রাঢ় বঙ্গের গান : বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য
ড: সোমা দাস মণ্ডল, অধ্যাপিকা, অ্যাডামস বিশ্ববিদ্যালয়
রাঢ় বঙ্গের বৈচিত্র্যময় সংগীত ও লােক সাংস্কৃতিক অজস্র উপকরণ রয়েছে। যা রাঢ় অঞ্চলের গ্রাম বাংলার জনপদগুলিতে ছড়িয়ে আছে। বিহার, ঝাড়গ্রাম ও ওড়িষ্যার সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাঢ় বঙ্গের বিভিন্ন আদিবাসী জনগােষ্ঠীর বাস। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও ক্রমে তা সাধারণ লােকসংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। রাঢ় অঞ্চলের লােকসংস্কৃতিকে জানা ও বােঝার জন্য রাঢ় অঞ্চলের রুক্ষতা, জনজাতি, প্রাকৃতিক ও ভৌগােলিক অবস্থান ইত্যাদি জানা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
রাঢ়বঙ্গের লােকসংস্কৃতির যে বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপরীতির অস্তিত্ব আমরা পেয়ে থাকি, তা গড়ে ওঠার পেছনে কয়েকটি বিশেষ কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যার মধ্যে ‘বঙ্গ’ শব্দ যুক্ত হয়ে রাঢ়বঙ্গ পরিভাষার উৎপন্ন। এস্থলে পৃথকভাবে বঙ্গের কিছু আলােচনার প্রয়ােজন আছে বলে আমার মনে হয়। রাঢ় অঞ্চলের লােকসংস্কৃতিকে জানা বা বােঝার জন্য রাঢ় অঞ্চলের রুক্ষতা, জনজাতি, প্রাকৃতিক ও ভৌগােলিক অবস্থান ইত্যাদি জানা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
রাঢ় ও বঙ্গের পরিচয়
রাঢ় অঞ্চলের যে সংস্কৃতির পরিচয় আমরা প্রাচীনকালে পেয়ে থাকি তা পরবর্তীকালে অনেক বিবর্তিত হয়েছে ঐতিহ্যপূর্ণ বঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আর্তিকরণের দ্বারা বর্তমান রাঢ়বঙ্গের এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। সুতরাং বিবর্তনের বিভিন্ন সময়গুলি আলােচনা করলে রাঢ়বঙ্গ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় অর্থাৎ পৃথকভাবে বঙ্গ ও রাঢ়ের ঐতিহাসিক ও ভৌগােলিক ব্যাখ্যা বা আলােচনার প্রয়ােজন আছে বলে মনে করেছি। পাকিস্থান ভারত থেকে পৃথক রাজ্যে পরিণত হওয়ার পূর্বে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের যে প্রদেশকে বঙ্গদেশ (বাংলাদেশ, Bengal বলা হত।[১] তার মাত্র এক অংশ প্রাচীনকালে বঙ্গ নামে অভিহিত হত। সাধারণভাবে বলতে গেলে গঙ্গানদীর পশ্চিমের ও দক্ষিণের অংশ রাঢ় ও অবিভক্ত বঙ্গদেশের উত্তর ভাগের নাম ছিল পুন্ড্র, বরেন্দ্র ও গৌড়। পূর্ব অংশে সমতট, হরিকেল ও বঙ্গ ও বঙ্গাল প্রভৃতি নানা দেশের নাম পাওয়া যায়—সম্ভবত বিভিন্ন সময়ে এই সমুদয় নাম প্রচলিত ছিল ও এদের বিভিন্ন সীমানা ছিল। সম্ভবত গৌড় এই নামটি হিন্দু যুগের কোন সময়ে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ এবং কখনও সমগ্র বঙ্গদেশকে বুঝাত। মুসলমান যুগে ‘বঙ্গাল’ নামটির বিকৃত রূপ ‘বাঙ্গালা সমগ্র দেশের নামে পরিণত হয় [২] এবং ইহা হইতেই বাংলা, Bengala (পর্তুগীজ), Bengal (ইংরেজি) প্রভৃতি নামের উৎপত্তি হয়েছে। বঙ্গদেশ’ এই নামও সমগ্র দেশের সংজ্ঞারূপে গৃহীত হয়েছে।[৩]ঐতরেয় অরণ্যকে সর্বপ্রথম বঙ্গ একটি জাতি ও দেশের নামরূপে ব্যবহৃত হয়েছে অনেকে এইরূপ মনে করেন। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতির বাইরে অবস্থিত বঙ্গদেশের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবি মধুসূদন দত্ত এই অর্থে গৌড়’ নাম ব্যবহার করেছেন।[৪] বর্তমানে সমগ্র বঙ্গ সম্বন্ধেই আলােচনা করা হবে। বহুপ্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগেও যে বাংলার মানুষের বসতি ছিল প্রত্নপ্রস্তর নব্যপ্রস্তর এবং তাম্ৰযুগের অস্ত্রশস্ত্র হতে তা জানা যায়।[৫] সম্ভবত কোল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডােম, চণ্ডাল প্রভৃতি জাতির পূর্ব পুরুষেরাই ছিল বাংলার আদিম অধিবাসী। ইহাদের সাধারণত সংজ্ঞা নিষাদ জাতি। এরা প্রধানত কৃষিকার্য দ্বারা জীবন ধারণ করত ও গ্রামে বাস করত। আরাে কয়েকটি জাতি বঙ্গদেশে বাস করত পরে অপেক্ষাকৃত উন্নততর সভ্যতার অধিকারী এক শ্রেণীর লােক বাংলাদেশে বাস করে।
এদের সাথে আরাে পরবর্তীকালে আর্যদের মিশ্রণের ফলেই বর্তমান বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে। বীরভূম ও বর্ধমান জেলার অজয়, কুনুর ও কোপাই নদীর তীরের অনেক স্থানে ভূগর্ভ থেকে বাংলার প্রাচীন সভ্যতার যে সমুদয় নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা যে বােধায়ন ধর্মসূত্র রচনার বহু পূর্বে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি খ্রিস্ট জন্মের প্রায় দেড় হাজার বৎসর আগেই বিদ্যমান ছিল।[৬] কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। ‘মনুসংহিতা’রচনাকালে (২০০ খ্রিস্টপূর্ব হইতে ২০০ খ্রিস্টাব্দের) বঙ্গদেশ আর্যাবতের অন্তর্ভুক্ত বলা হত। মহাভারতে বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত তীর্থের নাম আছে এবং রামায়ণেও বঙ্গদেশ সমৃদ্ধ জনপদ বলে বর্ণিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বেই যে আর্যগণের সহিত মিশ্রণের ফলে আর্যগণের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক রীতি ও সভ্যতার অন্যান্য অঙ্গ বঙ্গদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বে বঙ্গদেশের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। মহাভারতে বঙ্গদেশের কয়েকটি রাজ্যের ও রাজার উল্লেখ আছে—কিন্তু ইহাদের বিশেষ কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে যখন গ্রীক বীর আলােকসান্দর ভারতের পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ জয় করেন,[৭] তখন গঙ্গা রিদাই জাতি এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিল। অধিকাংশ গ্রীক লেখকের মতে এই জাতি ভাগিরথী ও মধ্যবর্তী ভূভাগে বাস করিত এবং পশ্চিমদিকের বিহার রাজ্যও তাহাদের অধীনে ছিল। সুতরাং ইহা মনে করা অসঙ্গত হইবে না যে আলেকসান্দরের সময় বাংলার রাজা প্রথমে মগধ দেশ জয় করেন এবং পরে পাঞ্জাবের সীমান্ত পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। বাংলার এই সাম্রাজ্যই ঐতিহাসিক যুগে ভারতের প্রথম সাম্রাজ্য খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে বঙ্গ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বঙ্গদেশ স্বাধীন হয়। [৮]ইহার অনতিকাল পরে বঙ্গদেশের ইতিহাস পাল, সেন প্রভৃতি রাজবংশের প্রসঙ্গে বিবৃত হয়েছে। ত্রয়ােদশ শতকের প্রথমে মুসলমানেরা বঙ্গদেশ জয় করেন। পরবর্তী তিনশ বৎসর মাঝে মাঝে দিল্লী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজ ক্রমে ক্রমে এই দেশে স্বীয় অধিকার পরিবর্তন করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ ইংরেজের অধীনতা হতে মুক্ত হয় এবং বঙ্গদেশ স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজ্যে পরিণত হয়।[৯] ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গদেশ ভাগ হয়ে দুটি দেশ হয়েছে। একটি বাংলাদেশ অন্যটি ভারতের অন্তর্গত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। বাংলাদেশকে অবশ্য অনেকে পূর্ববঙ্গ বলে থাকে।[১০] অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে দেখা গেছে যে রাজনৈতিক কারণে ও শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্য বারবার বাংলার বিভিন্ন অংশ ভারতের অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এইভাবে অতীত ইতিহাসের বিবর্তিত ধারায় আজকের বাংলাদেশের পূর্বনাম ও বনাম হল গৌড়বঙ্গ, বঙ্গালদেশ, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ প্রভৃতি।[১১] আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আবুল ফজল বলেছেন যে, এই দেশের প্রাচীন নাম ছিল বঙ্গ। প্রাচীনকালে রাজারা নিজে রাজ্যসীমায় আল দিতেন। যে আল দশ গজ উঁচু এবং বিশ গজের মত চওড়া হত। সেই হিসেবে বঙ্গদেশের যে আল, তাকে বঙ্গের আল বলা হয়। যথা বঙ্গ + আল।[১২] এই শব্দই পরবর্তীকালে ‘বঙ্গ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে করে অনেকে। প্রাচীন অনেক গ্রন্থ ও লিপিতে বঙ্গ ও বঙ্গাল দুটি পৃথক দেশ একত্রীকরণেও বাংলা শব্দের উৎপত্তি হতে পারে। আদিম উপনিবেশ স্থাপনকারী একটি উপজাতির নাম ছিল মু-অঙ। আর্য ভাষায় এই ‘ঙ’ শব্দ থেকেই বঙ্গদেশের উৎস। হিন্দুযুগে অর্থাৎ মুঘলযুগের আগের সময় বাংলার নাম ছিল গৌড়। পরিবর্তনের বা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বঙ্গ বা বাংলা হয়েছে।[১৩] তবে মূল দুটি ভাগ যা ছিল বঙ্গ ও বঙ্গাল, উত্তরকালে তাই পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং বর্তমানকালে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বলা যেতে পারে, পূর্ববাংলা বাংলাদেশ এবং উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম অংশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। প্রাচীন বঙ্গদেশে রাজনৈতিক ও ভৌগােলিক সীমানার ভিত্তিতে যে জনপদগুলির অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়, সেগুলি হল গৌড় বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গাল, পুণ্ড্র, বরেন্দ্রী, দক্ষিণ রাঢ়া, উত্তর রাঢ়া এবং তাম্রলিপ্ত। ভবিষ্য পুরাণ থেকে যে তথ্যটি পাওয়া যায় তা হল, পুণ্ড দেশের সাতটি বিভাগ। এই সাতটি বিভাগের মধ্যে ছিল গৌড়, বরেন্দ্র নীবিতি (রংপুর), সূক্ষ্মদেশ (রাঢ়), ঝাড়খণ্ডী বর্ধমান সুতরাং এখানে সূক্ষ্মদেশ বলতে রাঢ়কে বােঝান হয়েছে,[১৪] যা পুণ্ড্র দেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে একটি। আবার বরাহ মিহিরের সংহিতায় কিন্তু রাঢ় জনপদকে গৌড় থেকে স্বতন্ত্র করে দেখান হয়নি। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে রাঢ় আর গৌড় এর জনপদ কি এক ছিল ? তবে মধ্যযুগে পূর্ববঙ্গকে বঙ্গ ও পশ্চিমকে গৌড় বলা হত। এই তথ্য মুসলিম ঐতিহাসিক বিবরণে পাওয়া যায়। সেই কারণে সমগ্র বাংলা দেশকে বােঝাতে গৌড়বঙ্গ নামটি প্রচলিত ছিল। কৃষ্ণ মিশ্রের প্রবােধ চন্দ্রোদয়তে বলা হয়েছে যে রাঢ়া এবং ভুরি শ্রেষ্ঠিক গৌড় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, বঙ্গের সীমানা যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হােক, রাঢ় অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল, তা প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্যণীয়। ফলে রাঢ় অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা মনে করা যেতে পারে সুতরাং বর্তমান কালের মানচিত্রকে প্রাধান্য দিতে আদিবঙ্গের পশ্চিম অংশেই রাঢ়বঙ্গের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আবার কৃষ্ণ মিশ্রের প্রবােধ চন্দ্রোদয়তে বলা হয়েছে যে, রাঢ়া এবং ভুরি শ্রেষ্ঠিক গৌড় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রূপশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের গৌড় ঐতিহাসিক ভূগােল (প্রাক মধ্যযুগ) এ বলেছেন প্রাচীন বঙ্গদেশের রাজনৈতিক ও ভৌগােলিক সীমানা ভিত্তিতে যে জনপদগুলির অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায় সেগুলি হল গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গজিৎ, পুণ্ড, বরেন্দ্রী, দক্ষিণ রাঢ়া, উত্তর রাঢ় এবং তাম্রলিপ্ত। ভবিষ্যপুরাণে পুরাণ যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুণ্ড্র দেশের সাতটি বিভাগ ছিল। এই সাতটি বিভাগের মধ্যে ছিল গৌড়, বরেন্দ্রী, নীবিতি (রংপুর), সূক্ষ্মদেশ (রাঢ়) ঝাড়খণ্ডী, বর্ধমান। সুতরাং এখানে সূক্ষ্মদেশ বলতে রাঢ়কে বােঝানাে হয়েছে।[১৫] যা পুষ্প্রদেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে একটি। আবার ব্রাহ মিহিরের সংহিতায় কিন্তু রাঢ় জনপদকে গৌড় থেকে স্বতন্ত্র করে দেখান হয়নি। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে রাঢ় আর গৌড় এর জনপদ কি একই ছিল? তবে মধ্যযুগে পূর্ববঙ্গকে বঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে গৌড় বলা হত। এই তথ্য মুসলিম ঐতিহাসিক বিবরণে পাওয়া যায়। সেই কারণে সমগ্র বাংলাদেশকে বােঝাতে গৌড়বঙ্গ নামটি প্রচলিত ছিল। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, বঙ্গের ভৌগােলিক সীমানা যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হােক, রাঢ় অঞ্চলের সে একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল, তা প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্যণীয়। ফলে রাঢ় অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তা মনে করা যেতে পারে।
রাঢ়বঙ্গের জনপদ ও সংস্কৃতি
ভারতীয় বহু ভাষাতেই রাঢ় শব্দটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। অর্থগত দিক দিয়ে বিভিন্নতাও লক্ষ্যণীয়। সংস্কৃত অভিধানে রাঢ় শব্দের অর্থ হল সৌন্দর্য, বৈভব। সাঁওতালি ভাষায় ‘রাঢ়ো’ শব্দের অর্থ হল নদী গর্ভস্থ শৈলমালা বা পাথুরে জমি।[১৬] সাঁওতালি বা দেশী শব্দ হতে সম্ভবত রাঢ় শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কোল ভাষায় রৌড় শব্দের অর্থ পাথর বা পাথরের নুড়ি এবং ‘রৌড়দিশম’ বলতে রাঢ় দেশ বা পাথরে রূঢ়-রুক্ষ্ম মাটির দেশ।”[১৭] আবার ‘রৌড়হাসা’ শব্দের অর্থ পাথুরে মাটি। অনেকে অনুমান করেন যে, রৌড় শব্দ হতে ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় রঢ়া বা লড়া শব্দের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে আরও পরে লাঢ় বা রাঢ় শব্দটি এসেছে। সুকুমার সেন রাঢ় প্রসঙ্গে এক জায়গায় বলেছেন, ‘রাঢ়া’ শব্দের উদ্ভব ‘রাজ’ ধাতু থেকে। ‘রাঢ় শব্দটির এক অর্থ ছিল রক্তমৃত্তিকার দেশ এবং সে দেশের অধিবাসী। আর এক অর্থ ছিল দুর্ধর্ষ। এই দুই অর্থই খাটে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, বীরভূম, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার লাল মাটির ভূখণ্ডকে ‘রাঢ়’ নামে অভিহিত করা হত। আবার এই অনুমানও করা যেতে পারে যে, এই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ জাতি আদি অস্ত্রাল কিংবা তাদেরই শাখাভুক্ত নানা গােষ্ঠীর লােকেরা রাজ্য ও রাজত্ব কায়েম করতে পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহে এত বেশি লিপ্ত থাকত যে মাটিতে রক্তের দাগ শুকোবার সময় পেত । যুদ্ধবাজ অধিবাসীদের এই ভূখণ্ডকে তাই রক্তমৃত্তিকার দেশ ‘রাঢ়’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আবার একই ভাষাতেই ‘রাঢ়’অর্থ সুর—‘লাড়’(ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তন সঞ্জাত র > ল, ল > র) অর্থ সাপ।[১৮] সেইজন্য অনেকের ধারণা ‘লাড়’ শব্দটি মূলত অস্ট্রিক। রাঢ়’ অর্থ নীচ। মারাঠিতেও তাই Rangh, Savage মৈথিলি ভাষায় শব্দটির অর্থ নিন্ন জাতীয় লােক। একসময় শূদ্রদেরই রাঢ় হিসেবে চিহ্নিত করা হত। বিশ্বকোষে, রাঢ় শব্দ, সংস্কৃত মূল নহে। ইহা খাঁটি দেশী শব্দ। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রাঢ় শব্দটি বারেবারেই ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। সেখানে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে দুটি অর্থে জাতি অর্থে ও দেশ অর্থে। চৈতন্য ভাগবত-এ রাঢ়ের উল্লেখ আছে।
কবি বৃন্দাবন দাস তার এই বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেছেন—‘ধন্য রাঢ়দেশ। ষােড়শ শতকের বিখ্যাত কবি মুকুন্দ নীচ বা নিন্দা অর্থে ‘রাঢ়’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘অতি নীচ কূল জন্ম জাতিতে চোয়াড়। কেহ না পরশ করে লােকে বলে রাঢ়। এবং জাতি অর্থেও তিনি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কালকেতুকে তিনি ব্যাধ হিংসকরাঢ়’ বলে পরিচিত করেছিলেন। অভিধান-প্রণেতা জ্ঞানেন্দ্র মােহন দাস ‘রাঢ় শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন—[রাষ্ট্র > রাট–রাড় বর্তমান বিভাগ, রাঢ়। পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ধারার ঐতিহ্য পর্যালােচনার দ্বারা পৃথকভাবে রাঢ়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কিত বিশেষ কোনাে গবেষণা কার্য হয়নি। তাই অতীতে রাঢ়-বরেন্দ্র-বঙ্গ জনপদের ভৌগােলিক অস্তিত্ব থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাঢ় সংস্কৃতি বঙ্গ সংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে গেছে। প্রাচীন ঐতিহাসিক পর্বে রাঢ় ও বঙ্গ পৃথক জনপদ রূপে আখ্যা লাভ করলেও মােটামুটিভাবে বলা যায় যে, চতুর্দশ শতক হতে গৌড়, রাঢ়, পুণ্ডু, বরেন্দ্র, সমতট, বঙ্গ, বঙ্গাল, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি পৃথক পৃথক অঞ্চলসমূহের একত্রীকরণের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বঙ্গদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু প্রচলিত বাংলা উপভাষা ও সমাজ বিন্যাসের ক্ষেত্রে আজও বঙ্গ, রাঢ় ও বরেন্দ্রভূমিক পৃথক অস্তিত্ব বজায় আছে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের অধিকাংশ ভূভাগ প্রাচীন রাঢ়ভূমির অন্তর্গত ছিল। ঐতিহাসিক ও ভৌগােলিক কারণে রাঢ় জনপদের সীমা প্রসারিত আবার কখনাে সঙ্কুচিত হয়েছে এবং প্রসারিত সীমা সাংস্কৃতিক আলােচনার ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। রাঢ়’ শব্দটি মূলত অস্ট্রো এশিয়াটিক কোল গােষ্ঠীর ব্যবহৃত দেশনাম।
পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর পশ্চিমদিকে সূক্ষ্ম ও রাঢ়া জনপদ অবস্থিত ছিল। রাঢ় জনপদের অধিবাসীরা রাঢ়া বা রাঢ়াবাসী বা রাঢ়ী নামে পরিচিত ছিল এবং সূক্ষ্ম জনপদের অধিবাসীদের সূক্ষ্মই বলা হত। এককথায় বলা যায় সূক্ষ্ম ও রাঢ় একই দেশ। পূর্বে কোন সময়ে সূক্ষ্ম ও রাঢ় দুইটি ভাগে বিভক্ত ছিল। সূক্ষ্ম জাতিরা অনার্য গােষ্ঠীভুক্ত বঙ্গদেশেরই অধিবাসী ছিল। গঙ্গা-রাঢ়ী বা গঙ্গা রাষ্ট্র, রাঢ়ী বরেন্দ্রী ইত্যাদি জনপদের ব্যাখ্যা নিরীক্ষে বলা যায়, রাঢ় দেশ বঙ্গের পশ্চিমাংশ এবং সূক্ষ্ম দেশই রাঢ়দেশ। সূক্ষভূমি বা সূক্ষ্মদেশ রাঢ়বঙ্গের দক্ষিণাংশ। জনগ্রন্থ আচার অঙ্গ = “সূত্র থেকে জানা যায় রাঢ়বাসীরা ছিল অরণ্যবাসী বর্বর ও অসভ্য। রাঢ় দেশের বিভিন্ন নাম আমরা শুনে থাকি। যেমন লাঢ়, লড়, লাল, রাল, রাঢ়া, রারা, রর প্রভৃতি। বলাবাহুল্য ভূমিজ, লােধা, সাঁওতাল প্রভৃতি প্রাচীন উপজাতি গােষ্ঠী প্রাচীন রাঢ়াবাসী। মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল হতে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এক বিস্তৃত ভূখণ্ডে বসবাসকারী মুণ্ডা, সাঁওতাল হাে, ওরাওঁ, লােহার, মালপাহাড়িয়া, কেওট, ভূমিজ প্রভৃতি উপজাতীয়গণ কোল গােষ্ঠীর বংশধর। ভূ-ভাগে পাথরের অংশ অধিক হওয়ার জন্য কোল ভাষাভাষী গােষ্ঠীর নিকট বসবাসের স্থানটি রৌড়দিশম নামে পরিচিত ছিল এবং পরিবর্তিত রূপ হল রাল বা লাল। রিজাল মন্তব্য করেন, ভূমিজ প্রভৃতি রাঢ়বাসীরা হিন্দু রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানে ক্রমশ প্রভাবিত হয়ে এক সময় হিন্দু গােষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়ে। হিন্দুদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হতে থাকে, ততই তারা পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকে। বহুবিধ অধিবাসী, ভাষাভাষী গােষ্ঠী ও জাতি সংমিশ্রণের ফলে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারেনি। ক্রমে বাঙালি জনগােষ্ঠী গঠনে তারা নিজেদেরকে বিলীন করে দিয়েছিল এবং বাঙালি বা বাংলার রীতিনীতির সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার ফলে রাঢ় বাংলা হিসেবে একটি স্বতন্ত্র ভূভাগ গঠিত হল। ভাষার দিক দিকে বিচার করলে ভূমিজ প্রভৃতি সম্প্রদায়কে মুণ্ডা ভাষাভাষী বলে অবহিত করা যায়। মুণ্ডা গােষ্ঠী আবার অস্ট্র-এশিয়াটিক অর্থাৎ অস্ট্রিক ভাষাভাষী রাঢ় দেশের বিশেষ করে মেদিনীপুর জেলার আরেকটি আদিবাসীদের কথা আমরা জানতে পারি, যাদের বলা হত চুয়ার কিম্বা চোয়ার জঙ্গল মহলে লােধা সম্প্রদায়ের লােকেদের চুয়ার বা চোয়ার বলা হত। প্রকৃতপক্ষে চুয়ার ভূমিজদের উপাধি। কিন্তু বাংলা ভাষায় চুয়ার বা চোয়ার বলতে আমরা দস্যু লম্পট বা চণ্ডাল বুঝি। বলাবাহুল্য যুগের নানা বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই রাঢ় বাংলার আদিবাসীরা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বা অন্যান্য জাতির রীতিনীতি সঙ্গে নিজেদের ক্রমাগত যুক্ত করে এক নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছিল। যা বর্তমানে আমরা রাঢ় বাংলায় লক্ষ্য করে থাকি। বিভিন্ন সংস্কৃত্ব তথা সংগীতের ক্ষেত্রেও রাঢ় বাংলার স্বতন্ত্ররূপ লক্ষ্য করা যায়। এখন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নিম্নবর্গের কথ্য ভাষায় ‘র’ স্থলে ‘ল’, ‘ল’ স্থলে ‘র’, ‘র’ ‘অ’, ‘ন’ স্থলে ‘ল’ উচ্চারণবিধি প্রচলিত আছে।২৩ পাথরের ন্যায় শক্ত বা কর্কশ ভূভাগে বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলী, সিংভূম, মানভূমি, হাজারিবাগ, ধানবাদ, সাঁওতাল পরগণা সহ ভাগলপুর, রাঁচী ও পালামৌ জেলার কিয়দংশ নিয়ে বৃহৎ রাঢ় জনপদ গড়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. নীহাররঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস, পৃঃ ৩৯
২. তদেব, পৃঃ ৩৭ -৩৯
৪.ভারত কোষ (পঞ্চম খণ্ড), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, পৃঃ ৪, ৫
৫.ভারতকোষ (পঞ্চম খণ্ড), পৃঃ ৯
৬.নীহাররঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস, পৃঃ ৪১
৭. সুকুমার সেন বাঙালীর ইতিহাস, পৃঃ ৪১ শ্ৰী জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী আর্যা সপ্তশতী ও গৌড়বঙ্গ, কলিকাতা, পৃঃ ৫১
৮. অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌরাণিক (প্রথম খণ্ড) কলিকাতা, পৃঃ ৩৮
৯. নীহাররঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস, পৃঃ ৪১
১০. তদেব, পৃঃ ৪২
১১. শ্ৰী জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী আর্যা সপ্তশতী ও গৌড়বঙ্গ, কলিকাতা, পৃঃ ৫৩
১২.ভারতকোষ (পঞ্চম খণ্ড), পৃঃ ৯
১৩. শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস প্রাচীনযুগ প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৯
১৪. তদেব, পৃঃ ৯, ১০
১৫. বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য আকাদেমী, কলিকাতা, পৃঃ ৯
১৬. বিশ্বকোষের মতে, ‘রাঢ়’ শব্দ সংস্কৃত মূলক নহে। ইহা খাঁটি দেশী শব্দ। বিশ্বকোষ নগেন্দ্রনাথ বসু, ১৬ খণ্ড, পৃঃ ৬১৩
১৭. রায়, ভব, রাঢ় বাংলার মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতি, কলিকাতা, পৃঃ ৯
১৮. শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিম রাঢ় লােকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পৃঃ ৭
১৯. কবিকঙ্কণ চণ্ডী, বিজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত (১৩৭০), পৃঃ ৪৮
২০. শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমরাঢ়, পৃঃ ৯
২১. ইতিহাস অনুসন্ধান, পৃঃ ৯
২২. পশ্চিমরাঢ়, পৃঃ ১০
২৩. রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর অমলেন্দু মিত্র, পৃঃ ৩৫