July 1, 2014

হস্ত শিল্পের বাজার : বোলপুর

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য

বোলপুর শান্তিনিকেতন হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে অনেক কাল ধরে। রবীন্দ্রনাথ নিজে গড়ে তুলেছিলেন সমবায়। দেশজ শিল্পের উদ্যোগ। যার উপকরণ কাঠ, চামড়া, সুতো, কুঁচি, পুঁতি, ফলের বীজ, ঘাস, বালি, মাটি এই সব। যেগুলি শিল্পীর হাতে এসে অমূল্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমাদেবী, প্রমুখরা এইসব শিল্পকে বুঝতে শিখিয়েছেন।

শান্তিনিকেতনের সব কিছুতেই হস্তশিল্পের মেলা বসে। গান হয়। দেশজ শিল্প, দেশজ গান। বসনোতসব, পৌষ মেলা। হস্ত শিল্পে বোলপুরের পথপ্রান্তর আলোকিত হয়ে ওঠে। ছোটবড়ো সবাই মেতে ওঠেন মেলাতে।

বোলপুর থেকে বেশ কিছুটা দূরে খোয়াইয়ে বেশ বেচা কেনার হাট এর কথা অনেকেই জেনে গিয়েছেন। মাত্র কয়েক বছর আগে থেকে সেখানে হাট বসতে শুরু করেছে। যা জানা যায়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্রী শ্যামলী খাস্তগীরের উদ্যোগে সোনাঝুরি ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলে রাস্তার পাশে খোয়াইয়ে প্রথম হাট বসে।  স্থানীয় আদিবাসীদের বাড়ীতে অবসর সময়ে তৈরি নানান জিনিসপত্র এই হাটে বিক্রি করা এবং বাংলার শিল্প সৌন্দর্যকে পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই মেলা শুরু হয়।

রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই স্থানীয় আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষদের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় মানুষদের হাতের কাজ শেখানো ও তাদের হস্ত শিল্পের বাজার তৈরি করার সেই প্রচেষ্টার এটাও একটা দিক।


ক্রমে ছোট থেকে বড় হয় এই হাট। কাছের ও দূরের মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। হাতে তৈরি শিল্প সামগ্রীর জোগানও বাড়ে। বিদেশ থেকেও কিছু মানুষের আনাগোনা হয়।  এভাবেই খোয়াইয়ের হাট এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্থান করে নিয়েছে। দু’একদিনের ছুটি কাটাতে যারা বোলপুরে আসেন তাদের অন্যতম আকর্ষণ খোয়াইয়ের হাট। বোলপুরের শিল্প সামগ্রীর পাশাপাশি দূর দূরান্তের হস্ত শিল্পও আসে এখন। পাশাপাশি মানে প্রান্তিক, ভুবনডাঙ্গা, কোপাই, গোয়ালপাড়া, পাটুলডাঙ্গা, সুরুল। এখানকার নারী পুরুষেরা সাইকেলে করে বা কেউ কেউ সাইকেল ভ্যান ভাড়া করে সামগ্রী আনে। খোয়াইয়ে যে হাট শুধু শনিবারেই বসত বলে এই হাট ‘শনিবারের হাট’ নামে পরিচিত ছিল। ক্রমে শনিবার, রবিবার, ছুটির দিন ছাড়াও সপ্তাহের অন্য দিনগুলিতেও বসছে এই হাট। লোকজনের সমাগমও বেশ হচ্ছে। তবে এখনো শনিবারেই বেশি দোকান বসে। জনসমাগমও বেশি হয়।

‘খোয়াইয়ের হাট’ ক্রমে মেলায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ভাষাভাষি, ধর্ম, বর্ণ ও নানা দেশের মানুষের মিলন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই হাট। শুধু হাতের কাজ বা শিল্প সামগ্রীই নয়, এখানে জড়ো হয় ঘর গেরস্থালির প্রয়োজনীয় নানা উপকরণও।  বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন, একতারা, দোতারা, খমক, মেয়েদের নানান অলঙ্কার ব্রোঞ্জ, তামা, মাটির ও গালার পুঁতি, নানান বীজের তৈরি গলার হার, কানের দুল; কুর্তা, পাঞ্জাবী, হাতের কাজের রংবাহারী শাড়ী, কাঠের হাতা খুন্তি, চেয়ার-টেবিল, খাট, চোকি আরো কত কী। 

বাংলার দূর-দূরান্তের মানুষ সেখানে জড়ো হয়,  এখানকার স্থানীয় আদিবাসী পল্লীবাসীদের হাতের তৈরি শিল্প সামগ্রী কেনার জন্য। তেমনি বাংলার বাইরে থেকেও বহু মানুষ এখানে আসেন। আর আসেন অনেক বিদেশী পর্যটকও। ফলের হস্তশিল্পের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে চালু হয়েছে বীরভূম বোলপুর এবং স্থানীয় এলাকার আদিবাসী সংস্কৃতি মিলনক্ষেত্র।  সেখানে আদিবাসী রমনীরা মাদলের তালে নৃত্যের আল্পনায় চতুর্দিক ভরিয়ে তোলেন। ধিতাং ধিতাং শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে এখানকার আকাশ বাতাস। ধামসা বাজে, মাদল বাজে। আর সাঁওতালি ঝুমুর গানের সঙ্গে বাজে বাঁশি আর বানাম। অনেক আলাদা আলাদা দল এদিক ওদিক নিজেদের মতো জায়গা করে নিয়ে অনর্গল নেচে চলেছে। দল দল মানুষ তাদের ঘিরে বসে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে মাটির সুর।  নানা জায়গা থেকে এই আদিবাসীরা এসে সমবেত হয় ধামসা মাদল, বাঁশি-বানাম নিয়ে। মেয়েদের পরনে সাদা হলুদ রঙের লাল পাড় শাড়ি। মাথায় পিতলের কলসি দুটি করে একটির উপরে আর একটি বসানো। তাতে গাছের শাখা। আদিম ছন্দে তাদের চিরন্তন ঝুমুর নাচ, ঝুমুর গান অপূর্ব পরিবেশের তৈরি করে। যা থেকে আদিম সারল্য আর অসাধারণ পুরনো সংস্কৃতির কাছে পেতে ছুটে আসে দূরান্তের মানুষেরা। রবীন্দ্রপ্রেমীরা মাটির সুর ভালোবাসে। এ বড়ো বিস্ময়। আধুনিকতার সাথে আদিমতার মেল বন্ধন ঘটে বোলপুরে খোয়াইতে, ইউক্যালিপ্টাস আর সোনাঝুরির ফাঁকে ফাঁকে লাল মাটি আর কাঁকরের উপরে আসন পেতে বসা মেলায়। মাটির সুর যাদেরকে এখনো টানে তারা হাজির হয় খোয়াইয়ের হাটে। মাদলের তালে আদিবাসী রমনীদের সাথে অভিযাত্রীরা পা মেলায়। নীরব প্রকৃতির মাঝে এই মিলন ক্ষেত্র বড়ো আনন্দের।  অনেকেই তার ছবি তুলে ক্যামেরাবন্দি করে নিয়ে আসে শহরের কোলাহলে। নিজের মুহূর্তের স্মৃতিটুকুকে ধরে রাখার জন্য বন্ধুদের কাছে হাওয়ার তরঙ্গে ছবি পাঠিয়ে তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সে কি কম পাওয়া! কত কাছে অথচ মাটির কাছাকাছি। মাটির কাছাকাছি পৌঁছানোর মতো একটা দেখার জায়গা। মনের টানে যারা এখানে আসে তারা কেউই খালি হাতে ফেরে না। কারো কারো কেনাকাটার বহর খুব বেশী। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়, কুটুম্ব আর বন্ধুদের জন্যে একটাতো কিছু নিতেই হয়। বেশ সস্তায় মেলে এসব।

এদিকে ঝুমুর আর মাদলের মাখামাখি রোদে ছায়ায়, তখন অন্যদিকে রাস্তা থেকে একটু ভিতরে মেলার আর এক আকর্ষন অপেক্ষা করে আছে। সে বাউলের মেলা। বাউল আর লোক গানের দল দোতারা আর একতারায়, খমকে আর বাঁশিতে, খোল করতাল, ঢোল ডুপকির সুরে তালে গলা মিলিয়ে সোনাঝুরির সোঁসোঁ সুরের সঙ্গে মিলিয়ে এক স্বর্গীয় পরিবেশ রচনা করে। সামনে পাতা থাকে একটা রুমাল বা গামছা। যে যা পারে দু-দশ টাকা দেয়। তাতেই খুশি ওরা। ঝুমুর নাচের দলেও সেরকমই।

একসঙ্গে কয়েকজন গেলে তো কথাই নেই। কাঁকর ঘাসের আসনে বসে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে মাটির সুরে মাটির মানুষের আহ্বান শুনতে শুনতে অগাধ বিষ্ময়ে এক সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া যায়। যা অনেক দিনের বেঁচে থাকার পাথেয় হতে পারে। 

তথ্যসূত্র

১। ক্ষেত্র সমীক্ষা পৌষ মেলা, বসন্তোৎসব