May 1, 2023

The Harmonious Influence of Music on Radio and Television

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Paramita Chatterjee


Abstract:

This abstract explores the profound impact of music on the broadcast media landscape in India, specifically focusing on radio and television. Music has been an integral part of Indian culture for centuries, and its seamless integration into the electronic media has contributed significantly to the cultural fabric of the nation. This study investigates how music serves as a powerful tool in shaping the auditory and visual experiences of audiences across diverse regions and demographics. The research delves into the historical evolution of music on radio and television in India, highlighting key milestones and innovations that have shaped the landscape. It also examines the role of music in fostering a sense of cultural identity and national unity, as various forms of traditional and contemporary music are broadcast to a vast and diverse audience. Furthermore, the study explores the symbiotic relationship between music, storytelling, and visual content on television, emphasizing how music enhances the emotional impact of narratives and contributes to the overall viewer experience. It investigates the various genres of music that have gained popularity on both mediums, ranging from classical and folk to contemporary and fusion, and analyzes the changing trends in audience preferences over time. The research employs a mixed-methods approach, combining qualitative analysis of historical data, content analysis of music programming, and audience surveys to provide a comprehensive understanding of the harmonious influence of music on radio and television in India. Additionally, it considers the technological advancements that have facilitated the production and dissemination of music through these mediums, exploring the impact of digital platforms on the consumption patterns of audiences. The findings of this study aim to contribute to the academic discourse on media and culture, shedding light on the dynamic interplay between music, radio, and television in India. Understanding this harmonious influence not only provides insights into the cultural significance of music in the country but also offers valuable perspectives for media practitioners, policymakers, and researchers seeking to navigate the evolving landscape of broadcast media in India.

রেডিও এবং টেলিভিশনে সঙ্গীত

ড. পারমিতা চ্যাটার্জি , সংগীত বিভাগ, রামসদয় কলেজ, আমতা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

মানব সভ্যতার এক যুগান্তকারী আবিস্কার হল  রেডিও এবং টেলিভিশন। এই  আবিস্কার মানব সভ্যতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এদেশে টেলিভিশনের ব্যাপক বিস্তারের আগে পর্যন্ত রেডিওই ছিল সঙ্গীতের প্রধান প্রচার মাধ্যম। সময়ের সাথে সাথে এই মাধ্যমটির সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অতি গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বেতারের জন্ম লগ্নের পূর্বে সঙ্গীত সম্পর্কে মানুষের ধারনা কিছুটা অন্যরকম ছিল। বাংলার মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ সঙ্গীত মাত্রই মোটামুটিভাবে কবি গান, খেউড় ইত্যাদিকে বুঝতেন। বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে প্রাক বেতার যুগে এই ধরনের গানেরই প্রচলন বেশি ছিল। এ কারনে অন্যান্য ধরনের সঙ্গীত শোনা ও বোঝার সুযোগ মানুষের কাছে অত্যন্ত সীমায়িত ছিল। কিন্ত পরবর্তীকালে বেতারের জন্মের পর মানুষের সঙ্গীত সম্পর্কে ধারনা কিছুটা পরিবর্তিত হল ও বিস্তৃত হল। কারন বেতারে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। এবার আসি বেতারের ইতিহাস এবং বেতারের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান সম্পর্কে।

ব্রিটেনের এবং ভারতের সম্প্রচারের সুচনা প্রায় একই সময়ে হয়। ব্রিটেনের বিষয়ের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমটি খুব সহজ ছিল, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা নয়। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে ১৯২০ দশকে ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। ১৯২৬ সালে মে মাসে ব্রিটেনের ধর্মঘটে এই প্রচার মাধ্যমটি শাসক দের খুবই সাহায্য করেছিল বলে জানা যায়। ১৯২০ থেকে ১৯২৬ এর মধ্যবর্তী সময় ব্রিটেনের এই সম্প্রচার মাধ্যমের বিকাশের আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। ১৯২২ সালে অক্টোবর মাসে মার্কনি, মেট্রোপলিটন ভিকার্স, জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানী এবং আর কয়েকটি সংস্থা একত্রিত হয়ে একটি সমন্বয় কেন্দ্র গঠন করে এবং সেটির নামকরণ করেন ‘ব্রিটিশ ব্রড কাস্টিং কোম্পানি’ (BBC) এই সময় রিথ সাহেব তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের গুণে রেডিও বিষয়ে আগ্রহী এমন কিছু মানুষকে নিয়ে রেডিওর প্রকৌশল ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনা এই দুটি বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আরম্ভ করেন এবং এর ফল স্বরূপ এর পরীক্ষা এতটাই সফল হয়েছিল যে ১৯২৪ সালে শেষের দিকে দশ লক্ষেরও বেশি গ্রাহক লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছিল। ১৯২২ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর কর্মী সংখ্যা ছিল ৪ জন। এর ঠিক দু বছর পরেই সেটা গিয়ে দাঁড়াল ৪৬৫ জন। কিন্তু এর পরে এল বিপত্তি। কোম্পানির অর্থ সঙ্কটের ফলে ১৯২৬ সালের শেষে পুরানো কোম্পানিকে ভেঙে তৈরী হল ব্রিটিশ ব্রড কাস্টিং কর্পোরেশন।

   BBC ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে এবং এর কর্মী সংখ্যা ছিল ৭৭৩ এবং লাইসেন্সধারী গ্রাহকদের সংখ্যা ছিল ২০.৫ লক্ষ (২.৫ মিলিয়ন) এই প্রাইভেট কোম্পানি কোলকাতাতেও বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু কোম্পানির অর্থ সঙ্কটের ফলে সেটি নিলামে ওঠে। এই বিপত্তিতে দীর্ঘ আলোচনার পর সরকার এই কোম্পানির সমস্ত সম্পত্তি অধিকার করে এবং BBC কাজ শুরু করে। BBC কাজ শুরু করার প্রায় ৯ বছর পরে স্থাপিত হয়েছিল অল ইণ্ডিয়া রেডিও (AIR)। সালটি ছিল ১৯৩৫। এই সালের আগস্ট মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন লায়োডেন ফিলডেন। ১৯৪০ সালে ফিলডেন ৪ বছরের কঠোর পরিশ্রমে ১৪ টি ট্রান্সমিটার এবং ৪০০ মিলিয়ন লোক ৮৫০০০ বেতার যন্ত্র কিনেছিলেন। সেই সময় ও  বিভিন্ন সরকারি বিভাগ বেতারকে বার্তা সঞ্চালনের প্রয়োগ পন্থা হিসেবে ব্যবহার করত। এবং এর পাশাপাশি দুই দশক ধরে এর ব্যবহার করে আসছিল সামরিক ও আসামরিক বিভাগ। এ প্রসঙ্গে পার্থসারথী গুপ্ত লিখছেন-

“১৯৪০ সালের মে মাসে ভারতের পাঁচটি প্রধান শহরের ১৩,৫০৭ জন শ্রোতাকে নিয়ে অল ইণ্ডিয়া রেডিও প্রথম শ্রোতৃ সমীক্ষা করে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, বেশিরভাগ ভারতীয় রেডিও শোনে সংবাদের জন্য এবং বৃটেন-বিরোধী সংবাদ”[1]

ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন চলা কালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক শিশির কুমার মিত্র প্যারিসে যান গবেষণার জন্য। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় বেতারে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেডিও – ভাল্ভের ব্যাবহার সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট । এই রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করার পর সেই সময় কার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির বিষয় ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রমে ওয়্যারলেশ কে একটি নতুন বিষয় হিসেবে যোগ করার জন্য। এই চিঠির মূল্য বুঝে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নতুন বিভাগ (ওয়্যারলেশ সেকশান) স্থাপন করেন। এবং এই নতুন বিভাগ কে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন বিলেত ফেরত ডঃ শিশির কুমার মিত্র।

ইংরেজরা তাদের সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর কাজের সুবিধার্থে রেডিও ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সেই কারণে তারা কলকাতা শহরে একটি অফিস নির্মাণ করেছিল। এ প্রসঙ্গে স্বাতী দাস চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আমরা যা জানতে পারি-

“১৯১২ সাল। ক্যালকাটা ‘ইলাস্ট্রেট’ এর লেখক ‘জন ব্যারির’ একটা লেখা থেকে জানা যায় ভারতের সমুদ্র উপকূলে পাহাড়রত ব্রিটিশ নেভিগেশন কোম্পানির নৌ বহর কে বেতার যন্ত্রে সুজজ্জিত করার জন্য মার্কিন কোম্পানি কলকাতার হেস্টিং স্ট্রিটে একটি অফিস খোলে। ১৯১৮ সালে অফিস টি তার জায়গা বদলায়। নতুন ঠিকানা হয় কলকাতা হাইকোর্ট এর সামনে টম্পেল চেম্বার্স।”[2]

এর পরবর্তী পর্যায়ে জন ব্যারির রিপোর্ট থেকে জানা যায়  যে সরকার অনুমতি দিয়েছিল এই প্রসঙ্গে। জন ব্যারির রিপোর্ট টি নীচে বর্ণিত করা হল- It will be of interest to note that the first broadcasting transmitter, known as 5 A.F was installed here in 1923.[3]                                    

উপরিউক্ত পত্রিকা লিখনে যে স্টেপ্‌ল টনের নামের উল্লেখ পাওয়া যায় , তিনি বেতার সম্প্রচার এর ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এর পরবর্তীকালে রেডিও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ডঃ শিশির কুমার মিত্র। এবং এই রেডিও ক্লাব একটি পত্রিকা প্রকাশিত করল যার নাম দিল ‘রেডিও”। “রেডিও ক্লাব” প্রত্যেক সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা শুরু করল। তার সাথে সাথে ডঃ শিশির কুমার মিত্র তার ওয়্যারলেস ল্যাবরেটরিতে আর একটি ট্র্যান্সমিটার বসালেন এবং সেখান থেকে হীরেন বসুর উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা শুরু করলেন। বারানসী, আগ্রা, বার্মাতেও শিশির কুমার মিত্রর ট্রান্সমিটার থেকে অনুষ্ঠান শুনতে পাওয়া যেত। এরপরে অর্থাৎ ১৯২৪-এর জুন মাসে আরো দুটি রেডিয়ো ক্লাব স্থাপিত হল, বম্বে এবং মাদ্রাজ শহরে। এবং এইখান থেকেই প্রতিদিন আড়াই ঘন্টা করে অনুষ্ঠান সম্প্রচার হত। এর পাশাপাশি ডঃ শিশির কুমার মিত্রের প্রচেষ্টা উৎসাহিত করেছিল বিবিসি অর্থাৎ ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন কে। বিবিসির কর্মকর্তা সি.সি. ওয়ালিক ১৯২৬ সালে কলকাতায় এসে পৌছালেন এবং টেম্পল চেম্বার বিল্ডিং এর সর্ব্বোচ্চ তলে মিস্টার ওয়ালিক একটি বেতার ট্রান্সমিশন স্টুডিয়ো গড়ে তুললেন। এরপরে বিবিসি কলকাতায় স্থায়ী ভাবে ব্যবসা শুরু করল। এই ট্রান্সমিশন স্টুডিয়োর কর্তা হলেন জে.আর.স্টেপলটন। এর পর স্টেপল্টন একটি ভালো জায়গার খোঁজ করতে লাগলেন বেতার স্টুডিয়ো গড়ে তোলার জন্য। অবশেষে ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে তিনি তাঁর মনমতো জায়গা খুঁজে পেলেন। জায়গাটি ছিলো নির্জন, তাই এটি স্টুডিওর কাজ করার জন্য একদম উপযুক্ত। এরপর এই নির্জন ক্ষেত্রটি থেকেই শুরু হলো রেডিওর কাজ। এর পরেই ১৯২৭ সালের ২৩ শে জুলাই বম্বে শহরে বেতার কেন্দ্র তৈরী হল।

“এর পাশাপাশি ১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট কলকাতায় ভারতের প্রথম “নিয়মিত” বেতার কেন্দ্রটি গড়ে উঠল। দ্বারোদঘাটন করলেন বাংলার তদানীন্তন গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম বক্তব্য রাখেন স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসান এবং ইণ্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার. চিনয়।

   মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বিলেত থেকে সদ্য আসা বিবিসি-র কাজের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সি.সি. ওয়ালিক। অনুষ্ঠানটি ছিলো পুরোটাই ভারতীয়। গানে অংশগ্রহন করেন আঙুরবালা, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, প্রফুল্লবালা ও দীনেন্দ্র নাথ ঠাকুর। এই অনুষ্ঠানে হাসির গান পরিবেশন করেছিলেন সিতাংসুজ্যোতি মুখোপাধ্যায় (বকুবাবু)। বক্তা মণীলাল গঙ্গোপাধ্যায়। বাঁশি বাজান নৃপেনবাবু আর বাংলায় সংবাদ পরিবেশন করেন রাজেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।[4]

কিন্তু এরপরেই হল আসল ঘটনা যা ইতিহাসে পরিণত হয়েছিল। সেই ঘটনাটি ছিল ইণ্ডিয়ান স্টেট ব্রেকাস্টিং সার্ভিস থেকে অল ইণ্ডিয়া রেডিয়োতে রুপান্তরের গল্প। এই প্রসঙ্গে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ফায়োনেল ফিলডেনের আত্মজীবনী The Natural Bent-এ ফিলডেন লিখেছেন-

I had never liked the title ISBS (Indian State Broadcasting Service) which to me seemed not only unwieldy but also tainted with officialdom. After a good deal of things do not always appear easily- I had concluded that All India Radio would give me not only protection from the clauses which I most feared in the 1935 Act, but would also have the suitable initial AIR. I worked out a monogram which placed these letters over the map I mooted this point. I found that there was immense opposition in the secretariat to any such change. They wanted ISBS and they thought it fine. I realized that I must employ a little unnatural tact. I cornered lord Linlithgow after a vice regal banquet and said plaintively that I was in a great difficulty and needed his advice. (He usually responded well to such an opening). I said I
was sure that he agreed with me that ISBS was clumsy title. After a slight pause, he nodded his long wisely. Yes, it was rather a mouthful. I said that perhaps it was a pity to use the word broadcasting at all, since all Indians had to say ‘broadcasting’-‘broad’ was for them an unpronounceable word. But I could not. I said, think of another title: could he help me? ‘Indian State’. I said was a term which, as he well knew, hardly fitted into 1935 Act. It should be something general. He rose beautifully to the bait, ‘All India?’ I expressed my astonishment and admiration. The very thing. But surely not ‘Broadcasting’? After some thought he suggested ‘radio’? Splendid, I said-and what beautiful initials: The Viceroy concluded that he had invented it and there was no more trouble. His pet name must be adopted. Thus All India
Radio was born.[5]

ঠিক এর পর থেকেই “অল ইণ্ডিয়া রেডিয়ো’ নাম প্রচলিত হল। ১৯৫৮ সালের ১৫-ই সেপ্টেম্বর ১, গারস্টিন প্লেস থেকে কলকাতা বেতার চলে গেল ইডেন গার্ডেন্স। ১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট কলকাতা বেতারের সম্প্রচার শুরু হয়েছিল মিডিয়াম ওয়েভ-এর মাধ্যমে। ১৯৩৩ সালে এই মিডিয়াম ওয়েভ-এর সঙ্গে শর্টওয়েভ যুক্ত হল ইঞ্জিনিয়ার সুধীন্দ্রনাথ রায়ের তত্ত্বাবধানে। তবে এটি ছিল খুবই  কম শক্তি সম্পন্ন, ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে বসানো হল ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার। এই উপলক্ষ্যে বেতার জগৎ পত্রিকার ১৬ই আগস্ট সংখ্যাটিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা প্রকাশ করার জন্য খুবই উদ্যোগী হন সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা ‘নলিনীকান্ত সরকার’। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘নলিনীকান্ত সরকার’ সঙ্গীত বিভাগের সুবলচন্দ্র চক্রবর্তীকে সচিব সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর কাছে মনের অভিলাষের কথা ব্যাক্ত করেন। কিন্তু সেই সময় রবীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ থাকায় এবং চিকিৎসকদের নিষেধ থাকায় কোন কিছু লিখে দিতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথ। তবে এই ঘটনার ঠিক চার দিন পরই সুধাকান্ত বাবুর একটি চিঠি নলিনীকান্তের কাছে এসে পৌছায়। যার মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা একটি কবিতা। কবিতাটি নিচে বর্ণিত করা হল-

ধরার আঙিনা হতে ঐ শোনো

উঠিল আকাশবাণী,

অমরলোকের মহিমা দিল যে

মর্ত্যলোকেরে আনি।

সরস্বতীর আসন পাতিল

নীল গগনের মাঝে,

আলোক-বীণার সভামণ্ডলে

মানুষের বীণা বাজে।

সুরের প্রবাহ ধায় সুরলোকে

 দূরকে সে নেয় জিনি,

কবি-কল্পনা বহিয়া চলিল

অলখ সৌদামিনী।

ভাষা-রথ ধায় পূবে-পশ্চিমে

সূর্যরথের সাথে,

উধাও হইল মানবচিত্ত

 স্বর্গের সীমানাতে।

 উপরিউক্ত কবিতাটিতে “আকাশবাণী” শব্দের উল্লেখ আছে। এর থেকেই সম্পূর্ণ সুষ্টভাবে বোঝা যায় যে ‘আকাশবাণী’ নামটা রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। কিন্তু কলকাতা বেতারে রবীন্দ্রনাথের তাঁর নিজের কবিতা, গান প্রচারের ক্ষেত্রে খুবই আপত্তি এবং অনীহা দেখা গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে ১৯৩৭ সালের কলকাতা বেতারের প্রোগাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের কন্ঠস্বর প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন কলকাতা বেতারে। কিন্তু কবির অনিচ্ছার জন্য তা সম্ভবপর হয় নি। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর প্রয়োজনে অর্থসংগ্রহের জন্য দিল্লি গিয়েছিলেন। সেই সময়ে বেতার কর্তৃপক্ষের আগ্রহের জন্য দিল্লীর বেতার কেন্দ্র থেকে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, এবং সেটাই ছিল ভারতে প্রথম বেতার যন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রচারিত রবিন্দ্রনাথের কন্ঠস্বর। বেতারের প্রোগাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার বেতারে প্রচারের প্রসঙ্গ তুলতেই রবীন্দ্রনাথ বেতারের উপর ঘোরতর অভিযোগ আনেন। এই অভিযোগ শোনার পরে প্রোগাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার তৎকালিন কন্ট্রোলার অফ ব্রডকাস্টিং লায়োনেল ফিনডেনকে সব অভিযোগের কথা জানান এবং ফিলডেন এই অভিযোগ শুনে খুবই  মর্মাহত হন এবং এর যথাযথ ব্যবস্থা নেন। এরপর ফিলডেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বিষয়েই যোগাযোগ করেন। ঠিক সেই সময়েই কলকাতা বেতারের উপর রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ হয় বলে মনে হয়।

   সেই সময়কার কলকাতা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের কন্ঠস্বর প্রচারের অনেকবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা কোনভাবেই সম্ভবপর হচ্ছিল না, এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে কোনো কারনে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বেতার কেন্দ্রে যেতে চাইছিলেন না। কলকাতা বেতার কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথের না যাওয়ার কারন উন্মোচন করে দেখা গেল যে, কবির গান কোন শিল্পী তার খুশি মত পরিবর্তীত রূপে পরিবেশন করুক, সেটা কবির একদমই পছন্দ নয়। এক্ষেত্রে কবির মনে হত যে তাঁর গানের উপর উৎপীড়ন করা হচ্ছে। এরপর ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর স্টেপ্‌লটন ছুটি নিয়ে চলে যান এবং অস্থায়ী স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন অশোক কুমার সেন, স্টেপল্‌টনের জায়গায়। অস্থায়ী স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেনের একটি বড় অবদান ছিল যে, কলকাতার বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ঘনিষ্ট করে তোলার ক্ষেত্রে। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অশোক কুমার সেন শান্তিনিকেতনে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়নে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেই সময়কার স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেন জিজ্ঞাসা করেছিলেনযে, বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের উদাসীন হওয়ার কারন কি ছিল? সেই প্রশ্নের উত্তরে কবি জানিয়েছিলেন বেতারের স্টুডিয়োর মধ্যে হারমোনিয়ামের দৌরাত্মের ফলে রবীন্দ্রসঙ্গীত কে হত্যা করা হচ্ছে বলে তাঁর মনে হয়। এবং সেটাতে তিনি একদমই রাজি ছিলেন না। কবির এই ক্ষোভের কথা শুনে স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেন কবিকে আস্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। স্টেশন ডিরেক্টর অশোক কুমার সেনের কথায় কবির কিছুটা প্রশান্তি মিলেছিল বলে জানা যায়। এরপর কলকাতা বেতার থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে কবির বিশেষ বাণী প্রচারেও কবিকে রাজি করিয়েছিলেন অশোক কুমার সেন। এবং যথারীতি রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মদিন’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।

   এরপরে আসি ১৯৩৯ সালের কথায়। কবি তখন ছিলেন শান্তিনিকেতনে, কলকাতা বেতারের সঙ্গে তাঁর এক সুমধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বেতারের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন যে শান্তিনিকেতনে বেতার কেন্দ্রের একটা সহায়ক স্টুডিয়ো গড়ে তোলার জন্য। কবির এই আবেদনে তৎকালীন কেন্দ্র অধিকর্তা অশোক কুমার সেন তাঁকে আদরে সম্মতি দেন, কিন্তু ডাক বিভাগের কিছু গাফিলতির ফলে সেই প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হয় নি।

   “সঙ্গীত শিক্ষার আসর” অনুষ্ঠানটিতে দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে পরিচালনা করতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ, পঙ্কজ কুমার মল্লিককে বলেছিলেন, “ তোমার সংগীত শিক্ষার আসরে আমার গান শেখাতে পারো, তাতে আমি আপত্তির কারন দেখি না, বরং আনন্দই পাবো”। এর পাশাপাশি কবির আরেকটি অনুরোধ ছিল যে, তাঁর গানের সঙ্গে তবলা যেন মৃদুভাবে বাজানো হয় এবং তা যেন সুরের সঙ্গে মিশে গিয়ে সুরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত করে, তবলা কোন ভাবেই সুরকে ছাপিয়ে গিয়ে অতিরিক্ত শব্দ বিস্তার না করে, এরপরে রবীন্দ্রনাথের অনেক বক্তৃতাও রেকর্ড করা হয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতেই অমলা বসু, ইন্দুলেখা ঘোষ ও কনিকা বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্র অধিকর্তা অশোক কুমার সেন মহাশয়। কলকাতা বেতারের উদ্দেশ্যে। এইভাবে কলকাতা বেতারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ক্রমশ সুদৃঢ় হয়েছিল। কিন্তু এরপরেই এল ভীষণ বিপর্যয়। রবীন্দ্রনাথ ভীষনই অসুস্থ হয়ে পড়লেন।  অস্ত্রপ্রচারের জন্য ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। এদিকে কবির শরীরের অবস্থা জানার জন্য দেশবাসী ভীষনই ব্যাকুল হয়ে পড়ল, এইসময় কলকাতা বেতার এক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, কবির শরীরের অবস্থার খবর প্রত্যেক ঘন্টায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী থেকে সংগ্রহ করে দেশবাসীর কাছে পৌছে দিয়েছিল এই কলকাতার বেতার। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রে’র ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কবির শরীরের অবস্থা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, এবং তিনি এই দায়িত্ব খুবই যত্ন সহকারে পালন করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু এদিকে রবীন্দ্রনাথের শরীরের অবস্থার ক্রমশই অবনতি হতে লাগল। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে কলকাতার বেতার কর্তৃপক্ষ ৬ই আগস্ট ঘন্টায় ঘন্টায় কবির স্বাস্থ্যের খবর দেশবাসীর কাছে পৌছে দিয়েছিল। কিন্তু অবশেষে ২২শে শ্রাবন কবির মৃত্যুমুখে ঢলে পড়লেন। সর্বপ্রথম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে কবির প্রয়াত হওয়ার খবর পাঠানো হয়েছিল কলকাতা বেতার কর্তৃপক্ষের কাছে। সেই দুঃসংবাদ কলকাতা বেতার সঙ্গে সঙ্গেই সম্প্রচার করেছিল দেশবাসীর কাছে, গান, বাজনা, কবিতা প্রচার করার পাশাপাশিও কলকাতা বেতার সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রেও একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল বলে আমার মনে হয়।

বেতারের ইতিহাস খুজতে গিয়ে দেখা গেছে যে বেতারের সঙ্গে অনেক বিশিষ্ট গুণী মানুষেরই সু-সম্পর্ক ছিল। তাঁদের মধ্যে ‘নজরুল ইসলাম’ ছিলেন অন্যতম। ১৯৩৮ অথবা ১৯৩৯ সালে আসাদুল হক নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছেন অক্টোবর, ১৯৩৯ কলকাতা বেতার কেন্দ্রে কর্মী হিসেবে যোগদান করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

এ প্রসঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র লিখছেন- “কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে যোগ দেন ১৯৩৮ অথবা ১৯৩৯ সালে। আসাদুল হক নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছেন; অক্টোবর, ১৯৩৯। অন্যদিকে নজরুল জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত তাঁর একটি জীবন গ্রন্থে বলা হয়েছে; ১৯৩৮।”[6]

তবে ১৯২৮ সালে নজরুল বেতারের একটি গান গেয়েছিলেন এবং তার ঠিক পরের বছর ১২ই নভেম্বর তাঁর নিজস্ব কন্ঠে একটি আবৃত্তি প্রচারিত হয়েছিল কলকাতা বেতার থেকে। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে ১৯২৮ সালে অথবা ১৯২৯ সালেই বেতারের সঙ্গে নজরুলের সংযোগ হয়েছিল বলে জানা যায়। নজরুলের কবিতা গান ও বিভিন্ন কার্যকারিতার সঙ্গে লেগে থাকা সত্ত্বেও তাঁর জীবনে এই সময় ছিল অর্থসংকটে ভরা। কিন্তু কলকাতা বেতার, গ্রামাফোন কোম্পানী ও এইচ.এম.ভি এর সঙ্গে এইসময়ে যোগাযোগের ফলে অর্থের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি মিলেছিল বলে জানা যায়। কলকাতা বেতারের ইতিহাস অনুধাবন করে দেখা যাচ্ছে যে- কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রায় দশ বছর আগে থেকেই কলকাতা বেতারে নিয়মিত নজরুলের গান শোনা যেত। এরপর তিনি কখনো কখনো বেতারে নিজের কন্ঠেই গান পরিবেশন করতেন আবার কখনো বিভিন্ন শিল্পী দ্বারাও তাঁর গান পরিবেশন করাতেন। সেই সময় নজরুলের গানগুলি খুবি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল; কিন্তু সে সময়ে-ও “নজরুল গীতি” বলে অ্যাখ্যা পায় নি, তাঁর গানকে বাংলা আধুনিক গান হিসেবেই প্রচারিত করত কলকাতা বেতার। এই ভাবে বেতারের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হতে লাগল, বেতার নাটকের জন্য-ও গান লিখতেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল বেতারের জন্য অনেক গান কবিতাও লিখেছিলেন। ১৯৩৮ সালে ২৩শে এপ্রিল কবি নজরুল “আধুনিক বাংলা গানের গতি প্রকৃতি” বিষয়ে এক ভাষন দিয়েছিলেন কলকাতা বেতারে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সুরকারেরা বেতারের গীতানুষ্ঠানে নজরুলের গানকে ব্যবহার করতেন। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে ৫ই মার্চ, ১৯৩৯ সালে দোল পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে “শ্রী শ্রী চৈতন্যলীলা” অনুষ্ঠানে নজরুলের একটি গানকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এর পরবর্তীকালে বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান গুলিকে নজরুল নিজেই পরিচালনা করতেন, এর মধ্যে নজরুল পরিচালিত রাগসঙ্গীত বিষয়ে “হারামনি” অনুষ্ঠানটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য সব তথ্য সংগ্রহ করে নজরুলকে সাহায্য করতেন সংগীত বিশেষজ্ঞ সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, এইভাবে নজরুল বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বেতারের ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন বেতারকেন্দ্রে বসে “ রবিহারা” কবিতাটি রচনা করেছিলেন এবং সন্ধ্যায় তা নিজ কন্ঠে পাঠ করেছিলেন। এর সাথে সাথে “ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে” এই অসাধারন গানটি তিনি রচনা করেছিলেন এবং নিজ কন্ঠে বেতারের মাধ্যমে প্রচারিত করেছিলেন সকল দেশবাসীর কাছে। এর পরবর্তীকালে বেতারে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই সময়ে এইচ.এম.ভি তে তাঁর চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার দরুন নজরুল বেতারকে অনেকটা সময় দিতে পেরেছিলেন বলে জানা যায়। তবে কবি নজরুলের সঙ্গে বেতারের চুক্তি ছিল প্রোগ্রামভিত্তিক। নজরুল কোনদিনই বেতারে বেতন ভিত্তিক চাকরী করেন নি। ১৯৪২ সালের জুন মাসে নজরুলকে উপদেষ্টা কমিটিতে যোগদান করার আমন্ত্রন জানিয়েছিল বেতার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নজরুলের অসুস্থতার কারনে তা সম্ভবপর হয় নি। নজরুল এক জটিল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই বেতার কেন্দ্রেই। “ছোটদের আসর” অনুষ্ঠানে তাঁর কিছু বলার কথা ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও গলা দিয়ে কোন স্বর নিঃসৃত হয়নি। এমতবস্থায় বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁকে তাঁর শ্যামবাজারের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অসুস্থতার কারনে নজরুল বেশীদিন আর বেতারে কাজ করতে পারেন নি। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট দুপুর ১টা নাগাদ কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত করেছিল।

কলকাতা আকাশবাণীর বিভিন্ন জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে রম্যগিতি অনুষ্ঠানটি ছিল অন্যতম। এই অনুষ্ঠানটি ১৯৫৬ সালের জানুয়ারী মাস থেকে কলকাতা আকাশবাণী থেকে সম্প্রচার করা হত। এই অনুষ্ঠানটির স্রষ্টা ছিলেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের পরিচালনায় এই রম্যগীতি অনুষ্ঠানটির সিগনেচার টিউনটি নির্মিত হয়েছিল। এই সিগনেচার টিউনটি নির্মানের ক্ষেত্রে যে সব শিল্পীর নাম পাওয়া যায় তারা হলেন আলি আহমেদ হোসেন, শ্যামল বসু, অলোকনাথ দে ও সুরেন পাল।

কলকাতা আকাশবাণী বিভিন্ন ধরনের গান ও বাজনা প্রচারের ফলে মানুষের মনে এক নতুন ধারনা তৈরি হল। শ্রোতারা বুঝতে পারলেন যে সঙ্গীত কত ধরনের হতে পারে এবং সঙ্গীত মানে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের গান বাজনাকে বোঝায় না। বেতারের পর এল টেলিভিশন।

১৯৭৫ সালে ১৫ই সেপ্টেম্বর কলকাতা দূরদর্শন হবার ফলে মানুষ আরও সহজ ও সুন্দর ভাবে সঙ্গীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে ও শুনতে সক্ষম হল। রেডিওতে শুধুমাত্র শিল্পীর কণ্ঠ শুনতে পেতেন শ্রোতারা। কিন্ত টেলিভিশন আসার পর মানুষ শিল্পীর গান সহ সেই শিল্পীকেও দেখতে ও শুনতে পেলেন খুব সহজেই। এর ফলে সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীরও প্রচার ও প্রসার খুব সহজে হতে লাগল। উপরিউক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসার সমৃদ্ধ হওয়র ক্ষেত্রে রেডিও এবং টেলিভিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।    


তথ্যসূত্র

[1] পার্থসারথী গুপ্ত, রেডিও এবং ব্রিটিশরাজ(প্রবন্ধ), মুল গ্রন্থ- কলকাতা বেতার, সম্পাদনা, ভবেশ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, পুর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, পৃঃ-৩৫

[2] স্বাতী দাস চট্টোপাধ্যায়, শুরুর সেই দিনগুলি (প্রবন্ধ), মুল গ্রন্থ- কলকাতা বেতার, সম্পাদনা, ভবেশ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, পুর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, পৃঃ ৪২

[3] https://prasarbharati.gov.in/growth-development-air/

[4] স্বাতী দাস চট্টোপাধ্যায়, শুরুর সেই দিনগুলি (প্রবন্ধ), মুল গ্রন্থ- কলকাতা বেতার, সম্পাদনা, ভবেশ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, পুর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, পৃঃ ৪৫

[5] https://www.studocu.com/in/document/jadavpur-university/introduction-to-journalism/radio/36039486

[6] বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বেতার ও নজরুল সম্পর্ক (প্রবন্ধ), মুল গ্রন্থ- কলকাতা বেতার, সম্পাদনা, ভবেশ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, পুর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, পৃঃ ৭৩

সহায়ক গ্রন্থ

১) চৌধুরী, পরিমল, আকাশবাণীর দিনগুলি, কলকাতা, মণীষা, গ্রন্থালয়,১৯৮১।

২) ঠাকুর, ব্রহ্মমোহন, বেতারে নজরুল, মজহারুল ইসলাম, কলকাতা,নবজাত, ১৯৯৮।

৩) বেতার জগৎ, কলকাতা, আকাশবাণী কলকাতা, ১৯৬০-১৯৯০।

) দাস, ভবেশ, ও দাস প্রভাত কুমার, সম্পাদক, কলকাতা বেতার, কলকাতা; পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, ২০১১।