সভ্যতা ও সঙ্গীতের বিকাশ – প্রশেন রায়
পৃথিবীর মানব সভ্যতার অগ্রভাগে তথা বিকাশ বিষয়ে নানা গবেষণার ফল স্বরূপ সূদুর অতীত থেকে চলমান যুগ পর্য ন্ত মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাস আজ আমাদের কাছে সম্পূর্ন অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। যেহেতু এই সকল গবেষণার মূল ভিত্তি বিজ্ঞান, তাই অতীত সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারনা ও সংস্কারের অবলুপ্তি ঘটেছে । আজকের মানুষ পৃথিবীতে সমাজ জীবনের বিকাশ সম্পর্কে একটা নিটল ও যুক্তি সম্মত ধারনা অর্জন করতে সমথ© হচ্ছেন। পৃথিবীতে সঙ্গীতের ইতিহাস সুপ্রাচীন। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে ধাপে ধাপে তার বিকাশ ঘটছে ফলে সমাজ জীবনকে বাদ দিয়ে শুধু মাত্র সঙ্গীতের বিকাশ বিষয়ক কোন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয় আবার সঙ্গীত বলতে আমরা যেমন একটি অভিজাত ধারার সম্মান পাই তেমনি সূদূর অতীত থেকে সাধারন গ্রামীন জনসাধারনের কণ্ঠে গীত ও বিকশিত আরেকটি লৌকিক ধারাকেও অস্বীকার করতে পারা যায় না। গ্রামীন সমাজ জীবনের সঙ্গে এই সঙ্গীত ধারা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
কিন্তু এইরকম একটি বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য ও প্রমানের অভাবে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আলোচনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রাচীন গ্রন্থের সাহায্য পাওয়া যায় , কিন্তু লোকসঙ্গীত ও তার বিকাশ সম্পর্কে এই রকম কোন প্রাচীন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। যদিও বিভিন্ন শাস্ত্রীয় পুঁথীতে লোক ধারার সঙ্গীতের কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় তথাপি তা আলোচনার ক্ষেত্রে পযাপ্ত নয়। সামগ্রিক ভাবে সঙ্গীতের বিকাশের ক্ষেত্রে অভিজাত ধারার সঙ্গে লোক ধারার আদান প্রদান ঘটেছে বারবার । এর ফলে উভয় ধারাই লাভবান হয়েছে । কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে লোক ধারার সতাগ্রতা স্বীকার করা হয়নি ফলে লোকধারার সম্পকে মানুষের মনে অনেক ভ্রান্ত ধারনা আছে। প্রকৃতপক্ষে সমাজে অভিজাত শ্রেনীর পাশাপাশি বিরাট সংখ্যক দরিদ্র গ্রামীন জনগনের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিলে সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র লোক ধারাকে অস্বীকার করার কোন উপায় থাকে না।
প্রকৃতপক্ষে লোক ধারার সঙ্গীতের বিকাশ বিষয়ক বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি নির্ভর গভেষনা অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। অল্প কিছুকাল পূর্বে (দুইশতক পূর্বে) এ বিষয়ে কোন কাজ হয়নি। লোকসঙ্গীত সংগ্রহের কাজ কিছুটা হলেও বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে নানা বিভ্রান্তি ছিল। ঐ সমস্ত গবেষকরা প্রায় কেউই লোক সঙ্গীতের স্বাতন্ত্রকে মেনে নেননি। এমনকি বর্তমানের বহু গভেষক পাশ্চাত্যের সঙ্গীতবিদ Dr. C. Hubert , H. Parry’ র মন্তব্য ” folk music supply an apitome of the principles upon which musical art is funded ” মানেন। কিন্তু লোক সংগীতের স্বতন্ত্র সত্ত্বা তারা স্বীকার করেন না। অবশ্য সাম্প্রতিক কালের মূল্যবান গবেষণা উপরোক্ত ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমান করেছে ।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে শাস্ত্রকারেরা ছিলেন না কিন্তু ছিল মানব জীবন। বাঁচার তাগিদে এই সমস্ত মানুষেরা ছোট ছোট| গোষ্ঠীতে একত্রিত হয়ে যৌথবদ্ধ ভাবে জীবন যাপন করত। কৃষিকাজ না জানার ফলে জীবন যাপন পদ্ধতি কোন নিয়মে বাধা ছিল না। ফলমূল সংগ্রহ থেকে শিকার করে এবং বন্য হিংস্র জন্তু জানুয়ারদের সঙ্গে লড়াই করে দিন| কাটত যদিও প্রাকৃতিক রহস্যগুলি তাদের অন্তর্গত ছিল তবু তারা একত্রিত জীবন যাপনের প্রয়োজনীয়তা বাধ্য হয়েই বুঝতে পেরেছিল। একত্রিত হয়ে শিকার অথবা বন্য জন্তুর সঙ্গে লড়াই করার ফলে একটা সমবেত আবেগের সৃষ্টি হয়ে এবং তার থেকেই হিংস্র আওয়াজ নির্গত হত। এর সঙ্গে ছিল রুক্ষ ছন্দ। এই ছন্দের মাধ্যমে অনেক মানুষের পক্ষে একত্রিত হয়ে একই সঙ্গে হাত পায়ের সঞ্চালন অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল। এই ধরনের আওয়াজ ও ছন্দ সৃষ্টি হয়েছিল কোন প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে বাড়তি উন্মাদনা লাভ করার জন্য এবং এর মাধ্যমে এক সমবেত সত্তার প্রকাশ ঘটেছিল। তাই আজকের দিনে আমরা সঙ্গীত, নৃত্য থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় শিল্প সংস্কৃতির জনক হিসেবে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের সমবেত আবেগ প্রস্তুত করার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করতে পারি ।
পরবর্তীকালে মানব সমাজে আরোও অগ্রগতি লাভ করার পরে তাদের শ্রম সম্পৃক্ত জীবন নানা ধরনের প্রাথমিক সুর ভঙ্গিমা ও সুর কাঠামোর জন্ম দেয়। এক এক ধরনের শ্রম থেকে জন্ম নেয় এক এক ধরনের স্বর সঙ্গতি । তাই আজ একথা স্বীকার করতেই হয় যে আদিম মানুষের শ্রম থেকেই সঙ্গীতের উৎপত্তি হয়েছিল। এই সমস্ত শ্ৰমজাত সুর কাঠামো থেকেই পরবর্তীকালের সঙ্গীতের ব্যকরনের জন্ম হতে থাকে তবে যে প্রক্রিয়ার পথ অত্যন্ত জটিল।। আদিম সঙ্গীতের ছন্দ সম্পর্কে Sydney Finkelstien বলেছেন “Practically all known musical rhythm , consists of the alteration of atleast two different beats , as in the heart beat , breathing, Walking , rowing the sowing of grain , the up and down swing of an axe and all the movements of labour. It is this alteration or up and back quality of rhythm, which gives it the character not merely of division of time into intervals but of forward motion ” সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক এভাবেই গড়ে ওঠে । এই সূত্র আরো ইঙ্গিত দেয় যে শ্রম সংগীতে কেবলমাত্র অবরোহী সুরকাঠামোর পুনরাবৃত্তি ঘটত না। তার সঙ্গে অপর একটি আরোহী গতিও যুক্ত হয়েছিল।
এরপর থেকে মানুষের কল্পনার বিকাশের সূত্রপাত হয় অনিশ্চিত অবস্থার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য। সেই সময় ব্যাখ্যাতীত বিষয়ে বস্তুর উপর দেবতা আরোপিত হত। যার থেকে লোক ধর্ম ও ভবিষ্যতের নানা লোকাচারের জন্ম হয়েছিল। এই সকল আচার অনুষ্ঠানে দেব পূজো অপেক্ষা সামাজিক উদ্দেশ্য পূরনই প্রধান ছিল। এই লোকাচারগুলি অনেক প্রচীন এবং ভারতবর্ষে আর্য আগমনের সময়কাল থেকেও বহু অতীতের ঘটনা অনার্য এই সব দেবতারাই লোক দেবতা। তখনকার মানুষের এই লোক ধর্ম তাদের সংগ্রামশীল জীবনের সঙ্গে এবং সামাজিক প্রয়োজনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। লোকধর্মই লোকাচারের জন্ম দিয়েছে। পরবর্তীকালে শাস্ত্রীয় ধর্মের আক্রমনের ফলে অনেক লোকাচার বিলুপ্ত অথবা বিক্রিত হয়ে পরেছিল। অনেক ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাবে তার রূপ পরিবর্তীত হয়ে যায় । তথাপি এই কথা বলা যায় যে প্রত্যেক জাতি সত্তারই এই ধরনের লোকাচারের সঙ্গীত আঙ্গিক নানারূপে বর্তমান ছিল। সূত্রপাত থেকে এই প্রাথমিক আঙ্গিকগুলি জনসাধারনের দ্বারা গৃহীত হয়ে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিশেষ বিশেষ মানব সমাজ বা জনগোষ্ঠী থেকে তাকে আর আলাদা করা যায় না । তারফলে পরবর্তী যুগের নানা পল্লীগান এইসব আঙ্গিকের সুর কাঠামোকে আশ্রয় করে জন্ম এবং উন্নতি লাভ করেছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। যুগ বদলালেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমের ধরন আজও অপরিবর্তিত থাকায় কিছু কিছু রূপ পরিবর্তন সত্বেও আজও তা টিকে আছে। এই ভাবেই আমরা অভিজাত সঙ্গীতের পাশাপাশি লোক সঙ্গীত ও শ্রম সঙ্গীতের সন্ধান পাই যা আভিজাত্যের অধিনস্থ নয় । গ্রাম কেন্দ্রিক জীবন থেকে তার জন্ম এবং জীবনের মধ্যেই তার বিকাশ।
আর্যরা সঠিক কবে থেকে ভারতবর্ষে আসতে শুরু করেন সে বিষয়ে বহুমত আছে। সেই সকল মতামতকে একত্রিত করে অনুমান করা যায় যে মোটামোটি তিন হাজার (৩০০০) খ্রীষ্টপূর্ব সাল থেকে এ দেশের আর্য আগমন শুরু হয় । আর্য রা একসঙ্গে না এসে নানা দলে ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে আসেন। ইরান থেকে হিন্দুকোষ পর্বত পেরিয়ে ইন্দ-আর্যদের আগমন ঘটে ।
আর্য ও অনার্যদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও সমতার মধ্যেই পরবর্তীকালের সমাজ ধর্ম সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। এই যুক্তির স্বপক্ষে বহু প্রমান আছে। আর্য রা নাকি অনার্যদের শুদ্র বলে গণ্য করতেন অথচ বৈদিক গ্রন্থাদিতে দখা যায় আর্য পুরুষেরা অনার্য শুদ্র রমণীদের বিবাহ করতে পারতেন। আসলে আর্য আগমনের সময় তাদের সঙ্গে নারীর সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। এছাড়া নৃত্য,গীত,বাদ্য সম্পর্কে অনার্য দের কাছ থেকে আর্য রা অনেক কিছু পেয়েছেন।
বৈদিক আচার অনুষ্ঠান ছিল পুরুষদের এবং লৌকিক ব্রত অনুষ্ঠান ছিল মেয়েদের জন্য । বৈদিক দেবতা মূলত পুরষ এবং অনার্য দেবতারা অনেকেই নারী রূপী মহাশক্তিমান শিবকেও প্রকৃতপক্ষে শুদ্রের দেবতা বলতেন । ব্রাক্ষন স্বামীর শূদ্র স্ত্রীরা তাদের উপাস্য দেবতা শিবের পূজা করতেন| শিবকে বৈদিক (ব্যাদ) মুনিরা মানতে বাধ্য হতেন। আর্য -অনার্য মিলন ও সংঘাতের মধ্যেই হিন্দু ধর্মের সূচনা হয়। প্রথমে আর্য দের তিনটি শ্রেনী ছিল –
১) যোদ্ধা বা অভিজাত ২) পুরোহিত ৩) সাধারন মানুষ। প্রকৃতপক্ষে দাসেদের আলাদা করার পরেই বর্ণভেদ দেখা দিল প্রথম প্রভেদ আর্য -অনার্য বিভাগ । পরবর্তী বিভাজন – ১) ক্ষত্রিয় ২) ব্রাহ্মন (পুরোহিত) ৩) বৈশ্য (কৃষিজীবি) ৪) শূদ্র অর্থাৎ দাস। ক্রমে আর্য বৈশ্যরা ব্যবসায়ী ও জমির মালিক হয়ে উঠল। তখন এই বিভাজন কিছুটা পরিবর্তিত হল কারন কৃষিজীবিদের একটা অংশ ব্যবসায়ী শ্রেনী হিসেবে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কৃষিজীবি হিসেবে মূলত শুদ্ররাই থেকে গেল। তখন বিভাজন দাড়াল – ১) ক্ষত্রিয় ২) ব্রাক্ষন ৩) ব্যবসায়ী ৪) শুদ্র কৃষিজীবি। ক্রমে ব্রাহ্মন পুরোহিতরা ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হলেন এবং সমস্ত সামাজিক আচার আচরন এমন কি রাজার উপরেও দেবত্য আরোপ করলেন। এইভাবে সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে তারা উঠে এলেন এবং শূদ্ররা (মূলত অনার্য ) সর্ব নিম্নস্তরে রইলেন। তাই শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গীতের সঙ্গে অনার্য শূদ্র সংস্কৃতির একটা নিবিড় যোগ আছে ।
হিন্দু শাস্ত্রীয় ধর্ম ক্ৰমে শক্তিশালী হল এবং সমাজের গভীরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে লাগল। এইভাবেই লোকায়ত ধর্মে তার প্রভাব পড়ে। মূল ও আদি লোকাচার অনেক ক্ষেত্রেই লুপ্ত হয় অথবা পরিবর্তিত হয়। আমাদের দেশে মেয়েদের যে সমস্ত ব্ৰত বহুপূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল তার অনেকগুলি শাস্ত্রীয় ব্রাহ্মন ধর্মের প্রভাবে হারিয়ে গেছে কিছু আবার রূপান্তরিত হয়েছে । মেয়েদের প্রাচীন ব্রত এখনো কিছু থেকে গেছে কারন অন্তপুরে শাস্ত্রীয় ধর্মে আজও তেমন প্রকাশ করতে পারেনি।
আর্য -অনার্য সঙ্গীত
আর্যদের শাস্ত্র বেদ, তাদের ধর্মবৈদিক এবং সংস্কৃতির সবটাই যাগ-যজ্ঞাদির সঙ্গে জড়িত। এই আর্যরাও আদিম স্তরে পশুপালক স্তরে ছিলেন। সে যুগে তাদের মধ্যে মার্গ সঙ্গীত, দেশী সঙ্গীত বা লোক সঙ্গীতের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তাদের সঙ্গীতের সুর ছিল অতি সরল দুই থেকে তিনটি স্বরে বিস্তৃত। কৃষি সমাজ গঠন হওয়ার পর যখন এই সমাজে উচ্চ ও নিম্ন শ্রেনীর উদ্ভব হলো তখনই লোক সঙ্গীত এবং শিল্প সঙ্গীতের বিভাগ হয় । তাই শ্রেনী বিভাগের আগে যে আদিবাসী সঙ্গীত তা সামগ্রিকভাবে কমিউনিটি সঙ্গীত বা গোষ্ঠী সঙ্গীত সেখানে লোক সঙ্গীত কথাটা বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যায় না।
আর্য -অনার্য সমাজ বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই শ্রেণী বিভক্ত সমাজের অনার্য সঙ্গীতই প্রকৃতপক্ষে লোক সঙ্গীত। এই সঙ্গীত সরাসরি জীবনেরই গান। ফলে জীবন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা অপরিবর্তিত হতে বাধ্য। কিন্তু এটা ঠিক যে সেই বিকাশ যা পরিবর্তনের গতি অত্যন্ত ধীর,অতীতকে স্বীকার করে এবং তার অনেকটা রক্ষা করে তাকে সঙ্গীত বিকশিত হয়েছে। এভাবেই National music বা দেশীয় সঙ্গীতে লোক সঙ্গীতের অবদান দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে।
লোক সঙ্গীত নিয়ে বিগত এক বা দুই শতাব্দী পাশ্চাত্য দেশে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সংজ্ঞা নির্নয়ের ক্ষেত্রে বহুমতামত সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন মতে লোক সংগীত গ্রামের গান আবার কোন কোন মতে ঠিক কৃষিজীবিদের গান । শেষপর্য ন্ত যে মতটি প্রাধান্য লাভ করে তাহলো লোক সংগীত গ্রামীন অর্থনীতি থেকে উদ্ভূত গান। ১৯৫৪ খৃঃ বহু আলোচনার পর আন্তর্জাতিক লোক সংগীত পারিষদ (International folk music council) যে সংজ্ঞা নিরূপন করেন তা হলো: “Folk music is the product of a musical tradition that has been evolved through the process of oral transmission, the factors that shape the tradition are: i) Continuity which links the present with the past;ii) Variation which springs from the creative impulse of the individual or the group; and iii) Selection by the community, which determines the forms in which the music survives। The term can be applied to music that has been evolved from rudimentary beginnings by a community uninfluenced by popular and art music and it can likewise be applied to music which has originated with an individual composer and has subsequently been absorbed into the unwritten living tradition of a community.
The term does not cover composed popular music that has been taken over ready-made by a community and remains unchanged for it is the re-fashioning and re-creation of the music by the community that gives it its folk character.” [১]
উপরোক্ত সংজ্ঞার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন তিনটি লক্ষন হচ্ছে লোকসংগীতের Continuity, Variation ও Selection এর প্রশ্নটি । আমরা তাদের যথাক্রমে ঐতিহ্য,উদ্ভাবন ও নির্বাচন বলতে পারি । Continuity অর্থাৎ ধারাবাহিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যরক্ষার প্রশ্নটি জরুরি , Variation অর্থাৎ বৈচিত্রের মূল বিষয় হচ্ছে উদ্ভাবন এবং Selection কথাটির সঙ্গে গ্রামীন জনসাধারানের গ্রহনীয়তার প্রশ্নটি জরুরী । অন্তত এই তিনটি শর্ত একত্রে পালিত হলে তা লোকসংগীত হিসেবে গ্রহনযোগ্য হতে পারে ।
এটা পরিস্কার যে লোকসংগীত জীবনেরই সম্পদ । অন্যথায় উপরের সংজ্ঞা খাটে না । জীবন,সমাজ, পরিবেশ,আবহাওয়া এবং জীবিকা থেকে তাকে আলাদা করে চেনা যায় না এজন্যই গ্রাম্য ছড়া ও ছড়াগান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমানে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্নরূপে দেশীয়, স্থানীয় । তাহা কেবল দেশের জনসাধারনের উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য; যেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না তা হলে বলা যায় লোকসংগীতের বিকাশ উপরোক্ত সংজ্ঞার পথ ধরেই হবে। অর্থাৎ পরিবর্তন বা বিকাশের অধিকারী বিশেষ লোকসংগীতের সঙ্গে যুক্ত জনসাধারন, অন্য কেউ নয় । লোকসংগীতের বিকাশ বিষয়ক তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা করা অত্যন্ত দূরূহ, কারন যুগ বা সময় অনুযায়ী লোকসংগীতের কোন পুঁথি বা বই না থাকার তথ্য প্রমান সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। তবে মুখে মুখেই এই সংগীতের প্রচার বা বিকাশ ঘটেছে এবং লোক সংগীতের বিশাল ভান্ডার আমাদের আলোচনার জগৎকে সমৃদ্ধ করে।
তথ্যসূত্র
১। সংগীত মূল্যায়ন বক্তৃতামালা (তৃতীয় খন্ড) পৃ: ৮৩, সম্পাদনা, ড: উৎপলা গোস্বামী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ,প. ব. সরকার।