ব্রত কথা
দেবাশিস মণ্ডল
ব্রত কথাটির প্রতিজ্ঞা, চর্চা বা সাধনা অর্থে ব্যবহার করা হয়, তবে সাধারণভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে কোনো বিশেষ লোকাচার উদযাপনকেই প্রচলিত অর্থে ব্রত বলা হয় । বাংলায় ঘরে ঘরে অনেক রকমের ব্রত বা সামাজিক অনুষ্ঠানের রীতি বহুকাল ধরে প্রচলিত রয়েছে। ভারতের সর্বত্রই নানা ধরনের ব্রত উদযাপন করা হয়ে থাকে। যদিও সেখানে ব্রত শব্দটি সেভাবে প্রচলিত নয়। বাংলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। তাদের মধ্যেও অনেকে অনেক রকমের রীতিনীতি মা ধর্মাচরণ করে থাকেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও নানা রকমের ধর্মাচরণ লক্ষ্য করা যায়। সেখানে তারা নিজেদের মতো করে নিয়ম পালন করে। কেউ সারাদিন না খেয়ে, রান্না করা খাবার না খেয়ে, ফলমূল খেয়ে, কিংবা শরবত জাতীয় পানীয় খেয়ে সারাদিন ধরে নানা নিয়ম পালন করে ব্রত উদযাপন করে থাকে। বিভিন্ন ব্রত পালনে এক এক রকমের বিধি নিষেধ রয়েছে। কিছু ব্রত আছে যেগুলি ঘরের ভেতরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিছু ব্রত আছে যেগুলি বাড়ির বাইরে, উঠোনে কিংবা পুকুর ঘাটে গিয়ে উদযাপন করা হয়। ব্রত সম্পর্কে বিণয় ঘোষ লিখেছেন, মানুষের কামনার অনুষ্ঠান হল ‘ব্রত। কামনা ছাড়া মানুষ নেই, মানুষ ছাড়া কামনা নেই। বনবাসী নিষ্কাম সন্ন্যাসীরও কামনা আছে, ঐশি শক্তিলাভ ও ঈশ্বর দর্শনের কামনা। এই কামনা পূর্ণ করার জন্য সন্ন্যাসীকেও ব্রত করতে হয় এবং তার সাধনা ও সাধনপদ্ধতি হল তার ব্রত। মানুষই একমাত্র জীব যার কামনা আছে, আর কোনো জীবের কামনা নেই। মানুষের কামনা আছে বলেই সেই কামনা চরিতার্থ করার নানারকম কৌশলের কথা মানুষকে চিন্তা করতে হয়েছে, বিশেষ করে সেই সমস্ত কামনা যা সহজে ইচ্ছামতো পূর্ণ করা যায় না’।[১] প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর যুগ থেকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পারমাণবিক যুগ পর্যন্ত লক্ষাধিক বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাস হল এই কৌশল উদ্ভাবন চিন্তাধারার ইতিহাস। মানব বিজ্ঞানীরা সাধারণত এই চিন্তাধারাকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন। একটি প্রাক্বৈজ্ঞানিক চিন্তা, যাকে ঐন্দ্রজালিক চিন্তা বলা হয়, আর-একটি বৈজ্ঞানিক চিন্তা। সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন বিখ্যাত মানব বিজ্ঞানী মানব চিন্তার রৈখিক ক্ৰমবিকাশ এবং তার এরকম পবিভাগ অযৌক্তিক বলে প্রতিপন্ন করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ অবশ ‘বাংলার ব্রত’ অনুষ্ঠানের পর্যালোচনা করেছেন মানব চিন্তার এই ক্রমাে্ত পর্ববিভাগ মেনে নিয়ে, কিন্তু সে-বিষয় পরে আলােচ্য। বিশ্ময়কর হল ব্রত সম্বন্ধে অবনীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা। যেমন প্রথর তার ইতিহাসবােধ, তেমনি প্রকৃত মানববিজ্ঞানীর মতাে তার সজাগ বিশ্লেষণধর্মী বুদ্ধি ও মন। শিল্পী ও বিজ্ঞানীর আশ্চর্য মিলন হয়েছে তার মধ্যে।
বেশ কিছু ব্রত আছে যেগুলি বহুকাল ধরে চলে আসা ধর্মাচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার বেশ কিছু ব্রত রয়েছে যেগুলি লৌকিক ভাবেই চলে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। পাশাপাশি অবস্থান করতে গিয়ে অনেক আদিবাসী বা অন্যান্য সমাজের কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম নীতি, আচরণ, ব্রত ইত্যাদি আরেক সমাজের মধ্যে প্রবেশ করেছে। কালে কালে তা তাদের নিজেদের ধর্মাচরণের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে কোন অসুবিধা হয়নি।
বিভিন্ন প্রার্থনা ও কামনার সঙ্গে সম্পর্কিত এইসব ব্রত দীর্ঘকাল ধরে লালিত ও পালিত হয়ে আসছে। কখনো শস্য উৎপাদনের কামনায়, কৃষি কাজে বৃষ্টির জলের জন্য ও পানীয় জলের জন্য, প্রচন্ড গরমের সময় পুকুরের জল যাতে না শুকিয়ে যায়, বিভিন্ন মহামারী যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, পারিবারিক ও সামাজিক সুখ সমৃদ্ধি কামনায়, পুত্রের কামনায়, ধন-সম্পদের কামনায়, গবাদিপশুর কামনায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবার জন্য এছাড়াও আরও অনেক রকমের উদ্দেশ্য নিয়ে এই ধরনের ব্রত গলি উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও এরকম নানা ব্রত পালন করা হয়। সূর্য চন্দ্র অগ্নি ইত্যাদি দেবতার কাছে নিজেদের কামনা বাসনার কথা উত্থাপন করা বা পৌঁছে দেওয়াই এসব ব্রতের একটা বড়ো দিক। এর জন্য বিভিন্ন ধরনের কৃচ্ছসাধন, ভক্তি সহকারে নিবেদন, ফলমূল ইত্যাদি নানা ধরনের উপকরণ দিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখার পরিকল্পনা বা আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলি শ্রদ্ধার সাথে বহুকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয়ে আসছে।
কিছু ব্রত আছে যেগুলি প্রায় প্রতি মাসেই পালিত হয়ে থাকে যেমন একাদশী ব্রত, মা লক্ষ্মীর ব্রত, মঙ্গলচন্ডীর ব্রত, শুক্রবারে সংকটার ব্রত, মঙ্গল সংক্রান্তি ব্রত, এয়োঁ সংক্রান্তির ব্রত, মধু সংক্রান্তির ব্রত, নিত্য সিঁদুর ব্রত, সন্ধ্যামণির ব্রত, নখ ছুট এর ব্রত, ষোল কলা ব্রত, মৌনী অমাবস্যা ব্রত, বারোমেসে অমাবস্যা ব্রত ইত্যাদি।
সাধারণভাবে এইসব ব্রত বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা উদযাপন করে থাকে। বেশ কিছু ব্রত রয়েছে যেগুলি কুমারী মেয়েরা উদযাপন করে, কিছু ব্রত উদযাপন করে বিবাহিতা মেয়েরা, আবার বেশ কিছু ব্রত রয়েছে যেখানে মেয়েদের সঙ্গে পুরুষরাও অংশগ্রহণ করে। কুমারী মেয়েদের জন্য যে ব্রতগুলি রয়েছে সেগুলি হল শিবব্রত, পুণ্যিপুকুর ব্রত, দশপুতুল ব্রত, হরির চরণ, অসত্থ পাতা, গোকুল ব্রত, পৃথিবী ব্রত, জম পুকুর ব্রত, কুলকুলোতি ব্রত, সেঁজুতি ব্রত, তুঁস তুসলি ব্রত ইত্যাদি। অনেক ব্রত সধবা মেয়েরা উদ্যাপন করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে এঁয়ো সংক্রান্তি ব্রত, ফল গোছানো ব্রত, গুপ্ত বন, মধু সংক্রান্তি ব্রত, নিত্য সিঁদুর, মধু সংক্রান্তি ব্রত ইত্যাদি। বেশকিছু ব্রত রয়েছে যেগুলি পারিবারিকভাবে উদযাপিত হয় পরিবারের সামগ্রিক মঙ্গলকামনায়। এগুলির মধ্যে রয়েছে ভাদ্র মাসের লক্ষ্মী পুজো পৌষ মাসের লক্ষ্মী পুজো কার্তিক মাসের লক্ষ্মী পূজা কোজাগরী লক্ষ্মী ব্রত ইত্যাদি।
অনেক রকম ষষ্ঠী পূজার প্রচলন রয়েছে যেগুলোকে ষষ্ঠী ব্রত বলা হয়। যেমন অরণ্য ষষ্ঠী, লোটন ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী, মূলা ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী, শীতলা ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠ্ নীল ষষ্ঠী ইত্যাদি। আর রয়েছে বিভিন্ন রকম চন্ডী দেবতার ব্রত। যেমন জয় মঙ্গলচন্ডীর ব্রত, বারোমেসে মঙ্গল চন্ডী, হরিশ মঙ্গল চন্ডী ব্রত, জয় মঙ্গলচন্ডীর ব্রত, সুয়ো দুয়োর ব্রত, সংকট মঙ্গলবার এর সংকট মঙ্গল চন্ডী ব্রত, নাটাইচন্ডী ব্রত ইত্যাদি।
বাংলায় যে ব্রতগুলি উদ্যাপন করা হয় সেই ব্রত উদযাপন এর গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার জন্য নানারকম কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এই কাহিনীগুলির মধ্যে রয়েছে কোন দেবতা দেবী কিভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেন বা তিনি কোন ধরনের উপকার করতে পারেন। কোন একটি দেব বা দেবী সবরকমের সহযোগিতা করতে পারেন না বা করেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বা বিভিন্ন রকম প্রার্থনা বা প্রয়োজনে আলাদাভাবে দেবতার ব্রত উদযাপন করতে হয়। যেমন মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করলে যে ফল পাওয়া যাবে সেটা মনসার ব্রত করলে হবে না। মনসা ব্রথের জন্য যে ফল পাওয়া যায় তা শিবব্রত তে হয় না। এবং প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা উপকার বা সহযোগিতার জন্য পৃথক পৃথক ব্রত উদযাপন করার রীতি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে প্রচলিত রয়েছে। অবশ্য সবাই যে সব রকমের ব্রত উদযাপন করেন এমন নয় তবে নিজের বিশ্বাস এবং প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচারিত বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে সেখানকার নর-নারীরা তাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য বা সমৃদ্ধির জন্য পৃথক পৃথকভাবে ব্রত উদযাপন করেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রত প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন বাংলার প্রচলিত ব্রতগুলির সঙ্গে নেকক্ষেত্রে শাস্ত্রের যোগ রয়েছে। আবার বেশ কিছু ব্রত রয়েছে যেগুলি শাস্ত্র বহির্ভূত। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘আমাদের দেশে দু-রকমের ব্রত চলিত রয়েছে দেখা যায়। কতকগুলি শাস্ত্রীয় ব্রত, আর কতকগুলি শাস্ত্রে যাকে বলেছে যোষিৎপ্রচলিত বা মেয়েলি ব্রত। মেয়েলি ব্রতেরও দুটো ভাগ; একপ্রস্থ ব্রত কুমারী ব্রত-পাঁচ-ছয় থেকে আট-নয় বছরের মেয়েরা এগুলি করে, আর বাকিগুলি নারী ব্রত-বড়ো মেয়েরা বিয়ের পর থেকে এগুলি করতে আরম্ভ করে। এই শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক ব্রত যেগুলি হিন্দুধর্মের সঙ্গে এদেশে প্রচার লাভ করেছে, এবং দুই-থাকে বিভক্ত এই মেয়েলি ব্রত যার অনুষ্ঠানগুলি খঁটিয়ে দেখলে পুরাণেরও পূর্বেকার বলে বোধ হয় এবং যার মধ্যে হিন্দু পূর্ব ও হিন্দু এই দুই ধর্মের একটা ইতিহাস গড়তে পারি, এই দুই প্রস্থ ব্রতের গঠনের ভিন্নতা বেশ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়’।[২]
অবনীন্দ্রনাথ এইসব ব্রতকে যেভাবে ভাগ করেছেন তার রূপরেখা নীচে দেওয়া হল।
ব্রত
মেয়েলি ব্রত শাস্ত্রীয় ব্রত
কুমারী ব্রত এঁয়োতি ব্রত
এঁয়োতি ব্রতর মধ্যে শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গ থাকতে পারে, কিন্তু কুমারী ব্রতর সঙ্গে শাস্ত্রের যোগ সেভাবে লক্ষ করা যায় না। বিভিন্ন বারে যে ব্রত হয় তাকে বার ব্রত বলে। যেমন বৃহস্পতিবারকে লক্ষী বার বলা হয়। প্রতি সপ্তাহে লক্ষীর ব্রত উদ্যাপন করার রীতি অনেকে মেনে চলেন। আছে শিবের ব্রত। প্রতি সোমবার অনেকে শিবের ব্রত করে থাকেন। শনিবার হল বড়ো ঠাকুরের বার। এদিন শনির ব্রত করা হয়। মঙ্গলবারে মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত, বিশেষ করে যে মাসে শেষ দিন মঙ্গলবার সেই বারটি বিশেষ জাঁক-জমকপূর্ণভাবে এই ব্রত করা হয়। এরকম শুক্রবার সন্তোষী মা এর ব্রত। বুধবারেও কিছু ব্রত করার রীতি আছে। একটি ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ‘একটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো যে, প্রত্যেকদিন প্রত্যেক দেবতার পুজো হয় না। এক একটি বিশেষ দিনে এক এক দেবতার পুজো করা হয়। আপনারাও নিশ্চয়ই করেন? জানেন পূরাণ মতে আসলে সপ্তাহের কোন দিন কোন দেবতার পুজো করা উচিত্? রবিবার- রবিবার সূর্য দেবতার দিন। এই দিন সূর্যের পুজো করা হয়। যাঁরা এই দিনে উপবাস করেন, তাঁরা সূর্য ওঠার আগে খাবার খান আর সূর্য অস্ত যাওয়ার পরে খাবার খান। সোমবার- সোমবারের মাহাত্ম আমাদের প্রত্যেকেরই জানা আছে। সোমবার মানেই শিবের বার। অর্থাত্ নির্দিষ্ট এই দিনে ভগবান শিবের পুজো করা হয়। মহাদেবকে তুষ্ট করতে অনেক পূণ্যার্থীই এই দিন উপবাস করে থাকেন। অবিবাহিত মেয়েরা বিশেষ করে এই দিন উপবাস করে ব্রত করেন, ভগবান শিবের মতো স্বামী পাওয়ার জন্য। মঙ্গলবার- মঙ্গলবার কোনও একজন দেবতার নয়, বেশ কয়েকজন দেবতার পুজো করা হয়। এই দিন সিদ্ধিদাতা গনেশ, মা কালী এবং ভগবান হনুমানের পুজো করা হয়। যাঁরা এই দিন ব্রত করেন, তাঁরা খাবারে নুন দেন না। নুন ছাড়া খাবার খান। বুধবার- এই দিনে ভগবান ভিথালের পুজো করা হয়। এই দেবতা ভগবান বিষ্ণুর আর এক রূপ। এই দিন অনেকেই নতুন কাজ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার- বৃহস্পতিবার মানেই লক্ষ্মীবার। এই দিন মা লক্ষ্মীর পুজো করা হয়। ধন সম্পত্তি, অর্থ, প্রতিপত্তি, কারবারে শ্রী বৃদ্ধির জন্য বৃহস্পতিবারে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা শুরু করেন।
শুক্রবার- মঙ্গলবারের মতো শুক্রবারেও একাধিক দেবতার পুজো করা হয়। এই দিন দেবী মহালক্ষ্মী, মা সন্তোষী, মা দুর্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণার পুজো করা হয়’। [৩] এখানে বাংলার বাইরের বিভিন্ন জায়গার পুজোর কথা বলা হয়েছে। আর পুজো ও ব্রতর মধ্যে একটা পার্থক্যও রয়েছে। পুজো করা হয় একেবারে শাস্ত্র মেনে। তার জন্য নিয়মাবলী ও নির্ঘণ্ট নির্দিষ্ট। কিন্তু ব্রতে তা হয় না। মন্ত্র সব নিজেদের মতো। ছড়ায়, গানে, গল্পে। বাড়ির বা আশ-পাশের নানা সহজ লভ্য উপকরণ দিয়েই নৈবেদ্য সাজানো হয়। বিভিন্ন পক্ষেও কিছু ব্রত আছে যেমন একাদশী, ষষ্ঠী, নবমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা তিথি পালন এত্যাদি।
মাসের ব্রত চলে সারা মাস ধরে। বৈশাখ মাসে পূণ্যিপুকুর ব্রত। ‘পুণ্যিপুকুর ব্রত বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি কুমারীব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষদিন (সংক্রান্তি) পর্যন্ত একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। ব্রতের উদ্দেশ্য হল বৈশাখ মাসের খরায় যাতে পুকুর জলশূন্য না হয় অথবা গ্রীষ্মঋতুতে যেন গাছ না মরে এবং ফসল যেন ভাল হয়। ব্রতের ছড়ায় প্রকৃতির মঙ্গল কামনা ছাড়াও কুমারী নারীর সৌভাগ্য ও সন্তানলাভের কামনা পরিস্ফুট। [৪] এছাড়াও পৃথিবীর মঙ্গল কামনায় পৃথিবী ব্রত উদ্যাপন করা হয়। ‘পৃথিবী ব্রত বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি ব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা বৈশাখ মাস ধরে একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। এটি চার বছর পরপর পালন করতে হয়। ব্রতের উদ্দেশ্য হল সাংসারিক অমঙ্গল দূরীকরণ’।[৫] এইসব ব্রত উদ্যাপনের সুফল সম্পর্কে নানা ধরণের লোক কাহিনী বা লোক কথা প্রচলিত রয়েছে। এইসব কাহিনীর মধ্যেই কীভাবে ব্রত উদ্যাপন করা হবে তার নিয়মাবলী উল্লেখ করা আছে। শেষে বলা হয়, যে ব্রত উদ্যাপন করে, যে ব্রত উদ্যাপনের মাহাত্ম বর্ণনা করে ও যে বা যারা এই কাহিনী শোনে তারা সবাই একই রকম ফল পায়। অর্থাত এই কাহিনীর মধ্যেই ব্রতর নিয়ম ও প্রচারের সমস্ত ব্যবস্থা থাকে। এমনকী লক্ষ্মীর পাঁচালী বা অন্য ব্রতর পাঁচালী যেগুলি পদ্যে রচিত সেখানেও এরকম দেখা যায়। যেমন আমরা এরকম দেখি মহাভারতেও ‘কাশিরাম দাস কহে শুনে পূণ্যবান’।
১। http://www.mediafire.com/file/nsfjc328k4h6x2n/অবনীন্দ্রনাথ-বিনয়+ঘোষ.pdf/file
২। http://www.abanindranath.org/247624942434248224942480-2476250924802468.html
৪। চক্রবর্তী, ড. বরুণকুমার সম্পাদিত (১৯৯৫)। বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ। কলকাতা: অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স। পৃষ্ঠা ২৪৩–২৪৪। আইএসবিএন 81-86036-13-X। https://bn.wikipedia.org/wiki/পুণ্যিপুকুর_ব্রত
৫। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ২৩৫ https://bn.wikipedia.org/wiki/wiki/পৃথিবী_ব্রত