মানবতন্ত্রের বিকাশে যোগাভ্যাসের ভূমিকা এবং তার ফলস্বরূপ নৃত্যকলার সাবলীলতা বৃদ্ধি
রাহুল দেব মণ্ডল ( সহকারী অধ্যাপক , রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় , নৃত্য বিভাগ )
মানবদেহে তন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম। মানবতন্ত্র মানব শরীরের অভ্যন্তরীন ও বহিঃভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে আর একজন নৃত্যশিল্পীর ক্ষেত্রে শরীরের তন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। মানব শরীরের যে ১১ খানি তন্ত্র আছে, তাদের একে অপরের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
নৃত্যের ক্ষেত্রে আঙ্গিক শুদ্ধতা যেমন দরকার তেমনি ভাবানুগ্ধতাও অপরিসীম, আসলে সঠিক ভাব যদি আঙ্গিক ও ভাব শুদ্ধতা প্রকাশিত না হয় তবে রসের নিষ্পত্তি ঘটে না। তাই প্রতিটি তন্ত্র যথাক্রমে (১) অস্থি তন্ত্র (২) পেশীতন্ত্র (৩) রক্ত প্রবাহ তন্ত্র (৪) শ্বাসতন্ত্র (৫) পাচন তন্ত্র (৬) স্নায়ুতন্ত্র (৭) গ্রন্থিতন্ত্র (৮) রেচন তন্ত্র (৯) জনন তন্ত্র (১০) ত্বক তন্ত্র (১১) সংবহন তন্ত্র এদের প্রতিটির ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন।
অস্থি তন্ত্রও পেশীতন্ত্র সরাসরি আমাদের চলন ও গমনের সাথে যুক্ত। তার আঙ্গিক প্রক্ষেপনকে আরো সুনিবিড় ও দৃঢ় করতে সাহায্যে করে। অন্যদিকে রক্ত প্রবাহ তন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্র আমাদের শরীরের ভারসাম্য বজায় সহ শরীরে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ করে রক্তের প্রবাহকে নির্দিষ্ট হারে নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের দেহ মনের শুদ্ধতা ও শ্ৰমদানের ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে ও শরীরকে আরো দৃঢ় সংবন্ধ করে তোলে । পাচন তন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র আমাদের দেহের বিকাশকে সুনিশ্চিত করে, তার সাথে সাথে মনন বিকাশেও বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। আমাদের স্মৃতি শক্তি সহ প্রকাশমানতাকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে। গ্রন্থিতন্ত্র, রেচন তন্ত্র ও জনন তন্ত্র যা মানব বিকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । আমাদের দৈহিক ও মানসিক যোগ নিষ্পন্ন হয়। আমরা আগেই জেনেছি মানব শরীরের অবস্থান ও তাদের ক্রিয়া সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এক্ষেত্রেও প্রতিটি তন্ত্র যা আলাদা আলাদা চক্রের বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে । একজন নৃত্যে শিল্পী সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে তন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম, আর এই তন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট প্রাণায়াম, আসন ও মুদ্রা (যোগহস্ত) নির্ধারণ করা হল, যার নিয়মিত অভ্যাসের ফলস্বরূপ তন্ত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভভ এবং নৃত্যশিল্পী হিসাবে নিজের শিল্প উৎকর্যকে আরো সমৃদ্ধ করা যাবে।
১) অস্থি তন্ত্র
আসন — চক্রাসন, ধনুরাস, ভূজঙ্গাসন, বিপরীত নৌকাসন, ত্রিকোণাসন প্রভৃতি।
প্রাণায়াম — কপালভাতি, অনুলোম-বিলোম, এছাড়াও সূর্যনমস্কারের ১টি সমষ্টিগত যোগাসন যা অস্থিতন্ত্রকে আরো সুঠাম করে তোলে।
মুদ্রা – বায়ুমুদ্রা, লিঙ্গমুদ্রা।
২) মাংসপেশীতন্ত্র
আসন – ত্রিকোনাসন, বীরভদ্রাসন, সর্বাঙ্গাসন, পশ্চিমোত্তাসন, উস্ট্রাসন, চক্রাসন
প্রাণায়াম – কপালভাতি, অনুলোমবিলোম।
মুদ্রা – প্রানমুদ্রা, অগ্নি ক্রিয়া।
৩) রক্ত প্রবাহতন্ত্র
আসন – হলাসন, চক্রাসন, পশ্চিমোত্তাসন।
প্রাণায়াম – ভস্তিকা, কপালভাতি, অনুলোম-বিলোম।
মুদ্রা – সূর্যমুদ্রা, লিঙ্গমুদ্রা, অপনা বায়ুমুদ্রা।
৪) শ্বসনতন্ত্র
আসন – তির্যক তারাসন, ভূজঙ্গাসন, গোমুখাসন ।
প্রাণায়াম – ভস্তিকা, কপালভাতি, অনুলোম-বিলোম।
মুদ্রা – লিঙ্গমুদ্রা, বিপরীত করণীমুদ্রা।
৫) পাচন তন্ত্র
আসন – যোগ মুদ্রাসন, নৌকাসন, তারাসন, বজ্রাসন, পবনমুক্তাসন।
প্রাণায়াম – কপালভাতি, অনুলোম-বিলোম।
মুদ্রা – সূর্যমুদ্রা, মহামুদ্রা, অহ্নিসারক্রিয়া।
৬) স্নায়ুতন্ত্র
আসন – সর্বাঙ্গাসন, হলাসন, সূর্যনমস্কার, শীর্ষাসন, বকাসন, পর্বতসন।
প্রাণায়াম – অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি, ভ্রামরী।
মুদ্রা – মহামুদ্রা ও যোগ মুদ্রা।
৭) অন্তঃ স্রাবী গ্রন্থিতন্ত্র
আসন – সর্বাঙ্গাসন, হলাসন, শীর্ষাসন, সিংহাসন, অর্ধমৎসেন্দ্রাসন, ধনুরাসন, ভূজঙ্গাসন।
প্রাণায়াম –অনুলোম-বিলোম, ভ্রামরী।
মুদ্রা – জ্ঞান মুদ্রা।
৮) সংবহন তন্ত্র
আসন – মন্ডুকাসন, যোগমুদ্রাসন, সিদ্ধাসন, উৎকটাসন ইত্যাদি।
প্রাণায়াম – কপালভাতি।
মুদ্রা – অপানমুদ্রা।
৯) জনন তন্ত্র
আসন – সর্বাঙ্গাসন, হলাসন, শীর্ষাসন, সিদ্ধাসন, বজ্রাসন, উৎকটাস ইত্যাদি।
প্রাণায়াম – ভ্রামরী, কপালভাতি, অনুলোম-বিলোম।
মুদ্রা – অপনা বায়ু মুদ্রা।
১০) ত্বক তন্ত্র
আসন – বকাসন , কাকাসন জানুশিরাসন প্রভৃতি ।
প্রানায়াম – কপাল্ভাতি , অনুলোম বিলম
১১) রেচন তন্ত্র –
আসন ; ভদ্রাসন , তিত্তিলাসন ,
প্রানায়াম ; কপাল ভাতি
মানবশরীরের বিভিন্ন ক্রিয়া প্রক্রিয়া গুলো যা নৃত্যের ক্ষেত্রে অপরিহার্য তো বটেই সাথে সাথে মনন বিকাশের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে । ভারতীয় সংস্কৃতির এই দুই পারম্পরিক সমৃদ্ধ কলা যা কেবল মাত্র প্রাচীণত্বের নিরিখেই নয় অবয়ব তথা গঠন মূলক প্রেক্ষিতেও একে অপরের সাথে যেমন সম্পর্ক যুক্ত , যোগাভ্যাসের দ্বারা মানব তন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে তা আবার নৃত্যের সাবলীলতা বৃদ্ধিতেও বিশেষ ফলপ্রসূ ও নান্দনিক ভূমিকা পালন করে ।
****************************************************************************************