অরুণ মিত্র:একাধারে জীবন রস রসিক ও মগ্ন ধ্যানী কবি
ড. ইরাবতী মণ্ডল
দমদম মতিঝিল কলেজ
আপাত নিরীহ,প্রকৃতির সৌন্দর্য অবগাহনে ভালোবাসার রস সিঞ্চনে সদাই যাযাবর, অথচ বুকের গভীরে সদা জাগ্রত বিবেকের খোঁচা, সময় নদীর প্রবহমানতায় আপ্লুত স্নান করেও নৈঃশব্দের নির্জনতায় আত্ম জিজ্ঞাসায় ও আত্ম বীক্ষণে সর্বদাই একই সঙ্গে এক জীবন প্রেমিক ও মগ্ন ধ্যানী কবি অরুণ মিত্র।অরুণ মিত্র (২নভেম্বর,১৯০৯–২২শে আগস্ট,২০০০)ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথিতযশা কবি, ও ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও অনুবাদক।তিনি যশোর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর কয়েকটি কাব্য গ্রন্থের নাম, প্রান্তরেখা(১৯৪৩),উৎসের দিকে (১৩৫৭),ঘনিষ্টতাপ(১৯৬৩),মঞ্চের বাইরে(১৯৭০),শুধু রাতের শব্দ নয়(১৯৭৮),প্রথম পলি শেষ পাথর (১৯৮০), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৫)।
প্রথম থেকেই সদা জাগ্রত বিবেকবান কবি বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব দেখে হতাশ হয়েছিলেন।তিনি বুঝেছিলেন আত্মদংশনে–এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমিকা বড় করুণ,মর্মান্তিক, বড় বেশি অন্তঃসারশূন্য।তাই তিনি মানব স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠায় কৃষিজীবী শ্রমজীবী মানুষের অভ্যুত্থান কামনা করে বলতে বাধ্য হন–
“প্রাচীর পত্রে অক্ষত অক্ষর
তাজা কথা কয়,শোনো;
কখন আকাশে ভ্রুকুটি হয় প্রখর
এখন প্রহর গোনো।
উপোসী হাতের হাতুড়িরা উদ্যত,
কড়া-পড়া কাঁধে ভবিষ্যতের ভার;
দেবতার ক্রোধ কুৎসিত রীতিমতো;
মানুষেরা, হুঁশিয়ার;
লাল অক্ষরে লটকানো আছে দেখো
নতুন ইস্তাহার।”(১)(লাল ইস্তাহার, ‘প্রান্তরেখা’)
কবি অরুণ মিত্রের কবিতায় কবি মননের ভাবাদর্শের স্ফূরণ কঠোরে কোমলে মাখামাখি।হিটলারের বিরোধী মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার ভূমিকাকে তিনি একরকম শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষের আগামী দিনের মুক্তির ইশারা হিসাবে দেখেন ‘কসাকের ডাক:১৯৪২ কবিতায় যা পরিলক্ষিত হয়।জনগণের মিলিত শক্তিই যে শেষ পর্যন্ত শেষ কথা বলবে-এ ইঙ্গিত রাখেন তিনি। সুদূর ভারতবর্ষ থেকে যে ডাক তিনি তার স্বদেশ ভূমিতে দাঁড়িয়ে তাঁর দেশের শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষদের কানে অগ্নিকন্যার মতন ছুড়ে দিচ্ছেন রাশিয়ার মুক্তি যুদ্ধের অংশীদার হওয়ার জন্য–এই ভাবনা তো শ্রেণিগত ভাবে আন্তর্জাতিক।কবিতাটির দুটি স্তবকেই কবিমনের আন্তর্জাতিকতা বোধের পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।এ আন্তর্জাতিকতা বোধ মূলত সাম্যবাদী ফসলের, বীজের–
“তারপর অগনিত প্রেমমূর্তি নামে দক্ষিণে
কালোমাটি চিরে–
১৯১৭-র নভেম্বরের সকাল
বিদ্যুৎগতি অন্ধকারে
জারজের উত্তরাধিকারে আচ্ছন্ন আবার।
এবার কসাকের কড়া পাঞ্জায় চূড়ান্ত মীমাংসা!
মজ্জায় মজ্জায় এ কৃষাণকে চেনো;
ইউক্রাইনের গমের চারায় কুলাকের হাড়ের সার,
আর ধমনীতে ডনের স্রোত।
জনসাধারণ অসাধারণ।”(২)
এই ‘কসাকের ডাক:১৯৪২’ কবিতাটির শেষে কটি পংতির উচ্চারণে কবি মনের বিপ্লবী অংশীদার হওয়ার কথা স্পষ্ট–
“তোমাদের দুনিয়াকে রাখব
রুখবই দুশমন রুখব
দোসরের মুখ চাই ভাই হো…
হাতিয়ার।”(৩)
এ উচ্চারণ তো আবহমান কালের সাম্যবাদীদের।
ধ্বস্ত সময়ের জ্বালা-যন্ত্রণা, বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণ ও তার প্রতিরোধ, দুর্ভিক্ষ-মহামারীর কথা যেমন কবি অরুণমিত্রের কবিতায় উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে তাঁর কাব্যে নাগরিক চেতনা বোধ ও।কোলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজের জীবন যন্ত্রণাকে তিনি যেমন নিপূণ চিত্রকরের মতন তাঁর কবিতায় শব্দ বন্ধনে তুলে ধরেছেন জীবন রসের সুধা মাখিয়ে, তেমনি কোলকাতাকে কেন্দ্র করে তিনি করেছেন কোলকাতায় বসবাসের সুবাদে তাঁর নাগরিক জীবন বোধের কবি আত্মার প্রীতি-প্রেম-ভালোবাসার আত্ম উন্মোচন।’উৎসের দিকে’কাব্যগ্রন্থের’কলকাতায়’ নাম্নী কবিতাটিতে লক্ষ্য করা যায় কবি মনের একদিকে ব্যাথা -বেদনা বোধ ,মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লান্তি যন্ত্রণার কথা যেমন নিটোল গানের মতন উঠে এসেছে,তেমনি উঠে এসেছে কোলকাতা নগরকে ঘিরে কবি মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন মেদুর ভাবনার প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার প্রেমিক মনের প্রসারতা।
ক/কোলকাতার প্রতি গভীর প্রেমের জন্ম:
“কবেকার আবছা গাছের জটলা
ঘোর-ঘোরবেলায় লতা বুনোফুল
কোনো উদভ্রান্ত গন্ধ দূরান্তর স্বর,
আমার গাঁয়ের বাংলা ফিরে ফিরে আসে
কলকাতায়।”(৪)
খ/নগর কোলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লান্তি যন্ত্রণার ছবি:
“কুঁড়ে ঘরে কোন্ কান্না শুনেছিলাম
সন্ধ্যায় বা শেষরাতে
মজা গাঙের ধারে সরসর হাওয়ায়
তা যেন কোলকাতার কোলে মুখ গুঁজে ফোঁপায়;
শূন্য হাহুতাশ”(৫)
গ/ভালোবাসার একাত্মবোধ:
“কোলকাতা আমার খুব কাছে আসে
আমি তাকে ধমনীতে পাই,
তরাই থেকে সাগরদ্বীপ তার কণ্ঠে বাজে
আমাকে তা হৃৎস্পন্দন শোনায়।”(৬)
জীবন ও জগতকে কবি অরুণমিত্রের এই ভালোবাসা বোধের একাত্মবোধই তাঁকে পৌঁছে দেয় এক মহাপ্রেমের আনন্দময়তার কাছে।আর তখনই কবির চেতনা বোধে ফিরে আসে”প্রেম আর বাসনার চিত্রপট।”যেখানে সময় সঙ্কটের জ্বালা-যন্ত্রণার হা-হুতাশ মিশ্রিত কবি মন খুঁজে পায় অন্ধকার থেকে মুক্তি।মলিন সময় ও তখন তার কাছে হয়ে ওঠে টুকরো টুকরো হীরকের দ্যুতি।’উৎসের দিকে’কাব্য গ্রন্থের’আমার কাছে বদলে যায়’কবিতাটিতে কবির ভাষায় প্রেমময় মগ্নতার জ্বল জ্বল ছবি বিদ্যমান–যা কবির চেতনা বোধে নির্মাণ করে প্রেম আর বাসনার চিত্রপট,কবিমন একাত্ম হয় মগ্ন প্রেমের আনন্দ সমুদ্রে ঢেউয়ে ঢেউয়ে–কবিতাটির প্রথম স্তবকেই কবি উচ্চারণে যা স্পষ্ট–
“আমার কাছে বদলে যায়
কান্নার দুটি চোখ,রাত্রি
যেখানে আরো রাত্রির দিকে দরজা খোলা,
টুপটাপ ফুল আর শিশিরের মাঝখান দিয়ে যে নিরুদ্দেশ
তার সামনে আমার অবস্থান,
ঘণ্টা বেজে বেজে যখন ঝিমিয়ে পড়ে
আমি নাড়া দিয়ে নতুন কণ্ঠ জাগাই
প্রেম আর বাসনার চিত্রপট আলোর গুচ্ছে সাজাই” (৭)
এই জগত ও জীবনের প্রতি ভালোবাসার একাত্মবোধের জন্যই তিনি নগরবাসী কবি হলেও তাঁর কবিতায় জীবনের সুধারস হিসেবে বার বার উঠে এসেছে বাংলাদেশ, তাঁর জন্মস্থান ও পল্লীপ্রকৃতির কথা রূপে -রঙে -রসে -বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ নিয়ে ।এ কারণেই বলা যায় তাঁর কবিতায় বার বার ফিরে এসেছে মাটির বুকের কোমল দুর্বার নৈসর্গিক ছবি,সবুজ ধানের ওপর বাতাসের দোল লাগার নিবিড় আকর্ষণ, আপন খুশির আনন্দে মত্ত দোয়েল-ফিঙে পাখির কণ্ঠস্বর, গ্রামের সহজ-সরল মানুষের জীবন-যাপনের জলছবি, গভীর আন্তরিকতায় ভরপুর প্রাণখোলা হাসির কল্লোল বৈপরীত্যের কাছে এসে যেসব সুধামাখানো স্বপ্ন ছবি বার বার কবি-মনকে করে বেদনায় কাতর।এও এক কবির প্রতিনিয়ত আত্মবিশ্লেষণ।”ঘনিষ্ঠ উত্তাপ”কাব্যগ্রন্থের গদ্যধর্মী কবিতা গুলির মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে কবিমনের একাত্মবোধের অবস্থান যে কত গভীর তা লক্ষ্য করা যায় উদাহরণ:
১/”কাঁটাতারের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরি:
কেবল শূণ্যের চাপ ।আমার নাগালের বাইরে অনেক গুলো ফুল
নিবে যাওয়ার মতো দপদপ করে।একটি সুগন্ধি শরীর আমার দিকে ফেরে,তারপর ঘাসের বিবর্ণতায় মিশে যায়।গাছ গাছালি সব দুর্বোধ হয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের কথা শিকড়বেয়ে পাতালে গিয়ে সিঁধোয়।”(৮)(কাঁটাতার)
২/”সূর্যাস্ত যে এত কাছে তা ভাবা যায় না।হঠাৎ পূর্ণিমা বা অমাবস্যার টান এসে লাগে ।তখন সামাল সামাল।”(৯) (বাড়ি)
৩/”আমাদের আওয়াজ ঝাউয়ের হাওয়ার সঙ্গে ফেরে আর নদীর ধসে নামে।সে এক ভীষণ নির্জনতার স্বর,অথচ আমাদের ঘনিষ্ঠতা তার ভিতরে।”(১০)(এই প্রান্তে)
প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মবোধে একদিকে যেমন কবিমনের অফুরন্ত প্রেম ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় কবিমনের নানা দ্বান্দ্বিক চেতনা বোধের কথাও ।কবিমনে ব্যাথা-বেদনা, কামনা-বাসনার স্বপ্ন ও জীবন-বীক্ষণের চিত্রিত ছবি মিলে মিশে প্রকৃতি প্রেমের একাত্মতায় উদ্ভাসিত হয়েছে।জীবনানন্দের কিঞ্চিত গন্ধ থাকলেও বাচন ভঙ্গিতে, জীবনবোধের স্বতন্ত্রতায় তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ এক অন্যরসের ,যা একান্তই অরুণমিত্রের।তাঁর এ কণ্ঠস্বর ফরাসি কবিদের কারুর কারুর কবিতায় কিঞ্চিত আভাস পাওয়া গেলেও আধুনিক বাংলা কাব্যে এক নতুন সুর যোজনা করেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তথ্য সূত্র:
১/ চৌধুরী শীতল:আধুনিক বাংলা কবিতা নিবিড়পাঠ,প্রজ্ঞাবিকাশ পাবলিকেশন,দ্বিতীয় সংস্করণ,পৃষ্ঠা-১১১
২/ঐ,পৃষ্ঠা-১১২
৩/ঐ,পৃষ্ঠা-১১৩
৪/ঐ,পৃষ্ঠা–১১৩
৫/ঐ,পৃ–১১৩
৬/ঐ,পৃ–১১৪
৭/ঐ,পৃ–১১৫
৮/ঐ,পৃ–১১৫
৯/ঐ,পৃ–১১৫
১০/ঐ,পৃ–১১৫