লৌকিক ব্রত : তুসু ও ভাদু গান
দেবাশিস মণ্ডল
বাংলায় অসংখ্য আঞ্চলিক গীতি চোখে পড়ে। এরমধ্যে রাঢ় বঙ্গে ‘টুসু’ বা ‘তুসু’ এবং ‘ভাদু’ গানগুলি গ্রামের কম বয়সী মেয়েদের একান্তভাবে নিজস্ব সঙ্গীত। এক মাস ধরে প্রতিদিন গান গেয়ে ‘টুসু’ এবং ‘ভাদু’র গুণ কীর্তন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রায় সব পরিবারেই এই দুটি উৎসবের প্রচলন রয়েছে। যদিও আধুনিকতার ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক গান ও উৎসবের আধিপত্য কমে যাচ্ছে। তবু সাধারণ পরিবারে এই পরব বা উৎসবের প্রচলন রয়েছে। অঞ্চল ভেদে তুসু বা টুষু আর ভাদু গানের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও মূলগত দিক থেকে যথেষ্ট মিল রয়েছে।
‘টুসু’ কোথাও তুযু, তুষ-তুষলী বা তোষলা নামে পরিচিত। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন গ্রামের মেয়েরা তাদের আদরের দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন একটি মাটির সরাকে পিটুলি গোলা জল দিয়ে সাদা রঙ করা হয়। এর উপর লাল সবুজ রঙে চিত্রিত করা হয়। এই সরাটির মধ্যে রাখা হয় কিছু নবান্নের তুষ। কোথাও কোথাও সরার উপর সাদা রঙ করার পর সরাটিকে সিঁদুরের পঞ্চাঙ্গুলি দেওয়া হয়। কোথাও গোবরের নাডু রাখা হয় সরার মধ্যে, তার উপর সিঁদুরের ফোটা দূর্বা গুঁজে দেওয়া হয়। এছাড়াও অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত রীতি লক্ষ্য করা যায়। এই সরাটিকে আকন্দ ও গাঁদা ফুলের মালা পরানো হয়, কিছু ফুল দেওয়া সরার মধ্যে। এটিই ‘টুসু’ দেবী। এই দেবীকে রাখা হয় কুলু্ঙ্গীতে বা কোন উঁচু পিড়ির উপর।
পৌষ মাসের প্রথম দিন থেকেই ‘টুসু’ পুজো শুরু হয়। এক মাস ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই পুজো চলে। পৌষ সংক্রান্তির দিনে প্রত্যুষে হয় তার বিসর্জন। ‘টুসু’ ব্রতের দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ এটিকে খেত উর্বর করার ব্রত বলে উল্লেখ করেছেন। ড: আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন এটি শস্য উৎসব। ড: নীহারঞ্জন রায়ের মতে -কৃষি সংক্রান্ত প্রজনন শক্তির পূজা। আবার কারো মতে – এটি পূজা লক্ষ্মীরই পূজা। তুষ (তুষলী) ব্রতে কেউ কেউ একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রী দেবতার কল্পনা করেছেন।[১]
রামশংকর চৌধুরী বলেছেন নবান্ন উৎসবের শুরুতে একটা লৌকিক আকারের সঙ্গে অল্পবিস্তর ধর্মাচার মিশে আছে। আলোচ্য অঞ্চলে সব ধানের চালেই নবান্ন হয় না। ভাদ্র মাসে যখন ধান গাছগুলি শস্যভারে আনত হয়ে পড়ে, তখন এক বিশেষ দিনের প্রাত:কালে স্নান করে শুদ্ধাচারে নব বস্ত্র বা পট্টবস্ত্র (অভাবে জলে কেচে নেওয়া কোন বস্ত্র) পরিধান করে যেতে হয় ক্ষেতের মাথায়। সঙ্গে থাকে একটি শাঁখ, হলুদ রঙে রাঙানো একখন্ড কাপড় ও জলের একটি ক্ষুদ্র পাত্র। ক্ষেতের মাথায় গিয়ে আড়াই মুঠ ধান মূলের একটু উপর থেকে কেটে হলুদরঙা বস্ত্রখন্ডে বেঁধে নিতে হয়। ক্ষুদ্র পাত্রটি ধানগাছের মূলে জমে থাকা জলে পূর্ণ করে নিতে হয়। ধানের গাছ গুলিকে মাথায় নিয়ে মৌনমুখে গৃহস্থের দরজায় এসে শঙ্খধ্বনি যোগে আহ্বান করতে হয় গৃহিনীদের বরণ করে নিয়ে যাবার জন্য। গৃহিনীরা জলধারা দিয়ে ধানগাছগুলিকে ঘরে তুলে লক্ষ্মীর বেদীর উপর রাখার নির্দেশ দেন। এই ধান আনাকে বলা হয় ‘মুঠ আনা। মুঠি থেকে মুঠ কথাটি এসেছে।
এই ধরণের চালেই অগ্রহায়ণের কোন একদিনে নবান্ন হয়ে থাকে। তুষগুলিও ফেলে দেওয়া হয় না। এই তুষই হলেন ‘টুসু’। ‘টুসু’র প্রথম গানেই আছে :
লবান্নর ধান ভাই দিন ক্ষ্যান কৈর্যে
তারই কুড়া রাখ্লম টুসালুর তরে।[২]
‘টুসু’ নবান্নের সময় হলেও এটি নবান্নের উৎসব নয়। বিভিন্ন মতামত এবং টস পূজার রীতি থেকে মনে হয় ‘টুসু’ পূজার প্রারম্ভিক কালে এটি মূলত: উর্বরা শক্তি এবং শস্যকে আহ্বান করেই হত। পরে উর্বরাশক্তি ও শস্যের আহ্বানের পাশে স্থান নিয়েছে নারী জীবনের চাহিদাগুলি। ‘টুসু’ প্রতিষ্ঠার আগে তুষ সংগ্রহের সময় গাওয়া হয় –
তুষালু গো রাই, তুষালু গো রাই
তুষ তুষ তুষ তুষালু গো রাই
তোমার দৌলতে মোরা ছব্বরি পিঠে খাই
ছব্বরি নব্বরি গাঙ্গ সেনানে যায়।[৩]
কখনো ‘টুসু’ কন্যা কখনো ‘তুসু’ বা ‘টুসু’ অন্নদাত্রী মা। যকন তুষুর বিয়ে দিচ্ছে,’তুসু’কে সাজাচ্ছে, তাকে স্নান করাচ্ছে তখন সে কন্যা। আর যখন দাবি জানাচ্ছে নিজের প্রাপ্যটুকু পেতে চায় তখন তুষু মা। তখন তাকে পুজো করা হচ্ছে। এই প্রার্থিব সংসারে সেই পরম মা। এইসব জমি জায়গা তারই। এই সব ক্ষেত নদী, জল ‘তুসু’রই। আমরা তা থেকে ফসল পাই, ব্যবহার করি।
পৌষ এসেছে সাধের ‘টুসু’
পুজব তমাল ফুল দিয়ে
তোমার ক্ষেতের ধান তুলেছি
সে ধান যাবে কে লিয়ে।[৪]
পরবর্তীকালে ক্ষুধার অন্নের পাশাপাশি কামনা বাসনা আরও গভীরতা পেয়েছে। তাই ‘টুসু’কে নানা সাজে সাজানো হয়েছে আপনার রঙে। কল্পনায় ‘টুসু’র বিবাহিত জীবনের সুখ কামনা করা হয়েছে, আপনার সুখ স্বপ্নের মতো করে।
মাথায় বাঁধা পরিপাটি গো
তায় পরবে বেল কুঁড়ি
বোম্বাই হতে পার্সেলেতে
আনব দীঘল চুড়ি ।
কটকে গড়হাব গহনা
ঢাকাই শাড়ি পরাবো
কলকাতাতে রঙ করিয়ে
‘টুসু’ ধনকে পরাবো।[৫]
কিংবা
আমার ‘টুসু’র বিয়ে দুব ইস্টিশনের বাবুকে
ওলো ‘টুসু’ ভালো ই হল চাপবি কত গাড়িতে।
কুমারী মনের চাহিদা গুলির পাশাপাশি বিবাহিত জীবনে মেয়েদের স্বামী এবং পুত্র-কন্যার আকাংখা থাকে। এক্ষেত্রে ‘টুসু’র কাছে সেই কামনাও করা হয়। ভাল বরের জন্য। আর ‘টুসু’কে নিজের কন্যার মতো করেও কল্পনা করা হয়। তাকে সাজানো, আদর যত্ন করা সব দায়িত্ব পালন করার রীতিগুলি এই ‘টুসু’ গানগুলি থেকেই শিখে নিতে পারে । প্রতিটি সামাজিক সমস্যাকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা হয় এই গানে।
‘টুসু’ যাবে নদীর ধারে একলা যেতে দিওনা।
সড়ক ধরে চলে যাবে
কারো পানে চেয়োনা।[৬]
কিংবা
ছুটুই বিয়ে দিলি ক্যানে
আমি ঝাপ দুব নদীর বানে।[৭] … ইত্যাদি।
একই ‘টুসু’ গান প্রচলিত রয়েছে বহু জায়গায়। কোথাও কিছু কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। অঞ্চল বিশেষে পরিবেশ কিছু ভিন্ন হওয়ায়, তাদের কাজকর্ম, ভাষা, আচার অনুষ্ঠানেও কিছু ভিন্নতা রয়েছে। তারই প্রভাবে এই পরিবর্তন। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির অসম বিকাশ ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু যে সমাজ যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, বিকাশেরও বিবর্তনের নির্দিষ্ট কতকগুলি স্তর তাকে অতিক্রম করতেই হয়। বিকাশের এইসব স্তরে গোষ্ঠী মানুষ সর্বজনীন কতকগুলি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, প্রয়োজনের তাগিদে কিছু অভিন্ন চিন্তা নিজস্ব করে তোলেন। এগুলো কে আমরা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলতে পারি। প্রয়োজনেও মিল রয়েছে। এইসব অভিজ্ঞতা যখন সংস্কৃতিতে রূপ দেওয়া হয় তখন সদৃশ চিন্তা স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশ পায়। বিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কহীন অবস্থাতেই এসবের জন্ম হচ্ছে। নৃতাত্ত্বিক বহু অভিজ্ঞতা নানা জনগোষ্ঠীতে রয়েছে, তাদের শারীরিক বিভিন্নতা রয়েছে, বর্ণে ও ভাষায় বৈচিত্র্য আছে – কিন্তু শত-সহস্র বিচিত্রতা থাকা সত্ত্বেও একস্থানে তাদের মিল তারা সকলেই সামাজিক মানুষ। [৮]
‘ভাদু’ উৎসব, ‘ভাদু’ পুজো, ‘ভাদু’ পরব
আঞ্চলিক সঙ্গীত ধারার আরো একটি উদাহরণ হল ‘ভাদু’ গান। সাধারণভাবে কুমারী মেয়েদের দ্বারাই একমাস ধরে এই উৎসব চলে। সঙ্গে বিবাহিতা রমণী কিংবা কিশোররাও যুক্ত হন। ভাদ্র মাসের প্রথম দিনেই কোথাও শ্রাবণ সংক্রান্তির দিনে মৃৎশিল্পীদের দিয়ে বানিয়ে নেওয়া হয় একটি মাটির ছোট, দন্ডায়মান নারীমূর্তি। মূর্তিটিকে একটি উঁচু স্থানে বা পিড়ির উপর বসানো হয়। ঐ স্থান বা পিড়িটিকেও সাজানো হয় রঙিন কাগজ বা শালুক ফুল দিয়ে। মাঝখানে রাখা হয় ‘ভাদু’-র মূর্তি। এরপর ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত ঐ মূর্তির সামনে আসন পেতে বসে গান গেয়ে ‘ভাদু’র বন্দনা করেন গ্রামের অবিবাহিতা সহ সর্বস্তরের মহিলারা। থালায় থালায় মিষ্টান্ন ফল মুলে পরিপূর্ণ করে সাজানো হয় ‘ভাদু’র পাশেই। রাঢ় অঞ্চলে বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়ায় এই উৎসব চলে।
‘ভাদু’কে কন্যার মত করেই সাজানো হয়। যেন বিবাহযোগ্যা রমনী। তার বিবাহের পরই প্রকৃতি হয়ে উঠবে সৃষ্টি সম্ভবা। আষাঢ় শ্রাবণে যে ধানের রোপন হয় শরতে সেগুলিতে ফলবতী হবার সম্ভবনা দেখা দেয়। ‘টুসু’ যেমন উব্বরাশক্তিকে বজায় রাখার জন্য অধিষ্ঠাত্রী লৌকিক শক্তিদায়িনী, তেমনি ‘ভাদু’’ নতুন ফসলের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক।
‘বৃষ্টির রসে জারিত হয়ে বীজে অংকুরোদ্গমের সূচনা যখন হয়, তখন তাকে কেন্দ্র করে সোনালী ফসলের প্রত্যাশা যেমন চিরন্তন, তেমনি কুমারী কন্যার দেহে ও মনে যৌবন আগ্নি ও সেই নবল্ধ গৌরবে ভাবী জীবনের রঙীন স্বপ্নের বুনুনিও তেমনই চিরায়ত। আদিম প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের এই আত্মিক সঙ্গতির সূত্রেই ‘ভাদু’গানের অবাধ বিকাশ।
নিম্নতর সমাজের মধ্যে ‘ভাদু’ গানের বিশেষ বিস্তৃতি। আর্যতর সংস্কৃতির মধ্যেই এর মূল উভয়। বিশেষত ছোটনাগপুর, মানভূম অঞ্চলের অবিবাহিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে প্রচলিত করম’ উৎসবের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে। এটিও মূলত কৃষি উৎসব। উপজাতীয়দের এই করম’ উৎসবের সঙ্গে হিন্দু পৌত্তলিকতা ও কাশীপুর রাজপরিবারের কাহিনী মিশে গিয়ে এক একটি হিন্দু পূজা উৎসবের রূপ দিয়েছে এবং একটি প্রতিমা নির্মাণের রীতিও ক্রমে প্রচলিত হয়েছে’।[৯]
অবশ্য কেউ কেউ ‘ভাদু’ উৎসবকে করম উৎসবের হিন্দু সংস্করণ বলে মনে করেন না। হেমন্তে যে ধান উঠবে ভাদ্রে তা ফলতে শুরু করে। সেই সম্ভবনাকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব মাসাবধি কাল ধরে চলতে থাকে। এটা অত্যন্ত দৃঢ় যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
‘ভাদ্রের এই অবসর দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও পরিশ্রমের পরে জয়লাভের আশার আনন্দে ভরপুর। সারাটা বছর এই কয়েকটা মাসের দিকেই তাকিয়ে থাকে চাষীরা। ফসল ফলিয়েই আনন্দ। সারাবছর কেটেছে অভাব অভিযোগে, নানা প্রকার আপদ বিপদের মধ্যে।
এবার ফসল ঘরে আসবে। অভিযোগ মিটবে। আপদকে তারা নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়েছিলেন। এবার আর নয়। মনের কামনা বাসনা মেটাবার দিন আসছে। এই বিষয়গুলিই ‘ভাদু’ সঙ্গীতে স্থান পেয়ে সজীব হয়ে উঠেছে। তাই ‘ভাদু’ রাজকন্যা নন, ভাদ নয় করমের হিন্দু সংস্করণ, ‘ভাদু’ একান্তভাবেই ফসল ফলানোর উৎসব।‘[১০]
‘ভাদু’র কাছে মনের আশা পূরণের জন্য আবেদন করা হয় –
‘ভাদু’ এই ভাদরে কত আশা কইর্যে পূজব চরণ ধরে।
মনের যদি পুরাও আশাগো রাখবো সোনার মন্দিরে। [১১]
আবার ফসল হলে ‘ভাদু’কেও কোন ভাবনা করতে হবে না। ‘ভাদু’কে সুখে সাজিয়ে রাখার জন্য পিতা মাতার মত ‘ভাদু’কেও শোনানো হয়।
‘ভাদু’ ভাবিস ক্যানে
পাঁচ বিঘা জমি চাষ করেছি এই সনে
তিন বিঘাতে ঝুলুর ধানগো
দু বিঘাতে বাসমতী।
ফসল হৈল্যে ভাবনা কিসের
কিনে আনব তোর পতি
‘ভাদু’ ভাবিস ক্যানে।[১২]
এখানে বর পণের প্রচলন ছিল বলেই অনুমান করা হয়। তুসুর জন্যে বর কিনে আনার প্রসঙ্গ সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া বর কিনে এনে তাকে নেজের কাচে বা ঘর জামাই করে রেখে দেওয়ার প্রথাও সে সময় ছিল বলে বোঝা যায়। এছাড়া সামাজিক নানা সমস্যা, সমালো চনা, কিংবা উল্লেখযোগ্য ঘটনা কাহিনী ‘ভাদু’ গানের বিষয় বৈচিত্র্যকে মহান করে তুলেছে। (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের রচনা)
জাপান বিবেচনা
টাকায় এক সের চাল বিনা ভাত খেলামনা
সুলজার বুলে দেশে দেশে লো
কোরোসিন তেল মিলে না
দশটাকা সের চিনি ‘ভাদু’
তাও কিনতে পেলামনা
জাপান বিবেচনা।[১৩]
‘ভাদু’র বিয়ে দেওয়া, ‘ভাদু’কে সাজানো, শশুর বাড়ি পাঠানো এইসব ‘ভাদু’ গানে স্থা্ন পেয়েছে।
বলি ও সরলা, ‘ভাদু’র বিয়ে সরল মনে
সাজালো বরণ ডালা
কাঁঠাল পাতা তুলে আনলে
সাজালো সন্দেশ থালা।
আলপনা দিয়ে কর, পরিষ্কার ছাঁদনাতলা
পাড়ার যত এয়ো আছে, ডেকে আন এইবেলা।
কি মনের সাধে ‘ভাদু’ বিয়ে করে ফেল এইবেলা।
চিক পিড়ে বোম্বাই শাড়ি লো এঁটে পর কোমরে
রাস্তায় যেতে রৌদ্রের আভায় যেনলো ঝলমল করে।[১৪]
আবার
‘ভাদু’ বিদায় দিতে, প্রাণ চাইছেনা কোনো মতে।।
ওরে মাধুরী, শুধু শুধু বসলি কেনে ভাবিতে
‘ভাদু’ যাবেন শ্বশুর বাড়ি – সাজাও গো কোনো মতে
‘ভাদু’ বিদায় দিতে।[১৫]
প্রাচীন কিংবদন্তী বা পুরাণের গল্পকে আশ্রয় করে কাহিনী মূলক ‘ভাদু’গান গাওয়া হয়। এক্ষেত্রে ‘ভাদু’ উপলক্ষ্য মাত্র।সেই সব কাহিনীর সঙ্গে ভাদু পরব বা উৎসবের কোন সম্পর্ক নেই।
‘ভাদু’, হেরবি যদি আয়,
কদম তলায় দাঁড়িয়ে কালা আড় নয়নে চায়।
আয় ললিতা, আয় বিশাখা, প্রাণ করে উতলা
ঘরে গুরু গঞ্জনা হে, ঘরে যাওয়া দায়।[১৬] ইত্যাদি।
রাধা কৃষ্ণের বিষয় ছাড়াও রামায়ণের কাহিনী, হরিশচন্দ্র শৈব্যা, সাবিত্রী সত্যবান ইত্যাদি অসংখ্য কাহিনী আশ্রিত গান রয়েছে। সব গানই সমবেতভাবে গাইবার রীতি। গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে একই সঙ্গে গলা মিলিয়ে এই গান করেন। প্রায় সব গানেই একটি সাধারণ চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। মেয়েদের সহজাত কামনাগুলি যে ‘ভাদু’রও। তাই ‘ভাদু’কে সাজানো, হলুদ মাখিয়ে গায়ের রঙ উজ্জ্বল করা, ভালো ঘর, সুন্দর বর, ভালো শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ দেখে ‘ভাদু’র বিয়ে দেওয়া হয়। আসলে মেয়েরা যে সমস্যাগুলি বেশি উপলব্ধি করে সেগুলিই স্থান পায় ‘ভাদু’ গানে। কোন একক চিন্তা বা একের সমস্যা সাধারণত স্থান পায়না এই সমবেত পর্যায়ের গানে।
এই সব গানে সাধারণ মানুষের মনের কথা, চাহিদা বা সম্মিলিত চিন্তা ও সম্ভবনাকে প্রতিভাত করে তাই ‘ভাদু’ গানের বিষয় হয়ে উঠতে পেরেছে। প্রচলিত আঞ্চলিক সঙ্গীত ধারায় ‘ভাদু’গানের এটি একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক রয়েছে। আর বারো মাসে পশ্চিমবঙ্গে অজস্র উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘ভাদু’’ রাঢ় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। ‘ভাদু’’ উৎসবের প্রায়োগিক দিকগুলিও নারী সমাজের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু আশা আকাঙ্ক্ষা নয়, আদিম যুগ থেকে এরকম লোকসঙ্গীতের ধারা-ই লোকশিক্ষার ধারাটিকে অক্ষুন্ন রেখেছে। ফলে নতুন প্রজন্মের কুমারীরা তাদের ভবিষ্যৎ সমস্যা কি কি হতে পারে বা তার সমাধানে কি করা উচিত কিংবা সমাজ সংগঠনে ব্যক্তির ভূমিকা সমাজ সংসারকে সুন্দর করে তোলার দায়িত্বগুলি সম্পর্কেও এভাবেই সচেতন হতে পারে।
বাংলার লৌকিক উৎসব ও অনুষ্ঠান সঙ্গীত গুলির বিকাশ হয়েছে প্রকৃতির কাছে মানুষের আকাংখা ও কামনা থেকে। এক একটি ঋতুতে এক একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে কার্য কারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ভাদু’, ‘টুসু’, গাজন ইত্যাদির সঙ্গে সংগঠিত সমাজের চিরকালীন আশা আকাঙ্ক্ষা, ব্যাথা বেদনার বহি:প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ভরা ভাদরে হেমন্তে যখন মাঠ সবুজ হয়ে ওঠে। যেন যৌবন মত্ত পৃথিবী। সোনালী ফসলের আহ্বান বা প্রত্যাশা যেমন মানুষের চিরন্তন, তেমনি সেই সময় কুমারী কন্যার দেহে মনে যৌবন আগমন হয়। তারা ভাবী জীবনের স্বপ্নের জাল বোনে। প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের এই আত্মিক সঙ্গতির সূত্রেই ‘ভাদু’ গানের অবাধ বিকাশ হয়েছে। ‘ভাদু’গান করে কুমারী কন্যারা। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত একই পরিবারের কুমারীরা সমবেতভাবে একটি মাটির পাত্রের সামনে বসে গান করেন।
যেমন- বলি ও সরলা, ‘ভাদু’র বিয়ে, সরল মনে সাজালো বরণ ডালা
কাঠাল পাতা তুলে আনলো সাজালো সন্দেশ থালা
আলপনা দিয়ে কর, পরিষ্কার ছাঁদনাতলা।
পাড়ার যত এয়ো আছে ডেকে আন এইবেলা।।
চিক পিড়্যে বোম্বাই শাড়ী লো এঁটে পরো কোমরে
রাস্তায় যেতে রৌদ্রের আভায় যেনলো ঝলমল করে,
কি মনের সাধে ‘ভাদু’ বিয়ে করে এইবেলা।[১৭]
আবার কুমারী মেয়েদের ভাললাগা, প্রেম, আকর্যণ এসব নানাভাবে আলোড়িত করে। রূপকথা, লৌকিক কাহিনী তাদের জীবনের স্বপ্ন দেখায়। তারই বহি:প্রকাশ হয় গানে। লৌকিক দেবদেবী তাদের জীবনের স্বপ্নের চরিত্রে রূপ পায়।
যেমন,
‘ভাদু’ হেরবি যদি আয়, কদমতলায় দাঁড়িয়ে কালা আড় নয়নে চায়,
আয় ললিতা, আয় বিশাখা, হেরবি যদি জীবন সখা,
আমরা হে কুলবালা, জানিনা, প্রাণ কোন ছলা,
ঘরে গুরু গঞ্জনা হে, ঘরে যাওয়া দায়।
যমুনাতে হল খেলা, খেলব বলে চিকন কালা,
আর ভেবনা চিকন কালা ধরি তোমার পায়।
শুন ওহে বংশীধারী, কোরনা আর বসন চুরি,
বসন চুরি করলে হরি, ঘরে যাওয়া দায়।
ধরহে মুরলী ধর, নটবর বেশ কর,
এনেছি বন ফুলের মালা পরাব গলায়।
মস্তকেতে মোহন চূড়া, তাহে আছে গুঞ্জবেড়া
হেলিয়ে দুলিয়ে ধরা পড়ে ধরার পায়
সখি, হেরবি যদি আয়।[১৮] (বাঁকুড়া)
‘ভাদু’ উৎসবের সমসাময়িক সময়েই পুরুলিয়া জেলার পশ্চিম অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় জাওয়া পরব। অবশ্য এই উৎসব একমাস ব্যাপী চলে না। পনের দিন চলে। ‘ভাদু’ মাসের একাদশীর পনের দিন আগে থেকে শুরু হয়। শেষ হয় একাদশীর দিন। বিবাহিত কুমারী মেয়েরা এই উৎসব করে। মূলত কুর্মি ও মাহাতোরা এই উৎসব করে থাকে। এই গানের ভাষায় কুর্মালী, হিন্দী ও বাংলা ভাষার প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। ঝালদা অঞ্চলের কুর্মালী ভাষা, পূর্বাঞ্চলের বাংলা এবং পশ্চিমাঞ্চলের হিন্দি ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় জাওয়া গানে। এই গানের মধ্যে স্বপ্ন অপেক্ষা অতি সাধারণ বা তুচ্ছ বাস্তবও স্থান পায়।
যেমন-
সব খাওয়ালে দাদা না খাওয়ালে গিমারে
আর কি আসিব দাদা পুরুল্যারি সীমারে।[১৯]
তেঁতুল পাতে তেঁতুল পাতে ননদী ঘুমায় গো
উঠ ননদ, খাও ননদ, যাও শ্বশুর বাড়ী গো।
শ্বশুরের সঙ্গে হাম নাহি যাব গো,
পাটি বহিতে বেলা যায়।
তেঁতুল পাতে তেঁতুল পাতে ননদী ঘুমায় গো
উঠ ননদ, খাও ননদ, যাও শ্বশুর বাড়ী গো।[২০]…..ইত্যাদি।
টস গানের মধ্যদিয়েও নারীর মনের বিচিত্র ভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। পৌষমাসে টস পুজো করা হলেও, নারী জীবনের সমস্যা আশা আকাংখাগুলিই স্থান পায়। যেমন একমাস ‘টুসু’ (তুষু) পূজোর পর মাটির সরাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলে (নদীতে বা পুকুরে)। কুমারীরা গায় –
তুষলী গেল ভেসে। আমার বাপ ভাই এলো হেসে
স্বামী পুত্র এলো হেসে, টাকাকড়ি এলো হেসে। [২১]
প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় আবার স্বামীর প্রতি অভিমান –
ভালোবাসায় বলেছিল, পৌষ মাসে কাপড় দিব। পৌষ ফুরালো মাঘ ফুরালো তবু কাপড় দিল না। ভালোবাসার আশা করব না।
কাপড় দিলেও পরব না।।[২২]
তথ্যসূত্র
১। দিব্যজ্যোতি মজুমদার – টুসু ইতিহাসে ও সঙ্গীতে, পৃষ্ঠা ৪১। আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা,
১৯৮২
২। রামশংকর চৌধুরী – ভাদু ও টুসু, পৃষ্ঠা ৪১। কথা শিল্প, কলকাতা, ১৯৮১
৩। মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থেকে সংগৃহীত।
৪। দিব্যজ্যোতি মজুমদার সম্পাদিত টুসু ইতিহাসে ও সঙ্গীতে গ্রন্থে চিত্ত মণ্ডলের লেখা ‘টুসু সঙ্গীত ও রাজনৈতিক প্রেক্ষোপট’ থেকে সংগৃহীত। পৃষ্ঠা ৫৫। আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা, ১৯৮২
৫। ঐ পৃষ্ঠা ৯১
৬। মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থেকে সংগৃহীত।
৭। দিবাজ্যোতি মজুমদার – টুসু ইতিহাসে ও সঙ্গীতে, পৃষ্ঠা ৯৭। আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা, ১৯৮৭
৮। ঐ পৃষ্ঠা ৬
৯। জয়শ্রী ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসঙ্গীতে নারী ভাবনা, পৃষ্ঠা ১৩। অমর্ত্য প্রকাশ, কলকাতা, ১৩১৬
বঙ্গাব্দ।
১০। রামশংকর চৌধুরী – ভাদু ও টুসু, পৃষ্ঠা ১৩। কথাশিল্প, কলকাতা, ১৯৮১। রামশংকর চৌধুরী – ভাদু ও টুসু, পৃষ্ঠা ৩০।
১১।কথাশিল্প, কলকাতা, ১৯৮১।
১২। ঐ পৃষ্ঠা ৩০।
১৩। ঐ পৃষ্ঠা ৩৫।
১৪। শ্যামসুন্দর বর্ধমান জেলা থেকে সংগৃহীত।
১৫। ঐ
১৬। ঐ
১৭। ড: জয়শ্রী ভট্টাচার্য – বাংলা সাহিত্যে নারীর দান। পৃষ্ঠা ১৭, অমর্ত্য প্রকাশ, কলকাতা ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ।
১৮। ঐ, পৃষ্ঠা ১৮
১৯। ঐ পৃষ্ঠা ২৯
২০। পৃষ্ঠা ৩০
২১। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু – বাংলার লৌকিক দেবতা। পৃষ্ঠা ১৩৫। দে’জ – ১৯৭৮
২২। জয়শ্রী ভট্টাচার্য – বাংলার লোকসঙ্গীতে নারী ভাবনা। পৃষ্ঠা ৩৬। অমর্ত্যপ্রকাশ, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ।