আমার নৃত্যগুরু পদ্মশ্রী থিংবাইজম বাবু সিংহ
ডঃ সুমিত বসু, অধ্যাপক, সংগীত ভবন
সালটা ছিল ১৯৯১, ডিসেম্বর মাসের খুব ঠান্ডায় পৌছালাম মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল শহরে। অনেক রাত করে চলে এলাম প্রসিদ্ধ নাট্যব্যক্তিত্ব পদ্মশ্রী রতন থিয়ামের বাড়িতে। সঙ্গে একটি চিঠি যেটি লিখে দিয়েছিলেন বিখ্যাত নৃত্য সমালোচক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডঃ সুনীল কোঠারী জী। আমার খুব প্রিয় মানুষ। জহরলাল নেহেরু মনিপুর ডান্স আকাদেমিতে নাচ শিখবো বলে ভর্তি হওয়ার জন্য লিখে দিয়েছিলেন। ওই রাত্রে ওঝা রতন আমাকে ইস্টার্ন স্টার হোটেলে রেখেছিলেন। পরের দিন তাঁর সংগে গেলাম আমার বহু প্রতিক্ষিত জহরলাল নেহেরু মনিপুর ডান্স আকাদেমি। পরিচয় হলো আকাদেমির তৎকালীন ডাইরেক্টর বিখ্যাত মনিপুরী লেখক কে এইচ প্রকাশ সিংহ ও প্রিন্সিপাল গুরু সিংহের সঙ্গে। কিভাবে কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না। যদিও ওনারা হিন্দিতে কথা বলছেন। কিন্তু বাকিরা সবাই শুধু মনিপুরী ভাষা জানেন। আমি বিস্ফারিত চোখে চারিদিকের অসাধারণ সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করছি ধীরে ধীরে। সুনীল কোঠারীর কথা ও আমার রবীন্দ্রভারতীর কথা শুনলেন গুরুজি। আমার নৃত্য দেখলেন। আলাদা এক বিশেষ দিনে সমস্ত বন্ধুদের সামনে আমার নৃত্য প্রদর্শিত হলো। আমাকে প্রথমে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করা হল। ১৯৯১ সালে।
২
এরপর শুরু হলো আমার মনিপুরী নৃত্য জীবনের শুভ আরম্ভ। আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন গুরুজি বাবু সিংহ। আমি ওনাকে বাবার স্থানে রেখেছি। আমাকে উনি বাসু নামে ডাকতেন। বহুদিন পর যেমন বাড়িতে ছেলে ফিরে এলে আতিথেয়তা ও আদর ভালোবাসা পায়, আমিও ঠিক তেমনটাই পেতাম। গুরুজীর কাছে নিজে প্রতিদিন ভোর বেলায় তুলে দিতেন। গুরুজীর স্ত্রী, যাঁকে আমি মা বলে ডাকতাম। তিনি চায়ের গ্লাস দিতে চা খেতে খেতে মনিপুরী নৃত্য জগতের কথা বলতেন। গুরুজি প্রতিদিন শ্রীভাগবত পাঠ করতেন। গুরুজি অনেক গল্প শোনাতেন মনিপুরী রাষ্ট্রের। বিভিন্ন কাহিনীর বর্ণনা তার সঙ্গে নৃত্য ভঙ্গিমা নিয়ে বিশদে আলোচনা করতেন। কত অজানা তথ্য সামনে তুলে ধরতেন। আমায় নিয়ে গৌরাঙ্গ, গৌরাঙ্গ নর্তন এই দুটো নৃত্য নির্মিতি করেছিলেন। গুরুজি গৌরাঙ্গ ভাব নিয়ে কত কথা বলতেন। গৌরাঙ্গ নর্তন নিয়েও কথা বলতেন। অসম্ভব শান্ত ধীর প্রত্যয়ী মানুষ ছিলেন গুরু বাবু সিংহ। মনে পড়ে গৌরাঙ্গ নর্তন এর কম্পোজিশন শেখানোর সময় মুকুলগুলি গেয়ে গেয়ে শোনাতেন। আজও মনে পড়ে-
৩
১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত জে এন মনিপুর ডান্স একাডেমিতে ছাত্র থাকাকালীন আমি প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর গুরুজীর সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি মুখবোলগুলির নৃত্য নির্মিতি আমার জন্য তৈরি করেছিলেন। প্রতিদিনই গুরুজীর কাছে গিয়ে সকালবেলায় মনিপুরী নিত্য শিক্ষা ও ভাষাচর্চা করতাম। রান্নাঘরে একসঙ্গে গুরুজীর সঙ্গে আমি খাওয়া দাওয়া করতাম। গুরুজি বলতেন এই ঙআরী বা শুটকি মাছ তুমি যদি খাও তাহলে মণিপুরী ভাষা টা খুব ভালো করে শিখতে পারবে। নাচও শিখতে পারবে। গুরুজি পূজা করতেন প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধ রাসপঞ্চধ্যায় শ্লোকগুলি পড়তেন। আমাকে গল্পের আকারে খুব সুন্দর করে বোঝাতেন। রাসের গল্প কাহিনী যা বর্ণিত রয়েছে এবং বলতেন, তুমি পুজো করবে প্রতিদিন আমি মণিপুরে পইতে ধারণ করেছিলাম শ্রী গোবিন্দ মন্দিরে গিয়ে। এবং গুরুজীর যে পূজা পদ্ধতি দেখেছিলাম সেটা কিন্তু আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল ।রবিবার ছুটি থাকাতে আমাকে নিয়ে অনেক নাচের কথা আলোচনা করতেন। মনিপুরের প্রাচীন সংস্কৃতির কথাগুলো জানাতেন। তাঁর ছোটবেলায় তিনি যে সমস্ত গুরুদের সান্নিধ্য পেয়েছেন, সেই গুরু কৃপা, সম্বন্ধে আমাকে খুবই যত্ন নিয়ে বলতেন।
৪
যা আমার নৃত্য জীবনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে ও সমৃদ্ধ করেছে। গুরুজি ছিলেন একজন পরম বৈষ্ণব ভাবধারার মানুষ আমিষ খেতেন না। নিরামিষ পছন্দ করতেন। রখুবই সাদামাটা জীবন। প্রতিদিন ভোরে পুং বাজাতেন কাপড় চাপা দিয়ে যাতে শব্দ না হয় ।আর একজন ছিলেন আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মা। আমার গুরুপত্নী। তিনি নিরলসভাবে বাড়ির কাজ করতেন।
বাসু নামে ডাকতেন আমাকে। চা, জলখাবার, দুপুরের ভাত ,খেতে দিতেন। মাতৃস্নেহে কোন কমতি ছিল না। আজ তিনিও চলে গেছেন। মনে পড়ে যখন ওনাদের কথা লিখছি বা ভাবছি কি সব দিন কাটিয়েছি আমি গুরুগৃহে ! আমার মনিপুর প্রবাস কালে যে অভিজ্ঞতা তা স্বর্ণময়। আমার জীবন গড়ে উঠেছে ওই আবহাওয়ায়। একটি সাইকেল নিয়ে আমি গোটা ইম্ফল শহর ঘুরে বেড়িয়েছি, বিভিন্ন সঙ্গীত ও নৃত্য গুরুদের বাড়িতে গেছি।
আমার মনিপুর ডান্স একাডেমির প্রায় প্রত্যেক গুরুর বাড়িতে আমি গেছি। নাচ-গান, নৃত্য ও সঙ্গীতের তত্ত্বকথা, মনিপুরী সংস্কৃতির কথা, জেনেছি। ধুতি-পাঞ্জাবি এবং চন্দনের তিলক মনিপুরের ভাষা ও গুরুদেব কৃপা সঙ্গে শ্রী শ্রী গোবিন্দজির কৃপা আমি পেয়েছি। নিজেকে ধন্য মনে হয় এইসব গুরুদের সান্নিধ্যে আসতে পেরে।
৫
গুরুজি আমাকে দিয়ে দুটি বিখ্যাত নৃত্য নির্মিতি তৈরি করেছিলেন যা হলো গৌরাঙ্গ নর্তন ও গৌরাঙ্গ ভাব। আমার চেহারা ও নৃত্য শৈলীতে উনি বলেছিলেন যে বাসু আমি চাই তুমি এমন নৃত্য করবে যা তোমার দেহের সঙ্গে সকলকে আনন্দ দেবে। তুমি নিজে আনন্দ পাবে এই গৌরাঙ্গ সম্পর্কে তিনি অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল গোষ্ঠলীলার ইতিহাস। সেই নিয়ে গান নাচ আমাকে শিখতে হয়েছে। ১৯৯৪ সালে দু বছরের পিজি ডিপ্লোমা রাস নৃত্য নিয়ে পড়ার সময় প্রাচীন বাংলা ও সংস্কৃত পদ গুলো শিখতে পেরেছিলাম। মনে পড়ে ইমা মাধবী, ওঝা গোপাল, ইমা লেইপাকলোৎপি দেবীর কাছে আমি গিয়েছিলাম। গুরুজি পাঠিয়েছিলেন ভালো করে শেখার জন্য। আমার মণিপুরী ভাষা শেখা গুরুজীর হাত ধরে শুরু হয়। বিভিন্ন সভ্যতার অর্থ খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। মনের ভাব কে কিভাবে ব্যক্ত করতে হবে ব্যাকরণগত ব্যুৎপত্তি যাতে ঠিক থাকে, তার দিকে গভীর দৃষ্টি ছিল। গুরুজী সব সময় ডেকে ডেকে বহু কিছু শিখিয়েছেন যা আমার অজ্ঞাত ছিল। যেমন গুরুর সামনে বসা ,কিভাবে কথা বলা ,কিভাবে সম্মান দেখানো, হয় প্রণাম করা, সহজ সরলভাবে থাকা, দুঃখকে জয় করা,অপমান বাক্যকে পাত্তা না দেওয়া ,শুধু নিজের নির্দিষ্ট কাজ গুলি করে যাওয়া ।গুরুজি আরেকটি আরো একটি দু’টি বিষয়ে আমাকে অবগত করিয়েছিলেন যা হলো
৬
ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক, ও বিবাহ। নিজের ছাত্রীকে বিবাহ করা উচিত না এবং ছাত্রছাত্রীরা পুত্রকন্যা সম ।এই দৃষ্টিতে দেখা উচিত ।আমি আজও এই দুটি বিষয়ে ভাবধারায় নিজেকে ধরে রেখেছি। শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক পদে যুক্ত হবার পর গুরুজীর এই শিক্ষা আমাকে আজও প্রেরণা’ দেয়। বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তাদের সুযোগ করে দেয়ার মানসিকতা গুরুজীর কাছ থেকেই আমার শেখা।
এই প্রসঙ্গে আমার আরেকজন গুরুর কথা বলা প্রয়োজন তিনি হলেন স্বনামধন্য মনিপুরী নৃত্য শিল্পী ও গুরু শ্রীমতি দেবজানি চলিহা।
যিনি মনিপুরে আমাকে অর্থ সাহায্য করেছেন রবীন্দ্রভারতীতে ক্লাস নিয়েছেন। ও আমার মণিপুরী নৃত্যের পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ।তাঁর সান্নিধ্যে আমি দেখেছি অবৈতনিক ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের অন্য ছাত্র ছাত্রীদের সবাই এক ।একত্রিতভাবে মঞ্চ অনুষ্ঠান করছে। এদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই তারা সকলেই মনিপুরী নৃত্য শিক্ষার্থী।
গুরুজীর কাছে আমার নৃত্য জীবন প্রস্ফুটিত হয়েছে। দুইভাবে প্রাক্টিক্যালি আর থিওরিটিক্যাল এইভাবেই আমি গুরুজীর কাছে থেকে ভীষণ রকম ভাবে জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি গুরুজীর সঙ্গে সাইকেল নিয়ে যেতাম যেখানে যেখানে উনি অনুষ্ঠান করতেন। বিবাহের অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ,সম্বৎসর, উৎসব, কর্ণভেদ অনুষ্ঠানetc। ওনার সঙ্গে থাকায় একটা খুব ভালো অভিজ্ঞতা আমার এই মনিপুরী নৃত্য জীবনে কেটেছিল। আমি আমার সাইকেল নিয়ে আসতামউনি কত কথা বলতেন। আমি যতটা শিখেছি, জেনেছি ,মণিপুরী নৃত্যের কথা, জীবন চর্চার মধ্য দিয়ে, তার সবটাই উনার সান্নিধ্যে। কখন আমাকে আলাদা করে দেখেননি। অফুরন্ত স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি। বাবার মত একজন প্রথম প্রদর্শক হিসেবে গুরুজি আমাকে সঠিক দিশা দেখেছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন পদের মানেও বানান জানতে চাইতেন। দেখতেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি কিনা পরীক্ষা উনি নিতেন মাঝে মাঝে নিজের জীবনকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব। ধর্মের সহজ-সরল ভক্তি মার্গে চলার জন্য অনেক কথা বলতেন, উপদেশ দিতেন, পূজাবিধি দেখিয়েছেন আমাকে।
আজ গুরুজীর কথা লিখতে বসে বারবার চোখ জলে ভরে ওঠে। উনিতো শুধু নৃত্যগুরু ছিলেননা। মণিপুরে আমার লোকাল গার্জেন ছিলেন।মনিপুরের বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব পদ্মশ্রী রতন থিয়াম , খ প্রকাশ সিংহ,। মহা রাজকুমারী বিনোদিনী দেবী, পদ্মশ্রী গুরু গৌরকিশোর শর্মা এবং আমার যে মনিপুরি ডান্স একাডেমির সমস্ত গুরুরা সকলেই আমার জীবনে এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রূপে বিরাজ করছেন । মনিপুরি ডান্স
৭
একাডেমির সমস্ত গুরু দের কাছ থেকে যে অখন্ড ভালোবাসা পেয়েছি তা কোনদিন ভুলবার নয়। সেই সঙ্গে যে মনিপুরি ডান্স একাডেমির অফিস স্টাফ এবং প্রোডাকশন ইউনিটের আমার প্রিয় দাদা দিদি আমাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা স্নেহ পেয়েছি যা কোনদিন বলা সম্ভবও নয়। তাদের সকলের প্রতি আমার ভক্তি ও প্রণাম জানাই। তাদের ভালোবাসার শুভেচ্ছায় আজ আমি এখানে এসে পৌঁছেছি পদ্মশ্রীগুরু বাবু সিংহ আমার কাছে একটি বিদ্যালয় কারণ তিনি ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করা নয় মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন। খুব ভালো হিন্দি বলতেন। দীর্ঘদিন বোম্বাইতে কাটিয়েছেন সকলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল। নৃত্যশিল্পী ওপুং শিল্পীদের কোন সীমা নেই। সর্বদা ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এই নৃত্য শৈলী কে কিভাবে দর্শকের কাছে মনোগ্রাহী করা যায় তাই চিন্তা করতেন। বিভিন্ন তাল বোল প্রাচীন গুরুদের তৈরি তাই নিয়েই নির্মিত করেছেন ।আবার নিজেও বিভিন্ন বই এবং নৃত্য তৈরি করেছেন। উনিঅনেক নৃত্য নির্মিতি করেছেন। স্বদেশে বিদেশে উনার মত খুব কমগুরু দেখা যায় যিনি নিজের জীবন মনিপুরী নৃত্য, সঙ্গীত, এর মধ্যে দিয়েছেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি ওনার ছাত্রবাসে রূপে পরিচিত হয়েছি। মনিপুরি ডান্স
৮
একাডেমি আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। গুরুজি আমার জীবনের প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন। তার চরণে আমার শতকোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই।।