সর্পদেবী মনসা, নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা
বিষহরি পূজা’ই প্রকারান্তরে মনসা পূজা। আমাদের দেশে যেখানেই সাপের ভয় বা সাপের উৎপাত বেশি সেখানেই সাপের দেবী রয়েছে। তার পুজো হয়। নানা লোকাচার পালিত হয় সর্দপদেবীকে কেন্দ্র করে। বাংলায় বিশেষ করে দক্ষিন ও দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে সাপের উৎপাত বেশি। তাই সাপের দেবীর মাহাত্ম নিয়ে লোকাচারও বেশি। এখানে সাপের দেবতা – মনসা ।গ্রামে গ্রামে মনসার থান আছে। সেখানে নিয়মিত মনসার পুজো হয়। আবার বাড়িতেও তুলসী তলার পাশে একটা মনসার ডাল পোঁতা থাকে। সেই মনসার গাছেও মনসা দেবীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। বাংলার বাইরেও সাপের নানা দেবতা আছে। কোথাও নাগরাজ, কোথাও নাগাম্মা। আবার বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা ইত্যাদি আরো কতো নাম। দেবীর মাহাত্মনিয়ে অনেক গল কথা মুখেমুখে প্রচলিত। তা নিয়ে কত গল্প , নাটক সিনেমা হয়েছে। এখনো তা মানুষের কাছে অসীম আগ্রহের বিষয়।
গ্রামের সার্বজনীন মনসা থানে সমবেত হয়ে যে সমস্ত বার ব্রত ও উপবাস গুলির পালন করা হয় তার মধ্যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দশমীতে অনুষ্ঠিত বিষহরি মনসা পূজার ব্রত অন্যতম এক মাঙ্গলিক ব্রত রূপে বিবেচিত হয়।যদিও দক্ষিনবঙ্গে এই একই দিনে দশহরা গঙ্গা পূজারও আয়োজন হয়ে থাকে।
ব্রতগুলি গ্রামীন মহিলাদের অজস্র সংস্কারে আকীর্ণ। প্রতিটি পূজার ব্রতর ন্যায় মনসা পূজার ব্রততেও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সধবা নারীরা এই পূজার ব্রতাচার পালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঠিক পূজার আগের দিন নিরামিষ খাবার রান্না করে থাকে। দশহরা পূজার দিন রান্নার কোনো বাহ্যিক রীতি রিয়াজ বা নিয়ম নাই। ওই দিন দশ প্রকার পুষ্পবতীপত্র, ফুল ও ফলমূলাদি সহ দুধ-কলা ও মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয় বলে এরূপ পূজার নামকরণ দশহরা পূজা রাখা হয়েছে। প্রধানত দুধ-কলা ও চিনি সন্দেশের নৈবেদ্যে পূজা দেয়া এই ব্রতের অন্যতম প্রধান রীতি ও নিয়ম। এই ব্রততে দেবী মনসার সন্তুষ্ট হওয়ার নানান মাহাত্ম্য কথা লোক সমাজে অধিক প্রচলিত আছে। তিনি সর্প কূলের আরাধ্য দেবী। আষাঢ় ও শ্রাবনের পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে আমন ধানের ফলন খুব ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে যেমন ধানে অপরিণত শষ্যের (আগড়ার)পরিমাণ বাড়ে। আবার এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের উৎপাতে মানুষ বেশি অতিষ্ট হয়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যখন মাঠ ঘাটে জলে ভরপুর হয় তখনও এই একই পরিণতি ঘটে। শুধু তাই নয় অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের বিষের পরিমাণ ও তার তীক্ষ্ণতা এতোটাই বাড়ে যে (কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবোড়া) সাপের কামড়ে বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার প্রাগ মূহুর্তে প্রাণ হারায়। তাই বিষধর কাল সাপের কামড়ের হাত থেকে বিরত থাকার অন্যতম এক মানসিক শক্তি লাভের পথ হিসাবে মানুষ বিষহরা মনসা পূজার প্রচলন শুরু করেছিল এমনই কিছু অনুমান করা হয় লোক শিক্ষার অন্দর মহলে। মনসা কালসাপ কূলের প্রধানা রূপে খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে উপশাস্ত্রীয় দেবীপুরাণে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মনসা মঙ্গলের পালাতে মনসার লীলামহিমার ভয়াবহ ঘটনায় তার সেই বাহন কালসর্পের পরিচয় অতি সহজেই মেলে। তাই সেই বাহন স্বরূপ কাল সাপের হাত থেকে জীবন রক্ষার দরুন বিষহরি ব্রত ও পূজার আয়োজন করে থাকে দক্ষিণবঙ্গ তথা অখণ্ড বাংলার নারী সমাজ। ব্রতের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা মূর্তি হলেও প্রকৃত পক্ষে পূজার নৈবেদ্যাদি নিবেদন সমার্পন করা হয় একটি কাটা সিজ মনসার ডালের সন্নিকটে। যেখানে লাল রঙের সিঁদুর দিয়ে রাঙায়িত করা হয়। তার সামনে দুধের বাটি ও কলা নিবেদন করেন গ্রামের মায়েরা। এই সিজ মনসার ডাল পূজার প্রচলন যে ঠিক কবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্যের উপস্থাপন মোটেই সহজ নয়। তবে অধিকাংশ লোক দেবদেবীদের মূর্তি পূজার পূর্বে যেমন তাদের (আটেশ্বর, পেঁচাপেচি, ধর্মঠাকুর) বৃক্ষ পূজারই অধিক প্রচলন ছিল। মনসা পূজার ক্ষেত্রেও এই তথ্য একেবারে অযৌক্তিক নয়। বৃক্ষের মধ্যে বট, অশ্বথ্ব, পাকুর, বেল, তাল, সিজ মনসার বহুল প্রচলিত ছিল বলেই অনুমান করা হয়।
মায়েদের অনেকেই এদিন উপোস রাখে। গ্রামের মন্দিরে আবার অনেকেই গন্ডিও দিয়ে থাকে পরিবারের সদস্যদের কল্যাণার্থে। আবার অনেকে বাড়িতে ব্যাক্তিগত ভাবে সিজ মনসার ডাল লেপন করে সেখানেও পূজা দেয়। আবার অনেকে বলেন এই ব্রততে গঙ্গা ধরণীর বক্ষে পদার্পন করেন। তাই এ দিন গঙ্গা স্নানে দশ প্রকার পাপ খণ্ডিত হয় বলে অনেকে গঙ্গা পূজার ব্রতও পালন করে গঙ্গা স্নান সুসম্পন্নের মধ্যে দিয়ে।
বিষহরা ব্রত পালনকারী যযমান দের প্রতি প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পান্তা খেয়ে পূজার রীতি রক্ষা করে। উনুন জ্বালানোর রীতি নাই। লোক সমাজে পৌরাণিক গল্পের কাহিনীতে বর্নিত রয়েছে যে ওই দিন উনুন জ্বালানো হলে দেবী মনসা তাঁকে স্বপ্নে সাপের ভয় দেখান। এমনকি বাস্তবেও বিষাক্ত কালসর্প এই অপরাধের কারণে দংশনও করতে পারে। তাই সমস্ত দক্ষিণ বঙ্গ জুড়ে বেশ ঘটা করে এই পূজার নিয়ম কানুন, ব্রত ও উপাচার পালন করতে দেখা যায়।
গ্রামের মহিলাদের বেশীরভাগ মায়েরা সর্প দংশনের ভয়ে ভীত হয়ে এই দেবীকে বেশ ঘটা করে পূজা দেয়। কারণ মনসার পালা গানে এই দেবীর চন্দ্রধরের নিকট থেকে পূজা নেওয়ার কৌশল অন্যান্য অঞ্চলে অজানা থাকলেও এদের অজানা নয়। তাই অন্যান্য দেবীর তুলনায় এই লোক দেবীর প্রতি অনেক বেশী ভক্তি বর্ষিত হয়। ভক্তির সঙ্গে হোক বা ভয়ে ভয়ান্বিত হয়েই হোক দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এই নাগদেবী কে পূজা দিয়ে আসছে।
এই ব্রত ও পূজার আয়োজনে কোনো প্রকার মূর্তি পূজা করা হয় না। কিন্তু যাদের বাড়ির আরাধ্য দেবী মনসা তাদের বাড়িতে বেশ ঘটা করে পূজার আয়োজন করা হয়। মূলত ঠাকুর ঘরের এক কোণে বা তুলসী মন্ডপের পাশে একটা সিজ মনসার কান্ড কে কাদার মধ্যে পুঁতে সেখানে এই পূজার যাবতীয় উপাচার গুলির আয়োজন করা হয়। কোনো কোনো জায়গায় গ্রামের সার্বজনীন মনসার থানে পূজার আয়োজন করা হয় পূজার উপাচার গুলি নিয়ে। সিজ মনসার কান্ড কে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। তার সামনে ধূপ, দ্বীপ, চন্দন, ফুল ও ফল মূলাদি, মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয়। যখন সমস্ত গ্রাম জুড়ে প্রচন্ড সাপের উৎপাতের স্বীকার হয় তখন গ্রামের সার্বজনীন থানে সকলে একত্রিত হয়ে গন্ডি দেয়, ছলনা করে, মানত করে, পূজা দেয়, সিন্নি -ষষ্ঠী দেয়, পুরোহিত ডেকে মঙ্গল ঘট বসিয়ে পূজার শান্তি জল দেবীর চরনামৃত স্বরূপ গ্রহণ করে। দশহরা পূজার এই পূন্য লগ্নে বহু থানে মনসার পালা গানের আয়োজন করা হয়।অনেকে আছেন যারা আর্থিক দিক থেকে সবল তাঁরা ব্যক্তিগত মনসার গানের দল বায়না করে। সমস্ত পরিবারকে সাপের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য গৃহস্থরা এই পূজার আয়োজন করে। দক্ষিণ বঙ্গের বহু গ্রামাঞ্চল রয়েছে যেখানে নারী সমাজের বিশ্বাস ইচ্ছাধারী নাগদেব দেবী আজও জগতে বসবাস করে। এদের পূজার আয়োজন হয় দিন,বার ও তিথির পুন্য মূহুর্তে।ভক্তরা নাগদেবী রূপী এই সাপের সেবনের জন্য পাত্রে ভরে দুধ ও কলা দিতে দেখা যায় দু’এক জায়গায়। মনসার মৃন্ময়ী মূর্তির পিছনে এদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে অনায়াসে এরা সেই দুধ সেবন করে আবার গর্তে ঢুকে যায়। গ্রামের মানুষ বলেন এরা কারো কোনো ক্ষতি বা অনিষ্ট করে না।বরং বহিরাগত শত্রু দের হাত থেকে গ্রামের মানুষ কে রক্ষা করে আসছেন বহু বছর ধরে। তাই মনসা দেবী শুধুমাত্র আর দশটা দেব দেবীদের মত ঠিক তা নয়। তিনি গ্রামের মানুষের থেকে একদিকে যেমন পূজা নেন বিনিময়ে গ্রামের মানুষের রক্ষার ভার ও তিনি বহন করেন। তাই শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে মনসা দেবীকে কেন্দ্র করে বহু প্রকার বার, ব্রত ও উপাসনার নিয়ম রয়েছে।
দক্ষিনবঙ্গের গ্রাম সমাজে পূজনীয় সর্পের দেবী মা মনসা
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে আর দশটা লোক দেবদেবীর মধ্যে বিষাক্ত সাপের থেকে ত্রাণের একমাত্র দেবী রূপে মা মনসার মূর্তি সবচেয়ে বেশি পূজিত হতে দেখা যায়। এই মনসা মূর্তির আচ্ছাদিত পোশাক একদিকে যেমন শ্বেতবস্ত্র পরিধানে তিনি বিশ্ব শান্তি প্রদায়িনী, জগতের কল্যাণ রূপী, জগতের ধারক বাহকের স্নেহ বাৎসল্য রূপী মমতাময়ী জননীর এক ভাব মূর্ত প্রতীক স্বরূপ, ঠিক এর বিপরীতার্থে এই দেবীর এক রুদ্র ও বিনাশী ভাবমূর্তি রয়েছে যা অত্যন্ত ভয়াল ভয়ঙ্করী। শাস্ত্র অনুসারে কাল বিষাক্ত সর্প এই দেবীর অন্যতম প্রধান বাহন। তাই এই দেবীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অভক্তির পরিণতি বিষাক্ত সাপের কামড়ে প্রানের বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয় এমন কিছু কাহিনীর কথা প্রচলন রয়েছে এই অঞ্চলের সামাজিক রীতি নীতিতে। তাই এই দেবীর অনুগত ভক্তদের বেশিরভাগ ভক্তি অপেক্ষা ভয়ে এই দেবীকে বেশি পূজা দেয়। ফলতঃ জনপ্রিয়তা অতি সহজেই অর্জিত হয়ে যায়। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থানে আর অন্যান্য দু দশটি দেবদেবীর সঙ্গে একদিকে যেমন তাঁর দেবী মূর্তি অনুগত ভক্তদের থেকে পূজা পেয়ে আসছে আবার অজস্র ব্যাক্তিগত মন্দির বা থান রয়েছে যে মন্দিরের আরাধ্য লৌকিকদেবী রূপে শুধুমাত্র তারই দেবীমূর্তি স্থান পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের লোক সমাজে মনসা দেবীর পত্তন, সময়কাল, লীলার মাহাত্ম্য কথা বিস্তারিত তথ্যে নিম্নে বর্ণনা করা হল ।
মনসা দেবীর সৃষ্টি রহস্য ও দক্ষিণাঞ্চলে তার পূজার পত্তন
মঙ্গল কাব্যের যে সমস্ত দেবী, দেবতারা বাংলার বুকে সুদীর্ঘদিন ধরে পূজিত হয়ে আসছে এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ভয়াল ভয়ঙ্কর দেবী হিসেবে মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মা মনসার নাম। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে তিনি নাগকুলের মূল আধিষ্ঠাত্রী সর্পকুলের প্রধান দেবী রূপে জগতে প্রতিষ্ঠিত। মনসা আদি বৈদিক যুগের বা পুরাণের মহিমান্বিত বা রামায়ণ অথবা মহাভারতের যুগের মানুষের আরাধ্য কোনো দেবী নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শাস্ত্র গুলি ভালো করে অধ্যায়ন করে স্পষ্ট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে সেকালে কেবলমাত্র বাসুকি নাগ ও পরবর্তীতে কৃষ্ণের কালে কালীও নাগ নামটি ছাড়া আর অন্য কোনোও বিশেষ সর্পের দেব দেবতার নাম পুরাণাদি গ্রন্থগুলিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগ কুলের অধিষ্ঠাতা দেবতা বাসুকি হলেন নাগেদের রাজা। সাংস্কৃত শাস্ত্র ও উপপুরানে বলা হয়েছে নাগরাজ বাসুকির ভগিনী হল এই মনসা দেবী। সর্পকূলের দেবী নাগিনী নামটির দ্বারা এই সীদ্ধান্তে অনুমান হওয়া যায় যে ইহা আধা নর ও আধা সর্পের এক ভয়ঙ্কর মূর্তি বিশেষ কোনো রূপ অথবা ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান কোনো বিশেষ বিষধর সর্প হবে যার মধ্যে রূপ পরিবর্তন করার ইচ্ছাশক্তি আছে । ইতিহাসের পাতায় যা স্কাইথীয় নামে পরিচিত। কিন্তু মনসা নামটির সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে জগতে প্রচলিত হয়েছে তা গভীর অনুসন্ধানের একটা বিষয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে তাহার নাগ পরিবার, নাগরাজ বাসুকির ভগিনী তিনি তাই সেই কারনে দেবীর সঙ্গে সর্পের এই রূপ সম্পর্ক। যদিও শৈবপুরাণে দেবাদিদেব মহাদেবের সন্নিকটে যে বিষধর সর্পটির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে উদয় নাগ উহাতে সর্প দেবতাদের অনুচর স্বরুপ পূজিত হয়ে এসেছে। ব্যাক্তিস্বতন্ত্র রূপে কোনো দেবতা বা দেবী রূপে অধিষ্ঠানের কথা পুরাণের কোথাও বা শাস্ত্রে উল্লেখ নেই। বৈদিক যুগের মানুষ দেবীমূর্তি আরাধনার পরিবর্তে নিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান, যাগযজ্ঞ ও প্রকৃতি পূজার প্রতি বেশি মনোযোগী হতেন। বেদ, পুরাণে স্পষ্ট তার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে – ‘ধ্যায় শূন্য অহর্নিশম’। অতএব এত্যদ্বারা এই সত্য প্রমাণিত হয় যে মনসা পূজার সৃষ্টি বিগত আটশো নয়শো বছরের মধ্যবর্তী কোনোও এক সময় হবে, ইহার পূর্বে নহে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও পর্যন্ত যে কয়টি পৌরাণিক মনসা মন্দির ও মনসা দেবীর খোদায় করা মূর্তির সন্ধান পেয়েছে ইহাদের অধিকাংশ মূর্তি সর্বোচ্চ সেন বংশের রাজাদের আমল পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সেনরাজ বিজয় সেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত মনসা মূর্তির কয়েকটি প্রমাণ ও পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ ইহার থেকে আরো বিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে এই দেবীর জগতে অধিষ্ঠান হলেও সত্য হতে পারে কিন্তু তাহার এক কাঁচা পূর্বে নয়। কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা নামটির আদি সৃষ্টি বা উৎপত্তি ঠিক কবে এ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত শাস্ত্র অথবা পুরাণ গুলির একটিতেও মনসা নামটি খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বপ্রথম সাংস্কৃত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, দেবী পুরাণ ও দেবী ভাগবত উপপুরাণে মনসা নামটির সহিত সাক্ষাৎ লাভ করা যায়। এই সমস্ত গ্রন্থের প্রতিটির রচনা খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর এক কাঁচাও পূর্বে নয়।
মনসা শব্দটি ভারতীয় অর্বাচীন অনার্য ভাষা গোষ্ঠী হইতে এসেছে । মনসা নামটি অলুক সমাস। এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন নামটি এসেছে তো এসেছে কোথা থেকে।
দক্ষিণ ভারতের লোক সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দ্রাবিড় সভ্যতার নিম্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা আজও বহু সর্পের দেব দেবীর পূজা করে আসছে। যেমন- নাগাম্মা, বালাম্মা, মুদামা ইত্যাদি। নাম গুলি শুনে মনে হয় দাক্ষিণাত্য তেলেগু ভাষায় রচিত বিশেষ সর্প রূপের জাগ্রত দেবীই হবে। নাগাম্মা মা সর্প ও বালাম্মা ইহার কন্যা। প্রতিটি সর্পদেবীর আঞ্চলিক ভেদে নানান মাহাত্ম্যও রয়েছে। যেমন নাগাম্মা দেবীর কাহিনী পুতুল নাচ, সামাজিক পালাগানের মধ্যে দিয়ে আজও বর্ণনা করে চলেছে অন্ধ্রপ্রদেশের একশ্রেণীর স্ত্রী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দল। শুধু অন্ধ্রে নয় চেন্নাই সহ দক্ষিণের সমগ্র গ্রামাঞ্চল তথা শহরাঞ্চলেও বহুজাতিক সর্পের দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে।
কর্নাটকের মহীশূরে মুদামা নামে এক বিশেষ ধরনের সর্প দেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে আজও। সমগ্র দক্ষিণের নারী সমাজ আজও দেবী রূপে ইহাকে পূজা করে। দাক্ষিণাত্যে প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভাস্কর্য খোদায় করা এই দেবীর বহু মূর্তির সন্ধান পেয়েছে। এই সর্প দেবীর মূর্তি অন্যান্য সর্পদেবীর মূর্তির তুলনায় একটু আলাদা। এই মূর্তির বিশেষত্ব হলো ইহার উদরের নিম্ন ভাগ সর্পাকৃতি ও উদর থেকে মস্তক পর্যন্ত কন্যাকৃতি। অর্থাৎ আধা নাগিনী ও আধা নারী মূর্তি বিশেষ মূর্তি।
আবার নাগাম্মা, বালনাগাম্মা, মুদামা ভিন্ন দক্ষিন ভারতের কানাড়া প্রদেশে মঞ্চাম্মা নামে এক দেবীর পূজার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। ইহার মাহাত্ম্য হল ইহার কোনো মানবী রূপী দেবী মূর্তি বা রূপ নাই। মনে মঞ্চাম্মা এক অদ্ভুত অদৃশ্য সর্পের নাম। এই সর্পটি স্বর্গের নাগ জাতিগোষ্ঠীর একাংশ বলে মনে করা হয় বলে সর্পটির উপর দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই মঞ্চাম্মা দেবীর পূজার আয়োজন করে ভক্তরা। বল্মীক রূপ এক স্তুপ বা ঢিবির সামনে পূজার নৈবেদ্যাদি ফুল,পুষ্পচন্দনে সুসজ্জিত করে পূজা দেওয়া হয় এই দেবীকে।
এখন অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন বাংলার অনার্য সভ্যতার ভাষাগোষ্ঠীর শব্দভাণ্ডারে সৃষ্ট এই মনসা নামের সঙ্গে ইহাদের মিল কতখানি। উপরিউক্ত যে সর্প দেব দেবীদের নাম গুলি দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটি নাম দেখে ও উচ্চারন বুঝে স্পষ্ট বলা যেতে পারে ইহাদের প্রতিটি নাম স্ত্রী লিঙ্গ অর্থাৎ দেবীমাতা। তেলেগু, তামিল, বা কন্নড় যে ভাষায় দেবী গুলির নাম যে ভাবেই সৃষ্টি হউক না কেন প্রতিটি দেবীর নামের উৎপত্তি গত ও ব্যাকারণ গত মাধূর্য আছে। মনে মঞ্চাম্মা দক্ষিন ভারতের সর্পের দেবীর নাম। আবার আমাদের বাংলার সর্পের দেবীর নাম মনসা। দক্ষিণ ভারতের এই দেবী বাংলাদেশের বুকে নাম একটু বদলে মঞ্চাম্মা’থেকে মনসা আম্মা রূপে পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব নহে। শুধু মঞ্চা-এর চা এর পরিবর্তে সা শব্দটি উচ্চারণ করিলে মনসা উচ্চারণ হতে পারে। এখন বিচার করা প্রয়োজন যে, যদি এই তথ্যের ভিত্তিতে মনসা নামটি এসে থাকে তবে এই নামের বার্তা বাহক কে বা কারা ? একমাত্র সর্পদের নিয়ে খেলা দেখাতে দেখাতে বেদিয়া সাঁপুরের দল এর বার্তা বাহক হতে পারে। কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট করে বলা যায় না যে এই তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। যদিও এককালে বেদে সাপুড়ের দল সারা দেশে ভ্রমণ করতে করতে সাপ খেলা দেখাত।
আবার নাগাম্মা রুপী দক্ষিন ভারতের সর্প দেবীর সঙ্গে মনসা দেবীর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার করে দেখলে কিছু কিছু মিল ও অমিল পরিলক্ষিত হয়। নাগাম্মার প্রকৃত রুপ যেহেতু আধা নাগিনী ও আধা কন্যা তাই মনসার সঙ্গে ইহার পার্থক্য রয়েছে। শুধু তাই নয় বৈসাদৃশ্যের দিক দিয়ে আরোও কিছু কিছু পার্থক্যও রয়েছে। মনসা মঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও দক্ষিণ ভারতের এই প্রতিটি সর্প দেবীর মাহাত্ম্য কাহিনীও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এখন দক্ষিনবঙ্গে মনসা ও তার অন্যতম প্রধান বাহন সর্পের কয়েকটি লোক বিশ্বাস সম্পর্কে দেওয়া হল। যেগুলি খুব আন্তরিক ভাবে মান্য হয়ে আসছে কয়েক দশক আগে থেকে।
মনসার বাহন সাপ সম্পর্কে দক্ষিনবঙ্গে গ্রাম্য সমাজে প্রচলিত কিছু যাদুকরী লোকবিশ্বাস
1. সর্পের দেবী মনসার স্বপ্নবরে ঘর সংসার সুখী হওয়ার জন্য গুপ্তধন, রত্নসম্পদের সুযোগ সন্ধান সম্পর্কিত কিছু আবেগপ্রবন লোক গল্পের প্রবাদ প্রচলন এই সমাজে রয়েছে। সর্পের মাথার মণি সাত রাজার ধন। তাই তাকে প্রসন্ন করতে পারলে অনেক বেশি রত্ন সম্পদের মালিক হওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় বুক বাঁধে নারীপুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সবাই।
2. দেবী মনসাকে দুধ-কলা ও অন্যান্য নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলে তার কৃপায় নিজদের শাঁখা সিঁদুর সতীসাবিত্রী ও বেহুলার ন্যায় চির অক্ষয় থাকবে এরকম একটা কল্পনাও সচরাচর করা হয়।
3. বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর দেহে পুনরায় প্রান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র এই দেবীর। মনসামঙ্গলে তার রূপ চিত্রায়ন হয়েছে। তাই অন্যান্য লোক দেবীর পূজা অপেক্ষা এই দেবীর পূজায় বাস্তবিক জীবন সুস্থ সবল ও বিপদমুক্ত থাকার একটা মানসিক তৃপ্তিও অনুভব করা হয়।
4. বিষধর সর্পের কোনো প্রকারে একবার মৃত্যু ঘটলে কোনো কোনো জায়গায় তার বিষদাঁত ভেঙে তা সংগ্রহ করে রাখার রীতি নীতি রয়েছে। পরে ওই বিষদাঁত টি মাদুলি ও কবচে ভরা হয়। এই মাদুলি ও কবচ বয়োঃজ্যাষ্ঠ মানুষদের বাতের ব্যাথা হলে তাকেই পড়িয়ে দেওয়া হয়। বাতের ব্যাথা থেকে চীর মুক্তি লাভের আশায় আশায়।
5. যারা নিতুই বিষধর সর্পের স্বপ্ন দেখে, বহুমূত্র ব্যাধির স্বীকার, পরিণত কৈশোরেও বিছানায় ঘুম ঘোরে মূত্রত্যাগ করে তাদের অধিকাংশই সাঁপুরে, বাজিকরদের স্মরণাপন্ন হয়। বাজিকরেরা যখন গ্রামে গঞ্জে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত তখন তাদের ঝোলাতে নানান রোগ নিরাময়কারী ঔষধের সম্ভার থাকত। প্রতিটি রোগের মাদুলি ও কবচের ব্যবহার। অর্থাৎ এই সুযোগে সাঁপুরে বাজিকরদের দল ঔষধ বিক্রি করার একটা ফাঁদ পেতে বসে।
6. প্রতিটি বাড়িতে একটি করে বাস্তুসাপ থাকে। এই সাপ কারো ক্ষতি করে না। গ্রামের প্রতিটি মানুষ বাস্তুর মঙ্গল কামনার্থে এই সাপের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
7. কোনো সাপের একবার মৃত্যু ঘটলে তাকে দাহ করার রীতি দক্ষিনবঙ্গের প্রায় সর্বত্র প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে বাস্তুসাপ মারা গেলে অনেক গৃহস্থ ভক্তরা ক্ষৌরকর্ম, শ্রাদ্ধ শান্তি ও মস্তক মুণ্ডনও পর্যন্ত করে থাকে। তবে কারো আঘাতে কোনো বিষধর সর্পের মৃত্যু ঘটলে মূলত তার বংশোদ্ভূতদের দ্বারা প্রতিশোধ নেওয়ার এক ভৌতিক লোক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস বিশেষত তার চোখ ও স্মৃতিতে ওই আঘাতকারী ব্যাক্তির প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়ে যায়। তাই সাপের মুখমণ্ডল দাহ করে দিলে এর থেকে চীর মুক্তি পাওয়া যায়।
8. রাত্রে এলোমেলো বিছানায় বিষধর সাপের কামড়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। তাই গ্রামের মানুষের লোক বিশ্বাস মনসা ও তার স্বামীর নাম স্মরণ করে বালিশে ‘আস্তিমাতা ‘টোকা দিলে আর এরূপ অনিষ্ট ঘটে না।
9. বিনের আওয়াজে মনসার বাহন কালসর্প খুবই নেশা গ্রস্থ হয় এমন এক অদ্ভুত ধারণা আজও বেদেদের একদল গ্রামে গঞ্জে ঘুরে খেলা দেখিয়ে প্রমাণ করে বেড়ায়। শুধু তাই নয় ধূনার গন্ধেও সে ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্যমূহুর্তে কোনোরূপ ধূনা ব্যবহারের রীতি নাই। এসবের ব্যবহারে তিনি রুষ্ট হন বলে পুরোহিতদের একদলকে বলতে শোনা যায়।
10. হেঁতালের গন্ধে কালসর্প ঝিমিয়ে পড়ে। তাই তার পূজার পূণ্য লগ্নে হেঁতালের ব্যবহৃত ছড়ির পরিবর্তে কঞ্চির ছড়ি ব্যবহার করে কাঁসা বাজানোর রীতি রিয়াজ আজও কমবেশি চোখে পড়ে।
11. সাপে কাটা রোগীর দেহে প্রাণ বিয়োগ হলে সেই দেহে কেবলমাত্র মনসার সাধনায় সিদ্ধ গুনীন, বদ্যি ও ওঝারাই প্রান ফিরিয়ে আনতে পারেন- এই কথা আজও নিরক্ষর মানুষের মনে বিশ্বাস। ওঝা ও গুনীনরা এই দেবীর আশির্বাদ ধন্য মানস বা বরপুত্র। তাদের কাছে সাপে কাটার যাবতীয় ঔষধের সম্ভার রয়েছে ।তাই গ্রামের মানুষ বিজ্ঞানের ধারাপাত অপেক্ষা মনসা ও তার আশির্বাদধন্যা ওঝা, বদ্যিদেরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
12. সর্পে দংশিত রোগীরা মারা গেলে তাদের পোড়ানোর রীতি দক্ষিনবঙ্গের লোক সমাজে নাই। সমাধি দেওয়া হয় এই কারনে রোগীর দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায়, বিশ্বাসে ও কল্পনায়।
13. লোক সমাজে প্রবাদ প্রচলন রয়েছে যে সাপে কাটা রোগীদের প্রান দেহের মধ্যে থেকে যায়। বিষের জ্বালায় নীল হয়ে যায় সমস্ত শরীর। শ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য মৃতদের আগুনের সৎকারে মৃতদেহ চীর ভষ্মীভূত হয়ে যায় শ্মশানে। কিন্তু সাপে কাটা রোগীদের মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। তার একটি মাত্র কারন কোনো সহৃদয় ওঝা বা গুনীনের সান্নিধ্যে এসে যদি আবার পুনঃজন্ম লাভ করে এমন কিছু কাঙ্ক্ষিত আশায়।
14. সাপের বিষ থেকে যে (SAVS) স্নেক এন্টি ভেনম সিরাম তৈরি করা হয় তা দিয়ে সাপে কাটা রোগীর প্রান বাঁচানো সম্ভব। তাই একটি বুদ্ধিজীবী মানুষের চিন্তা ভাবনায় বিষাক্ত সাপকে হত্যা না করে বরং তাঁকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
15. সাপ বংশের ধারক বাহকের প্রতীক। নিঃসন্তান মাতাপিতা একটি সন্তান কামনায় এই দেবীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে ভক্তি দিয়ে পূজা করে, ছলনা দেয়, গন্ডি দেয় ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
মনসার বন্দনা গান
গ্রামের সার্বজনীন মন্দির গুলির মহোৎসব পর্বে মনসা দেবীর উত্থান ও পূজা পার্বণের পুণ্য লগ্নে সমগ্র উনবিংশ, বিংশ শতাব্দী থেকে আজও গ্রামের সধবা মহিলাদের একদল সমবেত কণ্ঠে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মঙ্গল ঘট বসিয়ে এক সুন্দর লোক সুরের আঙ্গিকে মনসার বন্দনা গান গায় দশহরার ব্রত পালন করে। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থান বা মন্দিরে সমগ্র গ্রামের মাঙ্গলিক লোক দেবী রূপে দীর্ঘকাল যাবৎ ভক্তদের কাছে থেকে মনসা পূজা নিয়ে আসছে। তাই বৎসরান্তে এক দুই বার তার মহিমা কীর্তন পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে মানসিক সুখ শান্তি অনুভব করে দক্ষিণ বঙ্গে এই দেবীর অনুগত ভক্তরা। লোক সঙ্গীতের আর অন্যান্য শৈলীর মতো মনসার পাঁচালীগান বা অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে যাত্রা পাঁচালী পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে তারা দেবীর গুনকীর্তনে আনন্দে মাতে।
মনসার পাঁচালী গান সম্প্রদায়ের শিল্পীরা দেবী মাহাত্ম্য কীর্তনের পালায় অনুপ্রবেশের পুণ্য মূহুর্তে পুরুষ ও মহিলা চরিত্রের সমস্ত নরনারীরা সর্বপ্রথমে ‘আশাবারী’ খনন করে দেবীকে আনয়ন করে। লোক সমাজের প্রতিটি গৃহস্থের ধারণা এই সময় মনসা দেবী জাগ্রত হয়ে তার অনুগত ভক্তদের কৃপা করেন। সেই কৃপা বর্ষনের সামান্য করুণা লাভের আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের একদল গন্ডি দেয় থানের চতুর্দিকে। অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পবিত্র সঙ্গীতানুষ্ঠানেও কমবেশি উপস্থিত হয়। সেই পুন্য ক্ষনে শিল্পীরা মহানন্দে মনসা বন্দনা পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে দেবীর চরণে নিবেদন রেখে সকলে উচ্চৈঃস্বরে গাইতে থাকে ;
জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো ।
বন্দনা করি মাগো মা মনসার চরণে।।
তার পরে বন্দনা করি মহাদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি ভগবতীর চরণে।জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি মা কালীর চরণে। জয় জয় মা মনসা
ও মা – – –
মাগো আকাল বন্দন পাতাল বন্দন বন্দনা করলাম,
আমি গুরুদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি তেত্রিশ কোটি দেবতা। (জয় জয়)
সামাজিক গুরুত্ব
এখন অনুসন্ধান করা প্রয়োজন মনসা দেবীর এই বাস্তবিক পূজার সামাজিক গুরুত্ব কতখানি। সেক্ষেত্রে দেখা যায় দক্ষিণ বঙ্গে অধিকাংশ গ্রামগুলির সার্বজনীন থানে মনসা দেবীর মূর্তি পূজার একটা বেশ বড়সড় রীতি রিয়াজ পালন করা হয়ে আসছে বহু পূর্বাপুরুষ ধরে। যদিও সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব (পঞ্চনন্দ), বনবিবি, শীতলা, লক্ষ্মী, কালি, চণ্ডী, বারা ঠাকুর সহ আরো আট দশটা দেব দেবীকে পূজা করে গ্রামের মানুষ। কিন্তু তার সত্বেও সার্বজনীন মন্দিরের বাইরেও এমন কিছু কিছু থান বা মন্দির রয়েছে যেগুলোতে শুধুমাত্র মনসা দেবীর মূর্তি ব্যাতিত আর অন্য কোনো দেব দেবীর মূর্তি পূজা করা হয় না অর্থাৎ ব্যাক্তিগত ভাবে শুধুমাত্র মনসা দেবীর জন্য বহু মনসা মন্দির রয়েছে। সেগুলি মনসার থান নামে পরিচিত। দক্ষিণ বঙ্গের চাষাবাদ যুক্ত পল্লী গ্রামাঞ্চল গুলিতে এ জাতীয় মনসা মন্দির সচরাচর বহু পরিমাণে দেখা যায়। কোনো স্থানে একবার মনসা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে সেই স্থান দিনের পর ভক্তদের সমাগম বাড়ে কিন্তু কমে না। শুধু তাই নয় সেই মন্দির নির্মাণের উপাদান প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি হলেও দিনের পর দিন অজস্র ভক্তের গুপ্ত ব্যাধি তথা নানান রোগ নিরাময় ও অন্যান্য বহু সুখ সমৃদ্ধির মূলে দেবীর মহিমাকে দায়ী করে তাঁকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানান গহনাদি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। পাড়ার বয়স্ক মোড়ল মতিব্বরদের উপস্থিতিতে সকলকে সাক্ষী করে ব্যাক্তিগত জায়গায় সৃষ্ট পূজনীয় স্থানকে মনসা দেবীর মন্দিরের নামেই উৎসর্গ করে জমির মালিক পক্ষ। এরপরে ধুমধাম করে জাগ্রত করা হয় পুরোহিতের পূজার নানান সাংস্কৃত মন্ত্রে। গ্রামের কুমারী, সধবা ও বিধবা মহিলারা প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যায় এইসব থানে বা মন্দিরে ভোগ লাগাতে শুরু করে।
বহু ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ মনসা দেবীর থানের সন্নিকটে রয়েছে সিজ মনসার গাছ। এই গাছকে দক্ষিণাঞ্চলের মনসা ভক্তদের একাংশ স্বয়ংসিদ্ধ মনসা দেবীই জ্ঞান করে। বহু স্থানে কিছু পুরানো মনসা মন্দির রয়েছে। যেখানে সিজ মনসার গাছ গুলি প্রচণ্ড বড় এবং তার নিচের অংশ গুঁড়ির আকারে পরিণত হয়েছে। তাই মনসা দেবীর মুর্তি পূজার সঙ্গে সঙ্গে সীজ মনসার ডাল পূজার প্রচলনও রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মনসা ভক্তদের একদল অনুগত ভক্তরা বলেন যে সমস্ত গৃহে মনসা মূর্তি নাই তাঁরা সীজ মনসার কান্ড কাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যদি পূজা দেয় তবে সেই পূজাতেও এই দেবী সন্তুষ্ট হয়। মনসা রূপী এই সীজ মনসার ডালের সামনে পূজার নানান নৈবেদ্যাদি সাজিয়ে পূজার আয়োজন করা যেতে পারে। বস্তুত মনসা মূর্তি ও সীজ মনসার কান্ড পূজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দী হতে পল্লী বাংলার গ্রামাঞ্চল গুলিতে গৃহস্থের নিজের আরাধ্য দেবীর পূজার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মনসা। এই দেবীর ভাক্তাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়তার যে কারণ গুলি মানা হয় তা বিস্তারিত তথ্যে উপস্থাপন করা হল;
1. অখণ্ড বাংলায় আর দশ বিশটি লৌকিক দেবদেবীর মতো খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে মনসা দেবীর উত্থান হয়েছিল সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গ তথা বাংলার লোক সমাজে। প্রতিটি লোক দেব দেবীর বাহনের ন্যায় এই দেবীর প্রধান অনুচর কাল বিষাক্ত সর্প। যার কামড়ের হাত থেকে রক্ষার্থে অতি সহজেই তার পূজার জনপ্রিয়তা কয়েক দশকের মধ্যে তুঙ্গে উঠে যায়। তার ভক্তরা স্বেচ্ছায় নয় বরং ভয়ে ভয়ে দেবীকে বেশি পূজা দেয় কেবলমাত্র কাল সর্পের কামড়ের হাত থেকে সপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রক্ষার্থে।
2. প্রতিটি লোক দেবী দেবীর উত্থানের পিছনে একটি মহান উদ্দেশ্য থাকে। গ্রামের মোড়ল মতিব্বরদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সব দেব দেবীর মূর্তি রাখার প্রধান উদ্দেশ্য বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ থেকে সমগ্র গ্রাম কে রক্ষা করা। অনুরুপ কালসর্পমূর্তি বিশেষ মনসা দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি প্রতিষ্টার পিছনে এটাই মহান উদ্দেশ্য।
3. শিবের অসাধ্য হাম, বসন্ত, গুটি বসন্তের মতো কতকগুলো রোগের প্রকোপে অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গ্রামের পর গ্রাম মড়ক দেখা দিত। যার ফলশ্রুতিতে উজাড় হয়ে যেত সমগ্র গ্রামের নিরপরাধী মানুষ। এই সমস্ত রোগের কোনো চিকিৎসা তো ছিলই না বরং বলা হত শীতলা, মনসা ও বিবি মায়ের মতো কিছু দেব দেবীর ব্রত ও পূজা পার্বনের কর্মকাণ্ডে ভুল ত্রুটি হলে তার পরিবর্তে রুষ্ট হয়ে দেবদেবীরা এসব অনিষ্ট দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করেন। তাই ভক্তি সহকারে ধুমধাম করে তাদের পূজা ও সন্তুষ্টিতে এহেন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এমন ধ্যান ধারণায় শীতলা বনবিবির ন্যায় মনসার ও সামাজিক গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
4. মনসা ভয়াল, ভয়ঙ্কর সর্পের দেবী রূপে জগতে পূজিতা হয়ে আসছে। কিন্তু মনসা মঙ্গল কাব্যের একেবারে শেষ মূহুর্তে আমরা এই দেবীর একটু বিপরীত চরিত্র খুঁজে পায়। চাঁদ বনিকের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কাহিনী বঙ্গের কোনোও নারীর অজানা নয়। বেহুলার সতীত্ব ও সত্য বচন রক্ষার্থে চাঁদ সওদাগর মনসাকে বাম হাতে পূজা দেয়। চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার পরিবর্তে মনসা যখন সন্তুষ্ট হয়ে লক্ষীন্দর সহ ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিল, তার প্রিয় বন্ধু শঙ্কর গারুরীর জীবন ফিরিয়ে দিল, সপ্ত ডিঙ্গার প্রতি ডিঙ্গা জলে ভাসিয়ে দিল এবং মহাজ্ঞান মন্ত্র সহ হাতি শালের হাতি, ঘোড়া একে একে সব ফিরিয়ে দিল এসমস্ত ঘটনায় আমরা কাহিনীতে আমরা মনসার ভক্ত বাৎসল্য রূপ খুঁজে পাই। সেই হারানো কাঙ্ক্ষিত সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি পুনরায় ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় দক্ষিণ বঙ্গে মনসার দেবীর পূজা খুবই শীঘ্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
5. মনসার প্রধান অনুচর কাল সর্প। যা বংশবৃদ্ধি ও বংশগতির ধারাবাহিকতার অগ্রগতির বিশেষ প্রতীক। স্নেহ বাৎসল্যময়ী এক পুত্র সন্তানের বা কন্যা সন্ততির জননী হওয়ার আশা বা বাসনা প্রতিটি সধবা রমনীর মনে থাকে। সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা বেদনায় সে মনসার কাছে আকুণ্ঠ ভরে প্রার্থনা করে শুধুমাত্র একটি পুত্র বা কন্যা পাওয়ার আশায়।
6. দেবী ভাগবত বা দেবী পুরাণে দুই হিন্দু দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের প্রধান বাহন শ্বেত হংস। এই দুই দেবীর একদিকে মা স্বরস্বতী ও অন্যদিকে মা মনসা। যদিও দেবী স্বরস্বতী বৈদিক যুগের সুরের আরাধ্য দেবী। তার প্রধান বাহন হংস হলেও এযুগের লোক দেবী মনসারও প্রধান বাহন হংস। হিন্দু সম্প্রদায়ের আর দশ বিশটি দেব দেবীদের ভিন্ন ভিন্ন বাহন দেখা গেলেও শ্বেত হংস সচরাচর নম্র, ভদ্র ও শ্বেতশুভ্র শান্তির পথিক। পঙ্কিল সলিলে হংস যেমন তার প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু গ্রহন করে অপ্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু পরিত্যাগ করে। তৎরূপ ভক্ত বাৎসল্যময়ী এই মনসা ভক্তদের মন কেই ভালোবাসে, কোনো পূজার বাহ্যিক আড়ম্বরে নয়। তাই তার ভক্তদের একাংশ বিনম্র ভক্তি ও শ্রদ্ধায় তাঁকে পূজা করে।
7. দক্ষিণাঞ্চলের লোক সঙ্গীতের আসরে এক শ্রেণীর সঙ্গীতজীবি সম্প্রদায়ের কাছে এই দেবীর গুরুত্ব অসীম। মনসামঙ্গল কাহিনীর মূল মাহাত্ম্য কথা মনসার গান আজ বাংলার কোণায় কোণায় প্রচলিত রয়েছে। পূর্বে এই পালাগান সিঙ্গেল পাঁচালির মতো করে গান ও অভিনয়ের প্রথা প্রচলন থাকলেও বর্তমানে শ্রোতাদেরকে রসাপ্লুত ও দৃষ্টিগোচরে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য যাত্রাপাঁচালির প্রচলন শুরু হয়েছে। এহেন লোক শিল্পীরা বছরে প্রায় সত্তর, আশি, এমনকি একশো পালা পর্যন্ত মনসা, শীতলা ও বনবিবির গান করে তাদের সংসার খরচ বহন করে আসছে। তাই এদিক দিয়ে এই দেবীর সামাজিক গুরুত্ব অনেক খানি।
গ্রন্থঋণ :-
বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস – ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য।
সুন্দরবনের লোকদেবতা – ড . দেবব্রত নস্কর।