‘লকডাউন’ পরিস্থিতিতে অনলাইন পঠন-পাঠন পদ্ধতির প্রবর্তন : একটি অনুসন্ধান
ড. সুশান্তকুমার সামন্ত
নভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপ প্রতিহত করার মতো ওষুধ বা টীকা কোনোটাই এখনো মানুষের হাতে আসেনি।পৃথিবীতে দুশোর বেশি দেশ আক্রান্ত হওয়ার পরেও সংক্রমণের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে,থামার কোনও লক্ষণই নেই। তবে আশার কথা, মৃত্যুর হার অনেকটা ঠেকোনো গেছে। আর সুস্থতার হারও অনেকটাই বেড়েছে। এমতাবস্থায়, সংক্রমণ যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য ব্যবস্থা হিসেবে একদিকে চলছে লকডাউন আর একদিকে প্রকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পরিষেবার মাধ্যমে রোগের কষ্ট থেকে মানুষকে অব্যাহতি দেওয়া কিংবা রোগ নির্মূল করার নিরলস প্রচেষ্টা।লকডাউন তো অসুখ সারানোর remedy নয়।সংক্রমণের গতিকে, সামাজিক শৃঙ্খলকে বহুলাংশে ছিন্ন করে দেবার ক্ষমতা আছে তার।তাই,লকডাউন পর্বে যা করা সম্ভব বা লকডাউন ব্যবস্থাপনা যা দিতে পারে তা হল – এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা-ব্যবস্থা ও পরিষেবা,অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে জীবনকে সচল রাখার নানা পরিকাঠামোগত দিকের সম্প্রসারণ ও তা সবার জন্য যথেষ্ট উপযোগী করে গড়ে তোলা।জীবন-জীবিকার ধারা ও বিন্যাসকে অটুট রাখতে দায়িত্ববান বিজ্ঞানী,ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, virologist, epidemiologist প্রত্যেকেই প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।তার সঙ্গে সাধারণ মানুষজনের আর একটু সচেতনতা, আর একটু সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, আর একটু দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় লকডাউন বিধি-ব্যবস্থাকে আরও বেশি করে কার্যকর করে তুলতে পারে।
এদিকে জীবন সম্পর্কে সচেতনতা নতুবা জীবিকা নিয়ে বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রধান যে উপাদান বা শক্তি সেই শিক্ষাভাবনা ও শিক্ষাক্ষেত্রেই লেগেছে বড়সড় ধাক্কা।শিক্ষাচর্চা,শিক্ষাপ্রবাহ নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে।classroom এর পড়াশোনা, ছাত্র-শিক্ষক সংযোগকেন্দ্র,বকাঝকা স্নেহদক্ষিণ্য প্রভৃতি সহজাত বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল র্জ্ঞানচর্চার উৎকর্ষকেন্দ্রগুলিকে তা আজ এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।বহুদিন ধরে চলে আসা এবং অপরিহার্য শ্রেণিকক্ষ নির্ভর পঠন-পাঠন ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়ার মুখে।নতুন এক বিপন্নতার ছবি আমাদের সামনে ক্রমশঃ প্রকট হচ্ছে।স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ।পরিকল্পনা,পঠন-পাঠন,গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মূল্যায়ন ইত্যাদি সমস্ত স্বাভাবিক কাজকর্ম সবই প্রায় শিকেয় উঠেছে; শিক্ষাব্যবস্থাই না ভেঙে পড়ে, একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি যেন।কিছু কিছু ব্যবস্থা ও ভাবনা সাময়িক অল্পবিস্তর সুবিধে তৈরির আশ্বাস তৈরি করলেও আতংক,উদ্বেগ ও অস্থিরতায় দিন কাটছে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত ঝুঁকি বহনকারীর।এরই মধ্যে ‘নেই মামা’র বিকল্প ‘কানা মামা’ অর্থাৎ online class (virtual class, digital learning কিংবা e-learning যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন)এর ব্যবস্থা অন্ধকারে আলোর ঝলকানির মতো কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।যদিও আংশিক ভাবে গ্রহণযোগ্য যান্ত্রিক এই পদ্ধতিটিকে শ্রেণীকক্ষে পাঠস্থানের (পাঠদান ও পাঠগ্রহণ)বিকল্প বা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা বা মেনে নেওয়া হয়তো কোনদিনই সম্ভব নয়।
ক্লাসরুম কেন্দ্রিক শিক্ষণ ব্যবস্থা অনেক বৃহত্তর জগতের পরিচায়ক।প্রধান এই ‘ছাত্ৰধারায়’ গড়ে ওঠে সান্নিধ্যের পরশমাখা প্রাণোচ্ছল কোলাহলমুখর এমন এক পাঠক্ষেত্র যেখানে অভিভাবকত্বকেও নবরূপে আবিস্কার ও প্রয়োগ এর সুযোগ ঘটে।সবাই মিলে একসঙ্গে বড়ো হয়ে ওঠার এই পরিবেশে ‘মনোবিকাশের ছন্দ’কে খুঁজে পাওয়া যায়।উদ্ভাবনী শক্তিকে জাগিয়ে তোলা আর চিন্তাধারায় উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্র হিসেবে এ যেন এক গর্ভভূমি।তাছাড়া,পড়াশুনাতো কেবল শ্রেণীকক্ষের গন্ডি বা অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকেনা,চারপাশের পরিবেশ অর্থাৎ সামাজিক নানারকম মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা,বন্ধুত্ব, খেলা -ধুলা,আড্ডা, নানা রকম আদানপ্রদানের ভিতর দিয়েই তার উৎসর্জন ঘটে, তার সম্মৃদ্ধি ঘটে।শুধু তাই নয়,এমন এক সংহতি গড়ে ওঠে যা জীবন সম্পর্কে আদর্শ ধারণারও জন্ম দেয় এবং জীবনকে গড়ে তোলার কাজেও উৎসাহ দেয়।
ক্লাসঘরে মুখোমুখি অবস্থানে, চোখের চাহনির ভাষ্য বিনিময়ে উৎসারিত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে গভীর নৈকট্য ও আন্তরিক সম্পর্কের জোরে যে সহজাত শিক্ষাপ্রকল্প ও পরিবেশের উদ্ভব, মনস্তাত্ত্বিক আদান-প্রদানের যে সাংস্কৃতিক উন্মেষ ক্ষেত্রের জন্ম, পরস্পরকে বুঝে নেওয়ার,মানিয়ে নেওয়ার যে অপূর্ব সমাবেশস্থল,পারস্পরিক নির্ভরতা ও নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠার যে জ্ঞানচর্চার জগৎ, online পঠন-পাঠন ব্যবস্থায় তার অনেক কিছুই থাকে অনুপস্থিত।এতদসত্ত্বেও,করোনা উপদ্রুত পরিস্থিতি অতিক্রম করার ক্ষেত্রে,নতুন ব্যবস্থাটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে আমাদের ক্ষতি বা দুর্দশা বাড়বে বই কমবে না। সে ক্ষতি ব্যক্তিগত স্তরে,সে ক্ষতি সামাজিক স্তরে।এই দুর্দশাগ্রস্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য তাই আমাদের মনটাকে উপযুক্ত করে তৈরি করে নিতে হবে।কী ভাবে এই ব্যবস্থাকে শিক্ষায় ক্ষতিপূরণের কাজে লাগানো যায়,কী ভাবে এই ব্যবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা যায় তা খুঁজে নিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত সহযোগিতা কে তো অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। অনলাইন পঠন-পাঠনকে কী ভাবে গ্রহণ করা যায়, ভার্চুয়াল ক্লাসরূম কে সঙ্গী করে কেমন করে সহজেই এগিয়ে যেতে পারি, পশ্চাৎপদতাকে কী করে অতিক্রম করা যায়, সেটাই আমাদের করে দেখাতে হবে।
এদিকে অবস্থা কবে থেকে স্বাভাবিক হবে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না আদৌ।পড়ুয়ারা অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে পারবে কিনা তারও কোনও ঠিক নেই। বাস্তবের ক্লাসরুমে কবে থেকে যে আবার ক্লাস শুরু করা যাবে তাও অনিশ্চিত।তাই আপাতত, virtual class এর উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।তা সে যতই কেবল সবাক ছবির কথা বলা, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, আলোচনা, কথা-বার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক ; জীবন্ত ছাত্র-ছাত্রী কিংবা জীবন্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার বাস্তব উপস্থিতি সেখানে নাই ঘটুক।তাই বলে তো পাঠ গ্রহণ ও পাঠ দান থেমে থাকতে পারে না বা তা বন্ধ রাখা যায় না।তাছাড়া, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, নানারকম শিক্ষা সহায়ক সরঞ্জাম বা শিক্ষা সহযোগী বস্তু (audio aids, audio-visual device, ICT i.e information & communication technology ইত্যাদি) ক্লাসরুমের পঠন-পাঠনেও কতটা কার্যকরী, কতটা ফলদায়ী।তাই, এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই Digital Teaching Learning Process টিকে এবং এই ব্যবস্থাপনাটিকে কী ভাবে আরো উন্নত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা যায়, তাকে সবদিক থেকে অনেক ফাঁক-ফোকরহীন ও কার্যকরী রূপে উপস্থাপিত করা যায় এবং সর্বোপরি তা সর্বত্রগামী হয়, সার্বিকভাবে সকলের কাছে তা এমনভাবে পৌঁছয় যেন প্রত্যেকেই এই পদ্ধতির সুযোগ ও সুবিধার অংশীদার হয়, কেউই যেন এই আধুনিক পদ্ধতির সুফল থেকে বঞ্চিত না হয়।
একইসঙ্গে ‘করোনা’ উদ্ভূত সংকটকালকে অতিক্রম করা আর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাধারা যেন ব্যাহত না হয়, বাধাগ্রস্ত না হয় কিংবা শিক্ষাপ্রবাহ যেন অটুট থাকে এটাই এই সময়ের একান্ত লক্ষ্য। E-learning বলতে যখন বোঝায়, ‘learning through electronic resources at anytime and anywhere’. সেক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি যে বিষয়টির কথা এখন না বলে উপায় নেই তা হলো — online education system এর বিস্তার, তার সর্বাঙ্গীণ ও পূর্ণ রূপায়ণ এবং বাস্তবায়নের সাফল্য অর্জন করার পূর্ব শর্তটি অর্থাৎ ব্যবস্থাপনাটির পরিকাঠামোগত দিক আর পড়ুয়াদের তা গ্রহণের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব ও সহমর্মিতা দিয়ে বিচার করতে হবে। একথা আমরা সকলেই অবগত যে প্রাথমিকস্তর থেকে গবেষণাস্তর পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক ছাত্র – ছাত্রীদের সবার কাছে সামগ্রিকভাবে পৌঁছনোর মতো প্রতিবেশ ও পরিকাঠামো এখনও এদেশে গড়ে ওঠেনি। সমাজের সকলস্তরের সকলশ্রেণীর পড়ুয়াদের এই সর্বার্থসাধক শিক্ষাধারাটির অন্তর্ভুক্ত করার সময় তাই খেয়াল রাখতে হবে ‘digital devide’ যেন কোনও ভাবেই তৈরি না হয়, সুযোগপ্রাপ্ত আর সুযোগবঞ্চিত ছাত্ৰ-ছাত্রীদের ভিতর ব্যবধান যেন না গড়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, এদেশে গড়ে ৬৮-৭০% মানুষেরই অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নীচে এবং বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। অত্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট কিংবা নেটওয়ার্ক সিস্টেম এর উপস্থিতি (connectivity) এখনও যথেষ্ট নয় বরঞ্চ তা অত্যন্ত অপ্রতুল। তাছাড়া ‘আমফান’ এর মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়লে কী দুরাবস্থা হয় সে অভিজ্ঞতা তো আমাদের সকলেরই হয়েছে। এদিকে আর্থিক সংগতির অভাবে অনেকেরই কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এর মতো প্রয়োজনীয় ডিজিট্যাল প্লায়টফর্ম ওরিয়েন্টেড ডিভাইস গুলি ক্রয় করার ক্ষমতা নেই। শুধুই কি তাই? প্রতিদিন নেট পরিষেবা ব্যবহার করার জন্য ব্যয়ভার মেটানোর সামর্থ্যও অনেকেরই নেই।ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এই সীমাবদ্ধতাগুলি ছাড়াও ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পঠন-পাঠন চলাকালীন দেখা ও শোনার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই যান্ত্রিক ত্রুটি বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় যা মনোসংযোগে বাধা দান করে।এছাড়া, এই কৃত্রিম পদ্ধতিটির সংগে সংগতি রেখে প্রাথমিক পর্বে পড়ুয়াদের তর তরিয়ে অগ্রসর করিয়ে দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবও বেশ চিন্তার উদ্রেক করে।একজন ছাত্র বা ছাত্রীরও যেন কোনও ধন্দ না থাকে , যেন কোনও অসন্তুষ্টি না থাকে বর্তমান আলোচিত ব্যবস্থাটি প্রসঙ্গে — এই বিষয়টিও সুনিশ্চিত হওয়া চাই।সেক্ষেত্রে, এই আপাতত নুতন পদ্ধতিটিকে স্বয়ংক্রিয় করে তুলতে ও প্রবর্তন করতে রাষ্ট্র ও তার সহযোগী সংস্থাগুলির আর্থিক বিনিয়োগ ও সহায়তা কে এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে যেন শিক্ষার সুযোগ, ক্ষমতা, অধিকার, পথ বা উপায়, তার স্বাভাবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য সর্বজনের জন্য নিশ্চিত ও সাধ্যায়ত্ত করা যায়। আর ছাত্র – ছাত্রীদের ভবিষ্যতের সুনাগরিক হয়ে ওঠা, তাদের জীবন-জীবিকার পথ সুগম করার এই প্রকল্পে সরকারের সমদর্শিতা ও ন্যায়বিচার তাই কতটা জরুরি সেকথা বোধ হয় বলে বোঝানোর দরকার নেই।