Rabindranath Tagore and Lalon Shah
Dr. Srabani Sen Associate Professor, Department of Music, Tarakeswar Degree College, Email: srabanisn1@kami Mobile no- 6290855102
Abstract
Lalon Shah is celebrated as one of the most influential figures in the Baul tradition, lastingly impacting Bengali music and spirituality. His songs, deeply embedded in the oral tradition, resonated profoundly with the common people. Lalon’s philosophy was radical for its time, rejecting societal distinctions based on caste, class, and creed, and denouncing racism and religious conflicts. His teachings on humanism and inclusivity remain significant in today’s world, offering a pathway to universal humanity. Lalon’s profound simplicity and spiritual depth left a lasting impression on Rabindranath Tagore, inspiring a philosophical and stylistic transformation in his poetry. Tagore’s engagement with Lalon’s existential humanism reshaped his worldview, infusing his work with Baul-inspired themes of devotion and unity.
Keywords: Lalon Shah, Baul tradition, existential humanism, Rabindranath Tagore, Bengali philosophy, oral tradition, universal humanity, caste and creed
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন শাহ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন শাহ ফকির দুজন ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৃত্তের মানুষ। প্রথমজন উনিশ শতকের কলকাতার অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান ও অন্যজন অনভিজাত পল্লীসন্তান। লালনের ছিল সমন্বয়কামী উদারতা এবং বহুজনের সঙ্গে সংযোগ-ধর্মনির্লিপ্ত অবস্থান। লালন যে শুধু ভাবমগ্ন গীতিকার ছিলেন তা নয়, ছিলেন সংগঠক ও প্রচারকারী। লালন নিজেকে এক ভাবসাধকরূপে বৃত্তায়িত না রেখে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমাবেশে ও সংগ্রামে।
লালন ফকিরের জীবন ও গানই তাঁর প্রাথমিক জনপ্রিয়তার কারণ। বিশেষত সেকালের নিম্নবর্গে ও গ্রামীণ বঙ্গে। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম সমাজের প্রান্তিক মানুষ রূপে বাউল ফকিররা বেঁচে থাকত মাধুকরী করে। নিজেদের আখড়ায় নিজেদের মতে সাধন ভজন করে, গান গেয়ে। গ্রাম সমাজের কাছে তারা না ছিল সমাদৃত, না ঘৃণিত। শান্ত, ভক্তিমান, উচ্চাসাহীন এই বর্গের রহস্যমাখানো গান মধ্যবিত্ত শহরবাসীর কাছে একসময় ভোগ্যপণ্য হয়ে উঠে, বিশেষত তারা এসব গানে খুঁজে পায় সমাজসত্যের দ্যোতনা আর উচ্চবর্গের শোষণ দমনের প্রচ্ছন্ন ইতিহাস। লালন আর দুদ্দু শাহের গানে, পাঞ্জু শাহ বা হাসন রাজার বাণীময়তায় খুঁজে পায় মধ্যবিত্ত ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যের নানা সারকথা। উনিশ শতকে রুচিমান শিক্ষিত সমাজে লালন গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন কাঙাল হরিনাথ, অক্ষয় কুমার মৈত্র, মীর মশাররফ ও জলধর সেনের প্রয়াসে। ঠাকুর পরিবারও বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে তাঁর প্রচারে অংশ নেয়। বলা যায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষে লোকায়ত সাধকদের সঙ্গে সংযোগ সাধনও অনেকটা প্রাণের টানে। পদ্মাতীরবর্তী শ্যামশোভাময় গ্রামগুলোর নিরক্ষর মানুষগুলোর মূক মুখে ভাষা দেবার সংকল্প ছিল তাঁর।
লালনের ধর্মমত নিভৃত পল্লীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্ম মতের মধ্যে অন্যতম এক গৌণধর্ম (Minor sect), যাতে মিশেছে মুসলমান ও জৈন ধর্মের স্রোত। লোকায়ত সাধনার আদর্শায়নে তথা ভাবে লালনের সাধনপথ পুরোপুরি ভাবায়িত নয়, তা পরম দেহতত্ত্বের জটিল ও রহস্যময় আচরণবাদে নিগূঢ় বস্তুবাদী। লালন গীতির অন্তর্বাণী মরমি মানুষদের জন্য, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, জাতপাত ও স্থান মাহাত্ম্যের অনেক ঊর্ধ্বে তাঁকে যথার্থ আসনে বসিয়েছেন। লালনের দার্শনিক ভাবনার অভিনবত্ব, মানব প্রেম, মানুষকে জাতপাতের খন্ড সীমানায় না দেখার দৃষ্টি, আত্মতৃপ্তি, প্রশান্তি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। এমন মহান সৃষ্টিশীল মানুষ ভাবের আবেগে বাউল গান রচনা করতেন, গানের মাধ্যমে সাধনার কথা বলতেন।
পারিবারিক সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ লালন সাঁইয়ের কথা প্রথমে জেনেছিলেন বলে অনুমান করা যায়।
ঠাকুরবাড়ির অনেকের সঙ্গেই যেমন- সত্যেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের আলাপ-পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে লালনের যাতায়াত ও সমাদর ছিল। প্রধানত কলকাতার ঠাকুর পরিবার তাঁদের শিলাইদহ- কুষ্টিয়া ও পাবনা-সাজাদপুরে জমিদারী পরিচালনা সূত্রে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন ওই অঞ্চলের বাউলদের। তাদের ধর্মকর্ম বা আচরণে নয়, ঠাকুর পরিবার আকৃষ্ট হন তাদের গানের ভাবে ও সুরে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাউলদের সম্পর্কে অনুকম্পায়ী ও গুণগ্রাহী। লালন ও গগন হরকরার গানে তারা বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের ভাগ্নি সরলা দেবী সংগ্রহ করেছিলেন অন্য অনেক বর্গের লোকায়িত গান। ‘বীণা বাদিনী’ পত্রিকায় ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী লালনগীতির স্বরলিপি প্রকাশ করেন। বাঙালি সমাজে লালন সম্পর্কে সন্ধিৎসা ও আগ্রহ জাগাতে রবীন্দ্রনাথও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এইসব মরমি সাধকের পরিচয়ের পরিধি প্রসারে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াস ছিল প্রেরণাসঞ্চারী। রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালনের গানের উল্লেখ করেন ভাদ্র ১৩১৪ এর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’- লালনের এই একই গানের উল্লেখ মেলে ‘জীবনস্মৃতি’ (১৩১৯) গ্রন্থের ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ অধ্যায়ে।
শিলাইদহে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর লালনের গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। শিলাইদহের মরমি কবি গগন হরকরার কণ্ঠে তিনি লালনের গান শোনেন। লালন-শিষ্যদের সাহচর্যও তাঁকে লালনের গান শোনার সুযোগ করে দেয়। লালনের গানের সুরের বৈচিত্র্য, বাণীর কাব্যময়তা ও উচ্চাঙ্গের তত্ত্বকথা তাঁকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে। বাংলার মূল বিদ্বজ্জনের চেতনা-প্রবাহে, বৃহত্তর বাঙ্গালীদের কাছে লালন প্রথম পরিচিতি পান ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ ভারতী’ পত্রিকায় সরলা দেবীর রচনায়। লালনের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে, ১৩০২ সালের ভাদ্র সংখ্যায়, ‘লালন ফকির গগন’ নামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এতে আটটি লালনের গান, দুটি গগনের এবং একটি ভণিতাহীন গান মুদ্রিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ সরলা দেবীর কাছে শোনা বেশ ক’টি লৌকিক গানের সুর নিয়ে নতুন গান বেঁধেছেন অনেক বছর পরে। সরলা দেবী জানিয়েছেন ‘ভারতী’ পত্রিকায়-কুষ্টিয়ার সন্নিহিত প্রদেশে সামান্য বৈরাগীর মুখে তাঁর (অর্থাৎ লালন) ও তাঁহার কোন শিষ্যের রচিত কতিপয় গান শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া তাহাদের কতকগুলি গান সংগ্রহ করিয়াছিলাম। অধিক সংগ্রহের সময় ছিল না, যে কয়টি পাইয়াছি, তাহাই পাঠকদের উপহার দিতেছি। ১
সরলাদেবী সংগৃহীত গগনের দুটি গানের সুর যা ‘ভারতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত, রবীন্দ্রনাথকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে ১৩১২ সালে ( ১৯০৫) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষ্যে তিনি সেই সুরে দুটি নতুন গান রচনা করেন। গগনের গান দুটির প্রথম পংক্তি হল – ‘আমি কোথায় পাব তারে’ এবং ‘ও মন, অসার মায়ায় ভুলে রবে’। এই দুটির ভাঙ্গা রবীন্দ্রগান হল ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’। বাউল গানের সুর বিন্যাসের ছক রবীন্দ্রগীতিপ্রতিভার দেশোদ্দীপনার গানে বদলে গেছে। গগনের গানের সুর ও চাল রবীন্দ্রনাথকে যতখানি টেনেছিল লালনের গানের সুর ততটা টানে নি। তাই লালনের সুর ভেঙে রবীন্দ্রনাথ বেশি গান রচনা করেন নি।
লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল এমন সুনশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। লালনের আখড়া ও তাঁর সংস্কার পুনর্নির্মাণের সূত্রেই লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা বিচিত্র যোগাযোগের বার্তা আমরা পাই। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ লালনের সমাধি অঞ্চলের অর্থাৎ ছেউড়িয়ার জমিদার ছিলেন। তাই লালন শিষ্য মনিরুদ্দিন সা জমিদার রবীন্দ্রনাথ সকাশে যে আবেদনপ্র পাঠান তার থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রজা লালনের আখড়ার লালন পালনে সংরক্ষণে জমিদারের কিছু দায় ছিল। লালন প্রয়াণের পর ১৮৯০ সালে এবং ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঐ অঞ্চলের প্রজাপালনের দায়িত্ব পান। তার আগে জমিদারি তত্ত্বাবধানের সূত্রে লালন সঙ্গে যোগাযোগ হয় মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ও মেজ বৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর, নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সূত্রে জানা যায় সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথও লালনকে প্রত্যক্ষভাবে জানতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী ১৮৯৫ সালে তার সম্পাদিত’ ভারতী’ পত্রিকায় ‘ লালন ও গগন’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যা ‘হিতকরী’-র প্রতিবেদনের পরবর্তী প্রয়াসে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘ বীণা- বাদিনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি ইন্দিরা দেবী ১৮৯৫ আর ১৮৯৯ সালে ‘পারমর্থিক গান’ আখ্যা দিয়ে লালনের দুটি গানের স্বরলিপি প্রকাশ করেন। লালনগীতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্বরলিপি হিসেবে এই দুটি গানের ঐতিহাসিক মূল্য আছে। গানগুলোর অভিনবত্ব, গূঢ় আধ্যাত্মিকতা এবং রহস্যময় (maystic) উদ্ভাষণ এতই আকর্ষণীয় ও অনুভবনীয় যে রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্যোগ করে সেই গানের খাতা সংগ্রহ করেছেন, ব্যক্তিগত হেফাজতে রেখেছেন। শিলাইদহে অবস্থানকালে লালনের গান সংগ্রহের উদ্যোগ তাঁর। ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে তিনি মনিরুদ্দীন শাহ- লিপিকৃত লালনের গানের দুটি পুরনো খাতা সংগ্রহ করেন, যা এখনও বিশ্বভারতীর ‘রবীন্দ্রভবন’ এর সম্পদ। এই দুটি খাতা প্রতিলিপি-সংস্করণ ‘রবীন্দ্রনাথ- সংগৃহীত লালনের গানের পান্ডুলিপি’ আবুল হাসান চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিলাইদহ ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্য লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপকরণ এবং সেইসঙ্গে লালনের কিছু গান সংগ্রহ করেন।২
‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কুড়িটি লালনগীতি স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করেছিলেন তার সংগৃহীত খাতা থেকে অনুলিপি করে। লালনের গান সম্পর্কে তাঁর এতটাই আসক্তি ছিল যে তাঁর সংগৃহীত গানের খাতার দুর্বোধ্য পাণ্ডুলিপির কোনও কোনও শব্দ (যা আঞ্চলিক ও অপ্রচলিত) বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়ে তার শিষ্টরূপটি খাতার মার্জিনে লিখেরেখেছেন। শব্দের অক্ষর গঠনের ছাঁদ এবং শুদ্ধ বানান লেখা বেশ কঠিন। ফলে রবীন্দ্রনাথকে তার পাঠোদ্ধারে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তার উপরে লালনের রচনায় ছিল কুষ্টিয়া অঞ্চলের বেশ কিছু নিজস্ব লব্জ। যেমন-
১। মন আমার কুসর-মলা জাঠ হল রে।
২। পিতৃধন তোর নিল চোরে
হলি রে মন ফোকতাড়া।
৩। কাজ দেখি পাগলের মতন
কথায় যেমন কাঠফাড়া। ৩
লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছিল। লালনের প্রয়াণের পর শিষ্য-প্রশিষ্যর অবস্থান ক্রমেই দ্বন্দ্বে ও বিরোধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে রয়েছে দুখানি লালনগীতির খাতা যেখানে লালনের হস্তচিহ্ন স্পষ্ট পাওয়া যায়। । দুটি খাতারই আখ্যাপত্রে লেখা আছে Songs of Lalon Fakir- Collected by Rabindranath। মোট গানের সংখ্যা ২৯৮। গানের পান্ডুলিপীর হস্তাক্ষর অত্যন্ত দুর্বল ও অপরিচ্ছন্ন। তাতে কোথাও কোথাও রবীন্দ্রহস্তাক্ষরে সঠিক পাঠ লেখা আছে। লালন গীতি সংগ্রহের অভিজ্ঞতা তিনি নিজেই লিখেগেছেন : I remember how troubled they were, when I asked some of them to write down for me a collection of their songs. When they did verture to attempt it. I found it almost impossible to decipher their writing – the spelling and lettering were so outrageously in conventional. ৪
ঠাকুরবাড়ির আলোকপ্রাপ্ত সদস্যরা যে লালন ফকির সম্পর্কে এত উৎসাহ ছিলেন। লালনের গানে অচিন পাখি-র মায়া রবীন্দ্রনাথকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তিনি উচ্ছ্বাসভরে লেখেন ও ভাষণে বলেন : That this unknown Is the profound reality, though difficult of comprehension, is equally admitted by the English poet as by the nameless village singer of Bengal, in whose music vibrate the wing-beats of the unknown bird, only Shelley’s utterance is for the cultured few, while the Baul song is for the tillers of the soil, for the simple folk of our village households, who are never bored by the mystic transecendentalism. ৫
‘প্রবাসী পত্রিকায় বৈশাখ ১৩২২ থেকে লোকসাহিত্য-সংগ্রহ প্রকাশের ‘হারামণি’ নামে একটি নতুন বিভাগ প্রবর্তিত হয়। ১৩২২ এর আশ্বিন থেকে মাঘ পর্যন্ত চার কিস্তিতে রবীন্দ্র- সংগৃহীত লালনের মোট কুড়িটি গান প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে মাত্র একটি গান ভবনে রাখা খাতা থেকে গৃহীত। এ থেকে ধারণা হয় রবীন্দ্রনাথ অন্য সূত্র অর্থাৎ লালন- শিষ্য কিংবা শিলাইদহের কোন বাউলের সৌজন্যেও লালনের গান সংগ্রহ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে। এই সাক্ষাতের পক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য বা প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যায় না, কেবল জনশ্রুতি ও অনুমানই ধারণার উৎস। লালনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতন পল্লীসেবা বিভাগের গ্রামসেবার কাজের ধারা নির্ধারণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেব ঘোষের পিতা কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন :
তুমি তো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোশাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার যো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত। ৬
এই উক্তি থেকে ধারণা জন্মায় যে রবীন্দ্রনাথ লালন নন, তার শিষ্যদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, বাউলপন্থা নিয়ে তাঁর কৌতুহল ছিল, বাউল গানের সুরকাঠামো তাঁর সাংগীতিক মানসে স্থায়ী ছাপ রেখেছিল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হোক আর নাই হোক, একথা স্বীকার করতেই হয় যে, রবীন্দ্রনাথের লালন-আবিষ্কার এবং রবীন্দ্র মানসে লালনীয় প্রভাব ও প্রেরণার সঙ্গে শিলাইদহবাসের সম্পর্ক অতি নিবিড়।
লালনের গানের বস্তুসত্য রবীন্দ্রনাথ হয়তো তেমন করে অনুধাবন করতে চাননি, তবে তাঁর অন্তর্লীন ভাবসত্য তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। কালী মোহন ঘোষকে যখন তিনি লালনের আখড়ায় পাঠালেন গান সংগ্রহের বরাত দিয়ে তখন কালীমোহন তাদের আহ্বান করলেন গুরুদেবের কাছে যেতে। কালীমোহন জানাচ্ছেন: পরদিন অপরাহ্ণে নৌকোর উপর কবি গভীর আনন্দের সহিত ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁহাদের আলোচনা করিতে লাগিলেন। তাহারা চলিয়া যাইবার পর আমাকে বলেদেন, ইহারা লেখাপড়া জানে না। কিন্তু সকলেই জ্ঞানী, বড় বড় কথা এমন সহজ ভাবে বুঝিতে পারে যে এদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া যে আনন্দ পাইয়াছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীদের সঙ্গে আলোচনা করিয়াও তাহা কচিৎ পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের বাউলচিন্তা ও মরমীভাবনা তাঁর জীবনচেতনার অন্তর্গত বিষয় হিসেবে বিবেচিত। এই প্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন শিলাইদহে এসে। মূলত শিলাইদহের বাউল-সম্প্রদায়ের প্রেরণা ও প্রভাবেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রবাউল’- এ। তার শিল্প-কর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্ম- দর্শন – বাউলভাবের পরিচয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। বাউলের মত রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিক ধর্মকে অগ্রাহ্য করে অন্তরের শুভ-প্রেরণাকেই আপন ধর্ম বলে মানতেন। বাউলের ধর্ম নিজেকে জানার ধর্ম, শাস্ত্রাচারহীন মহামিলনের ধর্ম, ভাবপ্লাবী হৃদয়বৃত্তির ধর্ম, সহজ ধর্ম। রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনি ; ‘আমার ধর্ম কি, তা যে আজও আমি সম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট করে জানি, এমন কথা বলতে পারিনে – অনুশাসন আকারে তত্ত্ব আকারে কোনো পুঁথিতে লেখা সে তো নয়।’
অন্যভাবে এই কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় লালনের গানে:
সব লোকে হয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন।
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।। ৭
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, ‘বাউলের গান শিলাইদহে খাঁটি বাউলের মুখে শুনেছিও তাদের পুরাতন খাতা দেখেছি।’ সম্ভবত এই খাতা লালন ফকিরের গানের খাতা, কারণ ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন থেকে মাঘ সংখ্যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ বিভাগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লালনের কুড়িটি গান প্রকাশ করে বিদ্বজ্জন সমাজে লালন ফকিরকে পরিচায়িত করেন।
লালন শিষ্যদের মধ্যে শীতল শাহ, ভোলাই শাহ পাঁচু শাহ, মলম শাহ, মানিক শাহ ও মনিরুদ্দীন শাহ শিলাইদহে কবির কাছে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রজনক দেবেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসহোদর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ লালনের শিষ্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ছেঁউড়িয়া ও শিলাইদহের মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্র রচনা করেন। শোনা যায়, কোনও এক সময় লালন- শিষ্যদের আমন্ত্রণে তিনি ছেঁউরিয়া আখড়াতেও গিয়েছিলেন। ছেঁউরিয়ায় লালন-আখড়া পাকা করার বিষয়ে তাঁর উদ্যোগ লালন-শিষ্যদের অন্তর্কলহে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ -সমীপে লালন- শিষ্য মনিরুদ্দীন শাহের একটি দরখাস্তে কবির সঙ্গে লালন- শিষ্যদের যোগাযোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
একটি সূত্র থেকে জানা যায়……… লালন শাহের মৃত্যুর পর শিষ্যসাগরেদের মধ্যে দুই বা তিন জন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে সাক্ষাৎ করেন এবং রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর খবর শুনে লালনের শ্রাদ্ধশান্তির জন্য নগদ দুইশত টাকা দান করেন।
বাউল আর শান্তিনিকেতন এক সুদীর্ঘ যুগলবন্দী এবং তার সূচনা রবীন্দ্রনাথ থেকে। রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক উৎসাহ ছিল পৌষ মেলাকে ঘিরে গড়ে তোলা, গ্রামীণ সংস্কৃতির উজ্জীবন। প্রথম থেকেই সেখানে বাউলদের যাতায়াত ছিল। নিম্নবর্গ থেকে উচ্চবর্গ পর্যন্ত বাউল গানের স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল চলছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাউল গানের ভাবমূল্যে ও ছন্দে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং দেশবাসীকে প্রথম সচেতন করেছিলেন বাউল গানের নিজস্বতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি যেসব অভিনব স্বদেশী গান লেখেন তার সুরকাঠামোয় বাউল গানের স্পন্দন ও উদ্দীপনা অত্যাশ্চর্য নৈপুণ্যে ব্যবহার করেন। পরে তাঁর গানে বাউল গানের অন্তর্জগতের গভীর বাণী ছাপ ফেলেছে।
লালন ফকির বিষয়ের যথাযথ মূল্যনির্ধারণে আমাদের পেড়োতে হবে আরো অনেক বিতর্কের পর্যায়। সে বিতর্ক শুধু তাঁর গানের শুদ্ধসত্তাকে নিয়ে বা পুঁথির অকৃত্রিমতাকে ঘিরে নয়, বরং অনেক বড় মাপের জিজ্ঞাসায় ও প্রযত্নে। সেখানে প্রশ্ন উঠবে লালনের জাতিসত্তার, তাঁর ধর্ম ধারণা, গুপ্তসাধনার জটিলতা নিয়ে। দেখা যাবে লালন তাঁর লোকায়ত জীবনসাধনার পরম্পরা মেনে নিয়েও কেমন করে হয়ে উঠেছেন সর্বাধুনিক উচ্চারণের গীতিকার। কিন্তু তাঁর বর্তমান লোকপ্রিয়তা এবং বিস্তৃতি প্রসিদ্ধি তথা লালন গীতির প্রচার-প্রচলন নিঃসন্দেহে ব্যাহত হত যদি না লালনের আখড়াটি থাকত কুষ্টিয়াতে এবং সেখানে না থাকত ঠাকুরবাড়ির জমিদারি এবং ঠাকুরদের আসা-যাওয়া। ঠাকুর পরিবার লালনের গানের গভীরতা ও সারল্য প্রকাশ না করলে তাঁর নাম সীমায়ত থেকে যেত কুষ্টিয়ার সন্নিহিত অঞ্চলের লালনপন্থী মারফতি বাউলদের কন্ঠে আর বিলীয়মান আখড়ার কিছু শিষ্যসেবকের আন্তরিক স্মরণবৃত্তে। তাঁর গান পেত না প্রসারণ ও প্রচার, প্রার্থিত মর্যাদা মূল্যবত্তা। লালনের আজকের যে প্রসিদ্ধি ও পরিচিতি, তার মূলে ছিল রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহিতা। মূলত রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগ ও প্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে পরবর্তীকালে অনেক পন্ডিত ও মরমি ব্যক্তি লালন সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন এবং সমগ্র বাংলায় লালনগীতি সংগ্রহ এবং লালন জীবনের তথ্য বিষয় প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা চলতে থাকে, যা আজও ক্ষান্তিহীন।
তথ্যসূত্র
১। ব্রাত্য লোকায়ত লালন, পৃঃ-২১
২। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৮৩
৩। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৩০
৪। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-২৯
৫। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৩৪
৬। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৮৪
৭। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল, পৃঃ-৮৯
সহায়ক গ্রন্থ
১। শান্তিদেব ঘোষ – রবীন্দ্রসঙ্গীত
২। বাংলার বাউল ও বাউল গান- অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঙ্গীতচিন্তা, বিশ্বভারতী, ১৯৬৬
৪। সুধীর চক্রবর্তী, বাউল ফকির কথা
৫। লীনা চাকী, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল,প্রথম প্রকাশ:২০২১,পুস্তক বিপণি,২৭ বেনিয়াটোলা লেন,কলকাতা ৯
৬। সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন