায়। গ্রামের মানুষ দলবদ্ধভাবে এই গানে অংশ নেয়, যা সামাজিক ঐক্যকে সুদৃঢ় করে (Sen 91)।
আলকাপ ও বোলান—উভয়ই লোকনাট্যধর্মী হলেও তাদের উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আলকাপ বেশি সামাজিক ও ব্যঙ্গাত্মক, আর বোলান প্রধানত ধর্মীয় ও আচারনির্ভর।
তবে উভয় ক্ষেত্রেই মৌখিক ঐতিহ্য, দলগত পরিবেশনা ও লোকভাষার ব্যবহার সাধারণ বৈশিষ্ট্য (Chakraborty 156)।
ভারবোল গীতি ঘোষ সম্প্রদায়ের গোষ্ঠজীবন ও পশুপালন-নির্ভর সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। পুষালু পরবে চাল-ডাল সংগ্রহের প্রথাটি গোষ্ঠীগত সামাজিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতার ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে। এটি প্রমাণ করে যে, লোকগীতি শুধুমাত্র উৎসবের গান ছিল না, বরং সমাজের দুর্বল অংশের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রতিফলন ছিল।
মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে আলকাপ, বোলান, ও ভারবোল গীতি ছাড়াও আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকধারা প্রচলিত ছিল: মনসা মঙ্গল পালা, যা ‘বিষ হরি পালা’ নামেও পরিচিত, প্রধানত সর্পদেবী মনসার পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচার করে। নদীমাতৃক ও জলাভূমি-প্রধান মুর্শিদাবাদে সাপের উপদ্রব ছিল স্বাভাবিক, তাই এই পালায় দেবীর করুণা ও বিষ-হরণের ক্ষমতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনসা পূজা ও পালা পরিবেশনের প্রথা এই অঞ্চলের কৃষিজীবী ও নদী-নির্ভর সমাজের লোকবিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে।
কবি গান হলো মূলত দুটি ‘কবিয়াল’ দলের মধ্যে সঙ্গীত-ভিত্তিক তাৎক্ষণিক বাচ্যিক ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিযোগিতা। এটি একদিকে যেমন সাহিত্য ও সঙ্গীতের মিলন, তেমনি এটি গ্রামীণ লোকশিক্ষারও মাধ্যম। এই গানগুলিতে সামাজিক কৌতুক ও গভীর তত্ত্বকথার সংমিশ্রণ দেখা যায়।
মুসলিম সমাজে বিয়ে ‘শাদী’ নামে পরিচিত, এবং ‘মোহর’ প্রদানের মাধ্যমে পাত্রপক্ষ কন্যা গ্রহণ করেন। ‘মুসলিম বিয়ের গীত’ মুর্শিদাবাদের লোকায়ত ধারায় আবহমান কাল ধরে বহমান এক গুরুত্বপূর্ণ লোকধারা। মূলত এটি ছিল অন্দরমহলের প্রথা, যেখানে কেবল মহিলারাই দর্শক-শ্রোতা ও পরিবেশক হতেন।
পরবর্তীকালে, মুসলমান মৌলবাদীদের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে কান্দির বাসিন্দা মহিমা খাতুন-এর উদ্যোগে এটি মঞ্চের গান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিবাহের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক পর্বকে কেন্দ্র করে গানগুলি রচিত হয়—যেমন গায়ে হলুদ মাখানোর গান, বরযাত্রীদের স্বাগত জানানোর গান, জামাই-এর হাত ধোঁয়ার গান, ও কন্যা বিদায়ের গান। সাত-আটজনের একটি দল ঢোলক ও হাতে রুমাল বেঁধে নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে এই গান পরিবেশন করে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, মঞ্চে পরিবেশিত বন্দনা গানে এই শিল্পীরা বিভিন্ন দেবদেবীর উল্লেখ করেন, যা মুর্শিদাবাদের লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে সামগ্রিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।
রামায়নী গান বলতে মুর্শিদাবাদে প্রচলিত রামায়ণের পালা গানকে বোঝায়। এটি প্রধানত রামায়ণ কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গীত হয় এবং গ্রামীণ সমাজের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক। এই গান ও পালাগুলির মধ্যে দিয়ে পৌরাণিক কাহিনীগুলি আঞ্চলিক লোক-সুর ও ঢঙে পরিবেশিত হয়, যা শ্রোতাদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বাউল ও ফকিরি গান। এই গানগুলি আধ্যাত্মিক সাধনা ও দেহতত্ত্বের গভীর দর্শনের প্রকাশ। এই গানের শিল্পীদের সম্প্রদায়গত পরিচিতি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা যায়:
ডক্টর সুধীর চক্রবর্তী এই দুটি শব্দকে সম্প্রদায়গতভাবে ব্যবহার করে বাউল (হিন্দু) এবং ফকির (মুসলিম) এই দুই সম্প্রদায়ের পৃথকীকরণকে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, ডক্টর শক্তিনাথ দা সম্প্রদায়গত এই পৃথকীকরণ মানতে নারাজ। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই গানের মাধ্যমে সাধারণত শরিয়ত (ধর্মীয় আচার ও বাহ্যিক নিয়ম) এবং মারিফত (আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ভেতরের পথ) নামক দুটি পন্থী বা ধারার চর্চা দেখা যায়, যা এই ফকিরি গানের মূল দর্শনকে সমৃদ্ধ করে। সাধক লালন ফকির এবং লালনোত্তর মহাজনি মানুষরা এই ধারাকে বহমান রেখেছে যেখানে তারা মানুষ তত্ত্বের দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
আধুনিক গণমাধ্যম, শহরমুখী জীবন ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে লোকসংস্কৃতির চর্চা হ্রাস পাচ্ছে। আলকাপ ও বোলানের শিল্পীরা পেশাগত অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছেন। গবেষকেরা মনে করেন, লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও নথিভুক্তকরণ জরুরি (Sen 134)[8]।
লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ মানে কেবল অতীত রক্ষা নয়, বরং ভবিষ্যতের সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণ। বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে আলকাপ ও বোলানের মতো শিল্পরীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব (Mukhopadhyay 278)[9]। মুর্শিদাবাদের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির মধ্যে আলকাপ ও বোলান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এগুলি গ্রামীণ মানুষের জীবন, বিশ্বাস ও প্রতিবাদের ভাষা। গবেষণার মাধ্যমে এই লোকরীতিগুলিকে বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণ করা আজ একান্ত প্রয়োজন।
লোকসংস্কৃতির এত সম্ভার এবং বৈচিত্র্য থাকার কারণেই মুর্শিদাবাদ জেলা সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই সমস্ত ধারার শিল্পীরা যে বার্তা দেয় তা মূলত হল সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা। এই মাটিতেই জন্ম আমার। এই জেলার পবিত্র আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে তা বহন করে চলেছে আমি আমার গান –
আমি ঈদ গাহায় নামাজ পড়ি
দুর্গাপূজায় সাজি
আর খ্রিস্ট মাসের বড়দিনে
চার্চে যেতেও রাজি
সকল জাতির ভাইকে আমার
স্বজন বলেই জানি
গীতা বাইবেল বেদ কোরআন
পুণ্য প্রেমের বাণী…..
References:
[1] Sen, Sukumar. Banglar Sanskriti O Lokparampara. Mitra & Ghosh, 2002, pp. 14–165.
[2] Chakraborty, Dulal. Banglar Loksanskriti. Ananda Publishers, 2010, pp. 52–215.
[3] Sen, Sukumar. Banglar Sanskriti O Lokparampara. Mitra & Ghosh, 2002, pp.22
[4] Bakhtin, Mikhail. Rabelais and His World. Indiana UP, 1984, pp.88
[5] Bakhtin, Mikhail. Rabelais and His World. Indiana UP, 1984, pp.121.
[6] Chakraborty, Dulal. Banglar Loksanskriti. Ananda Publishers, 2010, pp.97.
[7] Bakhtin, Mikhail. Rabelais and His World. Indiana UP, 1984, pp 90.
[8] [8] Sen, Sukumar. Banglar Sanskriti O Lokparampara. Mitra & Ghosh, 2002, pp.134.
[9] Mukhopadhyay, Ashutosh. Banglar Lokonatya O Lokgeeti. Sahitya Akademi, 2005, pp. 278