Interplay Between Rabindranath Tagore’s Songs and Dhrupad Music
Dr. Mali Mitra, Department of Music, Memory College, Memory, East Burdwan
Abstract: This exploration delves into the profound connection between the timeless compositions of Rabindranath Tagore, the legendary poet and musician, and the traditional Dhrupad songs of Indian classical music. Both genres, originating from diverse cultural backgrounds, share a deep-rooted affinity in their melodic structures, rhythmic intricacies, and spiritual essence. This study aims to unravel the intricate threads that bind Tagore’s soul-stirring songs with the meditative and ancient art form of Dhrupad, shedding light on the commonality of emotions, philosophical underpinnings, and musical elements that transcend temporal and cultural boundaries. Through comparative analysis and appreciation of these musical traditions, we seek to illuminate the universal language that resonates in the harmonies of Rabindranath’s creations and the timeless echoes of Dhrupad.
ধ্রুপদ গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের একাত্মতা
ডঃ মলি মিত্র, সংগীত বিভাগ, মেমারি কলেজ, মেমারি ,পূর্ব বর্ধমান
মার্গ সংগীত অন্যান্য ভারতীয় বিদ্যার মতোই গুরুমুখী বিদ্যা। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ- আলমের দরবারে সংগীত চর্চা যখন রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল, তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ। দিল্লির দরবারে স্ব –নাম ধন্য গায়ক গুণীরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়লেন, বিভিন্ন সামন্ত রাজাদের দরবারে আশ্রয় খুঁজতে থাকেন তারা। এই সময় কয়েকজন সংগীত সাধক চলে এলেন আরো পূর্বদিকে -বাংলাদেশে। এছাড়াও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও দেখেছি দিল্লির দরবারের বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞ আসছেন। পূর্বাঞ্চলের ধন –কুবেরদের আশ্রয়ে, কলকাতায় মুর্শিদাবাদে এবং বর্তমানে এই সময়েই বিষ্ণুপুরে এসে হাজির হলেন তানসেন ঘরানার বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পাখোয়াজ বাদক পীর বক্স। বাহাদুর খাঁকে ঘিরে বিষ্ণুপুরে শুরু হল সংগীত চর্চা। সেই বিষ্ণুপুর ঘরানার আদি গুরু হলেন রাম সংকর ভট্টাচার্য, গদাধর চক্রবর্তী, নিতাই বৃন্দাবন প্রভৃতি ও এই ঘরানার প্রথম যুগের সংগীতাচার্য। শুধু বিষ্ণুপুর নয়, বিষ্ণুপুর ঘরানার সমান্তরালে উত্তর কলকাতায় প্রায় সব সময়ই গড়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ ধ্রুপদী আখড়া। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য দেহ ত্যাগ করেন। সেই সময় তাঁর শিষ্যরা বাংলাদেশের সর্বত্র ধ্রুপদ চর্চার প্রসার ও প্রচার করেন। তাঁর শিষ্য দের মধ্যে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, যদুভট্ট, কেশবলাল চক্রবর্তী র নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারতীয় রাগসংগীতের অন্য তম একটি ধারা হল ধ্রুপদ। প্রাচীন “ধ্রব” প্রবন্ধ থেকে উদ্ভূত মধ্য যুগে পরিমার্জিত চার তুকে রচিত যে গান পাখোওয়াজের সঙ্গে নির্দিষ্ট তালে এবং বিশিষ্ট রাগ বিকাশের নিয়মে আলাপ থেকে শুরু করে মীড় , গমক ইত্যাদি গম্ভীর ও গভীর ভাবময় অলংকার প্রয়োগে হালকা তান সহযোগে গাওয়া হয়, সেই রচনার নাম হচ্ছে ধ্রুপদ। ধ্রুপদ শব্দের অর্থ হল ধ্রুব পদ। ধ্রুব অর্থ স্থির, নির্দিষ্ট ও সত্য এবং পদ অর্থ কথা যুক্ত গীত। তাই ধ্রুবপদ বা ধ্রুপদ বলতে একপ্রকার ধীর স্থির গম্ভীর সংগীত কে বোঝায়।ধ্রুপদ গানে চার তুকে নিবদ্ধ এই তুকগুলি হল স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও অভোগ। ধ্রুপদ গানকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সবচেয়ে অভিজাত ধারা বলা হয়ে থাকে।
ভারতবর্ষে ধ্রুপদ গানের চর্চা কখন থেকে শুরু হয় তা বলা কঠিন, তবে মহর্ষি ভরতের সময় ধ্রুবা নামে এক প্রকার সঙ্গীতের প্রচলন ছিল। সেই সংগীতের পরে ধ্রুপদ নামে প্রচলিত হয় বলে মনে হয় । তবে পরবর্তীকালে গোয়ালিয়রের রাজা মান সিংহ তোমারকে ধ্রুপদ গানের শ্রষ্ঠা হিসেবে ধরা হয়। ধ্রুপদ গান প্রথম রচনা করেন গোয়ালিয়রের রাজা মান সিংহ তোমার।
ধ্রুপদ সম্পর্কে অভিজাত সঙ্গীতজ্ঞরা দুই তুকের ধ্রুপদকে “তুরুট” বলেন। এর সঙ্গে মৃদঙ্গের বোল উচ্চারিত হয় এর একটি প্রকার ভাগ হলো “ফুল বন্ধ” এবং আরও একটি প্রকার ভাগ হলো “যুগল বন্ধ” এই ধরনের গানের গানে দুজন শিল্পী একসঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। ধ্রুপদ গানের অর্থ সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা সূচক সংগীত, অন্য মতে ধ্রুপদ ধ্রুবপদ শব্দের অপভ্রংশ। ধ্রপদের যে চারটি বাণী আছে তা হল – গোবর হার, খান্ডার, ডাগর ও নওহার। এই বাণী গুলি আবার এক একটি রসের দ্বারা সৃষ্টি। যেমন–
১) গোবরহার বানী শান্তরসের দ্যোতক প্রসারগুন যুক্ত ও ধীরগতি সম্পন্ন।
২) খান্ডার বানী বীর রসের উদ্দীপক ও বিলম্বিত গতি সম্পন্ন।
৩) ডাগুর বা ডাগর বানী সহজ, সরল, মাধূর্য পূর্ণ, ও লালিত্য পূর্ণ।
৪) নওহার বাণী অদ্ভুত রসের উদ্দীপক, এক বা একাধিক স্বর অতিক্রম করে অপর স্বরে যাওয়া আসা এই বানীর বৈশিষ্ট্য। গতিবেগ সম্পন্ন হয়ে থাকে।
রাগ সংগীতের ক্ষেত্রে ধ্রপদ পরিবেশন করবার কতকগুলি রীতি আছে। যেমন-
১) ধ্রুপদ আরম্ভের পূর্বে বিস্তারিত রাগালাম বর্তমানে নন্তোম ইত্যাদি অর্থহীন শব্দের সাহায্যে রাগাদা করা হয়। সম্ভবত এগুলি পূর্ব প্রচলিত কোন অর্থবোধক শব্দ বিন্যাসের অপভ্রংশ।
২) ভক্তিভাব, শান্ত রস ও বীর রসের পক্ষে ধ্রুপদ বিশেষ উপযোগী। অবশ্য ধামার তালের হোরি শৃঙ্গার রসের সন্ধান মিলে এই ধ্রুপদ গানেই।
৩) ধ্রুপদে দ্বিগুণ চতুর্গুণ ইত্যাদি লয়ে বাঁট করা হয়ে থাকে। বাঁট শব্দের অর্থ বন্টন। রাগ ও তালের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে ধ্রুপদের শব্দগুলিকে দ্বিগুণ চতুর্গুণ ইত্যাদি লয়ে পরিবেশন করাকে বাঁট বলে। তা ছাড়া ধ্রুপদের তানের প্রয়োগ হয় না।
৪) বর্তমানে ধ্রুপদে চৌতাল, ধামার, সুর–ফাঁক তাল, ঝাঁপতাল, তেওড়া ইত্যাদি তাল ব্যবহৃত হয়, এবং মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজ বাজানো হয়। পূর্বে ব্রহ্মতাল, লক্ষ্মীতাল, গনেশতাল প্রভৃতি তালের প্রচলন নেই বললেই চলে।
৫) অন্যান্য শ্রেণীর গান অপেক্ষা ধ্রুপদের গাম্ভীর্য অধিকতর এই বিষয়ে দৃষ্টি দেখেই আনুষাঙ্গিক যন্ত্রাদি নির্বাচিত হয়।
৬) ধ্রুপদ রচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায় যে ভগবত বিষয়ক রচনা হয়ে থাকে।
ধ্রুপদ গানগুলি প্রধানত হিন্দি উর্দু বা ব্রজভাষায় রচিত। তবে অধিকাংশ গানের ভাষায় একাধিক ভাষার মিশ্রণ দেখা যায়। মিশ্রিত ভাষা হলেও সুরগুলিকে গাওয়া হয় কেটে কেটে। এই সময় ঠাকুর পরিবারে শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারার বীজ বপন করা হয়েছিল; প্রিন্স দ্বারকা নাথ ঠাকুরের সময় থেকেই তাঁর সুযোগ্য পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে এবং অনুপ্রেরণায় ঠাকুর বাড়িতে হিন্দুস্তানি সংগীতের চর্চা আরো ব্যাপকতা লাভ করে। ঠাকুর বাড়ির ছেলেমেয়েরা এই আবহাওয়াতেই যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং সংগীতের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি হয়ে ওঠে। তাদের জন্য বড় বড় ওস্তাদরা গৃহ শিক্ষক রূপে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় গুরুদেবের দাদারা যাঁর কাছে হিন্দি ধ্রুপদ গান শিখতেন তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজ দরবারের শিক্ষা প্রাপ্ত বিষ্ণু চক্রবর্তী। রাজা রামমোহন রায় যখন ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রহ্মসভা স্থাপন করেন তখন এই সভার উপাসনার প্রয়োজনীয় গান গাইবার জন্য নিযুক্ত হন বিষ্ণু চক্রবর্তী ও কিষ্টু চক্রবর্তী। রাজা রামমোহন রায় এবং খিষ্ট চক্রবর্তী মৃত্যুর পর গুরুদেবের পিতৃদেব বাড়ির ছেলেমেয়েদের সংগীত শিক্ষক রূপে এবং ব্রাহ্মসমাজের গায়ক হিসাবে বিষ্ণু চক্রবর্তীকে নিযুক্ত করেন। গুরুদেব শিশু বয়স থেকেই বিষ্ণু চক্রবর্তী সংস্পর্শে আসেন; এছাড়া গুরুদেবের বাড়ির সংগীতের পরিবেশ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, তাই বলা যায় যে- তিনি বাল্যকাল থেকেই ধ্রুপদ গানের আবহাওয়ার মধ্যে লালিত পালিত হয়েছেন; এবং তাঁর হৃদয়ে উচাঙ্গ হিন্দি গানের স্থান অন্যতম। “বাল্যকালের আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল না সুদূর থেকে অযোধ্যা, গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে ওস্তাদ আসত তাছাড়া বড় বড় ওস্তাদ ঘরেও বাঁধা ছিল”।১ (সংগীত চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃষ্ঠা ২৬১ বিশ্বভারতী প্রকাশন)।
এই উক্তি থেকে বোঝা যায় যে বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা যেভাবে হয় তার মধ্যে একটা বড় অংশই ছিল পরিবারের আবহাওয়া। তাই তিনি বলেছেন – “আমরা বাল্যকালে ধ্রুপদ গান শুনতে অভ্যস্ত, তার আভিজাত্য বৃহৎ সীমার মধ্যে আপন মর্যাদা রক্ষা করে। এই ধ্রুপদ গানে আমরা দুটো জিনিস পেয়েছি – একদিকে তার বিপুলতা, গভীরতা, আর একদিকে তার আত্মদমন, সুসংগতির মধ্যে আপন ওজন রক্ষা করা। এই ধ্রুপদের সৃষ্টি আগেকার চেয়ে আরো বিস্তীর্ণ হোক, আরো বহু কক্ষ বিশিষ্ট হোক, তার ভিত্তি সীমার মধ্যে বহু চিত্র-বৈচিত্র্য ঘটুক, তাহলে সংগীতে আমাদের প্রতিভা বিশ্বজয়ী হবে”।২ (সংগীত চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃষ্ঠা ১৫৮ বিশ্বভারতী প্রকাশন)
রবীন্দ্র সংগীতে এই ‘ধ্রুপদের সৃষ্টি’ আর ও ‘বিস্তীর্ণ’ হওয়া, ‘বহু কক্ষ বিশিষ্ট’ হওয়া, ‘ভিত্তি সীমার মধ্যে’ ‘বহু বৈচিত্র’ ঘটা ইত্যাদি বিষয়গুলি সার্থক হয়েছে। ধ্রপদাঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথা ও সুরের মিলিত অর্ধনারীশ্বর রূপ সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন গানের কথার দিকে।
ধ্রুপদ গানে অভ্যস্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম যুগে গানে যে সুর সংযোজন করলেন তা তালে-ছন্দে- লয়ে একেবারে শুদ্ধ। ধ্রুপদ গান চালে গাম্ভীর্যে এবং পরিপূর্ণতায় স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করেছিল। রবীন্দ্র সংগীতে সেই আদি যুগের ধ্রুপদের চার তুক বা পদ মীড় , মূর্ছনা তালের ব্যবহার সব যথাযথ ভাবে করেছেন, এবং তা বর্তমান। রবীন্দ্রনাথের যত ধ্রুপদ রীতির গান আছে তার অধিকাংশই বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি তাঁর প্রথম জীবনে ধ্রুপদী আদর্শে অজস্র ব্রম্ভসঙ্গীত রচনা করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজের সৃষ্টি রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনা করেন রবীন্দ্র সৃষ্ট গানগুলিকে ধ্রপদাঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীত বলা হয়ে থাকে; সুর রচনা বা সুর যোজনার দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সব নিয়ম ও রীতি আছে, তা হুবহু অনুসৃত নয়। এইরূপের স্বাতন্ত্র্য থাকায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধ্রুপদ গান কে ধ্রপদাঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীত বলা হয়ে থাকে। এই সংগীত বোধের আলোকেই রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছেন। হিন্দুস্তানি সংগীতে যথেষ্ট অধিকার ছিল বলেই তিনি যেমন নিয়ম মেনেছেন, তেমনি নিয়ম ভেঙেওছেন। একেবারেই নিজস্ব ধরনের গান সৃষ্টি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের ধ্রপদাঙ্গ গানের পরিপ্রেক্ষিতে ভাঙ্গা রবীন্দ্রসঙ্গীত গুলিকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –১) মূলানুগ রবীন্দ্র সঙ্গীত , ২) মূল গানের ছায়াবলম্বী রবীন্দ্র সংগীত।
১) মূলানুগ রবীন্দ্রসঙ্গীত– মুলানুগ রবীন্দ্র সংগীত অর্থাৎ মূল গানে ‘হুবহু’ অনুসরণে রচিত রবীন্দ্র সংগীত। এরকম গানের দৃষ্টান্ত বেশি পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। তার মধ্যে “প্রচন্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন” – এটি একটি গান, এর মূল গান- “প্রচন্ড গর্জন সজল বরখা ঋতু”। জানকি দাস রচিত ভুপালি রাগ ও সুরফাঁক তালের একটি ধ্রুপদ। মূল গান ও মুলানুগ গান দুটি এক্ষেত্রে সুরে ও তালে এক রূপ। লক্ষ্য করার বিষয় হলো – মূল গানটি একটি ঋতু সংগীত (বর্ষা)। আর মুলানুগ রবীন্দ্র সংগীতটি পূজা পর্যায়ের অন্তর্গত (ধর্ম সংগীত)। দুটি গান সুরে তালে এক রূপ হলেও তাদের পরিবেশন রীতিতে পার্থক্য আছে। একথা উভয় গানের শ্রোতা মাত্রই স্বীকার করবেন।
২) মুল-গানের ছায়াবলম্বী রবীন্দ্র সংগীত– মূল গানের ছায়াবলম্বী রবীন্দ্র সংগীতে মূল গানের প্রভাব অল্প বিস্তার থাকলেও, যেহেতু গান গুলির সুর, তাল ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ গানের আদর্শে রচিত তাতে রবীন্দ্রনাথের মৌলিকতার ছাপ স্পষ্ট। যেমন – শূন্য হাতে ফিরি হে, চরণধ্বনি শুনি তব নাথ ইত্যাদি।
ধ্রুপদ গানের বিষয়বস্তু সাধারণত ভগবত বিষয়, প্রকৃতি বর্ণনা, রাজ বন্দনা ও রাগ বন্দনা এই কটি বিষয়ের হয়ে থাকে; আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছটি পর্যায়ের মধ্যে অধিকাংশ ধ্রুপদাঙ্গ গান পূজা পর্যায়ের অন্তর্গত; কিছু প্রেম, স্বদেশ ও প্রকৃতি পর্যায়ের আছে। তবে রাগ বন্দনা ও রাজ বন্দনা একেবারেই পাওয়া যায় না। এই রকমই কতগুলি গানের উল্লেখ করি।
পূজা পর্যায়ে – “দাঁড়াও মন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড, মাঝে আনন্দ তুমি স্বামী, বাজাও তুমি কবি” ইত্যাদি।
প্রেম পর্যায় – “গহনও ঘন বনে পিয়াল তমাল, মন জানে মন মোহন আইলো” ইত্যাদি।
প্রকৃতি পর্যায় – “নব নব পল্লব রাজী, এসো হে এসো সজল ঘন, নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এলো প্রাণে” ইত্যাদি। তখন তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোন সংশয় থাকে না।
পরিশেষে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথের মতো বিরল প্রতিভাধরের পক্ষেই শুধু স্বর প্রয়োগেই নয়; তাঁর গানে ছন্দ প্রয়োগে ধ্রুপদের চলনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা স্বতন্ত্র লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে যে সুর প্রয়োগের রীতি দেখি তা তাঁর বাল্যকালে ধ্রুপদ গানের আবহাওয়ায় বা তালিম তাঁর গানের প্রয়োগের এই পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছিল, এবং রবীন্দ্রনাথের গানে ভারতীয় সকল গীত রীতির মধ্যে ধ্রুপদের প্রভাবই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। গানে কথা আর সুরকে মেলানোর এ সাধনা, রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের।
তথ্যপঞ্জী :
১) সংগীত চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃষ্ঠা ২৬১ বিশ্বভারতী প্রকাশন)।
২) সংগীত চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃষ্ঠা ১৫৮ বিশ্বভারতী প্রকাশন)
গ্রন্থপঞ্জী:
১) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – জীবনস্মৃতি – বিশ্বভারতী।
২) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – গীতবিতান – বিশ্বভারতী।
৩) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – স্বরবিতান – বিশ্বভারতী।
৪) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – সংগীত চিন্তা – বিশ্বভারতী।
৫) ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ – ছবি ও গান – বিশ্বভারতী।
৬) দেবনাথ ধীরেন্দ্রনাথ- রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু – রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
৭) বসু ডঃ অরুন কুমার – বাংলা কাব্য সংগীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত – দেজ পাবলিশিং।
৮) বন্দ্যোপাধ্যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বীরেন্দ্র – রবীন্দ্রসংগীতঃ কাব্য ও সুর – করুণা প্রকাশনী।
৯) মুখোপাধ্যায় প্রভাত কুমার – গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী – টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
১০) স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ – সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান – শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা।