Dynamics Between Music Directors and Artists: A Study on the Incorporation of Folk Music in Bengali Films
Dr. Iti Pal
Abstract:
Dynamics Between Music Directors and Artists: A Study on the Incorporation of Folk Music in Bengali Films
Abstract: This research delves into the intricate relationship between music directors and artists in the context of Bengali cinema, with a specific focus on the utilization of folk music. Bengali films have a rich tradition of incorporating folk elements into their soundtracks, contributing to the cultural tapestry of the region. Through a comprehensive analysis of interviews, case studies, and musical compositions, this study aims to unravel the collaborative processes and creative negotiations that occur between music directors and artists in bringing folk music to the cinematic realm. By shedding light on the dynamics of this collaboration, the research seeks to provide insights into how cultural heritage is preserved, transformed, and reinterpreted through the medium of film music in the Bengali context.
বাংলা চলচ্চিত্রে লোকসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংগীত পরিচালক ও সংগীত শিল্পীদের সম্পর্ক, ডঃ ইতি পাল
চলচ্চিত্র শুরুর দিন থেকেই সংগীতের সঙ্গে এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান । সঙ্গীতের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক একেবারে সাংগঠনিক ও সাংবিধানিক । চলচ্চিত্রের মধ্যে সমাজ তথা মানবজীবন বিশ্লেষিত হয়ে এসেছে নানা আঙ্গিকে । স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেকটি সাংস্কৃতিক উপাদানের মত চলচ্চিত্রে সামাজিক গতিধারা চলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংগীত তথা লোকসংগীত । চলচ্চিত্র ও সংগীত তথা লোকসংগীতের এই পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্র ধরেই চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক এবং সংগীত শিল্পীদের সৃজনশীলতার প্রসঙ্গটি উঠে আসে। প্রথম দিকে চলচ্চিত্র পরিচালকরা চলচ্চিত্রকে বিনোদনের স্বরূপ বলে জানলেও শিল্পের আঙ্গিকে চলচ্চিত্রে সংগীত সংযোজিত হতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে। তাই প্রথম দিকে সংগীতের প্রয়োগ যা চলচ্চিত্রের বিনোদনকে বাড়িয়ে তোলার ভাবনা এসেছে। কিন্তু কালক্রমে চলচ্চিত্রে সংগীত শুধুমাত্র প্রযুক্ত হওয়া ছাড়াও সামগ্রিক ভাবে যে চলচ্চিত্রের ভাষা তথা শিল্পরূপকে উন্নত করতে পারে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার হল। আমাদের এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীতশিল্পীর সৃজনশীলতা। চলচ্চিত্র-পরিচালক, সংগীত পরিচালক ও সংগীত শিল্পীদের সম্পর্ক মোটেই সমকোণী ত্রিভুজের মতো নয়। বরং চলচ্চিত্র পরিচালক ও সংগীত পরিচালক ত্রিভুজের ভূমিরেখার দুই প্রান্তে অবস্থান করলেও সঙ্গীত শিল্পীর অবস্থান ত্রিভুজের ভূমিরেখার উল্টো দিকে অবস্থিত দুই বাহুর সংযোগ স্থলের কৌণিক বিন্দুর ন্যায় । যার অবস্থান নানা পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হয় ।
চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপুর্ন বৈশিষ্ট্য হল ধ্বনিগত উপাদানের উপস্থিতি বা ধ্বনিময়তা। যার চূড়ান্ত রূপ সাংগীতিকতা। ফলে চলচ্চিত্রের গতিময়তা ও সংগীতের পারস্পরিক প্রসঙ্গ যা চিত্রপরিচালক ও সংগীত পরিচালকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া বা চিত্রপরিচালক ও সংগীত পরিচালকের নিজস্ব ভাবনা চিন্তার চূড়ান্ত রূপের প্রতিফলন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাজ্যেশ্বর মিত্র বলেছেন, “নায়ক-নায়িকার কন্ঠে গান ছাড়া সমগ্র ছবিতে ঘটনা বা দৃশ্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগীতের গুরুত্ব অত্যন্ত অধিক। কারণ, এই সংগীত পরোক্ষভাবে হলেও সমগ্র চিত্রের এমন কতকগুলি উদ্দেশ্য সাধন করে যা অপর কোনো প্রয়োগের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন ধরা যাক একবারে গোড়ার অংশ (title) যেখানে কেবলমাত্র নাট্যজনের পরিচিতি দিয়ে চিত্র আরম্ভ হচ্ছে, এইখানে সংগীত পরিচালক কোন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হবেন? সেটা কি কেবলমাত্র একটা মেলোডি বা ঐকতান সৃষ্টি করলেই সার্থক হল ? আজকাল অনেকে নামকরা ওস্তাদের ওপর সংগীত পরিচালনার ভার দেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা যা করেন সেটা নিছক একটা মেলোডির সৃষ্টি মাত্র। যিনি সরোদে সুদক্ষ তিনি নিজের হাতে কিছুটা সরোদের আলাপ করে গেলেন, যিনি সেতারে পারদর্শী তিনিও অনুরূপ ভাবেই বাজিয়ে যান, কিন্তু এতে তাঁদের খ্যাতি বজায় থাকে মাত্র বাজিয়ে হিসাবে। অপর কোনো উদ্দেশ্যসিদ্ধ হয় না। এই পরিচিতি আসলে সংগীত পরিচালককে একটি মুখবন্ধ প্রস্তুতের সুযোগ দিচ্ছে। মুখবন্ধে যেমন একটি গ্রন্থের সারাংশ এবং মূল বক্তব্যকে তুলে ধরা হয় তেমনি এই প্রাথমিক সংগীতে সমগ্র চিত্রের মূল রস, আবেদন এবং বক্তব্যকে তুলে ধরবার সুযোগ আছে। সংগীত পরিচালক যদি বিশেষ নৈপুণ্যের সঙ্গে এই কাজটি করতে পারেন তাহলে তিনি মূল পরিচালককে অতিমাত্রায় সাহায্য করবেন। উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় কাজ তাহলে গোড়াতেই অনেকটা এগিয়ে যাবে” ১।
চলচ্চিত্রের ঔপপত্তিক পর্যালোচনায় পরিচালক ও সংগীত পরিচালকের প্রসঙ্গ আলোচিত হলেও সংগীতশিল্পীদের প্রসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিতই থেকে গেছে। লোকসংগীত শিল্পীদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয় নি । অথচ সংগীত শিল্পীদের কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে গানের ভাব, ভাষা ও সুর । লোকসংগীত এর ক্ষেত্রে লোকশিল্পীর কণ্ঠস্বর এইখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । কারণ লোকসংগীত শিল্পী কণ্ঠস্বরের মেঠো স্বরক্ষেপণ ভঙ্গি ও ভাষার যে উচ্চারণ শৈলী লক্ষ্য করা যায় তা লোকসঙ্গীতের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । শহুরে রেওয়াজ করা পরিশীলিত কণ্ঠস্বরের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। আবার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের গানের তারতম্য ভেদে লোকসংগীত শিল্পী কণ্ঠস্বর ও স্বরক্ষেপণ ভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া-চটকা গান, পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি গান, রাঢ়বঙ্গের ঝুমুর গান ইত্যদি।
সবাক যুগের (১৯৩১) শুরুর সময় থেকেই চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালকের পাশাপাশি সঙ্গীত শিল্পীর গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘ঠিকাদার’(১৯৪০) চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা তুলসী লাহিড়ী করলেও ছবিতে লোকসংগীত গুলি গেয়েছেন আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ভাওয়াইয়া, চটকা, চা বাগানের গানগুলি তৎকালীন সময় ভিত্তিতে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে আব্বাসউদ্দিন নিজেই বলেছেন, “বহুদিন পর সুযোগ এলো একবার তুলসী লাহিড়ীর ঠিকাদার ছবিতে। চা বাগানের ছবি নেওয়া হবে। কুচবিহার থেকে উত্তরের ডুয়ার্সের চা বাগানে সেখানকার সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গাইতে হবে । আমার কাছে প্রস্তাব করলেন শৈলেন রায় (পরিচালক)। তোমাকে এবার ছবিতে নামতে হবে”২ । এই চলচ্চিত্রে আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে মোট চারটি গান আছে। আলিপুরদুয়ারকে কেন্দ্র করে এই ছবির পরিবেশ । ওই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ গায়ককে দিয়ে আঞ্চলিক গান গাওয়ানো ও চলচ্চিত্র অভিনয় করানোর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকে আরো বাস্তবের কাছাকাছি আনা হয়েছে। যার মধ্যে উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশ নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে। ভাওয়াইয়া গান মূলত উত্তরবঙ্গের গান আব্বাস উদ্দিন নিজেও উত্তরবঙ্গের লোকশিল্পী ছিলেন। এখানে পরিচালক উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের কাহিনী অবলম্বনে সেই চলচ্চিত্রে যে লোকসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে তাতে সেই অঞ্চলের শিল্পী কে দিয়ে গান গাওয়ানো ও অভিনয় করানোর মধ্য দিয়ে গানের ও চলচ্চিত্রের বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে কণ্ঠশিল্পীকে উপযুক্ত স্থলে সঠিক ব্যবহার করে তাঁর গান, অভিনয় ও সামগ্রিকভাবে তার শৈল্পিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা সামগ্রিকভাবে শিল্প রসকে সমৃদ্ধ করেছে । প্রসঙ্গত ছবির সংগীত পরিচালক তুলসী লাহিড়ী নিজেও একজন ভাওয়াইয়া শিল্পী ও বহু ভাওয়াইয়া গান রচনা করেছেন ।
ভাওয়াইয়া গান নির্ভর আরেকটি চলচ্চিত্র হলো ‘মাহুত বন্ধুরে’। যেটি নির্মিত হয় ১৯৫৯ সালে। এই চলচ্চিত্রটির চিত্র পরিচালনা ও সংগীত পরিচালনা করেন ভূপেন হাজারিকা। ছবির কাহিনী অসম অঞ্চলকে কেন্দ্র করে । গ্রামের উপজাতীদের যেহেতু প্রধান জীবিকা হাতি ধরা, হাতি কেনা-বেচা করা সেহেতু খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছবিতে ‘মাহুত বন্ধুর গান’, ‘হস্তী কন্যার’ গান লক্ষ্য করা যায়। এই গানের পেশা ও কর্ম কেন্দ্রিক চরিত্রের পার্থক্যে ‘মাহুত’, ‘মইষাল’, ‘গাড়িয়াল’ এই ধরনের গান উঠে আসে । চলচ্চিত্রে কন্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ও প্রতিমা বড়ুয়ার গানের মধ্যে আসাম, গোয়ালপাড়া অঞ্চলের গানের প্রকৃত গায়কীর ছাপটি ফুটে উঠেছে। বলা বাহুল্য প্রতিমা বড়ুয়া বিখ্যাত ছিলেন তাঁর গোয়ালপাড়িয়ার গান , হস্তির কন্যা এবং মাহুত বন্ধুর গানের জন্য ।
১৯৪৩ সালে ‘শহর থেকে দূরে’ চলচ্চিত্রে ‘মনসামঙ্গল’ গানের ব্যবহার পাওয়া যায় শিল্পী কল্যাণী দাসের কন্ঠে । মনসামঙ্গলের গানটি হল – ‘লখিন্দর লখিন্দর আমার লখিন্দর’ । শিল্পী কল্যাণী দাসের উচ্চারণ ভঙ্গি ,কণ্ঠ বৈশিষ্ট্য ও গানের বর্ণনাত্মক শৈলী প্রকাশিত করেছে মনসামঙ্গল গানের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যকে । সমবেত ভাবে গান গাওয়ার সাথে সাথে দৃশ্যপটে ঢোল, বাঁশি ও কাঁসির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ।
সংগীত পরিচালক ও সংগীত শিল্পীর কথা আলোচনা করতে গিয়ে সবাক যুগের শুরুর প্রথম দুই দশকে অনেক সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পীর নাম উঠে আসে। চল্লিশ ও পঞ্চাশ-এর দশকে তিনজন সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম ও শচীনদেব বর্মন লোকসংগীত ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি সংগীত শিল্পীর ভূমিকায় চলচ্চিত্রে অবতীর্ণ হলেও সংরক্ষণের অভাবে স্বকণ্ঠে তাঁর গান সেভাবে পাওয়া যায় না । তার লোকআঙ্গিকে রচিত অনেক গান চলচ্চিত্রে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল । বিশেষত ঝুমুর গান নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সৃষ্ট গানগুলি খুবই উল্লেখযোগ্য । তার সুরারোপিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র গুলি হল – ‘সাপুড়ে’ , পাতালপুরী’ , ‘নতুন ফসল’ ইত্যাদি।
১৯৩৭ সাল থেকেই পরপর কয়েকটি শচীন দেব বর্মন বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ১৯৪১ সালে ‘প্রতিশোধ’ চলচ্চিত্রে শচীন দেব বর্মনের গাওয়া ভাটিয়ালি গান ‘অবোধ মেয়ে উজান বেয়ে যাও’ – এর মধ্যে যথার্থ লোকসংগীতের রূপ পরিস্ফুট হয়েছে । লোকসংগীত ব্যবহৃত তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র গুলি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি।
পঞ্চাশ-এর দশকের শেষ দিক থেকেই চলচ্চিত্রে সংগীত শিল্পী তথা পরিচালক রূপে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ন হন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে তরুণ মজুমদার, তপন সিনহা, মৃণাল সেন, অজয় কর সহ বিভিন্ন ধরনের চিত্র পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। তবে সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি অনেক ছবিতে তিনি নিজেই বিভিন্ন ধরনের সংগীত পরিবেশন করেছিলেন, এমনকি লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি। বিভিন্ন চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘বালিকা বধূ’, ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৬৩) অন্যতম । যেখানে বহু লোকসংগীতের ব্যবহার হয়েছে । যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ‘নিমন্ত্রণ’ চলচ্চিত্রে ‘তারা মা, মাগো তারা সিংহপৃষ্ঠে ভর করিয়ে’ , পলাতক চলচ্চিত্রে মেঠো ভাটিয়ালি সুরে গাওয়া “জীবনপুরের পথিক রে ভাই”, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ চলচ্চিত্রে সারি গান ‘হাওয়া উঠিল , প্লোহীঁ প্লোহীঁ/ কনে বউ ভিজিল , ‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রে ভাটিয়ালি সুরে গীত “ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে” বিশেষ উল্লেখযোগ্য । ‘নিমন্ত্রণ’ চলচ্চিত্রে সংগীত শিল্পী রূপে নির্মলেন্দু চৌধুরী , গীতা চৌধুরী , অমর পাল’-এর গাওয়া গান গুলি ছবির অন্যতম সম্পদ হয়ে আছে। অমর পাল এর কন্ঠে প্রভাতী গান ‘প্রভাত সময় কালে শচীর আঙিনা মাঝে’ ও নির্মলেন্দু চৌধুরী ও গীতা চৌধুরীর কণ্ঠে ‘চ্যাং ধরে ব্যাঙ, ব্যাঙ ধরে চ্যং’ — গম্ভীরা গানটি লোকসঙ্গীতের অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে । এই গানের সঙ্গে লোকবাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ করা হয়েছে ।
‘পলাতক’ চলচ্চিত্রটি তৎকালীন সময়ে স্রোতের বিপরীতে হাঁটা একটি ছবি । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনা তাতে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। তার কারণ মূলত ঝুমুরের বহুল প্রয়োগ । এছাড়াও এই চলচ্চিত্রে ভাটিয়ালি, তরজা , কাওয়ালী গানের সফল প্রয়োগ হয়েছে। “নানা রীতির বাংলা গানের প্রবহমান ধারার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও, যে গানের সঙ্গে তাঁর প্রায়োগিক সখ্যতা ছিল না, সেই রীতির সুর রচনায় হেমন্ত মুখার্জী স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন না। পেশাদারি কারণেও সুযোগ থাকলেও কখনো আপোষ করেন নি। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলে তাঁর সাংগীতিক নিষ্ঠা ও সততার প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমরা জানি মূল ধারার জনপ্রিয় চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের প্রায় সবকটি ছবির সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখার্জী। অথচ ষাট দশকের অতি সফল বাণিজ্যিক ছবি ‘পলাতক’-এর সুর রচনার ক্ষেত্রে হেমন্ত মুখার্জী প্রাথমিকভাবে রাজি হননি। ছবির কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাঢ় বাংলার ঝুমুর দলের ব্যক্তি জীবনের টানাপোড়েন এবং বিশিষ্ট লোকরীতির ঝুমুর গান। এই রীতির গানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় না থাকার দরুন তিনি ছবিটির সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। সেই সময় চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদার বেশ কিছু মৌলিক ঝুমুর গান সংগ্রহ করে হেমন্ত মুখার্জীকে প্রদান করেন এবং আশ্বস্ত করেন যে এইসব গানের চলন অনুধাবন করে একমাত্র হেমন্ত বাবুই ‘পলাতক’ ছবির সাংগীতিক আবহকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন। বলা বাহুল্য যে, তরুনবাবুর নিবিড় সাহচর্য এবং হেমন্ত মুখার্জীর সাংগীতিক প্রত্যয়ের মিলনে ‘পলাতক’ ছবির সাংগীতিক পরিমন্ডল বাংলা সিনেমায় একটি মানদন্ড হয়ে আছে। এটা হেমন্ত মুখার্জীর সঙ্গীত নিষ্ঠার একটা পরিচয় হয়ে আছে”৩। আবার ‘বালিকা বধূ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রে তিনটি লোকআঙ্গিক গানের ব্যবহার পাওয়া যায় যেগুলি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বকন্ঠে গেয়েছেন।
১) লাগ লাগ লাগ লাগ রঙের ভেলকী লাগ। (হোলীর গান)
২) সুক বলে কেন সারি বাপের বাড়ি যাস। (ঝুমুর)
৩) ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম রে। (বাউল)
বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের অবিসংবাদিত গায়ক তথা সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । নান্দনিকতার দিক থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা নিজস্ব সত্ত্বা ছিল। তাঁর সৃষ্ট গানে সহজ সরল সুন্দর স্বর বিন্যাসের মধ্যে তার ব্যরিটোন কণ্ঠ দিয়ে একটা নান্দনিকতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। পঞ্চাশের দশকের পর থেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক নতুন আধুনিক গানের ধারা নিয়ে আসেন। সুরসংযোজনায় ও তার কন্ঠ মাধুর্যে সংগীত গুলি হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠতো । কিন্তু বাংলা লোকসংস্কৃতি তথা লোকসংগীতের দীর্ঘ ঐতিহ্যের ও পরম্পরার দিকে তাকিয়ে বলা যায় বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে বিভিন্ন লোকসংগীত বা লোকআঙ্গিকের গান গাওয়া হলেও তা কখনো যথার্থ লোকসংগীত হয়ে ওঠেনি । এই একই কথা বলা যেতে পারে লতা মঙ্গেশকরের ক্ষেত্রেও । ‘ও আমার দেশের মাটি’ (১৯৫৮) চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত অতি পরিচিত ও প্রচলিত আব্বাস উদ্দিনের বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গান ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। উত্তরবঙ্গের এই চিতান ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে বিশেষ যে সুরভঙ্গতা অর্থাৎ দীর্ঘ টানের চড়ার সুরের মধ্যে যে ভাঁজ থাকে তা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত এই ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে পাওয়া যায় না। লতা মঙ্গেশকরের গায়কীর মধ্যে যে চূড়ান্ত পরিশীলিত ও অনুশীলন নির্ভর শাস্ত্রীয় কন্ঠস্বর পাওয়া যায় তাতে এই ভাওয়াইয়া গানের আঞ্চলিকতার বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুন্ন করেছে। প্রসঙ্গত ‘ও আমার দেশের মাটি’ চলচ্চিত্রে মোট ২৪ টি গানের ব্যবহার করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে সমস্ত বক্স শিল্পীদের দিয়ে গান গাওয়ানো হয়েছিল । এ প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত টি প্রণিধানযোগ্য – “এখন পেশা রূপালী নেশার মাতলামিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। শিল্পী আজ paid piper অর্থাৎ রুপিয়া শিল্পের রূপ নির্ধারণ করে। প্রথমেই উল্লেখ করেছি স্ফীত মুদ্রা রাক্ষসের আধিপত্য সংস্কৃতিতে কি দুষ্কৃতি এনেছে। লোকরঞ্জনের সমস্ত মাধ্যমগুলি একচেটিয়া আধিপত্যের রুচি ও mass production-এ নিয়োজিত, তার জন্য প্রয়োজন ট্রেডমার্ক এবং সেই ট্রেডমার্ক হল স্টার আর্টিস্ট। এমন একদিন ছিল যখন গ্রামোফোন কোম্পানি আনকোরা পল্লী গায়কদের সন্ধানে গ্রামে স্কাউট পাঠাতেন। এভাবেই অনন্ত বালা বৈষ্ণবী বা টেপু মিঞাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। কিন্তু তেহিনোদিবসাগতা । আজ তাদের জন্য গ্রামোফোন কোম্পানির দ্বার রুদ্ধ । লোকসংগীত এর লংপ্লে রেকর্ড করাতে হলে এখন আর গাঁয়ে গাঁয়ে লং মার্চের কষ্ট নেই , আধুনিক স্টার-শিল্পীদের মার্জিত কন্ঠের বাজার দর তার চেয়ে অনেক বেশি”৪।
পঞ্চাশের দশকে শুরুর দিক থেকে সংগীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীও যথাযথ সুনাম অর্জন করেন। লোকসংগীত ও লোকআঙ্গিক গানের ব্যবহার ও চলচ্চিত্রে সংগীতের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ নিয়ে সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। ‘গঙ্গা’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘মর্জিনা আবদাল্লা’, ‘কোরাস’ ইত্যাদি ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও তিনিই পালন করেন । রাজেন তরফদার, ঋত্বিক ঘটকের মত পরিচালকদের সংস্পর্শে চলচ্চিত্রে তার সংগীত ব্যবহারের নিপুনতা পরিস্ফূট হয়। সলিল চৌধুরীর সংগীত পরিচালনায় ‘গঙ্গা’ চলচ্চিত্রে ভাটিয়ালি গান “ওরে ও সুন্দইরা নাওয়ের মাঝি — ” গেয়েছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। নির্মলেন্দু চৌধুরীর গায়কী যেন অন্য মাত্রা এনে দেয়। মান্না দে’র কন্ঠ পূর্ণমাত্রায় রেওয়াজ নির্ভর শাস্ত্রীয় কন্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ‘আমায় ডুবাই লি রে আমায় ভাসাইলিরে’ গানের লোকসংগীতের বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বর্তমান রয়েছে। তবুও গানের শুরুর দিকের সুরের চলন লোকসংগীতর বৈশিষ্টকে খুন্ন করেছে । আবার পঙ্কজ মিত্রের কণ্ঠে ‘ইচ্ছা করে ও পরাণডারে গামসা দিয়া বান্ধি’ গানটি যথাযথ লোকসংগীতের বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলেছে ।
পরিচালক রূপে ঋত্বিক ঘটক তাঁর চলচ্চিত্রে সব ধরনের সংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধতা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। লোক-সংগীতের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সংগীত পরিচালক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র থাকলেও লোকসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক নিজে সংগীত শিল্পী নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করেন । আবার ‘সুবর্ণরেখা’র সংগীত পরিচালক বাহাদুর খান হলেও এই লোকসংগীতটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক তাঁর সৃজনী ক্ষমতার ছাপ রেখেছেন। রণেন রায়চৌধুরীর কন্ঠে গাওয়া ‘দেহতরী ছাইরা দিলাম ও তোমারই নামে’- এই গানটি উদ্বাস্তু জীবনের সঠিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। রণেন রায়চৌধুরী ঋত্বিক ঘটকের কয়েকটি চলচ্চিত্রেই প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কাজ করেন। এ প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছ “লোকসংগীত শহরের লোককে দিয়ে গাওয়ালে যে আর লোকসঙ্গীত থাকে না এটা ঋত্বিক বুঝত। কেন হয় না, এটা অনেকেই বুঝতে চায় না – ঋত্বিককে বোঝাতে হয়নি, ওর কান তৈরী ছিল এ ব্যাপারে”৫ । অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে একজন পরিচালকের চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিষয়ের দক্ষতা ছাড়াও সাঙ্গিতীক বোধও চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা দরকার সেটি এই উক্তিতেই বোঝা যায়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র রণেন রায়চৌধুরী সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন, “ ‘মেঘে ঢাকা তারায়’ গোঁ ধরল ছবিতে আমাকে তুলবে এবং গান গাওয়াবে। কিন্তু আজীবন গণনাট্য করে সেলুলয়েডের প্রতি একটা ভীতি আমার ছিল, আমি বললাম ‘তোমাকে একটি খাঁটি গ্রাম্য গলা দেব – পরীক্ষা করে দেখো’। আমি সে সময় কলকাতায় সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমার নিজ-জেলাবাসী রণেনকে তার কাছে পাঠাই। তার গান শুনে ঋত্বিক আমাকে চিঠি লেখে, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ওর গলা শুধু নয় – ভাবভঙ্গিতেও একটা গ্রাম্যতা আছে। ওকে দিয়ে ঠিক চলবে’। ‘মেঘে ঢাকা তার’য় সেই পল্লীশিল্পী রণেন রায়চৌধুরীকে অনেকেই ছবিতে দেখেছেন। তার গান ‘কান্দিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পারে’। সেই গানে আঞ্চলিক Phonetics পুরো অক্ষত রাখা হয়েছে। সিলেটে উচ্চারণে ‘ক’ হল ‘খ’-এর কাছাকাছি এবং ‘ভব’ উচ্চারণ অনেকটা ‘বব’-এর মতো…। শহরের অন্যান্য বিদগ্ধ পরিচালক এটা হয়তো করতেন না। উচ্চারণটাকে একটু না একটু পরিশীলিত করতেন – সর্বজনবোধ্যতার জন্য। কিন্তু ঋত্বিক ছিল সত্যিকারের সমঝদার। সে জানত regional phonetics লোকসংগীতের প্রাণ এবং আরও জানত যে শহরে খ্যাতিমানদের চেয়ে গ্রামের অখ্যাতরাই লোকসংগীতের সত্যিকার রূপকার”৬ । উক্ত চলচ্চিত্রে লোকসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাঁটি গ্রাম্য উচ্চারণ, সিলেটি ভাষার প্রয়োগ ছাড়া সরাসরি গায়ককে দিয়ে গাইয়ে ছবির পর্দায় অভিনয় করিয়ে গান শোনা ও দেখার মধ্যে সঠিক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রেও তিনি সরাসরি রণেন রায়চৌধুরীকে ব্যবহার করেছেন গুরুবাদী বাউল গানের ক্ষেত্রে।
আবার সত্যজিৎ রায় তাঁর চলচ্চিত্রে লোকসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিচালক হিসেবে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সেটা ‘পথের পাঁচালীর’ বৈরাগ্য বাউলই হোক, ‘সোনার কেল্লা’ রাজস্থানী লোকসংগীতই হোক , ‘কাঞ্চনজঙ্ঘায়’ নেপালি লোকসংগীত, ‘হীরক রাজার দেশের’ বাউল গান কিংবা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রে সাঁওতালি ঝুমুর গানের ক্ষেত্রেই হোক। প্রসঙ্গত ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক রবিশঙ্কর হলেও ইন্দির ঠাকরুনের কন্ঠে দুটি গান ব্যবহারের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব ভাবনা চিন্তার দিক উঠে এসেছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই সত্যজিৎ রায় স্থানীয় লোকসংগীত শিল্পীদের চলচ্চিত্রের পর্দায় দৃশ্যমান করে ও তার কণ্ঠ ব্যবহার করে আদতে লোকসংগীত এর মূল উৎসকে বা সংগীতের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে ধরে রেখেছেন ।
মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ (১৯৭৪) চলচ্চিত্রটি শুরু হয় কথকতার মধ্য দিয়ে। কথকতার ছড়াগুলো রূপকাশ্রিত। সেই রূপকের মধ্যে আছে ধর্মের দোহাই দিয়ে দারিদ্র্যকে আড়াল করার ছলনা, দারিদ্র্যের জন্যে সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপের ছলনা। মান্না দে’র উদাত্ত কন্ঠে এই কথকতা লোকআঙ্গিকের নিজস্ব রূপ পেয়েছে । একটি রাজনৈতিক ছবি ‘কোরাস’-এর চলচ্চিত্রৈক আঙ্গিকের সঙ্গে কথকতার যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী অপেক্ষা পরিচালক মৃণাল সেনের কৃতিত্ব অনেক বেশি দাবি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই শিল্পে অতি বাস্তববাদী ধারা বা ইতালীয় নিওরিয়ালিজম প্রকৃত সমাজ বাস্তবতাকে অন্বেষণ করতে শুরু করে । চলচ্চিত্র, রুপালি পর্দার জগৎ হলেও সেখানেও এই বাস্তবতার ছোঁয়া লেগেছিল। চল্লিশে দশকে গণআন্দোলন, যুদ্ধবিরোধিতা এই বাস্তবতাকে আরো প্রকট সবাক চলচ্চিত্রের প্রথম দিক থেকেই লোকসংগীত ব্যবহার প্রতীক ধর্মীতাকে অনুসরণ করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত শাস্ত্রীয় সংগীত, আধুনিক সংগীত , কিছু কিছু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসংগীত যখন বিমূর্ত ভাবনা চিন্তাকে প্রকাশ করেছে, লোকসংগীত সেই দিক থেকে বিমূর্ত চিন্তা ভাবনা যেমন প্রকাশিত করেছে তেমন সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। সৃষ্টির প্রথম থেকেই লোকসঙ্গীতে এই বাস্তবতা যেমন প্রকট হয়েছে তেমনই তার দার্শনিক চেতনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে । আবার কঠিন বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে জীবনকে রূপালী মোড়কে প্রদর্শন করা বুর্জোয়া সংস্কৃতির চিরকালীন লক্ষ্য। ফ্যান্টাসির বাস্তবতায় মশগুল হয়ে ওঠা মানুষ যে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড় থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তা লোকসংস্কৃতি তথা লোকসংগীত বারে বারে অনুভব করিয়ে দিয়েছে।
বর্তমান দিনের লোকগানের শুদ্ধতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী অমর পাল বলেছেন “গানের বিশুদ্ধতাই অনেকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গান বিকৃত করা হচ্ছে । লোকসঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রই বদলে গিয়েছে । একতারা, দোতারা , খোল , ঢোল নিয়ে আমাদের সময় গান বাধা হতো । এখন এই বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান বাধা হচ্ছে । লোকসুরের প্রাণ যে বাদ্য তাকে ছাড়া কি গান হয় বল দেখি”৭। ঋত্বিক ঘটক বরাবরই সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলেছিলেন তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে, তাঁর ছবির মাধ্যমে। কোন জাতিকে বাঁচতে হলে প্রাকৃতিক সম্পদ যথেষ্ট নয়। চাই চরিত্রের জোরও। যে কথাটাই ঋত্বিক ঘটক জানাতে চেয়েছিলেন বাঙালীকে। ‘কিছুতো একটা করতে হবে’ …. চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আপামোর জনসাধারণকে যা বারে বারে বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাই ছবিতে ব্যবহৃত লোকসংগীতের ক্ষেত্রেও হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণার দলিল হয়ে উঠেছে মহানন্দ, রণেন রায়চৌধুরী গাওয়া গান গুলি ইত্যাদি।
লোকসঙ্গীতকে রঙিন মোড়কে মুড়ে বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা কম হয়নি । অনেক সংগীত পরিচালকই প্রযোজকদের চাহিদা মতো সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে লোকসংগীতকে লঘু আঙ্গিকে চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেছেন। ‘শুকনো লঙ্কা’ চলচ্চিত্রে নৈশ পার্টিতে অতিথি অভ্যাগতদের সামনে পাশ্চাত্য যন্ত্রানুষঙ্গ ও ড্রাম বিটের সঙ্গে ‘ভালো কইরা বাজাও গো দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে’ কিংবা সাম্প্রতিককালে ‘বেলাশুরু’ চলচ্চিত্রের ‘ইনি বিনি টাপা টিনি টানা টুনি টাসা’ লোকআঙ্গিক গানের চলচ্চিত্রায়ন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে অনেক লোকসংগীত শিল্পী চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটিয়েও লোক লোকসংগীতকে কোনদিন বিকৃত করতে চায়নি। আসলে তারা শিল্পের সঙ্গে কোন প্রকার আপোষ করেননি । “চরম দারিদ্র্যেও তাদের সৃষ্টি ক্রিয়ায় কোন ব্যবসায়ী বুদ্ধি ভেজাল মেশাতে পারেনি। শিল্পী ও শ্রোতার সম্পর্কটা শুধু প্রমোদ বিতরণের জন্য ছিল না । সম্পর্কটা ছিল সামাজিক দায়িত্বের, আনন্দের মাধ্যমে লোকশিক্ষার , গোষ্ঠী চেতনার ঐক্য গ্রন্থনে এবং কর্মজীবনের প্রেরণা হিসেবে”৮ । তাই ১৯৮২ সালে মৃণাল সেনের পরিচালনায় আকালের সন্ধানে চলচ্চিত্রে ‘হেই সামালো হেই সামালো’ প্রতিবাদী লোকসংগীত এর মধ্যে ‘জান কবুল আর মান কবুল / আর দেব না আর দেব না / রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো, পংক্তি গুলি যেন সেই লোকসংগীত শিল্পীর শরীর-হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণার সাংস্কৃতিক দলিল, যারা পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে কোন সমঝোতা করেনি। এই সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার লড়াই চিরকালীন । তাতে লোকসংগীত একটি উপাদান মাত্র ।
লোকসংগীতের সস্তা বাণিজ্যিকীকরণ কিছু মাত্রায় সফল হলেও ফ্যান্টাসির রঙিন মোড়ক ছেড়ে লোকসংস্কৃতির আত্মা বারে বারে প্রকট হয়েছে নৌকার দাঁড় টানা শব্দে ,ছাদ পিটানোর গানে , ধান কাটার গানে, উত্তরবঙ্গের মহীশাল-গাড়িয়াল বন্ধুর গানের মধ্য দিয়ে। সবাক যুগের চলচ্চিত্রের প্রথম দুই দশক চলচ্চিত্রে বিনোদনের বিষয়টা প্রাধান্য থাকলেও পথের পাঁচালীর পর থেকে চলচ্চিত্র প্রকৃত সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরতে থাকে। এই সময়কার এক ঝাঁক নতুন পরিচালক যেমন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদার, তপন সিনহা প্রমূখ যারা এই বাস্তবতা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছিলেন। তাদের হাত ধরেই চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক রূপে অবতীর্ণ হন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী প্রমুখ । আবার এই সময় লোকসংগীত শিল্পী রূপে চলচ্চিত্রে কন্ঠ প্রদান করেছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, গার্গী চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, রনেন রায়চৌধুরী, মহানন্দ দাস, ভূপেন হাজারিকা, প্রতিমা বড়ুয়া, আব্বাসউদ্দিন, অমর পাল , প্রমূখ। এছাড়াও চলচ্চিত্র শিল্পীরাও অনেক সময় ছবির প্রয়োজনে লোকসংগীত গেয়েছেন। যেমন- ‘কবি’ চলচ্চিত্রে তুলসী চক্রবর্তী, ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে চূনীবালা দেবী, ‘ধনরাজ তামাং’ চলচ্চিত্রে ছায়া দেবী প্রমুখ শিল্পীর নাম উল্লেখ যোগ্য।
এই আলোচনায় সংগীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পীদের প্রসঙ্গ আলোচনা করা হলেও লোকসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিত্র পরিচালকের নিজস্ব পছন্দ ও অভিমত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমিকা পালন করেছিল তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই । কিন্তু পরিচালকের এই নিজস্ব ভাবনা তা সামগ্রিকভাবে লোকসংগীত বা লোকসংস্কৃতির মূল্যবোধের প্রতি স্থায়ীভাবে কোন দিক নির্দেশ করতে পেরেছিল কিনা তা নিয়ে আরো গবেষণার অবকাশ আছে। একবিংশ শতাব্দীতে অতি পোস্টমর্ডানিজমের যুগে লোকসংগীতকে আদিরূপে চলচ্চিত্রের ব্যবহার করা হবে কিনা, না তা আরো রঙিন করে পাশ্চাত্য যন্ত্র সহযোগে তার শিকড় ছেঁটে দিয়ে দর্শকের কাছে পরিবেশন করা হবে কিনা, তা ঠিক করার দায়িত্ব চিত্র পরিচালকের উপর নির্ভর করলেও সবশেষে চলচ্চিত্রে লোকসংগীত শিল্পীর কণ্ঠস্বরই রয়ে যায় । তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রের নামদৃশ্যে ধীরাজ উদ্দিন ফকির উদাত্ত কন্ঠে গান আজও চির ভাস্বর হয়ে আছে। তাই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথায় বলা যেতে পারে “লোকসংগীত এর সার্থক রূপকার অসংখ্য গ্রাম্য শিল্পীর কন্ঠ যে অনাহার ও দারিদ্র্যে স্তব্ধ হয়ে এসেছে তাদের দিকে পিছন ফিরে লোকসাহিত্য ও লোকসংগীত আলোচনা হবে সৌখিন বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয় । এই ‘একাডেমিক ঔদাসীন্য’ যেন আমাদের কখনো না হয়”৯ ।
তথ্যসূত্র
১ মিত্র, রাজ্যেশ্বর, সিনেমায় সংগীতের ভূমিকা, চলচ্চিত্রের সংগীতের প্রয়োগ, সম্পাদক উৎপল সরকার, পৃষ্ঠা , ১২৬-১২৭
২ আহমেদ , আব্বাস উদ্দিন, আমার শিল্পী জীবনের কথা , পৃষ্ঠা ৯১
৩ ঘোষ, সোমেন, মোহিনী সুরের অনুপম রূপকার হেমন্ত, সুরের আকাশে শুকতারা, পৃষ্ঠা : ৪-৫
৪ বিশ্বাস হেমাঙ্গ , গানের বাহিরানা , প্যাপিরাস, কলকাতা ৭০০০৪ , পৃষ্ঠা ৭-৮
৫ বিশ্বাস, হেমাঙ্গ, স্মৃতির ছিন্নপত্রে ঋত্বিক, চলচ্চিত্র চর্চা, প্রসঙ্গ ঋত্বিককুমার ঘটক, সম্পাদক, বিভাস মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা – ৩১২
৬ বিশ্বাস, হেমাঙ্গ, উজান গাঙ বাইয়া, সম্পাদক মৈনাক বিশ্বাস, অনুষ্টুপ, ২০১৮, পৃষ্ঠা – ৩১২-৩১৩
৭ সামন্ত, পায়েল, আই.ই বাংলা ওয়েব ডেস্ক ,গানের সর্বনাশ হয়ে গেছে, বলেছিলেন অমর পাল ,২২ এপ্রিল
২০১৯ , কলকাতা
৮ বিশ্বাস হেমাঙ্গ , গানের বাহিরানা , প্যাপিরাস, কলকাতা ৭০০০৪ , পৃষ্ঠা ৭
৯ তদেব
M.A, NET-JRF, Ph.D.9830579427 , itipaul2@gmail.com