Contributions of Lyricists Beyond Rabindranath During the Bengal Partition Movement
Dr. Nandita Basu Sarbadhikari
Assistant Professor, Department of Rabindra Sangeet, Dance and Drama, Sangeet Bhavan, Visva Bharati, Santiniketan
Abstract:
The Bengal Separation Movement (1905) marked a critical juncture in India’s socio-political history, not only mobilizing people but also igniting a cultural renaissance that would influence the collective consciousness of Bengal. Beyond the towering figure of Rabindranath Tagore, several lyricists contributed significantly to this movement, shaping the emotional and cultural identity of the people through their lyrics. These lyricists employed poetic language and folk idioms to express resistance against British imperialism, convey nationalist sentiments, and inspire unity among Bengalis across diverse social strata. This paper explores the contributions of lesser-known but impactful lyricists who crafted songs that became anthems of resilience and identity during this period. By examining their works, themes, and influences, this study highlights the role of these lyricists in cultivating a cultural and emotional foundation that supported and sustained the resistance movement against the Bengal Partition.
Keywords:
Bengal Separation Movement, Bengal Partition, lyricists, nationalist poetry, cultural renaissance, resistance songs, colonial India, Bengali identity, folk songs, anti-colonial movement.
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ব্যতিরেকে অন্যান্য গীতিকারদের অবদান
নন্দিতা বসু সর্বাধিকারী
সহকারী অধ্যাপক, রবীন্দ্রসংগীত, নৃত্য ও নাটক বিভাগ
সংগীতভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন
কোনও পরাধীন জাতির আত্মচেতনা যখন উদ্বুদ্ধ হয়, তখন জাতীয় জীবনের নানা দিক দিয়ে তার প্রকাশ ফুটে ওঠে। বাংলার তথা ভারতের এই নতুন জীবনের অভ্যুদয় ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে, প্রধানত ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। আজ ভারতবর্ষ যে স্বাধীনতালাভ করেছে, তার প্রস্তুতিপর্ব চলেছিল সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম চল্লিশ বছর ধরে। বাংলার সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশবাসীর মনে স্বাজাত্যবোধের চেতনা জেগে উঠতে থাকে। প্রবল বলশালী বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ, স্বদেশভূমিকে শৃঙ্খলামুক্ত করার একটা অভিলাষ, মাতৃভাষার জন্য একটা বিশেষ গভীর অনুরাগ প্রতিফলিত হতে থাকে তৎকালীন বাঙালীর মননে এবং তার প্রতিফলন ঘটে বাংলা গানে।
বাংলার মুক্তির গানকে মোটামুটি তিনটি পর্বে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্বে প্রধানত হিন্দুমেলাকে কেন্দ্র করে রচিত, দ্বিতীয়টি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলাকালীন ও তৃতীয়টি তার পর থেকে ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা-অর্জন পর্যন্ত। ভাষা ও সুরের গঠন-ভঙ্গিমায় তিনটি পর্যায়ের গানে যথেষ্ট তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় হিন্দুমেলার থেকে। এর পূর্বে সংগীতে জাতীয়তার ভাবধারার তেমন লক্ষ্য করা যায়নি, অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর নিধুবাবু অর্থাৎ রামনিধি গুপ্তের ‘নানান দেশে নানান ভাষা / বিনে স্বদেশীয় ভাষা পূরে কি আশা’ গানখানিতে মাতৃভাষার প্রতি গভীর আকর্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দ কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘ভারতসংগীত’ যার সুরারোপ করেন কৃষ্ণধন বান্দ্যাপাধ্যায়, সেটিকে বাংলায় প্রথম দেশাত্মবোধক গান বলে গণ্য করা যায়। এর পর থেকে বাংলায় বহু কবি ও গীতিকার তাঁদের দেশাত্মবোধক গানগুলিতে তাঁদের স্বদেশপ্রেম ফুটিয়ে তুলেছেন। হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতির জাগরণ এবং স্বদেশী সংগীতচর্চার মাধ্যমে ভারতচিন্তার বিকাশ। পরাধীনতার বেদনা ও গ্লানি যেভাবে দেশবাসীকে পীড়িত করেছিল— তারই প্রকাশ ঘটেছে এইসব গানে। শুধু কাব্য হিসেবে এর মূল্য বিচার করলে হবে না, এইসব সংগীত ছিল স্বদেশীযুগের মন্ত্র, সংগ্রামের হাতিয়ার। এইসব গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে কত নবীনপ্রাণ যে আত্মবলি দিতে অনুপ্রেরণা পেয়েছে তা বলা নিষ্প্রয়োজন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্বে যে-সব জাতীয়তামূলক সংগীত উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে কয়েকটি হল—
গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত— ‘লজ্জায় ভারতযশ গাহিব কী করে
লুটিতেছে পরে এই রত্নের আকরে’
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত— ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত— ‘মিলে সবে ভারত-সন্তান’
মনমোহন বসু রচিত— ‘কোথায় মা ভিক্টোরিয়া দেখ আসিয়া
(বাউল সুরে শ্লেষাত্মক গান) ইণ্ডিয়া তোর চলছে কেমন।‘
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত— ‘না জাগিলে সব ভারত ললনা’
আনন্দচন্দ্র মিত্র রচিত— ‘কোথায় রহিলে ভারতভূষণ’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত— ‘বন্দে মাতরম্ সুজলাং সুফলাং শস্যশ্যামলাং’
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত— ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়’
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত— ‘বাজ রে শিঙা বাজ’
এছাড়াও বহুসংখ্যক স্বদেশী সংগীতের সন্ধান মেলে। অর্থাৎ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে দেশাত্মবোধক গান লেখার একটা প্রেরণা স্বাভাবিকভাবেই দেশের কবিদের মধ্যে বেশ কিছুকাল ধরেই স্বতোৎসারিত ছিল। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার পর বাংলা সংগীতজগতে এক নতুন পর্বের অভ্যুদয় হয়। যে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল জনমানসে, তা যেন একটি স্ফুলিঙ্গের আঘাত সারা বাংলায় দাবানলের মত জ্বলে উঠল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শীর্ষে দেশবরেণ্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বাংলার মহান কবিরা যার অগ্রণী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, মুকুন্দ দাস প্রমুখ।
এই লেখায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত অন্যান্য রচয়িতাদের ভূমিকা— এই বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার প্রয়াস করা হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর্যায়ের গানগুলিতে আত্মশক্তি বিকাশের উজ্জ্বলরূপ অভূতপূর্বভাবে প্রতিভাত হয়। দেশবন্দনার এত বিচিত্র প্রকাশ এর পূর্ববর্তী রচনায় পাওয়া যায় না। কখনও বাংলা মায়ের শ্যামল কোমল মূর্তি বর্ণিত, কোথাও বাংলাবিভাজন রদ করার দৃপ্ত প্রতিজ্ঞা, আবার কোনওখানে অত্যাচারী শাসককুলকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার নির্ভীক হুঁশিয়ারী ধ্বনিত হয়েছে।
হিন্দুমেলাকে কেন্দ্র করে যেসব গান রচিত, সেগুলিতে ভারতচিন্তারই বেশি প্রাধ্যান্য, কিন্তু বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের সময় ভারতমাতা ছাড়াও বঙ্গজননীকে অবলম্বন করে বহুগান রচিত হয়। তখনকার দিনে বলা হত ‘What Bengal thinks today India thinks tomorrow’। বাংলাদেশই যেন সারা ভারতের নেতৃত্ব দান করত এবং কলকাতাই ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র।
পূর্বকালের গানের ভারী যুক্তাক্ষরযুক্ত শব্দের ব্যবহারের পরিবর্তে এই পর্বে সহজ কথা, সহজ ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায় যা সহজেই সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
এছাড়া সুরের দিক থেকে লক্ষ্য করা যায় যে পূর্বে ভারী রাগ এবং বিলম্বিত লয়ে অধিকাংশ গান রচনা হত। পরবর্তীযুগে আর রাগসংগীত প্রধান বৈশিষ্ট্য থাকল না। পরিবর্তে এল নিজস্ব লোকসংগীতের রীতি অবলম্বন করে সুরসংযোজনার আগ্রহ। এবিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অগ্রণী ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল এবং আরও কারও কারও গানে অবশ্য পাশ্চাত্য রীতির প্রত্যক্ষ প্রয়োগ বিশেষ লক্ষণীয়। দেশী-বিদেশী সর্বপ্রকার সংগীতের বৈশিষ্ট্যই গ্রহণ করা হয়েছে দেশপ্রেমের আবেদনকে মূর্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে। হিন্দুমেলা উপলক্ষে রচিত তদানীন্তন স্বদেশীগানে ভারতীয় বলতে আর্যদের গৌরবগাথাই বহুলভাবে স্মরণ করা হয়েছে। কিন্তু পরের যুগে পরিমার্জনার ফলে ফুটে উঠেছে মুক্তির প্রস্তুতি, চ্যালেঞ্জ, প্রতিরোধের মনোভাব, হীনমন্যতা পরিহার, সাম্প্রদায়িক ঐক্য। তাই এযুগের গানে বিদেশী সুর ও ছন্দের প্রয়োগ মার্চের ঢঙ এবং উদ্দীপনার ভাব অধিক পরিমাণে অনুভূত হয়। সম্মেলক গীতিগুলির বলিষ্ঠভাব সারা দেশে উন্মাদনা সঞ্চার করে। রাজনীতি ও সমাজনীতির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে গান গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে ও সমগ্র দেশবাসীর প্রতিটি স্তরে জাতীয় ঐক্য জাগ্রত করে তোলে। এই প্রসঙ্গে নীহারবিন্দু সেনের লেখা একটি অংশ উদ্ধৃত করছি, “স্কুল ছেড়ে খদ্দর ফেরি করতে গ্রামেগঞ্জে চরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই, কোথায় রাত কাটাই তাও বেঠিকানা। তবু আমরা কজন কিশোর হইহই করে খদ্দর ফেরি করি,স্বদেশিগান গাই, দেশের কথা বলি। সেদিনের গ্রামগঞ্জের মানুষরা আমাদের এই যাযাবর বৃত্তিটিকে স্নেহের চোখেই দেখেছিল। তাই কোথাও না কোথাও খাদ্য, আশ্রয় জুটে যেত। তাঁরা রাত্রে গান শুনতে চাইতেন। আমরা সেখানে ব্রহ্মসংগীত বা কাব্যগীতি কদাচ গাইনি, গাইতাম যাত্রার গান আর স্বদেশী গান।”
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বিধৃত ‘বন্দেমাতরম্’ মাতৃবন্দনাটিতে সুর-সংযোজনা করে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজমন্ত্ররূপে গৃহীত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের দেওয়া সুর ছাড়াও দেশ, কাওয়ালিতে রবীন্দ্রনাথ ও সরলাদেবীর দেওয়া সুরই বেশি প্রচলিত ছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই গানের জনপ্রিয়তা শিখরস্পর্শী হয়ে ওঠে— নীহারবিন্দু সেন বলেছেন, “একটি গান আমরা গর্বে সুখে গাইতাম— ‘বন্দে মাতরম্।‘ সরলাদেবী-রবীন্দ্রনাথের সুর আমাদের জানা ছিল না। আমরা গাইতাম খাম্বাজ আশ্রিত সুরে ঝাঁপতাল ছন্দে বরিশাল থেকে পাওয়া বন্দে মাতরম্ গান। কথার সঙ্গে সুরের সামঞ্জস্য না থাকলেও আমরা জানতাম কিশোর চিত্তরঞ্জন পুলিশের মার খেয়েও এই সুরে গান গেয়েছিল। এই সুর হল শাসনকে তুচ্ছ করার সুর।…
কত অন্ধকার রাত্রে রেড়ির তেলের পিদিমের আলোয় বা পাটকাঠির আগুনের আভা মুখে নিয়ে কোনো এক ঘরের দাওয়ায় আমরা গলা ছেড়ে গেয়ে চলেছি, ‘বন্দে মাতরম’ সেই সুর ধানক্ষেত, পাটক্ষেত পার হয়ে সুপুরি নারকেল গাছের পাতা ছুঁয়ে কাশবনে শিরশিরি জাগিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক থামিয়ে দিত।”
স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বরিশাল শহর ছিল পীঠস্থান। সেখানকার দেশনেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের কর্মতৎপরতা ও দেশের লোকের মনে স্বদেশীভাব জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁরই আহ্বানে বরিশালে জাতীয় মহাসভার প্রাদেশিক সম্মিলনীর বিরাট আয়োজন হয় ১৯০৬ সালে ১লা ও ২রা বৈশাখ। বাংলার সমস্ত অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিরা সমবেত হন ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, যেমন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, রাজনারায়ণ বসু, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ প্রমুখ। যে মণ্ডপে প্রাদেশিক সমিতি বসার কথা সেই মণ্ডপেই ৩ বৈশাখ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের আয়োজন করা হয় এবং রবীন্দ্রনাথ সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করবেন এমন স্থির ছিল। উৎসাহ উদ্দীপনার সীমা ছিল না বরিশালে। হঠাৎ ছোটলাট ফুলার-এর নির্দেশে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি ও গান নিষিদ্ধ বলে জারি করা হয়। সে আদেশ অমান্য করে সমবেত কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি তোলা হয়। সেদিন পুলিশ জনতার উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। কেউ কেউ সেই প্রহার সহ্য করতে না পেরে পুকুরে ঝাঁপ দেন, তবু মুখে ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি সোচ্চার ছিল। যখন সুরেন ব্যানার্জীকে গ্রেপ্তার করে ঘোড়ার গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন গাড়ির পিছনে কালীপ্রসন্ন স্বরচিত গান গাইতে গাইতে চললেন— “মাগো, যায় যেন জীবন চলে / জগৎ-মাঝে তোমার কাজে বন্দে মাতরম্ বলে।” পুলিশের অত্যাচার থেকে তিনিও নিষ্কৃতি পাননি। প্রাদেশিক সমিতি ভেঙে যাওয়ায় সাহিত্য সম্মিলনের পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বরিশালবাসীরা ক্ষুণ্নমনে ও ভগ্নহৃদয়ে সমবেত প্রতিনিধিদের বিদায় দিতে বাধ্য হন।
আবার ১৯০৬ সালে কাশীর কংগ্রেস অধিবেশনে গোখলের সভাপতিত্বে, সরলাদেবীর মুখে শ্রোতারা ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি সম্পূর্ণ শুনতে চান এবং সরলাদেবী তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেন।
স্বদেশী যুগে অজস্র গীতিকারদের রচনায় ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দটির ব্যবহার হতে দেখা গেল। যেমন—
রবীন্দ্রনাথের— “একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন
এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন, বন্দে মাতরম্”
রজনীকান্ত লিখেছেন— ‘বন্দে মাতরম্’ তো শুধু মায়ের বন্দনাই
এতে তো ভাই সিডিশানের গন্ধ নাই।”
কালীপ্রসন্নর গানে পাই— “আজ বরিশাল পুণ্যে বিশাল হল লাঠির ঘায়
ঐ যে মারের ভয়ে গেয়ে যায় ‘বন্দে মাতরম’ বলে”।
চারণকবি মুকুন্দ দাসের রচনা— “বন্দে মাতরম্ মন্ত্র কানে / বর্ম এঁটে দেহে মনে
রোধিতে কি পারবে রণে । তুমি কত শক্তিময়।”
অথবা
‘‘‘বন্দে মাতরম্’ বলে নাচ রে সকলে
কৃপাণ লইয়া হাতে।”
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যান্য গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন— দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমৃতলাল বসু, রজনীকান্ত সেন, প্রমথনাথ চৌধুরী, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস, মনমোহন চক্রবর্তী, অতুলপ্রসাদ সেন, কামিনীকুমার ভট্টাচার্য, মহিলাদের মধ্যে সরলা দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, কামিনী রায় আরও বহু খ্যাত অখ্যাত গীতিকার। শতগান, কাকলি, প্রকাশিকা, গীতসূত্রকার প্রভৃতি গ্রন্থে এঁদের গান প্রকাশিত হত।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন চলছে তখন সরলাদেবী শারদীয়া পূজাকে ভিত্তি করে ‘বীরাষ্টমী’ উৎসব প্রবর্তন করেন। এই অনুষ্ঠানে লাঠিখেলা, ছোরা খেলা, কুচকাওয়াজ প্রভৃতি martial art অঙ্গ ছিল যার উদ্দেশ্য ছিল ছেলেমেয়েদের মনে সাহস সঞ্চার করা ও চিত্তকে শৌর্যবীর্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত করা। এই উপলক্ষে রচিত সরলাদেবীর গান ‘অতীত গৌরব বাহিনী’ অথবা ‘বন্দি তোমায় ভারত জননী / বিদ্যা মুকুটধারিণী উল্লেখ্য।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক গান ও নাটক জাতির মনে তীব্র আলোড়ন তোলে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল—
‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’
‘ভারত আমার ভারত আমার’
‘বঙ্গ আমার জননী আমার’
‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে’ ও আরও বহু উদাহরণ।
তাঁর গানে ভারত ও বঙ্গদেশ সমান গুরুত্বলাভ করেছে। তাঁর গানের শিকড় দেশের মাটিতেই প্রোথিত হলেও সুর সংযোজনার ক্ষেত্রে দিশী পদ্ধতির প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে তিনি জাতীয়তার আবেগকে শক্তিদান করবার উপযুক্ত সুরারোপ করেন, এবং এর প্রভাব অপরিসীম।
কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের যেসব স্বদেশী গান সে যুগে বাংলায় উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল সেগুলি হ’ল–
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’
‘তাই ভালো মোদের মায়ের ঘরের ভাত’
‘ফুলার কল্লে হুকুম জারি’
‘আয় ছুটে ভাই হিন্দু মুসলমান’
‘শ্যামল শস্যভরা’
‘ভারতকাব্য নিকুঞ্জে’
‘জাগো সুমঙ্গলময়ী মা’
‘বিধাতা আপনি এসে পথ দেখালে’
‘রে তাঁতী ভাই’
‘জয় জয় জন্মভূমি জননী’
‘এবার সোনার বাংলা ভাগ করে ভাই কল্পে রে দুখান’
‘তোরা আয় রে ছুটে আয়’
‘আমরা নেহাৎ গরীব’
‘আর কিসের শঙ্কা’
‘কেমন বিচার কচ্ছে গোরা’
এই গানগুলিতে সহজ সরল অভিব্যক্তির সঙ্গে প্রচলিত সুরসংযোজনার দক্ষতা লক্ষ্যণীয়। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি রচনার দিনই সন্ধ্যায় একদল যুবক এই গান গাইতে গাইতে খালিপায়ে নগর পরিক্রমা করে। বিদেশী দ্রব্য বর্জনে এসব গান যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
বাংলার জাতীয়সংগীতের এই পর্বে যাঁদের অবদান স্মরণীয় তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মুকুন্দ দাস। তিনি কোনও সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না। মুসলমানদের অনুষ্ঠানেও তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে যোগ দিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সন্তান’ বলে অভিহিত করেন। যাত্রাভিনয়ে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। ভ্রাম্যমাণ যাত্রার দল গঠন করে সামাজিক, দেশাত্মবোধক রূপক নাট্য অভিনয় করে বেড়াতেন। তাঁর অভিনয় দেখার জন্য আবালবৃদ্ধবণিতা সকলের মধ্যে তীব্র আগ্রহ দেখা যেত। গেরুয়াবসন পরিহিত এক অগ্নিশিখার ন্যায় যাত্রার আসরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’ বলে গান ধরতেন ও উদাত্ত কণ্ঠে সুরের মাতনে সবাইকে মাতিয়ে দিতেন। তাঁর ‘ছেড়ে দাও রেশমী চুড়ি’ গান শুনে চিকের আড়াল থেকে মহিলারা হাত থেকে রেশমী চুড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেলতেন।
তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় গান—
‘আমি দশহাজার প্রাণ যদি পেতাম
তবে ফিরিঙ্গী বণিকের রবি অতলজলে ডুবিয়ে দিতাম।’
‘ফুলার আর কি দেখাও ভয়
দেহ তোমার অধীন বটে, মন তো তোমার নয়।’
‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।’
‘রাম রহিম না জুদা কর ভাই’
নিজ রচনা ছাড়াও অন্যান্য গীতিকারদের গানও তাঁর যাত্রায় তিনি ব্যবহার করতেন।
সংখ্যায় বেশী না হলেও যাঁর লেখা কয়েকটি দেশাত্মবোধক গানের গভীর আবেদন মনকে স্পর্শ করে, তিনি হচ্ছেন অতুলপ্রসাদ সেন।
‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’
‘বলো বলো বল সবে, শতবীণা বেণু রবে’
‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’
‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’
‘ভারত ভানু কোথা লুকালে’ ইত্যাদি।
সম্মেলক গীতি হিসাবে গানগুলি সার্থক এবং গানের ছন্দ, সহজ-সরল স্বতঃস্ফূর্তভাব সবার নিকট সহজবোধ্য হয়ে উঠেছিল।
কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের নিম্নোক্ত গানগুলি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে –
‘সেই তো রয়েছে মা’
‘আজ বরিশাল পুণ্যে বিশাল’
‘ভাই সব দেখ চেয়ে’
‘চণ্ড দিতে চণ্ড মুণ্ডে’
‘ছিন্ন হল বঙ্গ কেন ভাব অমঙ্গল’
‘এক দেশে থাকি এক মাকে ডাকি’
‘এস দেশের অভাব ঘুচাও’— এই গানটিতে মনমোহন বসুর ‘দিনের দিন সবে দীন’ গানটির প্রভাব চোখে পড়ে।
অন্যান্য আরও যে সব মুক্তির গান নিবিড় দেশপ্রেমে কালোত্তীর্ণ ছিল তার একটা তালিকা করা যেতে পারে।
প্রমথনাথ রায়চৌধুরীর— ‘নমো বঙ্গভূমি শ্যামাঙ্গিনী
জাগরণী শুভদিনে গাহ শুভক্ষণে গাহ আজি জয়’
‘হে মাতঃ বঙ্গ’।
কামিনী রায়ের— ‘তোরা শুনে যা আমার’
মনমোহন চক্রবর্তীর— ‘চল্ রে চরে চরে ও ভাই’ এবং
‘কাঁপায়ে মেদিনী কর জয়ধ্বনি জাগিয়া উঠুক মৃতপ্রাণ।’
হরিদাস হালদারের – ‘স্বদেশের ধূলি, স্বর্ণরেণু বলি’
অশ্বিনীকুমার দত্তের – ‘শুনি মাভৈঃ মাভৈঃ’
গোবিন্দচন্দ্র দাসের – ‘স্বদেশ স্বদেশ কচ্ছ কারে এদেশ তোমার নয়’
জ্যোতিরিন্দ্র মোহন বাগচীর – ‘ওরে খ্যাপা যদি প্রাণ দিতে চাস’
বরীন্দ্রমোহিনী দাসীর— ‘আজি গাও গাও খুলে মন প্রাণ’
বিপিনচন্দ্র পালের— ‘আর সহে না সহে না জননী, এ যাতনা আর সহে না’
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের– ‘কোন্ দেশেতে তরুলতা’
শিবনাথ শাস্ত্রীর— ‘পারি কি ভুলিতে ভারত রুধির’
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের— ‘চল্ রে চল্ সবে ভারতসন্তান’
স্বর্ণকুমারী দেবীর— ‘লক্ষ ভাইয়ের দাঁড়ের টানে’
গোবিন্দচন্দ্র রায়ের— ‘কতকাল পরে বল ভারত রে’
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের— ‘মলিন মুখ চন্দ্ৰমা’
এছাড়া আরও অজস্র গান রচিত হয়েছিল। জানা যায় বেশ কিছু জারি গানের মাধ্যমে মুসলমানরাও ব্রিটিশদের বিরোধিতা প্রকাশ করেছিল। বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের উৎসাহে এফিজুদ্দিন বয়াতি বেশ কিছু জারি গান রচনা ক’রে সর্বত্র সেগুলি গেয়ে প্রচার করতেন।
বিশদ আলোচনায় না গিয়ে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় যে ঢেউ উঠেছিল তা গ্রামজীবনকে যে সাড়া জাগিয়েছিল, তার পরিচয় মেলে বহু খ্যাত-অখ্যাত কবিদের রচিত দেশাত্মবোধক পল্লীগীতির সমান্তরাল ধারায়, যেমন— আউল, বাউল, ভাদু, টুসু, সারি, গম্ভীরা, সঙের গান ইত্যাদি। ভক্তিমূলক গানের পাশাপাশি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন অনেক ভক্তিমূলক গান যথা কীর্তন, ব্রতকথা, বৈষ্ণব গানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। সংরক্ষণের অভাবে এবং তাৎক্ষণিক তাৎপর্য হারানোয় সেসব গানের অধিকাংশই আজ অবলুপ্ত। আরও অনেক গীতিকার এই যুগে বাংলা জাতীয় সংগীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন যাঁদের গান দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ সঞ্চারিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল, তাঁদের সকলের নাম উল্লেখ করা গেল না, কালের স্রোতে অনেকের নাম ও গান হারিয়ে গেছে, কিন্তু শুধু বঙ্গবাসী নয়, সারা দেশবাসী চিরকৃতজ্ঞচিত্তে তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ রাখবে।
১৯১২ সালের পর রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিবর্তিত হয় এবং বাংলায় এই ধরণের স্বদেশপ্রেমের গানের জোয়ার স্তিমিত হয়ে আসে। তাই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনই বাংলায় জাগরণী সংগীতের স্বর্ণযুগ বলা যায়। বাংলার স্বদেশী আন্দোলনে এই সব দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের অবদান চিরস্মরণীয় এবং বাংলা সংস্কৃতিতে এঁদের মহান সৃষ্টি আজ এত বছর পরেও স্বমহিমায় জাজ্জ্বল্যময়।
তথ্যসূত্র –
১) মুক্তির গান – সংকলন ও সম্পাদন – সুভাষ চৌধুরী
২) বাংলা দেশাত্মবোধক গানের ধারা – নীহারবিন্দু সেন
৩) প্রসঙ্গ, বাংলা গান – শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র