বাঙ্গালার ইতিহাস -ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
প্রথম অধ্যায়:
১৭৫৬ খৃষ্টীয় অব্দের ১০ ই এপ্রিল, সিরাজউদ্দৌলা বাঙ্গালা ও বিহারের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। তৎকালে দিল্লীর সম্রাট্ এমত দুরবস্থায় পড়িয়ছিলেন যে নূতন নবাব আর তাহার নিকট সনন্দ প্রার্থনা করা আবশ্যক বোধ করিলেন না। তিনি, রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হইয়া, প্রথমতঃ আপন পিতৃব্যপত্নীর সমুদায় সম্পত্তি হরণ করিবার নিমিত্ত, সৈন্য প্রেরণ করেন। তাঁহার পিতৃব্য নিবাইশ মহমদ, ষোল বৎসর ঢাকার রাজত্ব করিয়া, অপরিমিত অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। পরে, তিনি লোকান্তর প্রাপ্ত হইলে, তাঁহার পত্নী তদীয় সমস্ত ধনের উত্তরাধিকারিণী হয়েন। ঐ বিধবা নারী, আপন সম্পত্তি রক্ষার নিমিত্ত, যে সৈন্য রাখিয়াছিলেন তাহারা কার্য্য কালে পলায়ন করিল। সুতরাং উহার সমুদায় ঐশ্বর্য্য নির্ব্বিবাদে নবাবের প্রাসাদে প্রেরিত হইল; এবং তিনিও সহজেই আপন বাসস্থান হইতে বহিষ্কৃতা হইলেন। রাজবল্লভ ঢাকায় নিবাইশ মহমদের সহকারী ছিলেন এবং, যবন রাজাদিগের অধিকার সময়ের প্রথা অনুসারে, প্রজার সর্ব্বনাশ করিয়া অনেক ধন সঞ্চয় কবেন। তিনি ঐ সময়ে মুরশিদাবাদে উপস্থিত থাকাতে, সিরাজউদ্দৌলা, তাঁহাকে কারাগারে বদ্ধ করিয়া, তদীয় সমুদায় সম্পত্তি রুদ্ধ করিবার নিমিত্ত ঢাকায় লোক প্রেরণ করিলেন।
কিন্তু রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস, অগ্রে ঐ সংবাদ জানিতে পারিয়া, সমস্ত সম্পত্তি লইয়া, নৌকারোহণ পূর্ব্বক, গঙ্গাসাগর অথবা জগন্নাথ যাত্রাচ্ছলে, কলিকাতা পলায়ন করিলেন; এবং ১৭ই মার্চ্চ তথায় উপস্থিত হইয়া, তথাকার অধ্যক্ষ শ্রীযুত ড্রেক সাহেবের অনুমতি লইয়া নগর মধ্যে বাস করিলেন। তিনি মনে মনে নিশ্চয় করিলেন যাবৎ পিতার মুক্তি সংবাদ না পাই, তত দিন এই স্থানে অবস্থিতি করিব। রাজবল্লভের সম্পত্তি এইরূপে হস্তবর্হিভূত হওয়াতে, সিরাজউদৌলা অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন; এবং, কুষ্ণদাসকে আমার হস্তে সমর্পণ করিতে হইবেক, এই দাওয়া করিয়া কলিকাতায় দূত প্রেরণ করিলেন। কিন্তু ঐ লোক বিশ্বাসযোগ্য পত্রাদি প্রদর্শন করিতে না পারিবাতে, ড্রেক সাহেব তাহাকে নগর হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিলেন।
কিছু দিন পরেই,ইউরোপ হইতে এই সংবাদ আসিল যে অল্প কালের মধ্যেই ফরাসিদিগের সহিত ইঙ্গরেজদিগের যুদ্ধ ঘটিবার সম্ভাবনা হইয়াছে। তৎকালে ফরাসিরা করমণ্ডল উপকূলে অতিশয় প্রবল ও পরাক্রান্ত ছিলেন; আর কলিকাতায় ইঙ্গরেজদিগের যত ইউরেপীয় সৈন্য ছিল, চন্দননগরে ফরাসিদের তদপেক্ষায় দশগুণ অধিক থাকে। অতএব কলিকতাবাসি ইঙ্গারেজের আপনাদিগের দুর্গ সংস্কার করিতে আরম্ভ করিলেন। এই ব্যাপার অনতিবিলম্বেই অল্পবয়স্ক উগ্রস্বভাব নবাবের কর্ণগোচর হইল। ইঙ্গরেজদিগের উপর তার যৎপরোনাস্তি দ্বেয ছিল; অতএব তিনি ভয়প্রদর্শন পূর্বক ড্রেক সাহেবকে এই পত্র লিখিলেন, আপনি নুতন দুর্গ নির্ম্মাণ করিতে পাইবেন না; বরং পুরাতন যাহা আছে, ভাঙ্গিয়া ফেলিবেন; এবং অবিলম্বে কৃষ্ণদাসকে আমার লোকের হস্তে সমর্পণ করিবেন।
আলিবর্দ্দির মৃত্যুর দুই এক মাস পূর্ব্ব, সিরাজউদ্দৌলার দ্বিতীয় পিতৃব্য সায়দ আহমদের পরলোক প্রাপ্তি হয়। তিনি আপন পুত্র সকতজঙ্গকে স্বীয় সমস্ত সৈন্য, সম্পত্তি ও পূর্ণিয়ার রাজত্বের অধিকারী করিয়া যান। তদনুসারে, সকতজঙ্গ, সিরাজউদ্দৌলার সুবাদার হইবার কিঞ্চিৎ পূর্ব্ব, রাজ্যশাসনে প্রবৃত্ত হয়েন। তঁহারা উভয়েই তুল্যরূপ অবিবেচক, নির্ব্বোধ ও নৃশংস ছিলেন। সুতরাং অধিক কাল তঁহাদের পরস্পর সম্প্রীতি ও ঐকবাক্য থাকিবেক, এমত কোন সম্ভাবনা ছিল না।
সিরাজউদ্দৌলা, সিংহাসনে আরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরাণ কর্ম্মকারক ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুস্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাহার প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা প্রতিদিন তাহাকে অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। সেই পরামর্শের এই, ফল দর্শিয়াছিল যে তৎকালে প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোন স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই। রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকেরা, এই সমস্ত অত্যাচার সহ্য করতে না পারিয়া, উহার পরিবর্তে অন্য কোন ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। তাঁহারা আপাততঃ সকতজঙ্গকেই লক্ষ্য করিলেন। তাহারা নিশ্চিত জানিতেন তিনিও সিরাজউদ্দৌলা অপেক্ষা ভদ্র হইবেন না; কিন্তু মনে মনে এই আশা করিয়াছিলেন, আপাততঃ এই উপায় দ্বারা উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হইয়া পরে কোন যথার্থ ভদ্র ব্যক্তিকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিতে পারিব।
এই বিষয়ে সমুদায় পরামর্শ স্থির হইলে, সকতজঙ্গের সুবাদারীর সনন্দ প্রার্থনায় দিল্লীতে দূত প্রেরিত হইল। আবেদন পত্রে বার্ষিক কোটি মুদ্রা কর প্রদানের প্রস্তাব থাকাতে অনায়াসেই তাহাতে সম্রাটের সম্মতি হইল।সিরাজউদ্দৌলা, এই চক্রান্তের সন্ধান পাইয়া, অবিলম্বে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া, সকতজঙ্গের প্রাণদণ্ডার্থে পূর্ণিয়া যাত্রা করিলেন। সৈন্য সকল, রাজমহলে উপস্থিত হইয়া, গঙ্গা পার হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমত সময়ে সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতার গবর্ণর ডেক সাহেবের নিকট হইতে, আপন পূৰ্বপ্রেরিত পত্রের এই প্রত্যুত্তর পাইলেন, আমি আপনকার আজ্ঞায় কদাচ সম্মত হইতে পারি না।
এই উত্তর পাইয়া তাহার কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন তিনি, ইঙ্গরেজেরা রাজ্যের বিরুদ্ধাচারিদিগকে আশ্রয় দিতেছে, এবং আমার অধিকার মধ্যে গড়বন্দি করিয়া আপনাদিগকে দৃঢ়ীভূত করিতেছে; অতএব আমি তাহাদিগকে নির্মূল করিব, এই প্রতিজ্ঞা করিয়া সৈন্যদিগকে অবিলম্বে শিবির ভঙ্গ করিয়া কলিকাতা যাত্রা করিতে আদেশ দিলেন। কাশিমবাজারে ইরেজদিগের যে কুঠী ছিল তাহা লুঠ করিলেন এবং তথায় যে যে ইউরোপীয়দিগকে দেখিতে পাইলেন তাহাদিগকে কারারুদ্ধ করিলেন।
কলিকাতাবাসি ইঙ্গরেজেরা ষাটি বৎসরের অধিক কাল নিরুপদ্রবে ছিলেন; সুতরাং, বিশেষ আস্থা না থাকাতে, তাঁহাদের দুর্গ প্রায় একপ্রকার নষ্ট হইয়া গিয়ছিল। ফলতঃ,তাহারা আপনাদিগকে এমত নিঃশঙ্ক ভাবিয়াছিলেন যে দুর্গপ্রাচীরের বহির্ভাগে বিংশতি ব্যামের মধ্যেও অনেক গৃহ নির্মাণ করিয়াছিলেন। তৎকালে ‘দুর্গমধ্যে একশত সত্তর জন মাত্র সৈন্য ছিল তন্মধ্যে কেবল ষাটি জন ইউরোপীয়। বারুদ পুরাতন ও নিস্তেজঃ; কামান সকল মরিচাধর। কিন্তু এ দিকে সিরাজউদ্দৌলা চল্লিশ পঞ্চাশ সহস্র সৈন্য ও উত্তম উত্তম কামান লইয়া কলিকাতা আক্রমণ করিতে আসিতেছেন।
ইঙ্গরেজেরা দেখিলেন আক্রমণ নিবারণের কোন সম্ভাবনা নাই; অতএব সন্ধিপ্রার্থনায় বারম্বার পত্র প্রেরণ করিতে লাগিলেন এবং বহুসংখ্যক মুদ্রা প্রদানেরও প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু নবাবের অন্য কোন বিষয়ে কর্ণ দিতে ইচ্ছা ছিল না; তিনি তাহাদিগকে একবারেই, উচ্ছিন্ন করিবার মানস করিয়াছিলেন; অতএব পত্রের কোন উত্তর না দিয়া, অবিশ্রামে কলিকাতা অভিমুখে আসিতে লাগিলেন। ১৬ই জুন,তাহার সৈন্যের অগ্রসর ভাগ চিৎপুরে উপস্থিত হইল। ইঙ্গরেজেরা ইতিপূর্ব্বে তথায় এক উপদুর্গ প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন; তথা হইতে তাহারা নবাবের সৈন্যের উপর এমত ভয়ানক গোল বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, যে তাহারা হটিয়া গিয়া দমদমায় অবস্থিতি করিল। নবাবের সৈন্যেরা, ১৭ই, নগর বেষ্টন করিয়া তৎপর দিন এককালে চারি দিকে আক্রমণ করিল। তাহারা ভিত্তিসন্নিহিত গৃহ সকল অধিকার করিয়া এমত ভয়ানক অগ্নিবৃষ্টি করিতে লাগিল যে এক ব্যক্তিও সাহস করিয়া গড়ের উপর দাঁড়াইতে পারিল না। এই দিবস, অনেক ব্যক্তি হত ও অনেক ব্যক্তি আহত হয়; এবং দুর্গের বহির্ভাগ বিপক্ষদের হস্তগত হয়। সুতরাং ইঙ্গরেজদিগকে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে হইল। রাত্রিতে বিপক্ষের দুর্গের চতুঃপাশ্ববর্ত্তি অতি বৃহং কতিপয় গৃহে অগ্নি প্রদান করিল; ঐ সকল গৃহ অতি ভয়ানক রূপে দগ্ধ হইতে লাগিল।
অতঃপর কি করা উচিত, ইহা বিবেচনা করিবার নিমিত্ত ইঙ্গরেজের এক সভা করিলেন। তৎকালীন সেনাপতিদিগের মধ্যে এক ব্যক্তিও কার্য্যঞ্জ ছিলেন না। তাঁহারা সকলেই কহিলেন পলায়ন ব্যতিরেকে পরিত্রাণ নাই। বিশেষতঃ, এত অধিক এদেশীয় লোক দুর্গ মধ্যে আশ্রয় লইয়াছিল, যে তন্মধ্যে যাহা আহারসামগ্রী ছিল, তাহাতে এক সপ্তাহও চলিতে পারিত না। অতএব নির্ধারিত হইল, গড়ের নিকট যে সকল নৌকা প্রস্তুত আছে, পর দিন প্রত্যুষে নগর পরিত্যাগ করিয়া তদ্দ্বারা পলায়ন করাই শ্রেয়। কিন্তু দুর্গমধ্যে এক ব্যক্তিও এমত ক্ষমতাপন্ন ছিল না যে এই ব্যাপার সুশৃঙ্খলরূপে নিৰ্বাহ করিয়া উঠে। সকলেই আজ্ঞা প্রদানে উদ্যত, কেহই আজ্ঞা প্রতিপালনে সম্মত নহে।
নিরূপিত সময়ে প্রথমতঃ স্ত্রীলোকদিগকে প্রেরণ করা গেল। অনন্তর দুর্গস্থিত সমুদায় লোক ও নাবিকগণ ভয়ে অত্যন্ত অভিভূত হইল। সকল ব্যক্তিই তীরাভিমুখে ধাবমান। নাবিকেরা নৌকা লইয়া পলাইতে উদ্যত। ফলতঃ সকলেই আপন লইয়া ব্যস্ত। যে যে নৌকা সম্মুখে পাইল তাহাতেই আরোহণ করিল। সাধ্যক্ষ ড্রেক সাহেব ও সৈন্যাধ্যক্ষ বাহাদুর সর্বাগ্রে পলায়ন করিলেন। এবং বে কয়েকখান নৌকা উপস্থিত ছিল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, কতক জাহাজের নিকটে, ও কতক হাবড়া পারে, চলিয়া গেল; কিন্তু সৈন্য ও ভদ্রলোক অর্ধেকেরও অধিক দুৰ্গমধ্যে রহিয়া গেল।
সাধ্যক্ষ সাহেবের পলায়ন সংবাদ প্রচার হইবা মাত্র, অবশিষ্ট ব্যক্তিরা একত্র হইয়া হালওয়েল সাহেবকে আপনাদিগের অধ্যক্ষ স্থির করিল। পলায়িতেরা,জাহাজে আরোহণ করিয়া, প্রায় এক ক্রোশ ভাটিয়া গিয়া, নদীতে নঙ্গর করিয়া রহিল। ১৯ জুন,বিপক্ষে পুনৰ্বার আক্রমণ করে; কিন্তু পরিশেষে অপসারিত হয়। দুর্গবাসিরা দুই দিবস পর্যন্ত আপনাদিগের রক্ষা করিয়াছিল, এবং জাহাজস্থিত লোকদিগকে নিরন্তর সঙ্কেত করিয়াছিল যে তোমরা আসিয়া আমাদিগের উদ্ধার কর। এই উদ্ধার করা অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারিত, সন্দেহ নাই। কিন্তু পলায়িত ব্যক্তিরা পরিত্যক্ত ব্যক্তিদিগের উদ্ধারার্থে এক বারও উদ্যোগ পাইল না। যাহা হউক, তখনও তাহাদিগের অন্য এক আশা ছিল। রয়েল জর্জ নামক এক জাহাজ চিৎপুরের নীচে নঙ্গর করিয়া ছিল, হলওয়েল সাহেব ঐ জাহাজ গড়ের নিকট আনিবার নিমিত্ত দুই জন ভদ্রলোককে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উহা আসিবার সময় চড়ায় লাগিয়া গেল, আর উঠাইতে পারা গেল না। এইরূপে, দুর্গতি হভাগ্য লোকদিগের শেষ আশাও উচ্ছিন্ন হইল।
১৯এ, রাত্রিতে, বিপক্ষের দুর্গের চতুর্দিস্থ অবশিষ্ট গৃহ সকলে অগ্নি প্রদান করিয়া, ২০এ, পুনর্ব্বার পুর্বাপেক্ষায় অধিকতর পরাক্রম পূর্ব্বক আক্রমণ করিল। হালওয়েল সাহেব, আর নিবারণ চেষ্টা করা ব্যর্থ বুঝিয়া, নবাবের সেনাপতি মাণিকচাঁদের নিকট পত্র দ্বারা সন্ধি প্রার্থনা করিলেন। দুই প্রহর চারিটার সময়, এক জন শত্রুপক্ষীয় সৈনিক পুরুষ কামান বন্ধ করিতে সঙ্কেত করে; তাহাতে ইঙ্গরেজেরা, সেনাপতির উত্তর আইল বোধ কৃরিয়া, আপনাদিগের কামান ছোড়া রহিত করিলেন। তাঁহারা এইরূপ করিবামাত্র বিপক্ষের প্রাচীরের নিকট দৌড়িয়া আইল, প্রাচীর লজ্জন করিয়া দুর্গ মধ্যে প্রবেশ করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিল এবং তৎপরে এক ঘণ্টার মধ্যেই ঐ দুর্গ অধিকার করিয়া লঠ আরম্ভ করিল।
পাঁচটার সময়,সিরাজউদ্দৌলা চৌপালায় চড়িয়া দুর্গমধ্যে উপস্থিত হইলে, ইউরোপীয়রা তাহার সম্মুখে আনীত হইল। হালওয়েল সাহেবের দুই হস্ত বদ্ধ ছিল, নবাব, খুলিয়া দিতে আজ্ঞা দিয়া, তাঁহাকে এই বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিলেন, তোমার মস্তকের একটা কেশও স্পর্শ করা যাইবে না। অনন্তর বিস্ময় প্রকাশ পূৰ্বক কহিলেন, এত অল্প সংখ্যক ব্যক্তি কিরূপে চারিশতগুণ অধিক সৈন্যের সহিত এত অধিক কাল যুদ্ধ করিল। পরে, এক অনাবৃত প্রদেশে সভা করিয়া, কৃষ্ণদাসকে সম্মুখে আনিতে আদেশ করিলেন। নবাব যে ইঙ্গরেজদিগকে আক্রমণ করেন, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দেওয়াই তাহার এক প্রধান কারণ। তাহাতে সকলে অনুমান করিয়াছিল, তিনি কৃষ্ণদাসের গুরুতর দণ্ড বিধান করিবেন। কিন্তু তিনি, তাহা না করিয়া, তৎপরির্তে তাহাকে এক মর্যাদাসুচক পরিচ্ছদ পুরস্কার দিলেন।
বেলা ছয় সাত ঘটিকার সময়, নবাব, সেনাপতি। মাণিকদের হস্তে দুর্গ সমৰ্পণ করিয়া, শিবিরে প্রত্যাগমন করিলেন। সমুদায়ে এক শত ছচল্লিশ জন ইউরোপীয় বন্দী ছিল। সৈন্যাধ্যক্ষ, সেই রাত্রি তাহাদিগকে যেখানে রাখিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন, এমত এক স্থান অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তৎকালে দুর্গের মধ্যে,দীর্ঘে দ্বাদশ ও প্রস্থে নয় হস্ত প্রমাণ, এক গৃহছিল। বায়ুসঞ্চারের নিমিত্ত তাহার এক এক দিকে এক এক মাত্র গবাক্ষ থাকে। ইঙ্গরেজেরা কলহকারি দুর্ব্বৃত্ত সৈন্যদিগকে ঐ গৃহে রুদ্ধ করিয়া রাখিতেন। মুসলমানেরা, এই দারুণ গ্রীষ্মসময়ে, সেই সমস্ত ইউরোপীয় বন্দীদিগকে এমত ক্ষুদ্র গৃহে নিক্ষিপ্ত করিল।
সেই রাত্রিতে যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না! বন্দীর অতি ত্বরায় ঘোরতর পিপাসায় কাতর হইল; আর রক্ষকদিগের নিকট বরিস্কার প্রার্থনা করিয়া যে জল পাইল, তাহাতে কেবল তাহাদিগকে ক্ষিপ্তপ্রণয় করিল। প্রত্যেক ব্যক্তিই, সম্যক্রূপে নিশ্বাস আকর্ষণ করিবার আশয়ে, গবাক্ষের নিকটে যাইবার নিমিত্ত বিবাদ করিতে লাগিল; এবং যন্ত্রণায় অধৈর্য্য হইয়া রক্ষিদিগকে প্রার্থনা কবিতে লাগিল, তোমরা আমীদিগের উপব গুলী করিয়া এই দুঃসহ ক্লেশের অবসান কর। ক্রমে ক্রমে এক এক জন করিয়া অনেকেই পঞ্চস্থ পাইয়া ভূতলশায়ী হইল। তখন অবশিষ্ট ব্যক্তিরা, সেই শবরাশির উপর দাড়াইয়া, নিশ্বাস আকর্ষণের অনেক স্থান পাইল; তাহাতেই কয়েক জন জীবিত থাকিল। পর দিন প্রাতঃকালে, সেই গৃহের দ্বার উদঘাটিত হইলে, দৃষ্ট হইল এক শত ছচল্লিশের মধ্যে কেবল তেইশ জন মাত্র জীবিত আছে। অন্ধকূপহত্য নামে যে অতি ভয়ানক ব্যাপার প্রসিদ্ধ আছে, সে এই! এই হত্যার নিমিত্তই সিরাজউদৌলার কলিকাতা আক্রমণ শুনিতে এত ভয়ানক হইয়া রহিয়াছে। উক্ত ঘোরতর অত্যাচার প্রযুক্তই, এই বৃত্তান্ত সর্ব্বদেশীয় লোকের অন্তঃকরণে জদ্যাপি দেদীপ্যমান আছে; এবং সিরাজউদৌলাও কৃশংস রাক্ষস বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। কিন্তু তিনি, পর দিন প্রাতঃকাল পর্য্যন্ত, এই ব্যাপীবের বিন্দুবিসর্গও জানিতেন না। সেই রীত্রিতে সেনাপতি মাণিকচাঁদের হস্তে দুর্গের ভার অর্পিত ছিল; অতএব তিনিই এই সমস্ত দোষের ভাগী।
২১এ জুন, প্রাতঃকালে, এই দারুণ ব্যাপার নবাবের কর্ণগোচর হইলে, তিনি অত্যন্ত অনবধান প্রদর্শন করিলেন। অন্ধকূপে রুদ্ধ হইয়া যে কয়েক ব্যক্তি জীবিত থাকে, হালওয়েল সাহেব তাহীদের মধ্যে এক জন। নবাব তাহণকে আহবান করিয়া ধনাগার দেখাইয়া দিতে কহিলেন। তিনি দেখাইয়া দিলেন; কিন্তু ধনগণর মধ্যে কেবল পঞ্চণশ সহস্র মাত্র টাকা পাওয়া গেল, ইহাতে নবাবের অত্যন্ত চমৎকার বোধ হইল।
সিরাজউদৌল নয় দিবস কলিকাতার সন্নিধ্যে থাকিলেন। অনন্তর কলিকাতার নাম আলিনগর রাখিয়া মুরশিদাবাদ প্রস্তান করিলেন। ২রা জুলাই,গঙ্গা পার হইয়া হুগলীতে উত্তীর্ণ হইলেন এবং লোক দ্বারা ও লন্দাজ ও ফরাসিদিগের নিকট কিছু কিছু টাকা চাহিয়া পঠাইলেন। তিনি তঁহাদিগকে এই বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়াছিলেন, যদি অস্বীকার কর, তোমাদেরও ইঙ্গরেজদের মত দুরবস্থা করিব। তাহাতে ওলন্দাজের সাড়ে চারি লক্ষ, ও ফরাসির সাড়ে তিন লক্ষ, টাকা দিয়া সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলেন।
যে বৎসর কলিকাতা পরাজিত ও ইঙ্গরেজেরা বাঙ্গালা হইতে দূরীকৃত হয়েন, সেই বৎসর অর্থাৎ ১৭৫৬ খৃঃ অব্দে দিনামারেরা, এই দেশে বাসের অনুমতি পাইয়া, শ্রীরামপুর নগর সংস্থাপন করেন। সিরাজউদ্দৌলা, জয় লাভে প্রফুল্ল হইয়া, পূর্ণিয়ার অধিপতি নিজপিতৃব্যপুত্র সকতজঙ্গকে আক্রমণ করিবার নিশ্চয় করিলেন। বিবাদ উথাপন করিবার নিমিত্ত আপন এক ভৃত্যকে ঐপ্রদেশের ফৌজদার নিযুক্ত করিয়া, পিতৃব্যপুত্রকে এই আজ পত্র লিখিলেন তুমি অবিলম্বে ইহাকে সমস্ত কর্মের ভার দিবে। ইহাতে ঐ উদ্ধত যুবা ক্রোধে অন্ধ ও ক্ষিপ্ত প্রায় হইয়া উত্তর লিখিলেন, আমি এই সমস্ত প্রদেশের যথার্থ অধিপতি; দিল্লী হইতে সনন্দ পাইয়াছি। অতএব আজ্ঞা করিতেছি, তুমি অবিলম্বে মুরশিদাবাদ পরিত্যাগ করিয়া যথায় ইচ্ছা চলিয়া যাও।
এই উত্তর পাইয়া সিরাজউদ্দৌলা ক্রোধে অধৈর্য্য হইলেন এবং অতিত্বরায় সৈন্য সংগ্রহ করিয়া পূর্ণিয়া প্রস্থান করিলেন। সকতজঙ্গও এই সংবাদ পাইয়া সৈন্য লইয়া তদভিমুখে যাত্রা করিলেন। কিন্তু সকতজঙ্গ যুদ্ধের কিছুই জানিতেন না, এবং কাহারও পরামর্শ শুনিতেন। তাহার সেনাপতিরা সৈন্য সহিত এক দৃঢ় স্থানে উপস্থিত হইল। ঐ স্থানের সম্মুখে জলা; পার হইবার নিমিত্ত মধ্যে কেবল এক মাত্র সেতু ছিল। সৈন্য সকল সেই স্থানে শিবির সন্নিবেশিত করিল। কিন্তু এক জনও উপযুক্ত সেনাপতি ছিল না,এবং অনুষ্ঠানেরও কোন পরিপাটা ছিল না। প্রত্যেক সেনাপতিই আপন আপন সুবিধা অনুসারে পৃথক পৃথক স্থানে সেনা নিবেশিত করিল। সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যেরা, ঐ জলার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, সকতজঙ্গের সৈন্যের উপর গোল চালাইতে লাগিল। বড় বড় কামানের গোলাতে তাঁহার সৈন্য ছিন্ন ভিন্ন হইলে, তিনি, নিতান্ত উন্মত্তের ন্যায়, স্বীয় অশ্বরোহদিগকে জল পার হইয়া আক্রমণ করতে আজ্ঞা দিলেন। তাহারা অতিকষ্টে কদ্দন পার হইয়া শুষ্ক স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যেরা অতি ভয়ানক রূপে তাহাদিগকে আক্রমণ করিল।
ঘোরতর যুদ্ধ হইতেছে, এমত সময়ে কতজঙ্গ স্ত্রী সম্ভোগার্থে শিবির প্রবেশ করিলেন এবং সুরাপান করিয়া এমত মত্ত হইলেন যে আর সোজা হইয়া বসিতে পারেন। তাঁহার সেনাপতিরা,পশ্চাৎ পশ্চাং আসিয়া,ওঁহাকে রণস্থলে উপস্থিত থাকিবার নিমিত্ত অত্যন্ত অনুরোধ করিতে লাগিল। পরিশেষে, ধরিয়া থাকিবার নিমিও এক ভৃত্য সমেত, তাঁহাকে হস্তিতে আরোহণ করাইয়া, ‘জলার প্রান্ত ভাগে উপস্থিত করিল। তথায় উপস্থিত হইবামাত্র, শত্রুপক্ষ হইতে এক গোলা আসিয়া তাহার কপালে লাগিল; তাহাতে তিনি তৎক্ষণাঃ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়া হাওদার উপরে শয়ন করিলেন। সৈন্যেরা উহাকে প্রাণ ত্যাগ করিতে দেখিয়া শ্রেণীভঙ্গ পূর্বক পলায়ন করিল। দুই দিবস পরে, নবাবের সেনাপতি মোহনলাল পূর্ণিয়া অধিকার করিলেন এবং তথাকার ধনাগারপ্রাপ্ত অ্যানাধিক নবতি লক্ষ টাকা ও সকতঙ্গের যাবতীয় অন্তঃপুরিকাগণ মুরশিদাবাদে পাঠাইয়া দিলেন।
সিরাজউদ্দৌলার, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইতে, সাহস হয় নাই। বস্তুতঃ, তিনি রাজমহলের অধিক যান নাই। কিন্তু এই জয়ের সমুদায় বাহাদুরী আপনার বোধ করিয়া মহাসমারোহে মুরশিদাবাদ প্রত্যাগমন করিলেন।
এক্ষণে পুনর্ব্বার ইঙ্গরেজদিগের বিষয় আরব্ধ হইতেছে। ডেক সাহেব, কাপুরুষত্ব প্রদর্শন পুর্ব্বক স্বদেশীয়দিগকে পরিত্যাগ করিয়া, মান্দ্রাজে সাহায্য প্রার্থনা করিয়া পাঠাইলেন; এবং স্বীয় অনুচরবর্গের সহিত নদীমুখে জাহাজেই অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তথায় অনেক ব্যক্তি রোগাভিভূত হইয়া প্রাণত্যাগ করিল।
কলিকাতার এই দুর্ঘটনার সংবাদ মান্দ্রাজে পহুছিলে, তথাকার গবর্ণর ও কৌনসিলের সাহেবের যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন এবং চারি দিক বিপদ সাগর দেখিতে লাগিলেন। কারণ, সেই সময়ে ফরাসিদিগের সহিত যুদ্ধও আজি কালি ঘটে এইরূপ হইয়াছিল। ফরাসিরা তৎকালে পণ্ডিচরীতে অত্যন্ত প্রবল ছিলেন, এবং ইঙ্গরেজদিগের সৈন্য অতি অল্প ছিল। তথাপি তাঁহার বাঙ্গালার সাহায্য করাই অগ্রে কর্তব্য স্থির করিলেন। অনন্তর তাঁহারা অতি ত্বরায় কতিপয় যুদ্ধজাহাজ ও কিছু সৈন্য সংগ্রহ করিলেন; এবং এডমিরল ওয়াটসন সাহেবকে জাহাজের কর্তৃত্ব দিয়া এবং কর্ণেল ক্লাইব সাহেবকে সৈন্যাধ্যক্ষ করিয়া বাঙ্গালায় পাঠাইলেন।
ক্লাইব, ইহার ত্রয়োদশ বৎসর পূর্বে, অষ্টাদশ বৎসর বয়ঃক্রমে, কোম্পানির কেরানি হইয়া ভারতবর্ষে আগমন করেন; কিন্তু সাংগ্রামিক ব্যাপারে গাঢ়তর অনুরাগ থাকাতে, প্রার্থনা করিয়া সেনাসংক্রান্ত কর্ম্মে নিবিষ্ট হয়েন; এবং, অল্পকাল মধ্যেই, এক জন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা হইয়া উঠেন। তিনি বয়সে যুবা, কিন্তু অভিজ্ঞতাতে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। মান্দ্রাজে উদ্যোগ করিতে অনেক সময় নষ্ট হয়; এজন্য, জাহাজ সকল অক্টোবরের পূর্বে বহির্গত হইতে পারিল না। তৎকালে উত্তরপূর্বীয় বায়ুর আরম্ভ হইয়াছিল; এপ্রযুক্ত জাহাজ সফল ছয় সপ্তাহের নে কলিকাতায় উপস্থিত হইতে পারিল না। তন্মধ্যে দুই খানার আরো অধিক বিলম্ব হইয়াছিল। কলিকাতার উদ্ধারার্থে সমুদায়ে ৯০০ গোরা ও ১৫০০ সিপাই প্রেরিত হয়। তাহারা ২০ ডিসেম্বর ফলতায়, ও ২৮এ মায়াপুরে, পহুছে। তৎকালে মায়াপুরে মুসলমানদিগের এক দুর্গ ছিল। কর্ণেল ক্লাইব শেষোক্ত দিবসে রজনী যোগে স্বীয় সমস্ত সৈন্য তীরে অবতীর্ণ করিলেন; কিন্তু পথদর্শক দিগের দোষে, অরুণোদয়ের পূর্বে, ঐ দুর্গের নিকট ‘পহুছিতে পারিলেন না।
নবাবের সেনাপতি মাণিকচাঁদ, কলিকাতা হইতে অকস্মাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া, ক্লাইবকে আক্রমণ করিলেন। ঐ সময়ে নবাবের সৈন্যেরা যদি প্রকৃত রূপে কর্ম করিত, তাহা হইলে ইঙ্গরেজেরা নিঃসন্দেহ পরাজিত হইতেন। ক্লাইব অতি ত্বরায় কামান আনাইয়া শত্রুপক্ষের উপর গোল চালাইতে আরম্ভ করিলেন। তন্মধ্যে এক গোলা মাণিকচাঁদের হাওদার ভিতর দিয়া চলিয়া যাওয়াতে, তিনি যৎবোনান্তি ভীত হইয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতা পলায়ন করিলেন। পরিশেষে, কলিকাতায় থাকিতেও সাহস না হওয়াতে, তথায় কেবল পাঁচশত সৈন, রাখিয়া, আপন প্রভুর নিকটস্থ হইবার মানসে, অতি সত্বর হইয়া মুরশিদাবাদ প্রস্থান করিলেন। তদনন্তর ক্লাইব স্থল পথে কলিকাতা যাত্রা করিলেন। কিন্তু জাহাজ সকল তাঁহার উপস্থিতির পূর্ব্বেই তথায় পহুছিয়াছিল। ওয়াটসন সাহেব, কলিকাতার উপরি ক্রমাগত দুই ঘণ্টা কাল গোলাবৃষ্টি করিয়া, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ২রা জানুয়ারি, ঐ স্থান অধিকার করিলেন। এইরূপে ইঙ্গরেজেরা পুনর্ব্বার কলকাতা অধিকার করিলেন অথচ স্বপক্ষীয় এক ব্যক্তির ও প্রাণ হানি হইল না।
দ্বিতীয় অধ্যায়।
ক্লাইব ভালরূপে বুঝিযাছিলেন, ভয় প্রদর্শন না করিলে, নবাব কদাচ সন্ধি করিতে চাহিবেন না। অতএব তিনি, কলিকাতা উদ্ধারের দুই দিবস পরে, যুদ্ধ জাহাজ ও সৈন্য পাঠাইয়া হুগলী হস্তগত করিলেন। তৎকালে এই নগর অতিসমৃদ্ধ প্রধান বাণিজ্যস্থান ছিল। বোধ হইতেছে, ক্লাইব, কলিকাতা অধিকার হইবার অব্যবহিত পরেই, মুরশিদাবাদের শেঠদিগের নিকট এই প্রার্থনা করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, যে তাঁহারা মধ্যস্থ হইয়া নবাবের সহিতইঙ্গরেজ দিগের সন্ধি করিয়া দেন। তদনুসারে তাহারা সন্ধির প্রস্তাব করেন। সিরাজউদ্দৌলা- ও প্রথমতঃ প্রসন্ন চিত্তে তাঁহাদের পরামর্শ শুনিয়াছিলেন; কিন্তু, ক্লাইব হুগলী অধিকার করিয়া তথাকার বন্দর লুঠ করিয়াছেন, ইহা শুনিবা মাত্র একবারে ক্রোধে অন্ধ হইয়া সসৈন্যে অবিলম্বে কলিকাতা যাত্রা করিলেন। তিনি,৩০ এ জানুয়ারি,হুগলীর ঘাটে গঙ্গা পার হইলেন; এবং ২ রা ফেব্রুয়ারি কলিকাতার সন্নিকটে উপস্থিত হইয়া, ক্লাইবের ছাউনির এক পোয়া অন্তরে শিবির নিবেশন করিলেন।
ক্লাইব ৭০০ গোরা ও ১২০০ সিপাই এই মাত্র সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন। কিন্তু নবাবের সৈন্য প্রায় ৪০০০০ ছিল। সিরাজউদ্দৌলা পহুছিবামাত্র, ক্লাইব সন্ধি প্রার্থনা করিয়া তাঁহার নিকটে দূত প্রেরণ করিলেন। নবাবের সহিত দূতদিগের অনেক বার সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হইল। তাহাতে হারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, নবাব যদিও মুখে সন্ধির কথা কহিতেছেন, তাঁহার অন্তঃকরণ সেরূপ নহে। বিশেষতঃ, তাহাকে উপস্থিত দেখিয়া কলিকাতার চারি দিকের লোক ভয়ে পলায়ন করাতে,ইঙ্গরেজদিগের আহারসামগ্রী দুষ্পাপ্য হইতে লাগিল। অতএব ক্লাইব এক উদ্যমেই নবাবকে আক্রমণ করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন। তিনি, ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি রাত্রিতে, ওয়াটসন সাহেবের জাহাজে গিয়া তাঁহার নিকট ছয় শত জাহাজী গোরা চাহিয়া লইলেন, এবং তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া, রাত্রি একটার সময়, তীরে অবতীর্ণ হইলেন। দুইটার সময় সমুদায় সৈন্য স্ব স্ব অস্ত্রশস্ত্র লইয়া প্রস্তুত হইল; এবং চারি টার সময়, একবারেই নবাবের ছাউনির দিকে যাত্রা করিল। সৈন্য সমুদায়ে ১৩৫০ গোরা ও ৮০০ সিপাই মাত্র। ক্লাইব, সাহসে নির্ভর করিয়া, এই মাত্রসৈন্য লইয়া, বিংশতিগুণ অধিক সৈন্য আক্রমণ করিতে চলিলেন।
শীতকালের শেষে প্রায় প্রতিদিন কুজঝটিকা হইয়া থাকে। সে দিবসও, প্রভাত হইবামাত্র, এমত নিবিড় কুজঝটি হইয়াছিল যে কোন ব্যক্তি আপনার ছয় হস্ত অন্তরের বস্ত্র দেখিতে পায় না। যাহাহউক, ইঙ্গরেজেরা যুদ্ধ করিতে করিতে বিপক্ষের শিবির ভেদ করিয়া চলিয়া গেলেন। হত ও আহত সমুদায়ে তাহাদের দুই শত বিংশতি জন মাত্র সৈন্য নষ্ট হয়। কিন্তু নবাবের তদপেক্ষায় অনেক অধিক লোক নিধন প্রাপ্ত হইয়াছিল। নবাব ক্লাইবের এইরূপ অসম্ভব সাহসপূর্ব্বক আক্রমণ দর্শনে অত্যন্ত ভয় প্রাপ্ত হইলেন, এবং বুঝিতে পারিলেন, কেমন সাহসিক ও ভয়ানক শত্রুর সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। অতএব তৎক্ষণাৎ তথা হইতে চারি ক্রোশ দূরে গিয়া ছাউনি করিলেন। ক্লাইব দ্বিতীয় বার আক্রমণের সমুদায় উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু নবাব ক্লাইবের অসম্ভব সাহস ও অকুতোভয়তা দর্শনে যুদ্ধের বিষয়ে এমত পরাঙ্মুখ হইয়াছিলেন যে সন্ধির বিষয়েই সম্মত হইয়া, ৯ই ফেব্রুয়ারি,সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিলেন।
এই সন্ধিদারা ইঙ্গরেজের পূর্বের ন্যায় সমুদায় ধিকার প্রাপ্ত হইলেন; অধিকন্তু, কলিকাতাতে দুর্গ,— নির্মাণ ও টাঁকশাল স্থাপন করিবার অনুমতি পাইলেন আর তাঁহাদের পণ্য দ্রব্যের শুল্কদান রহিত হইল। নবাব ইহাও স্বীকার করিলেন, কলিকাতা আক্রমণ কালে যে সকল দ্রব্য গৃহীত হইয়াছে সমুদায় ফিরিয়া দিবেন; আর যাহা যাহা নষ্ট হইয়াছে তং সমুদায়ের যথোপযুক্ত মূল্য ধরিয়া দিবেন। ইঙ্গরেজেরা যুদ্ধে জয়ী হইয়াছেন এই ভাবিয়া,নবাব এই সকল নিয়ম তৎকালে অত্যন্ত অনুকূল বোধ করিলেন; আর ক্লাইবও এই বিবেচনা করিয়া সন্ধি পক্ষে নির্ভর করিলেন, যে ইউরোপে ফরাসিদিগের সহিত ইঙ্গরেজদের যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে; আর কলিকাতায় আমার যত ইউরোপীয় সৈন্য আছে, চন্দন নগরে ফরাসিদিগেরঙ তত আছে; অতএব চন্দন নগর আক্রমণ করিতে যাইবার পূর্বে, নবাবের সহিত নিষ্পত্তি করিয়া সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিন্ত হওয়া আবশ্যক। ইঙ্গরেজ ও ফরাসি এই উভয় জাতির ইউরোপে পরস্পর যুদ্ধ আরম্ভ হইবার সংবাদ কলিকাতায় পহুছিলে, ক্লাইর চন্দননগরবাসি ফরাসিদিগের নিকট প্রস্তাব করিলেন, ইউরোপে যেরূপ হউক, ভারতবর্ষে ঔদাসীন্য অব লম্বন করা যাইবেক, অর্থাৎ উভয়ের মধ্যে কেহ কোন পক্ষকে আক্রমণ করিবে না। তাহাতে চন্দন নগরের গবর্ণর উত্তর দিলেন যে আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু যদি প্রধানপদারূঢ় কোন ফরাসি সেনাপতি আইসেন, তিনি এইরূপ সন্ধি পত্র অস্বীকার করিতে পারেন।
ক্লাইব বিবেচনা করিলেন, যাহাতে নিশ্চিন্ত হইতে পারা যায়, এরূপ নিষ্পত্তি হওয়া অসম্ভব। আর কত দিন চন্দন নগরে ফরাসিদিগের এত অধিক সৈন্য থাকিবেক, তারত পর্যন্ত কলিকাতা নিরাপদ হইবেক না। আর ইহাও স্থির করিলেন যে সিরাজউদ্দৌলা কেবল ভয় প্রযুক্তই সন্ধি করিয়াছেন; সুযোগ পাইলেই নিঃসন্দেহ যুদ্ধ আরম্ভ করিবেন। বস্তুতঃ, সিরাজউদ্দৌলা এ পর্যন্ত ক্রমাগত ফরাসিলিগের সহিত, ইঙ্গরেজদিগের উচ্ছেদের, মন্ত্রণা করিতেছিলেন; এবং যুদ্ধকালে ফরাসিদিগের সাহায্যার্থে কিছু সৈন্যও পাঠাইয়াছিলেন। যাহাহউক, ক্লাইব বিবেচনা করিলেন, নবাবের অনুমতি ব্যতিরেকে ফরাসিদিগকে আক্রমণ করা উপযুক্ত নহে! কিন্তু এ বিষয়ে অনুমতির নিমিত্ত যত বার প্রার্থনা করিলেন, প্রত্যেক বারেই নবাব কোন স্পষ্ট উত্তর দিলেন না। পরিশেষে, ওয়াটসন সাহেব নবাবকে এই ভাবে পত্র লিখিলেন, আমার যত সৈন্য আসিবার কল্পনা ছিল সমুদায় আসিয়াছে; এক্ষণে আপনার রাজ্যে এমত প্রবল যুদ্ধানল প্রজ্বলিত করিব যে সমুদায় গঙ্গার জলেও তাহার নির্ধাণ হইবেক না। সিরাজউদ্দৌলা, এই পত্র পাঠে যৎপয়োনাস্তি ভীত হইয়া, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ১০ই মা, বিনয় করিয়া এক পত্র লিখেন। ঐ পত্রের শেষে এই কথা লিখিত ছিল, যাহা আপনার উচিত বোধ হয়
ক্লাইব ইহাকেই ফরাসিদিগকে আক্রমণ করিবার অনুমতি গণনা করিয়া লইলেন, এবং অবিলম্বে সৈন্য সহিত স্থলপথে চন্দন নগর যাত্রা করিলেন। ওয়াটসন সাহেব ও সমস্ত যুদ্ধজাহাজ সহিত জলপথে প্রস্থান কবিয়া ঐ নগরের নিকটে নঙ্গর করিলেন। ইঙ্গরেজদিগের সৈন্য চন্দন নগর অবরোধ করিল। ক্লাইব স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ সাহসিকতা সহকারে অশেষবিধ চেষ্টা করিয়াছি, লেন; কিন্তু জাহাজী সৈন্যদিগের ব্যাপারেই ঐ স্থান হস্তগত হয়। ইঙ্গরেজের। এপর্যন্ত ভারতবর্ষে যত যুদ্ধ করিয়াছিলেন, এই যুদ্ধ সেই সর্বাপেক্ষা ভয়ানক। নয় দিন অবরোধের পর চন্দননগর পরাজিত হইয়াছিল। সচরাচর সকলেই কহিয়া থাকে, ইঙ্গরেজেরা ফরাসি সৈন্য ও সেনাপতিদিগকে উৎকোচ দিয়া বশীভূত করে। তাহাদিগের বিশ্বাসঘাতকতাতেই চন্দন নগর পরাজয় হয়। এই জনরবের মূল এই; ফরাসি গবর্ণর ইঙ্গরেজদিগের জাহাজের গতিপ্রতিরোধার্থে, নৌকা ডুবাইয়া গঙ্গার প্রায় সমুদায় অংশ রুদ্ধ করিয়া কেবল এক অল্পপরিসর পথ মাত্র রাখিয়াছিলেন। এই বিষয় অতি অল্প লোকে জানিত। ফরাসিদিগের এক জন কর্মকর ছিল; তাহার, নাম টেরেনো; টেরেনো, কোন কারণ বশতঃ ফরাসি গবর্ণর রেনেড সাহেবের উপরি বিরক্ত হইয়া, ইঙ্গরেজদিগের পক্ষে আইসে, এবং ক্লাইকে ঐ পথ দেখাইয়া দেয়। পরে ঐ ব্যক্তি ইঙ্গরেজদিগের নিকট কর্ম্ম করিয়া কিছু টাকা উপার্জন করে; এবং ঐ উপার্জিত টাকার কিয়দংশ ফ্রান্সে আপন বৃদ্ধ পিতার নিকট পাঠাইয়া দেয়। কিন্তু তাহার পিতা এই টাকা গ্রহণ করেন নাই; বিশ্বাসঘাতকের দত্ত বলিয়া, ঘৃণা প্রদর্শন পূর্ব্বক ফিরিয়া পাঠান। ইহাতে টেরেনোর অন্তঃকরণে এমত নির্ব্বেদ উপস্থিত হইল যে সে উদ্বন্ধন দ্বারা প্রাণত্যাগ করিল। সিরাজউদ্দৌলার সহিত যে সন্ধি হয়, তদ্বারা ইঙ্গরেজেরা এক টাঁকশাল ও এক দুর্গ নির্মাণ করিবার অনুমতি পান। ষাটিবৎসরের অধিক হইবেক, তাঁহারা এই দুই বিষয়ের নিমিত্ত নিয়ত প্রার্থনা করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। কলিকাতার যে পুরাতন দুর্গ নবাব অনায়াসে অধিকার করেন, তাহা অতি গোপনে নির্ম্মিত হইয়াছিল। অতএব ক্লাইব, এই সন্ধির পরেই, এতদ্দেশীয় সৈন্যেৱা পরাজয় করিতে না পারে এরূপ এক দুর্গ নির্মাণ বিষয়ে কালবিলম্ব অনুচিত বিবেচনা করিয়া, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দে, দুর্গ নির্মাণ আরম্ভ করিলেন; এবং তৎসমাধান বিষয়ে অত্যন্ত সত্বর ও সযত্ন হইলেন। যখন নক্লা প্রস্তুত করিয়া আনে তখন তিনি তাহাতে কত ব্যয় হইবেক বুঝিতে পারেন নাই। অনন্তর কার্য্য আরম্ভ করিয়া ক্রমে ক্রমে দৃষ্ট হইল দুই কোটি টাকার ম্যূনে নির্ব্বাহ হইবেক না। কিন্তু তখন আর তাহার কোন পরিবর্ত্ত করিবার উপায় ছিল না: কলিকাতার বর্ত্তমান দুর্গ এইরূপে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্ম্মিত হইয়াছিল। সেই বৎসরেই এক টাঁকশালও নির্ম্মিত হয় এবং ঐ বৎসরের আগষ্ট মাসের উনবিংশ দিবসে বাঙ্গালা দেশে ইরেজদিগের টাকা প্রথম মুদ্রিত হয়।
ক্লাইব, এইরূপে পরাক্রম দ্বারা ইঙ্গরেজদিগের অধিকার পুনঃ স্থাপন করিয়া, মনে মনে স্থির করিলেন যে “পরাক্রম ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে এই অধিকার রক্ষা হইবেক না। তিনি প্রথমাবধিই নিশ্চিত বুঝিয়াছিলেন যে ইরেজের নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবেক না; অবশ্যই তাঁহাদিগকে অন্য অন্য উপায় দেখিতে হইবেক। ইহাও স্থির করিয়াছিলেন,ফরাসিদিগের সাহায্য পাইলে নবাব দুর্জ্জয় হইয়া উঠিবেন। অতএব যাহাতে ফরাসিরা পুনর্ব্বার বাঙ্গালাতে প্রবেশ করিতে না পায়, এবিষয়ে তিনি অত্যন্ত সতর্ক ও সচেষ্ট ছিলেন। তৎকালে দক্ষিণ রাজ্যে ফরাসিদিগের বুসি নামে এক সেনাপতি ছিলেন। তিনি অনেক দেশ জয় করিয়া অত্যন্ত পরাক্রান্ত হইয়াছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা ইঙ্গরেজদিগের প্রতি মুখে বন্ধুত্ব দৰ্শাইতেন; কিন্তু ঐ ফরাসি সেনাপতিকে, সৈন্য সহিত বাঙ্গালায় আসিয়া ইঙ্গরেজদিগকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত, পত্র দ্বারা বারম্বার আহ্বান করিতেছিলেন। নবাব ফরাসি সেনাপতিকে যে সকল পত্রলিখিয়াছিলেন,তাহার কয়েক খান ধরা পড়িয়া ক্লাইবের হস্তে আইসে। ইঙ্গরেজের সিরাজউদ্দৌলাকে খর্ব করিয়াছিলেন; এজন্য তিনি তাঁহাদিগের প্রতি অক্রোধ হইতে পারেন নাই। সময়ে সময়ে তাহার ক্রোধ উদ্বেল হইয়া উঠিত। অর্বাচীন নির্বোধ নবাব ক্রোধোদয় কালে উন্মত্তপ্রায় হইতেন; কিন্তু ক্রোধ নিবারণ হইলেই, ইরেজদিগের ভয় তাহার অন্তঃকরণে আবির্ভূত হইত। ওয়াটস নামে এক সাহেব, তাহার দরবারে ইরেজদিগের রেসিডেণ্ট ছিলেন। নবাব, এক দিন তাঁহাকে শূলে দিব বলিয়া ভয় দেখাইতেন, অপর দিন, তাঁহাকে মর্যাদাসূচক পরিচ্ছদ পুরস্কার পাঠাইতেন। এক দিন রাগে অন্ধ হইয়া ক্লাইবের পত্র ছিড়িয়া ফেলিতেন, দ্বিতীয় দিন, বিনয় ও দীনতা প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে পত্র লিখিতেন।
ইঙ্গরেজের বুঝিতে পারিলেন, যাবৎ এই দুর্দ্দান্ত বালক বাঙ্গালার শাসনকর্তা থাকিবেক, তাবৎ কোন প্রকারেই ভদ্রস্থতা নাই। অতএব, তাহারা কি উপায়ে নিরাপদ হইতে পারেন, মনে মনে এই বিষয় আন্দোলন করিতেছেন, এমত সময়ে দিল্লীর সম্রাটের কোষাধ্যক্ষ পরাক্রান্ত শেঠবংশীয়েরা,নবাবের সর্ব্বাধিকারী রাজা রায়। দুর্লভ, সৈন্যদিগের ধনাধ্যক্ষ সেনাপতি মিরজাফর এবং উমিচাঁদ ও খোজাবাজীদ নামক দুই জন ঐশ্বর্যশালী বণিক ইত্যাদি কতকগুলি প্রধান লোক তাঁহাদিগের নিকট এক পত্র প্রেরণ করিলেন। সিরাজউদ্দৌলা নিষ্ঠুরতা ও স্বেচ্ছাচার দ্বারা তাঁহাদের অন্তঃকরণে অত্যন্ত বিরগি উৎপাদন করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ, তাঁহারা আপনাদিগের ধন, মান, জীবন সর্ব্বদাই সঙ্কটাপন্ন বোধ করিতেন। পূর্ব্ব বৎসর, সকতজঙ্গকে সিংহাসনে নিবেশিত করিবার নিমিত্ত, সকলে একবাক্য হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের সে উদ্যোগ বিফল হইয়া যায়। এক্ষণে তাঁহারা,সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নির্মিত্ত প্রাণপর্যন্ত পণ করিয়া, ইঙ্গরেজদিগের নিকট সাহায্য প্রার্থনায় গোপনে ঐ পত্র প্রেরণ করেন।
ইঙ্গরেজেরা বিবেচনা করিলেন আমরা সাহায্য না করিলেও এই রাজবিপ্লব ঘটিবেক, সাহায্য করিলে আমাদিগের অনেক উপকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তৎকালীন কৌনসিলের মেম্বরেরা প্রায় সকলেই ভীরুস্বভাব ছিলেন; অতএব এমত গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে তাঁহাদের সাহস হইল না। এডমিরেল ওয়াটসন সাহেবও বিবেচনা করিয়াছিলেন, যাঁহারা এ পর্যন্ত কেবল সামান্যাকারে বাণিজ্য করিয়া আসিতেছেন, তাঁহাদের পক্ষে দেশাধিপতিকে পদচ্যূত করিতে উদ্যম করা অত্যন্ত অসমসাহসের কর্ম্ম। কিন্তু ক্লাইব অকুতোভয় ও অতান্ত সাহসী ছিলেন; সঙ্কট পড়িলে, তাঁহার ভয় না জন্মিয়া, কেবল উৎসাহেরি বৃদ্ধি হইত। অতএব তিনি উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত হইতে কোন ক্রমেই পরাঙ্মুখ হইলেন না।
ক্লাইব, এপ্রিল মে দুই মাস, মুরশিদাবাদের রেসিডেণ্ট ওয়াটস সাহেব দ্বারা, নবাবের প্রধান প্রধান কর্ম্মকারকদিগের সহিত গোপনে যোগাযোগ করিতে লাগিলেন; এমত গোপনে যে সিরাজউদ্দৌলা কিছুই জানিতে পারেন নাই। কিন্তু একবার তাঁহার মনে সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল। তখন তিনি মীরজাফরকে ডাকাইয়া কোরান স্পর্শ করাইয়া শপথ করান। তিনিও যথোক্ত প্রকারে শপথ করিয়া স্বীকার করেন, অমি কখন কৃতঘ্ন হইব না। সমুদায় প্রায় স্থির হইয়াছে, এমত সময়ে উমিচাঁদ সমুদায় উচ্ছিন্ন করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। নবাবের কলিকাতা আক্রমণ, কালে তাঁহার অনেক সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছিল, এই নিমিত্ত মূল্যস্বরূপ তাঁহাকে যথেষ্ট টাকা দিবার কথা নির্দ্ধারিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি, তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া, এক দিন বিকালে ওয়াটস সাহেবের নিকটে গিয়া, কহিলেন মীর জাফরের সহিত ইঙ্গরেজদিগের যে প্রতিজ্ঞাপত্র হইবেক,তাহাতে আমাকে আর ত্রিশ লক্ষ টাকা দিবার কথা লিখিয়া আমাকে দেখাইতে হইবেক; নতুবা আমি এখনি নবাবের নিকটে গিয়া এই সমুদায় পরামর্শ ব্যক্ত করিব। উমিচাঁদ এরূপ করিলে, ওয়াটস প্রভৃতি যে সকল ব্যক্তি এই ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের প্রাণ দণ্ড হইত। ওয়াটস সাহেব, কাল বিলম্বের নিমিত্ত, সেই বিশ্বাসঘাতককে অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা করিয়া, অবিলম্বে কলিকাতায় পত্র লিখিলেন।
এই সংবাদ পাইয়া ক্লাইব প্রথমতঃ একবারে হতবুদ্ধি হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি ধূর্ত্ততা ও প্রতারকতা বিষয়ে উমিচাঁদ অপেক্ষা অধিক পণ্ডিত ছিলেন; অতএব বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, উমিচাঁদ গহিত উপায় দ্বারা অর্থলাভের চেষ্টা করিতেছে। অতএব এ ব্যক্তি সাধারণের শত্রু। ইহার দুষ্টতা দমনের নিমিত্ত যে কোন প্রকার চাতুরী করা অন্যায় নহে। অতএব আপাতত ইহার দাওয়া অঙ্গীকার করা যাউক। পরে এ ব্যক্তি আমাদের হস্তে আসিবেক। তখন ইহাকে ফাকি দেওয়া যাইবেক। এই স্থির করিয়া, তিনি, ওয়াটস সাহেবকে উমিচাঁদের দাওয়া স্বীকার করিতে আজ্ঞা দিয়া, দুই খান প্রতিজ্ঞাপত্র প্রস্তুত করিলেন, এক খান শ্বেত বর্ণের, দ্বিতীয় লোহিত বর্ণের; এই লোহিত পত্রে উমিচাঁদকে ত্রিশ লক্ষ টাকা দিবার কথা লেখা রহিল; শ্বেত পত্রে সে কথার উল্লেখ রহিল না। কিন্তু ওয়াটসন সাহেব ক্লাইবের ন্যায় নিতান্ত ধর্ম্মজ্ঞানশূন্য ছিলেন না; অতএব তিনি প্রতারণাঘটিত লোহিত প্রতিজ্ঞা পত্রে স্বীয় নাম স্বাক্ষরিত করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু উমিচাঁদ অত্যন্ত চতুর ও অত্যন্ত সতর্ক। সে প্রতিজ্ঞাপত্রে ওয়াটসনের নাম স্বাক্ষরিত না দেখিলে নিঃসন্দেহ সন্দেহ করিবেক। ক্লাইব কোন কর্ম্ম অঙ্গহীন করিতেন না; এবং স্বার্থসাধনের নিমিত্ত সকল কর্ম্মই করিতে পারিতেন। তিনি ওয়াটসন সাহেবের নাম জাল করিলেন। লোহিত পত্র উমিচাঁদকে দেখা গেল এবং তাহাতেই তাঁহার মন সুস্থ হইল। অনন্তর মীরজাফরের সহিত এই নিয়ম হইল, যে ইঙ্গরেজেরা যেমন অগ্রসর হইবেন, তিনি, স্বীয় প্রভুর সৈন্য হইতে আপন সৈন্য পৃথক করিয়া, ইঙ্গরেজদিগের সহিত মিলিত হইবেন।
এইরূপে সমুদায় স্থিরীকৃত হইলে, ক্লাইব সিরাজউদ্দৌলাকে এই পত্র লিখিলেন যে, আপনি ইঙ্গরেজদিগের অনেক অনিষ্ট করিয়াছেন; সন্ধি পত্রের নিয়ম লঙ্ঘন করিয়াছেন; যে যে ক্ষতি পূরণ স্বীকার করিয়াছিলেন, তাহা করেন নাই; এবং ইঙ্গরেজদিগকে বাঙ্গালা হইতে তাড়াইয়া দিবার নিমিত্ত, ফরাসিদিগকে আহ্বান করিয়াছেন। অতএব আমি স্বয়ং মুরশিদাবাদ যাইতেছি। আপনকার সভার প্রধান প্রধান লোক দিগের উপর ভার দিব, তাঁহারা সকল বিষয়ের মীমাংসা করিয়া দিবেন। নবাব, এই পত্রের লিখনভঙ্গী দেখিয়া, এবং ক্লাইব স্বয়ং আসিতেছেন ইহা পাঠ করিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন এবং অবিলম্বে সৈন্য সংগ্রহ করিয়া পলাশি অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ক্লাইবও, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের জুন মাসের আরম্ভেই,আপন সৈন্য লইয়া যাত্রা করিলেন। তিনি, ১৭ই, কাটোয়াতে উপস্থিত হইলেন এবং পর দিন তথাকার দুর্গ আক্রমণ ও অধিকার করিলেন।
১৯এ জুন, ঘোরতর বর্ষা আরম্ভ হইল। ক্লাইব, পার হইয়া নবাবের সহিত যুদ্ধ করি কি ফিরিয়া যাই, মনে মনে এই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। যেহেতু তিনি তৎকাল পর্যন্ত মীরজাফরের কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলেন না এবং তাঁহার এক খানি পত্রিকাও প্রাপ্ত হইলেন না তখন তিনি সকল সেনাপতি দিগকে একত্র করিয়া পরামর্শ করিতে বসিলেন। তাঁহারা সকলেই যুদ্ধের বিষয়ে অসম্মতি প্রকাশ করিলেন। ক্লাইবও প্রথমতঃ তাঁহাদের সিদ্ধান্তই গ্রাহ্য করিয়াছিলেন; কিন্তু পরিশেষে, অভিনিবেশ পূর্ব্বক বিবেচনা করিয়া,ভাগ্যে যাহা থাকে ভাবিয়া, যুদ্ধ পক্ষই অবলম্বন করিলেন। তিনি স্থির বুঝিয়াছিলেন যদি এত দূর আসিয়া এখন ফিরিয়া যাই, তাহা হইলে বাঙ্গালাতে ইঙ্গরেজদিগের অভ্যুদয়ের আশা এক বারেই উচ্ছিন্ন হইবেক।
২২এ জুন, সূর্য্যোদয়কালে সৈন্য সকল গঙ্গা পার হইতে আরম্ভ করিল। দুই প্রহর চারিটার সময়, সমুদয় সৈন্য অপর পারে উত্তীর্ণ হইল। তাহারা অবিশ্রান্ত গমন করিয়া রাত্রি দুই প্রহর একটার সময় পলাশির উদ্যানে উপস্থিত হইল। প্রভাত হইবামাত্র যুদ্ধারম্ভ হইল। ক্লাইব উৎকণ্ঠিত চিত্তে মীরজাফরের ও তদীয় সৈন্যের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তখন পর্যন্তও তাঁহার ও তদীয় সৈন্যের কোন চিহ্ন দেখা গেল না। যুদ্ধক্ষেত্রে নবাবের পঞ্চদশ সহস্র অশ্বারোহ ও পঞ্চত্রিংশৎ সহস্র পদাতিক সৈন্য উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু তিনি স্বয়ং, চাটুকার বর্গে বেষ্টিত হইয়া, সকলের পশ্চাদ্ভাগে তাঁবুমধ্যে ছিলেন। মিরমদন নামক একজন সেনাপতি যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছিলেন। মিরজাফর আত্মসৈন্য সহিত তথায় উপস্থিত ছিলেন কিন্তু যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন নাই।
বেলা প্রায় দুই প্রহরের সময়, কামানের গোলা লাগিয়া সেনাপতি মিরমদনের দুই পা উড়িয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ নবাবের তাবুতে আনীত হইলেন এবং তাঁহার সম্মুখেই প্রাণত্যাগ করিলেন। তদৃষ্টে নবাব যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন এবং ভৃত্যদিগকে বিশ্বাসঘাতক বলিয়া সন্দেহ করিতে লাগিলেন। তখন তিনি মীরজাফরকে ডাকাইয়া আনিলেন; এবং তাঁহার চরণোপরি স্বীয় উষ্ণীষ স্থাপন করিয়া, অতিশয় দীনতা প্রদর্শন পূর্ব্বক এই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন যে, নিদান আমার মাতামহের অনুরোধেও, আমার অপরাধ ক্ষমা করিয়া, এই বিষম বিপদের সময় সহায়তা কর।
জাফর এই অঙ্গীকার করিলেন আমি আত্মধর্ম্ম প্রতিপালন করিব; এবং তাহার প্রমাণ স্বরূপ নবাবকে পরামর্শ দিলেন, অদ্য বেলা অত্যন্ত অধিক হইয়াছে; সৈন্য সকল ফিরাইয়া আনুন। যদি জগদীশ্বর কৃপা করেন তবে কল্য আমরা সমুদায় সৈন্য একত্র করিয়া যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইব। তদনুসারে নবাব সেনাপতিদিগকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইবার আজ্ঞা পাঠাইলেন। নবাবের সেনাপতি মোহনলাল ইঙ্গরেজদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতেছিলেন; কিন্তু নবাবের এই আজ্ঞা পাইয়া অত্যন্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক নিবৃত্ত হইলেন। তিনি অকস্মাৎ ক্ষান্ত হওয়াতে,সৈন্যদিগের উৎসাহ ভঙ্গ হইল। তখন তাহারা ভঙ্গ দিয়া চারি দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল; সুতরাং ক্লাইবের অনায়াসে সম্পর্ণ জয় লাভ হইল। কিন্তু যদি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক না হইতেন এবং ঈদৃশ সময়ে এরূপ প্রতারণা না করিতেন, তাহা হইলে ক্লাইবের কোন ক্রমেই জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল না।
তদনন্তর সিরাজউদ্দৌলা এক উষ্ট্রে আরোহণ করিয়া, দুই সহস্র অশ্বারোহ সমভিব্যাহারে, সমস্ত রাত্রি গমন করত,পর দিন বেলা ৮ টার সময়, মুরশিদাবাদে উপস্থিত হইলেন, এবং উপস্থিত হইয়াই, আপনার প্রধান প্রধান ভৃত্য ও অমাত্যবর্গকে সন্নিধানে আসিতে আজ্ঞা করিলেন। কিন্তু তাহারা সকলেই স্ব স্ব আলয়ে প্রস্থান করিল। অনের কথা দূরে থাকুক, সে সময়ে তাঁহার শ্বশুর পর্যন্তও তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া যান। নবাব সমস্ত দিন একাকী আপন প্রাসাদে কাল হরণ করিলেন; পরিশেষে নিতান্ত হতাশ হইয়া, রাত্রি ৩ টার সময়, মহিষীগণ ও কতিপয় প্রিয় পাত্র মাত্র সমভিব্যাহারে করিয়া,শকটাররাহণ পূর্ব্বক ভগবানগোলা পলায়ন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, ফরাসি সেনাপতি লা সাহেবের সহিত সমাগত হইবার নিমিত্ত, নৌকারোহণ পূর্ব্বক জল পথে প্রস্থান করিলেন। ইতি পূর্ব্বে তিনি ঐ সেনাপতিকে পাটনা হইতে আসিতে পত্র লিখিয়াছিলেন।
পলাশির যুদ্ধে ইঙ্গরেজদিগের, হত আহত সমুদায়ে, কুড়ি জন গোরা ও পঞ্চাশ জন সিপাই নষ্ট হয়। যুদ্ধ সমাপ্তির পর, মীরজাফর, ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার রণজয় নিমিত্ত সভাজন ও হর্ষ প্রকাশ করিলেন। অনন্তর উভয়ে একত্র হইয়া মুরশিদাবাদ যাত্রা করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া মীরজাফর রাজকীয় প্রাসাদ অধিকার করিলেন। নগরের প্রধান প্রধান লোক ও রাজ্যের প্রধান প্রধান কর্ম্মকারকেরা রাজসভায় উপস্থিত হইলেন। তখন ক্লাইব, আপন আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, মীরজাফরের করগ্রহণ পূর্ব্বক সিংহাসনে বসাইয়া, তাঁহাকে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বলিয়া সম্ভাষণ ও বন্দনা করিলেন। তৎপরে তাঁহারা উভয়ে, কয়েক জন ইউরোপীয় ভদ্র লোককে এবং ক্লাইবের দেওয়ান রামচাঁদ ও তাঁহার মুন্সী নবকৃষ্ণকে সঙ্গে লইয়া, ধনাগারে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু তন্মধ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয়ে দুই কোটি টাকার অধিক দেখিতে পাইলেন না।
তৎকালের মুসলমান ইতিহাসলেখক কহেন যে ইহা কেবল বাহ্য ধনাগার মাত্র। এতদ্ভিন্ন, অন্তঃপুরে আর এক ধনাগার ছিল। ক্লাইব তাহার সন্ধান পান নাই। ঐ কোষে স্বর্ণ, রজত ও রত্নে আট কোটি টাকার ম্যূন ছিল না। মীরজাফর, আমীরবেগ খাঁ, রামাচাঁদ, নবকৃষ্ণ এই কয়েক জনে ঐ ধন ভাগ করিয়া লয়। উক্ত পুরাবৃত্তজ্ঞের এই নির্দেশ নিতান্ত অমূলক বা অসম্ভব বোধ হয় না। কারণ, রামচাঁদ তৎকালে কেবল ষাটি টাকা মাত্র মাসিক বেতন পাইতেন; কিন্তু দশ বৎসর পরে তিনি এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকার বিষয় রাখিয়া মরেন। মুন্সী নবকৃষ্ণেরও মাসিক বেতন ষাটি টাকার অধিক ছিল না; কিন্তু তিনি মাতৃ শ্রাদ্ধ উপলক্ষে নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন। এই মহাপুরুষই পরিশেষে রাজোপাধি প্রাপ্ত হইয়া রাজা নবকৃষ্ণ নামে বিখ্যাত হয়েন।
অতঃপর ইঙ্গরেজরা সকল সঙ্কট হইতে মুক্ত হইলেন। ১৭৫৬ খৃঃ অব্দের জুন মাসে, তাঁহাদের কুঠী লুঠ হয়, বাণিজ্য উচ্ছিন্ন হয়, এবং কর্ম্মকারকদিগের প্রাণ দণ্ড হয়। বস্তুতঃ, তাঁহারা বাঙ্গালাতে একবারে সন্ধ প্রকার সম্বন্ধ শূন্য হইয়াছিলেন। কিন্তু, ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের জুন মাসে, তাঁহারা কেবল আপনাদিগের কুঠী সকলই পুনর্ব্বার অধিকার করিলেন, এমত নহে; আপনাদিগের বিপক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজয় করিলেন,অনুগত এক ব্যক্তিকে নবাব করিলেন; এবং উহাদের প্রতিদ্বন্দ্বি ফরাসিরা বাঙ্গালা হইতে দূরীকৃত হইলেন। নবাব কলিকাতা আক্রমণ করাতে, কোম্পানি বাহা দুরের এবং ইঙ্গরেজ, বাঙ্গালি ও আরমানিদিগের যথেষ্ট ক্ষতি হইয়াছিল; সেই ক্ষতির এইরূপে পূরণ করা গেল। কোম্পানি বাহাদুর এক কোটি টাকা পাইলেন; ইঙ্গরেজেরা পঞ্চাশ লক্ষ; বাঙ্গালি বণিকেরা বিশ লক্ষ; আরমানি বণিকেরা সাত লক্ষ। এ সমস্ত ভিন্ন, সৈন্যদিগকেও অনেক পারিতোষিক দেওয়া গেল। আর কোম্পানির যে সকল কর্ম্মকারকেরা মীরজাফরকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিয়াছিলেন তাঁহারাও বঞ্চিত হইলেন না। ক্লাইব ষোল লক্ষ টাকা পাইলেন এবং কৌন্সিলের অন্যান্য মেম্বরের কিছু কিছু ন্যূন সংখ্যায় প্রাপ্ত হইলেন। ইহাও নির্ধারিত হইল, পূর্ব্বে ইঙ্গরেজদিগের যে যে অধিকার ছিল সে সমস্তই বজায় থাকিবেক; মহারাষ্ট্রখাতের অন্তর্গত সমুদায় স্থান, ও তাহার বাহ্যে ছয় শত ধনুঃ পর্যন্ত,ইঙ্গরেজদিগের হইবেক; কলিকাতার দক্ষিণ কুল্পী পর্যন্ত সমুদায় দেশ কোম্পানির জমীদারী হইবে; আর ফরাসিরা কোন কালেই এতদ্দেশে বাস করিবার অনুমতি পাইবেন না।
সিরাজউদ্দৌলা, ভগবানগোলা হইতে রাজমহলে পহুছিয়া, আপন স্ত্রী ও কন্যার জন্য অন্ন পাক করিবার নিমিত্ত, এক ফকীরের কুটীরের নিকট উপস্থিত হইলেন। পূর্বে সেই ফকীরের উপর তিনি অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন। এক্ষণে ঐ ব্যক্তি তাঁহারা অনুসন্ধানকারিদিগকে তৎক্ষণাৎ তাঁহার পহুছ সংবাদ দিলে, তাহারা আসিয়া তাঁহাকে রুদ্ধ করিল। সপ্তাহ পূর্ব্বে,তিনি ঐ সকল ব্যক্তির সহিত আলাপও করিতেন না; কিন্তু এক্ষণে অতি দীন বাক্যে তাহাদিগের নিকট বিনয় করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহারা, তদীয় বিনয় বাক্য শ্রবণে বধির হইয়া, তাঁহার সমস্ত স্বর্ণ ও রত্ন লুঠিয়া লইল এবং তাঁহাকে মুরশিদাবাদে প্রত্যায়ন করিল। যৎকালে তিনি নগরে আনীত হইলেন, তখন মীরজাফর অধিকমাত্রায় অফেণ খাইয়া তন্দ্রাবেশে ছিলেন। তাঁহার পুত্র,অতি পাপাত্মা মীরন,সিরাজউদ্দৌলাকে উপস্থিত শুনিয়া তাঁহাকে আপন আলয় সন্নিধানে রুদ্ধ করিতে আজ্ঞা দিল,এবং দুই এক ঘণ্টার মধ্যেই স্বীয় বয়স্যগণের নিকট তাঁহার প্রাণ বধের ভারগ্রহণের প্রস্তাব করিল। কিন্তু তাহারা একে একে সকলেই অস্বীকার করিল। আলিবর্দি খাঁ মহম্মদিবেগ নামক এক ব্যক্তিকে প্রতিপালন করিয়াছিলেন। পরিশেষে, সেই দুরাত্মাই এই নিষ্ঠুর ব্যাপার সমাধানের ভার গ্রহণ করিল। সে গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র, হতভাগ্য নবাব, তাহার আগমনের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া, করুণস্বরে কহিলেন আমি যে বিনা অপরাধে হুসেনকুলি খাঁর প্রাণদণ্ড করিয়াছিলাম তাহার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আমাকে অবশ্যই প্রাণত্যাগ করিতে হইবেক। এই বাক্য উচ্চারণ করিবামাত্র, দুরাচার মহম্মদিবেগ তরবারি দ্বারা তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিল। উপর্য্যুপরি কয়েক আঘাতের পর, তিনি, হুসেনকুলি খাঁর প্রাণদণ্ডের প্রতিফল পাইলাম, এই বলিয়া মৃত ও ভূতলে পতিত হইলেন।
অনন্তর তাঁহার মৃত দেহকে খণ্ড খণ্ড করিল; এবং অযত্ন ও অনাদর পূর্ব্বক হস্তিপৃষ্ঠে নিক্ষিপ্ত করিয়া, জনাকীর্ণ রাজ পথ দিয়া, কবর দিবার স্থানে লইয়া চলিল। ঐ সময়ে সকলেই লক্ষ্য করিয়াছিল যে, কোন কারণ বশতঃ পথের মধ্যে মাহুতের থামিবার আবশ্যক হওয়াতে, আঠার মাস পূর্ব্বে সিরাজউদ্দৌলা যে স্থানে হুসেনকুলি খাঁর প্রাণবধ করিয়াছিলেন, ঐ হস্তী ঠিক সেই স্থানে দণ্ডায়মান হয়; এবং যে ভূভাগে বিনাপরাধে হুসেনের শোণিতপাত করিয়াছিলেন ঠিক সেইস্থানে,তাঁহার খণ্ডিত কলেবর হইতে, কতিপয় রুধিরবিন্দু নিপতিত হয়।
তৃতীয় অধ্যায়।
মীরজাফরের প্রভুত্ব এককালে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা তিন প্রদেশে অব্যাহতরূপে অঙ্গীকৃত হইল। কিন্তু অতি অল্প কালেই প্রকাশ পাইল তাঁহার কিছুমাত্র বিষয়বুদ্ধি নাই। তিনি স্বভাবতঃ নির্ব্বোধ, নিষ্ঠুর ও অর্থলোভী ছিলেন। রাজ্যের প্রধান প্রধান হিন্দু কর্ম্মকরেরা, পূর্ব্ব পূর্ব্ব নবাবদিগের অধিকার কালে, অনেক ধন সঞ্চয় করিয়াছিলেন; তিনি, প্রথমতঃ, তাঁহাদিগের সর্ব্বস্ব হরণ মনস্থ করিলেন। প্রধান মন্ত্রী রাজা রায়দুর্লভ কেবল অত্যন্ত ধনবান ছিলেন, এমত নহে; তাঁহার নিজের ছয় সহস্র সৈন্যও ছিল। মীরজাফর সর্ব্বাগ্রে তাঁহাকেই লক্ষ্য করিলেন।
মীরজাফরকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিবার বিষয়ে রাজা রায়দুর্লভই প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। যখন সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত চক্রান্ত হয়, তখন রায় দুর্লভই চক্রান্তকারিদিগের নিকট প্রস্তাব করেন যে মীরজাফরকে নবাব করা উচিত। তথাপি, মীরজাফর এক্ষণে রায়দুর্লভের সর্ব্বনাশের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলেন। ফলতঃ, তাঁহার উপর মীরজাফরের এমত বিষম বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল যে তাঁহার সহিত সিরাজউদ্দৌলার কনিষ্ঠ ভ্রাতার বন্ধুতা আছে, এই সন্দেহ করিয়া, সেই অল্পবয়স্ক নিরপরাধ রাজকুমারের প্রাণবধ করিলেন। রায়দুর্লভও কেবল ইঙ্গরেজদিগের শরণাগত হইয়া সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলেন।
রাজা রামনারায়ণ বহুকালাবধি বিহারের ডেপুটী গবর্ণর ছিলেন। নবাব মনস্থ করিলেন, তাঁহাকে পদচ্যুত করিয়া তদীয় সমুদায় সম্পত্তি অপহরণ করিবেন, ও ‘ আপন ভ্রাতাকে গবর্নরী পদ দিবেন। ক্লাইবের মতে, মীরজাফরের ভ্রাতা মীরজাফর অপেক্ষাও নির্ব্বোধ। নবাব মেদিনীপুরের গবর্ণর রাজা রামসিংহের ভ্রাতাকে কারাগারে রুদ্ধ করিলেন; তাহাতে রামসিংহও তাঁহার প্রতি ভগ্নম্নেহ হইলেন। পূর্ণিয়ার ডেপুটী গবর্ণর অদল সিংহ মন্ত্রিদিগের কুমন্ত্রণা অনুসারে রাজবিদ্রোহে অভ্যুত্থান করিলেন।
এইরূপে, মীরজাফরের সিংহাসনারোহণের পর পাঁচ মাসের মধ্যে, তিন প্রদেশে তিন বিদ্রোহ ঘটে। তখন তিনি ব্যাকুল হইয়া, বিদ্রোহ শান্তির নিমিত্ত, ক্লাইবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। তৎকালে ক্লাইব বাঙ্গালাতে সকলেরি বিশ্বাসভূমি ছিলেন। এই বিশ্বাস অপাত্রে বিন্যস্ত হয় নাই। যেহেতু তিনি উপস্থিত তিন বিদ্রোহের শান্তি করিলেন, অথচ এক বিন্দুও রক্তপাত হইল না। নবাব বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করতে ক্লাইব পাটনা যাইবার সময় মুরশিদাবাদ হইয়া যান। নবাব ইঙ্গরেজদিগকে যত টাকা দিতে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, এপর্য্যন্ত তাহার অধিকাংশই পরিশোধ করেন নাই। অতএব, ক্লাই রাজধানীতে উত্তীর্ণ হইয়া নবাবকে জানাইলেন যে সে সকল পরিশোধ করিবার কোন বন্দোবস্ত অবশ্য করিতে হইবেক। নবাব তদনুসারে, দেয় পরিশোধ স্বরূপ, বর্দ্ধমান, নদীয়া ও হুগলী এই তিন প্রদেশের রাজস্ব তাঁহাকে নির্দ্ধারিত করিয়া দিলেন।
এই বিষয় নিষ্পত্তি হইলে পর, ক্লাইব ও নবাব স্ব স্ব সৈন্য লইয়া পাটনা যাত্রা করিলেন। তাঁহারা তথায় উপস্থিত হইলে, রামনারায়ণ ক্লাইবের শরণাগত হইয়া কহিলেন যদি ইঙ্গরেজেরা আমাকে অভয়দান করেন, তাহা হইলে আমি আপন প্রভুর আজ্ঞানুবর্তী থাকিতে পারি। ক্লাইব বিস্তর বুঝাইলে পর, নবাব রামনারায়ণের প্রতি অক্রোধ হইলেন। অনন্তর রামনারায়ণ অবিলম্বে মীরজাফরের শিবিরে গিয়া তাঁহার সমুচিত সম্মান করিলেন। মীরজাফর এ যাত্রা তাঁহাকে পদচ্যুত করিলেন না। পরে ক্লাইব ও নবাব একত্র হইয়া মুরশিদাবাদ প্রত্যাগমন করিলেন। রাজা রায়দুর্লভ পূর্ব্বাপর তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে ছিলেন। তিনি মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন, ইঙ্গরেজেরা যাবৎ উপস্থিত আছেন, তত দিনই রক্ষার সম্ভাবনা।
পাটনার ব্যাপার এইরূপে নিষ্পন্ন হওয়াতে, জাফরের পুত্র মীরন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহাদের পিতাপুত্রের এই অভিপ্রায় ছিল পরাক্রান্ত হিন্দুদিগের দমন ও সর্ব্বস্বহরণ করিবেন। কিন্তু এ যাত্রায় তাহা না হইয়া, বরং তাহাদিগের পরাক্রমের দৃঢ়ীকরণই হইল। সুতরাং তাঁহারা উভয়েই ক্লাইকের এইরূপ ক্ষমতা দর্শনে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। মীরজাফর শুনিতে তিন প্রদেশের নবাব ছিলেন বটে; কিন্তু বাস্তবিক তিনি কিছুই ছিলেন না; ক্লাইবই সকল ছিলেন।
দুই বৎসর পুর্ব্বে ইঙ্গরেজদিগকে, নবাবের নিকট স্বপক্ষে একটি অনুকুল কথা বলাইবার নিমিত্ত, টাকা দিয়া যে সকল প্রধান লোকের উপাসনা করিতে হইত; এক্ষণে সেই সকল ব্যক্তিকে ইঙ্গরেজদিগের উপাসনা করিতে হইল। মুসলমানেরা দেখিতে লাগিলেন, চতুর হিন্দুরা অকর্মণ্য নবাবের আনুগত্য পরিত্যাগ করিয়া, ক্লাইবের নিকটেই সকল বিষয়ের প্রার্থনা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু ক্লাইব সেই সকল বিষয়ে এমত বিজ্ঞতা ও বিবেচনা পূর্ব্বক কার্য্য করিতেন যে যাবৎ তাঁহার হস্তে সকল বিষয়ের কর্তৃত্ব ভার ছিল তাবৎ কোন বিষয়েই গোলযোগ উপস্থিত হয় নাই।
হতভাগ্য দিল্লীশ্বরের পুত্র, শাহ আলম, প্রয়াগ ও অষধ্যার সুবাদারের সহিত সন্ধি করিয়া, বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া, বিহারদেশ আক্রমণ করিতে উদ্যত হই লেন। ঐ দুই সুবাদারের,এই সুযোগে বাঙ্গালা রাজ্যের কোন অংশ আত্মসাৎ করিতে পারা যায় কি না, এই চেষ্টা দেখা যেরূপ অভিপ্রেত ছিল, উক্ত রাজকুমারের সাহায্য করা সেরূপছিলনা। শাহআলম ক্লাইকে পত্র লিখিলেন, যদি আপনি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করেন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্রমে ক্রমে এক এক প্রদেশের আধিপত্য প্রদান করি। কিন্তু ক্লাইব উত্তর দিলেন, আমি মীরজাফরের বিপক্ষতাচরণ করিতে পারিব না। শাহআলম, সম্রাটের সহিত বিবাদ করিয়া, তদীয় সম্মতি ব্যতিরেকেই বিহারদেশ আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন; এই নিমিত্ত, সম্রাটও ক্লাইবকে এই আজ্ঞা পত্র লিখিলেন আপনি আমার বিদ্রোহি পুত্রকে, দেখিতে পাইলেই, রুদ্ধ করিয়া আমার নিকট পাঠাইবেন।
মীরজাফরের সৈন্য সকল, বেতন না পাওয়াতে, অত্যন্ত অবাধ্য হইয়াছিল; সুতরাং, তদ্বারা এই আক্রমণ নিবারণের কোন সম্ভাবনা ছিল না। অতএব তাঁহাকে, উপস্থিত বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইবার নিমিত্ত, পুনৰ্বার ক্লাইবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিতে হইল। তদনুসারে ক্লাইব সত্ত্বর হইয়া, ১৭৫৮ খৃঃ অব্দে, পাটনা যাত্রা করিলেন। কিন্তু, ক্লাইবের উপস্থিতির পূর্ব্বেই, এই ব্যাপার এক প্রকার নিষ্পন্ন হইয়া ছিল। রাজকুমার ও প্রয়াগের সুবাদার নয় দিবস পাটনা অবরোধ করিয়াছিলেন। বোধ হয় ঐ স্থান তাঁহাদের হস্তগত হইতে পারিত। কিন্তু তাঁহারা শুনিলেন ইঙ্গরেজেরা আসিতেছেন, এবং অযোধ্যার সুবাদার, প্রয়াগের সুবাদারের অনুপস্থিতি রূপ সুযোগ পাইয়া, বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ব্বক হার রাজধানী অধিকার করিয়াছেন। এই সংবাদ পাইয়া, প্রয়াগের সুবাদার, আপন উপায় আপনি চিন্তা করুন এই বলিয়া, রাজকুমারের নিকট বিদায় লইয়া, স্বীয় রাজ্য রক্ষার্থে সত্বর হইলেন। কিন্তু তদুপলক্ষে যে যুদ্ধ উপস্থিত হইল তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইল। রাজকুমারের সৈন্যের অতি শীঘ্র তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল; কেবল তিন শত ব্যক্তি মাত্র তাঁহার অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া রহিল। পরিশেষে তাঁহার এমত দুরবস্থা ঘটিয়াছিল যে তিনি ক্লাইবের নিকট ভিক্ষার্থে লোক প্রেরণ করেন। ক্লাইব বদান্যতা প্রদর্শন পূর্ব্বক রাজকুমারকে সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা পাঠাইয়া দেন।
মীরজাফর, এইরূপে উপস্থিত বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইয়া, কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ ক্লাইবকে ওমরা উপাধি দিলেন; এবং কোম্পানিকে নবাব সরকারে কলিকাতার জমীদারীর যে রাজস্ব দিতে হইত, তাহা তাঁহাকে জায়গীর স্বরূপ দান করিলেন। নির্দিষ্ট আছে ঐ রাজস্ব বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা ছিল।
এই সকল ঘটনার কিছু দিন পরে, মীরজাফর কলিকাতায় আসিয়া ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; এবং তিনিও যৎপরোনাস্তি সমাদর পূর্ব্বক তাঁহার সম্বর্ধনা করিলেন। তিনি তথায় থাকিতে থাকিতেই, ওলন্দাজদিগের সাত খান যুদ্ধজাহাজ নদী মূখে আসিয়া নঙ্গর করিল। ঐ সাত জাহাজে পঞ্চদশ শত সৈন্য ছিল। অতি ত্বরায় ব্যক্ত হইল, ঐ সকল জাহাজ নবাবের সম্মতি ব্যতিরেকে আইসে নাই। ইঙ্গরেজদিগকে দমনে রাখিতে পারে, এমত এক দল ইউরোপীয় সৈন্য আনাইবার নিমিত্ত, তিনি কিয়ৎকালাবধি চুঁচুড়াবাসি ওলন্দাজদিগের সহিত মন্ত্রণ করিতেছিলেন। খোজাবাজীদ নামক এক কাশ্মীরদেশীয় বণিক্ এই সকল কুমন্ত্রণার সাধক হইয়াছিলেন।
খোজাবাজীদ আলিবর্দি খাঁর অত্যন্ত অনুগ্রহপত্র ছিলেন। লবণব্যবসায় তাঁহার একচাটিয়া ছিল। তিনি এমত ঐশ্বর্যশালী ছিলেন যে সহস্র মুদ্রা তাঁহার দৈনন্দিন ব্যয় ছিল; এবং এক বার তিনি নবাবকে পঞ্চদশ লক্ষ টাকা উপহার দিয়াছিলেন। পূর্ব্বে তিনি মুরশিদাবাদে ফরাসিদিগের এজেণ্ট ছিলেন। পরে, চন্দননগর পরাজয় দ্বারা তাঁহাদিগের অধিকার উচ্ছিন্ন হইলে, ইঙ্গরেজদিগের পক্ষে আইসেন।
সিরাজউদ্দৌলা তাঁহাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু উক্ত নবাবকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত, ইঙ্গরেজদিগকে আহ্বান করিবার বিষয়ে, তিনিই প্রধান উদ্যোগ হইয়াছিলেন। রাজবিপ্লবের পর তিনি দেখিলেন যে ইঙ্গরেজদিগের নিকট যে সকল আশা করিয়াছিলেন, তাহা পূর্ণ হইল না। অতএব ইঙ্গরেজদিগের দমন করিবার নিমিত্ত, বহুসংখ্যক ওলন্দাজী সৈন্য আনয়ন বিষয়ে যত্নবান হইয়াছিলেন।
তৎকালে চুঁচুড়ার কৌন্সিলে দুই পক্ষ ছিল। তন্মধ্যে এক পক্ষের প্রধান গবর্ণর বিসদম সাহেব। ইনি ক্লাইবের বন্ধু ছিলেন। তাহার নিতান্ত বাসনা, কোন রূপে সন্ধি ভঙ্গ না হয়। আর রর্ণেট নামক এক ব্যক্তি অন্য পক্ষের প্রধান ছিলেন। এই পক্ষের লোকেরা অত্যন্ত উদ্ধত ছিলেন; এবং তাঁহাদিগের মতানুসারেই চুঁচুড়ার সমুদায় কার্য্য সম্পন্ন হইত। ইতিপূর্বে ইঙ্গরেজেরা, আপনাদের মঙ্গলের নিমিত্ত, ওলন্দাজদিগকে নিষেধ করিয়াছিলেন, যে আপনারা এই নদীতে সজাতীয় নাবিক রাখিতে পরিবেন না। অতএব ওলন্দাজেরী, বহুসংখ্যক সৈন্য পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, বটেবিয়াতে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাঁহারা মনে মনে আশা করিয়াছিলেন এতদ্দেশে এক্ষণে নানা বিশৃঙ্খলতা ঘটিয়াছে; এই সুযোগে আপনাদিগের অনেক ইষ্টসাধন করিতে পারা যাইবেক।
এই সৈন্যের উপস্থিতিতে, ক্লাইব অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন। তৎকালে ওলন্দাজদিগের সহিত ইঙ্গরেজদিগের সন্ধি ছিল। এবং তাঁহাদিগের যত ইউরোপীয় সৈন্য থাকে, ইঙ্গরেজদিগের তাহার তৃতীয়াংশের অধিক ছিল না। যাহা হউক, তিনি স্বীয় স্বভাবসিদ্ধ পরাক্রম ও অকুতোভয়তা সহকারে কার্য্য করিতে লাগিলেন।
ক্লাইব, বাঙ্গালাতে ফরাসিদিগের প্রাধান্য লোপ করিয়া, মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন ওলন্দাজদিগকেও প্রবল হইতে দিব না। অতএব তিনি মীরজাফরকে কহিলেন আপনি, ওলন্দাজী সৈন্য সকলকে প্রস্থান করিতে, অবিলম্বে আজ্ঞা প্রদান করুন। নবাব কহিলেন আমি স্বয়ং হুগলীতে গিয়া এ বিষয়ের শেষ করিব। কিন্তু, তথায় উপস্থিত হইয়া, তিনি ক্লাইবকে পত্র লিখিলেন, আমি ওলন্দাজদিগের সহিত বন্দোবস্ত করিয়াছি; প্রস্থানের উপযুক্ত কাল উপস্থিত হইলেই তাহাদিগের সমুদায় জাহাজ চলিয়া যাইবেক।
ক্লাইব, এই চাতুরীর মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়া, স্থির করিলেন ওলন্দাজী জাহাজ সকল আর অগ্রসর হইতে দেওয়া উচিত নহে। অতএব, কলিকাতার দক্ষিণবর্ত্তি টানা নামক স্থানে যে গড় ছিল তাহা দৃঢ়ীভূত করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয় করিয়াছিলেন অগ্রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না। ওলন্দাজরা, দুর্গের নিকটবর্ত্তী হইয়া, অবিলম্বে আক্রমণ করিল, কিন্তু পরাস্ত হইল। অনন্তর তাহারা, কিঞ্চিৎ অপসৃত হইয়া, সাত শত ইউরোপীয়, ও আট শত মালাই, সৈন্য ভূমিতে অবতীর্ণ করিল। ঐ সকল সৈন্য, স্থলপথে, গঙ্গার পশ্চিম পার দিয়া, চুঁচুড়া অভিমুখে চলিল। ক্লাইব, তাহাদিগের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, চুঁচুড়া ও চন্দন নগরের মধ্য স্থানে অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত, পূর্ব্বেই কর্ণেল ফোর্ড সাহেবকে স্বল্প সৈন্য সহিত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।
ওলন্দাজী সৈন্য, ক্রমে অগ্রসর হইয়া, চুঁচুড়ার এক ক্রোশ দক্ষিণে ছাউনি করিল। কর্ণেল ফোর্ড অবগত ছিলেন উভয় জাতির পরস্পর সন্ধি আছে। অতএব, তাহাদিগকে সহসা আক্রমণ না করিয়া, স্পষ্ট অনুমতির নিমিত্ত, কলিকাতার কৌন্সিলে পত্র লিখিলেন। ক্লাইব তাস খেলিতেছেন এমত সময়ে ফোর্ড সাহেবের পত্র উপস্থিত হইল। তিনি খেলা হইতে না উঠিয়াই, পেনসিল দিয়া এই উত্তর লিখিলেন,প্রিয়তম! অবিলম্বে তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ কর, কল্য আমি কৌন্সিলের অনুমতি পাঠাইব। ফোর্ড, এই আদেশ প্রাপ্তিমাত্র, আক্রমণ করিয়া,আধ ঘণ্টার মধ্যেই ওলন্দাজদিগকে পরাজয় করিলেন। তাহাদিগের যে সকল জাহাজ নদী মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, ঐ সময়ে, তাহাও ইঙ্গরেজদিগের হস্তে পতিত হইল। এইরূপে ওলন্দাজদিগের এই মহোদ্যোগ পরিশেষে ধূমশেষ হইয়া গেল।
এই যুদ্ধের অব্যবহিত পর ক্ষণেই, রাজকুমার মীরন ছয় সাত সহ অশ্বারোহ সৈন্যসহিত চুঁচুড়ায় উপস্থিত হইলেন। ওলন্দাজেরা জয়ী হইলে, তাহাদিগের সহিত যোগ দিতেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু এক্ষণে, অগত্যা ইঙ্গরেজদিগের সহিত মিলিত হইয়া, ওলন্দাজদিগকে আক্রমণ করিলেন। কর্ণেল ফোর্ড, যুদ্ধ সমাপ্তির অব্যবহিত পরেই, চুঁচুড়া অবরোধ করিলেন। ঐ নগর ত্বরায় ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইত। কিন্তু, ওলন্দাজেরা সত্বর হইয়া ক্লাইবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাতে, তিনি উক্ত নগর অধিকার করিলেন না। অনন্তর, তাহারা যুদ্ধের সমুদায় ব্যয় ধরিয়া দিতে স্বীকার করাতে, ক্লাইব তাহাদিগের জাহাজ সকলও ছাড়িয়া দিলেন।
ক্লাইব, ক্রমাগত তিন বৎসর গুরুতর পরিশ্রম করিয়া, শারীরিক অত্যন্ত অপটু হইয়াছিলেন। অতএব, এই সকল ঘটনার অবসানেই, ১৭৬০ খৃঃঅব্দের ফেব্রুয়ারিতে, ধনে মানে পরিপূর্ণ হইয়া, ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন। গবর্ণমেণ্টের ভার বান্সিটার্ট সাহেবের হস্তে সমর্পিত হইল।
বাঙ্গালা দেশ যে একবারে নিরুপদ্রব হইবেক, তাহার কোন সম্ভাবনা ছিল না। বৃদ্ধ নবাব মীরজাফর নিজপুত্র মীরনের হস্তে রাজ্যশাসনের ভার সমৰ্পণ করিলেন। যুবরাজ রাজপুরুষদিগের সহিতু অত্যন্ত সাহঙ্কার ব্যবহার, ও প্রজাগণের উপরি অসহ্য অত্যাচার, আরম্ভ করাতে, সকলেই তাঁহার শাসনে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। তিনি এরূপ নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতে লাগিলেন, যে সকলে সিরাজউদ্দৌলার কুক্রিয়া সকল বিস্মৃত হইয়া গেল।
দিল্লীর সম্রাটের পুত্র শাহআলম, সর্ব্ব সাধারণের এই রূপ অসন্তোষ দর্শনে সাহসী হইয়া, দ্বিতীয় বার বিহার আক্রমণের উদ্যোগ করিলেন। পূর্ণিয়ার গবর্ণর, কাদিম হোসেন খাঁ, স্বীয় সৈন্য লইয়া তাঁহার সহিত যোগ দিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। শাহআলম, কর্ম্মনাশা পার হইয়া বিহারের সীমায় পাদার্পণ মাত্র, সংবাদ পাইলেন যে সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী, প্রসিদ্ধ ক্রূর, ইমাদউল্মুলুক, সম্রাটের প্রাণবধ করিয়াছে। এই ঘটনা হওয়াতে, শাহআলম ভারতবর্ষের সম্রাট হইলেন, এবং অযোধ্যার সুবাদারকে সাম্রাজ্যের অমাত্য পদে নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু তিনি নামমাত্র সম্রাট হইলেন; তাঁহার পরাক্রমও ছিল না, প্রজাও ছিল না; তৎকালে তাঁহার রাজধানী পর্য্যন্ত শত্রুদিগের হস্তগত ছিল; এবং তিনি নিজেও নিজরাজ্যে এক প্রকার পলাতক স্বরূপ ছিলেন।
অনন্তর তিনি পাটনা অভিমুখে যাত্রা করিলে, পরাক্রান্ত রামনারায়ণ, ঐ নগর রক্ষার এক প্রকার উদ্যোগ করিয়া সাহায্য প্রাপ্তির নিমিত্ত, অতি নিয়ে মুরশিদাবাদে পত্র লিখিলেন। কর্ণেল কালিয়ড তৎকালে সৈন্যের অধ্যক্ষ ছিলেন; তিনি ইংলণ্ডীয় সৈন্য লইয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন; এবং মীরনও আপন সৈন্য সহিত তাঁহার অনুগামী হইলেন। এই নরাধম ইতিপূর্ব্বে দুই জন নিজ কর্ম্মকারকের প্রাণদণ্ড করিয়াছিল, এবং স্বহস্তে দুই ভোগ্যা কামিনীর মস্তকচ্ছেদন করে। আলিবর্দ্দি খাঁর দুই কন্যা, ঘেসিতিবেগম ও আমানবেগম, আপন আপন স্বামী নিবাইশ মহমদ ও সায়দ অহমদের মৃত্যুর পর, গুপ্তভাবে ঢাকায় বাস করিতেছিলেন। মীরন, এই যুদ্ধ যাত্রাকালে, তাঁহাদের দুই জনের প্রাণবধ করিতে আজ্ঞা প্রেরণ করিলেন। ঢাকার গবর্ণর এই নিষ্ঠুর ব্যাপার সমাধানে অসম্মত হওয়াতে, পরিশেষে এক ভৃত্যকে এই আজ্ঞা দিয়া পাঠাইলেন যে তাহাদিগকে, মুরশিদাবাদ আনয়নচ্ছলে নৌকায় আরোহণ করাইয়া, পথের মধ্যে নৌকা সমেত জলমগ্ন করিবে।
এই নির্দেশ প্রকৃতরূপেই প্রতিপালিত হইল। হত্যা কারিয়া, ডুবাইয়া দিবার নিমিত্ত, নৌকার ছিপী খুলিতে উপক্রম করিলে, কনিষ্ঠা ভগিনী করুণস্বরে কহিলেন হে সর্ব্বশক্তিমন্ জগদীশ্বর! আমরা উভয়েই পাপীয়সী ও অপরাধিনী বটি; কিন্তু মীরনের কখন কোন অপরাধ করি নাই; প্রত্যুত, আমরাই তাহার এই সমুদায় আধিপত্যের মূল।
মীরন, প্রস্থান কালে, স্বীয় স্মরণপুস্তকে এই অতিপ্রায়ে তিন শত ব্যক্তির নাম লিখিয়াছিলেন, যে প্রত্যাগমন করিয়া ইহাদের প্রাণ দণ্ড করিব। কিন্তু আর তাঁহাকে প্রত্যাগমন করিতে হইল না।
কর্ণেল কালিয়ড রামনারায়ণকে এই অনুরোধ করিয়াছিলেন, যাবৎ জামি উপস্থিত না হই, আপনি কোন ক্রমে সম্রাটের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন না। কিন্তু তিনি, এই উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া, নগর হইতে বহির্গমন পূর্ব্বক, সম্রাটের সহিত যুদ্ধারম্ভ করিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইলেন। তখন পাটনা নিতান্ত অশরণ হইল। এক্ষণে সম্রাট এক উদ্যমেই ঐ নগর অধিকার করিতে পারিতেন; কিন্তু, অগ্রে তাহার চেষ্টা না করিয়া, দেশ লণ্ঠনেই সকল সময় নষ্ট করিলেন। ঐ সময় মধ্যে,কালিয়ড স্বীয় সমুদায় সৈন্য সহিত উপস্থিত হইলেন এবং অবিলম্বে শত্রুপক্ষ আক্রমণের প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু মীরন, ফেব্রুয়ারির দ্বাবিংশ দিবসের পূর্ব্বে গ্রহসকল অনুকুল নহেন এই বলিয়া, আপত্তি উত্থাপিত করাতে, প্রস্তাবিত আক্রমণ স্থগিত রহিল।
২০এ, সম্রাট আঁহাদের উভয়েরি সৈন্য এককালে আক্রমণ করিলেন। মীরনের পঞ্চদশ সহস্র অশ্বারোহ সহসা তঙ্গ দিয়া পলায়ন করিল। কিন্তু কর্ণেল কালিয়ড,দৃঢ়তা ও অকুতোভয়তা সহকারে সম্রাটের সৈন্য আক্রমণ করিয়া, অবিলম্বে পরাজিত করিলেন। শাহআলম, সেই রাত্রিতেই,শিবির ভঙ্গ করিয়া, রণক্ষেত্রের পাঁচ ক্রোশ অন্তরে গিয়া অবস্থিতি করিলেন। অনন্তর, তিনি স্বীয় সেনাপতির পরামর্শ অনুসারে, গিরিমার্গ দ্বারা অতর্কিত রূপে গমন করিয়া, সহসা মুরশিদাবাদ অধিকার করিবার আশয়ে প্রস্থান করিলেন।
এই প্রয়াণ অতিত্বরাপূর্ব্বক সম্পাদিত হইল। কিন্তু মীরনও সন্ধান পাইয়া, দ্রুতগতি পোত দ্বারা, আপন পিতার নিকট এই সম্ভাবিত বিপদের সংবাদ প্রেরণ . করিলেন। অল্পকাল পরেই,সম্রাট, মুরশিদাবাদের পঞ্চ-‘ দশ ক্রোশ দূরে, পর্ব্বত হইতে অবতীর্ণ হইলেন; কিন্তু সত্বর আক্রমণ না করিয়া, জনপদ মধ্যে অনর্থক কালহরণ করিতে লাগিলেন। এই অবকাশে কর্ণেল কালিয়ভও আসিয়া পহুছিলেন। উভয় সৈন্য পরস্পর দৃষ্টিগোচর স্থানে শিবির সন্নিবেশন করিল। ইঙ্গরেজেরা যুদ্ধ দানে উদ্যত হইলেন। কিন্তু সম্রাট, সহসা অসম্ভব ত্রাসযুক্ত হইয়া পাটনা প্রত্যাগমন পূর্ব্বক, ঐ নগর দৃঢ় রূপে অবরোধ করিলেন। ঐ সময়ে, পূর্ণিয়ার গবীর কাদিমহোসেন খাঁও,তাঁহার সাহায্য করিবার নিমিত্ত,স্বীয় সৈন্য সহিত যাত্রা করিলেন।
সম্রাট ক্রমাগত নয় দিবস পাটনা আক্রমণ করিলেন। ইহা নিশ্চিত বোধ হইয়াছিল, উক্তনগর অবশ্যই তাঁহার হস্তগত হইবেক। কিন্তু কাপ্তেন নক্ল অত্যল্প সৈন্য সহিত সহসা পাটনায় উপস্থিত হওয়াতে সে আশঙ্কা দূর হইল। তিনি, কর্ণেল কালিয়ড কতৃক প্রেরিত হইয়া, বর্দ্ধমান হইতে এয়োদশ দিবসে তথায় উপস্থিত হন। তিনি, সেই দিবস রাত্রিতে বিপক্ষের শিবির পরীক্ষা করিয়া, পর দিন, তাহাদিগের মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রার সময়, আক্রমণ করিলেন। সম্রাটের সেনা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল। তখন তিনি, আপন শিবিরে অগ্নিপ্রদান করিয়া, পলায়ন করিলেন।
দুই এক দিন পরে, কাদিমহোসেন খাঁ, ঘোড়শ সহস্র সৈন্য সমভিব্যাহারে হাজীপুরে পহুছিয়া, পাটনা আক্রমণের উপক্রম করিলেন। কিন্তু কাপ্তেন নক্ল, সহস্রের অবধিক সৈন্য মাত্র সহিত গঙ্গা পার হইয়া, তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন। উক্ত জয়লাভকে অসা-ধারণ সাহসের কার্য্য বলিতে হইবেক। এই জয়লাভ দেখিয়া এদেশীয় লোকেরা ইঙ্গরেজদিগকে মহাপ-রাক্রান্ত নিশ্চয় করিলেন। এই যুদ্ধে রাজা সিতাব রায় এমত অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন যে তদ্দর্শনে ইঙ্গরেজের। তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন।
পরাজয়ের পর, পূর্ণিয়ার গবর্ণর, সম্রাটের সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত, প্রস্থান করিলেন। কর্ণেল কালি-য়ড ও মীরন উভয়ে একত্র হইয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। বর্ষা আরম্ভ হইল; তথাপি তাঁহারা তাঁহার অনুসরণে বিরত হইলেন না। ১৭৬০ খৃঃ অব্দের ২রা জুলাই রজনীতে অতিশয় দুর্যোগ হয়। মীরন আপন পটমণ্ডপে উপবিষ্ট হইয়া গল্প শুনিতেছিলেন। দৈবাৎ ঐ সময়ে বিদ্যুৎপাত দ্বারা তাঁহার ও তাঁহার দুই জন পরিচারকের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হইল। কর্ণেল কালিয়ড, এই দুর্ঘটনাপ্রযুক্ত, উক্ত কাদিমহোসেনের অনুসরণে বিরত হইলেন, এবং, পাটনা প্রত্যাগমন পুর্ব্বক, বর্ষার অনু-রোধে, তথায় শিবির সন্নিবেশন করিলেন।
মীরন অত্যন্ত দুরাচার, কিন্তু নিজ পিতার রাজত্বের প্রধান অবলম্বন স্বরূপ, ছিলেন। তৎকালের মুসলমান ইতিহাস লেখক কহেন নির্বোধ ইন্দ্রিয়পরায়ণ বৃদ্ধ নবা-বের পূর্ব্বে যে কিছু বুদ্ধি বা বিবেচনা ছিল, এক্ষণে তাহা একবারেই লোপ পাইল। অতঃপর রাজকার্যে অত্যন্ত গোলযোগ ঘটিতে লাগিল। সেনাগণ পূর্ব্বতন বেতন নিমিত্ত রাজভবন অবরোধ করিয়া বিসম্বাদে উদ্যত হইল। তখন নবাবের জামাতা মীরকাসিম তাহাদের পুরোবর্ত্তী হইয়া কহিলেন আমি অঙ্গীকার করিতেছি, স্বধন দ্বারা তোমাদিগকে সন্তুষ্ট করিব। এই বলিয়া তিনি তাহাদিগকে আপাততঃ ক্ষান্ত করিলেন।
নবাব মীরকাসিমকে,দৌত্যকার্য্যে নিযুক্ত করিয়া, কলিকাতায় পাঠাইয়াছিলেন। তথায় বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেবের নিকটে তাঁহার বিশেষ রূপে বুদ্ধি ও ক্ষমতা প্রকাশ হয়। তৎকালে এই দুই সাহেবের মতেই কোম্পানির এতদ্দেশীয় সমুদায় বিষয় কর্ম্ম নির্ব্বাহ হইত। দ্বিতীয় বার দূত প্রেরণ আবশ্যক হওয়াতে, মীরকাসিম পুনর্ব্বার প্রেরিত হয়েন। এইরূপে দুই বার মীরকাসিমের বুদ্ধি ও ক্ষমতা দেখিয়া, গবর্ণর সাহেবের অন্তঃকরণে এই দৃঢ় প্রত্যয় জমে যে কেবল এই ব্যক্তিই অধুনা বাঙ্গালার রাজকীয় কার্য্য নির্ব্বাহে সমর্থ। তদনুসারে তিনি মীরকাসিমকে তিন প্রদেশের ডেপুটী নাজিমী পদ প্রদানের প্রস্তাব করিলেন। মীরকাসিম সম্মত হইলেন। অনন্তর বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস উভয়ে,এক দল সৈন্য সহিত মুরশিদাবাদ গমন করিয়া, মীরজাফরের নিকট ঐ প্রস্তাব করিলে, তিনি তদ্বিষয়ে অত্যন্ত অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন, এরূপ হইলে সমুদায় ক্ষমতাই অবিলম্বে জামাতার হস্তে যাইবেক; আমি কেবল আপন সভামণ্ডপে পুত্তলিকা প্রায় হইব।
বান্সিটার্ট সাহেব নবাবের অনিচ্ছা দেখিয়া দোলায়মানচিত্ত হইলেন। তখন মীরকাসিম এই বলিয়া ভয় দেখাইলেন, তবে আমি সম্রাটের পক্ষে যাইব। কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন যে এত কাণ্ড করিয়া আমি কখনই মুরশিদাবাদে নিরাপদে থাকিতে পারিব না। তখন বানসিটার্ট সাহেব, দৃঢ়তা সহকারে কার্য্য করা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, ইংলণ্ডীয় সৈন্যদিগকে রাজভবন অধিকার করিতে আদেশ দিলেন। তদ্দর্শনে শঙ্কিত হইয়া মীরজাফর অগত্যা সম্মত হইলেন।
অনন্তর মুরশিদাবাদ ও কলিকাতা এই উভয়ের অন্যতর স্থানে বৃদ্ধ নবাবকে এক বাসস্থান দিবার প্রস্তাব হইল। তাহাতে তিনি বিবেচনা করিলেন যদি আমি মুরশিদাবাদে থাকি, তাহা হইলে, যেখানে এতকাল আধিপত্য করিলাম, তথায় কেবল সাক্ষিগোপাল হইয়া থাকিতে হইবেক; এবং নিজ জামাতৃকৃত পরিভব সহ করিতে হইবেক। অতএব আমার কলিকাতা যাওয়াই শ্রেয়। তিনি এক সামান্য নর্ত্তকীকে আপন প্রণয়িনী করিয়া ছিলেন এবং তাহারি আজ্ঞাকারী ছিলেন। ঐ কামিনী পরে মণিবেগম নামে সবিশেষ প্রসিদ্ধ হন। মুসলমান পুরাবৃত্ত লেখক কহেন, ঐ রমণী ও মীরজাফর, প্রস্থানের পূর্ব্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ পূর্ব্বক, পূর্ব্ব পূর্ব্ব নবদিগের সঞ্চিত অতুল্য রত্ন সকল হস্তগত করিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন।
চতুর্থ অধ্যায়।
১৭৬০ খৃঃ অব্দের ৪ঠা মার্চ, ইঙ্গরেজের মীরকাসিমকে বাঙ্গালা ও বিহারের সুবাদার করিলেন। তিনি এই মহোপকারের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কোম্পানি বাহাদুরকে বর্দ্ধমান প্রদেশের অধিকার প্রদান করিলেন; এবং কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বরদিগকে বিংশতি লক্ষ টাকা উপঢৌকন দিলেন। সেই টাকা তাঁহারা সকলে যথাযোগ্য ভাগ করিয়া লইলেন।
মীরকাসিম অত্যন্ত বুদ্ধিশালী ও ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তিনি, সিংহাসনে নিবিষ্ট হইয়াই, ইঙ্গরেজদিগকে এবং মীরজাফরের ও নিজের সৈন্য ও কর্ম্মকারকদিগকে যত টাকা দিতে হইবেক, প্রথমতঃ তাহার ঠিক হিসাব প্রস্তুত করিলেন, তৎপরে সেই সকল পরিশোধ করিবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। তিনি রাজসভার ব্যয় সংক্ষেপ করিয়া আনিলেন; অভিনিবেশ পূর্ব্বক সমুদায় হিসাব দেখিতে লাগিলেন; এবং, মীরজাফরের শিথিল শাসন কালে, রাজপুরুষেরা যত টাকা অপহরণ করিয়াছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদের নিকট হইতে সেই সকল ফিরিয়া লইতে লাগিলেন। তিনি জমীদার দিগের নিকট হইতে কেবল বাকী আদায় করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন এমত নহে, সমুদায় জমীদারীর নূতন বন্দোবস্তও করিলেন। তাঁহার অধিকারের পুর্ব্বে, দুই প্রদেশের রাজস্ব বার্ষিক ১৪২৪৫০০০ টাকা নির্ধারিত ছিল, তিনি বৃদ্ধি করিয়া ২৫৬২৪০০ করিলেন। এই সকল উপায় দ্বারা তাঁহার ধনাগার অনতিবিলম্বে পরিপূর্ণ হইল। ইহাতে তিনি সমস্ত পূর্ব্বতন দেয় পরিশোধ করিতে পারিলেন এবং নিয়মিত রূপে বেতন দেওয়াতে, তদীয় সৈন্য সকল অতিশয় বশীভূত রহিল।
ইঙ্গরেজেরা তাঁহাকে রাজ্যাধিকার প্রদান করেন। কিন্তু ইঙ্গরেজদিগের অধীনতা হইতে মুক্ত হওয়া তাঁহার মুখ্য অভিপ্রায় হইয়া উঠিল। তিনি বুঝিতে পারিয়া ছিলেন যদিও আমি সর্ব্বসম্মত নবাব বটি, বাস্তবিক সমুদায় ক্ষমতা ও প্রভুত্ব ইঙ্গরেজদিগের হস্তেই আছে। কিন্তু তিনি ইহাও বুঝিতে পরিয়াছিলেন যে বল প্রকাশ ব্যতিরেকে কখনই ইঙ্গরেজদিগের পরাক্রম হইতে আপনাকে মুক্ত করিতে পারিব না; অতএব স্বীয় সৈন্যের শুদ্ধি ও বৃদ্ধি বিষয়ে তৎপর হইলেন। যে সকল সৈন্য অকর্মণ্য হইয়াছিল, তাহাদিগকে ছাড়াইয়া দিলেন; সৈন্যদিগকে ইঙ্গরেজী রীতি অনুসারে শিক্ষা দিতে লাগিসেন; এবং এক আরমানিকে সৈন্যের অধ্যক্ষ করিলেন।
এই ব্যক্তি পারস্যের অন্তর্গত ইস্পাহান নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ইহার নাম গর্গিন খাঁ। ইনি অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ও বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। গর্গিন প্রথমতঃ এক জন সামান্য বস্ত্রব্যবসায়ী ছিলেন; কিন্তু যুদ্ধবিদ্যা বিষয়ে অসাধারণ বুদ্ধি নৈপুণ্য থাকাতে, মীরকাসিম তাঁহাকে সৈনাপত্যে নিযুক্ত করিলেন। তিনিও, দৃঢ়তর অধ্যবসায় সহকারে, স্বীয় স্বামিকে ইঙ্গরেজদিগের অধীনতা হইতে মুক্ত করিবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। কামান ও বন্দুক সকল প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন এবং গোলন্দাজদিগকে শিক্ষা দিতে লাগিলে। তাঁহার শিক্ষিত সৈন্য সকল এমত উৎকৃষ্ট হইয়া উঠিল যে বাঙ্গালাতে কখন কোন রাজার সেরূপ ছিল না।
মীরকাসিম, ইরেজদিগের অগোচরে আপন অতিপ্রায় সুসিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, মুরশিদাবাদ পরিত্যাগ করিয়া মুঙ্গেরে রাজধানী করিলেন। ঐ স্থানে তাঁহার আরমানি সেনাপতি কামানের কারখানা স্থাপন করিলেন। বন্দুকের নির্ম্মাণ কৌশলের নিমিত্ত ঐ নগরের অদ্যাপিও যে প্রতিষ্টা আছে, এই গর্গিন খাঁ তাহার আদিকারণ। তৎকালে গর্গিনের বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের বড় অধিক ছিল না।
সম্রাট শাহআলম তৎকাল পর্যন্ত বিহারের পর্যন্ত দেশে ভ্রমণ করিতেছিলেন। অতএব, ১৭৬০ খৃঃ অব্দের বর্ষা শেষ হইবামাত্র, মেজর কার্ণাক সৈন্য সহিত যাত্রা করিয়া তাঁহাকে সম্পূর্ণ রূপে পরাজয় করিলেন। যুদ্ধের পর কার্ণাক সাহেব সন্ধিপ্রস্তাব করিয়া রাজা সিতাবরায়কে তাঁহার নিকট পাঠাইলেন। সম্রাট তাহাতে সম্মত হইলে, ইংলণ্ডীয় সেনাপতি, তদীয় শিবিরে গমন পূর্ব্বক, তাঁহার সমুচিত সম্মান করিলেন।
মীরকাসিম সম্রাটের সহিত ইঙ্গরেজদিগের এই সন্ধি বার্ত্তা শ্রবণে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন; এবং আপনার পক্ষে কোন অপকার না ঘটে, এই নিমিত্ত সত্বর হইয়া পাটনা গমন করিলেন। মেজর কার্ণাক মীরকাসিমকে সম্রাটের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত অনুরোধ করিলেন। কিন্তু তিনি কোন ক্রমেই সম্রাটের শিবিরে গিয়া সাক্ষাৎ করিতে সম্মত হইলেন না। পরিশেষে এই নির্ধারিত হইল উভয়েই ইঙ্গরেজদিগের কুঠীতে আসিয়া পরস্পর সাক্ষাৎ করিবেন।
উপস্থিত কার্য্যনির্ব্বাহের নিমিত্ত এক সিংহাসন প্রস্তুত হইল; সমস্ত ভারতবর্ষের সম্রাট তদুপরি উপবেশন করিলেন। মীরকাসিম সমুচিত সম্মান প্রদর্শন পূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখবর্তী হইলেন। অনন্তর সম্রাট তাঁহাকে বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারী প্রদান করিলে, তিনি প্রতি বৎসর চতুর্ব্বিংশতি লক্ষ টাকা কর দান স্বীকার করিলেন। তৎপরে সম্রাট দিল্লী যাত্রা করিলেন। কার্ণাক সাহেব কর্ম্মনাশার তীর পর্যন্ত তাঁহার অনুগমন করিলেন। সম্রাট তথায়, কর্ণাকের নিকট বিদায় লইবার সময়, প্রস্তাব করিলেন ইঙ্গরেজেরা যখন প্রার্থনা করিবেন তখনি আমি তাঁহাদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রদান করিব। ১৭৫৫ খৃঃ অব্দে উড়িষ্যা প্রদেশ মহারাষ্ট্রীয়দিগকে প্রদত্ত হয়, কেবল সুবর্ণ রেখার উত্তরবর্ত্তি অংশমাত্র অবশিষ্ট থাকে। তদবধি ঐ অংশই উড়িষ্যানামে ব্যবহৃত হইত।
মীরকাসিম, পাটনার গবর্নর রামনারায়ণ ব্যতিরিক্ত, সমুদায় জমিদারদিগকে সম্পূর্ণরূপে আপন বশে আনিয়াছিলেন। রামনারায়ণের ধনবান্ বলিয়া খ্যাতি ছিল; কিন্তু তিনি ইঙ্গরেজদিগের আশ্রয়চ্ছায়াতে উপবিষ্ট ছিলেন; অতএব, সহসা তাঁহাকে আক্রমণ করা অবিধেয় বিবেচনা করিয়া, নবাব কৌশলক্রমে তাঁহার সর্বনাশের উপায় দেখিতে লাগিলেন। রামনারায়ণ তিন বৎসর . হিসাব পরিষ্কার করেন নাই। কিন্তু ইহাও মনে করিতে হইবেক, যে ঐ সময়ে বিহার দেশ বিপক্ষ সৈন্য দ্বারা যতপরোনাস্তি উৎপাতগ্রস্ত হইয়াছিল। যাহা হউক, নবাব ইঙ্গরেজদিগকে লিখিলেন, রামনারায়ণের নিকট বাকী আদায় না হইলে, আমি আপনকারদিগের দেন। পরিশোধ করিতে পারি না। আর যাবৎ আপনকারদিগের সৈন্য পাটনাতে থাকিবেক তাবৎ ঐ বাকী আদায়ের কোন সম্ভাবনা নাই।
তৎকালে কলিকাতার কৌন্সিলে দুই পক্ষ ছিল; তন্মধ্যে এক পক্ষ মীরকাসিমের প্রতিকুল, অন্যপক্ষ তাঁহার অনুকূল। গবর্ণর বান্সিটার্ট সাহেব এই পক্ষে ছিলেন। মীরকাসিমের প্রস্তাব লইয়া উভয় পক্ষে বিস্তর বাদানুবাদ হইল। অবশেষে বানসিটার্টের পক্ষই প্রবল হইল। এই পক্ষের মতানুসারে ইঙ্গরেজেরা পাটনা হইতে আপনাদিগের সৈন্য উঠাইয়া আনিলেন; সুতরাং রামনারায়ণ নিতান্ত অসহায় হইলেন; এবং নবাবও তাঁহাকে রুদ্ধ ও কারাবদ্ধ করিতে কালবিলম্ব করিলেন না। গুপ্তধনাগার দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত তাঁহার কর্ম্মকরদিগকে অনেক যন্ত্রণা দেওয়া গেল, তথাপি গবর্ণমেণ্টের সমুচিত ব্যয়ের নিমিত্ত যাহা আবশ্যক, তদপেক্ষায় অধিক টাকা পাওয়া গেল না।
মীরকাসিম এপর্যন্ত নির্বিবাদে রাজ্যশাসন করিলেন। পরে তিনি কোম্পানির কর্ম্মকারকদিগের আত্মম্ভরিতা দোষে যেরূপে রাজ্যভ্রষ্ট হইলেন এক্ষণে তাহার বর্ণনা করা যাইতেছে। ভারতবর্ষে যে সকল পণ্যদ্রব্য দেশ হইতে দেশান্তরে নীত হইত তাহার শুল্ক হইতেই অধিকাংশ রাজস্ব উৎপন্ন হইত। এইরূপে রাজস্বগ্রহণ করা এক প্রকার অসভ্যতার প্রথা বলিতে হইবেক; যেহেতু ইহাতে বাণিজ্যের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মে। কিন্তু এই কালে ইহা অত্যন্ত প্রচলিত ছিল; এবং ইঙ্গরেজেরাও ১৮৩৫ খৃঃ অব্দের পূর্ব্বে ইহা রহিত করেন নাই। যখন কোম্পানি বাহাদুর সালিয়ানা তিন হাজার টাকার পেস্কস দিয়া বাণিজ্য করিবার অনুমতি পাইলেন তদবধি তাঁহাদের পণ্যদ্রব্যের মাশুল লাগিত না। কলিকাতার গবর্ণর এক দস্তক স্বাক্ষর করিতেন; মাশুলঘাটায় তাহা দেখাইলেই কোম্পানির বস্তু সকল বিনা মাশুলে চলিয়া যাইত।
এই অধিকার কেবল কোম্পানির নিজের বাণিজ্য বিষয়েই ছিল। কিন্তু যখন ইঙ্গরেজেরা অত্যন্ত পরাক্রান্ত হইয়া উঠিলেন, তখন কোম্পানির যাবতীয় কর্ম্মকারকে রাই নিজ নিজ বাণিজ্য আরম্ভ করিলেন। যত দিন ক্লাইব এ দেশে ছিলেন, তাঁহারা সকলেই, দেশীয় বণিকদিগের ন্যায়, রীতিমত শুক প্রদান করিতেন। পরে যখন তিনি স্বদেশ যাত্রা করিলেন এবং কৌনসিলের সাহেবের অন্য এক নবাবকে সিংহাসন প্রদান করিলেন, তখন তাঁহারা আরো প্রবল হইয়া বিনা শুল্কেই বাণিজ্য করিতে লাগিলেন। ফলতঃ তৎকালে তাঁহারা এমত প্রবল হইয়া ছিলেন যে তাঁহাদিগকে কোন প্রকার বাধা দিতে নবাবের কর্ম্মকারকদিগের সাহস হইত না।
ইঙ্গরেজদের গোমাস্তারা,শুল্ক বঞ্চন করিবার নিমিত্ত, ইচ্ছানুসারে ইঙ্গরেজী নিশান তুলিত এবং দেশীয় বণিক ও রাজকীয় কর্ম্মকারকদিগকে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ দিত। ব্যক্তি মাত্রেই, যে কোন ইঙ্গরেজের স্বাক্ষরিত দস্তক হস্তে করিয়া, আপনাকে কোম্পানি বাহাদুরের তুল্য পরাক্রান্ত বোধ করিত। নবাবের লোকেরা কোন বিষয়ে আপত্তি করিলে, ইউরোপীয় মহাশয়েরা, সিপাই পাঠাইয়া; তাহাদিগকে ধরিয়া আনিতেন ও কারাবদ্ধ করিয়া রাখিতেন। শুল্ক না দিয়া কোন স্থানে কিছু দ্রব্য লইয়া যাইবার ইচ্ছা হইলে, নাবিকেরা নৌকার উপর কোম্পানির নিশান তুলিয়া দিত।
ফলতঃ, এইরূপে নবাবের পরাক্রম একবারেই বিলুপ্ত হইল। দেশীয় বণিকদিগের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল। ইঙ্গরেজ মহাত্মারা অসীম ধনশালী হইয়া উঠিলেন। নবাবের রাজত্ব অত্যন্ত ন্যূন হইল। যেহেতু ইঙ্গরেজেরাই কেবল শুল্ক দিতেন না এমত নহে; যাহারা তাঁহাদের চাকর বলিয়া পরিচয় দিত, তাহারাও তাঁহাদের নাম করিয়া মাশুল ফাকি দিতে আরম্ভ করিল। মীরকাসিম, এই সকল অত্যাচারের উল্লেখ করিয়া, কলিকাতার কৌন্সিলে অনেক বার অভিযোগ করিলেন। পরিশেষে তিনি এই বলিয়া ভয় দেখাইলেন, আপনারা ইহার নিবারণ না করিলে, আমি রাজাধিকার পরিত্যাগ করিব।
বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেব এই সকল অন্যায় নিবারণের অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কৌন্সিলের অন্যান্য মেম্বরের। ঐ সকল অবৈধ উপায় দ্বারা ধন সঞ্চয় করিতেন, সুতরাং তাঁহাদিগের সে সকল চেষ্টা বৃথা হইল। পরিশেষে ঐ সকল অবৈধ ব্যবহারের এত বাড়াবাড়ি হইয়া উঠিল যে কোম্পানির গোমাস্তাদিগের নির্দ্ধারিত মূল্যেই দেশীয় বণিকদিগকে ক্রয় বিক্রয় করিতে হইত। অতঃপর মীরকাসিম ইঙ্গরেজদিগকে শক্রমধ্যে গণনা করিলেন। এবং ত্বরায় নবাব ও ইঙ্গরেজ এই উভয় পক্ষের পরস্পর যুদ্ধ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হইয়া উঠিল।
ইহার নিবারণার্থে বান্সিটার্ট সাহেব স্বয়ং মুঙ্গেরে গিয়া নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; নবাবও সৌহৃদ্যভাবে তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করিলেন। পরে বিষয় কর্ম্মের কথা উত্থাপন হইলে,মীরকাসিম, কোম্পানির কর্ম্মকারক দিগের অত্যাচার বিষয়ে যৎপরোনাস্তি অসন্তোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক, অনেক অনুযোগ করিলেন। বান্সিটার্ট সাহেব, তাঁহাকে অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা করিয়া, প্রস্তাব করিলেন, কি দেশীয় লোক কি ইঙ্গরেজ, সকলকেই বস্তুমাত্রের একবিধ অর্থাৎ শতকরা নয় টাকার হিসাবে মাশুল দিতে হইবেক। কিন্তু আমার স্বয়ং এরূপ নিয়ম নির্দ্ধারিত করিবার ক্ষমতা নাই। অতএব কলিকাতায় গিয়া কৌন্সিলের সাহেবদিগকে এই নিয়ম নির্দ্ধারিত করিতে পরামর্শ দিব। নবাব,অত্যন্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক, এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; কিন্তু কহিলেন যদি ইহাতেও এই অনিয়ম নিবারণ না হয়, তবে আমি মাশুলের প্রথা একবারে রহিত করিয়া দেশীয় ও ইউরোপীয় উভয় জাতিকেই সমান করিব। বান্সিটার্ট সাহেব, কলিকাতার কেন্সিলে এই বিষয়ে প্রস্তাব করিবার নিমিত্ত, সত্বর হইয়া কলিকাতা প্রত্যাগমন করিলেন। কিন্তু মীরকাসিম, কৌন্সিলের সম্মতি পর্য্যন্ত অপেক্ষা না করিয়া, তৎক্ষণাৎ শুল্কসম্পৰ্কীয় কর্ম্মকারকদের নিকট এই আজ্ঞ পাঠাইলেন যে তোমরা ইঙ্গরেজদের স্থানেও শত করা নয় টাকার হিসাবে মাশুল আদায় করিবে। ইঙ্গারেজেরা মাশুল দিতে অসম্মত হইলেন এবং নবাবের কর্ম্মকারকদিগকে কয়েদ করিয়া রাখিলেন। মফঃসলের কুটার অধ্যক্ষ সাহেবের কর্ম্মস্থান পরিত্যাগ করিয়া সত্বর হইয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন। শত করা নয় টাকা শুক্লের বিষয়ে বানসিটার্ট সাহেব ষে প্রস্তাব করিলেন হেষ্টিংস ভিন্ন অন্য সকলেই অবজ্ঞা প্রদর্শন পুর্ব্বক তাহ অগ্রাস্থ করিলেন। তাঁহারা সকলেই কহিলেন যে কেবল লবণের উপর আমরা শত করা আড়াই টাকা মাত্র শুল্ক দিব।
মীরকাসিম তৎকালে বাঙ্গালায় ছিলেন না যুদ্ধ যাত্রায় নেপাল গমন করিয়াছিলেন; প্রত্যাগমনানন্তর শ্রবন করিলেন যে কৌন্সিলের সাহেবেরা মাশুল দিতে অস্বীকৃত হইয়াছেন, এবং উহার কর্ম্মকারকদিগকে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন। তখন তিনি কিঞ্চিম্মাত্র বিলম্ব না করিয়া পুর্ব্বপ্রতিজ্ঞানুরূপ কার্য্য করিলেন অর্থাৎ বাঙ্গালা ও বিহারের মধ্যে পণ্যদ্রব্যের মাশুল একবারেই উঠাইয়া দিলেন।
কৌনসিলের মেম্বরেরা শুনিয়া ক্রোধে অন্ধ হইলেন, এবং কহিলেন নবাবকে আপন প্রজাদিগের নিকট পুর্ব্বমত শুল্ক লইতে হইবেক এবং ইঙ্গরেজদিগকে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিতে দিতে হইবেক। এই বিষয়ে ঘোরতর বিতণ্ডা উপস্থিত হইল। হেষ্টিংস সাহেব কহিলেন মীরকাসিম অধীশ্বর রাজা, নিজ প্রজাগণের হিতানুষ্ঠান কেন না করিবেন। ঢাকার কুঠীর অধ্যক্ষ বাটসন সাহেব কহিলেন এ কথা নবাবের গোমাস্তারা কহিলে সাজে; কৌন্সিলের মেম্বরের উপযুক্ত নহে। হেষ্টিংস কহিলেন পাজী না হইলে এরূপ কথা মুখে আনে না।
এইরূপ রাগাসক্ত হইয়া কৌন্সিলের মেম্বরেরা এবম্বিধ গুরুতর বিষয়ে বাদানুবাদ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে এই নিৰ্দ্ধারিত হইল, যে দেশীয় লোকের বাণিজ্যেই পূর্ব্ব নিরূপিত শুল্ক স্থির থাকে, এ বিষয়ে উপরোধ করিবার নিমিত্ত আমিয়ট ও হে সাহেব মীরকাসিমের নিকট গমন করুন। অনন্তর তাঁহারা তথায় পহুছিয়া নবাবের সহিত কয়েক বার সাক্ষাৎ করিলেন। প্রথমতঃ বোধ হইয়াছিল সকল বিষয়েরি নিম্পত্তি হইতে পরিবেক। কিন্তু পাটনার কুঠীর অধ্যক্ষ এলিস সাহেবের দুর্বৃত্ততা দ্বারা সন্ধির আশা একবারেই উচ্ছিন্ন হইল। কোম্পানির সমুদায় কর্ম্মকারকের মধ্যে তিনি অত্যন্ত অশান্ত ছিলেন। নবাব আমিয়ট সাহেবকে বিদায় দিলেন; কিন্তু তাঁহার যে সকল কর্ম্মকারক কলিকাতায় কয়েদ ছিল,হে সাহেবকে তাহাদের প্রতিভূ স্বরূপ আটক করিয়া রাখিলেন। আমিয়ট সাহেব নবাবের হস্তবহির্ভূত হইয়াছেন বোধ করিয়া, এলিস সাহেব অতর্কিতরূপে পাটনা আক্রমণ ও অধিকার করিলেন। কিন্তু তাঁহার সৈন্য সকল সুরাপানে মত্ত ও অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল হওয়াতে নবাবের একদল বহুসংখ্যক সৈন্য আসিয়া পুনর্ব্বার নগর অধিকার করিল; এলিস ও অন্যান্য ইউরোপীয়েরা রুদ্ধ ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন।
মীরকাসিম পাটনার এই বৃত্তান্ত শুনিয়া বোধ করিলেন এক্ষণে অবশ্যই ইঙ্গরেজদিগের সহিত যুদ্ধ ঘটিবেক। অতএব তিনি সমস্ত মফঃসল কুঠীর কর্ম্মকারক সাহেবদিগকে রুদ্ধ করিতে, ও আমিয়ট সাহেবের কলিকাতা যাওয়া বন্ধ করিতে, আজ্ঞা দিলেন। আমিয়ট সাহেব মুরশিদাবাদ পহুছিয়াছেন, এমত সময়ে নগরাধ্যক্ষের নিকট ঐ আদেশ উপস্থিত হওয়াতে, তিনি ঐ সাহেবকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সাহেব উক্ত আদেশ অমান্য করাতে, দাঙ্গা উপস্থিত হইল এবং ঐ দাঙ্গাতে তিনি পঞ্চত্ব পাইলেন। মীরকাসিম শেঠবংশীয় প্রধান বণিকদিগকে ইঙ্গরেজের অনুগত বলিয়া সন্দেহ করিতেন; অতএব তাঁহাদিগকে মুরশিদাবাদ হইতে আনাইয়া মুঙ্গেরে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিলেন।
আমিয়ট সাহেবের মৃত্যু এবং এলিস সাহেব ও তদীয় সহচরবর্গের কারাবরোধের সমাচার কলিকাতায় পহুছিলে, কৌন্সিলের সাহেবেরা অবিলম্বে যুদ্ধারম্ভ করাই নিৰ্দ্ধারিত করিলেন। বানসিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেব ইহা বুঝাইবার নিমিত্ত বিস্তর চেষ্টা পাইলেন, যে মীরকাসিম পাটনায় যে কএক জন সাহেবকে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন তাঁহাদের যাবৎ উদ্ধার না হয়, অন্ততঃ তাবৎ কাল পর্য্যন্তও ক্ষান্ত থাকা উচিত। কিন্তু তাহা ব্যর্থ হইল। অধিকাংশ মেম্বরের সম্মতি ক্রমে ইঙ্গরেজদিগের সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইল। সেই সময়ে মীরজাফর স্বীকার করিলেন যে যদি ইঙ্গরেজেরা পুনর্ব্বার আমাকে নবাব করেন, তাহা হইলে আমি কেবল দেশীয় লোকদিগের বাণিজ্য বিষয়ে পূর্ব্ব শুল্ক প্রচলিত রাখিব, আর ইঙ্গরেজদিগকে বিনা শুল্কে ব্যবসায় করিতে দিব। অতএব কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকেই পুনর্ব্বার সিংহসনে নিবিষ্ট করা মনস্থ করিলেন। বায়ত্তরিয়া বৃদ্ধ মীরজাফর তৎকালে কুণ্ঠরোগে প্রায় চলৎশক্তিরহিত হইয়াছিলেন, তথাপি মুরশিদাবাদগামি ইংলণ্ডীয় সৈন্য সমভিব্যাহারে পুনর্ব্বার নবাব হইতে চলিলেন।
মীরকাসিম স্বীয় সৈন্যদিগকে সুশিক্ষিত করিবার নিমিত্ত অশেষ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। বাস্তবিকও, বাঙ্গালাদেশেে কখন কোন রাজার তাঁহার মত উৎকৃষ্ট সৈন্য ছিল না। আর তাঁহার সেনাপতি গর্গিন খাঁও যুদ্ধ বিষয়ে অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তথাপি উপস্থিত যুদ্ধ অল্প দিনেই শেষ হইল। নবাবের সেনাপতিদিগের পরস্পর অনৈক্য প্রযুক্ত, ১৭৬৩ খৃঃ অব্দের ১৯এ জুলাই, কাটোয়াতে তাঁহার সৈন্য সকল পরাজিত হইল। মতিঝিলে নবাবের যে সৈন্য ছিল ইঙ্গারেজেরা, ২৪ এ, তাহা পরাজয় করিয়া মুরশিদাবাদ অধিকার করিলেন। সুতির সন্নিহিত ঘেরিয়ানামক স্থানে, ২রা আগষ্ট, আর এক যুদ্ধ হয়; তাহাতেও মীরকামিমের সৈন্য পুনরায় পরাজিত হইল। রাজমহলের নিকট উদয়নালাতে তাঁহার এক দৃঢ় গড়খাই করা ছিল নবাবের সৈন্য সকল পলাইয়া তথায় আশ্রয় লইল।
এই সকল যুদ্ধকালে মীরকাসিম মুঙ্গেরে ছিলেন; এক্ষণে উদয়নালার সৈন্যমধ্যে উপস্থিত থাকিতে মনস্থ করিলেন। তিনি এতদেশীয় যে সকল প্রধান প্রধান লোকদিগকে কারাবদ্ধ করিয়া রাখিয়ছিলেন, প্রস্থানের পুর্ব্বে তাহাদিগের প্রাণদণ্ড করিলেন। পাটনার পূর্ব্ব গবর্ণর রাজা রামনারায়ণের গলদেশে বালুকাপূর্ণ গোণী বদ্ধ করিয়া নদী মধ্যে নিক্ষেপ করিলেন, এবং পূর্ব্বোক্ত কৃষ্ণদাস প্রভৃতি সমুদায় পুত্ত্র সহিত রাজা রাজবল্লভ, রায়রাইয়াঁ রাজা উমেদ সিংহ, রাজা বুনিয়াদ সিংহ, রাজা ফতে সিংহ ইত্যাদি অনেক ব্যক্তির জীবনবধ করিলেন। শেঠবংশীয় দুই জন ধনবান বণিককে মুঙ্গেরের গড়ের বুরুজ হইতে নদীতে নিক্ষেপ করিলেন। বহুকাল পর্য্যন্ত নাবিকেরা, ঐ স্থান দিয়া যাতায়াত কালে, উক্ত হতভাগ্যদ্বয়ের বধ স্থান দেখাইয়া দিত।
মীরকাসিম এই সকল হত্যা সমাপন করিয়া উদয়নাল স্থিত সৈন্য সহিত মিলিত হইলেন। অক্টোবরের আরম্ভে ইঙ্গরেজেরা নবাবের শিবির আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে পরাজয় করিলেন। পরাজয়ের দুই এক দিবস পরে তিনি মুঙ্গেরে গমন করিলেন। কিন্তু ইঙ্গরেজদিগের যে সৈন্য তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছিল তাহা নিবারণ করা অসাধ্য বোধ করিয়া, সৈন্য সহিত পাটনা পলায়ন করিলেন। যে কয়েক জন ইঙ্গরেজ তাঁহার হস্তে পড়িয়াছিলেন তাহাদিগকেও সেই সমভিব্যাহারে লইয়া গেলেন। মুঙ্গের পরিত্যাগের পর দিন, তাঁহার সৈন্য রেবতীরে উপস্থিত হইল। সেই স্থানে তাঁহার শিবির মধ্যে হঠাৎ অত্যন্ত গোলযোগ উপস্থিত হইল। সকল লোকই নদী পার হইয়া পলাইতে উদ্যত। দৃষ্ট হইল কয়েক ব্যক্তি এক শব লইয়া গোর দিতে যাইতেছে। জিজ্ঞাসা করাতে কহিল, ইহা সৈন্যধ্যক্ষ গর্গিন খাঁর কলেবর। বিকালে তিন চারি জন মোগল তাঁহার তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহার প্রাণ বধ করে। এইরূপ প্রচার করিয়া দিয়াছিল যে তাহারা সেনাপতির নিকট পূর্ব্বপ্রাপ্য বেতন প্রার্থনা করিতে যায়; তিনি তাহাদিগকে হাঁকাইয়া দেওয়াতে, তাহারা তরবারি বহিষ্কৃত করিয়া তাঁহাকে বধ করে। কিন্তু সে সময়ে তাহাদিগের মাহিয়ানা কিছুই বাকী ছিল না। নয় দিবস পুর্ব্বে তাহারা বেতন পাইয়াছিল।
যাহা হউক, ইহা এক প্রকার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে মীরকাসিম স্বীয় সেনাপতি গর্গিন খাঁর প্রাণবধ করিবার নিমিত্ত ছলপুর্ব্বক তাহাদিগকে পাঠাইয়া দেন। গর্গিনের খোজা পিক্রস নামে এক ভ্রাতা কলিকাতায় থাকিতেন। বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেবের সহিত তাঁহার অত্যন্ত প্রণয় ছিল। পিক্রস এই অনুরোধ করিয়া গোপনে গর্গিনকে পত্র লিখিয়াছিলেন যে তুমি নবাবের কর্ম্ম পরিত্যাগ কর; আর যদি সুযোগ পাও তাঁহাকেও রুদ্ধ করবে। নবাবের প্রধান চর, এই বিষয়ের সন্ধান পাইয়া, রাত্রি দুই প্রহর একটার সময়ে, আপন প্রভুকে এই বলিয়া সাবধান করিয়া দেয়, যে আপনকার সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক। তৎপরে এক দিবস অতীত না হইভেই, আরমানি সেনাপতি গর্গিন খাঁ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েন।
তদনন্তর মীরকাসিম সত্বর হইয়া পাটনা পলায়ন করিলেন। মুঙ্গের ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইল। তখন তিনি বিবেচনা করিলেন পাটনাও পরিত্যাগ করিতে হইবেক এবং পরিশেষে দেশত্যাগীও হইতে হইবেক। ইঙ্গরেজদের উপর তাঁহার ক্রোধের ইয়ত্তা ছিল না; অতএব তিনি পাটনা পরিত্যাগের পূর্ব্বে, সমস্ত ইঙ্গরেজ বন্দীদের প্রাণদণ্ড নিশ্চয় করিয়া, আপন সেনাপতিদিগকে বন্দীগৃহে গিয়া তাহাদের প্রাণবধ করিতে আজ্ঞা দিলেন। ইহাতে তাঁহারা উত্তর করিলেন আমরা ঘাতক নহি যে বিনা যুদ্ধে প্রাণবধ করিব; তাহাদের হস্তে অস্ত্র প্রদান করুন, যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি। তাহারা এইরূপে অস্বীকার করাতে, নবাব শমরূ নামক এক ইউরোপীয় কর্ম্মকারককে তাহাদের প্রাণবধের আজ্ঞা দিলেন।
এই দুরাত্মা পূর্ব্বে ফরাসিদিগের একজন সার্জন ছিল, পরে মীরকাসিমের নিকট নিযুক্ত হয়। সে এই জুগুপ্সিত ব্যাপার সমাধানের ভার গ্রহণ করিল; এবং কিয়ৎসংখ্যক সৈন্য সহিত কারাগৃহে প্রবিষ্ট হইয়া গুলী করিয়া,ডাক্তর ফুলর্টন ব্যতিরিক্ত,সকলেরি প্রাণবধ করিল। আটচল্লিশ জন ভদ্র ইঙ্গরেজ ও একশত পঞ্চাশ জন গোরা এইরূপে পাটনায় পঞ্চস্থ প্রাপ্ত হইল। শমরু তৎপরে অনেক রাজার নিকট কর্ম্ম করে; পরিশেষে সিরথানার আধিপত্য প্রাপ্ত হয়। এই হত্যায় যে সকল লোক হত হয় তাহার মধ্যে কৌন্সিলের মেম্বর এলিশ, হে, লসিংটন এই তিন জনও ছিলেন। ১৭৬৩ খৃঃ অব্দের ৬ই নবেম্বর, পাটনা নগর ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইল। এবং মীরকাসিম পলাইয়া অযোধ্যার সুবাদারের আশ্রয় লইলেন।
এইরূপে প্রায় চারি মাসেই যুদ্ধের শেষ হইল। পর বৎসর, ২২এ অক্টোবর, ইঙ্গরেজদিগের সেনাপতি বক্সারে অযোধ্যার সুবাদারের সৈন্য সকল পরাজয় করিলেন। জয়ের পর উজীরের সহিত যে বন্দোবস্ত হয় বাঙ্গালার ইতিহাসে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। অতএব এস্থলে সে সকলের উল্লেখ না করিয়া, ইহা কহিলেই পর্য্যাপ্ত হইবেক যে তিনি প্রথমতঃ মীরকাসিমকে আশ্রয় দেন, পরে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়া তাড়াইয়া দেন।
মীরজাফর দ্বিতীয়বার বাঙ্গালার সিংহাসনে আরূঢ় হইয়া দেখিলেন, ইঙ্গরেজদিগকে যত টাকা দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন তাহা পরিশোধ করা অসাধ্য। তৎকালে তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার রোগ ক্রমে বদ্ধমূল হইয়া আসিয়াছিল। তিনি, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে, চতুঃসপ্ততি বৎসর বয়সে মুরশিদাবাদে প্রাণত্যাগ করিলেন।
তাঁহার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা দিল্লীর সম্রাটের অধিকার। কিন্তু তৎকালে তাঁহার কোন ক্ষমতা ছিল না; বরং তাঁহার নিজ রাজধানীতে প্রবেশ করিবারও উপায় ছিল না। অতএব ইঙ্গরেজদিগের যাহা ইচ্ছা হইল, তাহাই তাঁহারা করিলেন। মণিবেগমের গর্ভজাত নজমউদ্দৌলা নামে মীরজাফরের এক পুত্ত্র ছিল। কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বরেরা অনেক টাকা পাইয়া তাঁহাকেই নবাব করিলেন। তাঁহার সহিত নূতন বন্দোবস্ত হইল; ইঙ্গরেজেরা দেশরক্ষার ভার আপনাদিগের হস্তে লইলেন, এবং নবাবকে, রাজ্যের দেওয়ানী ও ফৌজদারী সম্পৰ্কীয় কর্ম্মনির্ব্বাহের নিমিত্ত, এক জন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করিতে কহিলেন।
নবাব অনুরোধ করিলেন নন্দকুমারকে ঐ পদে নিযুক্ত করা যায়। কিন্তু কৌন্সিলের মেম্বরেরা তাহা স্পষ্টরূপে অস্বীকার করিলেন। বরং বানসিটার্ট সাহেব, ভাবি গবর্ণরদিগকে সাবধান করিবার নিমিত্ত, নন্দকুমারের কুক্রিয়া সকল কৌন্সিলের বহিতে বিশেষ বিবরণ করিয়া লিখিয়া রাখিলেন। আলিবর্দ্দি খাঁর কুটুম্ব মহম্মদ রেজা খাঁ নামক এক মুসলমান ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন।
পঞ্চম অধ্যায়।
ভারতবর্ষীয় কর্ম্মকারকদিগের কুব্যবহার নিমিত্ত যে সকল বিশৃঙ্খলা ঘটে এবং মীরকাসিম ও উজীরের সহিত যে যুদ্ধ ও পাটনায় যে হত্যা হয়, এই সকল ব্যাপার অবগত করিয়া, ডিরেক্টরেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন। তাঁহারা এই ভয় করিতে লাগিলেন যে পাছে এই নবোপার্জ্জিত রাজ্য হস্তবহির্ভূত হয়; এবং ইহাও বিবেচনা করিলেন যে ব্যক্তির বুদ্ধিকৌশলে ও পরাক্রমপ্রভাবে রাজ্যাধিকার লব্ধ হইয়াছে, তিনি ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তিই এক্ষণে তাহা রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না। অতএব তাঁহারা ক্লাইবকে পুনরায় ভারতবর্ষে আসিতে অনুরোধ করিলেন।
তিনি ইংলণ্ডে পহুছিলে, ডিরেক্টরেরা তাঁহার সমুচিত পুরস্কার করেন নাই; বরং তাঁহার জায়গীর কাড়িয়া লইয়াছিলেন। তথাপি তিনি তাঁহাদের অনুরোধে পুনরায় ভারতবর্ষে আসিতে সম্মত হইলেন। ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে, কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করিয়া, বাঙ্গালার গবর্ণর ও প্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করিলেন; এবং কহিয়া দিলেন ভারতবর্ষীয় কর্ম্মকারকদিগের নিজ নিজ বাণিজ্য দ্বারাই এত অনর্থ ঘটিতেছে; অতএব তাহা অবশ্য রহিত করিতে হইবেক। আট বৎসরের মধ্যে তাঁহাদের কর্ম্মকারকেরা উপর্য্যুপরি কয়েক নবাবকে সিংহাসনে বসাইয়া, দুই কোটির অধিক টাকা উপঢৌকন লইয়াছিলেন; অতএব তাঁহারা স্থির করিয়া দিলেন সেরূপ উপঢৌকন রহিত করিতে হইবেক। তাঁহারা আরো আজ্ঞা করিলেন কি রাজকীয় কি সেনাসম্পৰ্কীয় সমস্ত কর্ম্মকারকদিগকেই এক এক নিয়ম পত্রে স্বাক্ষর ও এই প্রতিজ্ঞা করিতে হইবেক,চারি হাজার টাকার অধিক উপঢৌকন পাইলে সরকারী ভাণ্ডারে জমা করিয়া দিব এবং গবর্ণরের অনুমতি ব্যতিরেকে হাজার টাকার অধিক উপহার লইব না।
ডিরেক্টরেরা এই সকল উপদেশ দিয়া ক্লাইবকে ভারতবর্ষে প্রেরণ করিলেন। তিনি, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের ৩রা মে, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলেন ডিরেক্টরেরা যে সকল আপদ্ আশঙ্কা করিয়া উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন সে সমস্ত অতিক্রান্ত হইয়াছে, কিন্তু গবর্ণমেণ্ট যৎপরোনাস্তি বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছে। অন্যের কথা দূরে থাকুক, কৌন্সিলের মেম্বরেরাও কোম্পানির মঙ্গল চেষ্টা করেন না। সমুদায় কর্ম্মকারকেরই এই অভিপ্রায়, যে কোন উপায়ে শীঘ্র শীঘ্র অর্থ সঞ্চয় করিয়া ত্বরায় ইংলণ্ড প্রতিগমন করিব। সকল বিষয়েই সম্পূর্ণরূপ অবিচার। আর এতদ্দেশীয় লোকদিগের উপর এত অত্যাচার হইতে আরম্ভ হইয়াছিল যে ইঙ্গরেজ এই শব্দ শুনিলেই তাঁহাদের মনে ঘৃণার উদয় হইত। ফলতঃ, তৎকালে গবর্ণমেণ্ট সংক্রান্ত ব্যক্তিদিগের ধর্ম্ম জ্ঞান ও ভদ্রতার লেশমাত্র ছিল না।
পূর্ব্ব বৎসর ডিরেক্টরেরা দৃঢ়রূপে আজ্ঞা করিয়াছিলেন তাঁহাদের কর্ম্মকারকেরা আর কোন রূপে উপঢৌকন লইতে পারিবেন না। এই আজ্ঞা উপস্থিত হইবার সময় বৃদ্ধ নবাব মীরজাফর মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। কৌন্সিলের মেম্বরের উক্ত আজ্ঞা কৌন্সিলের পুস্তকে নিবিষ্ট করেন নাই; বরং, মীরজাফরের মৃত্যুর পর, অন্য এক ব্যক্তিকে নবাব করিয়া তাঁহার নিকট অনেক উপহার গ্রহণ করেন। সেই পত্রে ডিরেক্টরেরা ইহাও আদেশ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কর্ম্মকারকদিগকে নিজ নিজ বাণিজ্য পরিত্যাগ করিতে হইবেক। কিন্তু এই স্পষ্ট আজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়া কৌন্সিলের সাহেবেরা নূতন নবাবের সহিত বন্দোবস্ত করেন যে ইঙ্গরেজেরা পূর্ব্ববৎ বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিতে পাইবেন।
ক্লাইব, উপস্থিতির অব্যবহিত পরেই, ডিরেক্টরদিগের আজ্ঞা সকল প্রচলিত করিতে ইচ্ছা করিলেন। কৌনসিলের মেম্বরেরা বানসিটার্ট সাহেবের সহিত যেরূপ বিবাদ করিতেন তাঁহারও সহিত সেই রূপ করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু ক্লাইব অন্যবিধ পদার্থে নির্ম্মিত। তিনি জিদ করিতে লাগিলেন যে, সকল ব্যক্তিকেই,আর উপটৌকন লইব না বলিয়া, নিয়ম পত্রে স্বাক্ষর করিতে হইবেক। যাঁহারা অস্বীকার করিলেন তিনি তাঁহাদিগকে তৎক্ষণাৎ পদচ্যুত করিলেন। তদ্দর্শনে কেহ কেহ স্বাক্ষর করিলেন। আর যাঁহারা অপর্য্যাপ্ত অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন তাঁহারা গৃহ প্রস্থান করিলেন। কিন্তু সকলেই নির্ব্বিশেষে ক্লাইবের শক্র হইয়া উঠিলেন।
সমুদায় রাজস্ব যুদ্ধ ব্যয়েই পর্য্যবসিত হইতেছে, অতএব সন্ধি করা অতি আবশ্যক; ইহা বিবেচনা করিয়া ক্লাইব, জুন মাসের চতুর্ব্বিংশ দিবসে, পশ্চিমাঞ্চল যাত্রা করিলেন। নজমউদ্দৌলার সহিত এইরূপ সন্ধি হইল যে ইঙ্গরেজেরা রাজ্যের সমস্ত বন্দোবস্ত করিবেন, আর তিনি, আপন ব্যয় নির্ব্বাহের নিমিত্ত, প্রতি বৎসর পঞ্চাশ লক্ষমাত্র টাকা পাইবেন; মহমদ রেজাখাঁ, রাজা দুর্লভরাম ও জগৎ শেঠ এই তিন জনের মতানুসারে ঐ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ব্যয়িত হইবেক। কিছু দিন পরেই অযোধ্যার নবাবের সহিত ও সন্ধি হইল।
এই যাত্রায় যে সকল কার্য্য নিষ্পত্তি হয়, দিল্লীর সম্রাটের নিকট হইতে কোম্পানির নামে তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্তি সেই সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর। পূর্ব্বে লিখিত হইয়াছে, সম্রাট্ অঙ্গীকার করিয়াছিলেন ইঙ্গরেজেরা যখন প্রার্থনা করিবেন তখনি তিনি তাঁহাদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানী দিবেন। অতএব ক্লাইব, এলাহবাদে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, এই প্রতিজ্ঞা পরিপুরণার্থে প্রার্থনা করিলেন। তিনিও তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। ১২ই আগষ্ট, সম্রাট্ কোম্পানি বাহাদুরকে বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী প্রদান করিলেন; এবং ক্লাইব স্বীকার করিলেন উৎপন্ন রাজস্ব হইতে সম্রাটকে প্রতি মাসে দুই লক্ষ টাকা দিবেন।
এই স্থলে ইহা উল্লেখ করা উপযুক্ত বোধ হইতেছে যে সম্রাট্ তৎকালে আপন রাজ্যে পলাতক স্বরূপ ছিলেন; সুতরাং তাঁহার রাজকীয় কোন পরিচ্ছদাদি ছিল না। তন্নিমিত্তে ইঙ্গরেজদিগের খানা খাইবার দুই মেজ একত্রিত ও কার্ম্মিক বস্ত্রে মণ্ডিত করিয়া সিংহাসন প্রস্তুত করা গেল। সমস্ত ভারতবর্ষের সম্রাট তদুপরি উপবিষ্ট হইয়া বার্ষিক দুই কোটি টাকার রাজস্ব সহিত তিন কোটি প্রজা ইঙ্গরেজদিগের হস্তে সমর্পণ করিলেন। তৎকালীন মুসলমান ইতিহাসলেখক এই বিষয়ে ইঙ্গিত করিয়াছেন যে সময়ান্তরে এরূপ গুরুতর ব্যাপার নির্ব্বাহ বিষয়ে কত কত নীতিজ্ঞ মন্ত্রী ও কার্য্যদক্ষ দূত প্রেরণ ও কত কত বাদানুবাদের আবশ্যকতা হইত। কিন্তু এক্ষণে ইহা এত অল্প সময়ে সম্পন্ন হইল যে এক পাল পশু অথবা একটা গর্দভ বিক্রয়ও ঐ সময় মধ্যে সম্পন্ন হইয়া উঠে না। পলাশির যুদ্ধের পর ইঙ্গরেজদিগের পক্ষে যে সকল হিতজনক ব্যাপার ঘটে, এই বিষয় সেই সকল অপেক্ষা গুরুতর। ইঙ্গরেজের ঐ যুদ্ধ দ্বারা বাস্তবিক এতদ্দেশের প্রভু হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু এতদ্দেশীয় লোকের এপর্যন্ত তাঁহাদিগকে কেবল জেতৃস্বরূপ গণনা করিতেন; এক্ষণে, সম্রাটের এই দান দ্বারা, তিন প্রদেশের যথার্থ অধিকারী ৰোধ করিলেন। তদবধি মুরশিদাবাদের নবাব সাক্ষিগোপাল হইলেন। ক্লাইব এই সকল ব্যাপার সমাধান করিয়া, ৭ই সেপ্টম্বর, কলিকাতা প্রত্যাগমন করিলেন।
কোম্পানির কর্ম্মকারকেরা যে নিজ নিজ বাণিজ্য করিতেন, তাহাতেই যৎপরোনাস্তি অত্যাচার ঘটিত। অতএব ডিরেক্টরেরা বারম্বার এই আদেশ করেন যে ইহা একবারেই রহিত হয়। কিন্তু তাঁহাদের কর্ম্মকারকেরা ঐ সকল হুকুম এপর্যন্ত গোলমাল করিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের অন্তিম আদেশ কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট ছিল; এবং ক্লাইবও বিবেচনা করিলেন যে সিবিল সরবেণ্টদিগের বেতন অত্যন্ত অল্প; সুতরাং তাহারা অবশ্যই গৰ্হিত উপায় দ্বারা পোষাইয়া লইবেক। অতএব তিনি তাহাদের বাণিজ্য, একবারে রহিত না করিয়া, ভদ্র রীতিক্রমে চালাইবার মনস্থ করিলেন।
অনন্তর ক্লাইৰ লবণ, গুবাক, তবাক, এই তিন বস্তুর বাণিজ্য ভদ্র রীতিক্রমে চালাইবার নিমিত্ত এক সভা স্থাপন করিলেন। নিয়ম হইল, শীত করা ৩৫ টাকার হিসাবে কোম্পানির ধনাগারে মাশুল জমা করা যাইবেক; এবং যে উপস্বত্ব হইবেক রাজকীয় ও সেনা সম্পর্কীয় সমুদায় কর্ম্মকারকেরা তাহা অংশ করিয়া লইবেন। কৌন্সিলের মেম্বরেরা অধিক অংশ পাইবেন এবং তাঁহাদিগের নীচের কর্ম্মকারকেরা অপেক্ষাকৃত ন্যুন পরিমাণে প্রাপ্ত হইবেন।
ডিরেক্টরদিগের নিকট এই বাণিজ্য প্রণালীর সংবাদ পাঠাইবার সময়, ক্লাইৰ তাঁহাদিগকে গবর্ণরের বেতন বাড়াইয়া দিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়াছিলেন; কারণ, তাহা হইলে তাঁহার এই বাণিজ্য বিষয়ে কোন সংস্রব রাথিবার আবশ্যকতা থাকিবেক না। কিন্তু তাঁহার তৎপরে পঞ্চদশ বৎসর পর্যন্ত এই সৎপরামর্শ গ্রাহ্য করেন নাই। তাঁহারা উক্ত নূতন সভা স্থাপনের সংবাদ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র রূঢ় বাক্যে তাহা অস্বীকার করিলেন; ক্লাইব এই সভা স্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার যথোচিত তিরস্কার লিখিলেন; এবং এই আদেশ পাঠাইলেন যে উক্ত সভা রহিত করিতে হইবেক ও কোন সরকারী কর্ম্মকারক বাঙ্গালার বাণিজ্যে লিপ্ত থাকিতে পারিবেক না।
এ কাল পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের সমুদায় রাজস্ব কেবল রাজকার্য্য নির্ব্বাহের ব্যয়েই পর্য্যবসিত হইতেছিল। কোম্পানির শুনিতে অনেক আয় ছিল বটে; কিন্তু তাঁহারা সর্ব্বদাই ঋণগ্রস্ত ছিলেন। কি ইউরোপীয় কি এতদ্দেশীয়, সমুদয় কর্ম্মকারকেরাই কেবল লুঠ করিত; কিছুই দয়া ভাবিত না। ইংলণ্ডে ক্লাইবকে জিজ্ঞাসা করা গিয়াছিল যে কোম্পানির এত আয় থাকিতেও চিরকাল এত অপ্রতুল কেন। তাহাতে তিনি এই উত্তর দেন যে কোন ব্যক্তিকে কোম্পানি বাহাদুরের নামে এক বার বিল করিতে দিলেই সে তাহাতে বিষয় করিয়া লয়।
কিন্তু ব্যয়ের প্রধান কারণ সৈন্য। সৈন্য সকল যাবৎ নবাবের হইয়া যুদ্ধ করিত, তিনি তত দিন তাহাদিগকে ভাতা দিতেন। এই ভাতাকে ডবলবার্টা কহা যাইত। এই পারিতোষিক তাহারা এত অধিক দিন পর্য্যন্ত পাইয়া আসিয়াছিল যে পরিশেষে তাহা আপনাদিগের ন্যায্য প্রাপ্য বোধ করিত। ক্লাইব দেখিলেন যে সৈন্যের ব্যয় লাঘব করিতে না পারিলে কখনই রাজস্ব বাঁচিতে পারে না। তিনি ইহাও জানিতেন যে ব্যয় লাঘবের যে কোন প্রণালী করিব তাহাতেই আপত্তি উত্থাপিত হইবেক। কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন; অতএব একবারেই এই আজ্ঞা প্রকাশ করিলেন যে অদ্যাবধি ডবলবাটা রহিত হইল।
এই ব্যাপার শ্রবণ করিয়া সেনাসম্পৰ্কীয় কর্ম্মকারকেরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহারা কহিলেন আমাদের অস্ত্রবলে দেশ জয় হইয়াছে; অতএব তদ্দ্বারা আমাদের উপকার হওয়া সর্ব্বাগ্রে উচিত। কিন্তু ক্লাইবের মন বিচলিত হইবার নহে। তিনি তাঁহাদিগকে কিছু কিছু দিতে ইচ্ছুক ছিলেন; কিন্তু ইহাও স্থির করিয়াছিলেন সৈন্যের ব্যয় লাঘব করা অত্যন্ত আবশ্যক। সেনাপতিরা ক্লাইবকে আপনাদিগের অভিপ্রায়ানুসারে কর্ম্ম করাইবার নিমিত্ত চক্রান্ত করিলেন। তাঁহারা পরস্পর গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন সকলেই এক দিনে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিব।
প্রথম ব্রিগেডের সেনাপতিরা এইরূপে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিবামাত্র, ক্লাইব তাহার সংবাদ পাইয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন; এবং সন্দেহ করিতে লাগিলেন হয় ত সমুদায় সৈন্য মধ্যেই এইরূপ চক্রান্ত হইয়াছে। তিনি অনেক বার অনেক আপদে পড়িয়াছিলেন; কিন্তু এমন দায়ে কখন ঠেকেন নাই। এ দিকে মহারাষ্ট্ৰীয়েরা পুনর্ব্বার বাঙ্গালা দেশ আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন, এ দিকে ইঙ্গরেজদিগের.সেনা অধ্যক্ষহীনা হইল। কিন্তু ক্লাইব, তাহাতেও চলচিত্ত না হইয়া, আপন স্বভাবসিদ্ধ সাহস সহকারে কার্য্য করিতে লাগিলেন। তিনি মাদ্রাজ হইতে সেনাপতি আনয়নের আজ্ঞা প্রদান করিলেন। বাঙ্গালার যে যে সেনাপতি স্পষ্ট বিদ্রোহী হয়েন নাই তাঁহারা ক্ষান্ত হইলেন। ক্লাইব প্রধান প্রধান বিদ্রোহিদিগকে পদচ্যুত করিয়া ইংলণ্ড পাঠাইয়া দিলেন। এবম্বিধ কাঠিন্য দ্বারা পুনর্ব্বার সৈন্যদিগকে বশীভূত করিয়া আনিলেন; এবং গবর্ণমেণ্টকেও এই অভূতপূর্ব্ব ঘোরতর আপদ হইতে মুক্ত করিলেন।
ক্লাইব ভারতবর্ষে আসিয়া বিংশতি মাসে কোম্পানির কার্য্যের সুশৃঙ্খলা স্থাপন ও ব্যয়ের লাঘব করিলেন তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রাপ্তি দ্বারা রাজস্ব বৃদ্ধি করিয়া প্রায় দুই কোটি টাকা বার্ষিক আয় স্থিত করিলেন, এবং সৈন্যের মধ্যে ষে ঘোরতর বিদ্রোহ উপস্থিত হয় তাহার শান্তি করিয়া বিলক্ষণ রূপে সুরীতি স্থাপন করিলেন। তিনি এই সমস্ত গুরুতর পরিশ্রম দ্বারা শারীরিক এরূপ ক্লিষ্ট হইলেন যে স্বদেশে প্রস্থান না করিলে চলে না। অতএব ১৭৬৭ খৃঃ অব্দের ফেব্রুয়ারিতে জাহাজে আরোহণ করিলেন।
ইঙ্গরেজেরা দেওয়ানী প্রাপ্ত হইয়াছিলেন বটে অর্থাৎ সম্রাট্ তাঁহাদিগকে বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার সমুদায় রাজস্ব দান করিয়াছিলেন; কিন্তু এতদ্দেশীয় রাজস্ব সংক্রান্ত কার্য্য নির্ব্বাহবিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ ছিলেন। কোম্পানির ইউরোপীয় কর্ম্মকরের এপর্য্যন্ত কেৰল বাণিজ্য ব্যাপারেই ব্যাপৃত ছিলেন, ভূমির কর সংগ্রহ বিষয়ে কিছুই অবগত ছিলেন না।
পূর্ব্ব পুর্ব্ব সুবাদারেরা, হিন্দুদিগকে অভ্যন্ত সহিষ্ণু স্বভাব ও হিসাবে নিপুণ দেখিয়া,এই সকল বিষয়ের ভার তাঁহাদের হস্তে অৰ্পণ করিতেন। ইঙ্গরেজের এই জয়লন্ধ দেশের তাবৎ বিষয়েই অজ্ঞ ছিলেন, সুতরাং তাঁহাদিগকেও সমস্ত ব্যাপারই পুর্ব্ব রীতি অনুসারে প্রচলিত রাখিতে হইল। রাজা সিতাব রায়,বিহারের দেওয়ানের কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, পাটনায় অবস্থিতি করিলেন; আর মহমদ রেজা খাঁ, বাঙ্গালার দেওয়ান হইয়া, মুরশিদাবাদে রহিলেন। প্রায় সাত বৎসর এইরূপে রাজ্যশাসন হইল। পরে, ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, ইঙ্গরেজের স্বয়ং সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে আরম্ভ করিলেন।
এই কয়েক বৎসর, রাজ্যশাসনের কোন প্রণালী বা শৃঙ্খল ছিল না। জমীদার ও প্রজাবৰ্গ, কাহাকে প্রভু ৰলিয়া মান্য করিবেক, তাহার কিছুই জানিত না। সমুদায় রাজকার্য্য নির্ব্বাহের ভার নবাব ও তদীয় অমাত্যবর্গের হস্তে ছিল। কিন্তু ইঙ্গরেজের এ দেশের সর্ব্বত্র এমত প্রবল হইয়াছিলেন যে, তাঁহারা যৎপরোনাস্তি অত্যাচার করিলেও, ব্লাজপুরুষের তাঁহাদের শাসন করিভে পারিতেন না। আর পার্লিমেণ্টের বিধানানুসারে কলিকাতার গবর্ণর সাহেবেরও এমত ক্ষমতা ছিল না যে মহারাষ্ট্র খাতের বহির্ভাগে কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করিলে তাহার দণ্ড বিধান করিতে পারেন। ফলতঃ, ইঙ্গরেজদিগের দেওয়ানী প্রাপ্তির পর সাত বৎসর, সমস্ত দেশে যেরূপ ক্লেশ ও গোলযোগ ঘটিয়াছিল তাহার ইয়ত্তা করা যায় না।
এইরূপে কয়েক বৎসর রাজ্যশাসন বিষয়ে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে, ডাকাইতেরা অত্যন্ত সাহসিক হইয়াছিল। সকল জিলাই ডাকাইতের দলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল; তাহাতে কোন ধনবান্ ব্যক্তি নিরাপদে ছিলেন না। ফলতঃ ডাকাইতীর এত বাড়াবাড়ি হইয়াছিল, ষে ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, যখন কোম্পানি বাহাদুর আপন হস্তে রাজ্যশাসনের ভার লইলেন, তখন তাঁহাদিগকে, ডাকাইতীর দমনের নিমিত্ত,অতি কঠিন কঠিন আইন জারী করিতে হইয়াছিল। তাঁহারা এরূপ আজ্ঞা করিয়াছিলেন যে ডাকাইতকে তাহার নিজগ্রামে লইয়া গিয়া ফাঁশী দেওয়া যাইবেক; তাহার পরিবার চিরকালের নিমিত্ত রাজকীয় দাস হইবেক; এবং সেই গ্রামের সমুদায় লোককে শক্তি অনুসারে দগু দিতে হইবেক।
এই অরাজক সময়েতেই অধিকাংশ ভূমি নিষ্কর হয়। সম্রাট্ বাঙ্গালার সমুদায় রাজস্ব ইঙ্গরেজদিগকে নির্দ্ধারিত করিয়া দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা কলিকাতায় আদায় না হইয়া মুরশিদাবাদে আদায় হইত। মালের কাছারিও সেই স্থানেই ছিল। মহমদ রেজা খাঁ, রাজা দুর্ল্লভরাম ও রাজা কান্তসিংহ এই তিন ব্যক্তি বাঙ্গালার রাজস্বসম্পৰ্কীয় সমুদায় কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। তাঁহারাই সমুদায় বন্দোবস্ত করিতেন এবং রাজস্ব আদায় করিয়া কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতেন। তৎকালে জমীদারেরা কেবল প্রধান করসংগ্রাহক ছিলেন। তাঁহারা, পুর্ব্বোক্ত তিন মহাত্মার ইচ্ছাকৃত অনবধানবলে, ইঙ্গরেজদিগের চক্ষুঃ ফুটিবার পূর্ব্বে, প্রায় চল্লিশ লক্ষ বিঘা সরকারী ভূমি ব্রাহ্মণদিগকে নিষ্কর দান করিয়া, গবর্ণমেণ্টের বার্ষিক প্রায় ত্রিশ চল্লিশ লক্ষ টাকা ক্ষতি করেন।
লার্ড ক্লাইবের প্রস্থানের পর বেরিলষ্ট সাহেব ১৭৬৭ খৃঃ অব্দে বাঙ্গালার গবর্ণর হইলেন। পর বৎসর ডিরেক্টরেরা, সরকারী কর্ম্মকারকদিগের লবণ ও অন্যান্য বস্তু বিষয়ক বাণিজ্য রহিত করিবার নিমিত্ত, চূড়ান্ত হুকুম পাঠাইলেন। তাঁহারা এইরূপ আদেশ করিয়াছিলেন যে দেশীয় বাণিজ্য কেবল দেশীয় লোকেরাই করিবেক, কোন ইউরোপীয় তাহাতে লিপ্ত থাকিতে পারিবেক না। কিন্তু ইউরোপীয় কর্ম্মকারকদিগের বেতন অত্যন্ত অল্প ছিল; এ জন্য তাঁহারা ইহাও আদেশ করিয়াছিলেন যে বেতন ব্যতিরিক্ত সরকারী খাজানা হইতে শতকরা আড়াই টাকার হিসাবে দেওয়া যাইবেক সেই টাকা সমুদায় সিবিল ও মিলিটারি কর্ম্মকারকেরা যথাযোগ্য অংশ করিয়া লইবেন।
ক্লাইবের প্রস্থানের পর, কোম্পানির কার্য্য সকল পুনর্ব্বার বিশৃঙ্খল হইতে লাগিল। ভারতবর্ষে আয় অনেক ছিল বটে, কিন্তু ব্যয় তদপেক্ষায় অধিক হইতে লাগিল। ধনাগারে দিনে দিনে বিষম অনাটন হইতে লাগিল। কলিকাতার গবর্ণর, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দের অক্টোবরে, হিসাব পরিষ্কার করিয়া দেখিলেন অনেক দেনা হইয়াছে,এবং আরও দেন না করিলে চলে না। তৎকালে টাকা সংগ্রহ করিবার এই রীতি ছিল। কোম্পানির ইউরোপীয় কর্ম্মকারকেরা যে অর্থ সঞ্চয় করিতেন, গবর্ণর সাহেব, কলিকাতার ধনাগারে তাহা জমা করিয়া লইয়া, লণ্ডন নগরে ডিরেক্টরদিগের উপর সেই টাকার বরাত পাঠাইতেন। ভারতবর্ষ হইতে যে সকল পণ্যদ্রব্য প্রেরিত হইত, তাহা বিক্রয় করিয়া অর্থ সংগ্রহ ব্যতিরেকে, ডিরেক্টরদিগের ঐ হুণ্ডীর টাকা দিবার অন্য কোন উপায় ছিল না। কলিকাতার গবর্ণর যথেষ্ট ধার করিতে লাগিলেন কিন্তু পুর্ব্বাপেক্ষায় ন্যুন পরিমাণে পণ্যদ্রব্য পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন। সুতরাং ঐ সকল হুণ্ডীর টাকা দেওয়া ডিরেক্টরদিগের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিল। এজন্য তাঁহারা কলিকাতার গবর্ণরকে এই আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন যে,আর এইরূপ হুণ্ডী না পাঠাইয়া, এক ৰৎসর কলিকাতাতেই টাকা ধার করিয়া কার্য্য সম্পন্ন কর।
ইহাতে এই ফল হইল, ষে সরকারী কর্ম্মকারকেরা ফরাসি, ওলন্দাজ ও দিনামারদিগের দ্বারা আপন আপন উপার্জ্জিত অর্থ ইউরোপে পাঠাইতে লাগিলেন, অর্থাৎ চন্দন নগর, চুঁচুড়া ও স্ত্রীরামপুরের ধনাগারে টাকা জমা করিয়া দিয়া, বিলাতের অন্যান্য কোম্পানির নামে হুগুী লইতে আরম্ভ করিলেন। উক্ত সওদাগরের ঐ সকল টাকায় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করিয়া ইউরোপে পাঠাইতেন, এবং হুগুীর মিয়াদ মধ্যেই ঐ সমস্ত বস্তু তথায় পহুছিত ও বিক্রয় হইত। এই উপায় দ্বারা ভারতবর্ষবাসি অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদিগের, টাকার অসঙ্গতি নিমিত্ত, কোন ক্লেশ ছিল না। কিন্তু ইঙ্গরেজ কোম্পানি যৎপরোনাস্তি ক্লেশে পড়িলেন। ডিরেক্টরেরা নিষেধ করিলেও, কলিকাতার গবর্ণর অগত্যা পুনর্ব্বার পুর্ব্ববৎ ঋণ করিয়া, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দে ইংলণ্ডে হুগুী পাঠাইলেন; তাহাতে লণ্ডন নগরে কোম্পানির কার্য্য একবারে উচ্ছিন্ন হইবার সম্ভাবনা হইয়া উঠিল।
নজমউদ্দৌলা ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে নবাব হইয়াছিলেন। পর বৎসর তাঁহার মৃত্যু হইলে, সৈফউদ্দৌলা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন। ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, বসন্ত রোগে তাঁহার প্রাণান্ত হইলে তদীয় ভ্রাতা মোবারিকউদ্দৌলা তৎপদের অধিকারী হইলেন। তাঁহার পুর্ব্বাধিকারিরা, আপন আপন ব্যয়ের নিমিত্ত, যত টাকা পাইতেন, কলিকাতার কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকেও তাহাই দিতে লাগিলেন। কিন্তু ডিরেক্টরেরা প্রতি বৎসর তাঁহাকে তত না দিয়া ১৬ লক্ষ টাকা দিবার আদেশ করিলেন। ১৭৭০ অব্দে, ঘোরতর দুর্ভিক্ষ হওয়াতে, দেশ শূন্য হইয়া গিয়াছিল। উক্ত দুর্ঘটনার সময় দরিদ্র লোকেরা যে কি পর্য্যন্ত ক্লেশ ভোগ করিয়াছিল তাহা বর্ণন করা যায় না। এই মাত্র কহিলেই এক প্রকার বোধগম্য হইতে পরিবেক যে ঐ ছুর্ভিক্ষে দেশের প্রায় তৃতীয়াংশ লোক কালগ্রাসে পতিত হয়। ঐ বৎসরেই ডিরেক্টরেরা মুরশিদাবাদে ও পাটনায় কৌন্সিল অব রেবিনিউ স্থাপন করিতে আদেশ প্রদান করেন। তাঁহাদিগের এই কর্ম্ম নিৰ্দ্ধারিত হইয়ছিল যে তাঁহারা রাজস্ব বিষয়ক তত্ত্বানুসন্ধান ও দাখিলা পরীক্ষা করিবেন। কিন্তু রাজস্বের কর্ম্মনির্ব্বাহ এখন পর্য্যন্তও দেশীয় লোকদিগের হস্তেই রহিল। মহমদ রেজা খাঁ মুরশিদাবাদে, ও রাজা সিতাব রায় পাটনায়, থাকিয়া পুর্ব্ববৎ কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। ভূমিসম্পৰ্কীয় সমুদায় কাগজ পত্রে তাঁহাদেরই সহী মোহর চলিত।
শ্রীযুত বেরিলষ্ট সাহেব, ১৭৬৯ খৃঃ অব্দে, গবর্ণরী পদ পরিত্যাগ করাতে, কার্টিয়র সাহেব তৎপদে অধিরূঢ় হইলেন। কিন্তু, কলিকাতার গবর্ণমেণ্টের অকর্ম্মণ্যতা প্রযুক্ত, কোম্পানির কার্য্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ও উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়া উঠিল। অতএব ডিরেক্টর সাহেবেরা, সমুদায় কুরীতি সংশোধন ও ব্যয় লাঘব করিবার নিমিত্ত, কলিকাতার পুর্ব্ব গবর্ণর বান্সিটার্ট, স্ক্রাফটন, কর্ণেল ফোর্ড এই তিন জনকে ভারতবর্ষে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু তাঁহারা যে জাহাজে আরোহণ করিয়াছিলেন, কেপ উর্ত্তীর্ণ হইবার পর, আর তাহার কোন উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই। সকলে অনুমান করেন ঐ জাহাজ সমুদায় লোক সহিত সমুদ্রে মগ্ন হইয়াছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়।
কার্র্টিয়র সাহেব, ১৭৭২ খৃঃ অব্দে, গবর্ণরী পরিত্যাগ করিলে, শ্রীযুত ওয়ারন হেস্টিংস সাহেব তৎপদে অধিরূঢ় হইলেন। হেষ্টিংস, ১৭৪৯ খৃঃ অব্দে, রাজকীয় কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, আঠার বৎসর বয়ঃক্রম কালে এতদ্দেশীয় আগমন করেন; এবং গুরুতর পরিশ্রম সহকারে এতদ্দেশীয় ভাষা ও রাজনীতি শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। ১৭৫৭ খৃঃ অব্দে, ক্লাইব তাঁহাকে মুরশিদাবাদের রেসিডেণ্টের কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তৎকালে গবর্ণরের পদ ভিন্ন এতদপেক্ষায় মান্য কর্ম্ম আর ছিল না। যখন বান্সিটার্ট সাহেব কলিকাতার প্রধান পদ প্রাপ্ত হয়েন তখন কেবল হেষ্টিংস সাহেবই তাঁহার বিশ্বাসপাত্র ছিলেন। ১৭৬১ খৃঃ অব্দের ডিসেম্বর মাসে,হেষ্টিংস কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বর হন। তৎকালে অন্য সকল মেম্বরেরাই বানসিটার্ট সাহেবের প্রতিপক্ষ ছিলেন কেবল তিনিই একাকী তাঁহার পোষকতা করিতেন। ১৭৭০ খৃঃ অব্দে ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে মাদ্রাজ কৌন্সিলের দ্বিতীয় পদে অভিষিক্ত করেন। তিনি তথায় নানা সুনিয়ম প্রচলিত করেন; তাহাতে ডিরেক্টরেরা তাঁহার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। পরে, কলিকাভার গবর্ণরের পদ শূন্য হইলে, তাঁহারা তাঁহাকে সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া তৎপদে অভিষিক্ত করিলেন। তৎকালে তাঁহার চল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রম হইয়াছিল।
দেশীয় লোকেরা যে রাজস্ব সংক্রান্ত সমুদায় বন্দোবস্ত করেন ইহাতে ডিরেক্টরেরা অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন। তাঁহারা দেখিলেন আয় ক্রমেই অল্প হইতেছে। অতএব, দেওয়ানী প্রাপ্তির সাত বৎসর পরে, তাঁহারা যথার্থ দেওয়ান হইতে, অর্থাৎ রাজস্বের বন্দোবস্তের ভার আপনাদের হস্তে লইয়া ইউরোপীয় কর্ম্মকারক দ্বারা কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে, মনস্থ করিলেন। এই নূতন নিয়ম হেষ্টিংস সাহেবকে অসিয়াই প্রচলিত করিতে হইল। তিনি ১৩ ই এপ্রিল গবর্ণরের পদ গ্রহণ করিলেন। ১৪ই মে, কৌন্সিলের সম্মতি ক্রমে এই ঘোষণা প্রচার হইল যে ইঙ্গরেজেরা স্বয়ং রাজস্বের কার্য নির্ব্বাহ করিবেন; যে সকল ইউরোপীয় কর্ম্মকারকেরা রাজস্বের কর্ম্ম করিবেন, তাঁহাদের নাম কালেক্টর হইবেক; কিছু কালের নিমিত্ত, সমুদায় জমী ইজারা দেওয়া যাইবেক; আর কৌন্সিলের চারি জন মেম্বর সমুদায় প্রদেশে গিয়া সমস্ত বন্দোবস্ত করিবেন। ইঁহারা প্রথমেই কৃষ্ণনগরে ষাইয়া কার্য্যারম্ভ করিলেন। কিন্তু পূর্ব্বাধিকারিরা অত্যন্ত কম নিরিখে মালগুজারী দিতে চাহিবাতে, তাঁহারা সমুদায় জমী নীলাম ডাকাইতে লাগিলেন। যে জমীদার অথবা তালুকদার ন্যায্য মালগুজারী দিতে সন্মত হইলেন,তিনিই আপন বিষয় পুর্ব্ববৎ অধিকার করিতে লাগিলেন। আর যিনি অত্যন্ত কম দিতে চাহিলেন, তাঁহাকে পেন্সিয়ন দিয়া অধিকারচ্যুত করিয়া, তৎপরিবর্ত্তে অন্য ব্যক্তিকে অধিকার দেওয়াইলেন। গবর্ণর স্বচক্ষে সমুদায় দেখিতে পরিবেন, এই অভিপ্রায়ে মালের কাছারী মুরশিদাবাদ হইতে কলিকাতায় আনীত হইল।
এইরূপে রাজস্ব কর্ম্মের নিয়ম পরিবর্ত্ত হওয়াতে, দেশের দেওয়ানী ও ফৌজদারী কর্ম্মেরও নিয়ম পরিবর্ত্ত আবশ্যক হইল। প্রত্যেক প্রদেশে, এক ফৌজদারী এক দেওয়ানী, দুই দুই বিচারালয় সংস্থাপিত হইল। ফৌজদারী আদালতে কালেক্টর সাহেব, কাজী, ও মুকতী এই কয়েক জন একত্র হইয়া বিচার করিতেন। আৱ দেওয়ানী আদালতেও কালেক্টর সাহেব মোকদমা করিতেন, দেওয়ান ও অন্যান্য আমলারা তাঁহার সহকারিতা করিত। মোকদ্দমার আপীল শুনিবার নিমিত্ত কলিকাতায় দুই বিচারালয় স্থাপিত হইল। তন্মধ্যে যে স্থলে দেওয়ানী বিষয়ের বিচার হইত, তাহার নাম সদর দেওয়ানী আদালত; ও যে স্থানে ফৌজদারী, তাহার নাম সদর নিজামৎ আদালত রহিল।
এপর্য্যন্ত আদালতে যত টাকার মোকদ্দমা উপস্থিত হইত, জজ সাহেব তাহার চতুর্থাংশ লইতেন; এক্ষণে তাহা রহিত হইল; অধিক জরীমানা রহিত হইল; আর মহাজনদিগের, স্বেচ্ছাক্রমে খাদককে রুদ্ধ করিয়া টাকা আদায় করিবার, যে ক্ষমতা ছিল তাহা নিবারিত হইল; আর দশ টাকার অনধিক দেওয়ানী মোকদ্দমার নিষ্পত্তির ভার পরগনার প্রধান ভূম্যধিকারির হস্তে অপিত হইল। ইঙ্গরেজেরা, আপনাদিগের প্রণালী অনুসারে বাঙ্গালা শাসন করিবার নিমিত্ত, প্রথমে এই সকল নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত করিয়াছিলেন।
ডিরেক্টরেরা স্থির করিয়াছিলেন যে মহমদ রেজা খাঁর অসৎ ব্যবহারেই বাঙ্গালার রাজস্ব ক্ষতি হইতেছে। তাঁহার পদ প্রাপ্তি দিবসাবধি তাঁহারা তাঁহার চরিত্র বিষয়ে সন্দেহ করিতেন। আর তাঁহারা ইহাও বিস্মত হয়েন নাই, যে যখন তিনি, মীরজাফরের রাজত্ব সময়ে, ঢাকার চাকলায় নিযুক্ত ছিলেন তখন তথায় অনেক লক্ষ টাকা তহবীল ঘাটি হইয়াছিল। কেহ কেহ তাঁহার নামে এ অভিযোগও করিয়াছিল যে তিনি, ১৭৭০ খৃঃ অব্দের দারুণ অকালের সময়, সমধিক লাভপ্রত্যাশায় সমুদায় শস্য একচাটিয়া করিয়াছিলেন। আর সকলে সন্দেহ করিত, তিনি অনেক রাজস্ব ছাপাইয়া রাখিয়াছিলেন এবং প্রজাদিগকেও অধিক নিষ্পীড়ন করিয়াছিলেন।
যৎকালে তিনি মুরশিদাবাদে কর্ম্ম করিতেন, তখন বাঙ্গালায় তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। নায়েব সুবাদার ছিলেন, তদনুসারে রাজস্বের সমুদায় বন্দোবস্তের ভার তাঁহার হস্তে ছিল; আর নায়েব নাজিম ছিলেন, সুতরাং পুলিসেরও সমুদায় ভার তাঁহারই হস্তে ছিল। ডিরেক্টরেরা বুঝিতে পারিলেন, ষত দিন তাঁহার হস্তে এরূপ ক্ষমতা থাকিবেক, কোন ব্যক্তিই তাঁহার দোষ প্রকাশে অগ্রসর হইতে পরিবেক না। অতএব তাঁহারা এই আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন যে মহমদ রেজা খাঁকে কয়েদ করিয়া সপরিবারে কলিকাতায় আনিতে হইবেক, এবং তাঁহার সমুদায় কাগজ পত্র আটক করিতে হইবেক।
হেষ্টিংস সাহেব গবর্ণরের পদে অধিরূঢ় হইবার দশ দিবস পরেই, ডিরেক্টরদিগের এই আজ্ঞা তাঁহার নিকট পহুছে। যৎকালে ঐ আজ্ঞা পহুছিল তখন অধিক রাত্রি হইয়াছিল; এজন্য সে দিবস তদনুযায়ি কার্য্য করা হইল না। পর দিন প্রাতঃকালে তিনি, মহমদ রেজা থাঁকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, মুরশিদাবাদের রেসিডেণ্ট মিডিল্টন সাহেবকে পত্র লিখিলেন। তদনুসারে রেজা খাঁ সপরিবারে জলপথে কলিকাতায় প্রেরিত হইলেন। মিডিল্টন সাহেব তাঁহার কার্য্যের ভার গ্রহণ করিলেন। রেজা খাঁ চিৎপুরে উপস্থিত হইলে,তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে অকস্মাৎ এরূপ ব্যাপার ঘটিবার কারণ জানাইবার নিমিত্ত, এক জন কৌন্সিলের মেম্বর প্রেরিত হইলেন। আর হেষ্টিংস সাহেব এইরূপ পত্র লিখিলেন, আমি কোম্পানির ভৃত্য, আমাকে তাঁহাদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইয়াছে; নতুবা, আপনকার সহিত আমার যে রূপ প্রণয় আছে, তাহার কোন ক্রমে ব্যতিক্রম হইবেক না, জানিবেন।
বিহারের নায়েব দেওয়ান রাজা সিতাব রায়েরও চরিত্র বিষয়ে সেইরূপ সন্দেহ জন্মিয়ছিল; অতএব তিনিও কলিকাতায় আনীত হইলেন। তাঁহার পরীক্ষা অল্প দিনেই সমাপ্ত হইল, পরীক্ষায় তাঁহার কোন দোষ দৃষ্ট হইল না, অতএব তিনি মান পূর্ব্বক বিদায় পাইলেন। তৎকালীন মুসলমান ইতিহাসলেখক তাঁহার সরকারী কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ের প্রশংসা করিয়াছেন; কিন্তু ইহাও লিখিয়াছেন, প্রধান পদারূঢ় অন্যান্য লোকের ন্যায়, তিনিও অন্যায়াচরণ পুর্ব্বক প্রজাদিগের নিকট অধিক ধন গ্রহণ করিতেন।
তাঁহাকে অপরাধী বোধ করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করাতে তাঁহার যে অমর্য্যাদা হইয়াছিল, তাহার প্রতিবিধানার্থে কিছু পারিতোষিক দেওয়া উচিত বোধ হওয়াতে, কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকে এক মর্য্যাদা সুচক পরিচ্ছদ পুরস্কার দিলেন এবং বিহারের রায় রাইয়াঁ করিলেন। কিন্তু অপরাধী বোধ করিয়া পরীক্ষার্থ কলিকাতায় আনয়ন করাতে তাঁহার যে অপমান বোধ হইয়াছিল, তাহাতে তিনি একবারে ভগ্নচিত্ত হইলেন। ইঙ্গরেজেরা এপর্য্যন্ত এ দেশীয় যত লোক নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে তাঁহারা রাজা সিতাব রায়ের সর্ব্বদা অত্যন্ত গৌরব করিতেন। তিনি এরূপ তেজস্বী ছিলেন, যে অপরাধি বোধে অধিকারচ্যুত করা,কয়েদ করিয়া কলিকাতায় আনা, এবং দোষের আশঙ্কা করিয়া পরীক্ষা করা এই সকল অপমান তাঁহার অত্যন্ত অসহ্য হইয়াছিল। ফলতঃ, পাটনা প্রত্যাগমন করিয়া এই মনঃপীড়াতেই তিনি প্রাণ ত্যাগ করিলেন। তাঁহার পুত্র রাজা কল্যাণসিংহ অবিলম্বে তদীয় পদে অভিষিক্ত হইলেন। পাটনা প্রদেশ উৎকৃষ্ট দ্রাক্ষা ফলের নিমিত্ত যে প্রসিদ্ধ হইয়াছে, রাজা সিতাব রায়ই তাহার আদিকারণ। তাঁহার উদ্যোগেই ঐ প্রদেশে দ্রাক্ষা ও খরমুজের চাস আরম্ভ হয়। মহমদ রেজা খাঁর পরীক্ষায় অনেক কাল লাগিয়াছিল। নন্দকুমার তাঁহার দোষোদঘাটক নিযুক্ত হইলেন। প্রথমতঃ স্পষ্ট বোধ হইয়াছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ সপ্রমাণ হইবেক। কিন্তু দ্বৈবার্ষিক বিবেচনার পর নিৰ্দ্ধরিত হইল, মহমদ রেজা খাঁ নির্দ্দোষ; নির্দ্দোষ হইলেন ৰটে কিন্তু আর তিনি পুর্ব্ব কর্ম্ম প্রাপ্ত হইলেন না।
মহমদ রেজা খাঁ পদচ্যুত হইলে পর, নিজামতে তাঁহার যে কর্ম্ম ছিল, তাহা দুই ভাগ হইল। নবাবকে শিক্ষা দেওনের ভার মনিবেগমের প্রতি অর্পিত হইল। আর সমুদায় ব্যয়ের তত্ত্বাবধানার্থে হেষ্টিংস সাহেব নন্দকুমারের পুত্র গুরুদাসকে নিযুক্ত করিলেন। কৌন্সিলের অধিকাংশ মেম্বর এই নিয়োগ বিষয়ে বিস্তর আপত্তি করিলেন; কহিলেন গুরুদাস অত্যন্ত বালক, তাহাকে নিযুক্ত করায়, তাহার পিতাকে নিযুক্ত করা হইতেছে; কিন্তু তাহার পিতাকে কখন বিশ্বাস করা যাইতে পারে না। হেষ্টিংস তাঁহাদের পরামর্শ না শুনিয়া গুরুদাসকেই নিযুক্ত করিলেন।
এই সময়ে, ইংলণ্ডে কোম্পানির বিষয়কর্ম্ম অত্যন্ত ৰিশৃঙ্খল ও উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়াছিল। ১৭৬৭ সালে লার্ড ক্লাইবের প্রস্থান অবধি, ১৭৭২ সালে হেষ্টিংসের নিয়োগ পর্য্যন্ত, পাঁচ বৎসর ভারতবর্ষে যেমন ঘোরতর বিশৃঙ্খলতা ঘটিয়াছিল; ইংলণ্ডে ডিরেক্টরদের কার্য্যও তেমনি ৰিশৃঙ্খল হইয়াছিল। যে সময়ে কোম্পানির দেউলিয়া হইবার উপক্রম হইয়াছে, এমত সময়ে ডিরেক্টরেরা মুলধনের অধিকারিদিগকে শতকরা সাড়ে বার টাকার হিসাবে মুনফার হিস্যা দিলেন। যদি তাঁহাদের কার্য্যের বিলক্ষণরূপ উন্নতি থাকিত, তথাপি এরূপ মুনফা দেওয়া কোন প্রকারেই উচিত হইত না। যাহা হউক, এইরূপ পাগলামির কর্ম্ম করিয়া, ডিরেক্টরেরা দেখিলেন, ধনীগারে এক কপর্দ্দকও সম্বল নাই। অতএব তাঁহাদিগকে, ইংলণ্ডের ব্যাঙ্কেতে, প্রথমতঃ চল্লিশ লক্ষ ও তৎপরে আর বিশ লক্ষ টাকা ধার করিতে হইল। পরিশেষে রাজমন্ত্রির নিকটে গিয়া এক কোটি টাকা ধার চাহিতেও হইয়াছিল।
এপর্য্যন্ত পার্লিমেণ্টের অধ্যক্ষেরা ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কোন বিষয়েই কখন দৃষ্টিপাত করেন নাই। কিন্তু এক্ষণে কোম্পানির বিষয়কর্ম্মের এই প্রকার দুরবস্থা প্রকাশ হওয়াতে, তাঁহারা সমুদায় ব্যাপার আপনাদিগের হস্তে আনিতে মনস্থ করিলেন। কোম্পানির রাজ্যশাসনে যে সকল অন্যায়াচরণ হইয়াছিল, তাহার পরীক্ষার্থে এক কমিটী নিয়োজিত হইল। ঐ কমিটী বিজ্ঞাপনী প্রদান করিলে,রাজমন্ত্রিরা বুঝিতে পারলেন,যে সম্পূর্ণরূপে নিয়ম পরিবর্ত্ত না হইলে, কোম্পানির পরিত্রাণের উপায় নাই। অতএব তাঁহারা, সমুদায় দোষ সংশোধনার্থে, পার্লিমেণ্টে নানা প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। ডিরেক্টরেরা তদ্বিষয়ে,যত দূর পারেন, আপত্তি করিলেন; কিন্তু তাঁহাদের অসদাচরণ এত স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়াছিল,ও তাহাতে মনুষ্য মাত্রেরি এমত ঘৃণা জন্মিয়াছিল, ষে পার্লিমেণ্টের অধ্যক্ষেরা, তাঁহাদের সমস্ত আপত্তি উল্লঙ্ঘন করিয়া, রাজমন্ত্রির প্রস্তাবিত প্রণালীরই পোষকতা করিলেন। অতঃপর, ভারতবর্ষীয় রাজকর্মের সমুদায় প্রণালী, ইংলণ্ড ও ভারতবর্ষ উভয় স্থানেই, পরিবর্ত্তিত হইল। ডিরেক্টর মনোনীত করণ বিষয়েও কিছু কিছু রীতি পরিবর্ত্ত হইল। ইংলণ্ডে কোম্পানির কার্য্যে যে সমস্ত দোষ ঘটিয়াছিল ইহা দ্বারা তাহার অনেক শোধন হইল। ইহাও আদিষ্ট হইল, ষে প্রতি বৎসর ছয় জন ডিরেক্টরকে পদ পরিত্যাগ করিতে হইবেক, এবং তাঁহাদের পরিবর্ত্তে, আরও ছয় জনকে মনোনীত করা যাইবেক। আরও অনুমতি হইল, ষে বাঙ্গালার গবর্ণর ভারতবর্ষের গবর্ণর জেনেরল হইবেন এবং অন্যান্য রাজধানীর রাজনীতি ঘটিত ষাবতীয় ব্যাপার তাঁহার অধীনে থাকিবেক।
গবর্ণর ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের ক্ষমতা বিষয়ে সর্ব্বদাই বিবাদ উপস্থিত হইত; অতএব নিয়ম হইল, গবর্ণর জেনেরল ফোর্ট উইলিয়মের এক মাত্র গবর্ণর ও সেনানী হইবেন। গবর্ণর জেনেরল, কৌন্সিলের মেম্বর, ও জজদিগকে বাণিজ্য করিতে নিষেধ হইল। অতএব গবর্ণরের আড়াই লক্ষ ও কৌন্সিলের মেম্বরদিগের আশী হাজার বার্ষিক বেতন নিৰ্দ্ধারিত হইল। ইহাও আজ্ঞপ্ত হইল, যে কোম্পানির অথবা রাজার কার্য্যে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি উপটৌকন লইভে পরিবেন না। আর ডিরেক্টরদের প্রতি আদেশ হইল, যে ভারতবর্ষ হইতে রাজশাসনসম্পৰ্কীয় যে সকল কাগজ পত্র আসিবেক, সে সমুদায় তাঁহারা রাজমন্ত্রিগণের সম্মুখে উপস্থিত করিবেন।
বিচার নির্ব্বাহ বিষয়ে,এই নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত হইল, যে কলিকাতায় সুপ্রীমকোর্ট নামে এক প্রধান বিচারালয় স্থাপিত হইবেক। তথায় বার্ষিক অশীতি সহস্র মুদ্রা বেতনে এক জন চীফ্ জষ্টিস্ অর্থাৎ প্রধান বিচারকর্ত্তা, ও ষষ্টি সহস্ৰ বেতনে তিন জন পিউনি জজ অর্থাৎ কনিষ্ঠ বিচারকর্ত্তা থাকিবেন। এই জজেরা কোম্পানির অধীন হইবেন না, স্বয়ং রাজা তাঁহাদিগকে নিযুক্ত করিবেন। আর ঐ ধর্ম্মাধিকরণে ইংলণ্ডীয় ব্যবহার সংহিতা অনুসারে ব্রিটিশ সবজেক্টদিগের বিবাদ নিষ্পত্তি করা যাইবেক। পরিশেষে এই অনুমতি হইল, যে ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে পার্লিমেণ্টের অধ্যক্ষেরা প্রথম এই যে নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত করিলেন, ১৭৭৪ সালের ১লা আগষ্ট তদনুযায়ি কার্য্যারম্ভ হইবেক।
হেষ্টিংস সাহেৰ বাঙ্গালার রাজকার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে এমত ক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে তিনিই প্রথম গবর্ণর জেনেরলের পদ প্রাপ্ত হইলেন। সুপ্রীম কৌন্সিলে তাঁহার সহিত রাজকার্য্য পর্য্যালোচনার্থে, চারি জন মেম্বর নিযুক্ত হইলেন। ইহাঁদের মধ্যে, বারওএল সাহেব বহুকালাবধি এতদ্দেশে রাজকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। আর কর্ণেল মনসন্, সর জান ক্লাবরিং ও ফ্রানসিস সাহেব, এই তিন জন কখন এ দেশে আইসেন নাই।
হেষ্টিংস এই তিন নুতন মেম্বরের মাদ্রাজ পহুছিবার সংবাদ শ্রবণমাত্র তাঁহাদিগকে এক অনুরাগসূচক পত্র লিখিলেন। অনন্তর তাঁহারা খাজরীতে পহুছিলে, তিনি কৌন্সিলের প্রধান মেম্বরকে তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পাঠাইলেনএবং তাঁহার এক জন নিজ পারিজদও স্বাগতজিজ্ঞাসার্থে প্রেরিভ হইলেন। তাঁহারা কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলে, তাঁহাদের যেরূপ সমাদর হইয়াছিল, লার্ড ক্লাইব ও বানসিটার্ট সাহেবেরও সেরূপ হয় নাই। আসিবামাত্র সতরটা সেলামি তোপ হয় ও তাঁহাদের সম্বৰ্দ্ধনা করিবার নিমিত্ত কৌন্সিলের সমুদায় মেম্বর একত্র হন। তথাপি তাঁহাদের মন উঠিল না।
তাঁহার ডিরেক্টরদিগের নিকট এই অভিষোগ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে আমরা সমুচিত সমাদর প্রাপ্ত হই নাই; আমাদিগের সম্বৰ্দ্ধনা করিবার নিমিত্ত সৈন্য বহিস্কৃত করা যায় নাই; এবং সেলামি তোপও উপযুক্ত সংখ্যায় হয় নাই; আর আমাদিগের সম্বৰ্দ্ধনা, কৌন্সিল গৃহে না করিয়া, হেষ্টিংসের বাটীতে করা গিয়াছিল; এবং আমরা যে নূতন গবর্ণমেণ্টের অবয়বস্বরূপ আসিয়াছি উপযুক্ত সমারোহ পুর্ব্বক তাহার ঘোষণা করা হয় নাই।
২০ এ অক্টোবর, কৌনসিলের প্রথম সভা হইল; কিন্তু বারওয়েল সাহেব তখন পর্য্যন্ত না পহুছিবাতে, সে দিবস কেবল নূতন গবর্ণমেণ্টের ঘোষণমাত্র হইল। অন্যান্য সমুদায় কর্ম্ম, আগামি সোমবার ২৪ এ তারিখে, বিবেচনার নিমিত্ত রহিল। নূতন মেম্বরেরা ভারতবর্ষের কার্য্য কিছুই অবগত ছিলেন না; অতএব, সভা আরম্ভ হইলে, হেষ্টিংস সাহেব, কোম্পানির সমুদায় কার্য্য যে অবস্থায় চলিতেছিল, তাহার এক সবিশেষ বিবরণ তাঁহাদের সম্মুখে ধরিলেন। কিন্তু এই প্রথম সভাতেই এমত বিবাদ উপস্থিত হইল যে, তদ্দ্বারা ভারত বর্ষের রাজ্যশাসন তদবধি প্রায় সাত বৎসর পর্য্যন্ত অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়াছিল। বারওয়েল সাহেৰ একাকী গবর্ণর জেনেরলের পক্ষ ছিলেন। অন্য তিন জন মেম্বর সকল বিষয়ে সর্ব্বদা তাঁহার বিরুদ্ধ পক্ষেই মত দিতেন। তাঁহাদের সংখ্যা অধিক, সুতরাং গবর্ণর জেনেরল কেবল সাক্ষিগোপাল হইলেন। যেহেতু, যে স্থলে বহু সংখ্যক ব্যক্তির উপর কোন বিষয়ের ভার থাকে, তথায়, মতভেদ হইলে, অধিকাংশ ব্যক্তির মতানুসারেই যাবতীয় কার্য্য নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। বস্তুতঃ সমস্ত ক্ষমতা তাঁহাদের হস্তেই পতিত হইল। তাঁহাদের ভারতবর্ষে আসিবার পুর্ব্বে হেষ্টিংস এতদ্দেশে যে সকল ঘোরতর অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়াছিলেন তাঁহারা তৎসমুদায় সবিশেষ অবগত ছিলেন, এবং হেষ্টিংসকে অতি অপকৃষ্ট লোক স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। অতএব, ন্যায় অন্যায় বিবেচনা না করিয়াই, হেষ্টিংস যাহা কহিতেন,তাহাই অগ্রাহ করিতেন, সুতরাং তাঁহারা যে ক্রোধ দ্বেষ শূন্য হইয়া সকল কর্ম্ম করিবেন তাহার সম্ভাবনা ছিল না।
হেস্টিংস সাহেব, কিয়দ্দিবস পূর্ব্বে, মিডিল্টন সাহেবকে লক্ষণৌ নগরে রেসিডেণ্ট নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এক্ষণে নূতন মেম্বরেরা তাঁহাকে সে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিতে আজ্ঞা দিলেন; এবং হেষ্টিংস সাহেব নবাবের সহিত যে সকল বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, সে সমুদায় অগ্রাহ্য করিয়া তাঁহার নিকট নুতন বন্দোবস্তের প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন। হেস্টিংস তাঁহাদিগকে ক্ষান্ত হইতে অনুরোধ করিলেন, এবং কহিলেন এরূপ হইলে সর্ব্বত্র প্রকাশ হইবেক যে গবর্ণমেণ্ট মধ্যে অনৈক্য উপস্থিত হইয়াছে। এতদ্দেশীয় লোকেরা সর্ব্বদাই গবর্ণরকে গবর্ণমেণ্টের প্রধান বিবেচনা করিয়া থাকে; কিন্তু এক্ষণে তাঁহাকে এরূপে ক্ষমতাশূন্য দেখিয়া,সহজেই বোধ করিতে পারে যে রাজবিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু ফ্রান্সিস্ ও তৎপক্ষীয়েরা ক্রোধ-দ্বেষ-পরবশতা প্রযুক্ত তাহা শুনিলেন না।
দেশীয় লোকের অল্পকাল মধ্যেই কৌন্সিলের এই প্রকার বিবাদের বিষয় অবগত হইলেন; এবং ইহাও জানিতে পারিলেন, যে হেষ্টিংস সাহেব এত কাল সকলের প্রধান ছিলেন, এক্ষণে আর তাঁহার কোন ক্ষমতা নাই। অতএব যে সকল লোক তৎকৃত কোন কোন ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিল, তাহারা ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয় মেম্বরদিগের নিকট তাঁহার নামে অভিযোগ করিতে আরম্ভ করিল। তাঁহারাও আন্তরিক যত্ন ও উৎসাহ সহকারে তাহাদিগের অভিযোগ গ্রাহ্য করিতে লাগিলেন। সেই সময়ে, বর্দ্ধমানের অধিপতি মৃত তিলকচন্দ্রের মহিষী স্বীয় তনয়কে সমভিব্যাহারে করিয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন। তিনি অবিলম্বে এই আবেদন পত্র প্রদান করিলেন যে আমি রাজার মৃত্যুর পর ইঙ্গরেজ ও তাঁহাদিগের কর্ম্মকারকদিগকে নয় লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়াছি; তন্মধ্যে হেষ্টিংস সাহেব ১৫০০০ টাকা লইয়াছেন। ইহাতে হেষ্টিংস, ৰাঙ্গালা ঐ পারসীতে হিসাব দেখিতে চাহিলেন; কিন্তু রাণী কিছুই দেখাইলেন না। কোন ব্যক্তিকে সম্মানদান করা এপর্য্যন্ত গবর্ণমেণ্টের প্রধান ব্যক্তির অধিকার ছিল; কিন্তু হেষ্টিংসের বিপক্ষেরা তাঁহাকে তুচ্ছ করিয়া স্বহস্তে শিশু রাজাকে খেলাত দিলেন।
অতি শীঘ্র শীঘ্র হেষ্টিংসের নামে ভুরি ভুরি অভিযোগ উপস্থিত হইতে লাগিল। এক জন এই বলিয়া দরখাস্ত দিলেক যে হুগলীর ফৌজদার বৎসরে ৭২০০০ টাকা বেতন পাইয়া থাকেন; তন্মধ্যে তিনি হেষ্টিংস সাহেবকে ৩৬০০০ ও তাঁহার দেওয়ানকে ৪০০০ টাকা দেন। আমি ৩২০০০ টাকা পাইলেই ঐ কর্ম্ম নির্ব্বহ করিতে পারি। উপস্থিত অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া, সাক্ষী লওয়া গেল। হেষ্টিংসের বিপক্ষ মেম্বরেরা কহিলেন যথেষ্ট প্রমাণ হইয়াছে। তদনুসারে ফৌজদার পদচ্যুত হইলেন। অন্য এক ব্যক্তি ন্যূন বেতনে ঐ পদে নিযুক্ত হইল; কিন্তু অভিযোক্তার কিছুই হইল না।
এক মাসের মধ্যে আর এক অভিযোগ উপস্থিত হইল। যে মনিবেগম নয় লক্ষ টাকার হিসাব দেন নাই। পীড়াপীড়ি করাতে, বেগম কহিলেন হেষ্টিংস সাহেব যখন আমাকে নিযুক্ত করিতে আইসেন, তাঁহাকে,আমোদ উপলক্ষে ব্যয় করিবার নিমিত্ত,এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়াছি। হেষ্টিংস সাহেব কহিলেন আমি ঐ টাকা লইয়াছি বটে; কিন্তু সরকারী হিসাবে খরচ করিয়া কোম্পানির দেড় লক্ষ টাকা বাঁচাইয়াছি। তিনি ইহাও কহিলেন, যে বাঙ্গালায় নবাব যখন যখন কলিকাতায় ভাসিয়া থাকেন, দৈনন্দিন ব্যয়ের নিমিত্ত, তাঁহাকে ১০০০ টাকা দেওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু হেষ্টিংস সাহেবের এই হেতুবিন্যাস কাহারও মনোগত হইল না।
এক্ষণে স্পষ্ট দৃষ্ট হইল, যে অভিযোগ করিলেই গ্রাহ্য হইতে পারে; অতএব নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন যে গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, সাড়ে তিন লক্ষ টাকা লইয়া, মনিবেগমকে ও আমার পুত্ত্র গুরুদাসকে মুরশিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা প্রস্তাৰ করিলেন, সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত নন্দকুমারকে কৌন্সিলের সম্মুখে আনয়ন করা যাউক। হেষ্টিংস উত্তর করিলেন, আমি যে সভার অধিপতি, তথায় আমার অভিযোক্তাকে আসিতে দিব না। বিশেষতঃ, এমত বিষয়ে অপদার্থ ব্যক্তির ন্যায় সম্মত হইয়া গবর্ণর জেনেরলের পদের অমর্য্যাদা করিব না; বরং এই সমস্ত ব্যাপার সুপ্রীমকোর্টে প্রেরণ করা যাউক। ইহা কহিয়া হেষ্টিংস গাত্রোত্থান করিয়া কৌন্সিল চেম্বার হইতে চলিয়া গেলেন; এবং বারওয়েল সাহেৰও তাঁহার অনুগামী হইলেন।
তাঁহাদের প্রস্থানের পর, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা নন্দকুমারকে কৌন্সিল গৃহে আহ্বান করিলে,তিনি এক পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন মনিৰেগম যখন যাহা ঘুস দিয়াছেন তদ্বিষয়ে এই পত্র লিখিয়াছেন। কিছু দিন পূর্ব্বে বেগম গবর্ণমেণ্টে এক পত্র লিখিয়াছিলেন; সর জান ডাইলি সাহেব, নন্দকুমারের পাঠিত-পত্রের সহিত দিলাইবার নিমিত্ত, ঐ পত্র বাহির করিয়া দিলেন। মোহর-দলিল, হস্তাক্ষরের ঐক্য হইল না। যাহাহউক, কৌন্সিলের মেম্বরেরা নন্দকুমারের অভিযোগ যথার্থ বলিয়া স্থির করিলেন এবং হেস্টিংসকে ঐ টাকা ফিরিয়া দিতে কহিলেন। কিন্তু তিনি তাহাতে. কোন ক্রমেই সম্মত হইলেন না।
এই বিষয় নিম্পত্তি না হইতেই, হেষ্টিংস নন্দকুমারের নামে, চক্রান্তকারী বলিয়া, সুপ্রীমকোর্টে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। হেষ্টিংসের অভিযোগের কিছুদিন পরেই কামালউদ্দীন নামে এক জন মুসলমান এই অভিযোগ উপস্থিত করিল যে নন্দকুমার এক কাগজে আমার নাম জাল করিয়াছে। সুপ্রীমকোর্টের জজের এই অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া নন্দকুমারকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করিলেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা জজদিগের নিকট বারম্বার প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন যে জামীন লইয়া নন্দকুমারকে কারাগার হইতে মুক্ত করিতে হইবেক। কিন্তু জজেরা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন পুর্ব্বক তাহা অস্বীকার করিলেন। বিচারের সময় উপস্থিত হইলে, চীফজাষ্টিস্ সর ইলাইজা ইম্পি একাকী ধর্ম্মাসনে অধিষ্ঠান করিলেন এবং কেবল কতকগুলি ইঙ্গরেজ জুরী নিযুক্ত হইলেন। জুরীরা নন্দকুমারকে দোষী নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দিলেন এবং চীফজাষ্টিস্ বাহাদুর নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ বিধান করিলেন। তদনুসারে, ১৭৭৫ খৃঃ অব্দের জুলাই মাসে, তাঁহার ফাঁশী হইল।
যে দোষে সুপ্রীমকোর্টের বিচারে নন্দকুমারের প্রাণদও হইল, তাহা যদিই তিনি যথার্থ করিয়া থাকেন, সুপ্রীমকোর্ট স্থাপিত হইবার ছয় বৎসর পুর্ব্বে করিয়াছিলেন; সুতরাং তৎসংক্রান্ত অভিযোগ কোন ক্রমেই সুপ্রীমকোর্টের গ্রাহ্য ও বিচার্য্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ, যে আইন অনুসারে এই সুবিচার হইল, ন্যায়পরায়ণ হইলে ইম্পি কদাচ উপস্থিত ব্যাপারে ঐ আইনের মর্ম্মানুসারে কর্ম্ম করিতেন না। ঐ আইন ভারতবৰ্ষীয় লোকদিগের বিষয়ে প্রচলিত হইবেক বলিয়া নিরূপিত হয় নাই। ফলতঃ, নন্দকুমারের প্রাণবধ ন্যায় মার্গানুসারে বিহিত হইয়াছে ইহা কোন ক্রমেই প্রতিপন্ন হইতে পারে না।
এতদ্দেশীয় লোকেরা এই অভূতপূর্ব্ব ব্যাপার দর্শনে একবারে হতবুদ্ধি হইলেন। কলিকাতাবাসি ইঙ্গরেজেরা প্রায় সকলেই গবর্ণর জেনেরলের পক্ষ ও তাঁহার প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত ছিলেন; তাঁহারাও অবিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড দেখিয়া যৎপরোনাস্তি মনস্তাপ ও অক্ষেপ করিয়াছিলেন।
নন্দকুমার এতদ্দশের এক জন অতি প্রধান লোক ছিলেন। ইঙ্গরেজদিগের সৌভাগ্যদশা উদয় হইবার পুর্ব্বে, তাঁহার এরূপ আধিপত্য ছিল যে ইঙ্গরেজেরাও, বিপদ পড়িলে, সময়ে সময়ে তাঁহার আণুগত্য করিতেন ও শরণাগত হইতেন। নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন অসম্ভব নহে; কিন্তু ইম্পি ও হেষ্টিংস তদপেক্ষা অধিক দুরাচার তাহার কোন সন্দেহ নাই।
নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে নানা অভিযোগ উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন! হেষ্টিংস দেখিলেন নন্দকুমার জীবিত থাকিতে আমার ভদ্রস্থতা নাই; অতএব যে কোন প্রকারে ইহার প্রানবধ সাধন করা আবশ্যক। তদনুসারে কামালউদ্দীনকে উপলক্ষ্য করিয়া সুপ্রীমকোর্টে পুর্ব্বোক্ত অভিযোগ উপস্থিত করেন। ধর্ম্মাসনারূঢ় ইম্পি, গবর্ণর জেনেরল পদারূঢ় হেষ্টিংসের পরিতোষার্থে, একবারেই ধর্ম্মাধর্ম্মজ্ঞান ও ন্যায় অন্যায় বিবেচনাশূন্য হইয়া নন্দকুমারের প্রাণবধ করিলেন। হেস্টিংস তিন চারি বৎসর পরে এক পত্র লিখিয়াছিলেন; তাহাতে ইম্পিকৃত এই মহোপকারের বিষয় উল্লিখিত আছে। ঐ পত্রে এইরূপ লিখিত আছে যে এক সময়ে ইম্পির আনুকুল্যে আমার সৌভাগ্য ও মান সন্ত্রম রক্ষা পাইয়াছে। এই লিখন দ্বারা ইহাও প্রতিপন্ন হইতে পারে যে নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে যে সকল অভিষোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন সে সমস্ত অমুলক নহে; এবং সুপ্রীমকোর্টের অবিচারে তাঁহার প্রাণদণ্ড না হইলে তিনি সে সমুদায় সপ্রমাণও করিয়া দিতেন; সেই ভয়েই হেষ্টিংস ইম্পির সহিত পরামর্শ করিয়া নন্দকুমারের প্রাণবধ করেন।
মহমদ রেজাখাঁর পরীক্ষার কলিতার্থ সংবাদ ইংলণ্ডে পহুছিলে, ডিরেক্টরেরা কহিলেন আমাদের বিলক্ষণ প্রতীতি জম্মিয়াছে যে মহমদ রেজা খাঁ নিরপরাধ। অতএব তাঁহারা, নবাবের সাংসারিক কর্ম্ম হইতে গুরুদাসকে বহিষ্কৃত করিয়া, তৎপদে মহমদ রেজা খাঁকে নিযুক্ত করিতে আদেশ প্রদান করিলেন।
সুগ্রীম কৌন্সিলের সাহেবেরা দেখিলেন, তাঁহাদের এমত অবসর নাই যে কলিকাতা সদর নিজামত আদালতে স্বয়ং অধ্যক্ষতা করিতে পারেন। অতএব, পুর্ব্বপ্রণালী অনুসারে, পুনর্ব্বার ফৌজদারী আদালত ও পুলিসের ভার এক জন দেশীয় লোকের হস্তে সমৰ্পণ করিতে মানস করিলেন। তদনুসারে ঐ আদালত কলিকাতা হইতে মুরশিদাবাদে নীত হইল এবং মহমদ রেজা খাঁ তথাকার প্রধান পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন।