Swadesh Consciousness in the Background of the Partition of Bengal: A Literary Exploration of Rabindranath Tagore’s Perspectives
Sushma Bhui
Abstract: This literary analysis delves into the profound reflections of Rabindranath Tagore on Swadesh Consciousness, contextualized against the backdrop of the Partition of Bengal. Tagore, a polymathic figure in Indian literature, was not only a poet but also a philosopher and a social reformer. The Partition of Bengal in 1905, a contentious political move by the British, deeply influenced Tagore’s thoughts on nationalism, identity, and the cultural fabric of India. This abstract explores how Tagore’s writings, particularly his poems, essays, and letters, articulate a nuanced response to the socio-political climate of the time. It seeks to unravel the intricate layers of Swadesh Consciousness as conceptualized by Tagore and examines how his ideas continue to resonate in the contemporary discourse on nationalism and identity in India. Through a literary lens, this analysis aims to provide insights into Tagore’s intellectual contributions, shedding light on his visionary understanding of the complex interplay between regionalism, national unity, and cultural consciousness during a pivotal period in Indian history.
বঙ্গভঙ্গ পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চেতনা – সুষমা ভূই
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গদেশ কে বিভক্ত করা এবং শাসন বিরোধীদের দুর্বল করে দেওয়া। সেই উদ্দেশ্য সচল করার জন্য ইংরেজ সরকার বাংলায় ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়ের বিভেদ সৃষ্টি করে। এই বিভেদ বাংলার মানুষকে দুর্বল করে তুলেছিল। ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায় এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ রেষারেষি বা অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিতে শুরু করে ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলে সকল ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুব দরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদাযকে মিলনের স্রোতধারায় নিতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কথায় –এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশ ভাঙলে হিন্দু–মুসলমান–বৌদ্ধ–খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে।বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী–পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে।
অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলিতে দেশমাত্রিকাকে সৌন্দর্যময়ী কল্পমূর্তি রূপে রচনা করেছেন। এই গান গুলির মাধ্যমে তিনি বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগিয়েছেন এবং সমস্ত দেশবাসীকে এক জনসম্প্রদায়ে বা এক জাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর লিখিত ৪৬টি স্বদেশ পর্যায়ের গানের উল্লেখ আছে।বঙ্গভঙ্গের সময়কালীন কবিগুরু ছিলেন গিরিডিতে, এবং সেখানে থাকাকালীন তিনি বাউল সুরে একুশ টি স্বদেশী গান লেখেন। বঙ্গভঙ্গের সময়কালীন কয়েকটি গান নিয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি গানের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ চেতনা এবং বঙ্গভঙ্গ পটভূমিতে দেশবাসীর ওপর এই গানগুলির প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
উল্লেখ্যযোগ্য শব্দমালা : বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, স্বদেশ, চেতনা,সঙ্গীত, দেশ,দেশপ্রেম, দেশবাসী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্গদেশ, বিভক্ত, শোষণ, মানুষ, সকল, শক্তি, পর্যায়, অংশগ্রহণ, জনসম্প্রদায়, ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়,
- ভূমিকা :
১৭৬৫ সালের পর থেকেই বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা একত্র ছিল। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষের কাছ থেকে অর্থসম্পদ লুটপাট করা। যে কোনো উপায়ে খাজনা আদায়ই করার জন্য স্থানীয় জমিদারদের ব্যবহার করতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। সে সময়ে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখা দেয়। খাবারের অভাবে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মানুষ নির্মম শোষণের শিকার হয়। ফলে সেই সময় কিছু কিছু জায়গায় প্রজাবিদ্রোহও দেখা দিচ্ছিল।
বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা যুক্ত থাকায় বাংলার আয়তন অতিরিক্ত বড় ছিল। ফলে বনিক ইংরেজদের পক্ষে বাংলাকে শাসন ও শোষণ করা ঝামেলাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ কারণে ইংরেজরা বঙ্গকে ভাগ করার একটা পরিকল্পনা বহু পূর্ব থেকেই করে এসেছিল।বঙ্গপ্রদেশের আয়তন ছিল সে সময় ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ছিল ৭৮,৫ মিলিয়ন। ১৮৩৬ সালের জনগননা অনুযায়ী। তখন বঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভৌগলিক ও অপ্রতুল যোগাযোগ ববস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে গভর্নরের উপর অর্পন করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেটসহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত করা হয়।
১৮৯৬ সালে আসামের চীফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড প্রস্তাব করেন, চট্টগ্রাম ডিভিশন ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে একটি লেফটেনান্ট গভর্নর–শাসিত প্রদেশ গঠন করা হোক—কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী স্যার হেনরী কটন ও জনগণের প্রতিবাদে কেবল লুসাই পর্বতমালা হস্তান্তর করে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়। ১৯০১ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার সম্বলপুর–সহ উড়িষ্যাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলার সীমানা–পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করলে ব্যাপারটি কার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তাঁর বিখ্যাত Round and round নোটে (২৪ মার্চ ১৯০২) সমস্ত ব্যাপারটিকে ত্বরাণ্বিত করার হুকুম দিলেন। ফ্রেজার ২৮ মার্চ ১৯০৩ সালের নোটে ওয়ার্ডের পরিকল্পনাটি উপস্থাপিত করলে কার্জন তাঁর ১ জুন ১৯০৩ তারিখের নোটে ‘একটি প্রজন্মের জন্য ভারতের শাসন–সীমানা’[1] নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আশা প্রকাশ করলেন। এরইপর ভিত্তি করে ভারত সরকারের প্রধান সচিব হার্বার্ট রিজলে বাংলা গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারিকে তার বিখ্যাত ৩ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখের চিঠিতে Artificial agitation এবং interested outcry—এর সম্ভাবনা সত্বেও শাসনতান্ত্রিক নৈপুণ্য ও সুবিধার স্বার্থে সীমানা–পুনর্বিন্যাসের যৌক্তিকতা সমর্থন করলেন। রিজলি তার নোটে লিখেছিলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বঙ্গদেশকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসন–বিরোধীদের দুর্বল করে দেওয়া।
- উদ্দেশ্য :
বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কী ভূমিকা ছিলো তা এখনও আমাদের কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, ফলে এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। বিরাজমান বিতর্ক বিমোচনে খুটিনাটি তথ্য, যেমন – বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে কবিগুরুর অংশগ্রহণ,এবং তিনি এই অংশগ্রহণে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার লেখা গানগুলি কে, সেই সময়ে রচিত এই গানগুলি এই পটভূমিকায় কত বড় ভূমিকা পালন করেছে সেটি আলোচনা করার চেষ্টা করব । তারসাথে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই পটভূমিকায় তিনি শিক্ষাব্যবস্থার দিকেও আলোকপাত করতে চেয়েছেন এবিষয়ে কিছু বিশ্লেষণসহ নতুন করে আলো ফেলার চেষ্টা করব আমার এই কাজের মাধ্যমে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে কবিগুরুর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করা নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের জন্য মিলনের স্রোতধারায় নিতে চেষ্টা করেছেন। ৭ই আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব প্রতীকই হিন্দুদের প্রতীক থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রতীকের সাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। বঙ্গদেশ কেবল হিন্দুদের নয়—হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষেরই দেশ। এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে তা নয়। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে। সুতরাং তিনি এই বিজয় সম্মিলনীতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্ভাষণ করার আহ্বান করেন। তিনি লিখেছেন–“হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।”[2]
৩ রা সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। প্রায় চার হাজার ছাত্র খালি পায়ে পতাকা হাতে সমাবেশে যোগদান করে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা‘ গানটি গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঘোষণা করা হয়– যদি ১৬ অক্টোবর সতি সত্যি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় তবে সেদিনটিতে সারা দেশে পাদুকা বর্জন ও চাদর বর্জন করার মধ্যে দিয়ে তিন দিনের শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে।[3]
- বিশ্লেষণ :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সেভাবে যুক্ত ছিলেন না ঠিকই , কিন্তু তাঁর লেখার মাধ্যমে যেভাবে দেশবাসীর মনের বল জুগিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য । বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিতে তার সকল দেশবাসীকে একত্রিত করার যে চেষ্টা তার লেখার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে তা এই পরিস্থিতিতে যথেষ্ট গুরুত্ব রাখে। পরবর্তী ক্ষেত্রে আমি কবির সেই সময় রচিত গানগুলি দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
১ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে ঘোষণা করা হয়— ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়। বঙ্গবঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ৩টি কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল –
১) বিলিতি ভোগ্যপণ্য বয়কট।
২) স্বদেশী শিল্পের সংগঠন ও প্রচার এবং এই উপলক্ষ্যে জাতীয় অর্থভাণ্ডার স্থাপন।
৩) মিছিল, বক্তৃতা ও লেখালেখি।
প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন, এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ৫টি সভায় যোগ দিয়েছেন, ২টি সভায় লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন। ১টিতে সভাপতিত্ব ও মৌখিক ভাষণ দিয়েছেন। একটিতে ঘোষণাপত্রের বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছেন। একটি সভায় শুধু উপস্থিত ছিলেন। এই হিসেব থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ ছিল অন্যদের চেয়ে কম। তবে ভাণ্ডার ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ মোটেই কম নয়। এইসব লেখালেখির মাধ্যমে তিনি কয়েকটি বিষয়ের উপর সুস্পষ্টভাবে জোর দিয়েছেন—
১) বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা।
২) ভিতর থেকে ঐক্য গড়ে তোলা গেলে সে ঐক্য বাইরে কোনো শক্তি ভাঙতে পারবেনা।
৩) ইংরেজদের উপর রাগ করে নয়—দেশকে ভালোবেসে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা দরকার।
৪) দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে গড়ে তোলার জন্য কিছু বিলেতি ভোগ্যবস্তু থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে হবে। এই ত্যাগের মধ্যেকার ইতাবাচক বা ভাবগত দিকটিকেই জোর দিয়েছেন।
৫) সহজ পরিচিত সুরে রচিত গানগুলির মাধ্যমে দেশজননীর একটি সৌন্দর্য্যময়ী কল্পমূর্তি রচনা করেছেন। এ–গানগুলোর মাধ্যমে তিনি বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগিয়েছেন। এবং একটি জনসম্প্রদায়কে একটি জাতি হিসাবে পরিণত করার চেষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ করেছেন।
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মজফ্ফরপুরে। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোণামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও ইউনিভার্সিটি বিল দুটি বিষয়েই তার নিজস্ব মত প্রকাশ করলেন।কার্জনের শিক্ষা সংকোচন বিল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘বিলিতি য়ুনিভার্সিটির ব্যয়বহুল আয়োজন দেশীয় জীবনযাত্রার জন্য সংগতিপূর্ণ নহে,আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল—দেশের উচ্চনিচ্চ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্রণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। কিন্তু বিলিতি আদর্শে শিক্ষা যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী–দরিদ্রের ব্যবধান অত্যন্ত বৃহৎ হইয়া উঠিবে।’
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেছেন, ‘এ স্থলে আমাদের একমাত্র কর্তব্য, নিজেরা সচেষ্ট হওয়া, আমাদের দেশে ডাক্তার জগদীশ বসু প্রভৃতির মতো যে–সকল প্রতিভাসম্পন্ন মনস্বী প্রতিকূলতার মধ্যে থাকিয়াও মাথা তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগকে মুক্তি দিয়া তাঁহাদের হস্তে দেশের ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার স্বাধীন অবকাশ দেওয়া; অবজ্ঞা–অশ্রদ্ধা–অনাদরের হাত হইতে বিদ্যাকে উদ্ধার করিয়া দেবী সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা করা; জ্ঞানশিক্ষাকে স্বদেশের জিনিস করিয়া দাঁড় করানো; আমাদের শক্তির সহিত, সাধনার সহিত, প্রকৃতির সহিত তাহাকে অন্তরঙ্গরূপে সংযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বভাবের নিয়মে পালন করিয়া তোলা।’ বঙ্গভঙ্গ, য়ুনিভার্সিটি বিল ও দেশের কথা এই তিনটি সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্য ও আত্মশক্তির কথা বলেছিলেন। তাকেই তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকারে হাজির করলেন স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে।
৩ রা সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। প্রায় চার হাজার ছাত্র খালি পায়ে পতাকা হাতে সমাবেশে যোগদান করে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঘোষণা করা হয়– যদি ১৬ অক্টোবর সত্যি সত্যি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়, তবে সেদিনটিতে সারা দেশে পাদুকা বর্জন ও চাদর বর্জন করার মধ্যে দিয়ে ৩ দিনের শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে।
এই দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে অবস্থান করছিলেন। গিরিডিও তৎকালীন বঙ্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ লাগে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ দেশীয় কোম্পানীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের শেয়ার কেনেন। বাঙালী মালিকাধীন একটি ব্যাংকে টাকা রাখেন।
গিরিডিতে বসে তিনি এক মাসে বাউল সুরে ২১টি স্বদেশী সঙ্গীত লেখেন। তাঁর গান লেখার খবর পেয়ে কোলকাতায় স্বদেশী গান শেখানের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই গানগুলি “খেয়া” কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।[4]
স্বদেশী গানগুলির তালিকা —
১) ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, ২) মা কি তুই পরে দ্বারে পাঠাবি কি তোর ঘরের ছেলে, ৩) এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, ৪) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা, ৫) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে, ৬) যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু, ৭) তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, ৮) সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, ৯) আমি ভয় করব না ভয় করব না, ১০) ওরে তোরা নেই বা কথা বললি, দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী, ১১) ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি, ১২) বুক বেধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই, ১৩) নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে, ১৪) আমরা পথে পথে যাব সারে সারে, তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে, ১৫) আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে,১৬) আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে,১৭) আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার, ১৮) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, ১৯) ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন কাটবে, ২০) আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে, ২১) ওরে ভাই মিথ্যা ভেবো না। হবার যা নয় কোনোমতেই হবেই না সে, হতে দেব না।।
আমার আলোচনার বিষয় বঙ্গভঙ্গের সমকালীন গান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগ রবীন্দ্রনাথের জীবনে উৎসাহের যুগ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন কালের গানে যে বীর রসের উৎসার দেখা যাবে প্রথম যুগের গানেও তার উদাহরণ আছে। উদ্দীপনার জ্বলন্ত শিখা যেন এই গানটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে –
আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে
কে আছ জাগিয়া পুরবে চাহিয়া,
বলো ‘উঠ উঠ‘ সঘনে গভীরনিদ্রামগনে ॥
তিমিররজনী যায় ওই, হাসে উষা নব জ্যোতির্ময়ী—
হেরো নব আনন্দে, নব জীবনে,
ফুল্ল কুসুমে, মধুর পবনে, বিহগকলকূজনে ॥[5]
- গানটির রাগ: হাম্বীর,তাল: তালফেরতা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ) :1299, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1893, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
রাখি বন্ধন কর্মসূচি : গিরিডি থেকে কোলকাতায় এসে ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরী স্বধর্ম সমিতির বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি প্রস্তাব রাখেন –১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হলে সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব। দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজনীতিকরা ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল এর আহ্বান জানায়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে শোভাযাত্রা হলো রাখিবন্ধন উৎসব এর মাধ্যমে। তার সাথে রাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা রাখি–সঙ্গীত গাওয়া হল –
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ—
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা—
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥ [6]
– গানটি ১৩১২(1905) ভাদ্র, ভান্ডার রাখি সংগীত ১–এ প্রকাশ পায়। গানটি একতালে নিবন্ধ। মূলত ঢপ কীর্তন (ঝিঁঝিট) এর সুরের ছোঁয়ায় এই গানটি।
বঙ্কিম চন্দ্র রায়ের ‘বন্দে মাতরম্‘ বাংলার দেশপ্রেম ও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চিন্তা কে প্রভাবিত করেছে। তবে বঙ্কিমচন্দ্র দেশ জননীকে জগত জননী দূর্গা রূপে দেখেছেন, আর রবীন্দ্রনাথ তাকে দেখেছেন স্তন্যদায়িনী অন্নদায়িনী স্নেহদায়িনী রূপে।রবীন্দ্রনাথ উনবিংশ শতকে ও হিন্দু জাতীয়তা দ্বারা লালিত হলেও উদার বিশ্বমানবতার সুর এই সময়েই তার গানে পাওয়া যায়। কবির প্রেম নিজের দেশকে মাথায় করে রাখলেও অন্য দেশের প্রতি তার ঘৃণা ছিলনা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের দেশপ্রেমের সামুদ্রিক কালোচ্ছাসের মধ্যেও বিশ্ব প্রেমের স্বপ্ন দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ –
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥ [7]
–গানটি ১৩১২(1905) সালে আশ্বিন মাসে। ‘বঙ্গদর্শন‘ –এ প্রকাশিত হয়। দাদরা তালের এই গানটি পিলু রাগের উপর সুরারোপিত। রাগ: পিলু–বাউল, স্বরলিপিকার–ইন্দিরা দেবী।
প্রায় সমস্ত গানেই দেশমাতৃকার যথার্থ স্নেহদায়িনী রুপই বর্ণিত হয়েছে। বাংলার বনানীর শীতল স্নিগ্ধতা, শস্যক্ষেত্রের উদার অন্নদান, নয়ন মনোহর সৌন্দর্য প্রভৃতি এই জননীরই স্নেহ। দেশ জননীর কোলে জন্মলাভ করে তার অতুলনীয় আদরণীয় স্নেহ বৈভবে জীবন কাটিয়ে কবি ধন্য। মৃত্যুতেও এই মাটিই কবির কাম্য। বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়ার সার্থকতা কবির পরবর্তী গানে প্রকাশ পেয়েছে–
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে॥
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানীর মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে ॥[8]
–গানটি ১৩১২(1905) সালে আশ্বিন মাসে প্রকাশ পায়। রাগ: ভৈরবী, তাল: একতাল, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ):1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
অপরদিকে দেশমাতৃকাকে ভালবেসে সেই মায়ের কোলে লুটিয়ে যাওয়ার কথাও তাঁর গানে পাওয়া যায়।মাইকেল মধুসূদন দত্ত Albion –এর মোহে স্বদেশকে ভুলে, পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্বদেশে থেকেই স্বদেশী ভাষায় সরলভাবে বলেছেন–
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা!
আমি তোমার চরণ—
মা গো, আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা
কে বলে তোর দরিদ্র ঘর, হৃদয় তোর রতনরাশি—
আমি জানি গো তার মূল্য জানি, পরের আদর কাড়ব না মা ॥[9]
– গানটি ১৩১২(1905) সালে ভাদ্রমাসে ‘ভান্ডার‘ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। রাগ: বাউল, তাল:দাদরা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
এই একনিষ্ঠ দেশপ্রেমকে তিনি সঞ্চারিত করেছেন জনসাধারণের মনে। আপনি আচরি ধর্ম তিনি দেশবাসীকে সচেতন করেছেন। তিনি লিখেছেন সকল বাধাকে তুচ্ছ করে নিজের মনোবলের ওপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়ার গান–
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে ॥[10]
– গানটি ১৩১২(1905) সালে ‘ভান্ডার‘ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। রাগ: বাউল, তাল: দাদরা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312,রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
–এ পথের পথিক কে তাই বলিষ্ঠ হতে হয়, ক্লান্ত হলে চলে না। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক, উৎসাহে তাদের ভাটা পড়ে না। তাই কবিতার গানের মধ্যে দিয়ে বলসঞ্চার করেছেন দেশপ্রেমিকের মনে। অবসন্ন দেশসেবক বল ফিরে পেয়েছে কবিকন্ঠের চারণ গানে–
নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।
যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে।
ওরে মন, হবেই হবে ॥
পাষাণসমান আছে পড়ে, প্রাণ পেয়ে সে উঠবে ওরে,
আছে যারা বোবার মতন তারাও কথা কবেই কবে ॥ [11]
–গানটি ১৩১২(1905) সালে আশ্বিন মাসে প্রকাশিত হয়। রাগ: বিভাস–বাউল, তাল: দাদরা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905,স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
–এই দিনগুলোতে এই উত্তাল সময়ে বাউল সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন “আমার সোনার বাংলা” গানটি। গানটি কোলকাতায় মানুষের মুখে মুখে গীত হয়েছে। আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে।দেশমাতৃকার স্নেহধন্য কবির কাছে আপন দেশের ধূলিকণাও পরদেশের অলংকার এর চেয়ে অধিক বরণীয়। এই বোধ সকলকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে –
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—[12]
–রাগ:বাউল,তাল:দাদরা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক হওয়ার জন্য, যোগ্যতা অর্জন করার পথে বাধা বিস্তর । ঘরের ও বাইরের বাঁধাকে তুচ্ছ করে,সাহস বুকে বেঁধে, উৎসাহ নিয়ে দেশ সেবায় অবতীর্ণ হতে হয় –
ঘরে মুখ মলিন দেখে গলিস নে— ওরে ভাই,
বাইরে মুখ আঁধার দেখে টলিস নে— ওরে ভাই ॥
যা তোমার আছে মনে সাধো তাই পরানপণে,
শুধু তাই দশজনারে বলিস নে— ওরে ভাই ॥[13]
রাগ: বাউল, তাল: অজ্ঞাত, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905।
অথবা,
তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা ব‘লে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফলবে না ॥[14]
–রাগ: বাউল,তাল: দাদরা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312,রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905,স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
উৎসাহের বেগে দিধার বা ভয়ের অবকাশ নেই–
বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই!
শুধু তুই ভেবে ভেবেই হাতের লক্ষ্ণী ঠেলিস নে ভাই ॥
(গীতবিতান, স্বদেশ ৩৩)
– রাগ: বেহাগ, তাল: একতাল, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
কবি আবেদন–নিবেদনের পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি ভিক্ষার রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাম্য ছিলো আত্মবলের জাগরন–
ছি ছি, চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি।
এবার কঠিন হয়ে থাক্-না ওরে, বক্ষোদুয়ার আঁটি–
জোরে বক্ষোদুয়ার আঁটি ॥ … … … ..
দেখলে ও তোর জলের ধারা ঘরে পরে হাসবে যারা
তারা চার দিকে—
তাদের দ্বারেই গিয়ে কান্না জুড়িস, যায় না কি বুক ফাটি,
লাজে যায় না কি বুক ফাটি?।[15]
– রাগ: বাউল, তাল: দাদরা, রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1312, রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1905, স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী।
- উপসংহার :
আন্দোলনটিকে স্বাগত জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ কারণ তিনি মনে করেন, পরের কাছ থেকে সুস্পষ্ট আঘাত পেয়ে পরতন্ত্রতা শিথিল হলে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে উঠবে। ‘আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা আমাদের কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।’ ১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।[16]‘
এই দেশ প্রেম একটা শক্তি, এই শক্তি যখন হৃদয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা পরিণত হয় এক মহাশক্তিতে। এই মহাশক্তি দিয়ে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াই করা যায়–সেই লড়াইটারই সূচনাপর্ব রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন। তাঁর কাম্য ছিল মানুষকে আত্মিক দিক থেকে স্বাধীন করা। আত্মশক্তির জাগরণ ঘটলে বহিরঙ্গ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার দুর্লভ হবে না। পূর্ণ বাঙালিত্বের অনুভবই আত্মার স্বাধীনতার প্রমাণ, কবির ভাষায় –
“বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা—
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন—
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥“[17]
তথ্যসূত্র
[1] https://jrliton77.blogspot.com/2012/08/blog-post_9524.html
[2] https://bangla.bdnews24.com/arts/ arts/প্রবন্ধ/4576
[3] https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/pkbarua/30127087
[4] http://ambedkaractions.blogspot.com/2012/11/blog-post_23.html
[5] গীতবিতান, স্বদেশ ১৯
[6] গীতবিতান, স্বদেশ ২০
[7] গীতবিতান, স্বদেশ ২
[8] গীতবিতান, স্বদেশ ২৪
[9] গীতবিতান, স্বদেশ ২৫
[10] গীতবিতান, স্বদেশ ৩
[11] গীতবিতান, স্বদেশ ৬
[12] গীতবিতান, স্বদেশ ১
[13] গীতবিতান, স্বদেশ ৩১
[14] গীতবিতান, স্বদেশ ৪
[15] গীতবিতান, স্বদেশ ৩০
[16] https://rabindra-rachanabali.nltr.org/print/16046
[17] গীতবিতান, স্বদেশ ২০
গ্রন্থপঞ্জি
১) ওদুদ কাজী আবদুল ,”শাশ্বত বঙ্গ“,ব্রক্ষ্মা, প্রথম প্রকাশ ১৯৫১,দ্য ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া।
২) ঘোষ সম্ভুনাথ : “রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিবৃত্ত” আদিনাথ ব্রাদার্স, কলকাতা ৭৩,৪ ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৩৮০।
৩) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ , “গীতবিতান“, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, মাঘ ১৩৪৮।
৪) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ : “জীবনস্মৃতি” বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা ১৩১৯।
৫) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ : “সংগীত চিন্তা” বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি, প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৭৩,সংস্করণ ২৫ বৈশাখ ১৩৯২।
৬) দত্ত দেবব্রত , “সংগীত তত্ত্ব”, ব্রতী প্রকাশনী, কলকাতা ৭৩।