January 1, 2020

বাংলাদেশ : ভাষার দাবি – মুক্তির গান

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

দেবাশিস মণ্ডল

বাংলাদেশ ভাগের প্রতিটি অধ্যায় অজস্র মানুষের রক্ত আর অশ্রুতে মেশা। বহু ত্যাগ আর যন্ত্রনার অতীত ও ঐতিহ্যের গৌরব বহন করছে এদেশের মাটি-আর প্রতিটি ধুলিকনা। জর্জরিত হৃদয় থেকেই জেগে ওঠে নতুন রক্তস্রোত। হৃদয়াবেগের অহংকার থেকেই একুশের আহ্বান, বাহান্নর ব্যাথায় মর্মর হয়ে মুশড়ে পড়েনা। নতুনের ডাক ওঠে। সেদিনের ভোর, মুক্তির ডাক আর মুক্তির গানে গলা মিলিয়েছিল একাত্তরের দিকে। সেই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে গান, কবিতা, নাটক মানুষের হৃদয়াবেগকে আকুল করে তুলেছিল। জীবন মরন পন করার যে আহ্বান তা শোনা গিয়েছিল সেদিনের গানে। ধমনীর রক্তস্রোত, পথে টেনে এনেছিল দেশের মানুষকে। পৃথিবীর সব মুক্তিযুদ্ধেই অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে গান। কিন্তু এখানে, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। সেই গানেও শোনা গিয়েছিল মুক্তির আহ্বান।

প্রথম দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া আইন কানুনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল সারা বাংলা জুড়ে। জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন সর্বাত্মক হয়ে ওঠে। আর এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গান আর কবিতাকেই অন্যতম হাতিয়ার করে নিয়েছিল বাঙালিরা।

ভারতের মাটিতেও ঐক্যের আন্দোলন হয়েছিল ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব আনলে। বিচ্ছিন্নতার আতঙ্ক শুরু হয়েছিল। নানা বিভেদের চক্রান্ত করে বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সব মানুষ।  তখন ঐক্য ও সম্প্রীতির গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ঈশ্বরগুপ্ত, দ্বিজেন্রলাল রায় প্রমুখরা। হয়েছিল রাখিবন্ধন উৎসব। চিতপুরের রাস্তায় সেদিন লক্ষ মানুষের ঢল জমে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন’ বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি। পাশাপাশি শতশত কবি গীতিকারের কবিতায় গানে বাংলার জয়গানে সম্প্রীতির সুর মুখরিত করেছিল দিক-বিদিক। আর সেইসব গান কালজয়ী হয়ে দীর্ঘকাল ধরে লক্ষ কণ্ঠে গীত হয়েছিল। তবু দেশ ভাঙ্গল। ভাঙল বাংলা। কিন্তু বাংলা ভাষা ভুলিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র বাংলার মানুষ মানল না। প্রতিবাদ ক্রমে প্রতিরোধ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে)ও তাই হয়েছিল। যেখানে লক্ষ মানুষের পথে নেমে বিক্ষোভ আর লক্ষকণ্ঠে গান। সেদিনও সহ্য করতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা। বাঙালি সেদিনের তীব্র ঘৃণা নিয়ে যত ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, ততই নেমে এসেছে অত্যাচার। অত্যাচার শাসকের, অত্যাচার সৈরাচারীদের।    

   সে সময় কালজয়ী হয়েছিল অজস্র গান। ‘১৯৪৮-এ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকে ভাষার গান রচনা শুরু হয়। সর্বপ্রথম গানটি রচনা করেন কবি ও গীতিকার অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী। এতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান। গানটির একাংশ এমন: ‘শোনেন হুজুর—/ বাঘের জাত—এই বাঙালেরা—/ জান দিতে ডরায় না তারা,/ তাদের দাবি বাংলা ভাষা/ আদায় করে নেবে তাই’।১ ভাষা আন্দোলন জয়যুক্ত হল বহু শহীদদের রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে। কিন্তু গান থামলো না। ভাষা আন্দোলনের সময় এবং তারপরেও মাঠে-ঘাটে, অফিসে, স্কুলে-কলেজে ছোট বড়ো সবার কণ্ঠে গান যেন স্রোতস্বিনী হয়ে উঠল। ভাষার মাধুর্যের নুতুন গান রচিত হতে থাকল। ভাষা আন্দোলনের গানই ক্রমে মুক্তির গানে পরিণত হল। বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই ক্রমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল।

একুশের আর মাতৃভাষার গান এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গান হয়ে উঠেছে। সেই কালজয়ী চিরস্মরণীয় গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী……’ । গানটি বাংলাদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে ও অন্যান্য দেশে। একুশে ফেব্রুয়ারি আর একুশের গান। ভাষা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস মানেই একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। গানটি রচিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের তৎকালীন কোয়ার্টার ৩৭ বেচারাম দেউরিতে। গানটি রচনা করেচিলেন প্রখ্যাত আব্দুল গাফফার চৌধুরী। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গানটি রচনা করেন। গানটি একটি খবরের কাগজের শেষের পাতায় ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তখন গীতিকারের নাম ছাপা হয়নি। পরে প্রকাশের সময় গীতিকারের নাম ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে’ সংকলনে গানটি পুনরায় প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। মানুষের হৃদয়াবেগকে শোষক ও অত্যাচারীরা ভয় পায়। হৃদয়াবেগ সমষ্টির কথাবলে। অন্ধকার থেকে নিংড়ে বের করে আনে আলোর শিখা। তাই এতো ভয়। আর ওরা যতই আঘাত করে ততই যেন হৃদয় থেকে আরো তীব্রবেগে গান উৎসারিত হয়ে পড়ে। কোন বাধাই সেখানে ব্যবধান সৃষ্টি করতে পারে না। 

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি  গানটি ও সেসময়েরর আন্দোলনের সঙ্গে গানটি কীভাবে জড়িয়েছিল সে সম্পর্কে যা জানাযায় তা হল, ‘প্রথমে এটি কবিতা হিসেবে লেখা হয়েছিল। কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। লতিফ আতিকুল ইসলাম প্রথম গানটি গান। কিন্তু গানটি ছিল সমবেত সঙ্গীত। আবারো সময়ের সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময় গানটি গেয়েছিল। একারণে তৎকালীন কলেজ প্রশাসন তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ, যিনি সে সময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি’।২

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আর যারা গান লিখেছিলেন তার মধ্যে সাধক কবি মহিন শাহ অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছিলেন,

সালাম আমার শহীদ স্মরণে

দেশের দাবী নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া

প্রাণ দিলেন যে সব বীর সন্তানে॥

সাইদুর রহমান বয়াতি লিখেছেন,

জন্মভূমি মায়ের ভাষা বলতে কেন দাও বাধা

তোমাদের কি হয় মাথা বেথা?

হায়রে বনের পাখি বনে থাকে

যার যার ভাষায় সেই ডাকে

তাতেই খুশি আল্লাপাকে

বুলিতে তার নাম গাথা॥

ভাবসাধক আবদুল হালিম বয়াতি লিখেছেন,

“উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা জিন্নাহ সাহেব কয়

ছাত্ররা সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানায়

বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু আমরা মানি না॥

জিন্নাহর সাথে নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগ আর নুরুল আমিন

উর্দুভাষা চাইল সেদিন বাংলাভাষা চাইল না॥”

মোশারেফ উদ্দিন আহমেদ রচনা করলেন ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল’।

তবে প্রথম প্রভাতে ফেরির গান হিসাবে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ভুলব না, ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না। লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি ভুলবো না।’গানটি। ‘ভাষা আন্দোলনের সূচনার গান হিসেবে এটি সে সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং তা আন্দোলনের মহা অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। গানটির গীতিকার ছিলেন গাজীউল হক নিজেই। ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে আয়োজিত জনসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী ও প্রথম শহীদ দিবসের প্রথম প্রভাত ফিরিতে যে গানটি গাওয়া হয়েছিল। তা হলো :

‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল
ভাষা বাঁচাবার তরে
আজিকে স্মরিও তারে।’৩

বিবিসি ডট কম লিখেছে,  ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রেরণার অন্যতম মূল একটা উৎস ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রচিত গণসঙ্গীত। গণ জাগরণের এই সঙ্গীত রচনা ও পরিবেশনায় সেসময় অসামান্য অবদান যাঁরা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাংলাদেশের বহু সঙ্গীত রচয়িতা, সুরকার-গীতিকার ও শিল্পী। সেই সময়ের আবেগ আর উদ্দীপনার ঢেউ তখন স্পর্শ করেছিল প্রতিবেশী পশ্চিমবাংলার বহু মানুষকেও। বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার সঙ্গীতজগতকেও ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল ৭১য়ের স্বাধীনতা যুদ্ধ। রচিত হয়েছিল স্মরণীয় কিছু গান’। ৪

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন স্থানে আক্রান্তদের নিরাপত্তার জন্য অনেক অস্থায়ী শিবির গড়ে উঠেছিল। সেগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বহু মানুষ।  তাদের তাদের মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য সেসব শিবিরে শিবিরে গান গেয়ে বেড়াতেন বাংলাদেশের বেশ কিছু শিল্পী। তাদের মধ্যে মাহমুদুর রহমান বেনু ও আরো কারোকারো নাম জানা যায়।

মুক্তি যুদ্ধের গান কোন সীমানা মানেনা। তারা চেনে অত্যাচারী আর অত্যাচারিত মানুষকে। সেই কারনেই দেশের বাইরের বহু গানও সেসময় গাওয়া হয়েছিল। আর ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখরা। মুক্তিযুদ্ধে সেসব গান মুখে মুখে ফিরত। শাসকের কালো হাত, কিংবা স্বৈরতন্ত্রের চাহনির মধ্যে যেমন কোন ভেদ নেই, তেমনি জাগরণ ও প্রতিবাদের ভাষার মধ্যেও বেশ মিল রয়েছে যথেষ্ট। তাই আজও বাংলায় গীত হয় পিট সিগারের গান। জন হেনরি আর নিগ্রোভাই পল রবসন বাংলার মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। দেশ মুক্ত হলেও অত্যাচার চলে। যতদিন দারিদ্র ও বঞ্চনা থাকবে অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের দ্বন্দ্বের থেকে মুক্তির জন্য লড়াইয়ও চলবে। আর তাই দেশে বিদেশে যেকোন জায়গার রক্তাক্ত হিংস্র নখরের নজর পড়লেই আমরা ঐক্যের সুর, মুক্তির গান গাইতেই থাকব। যেখানে পথ দেখাবে এইসব কালজয়ী মুক্তির গান।     

১। https://www.prothomalo.com/special-supplement/article/152008/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8

২।https://www.facebook.com/notes/একুশের-গান-শহীদ-মিনার-ও-ভাষা-আন্দোলনে-ঢাকা-কলেজের-ছাত্র-শিক্ষক-দের-ভূমিকা/1321063944598822/

৩। https://www.bhorerkagoj.com/print-edition/2018/02/02/178212.php

৪। https://www.bbc.com/bengali/news/2011/01/110102_mb_mukhtijudhdher_gaan