Role and Responsibilities of Rabindra Sangeet Artists
Ankhi Roy, Assistant Professor, Department of Rabindra Sangeet, Rabindra Bharati University
Abstract:
Rabindra Sangeet, the musical legacy crafted by the legendary poet Rabindranath Tagore, holds a unique place in the cultural tapestry of Bengal and beyond. This musical genre encompasses a rich fusion of poetic verses, soul-stirring melodies, and intricate rhythms. The artists who choose to delve into the realm of Rabindra Sangeet inherit not only a musical tradition but also the responsibility of preserving and enriching this cultural heritage. This paper aims to explore the multifaceted role and responsibilities of Rabindra Sangeet artists in the contemporary context. It delves into the historical significance of Rabindra Sangeet, its evolution, and the distinctive features that set it apart. Moreover, it sheds light on the intricate nuances of rendering Tagore’s compositions and the challenges faced by artists in maintaining authenticity while infusing a modern touch. The responsibilities of Rabindra Sangeet artists extend beyond mere musical performance. They act as custodians of Tagore’s vision, transmitting the cultural ethos embedded in his verses. This paper also examines the educational aspect, emphasizing the role of artists in teaching and passing on the tradition to the next generation. Additionally, the societal impact of Rabindra Sangeet and the artists’ role in fostering cultural understanding and unity are explored. In conclusion, this exploration seeks to underscore the significance of Rabindra Sangeet artists as cultural ambassadors, educators, and torchbearers of a musical heritage that transcends time and borders. It emphasizes the need for a holistic approach, wherein artists not only master the technical aspects of performance but also embrace their responsibility in preserving and promoting the cultural legacy encapsulated in Rabindra Sangeet.
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা ,- আঁখি রায়, সহকারী অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রসংগীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সৃষ্টিকর্মের মধ্যে গানই ছিল তাঁর সবচেয়ে আপন এবং সবচেয়ে প্রিয়। গান রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ যে আনন্দ, তৃপ্তি এবং প্রশান্তি অনুভব করতেন তা আর কিছুতে তেমন তীব্রভাবে অনুভব করেননি। ৬৩ বছর বয়সে তাই তিনি বলেছেন-“আজ নাগাদ প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে খুব কষে গানই লিখছি।…আর একটা কথা বলে রাখি গান লিখতে যেমন আমার নিবিড় আনন্দ হয় এমন আর কিছুতে হয় না। এমন নেশায় ধরে যে, তখন গুরুতর কাজের গুরুত্ব একেবারে চলে যায়, বড় বড় দায়িত্বের ভারাকর্ষণটা হঠাৎ লোপ পায়। কর্তব্যের দাবিগুলোকে মন এক ধার নামঞ্জুর করে দেয়।”১
যে সৃষ্টিকর্মে তিনি অবিচ্ছেদ্য অবকাশ এবং বিপুল আনন্দ অনুভব করতেন খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই সৃষ্টির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আত্মবিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন-এ গান বাঙালিকে গাইতেই হবে। সেকথাকে পুরোপুরি সত্য প্রমাণিত করেছে আজকের বাঙালি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় দুইশত বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তবু রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। আর এখনো পর্যন্ত প্রচুর নিত্যনতুন গবেষকরা রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে নানা গবেষণা করে চলেছে। নিত্যনতুন শিল্পীরাও সেই গান নব নব রূপে পরিবেশন করে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যত্যয় যে ঘটবে না, সে বিষয়ে বাঙালি সমাজও আত্মবিশ্বাসী। তার কারণ রবীন্দ্রসংগীতের চলন,যা মূলত সরল, তার নিরাভরণ সুর, গভীর ভাবসম্পন্ন এমন বিপুল গানের সম্ভার যা বাঙালিকে প্রতিটি অনুষ্ঠান, উৎসব, উপলক্ষ্যে গাইতে হয়েছে,এখনো হয়।এমনকি ব্যক্তি জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে,নানা সংকটে, বেদনায় ,আনন্দে গীতবিতান বাঙালির সহায় এবং আশ্রয় হয়ে উঠেছে। এতো গেল সমগ্র বাঙালি সমাজের তথা শ্রোতা সমাজের কথা। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পীদের এতে ভূমিকা কতটা গুরুতর সে বিষয়ে আমাদের আলোচনা করা আবশ্যিক।
রবীন্দ্রনাথ এক বেশ বিচিত্র সাংগীতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন। বিচিত্র কথাটা বলার অর্থ নানা ধরনের গানের চর্চা চলতো সেসময় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল থেকে শুরু করে নাটকের গান, বাউল, কীর্তন এবং পাশ্চাত্য সংগীতের প্রবল চর্চা হতো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে পিয়ানো বাজিয়ে গান রচনা করতেন। এছাড়া যদুভট্ট, বিষ্ণু চক্রবর্তীর মত দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে রবীন্দ্রনাথ সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত সঙ্গীতের প্রভাব তাঁর গানে থাকলেও, কোথাও যেন রবীন্দ্রনাথের গানকে আমরা একেবারে ভিন্নমাত্রায় পাই। তাঁর ২২৩২টি গান একে অপরের থেকে একেবারে ভিন্ন, প্রত্যেকটি গান ভিন্ন ভাবমাধুর্যে ঋদ্ধ। শুধুমাত্র স্বরলিপি গায়ন কখনোই রবীন্দ্রনাথের গানের সঠিক পরিবেশনা নয়।
প্রত্যেকটি গানের ভাব অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ তার লয়, তাল ,ছন্দ, সুর যোজনা করেছেন। তা সঠিকভাবে উপলব্ধি না করে গায়ক -গায়িকা সেই সংগীতকে তাদের গায়নের মাধ্যমে একটা সাধারণ গান ছাড়া কখনোই তা শিল্পতে উত্তীর্ণ করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ নিজে বলে গেছেন “আমার গানে তোমরা স্টিমরোলার চালিয়ো না”।২
তিনি নিজেই নানা শিল্পীদের কন্ঠে তাঁর সৃষ্ট গান শুনে কখনো কখনো নিজেই নিজের গানকে চিনতে পারতেন না।“মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়।”৩
সুরভ্রষ্টতার সংকটকে মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটা গানের স্বরলিপি সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু শুধু স্বরলিপিটাই গাওয়া শিল্পীর কর্তব্য নয়। এ বিষয়ে শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন-“গুরুদেবের গান রচনার কয়েকটি বিশেষ রীতি ছিল। গানের ভাবের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি স্থির করতেন কোন তালের ছন্দে গানটির সুর যোজনা করতে হবে।”৪
এখানে দুটি বিষয় উঠে আসছে ভাব এবং ছন্দ বা তাল। বেশিরভাগ স্বরলিপিতে লয়ের উল্লেখ নেই। সেক্ষেত্রে গায়ক-গায়িকাকে গানের ভাবব্যঞ্জনা উপলব্ধি করে, তার লয় নির্বাচন করতে হবে।লয় নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শান্তিদেব ঘোষ আরো বলেছেন-“শ্রদ্ধা, বন্দনা ,ভক্তি, গম্ভীর ও শান্ত প্রকৃতির গানগুলিতে তিনি হিন্দি চৈতালের ধ্রুপদ গানের রচনা অনুযায়ী সরল ও নিরাভরণ সুর যোজনা করতেন। সহজ তালে একই প্রকার গান রচনার সময়ও দেখা গেছে যে সুর যোজনা তার গীতি রীতিতে ধ্রুপদের রচনা রীতির ছাপ। উদ্দীপক ও উল্লাসের কবিতায় যখন সুর বসাতেন তখন সুরগুলি প্রায়ই পরস্পরের সঙ্গে বেশ খানিকটা ব্যবধান রচনা করে ওঠানামা করত। এসব গান মধ্যলয়ের গতিতে গাইতে হয়, বাণীর ওপর নির্দিষ্ট ছন্দের ঝোঁক দিয়ে। আনন্দ চঞ্চল আবেগের গানে তিনি সুর বসাতেন দ্রুত লয়ের ঘন সন্নিবিষ্ট ছন্দের ঝোঁকে। হতাশা, বিষন্নতা, বিরহ বেদনা, দুঃখ বা কান্নায় আবেগের কথা সুর বসিয়েছেন গড়ানো বা ঢিমালয়ের তালে। কখনো কখনো ঢিমালয়ের তালের বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়ে এ ধরনের গানকে ভাঙ্গা বা অনিয়মিত ছন্দে গেয়েছেন।”৫
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গানের যে বহুবৈচিত্র্য ভাবাবেগ তাকে সঠিকভাবে অনুধাবন ক’রে গায়ক-গায়িকাদের কর্তব্য তার সঠিক লয় নির্বাচন করা। সঠিক লয় নির্বাচনের মাধ্যমে গানের প্রকৃত রূপ তার সৌন্দর্য, তার রস ফুটে উঠবে। অর্থাৎ এখানেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক-গায়িকার শিল্পচেতনার পরিস্ফুটন ঘটবে। শুধুমাত্র সুরে,ছন্দে, তালে এবং স্বরলিপি-সম্মত গাওয়াই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কাজ নয়। এখানে রবীন্দ্র সাহিত্যচর্চার দিকটাও উঠে আসে এবং তার সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের জীবন, তাঁর যাপন অর্থাৎ সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধির প্রয়াস না থাকলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রকৃত পরিবেশনা অসম্ভব।
শুধুমাত্র লয় নির্বাচন নয় তালের ছন্দ বিক্ষিপ্ত করে গাওয়াও এক ধরনের বিকৃতি। আগেই বলা হল সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে জানা অর্থাৎ তার প্রয়োজনীয়তা কতটা ভূমিকা রাখে ,একজন রবীন্দ্রসংগীত গায়ক-গায়িকার জীবনে- এ বিষয়ে বলি, যেসব রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা, রবীন্দ্রনাথকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন যেমন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমল দাশ, সাহানা দেবী, অমিতা সেন, শৈলজারঞ্জন মজুমদার ,শান্তিদেব ঘোষ, পঙ্কজ মল্লিক এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী যাঁরা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর পর রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন রবীন্দ্র-স্নেহধন্য শিক্ষক তথা শিল্পীদের কাছে ,যেমন সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা ঘটক, সুবিনয় রায় ,দেবব্রত বিশ্বাস তাঁদের গানের যে বৈশিষ্ট্য, যে মাধুর্য, যে শিল্প পরতে পরতে ফুটে উঠৈছে তা অনস্বীকার্য এবং রবীন্দ্রসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে আমরা এখনো তাদেরই জানি। তার পরবর্তীকালে কতিপয় শিল্পী ছাড়া কিন্তু তেমন শিল্পী আমরা সেইভাবে পেলাম না যাদের গান আমরা স্বয়নে, স্বপনে ,জাগরনে অবিরত শুনতে পাই, শুনতে পাই তার প্রতিধ্বনি। রবীন্দ্রনাথের গান বললেই যাঁদের কন্ঠ আমাদের শ্রবণে, মননে তার ধারা বর্ষিত হয়, সেই প্রত্যেক শিল্পীর(উপরে উল্লিখিত শিল্পী গান)গানের ধরন অর্থাৎ স্টাইল একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। এর কারণ এঁরা তাঁদের মনন দিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের মত করে সত্যরূপে রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রসংগীতকে অবিচ্ছেদ্যভাবে চর্চার মাধ্যমে তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। তাঁদের এই শিল্পী মননের প্রকাশ হিসেবে তাঁদের গীত এক একটা রবীন্দ্রসংগীত আমাদের কাছে এক একটা সম্পদ।
রবীন্দ্রনাথের গানে আরো একটি দিক হলো স্বরপ্রক্ষেপণ। পুরোপুরি মৃদুস্বরে গাওয়া আবার একটানা প্রবল স্বরে গাওয়া এও এক ধরনের বিকৃতি। রবীন্দ্রনাথের এক একটা গানের বাণীর এক একটি শব্দ তার ভাব অনুযায়ী কখনো মৃদু ,কখনো প্রবল, কখনো মধ্য প্রবল, কখনো মধ্য মৃদু, কখনো ক্রমশ মৃদু রূপে প্রক্ষেপিত হয় এক একটি গানের মধ্যে স্বরপ্রক্ষেপণের বিস্তর ওঠানামা থাকে, তাকেও সঠিক রূপে বা সূক্ষ্মরূপে অনুধাবন করা গায়ক গায়িকার কর্তব্য। এক্ষেত্রে শান্তিদেব ঘোষের আরো একটি উক্তিতে আমরা পাই-“বন্দনা, শ্রদ্ধা, শান্ত, উল্লাস ,উদ্দীপনা, আনন্দ চঞ্চল, দুঃখ, ক্রোধ, বিরহ বেদনার ভাব যুক্ত কবিতার কবিতার আবৃত্তিকালে নানা প্রকার কণ্ঠস্বর প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। তেমনি গানের রসভেদে কণ্ঠস্বরের হ্রাস বৃদ্ধি অর্থাৎ কখনো মৃদু কখনো মধ্য বল কখনো প্রবল কখনো ক্রমশ মৃদু থেকে ক্রমশবৃদ্ধি থেকে ক্রমশ মৃদুস্বর কন্ঠে প্রয়োগ করতে হয়।”৬
রবীন্দ্র সংগীতের আরো একটি বিশেষ দিক হলো উচ্চারণ। সঠিক উচ্চারণ বা উচ্চারণের শুদ্ধতা গানের সৌন্দর্যের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর ততোধিক অশুদ্ধ উচ্চারণ গানের সৌন্দর্যকে ম্রিয়মান করে দেয়। সেক্ষেত্রে গায়ক গায়িকাদের একটি বিশেষ এবং প্রাথমিক কর্তব্য হল সঠিক উচ্চারণ। যেমন একটি শব্দের একাধিক উচ্চারণ হয়, সেটি কোন গানে কিভাবে উচ্চারিত হবে সে বিষয়ে অবগত হওয়া প্রয়োজন ।যেমন ‘একটি নমস্কারে প্রভু’ গানে ‘একটি’ শব্দটির উচ্চারণ একপ্রকার। আবার ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ গানে আভোগ অংশে ‘আমার শুধু একটি মুঠি ভরি’-এখানে ‘একটি’ শব্দটির উচ্চারণ ‘একোটি’ অর্থাৎ এখানে উচ্চারণটি আবার ভিন্ন। এরকম একটি শব্দের ভিন্ন উচ্চারণ বা প্রত্যেকটি অক্ষরের, যেমন র,ড়,ঢ়-এর সঠিক উচ্চারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে সঠিক গুরুর কাছে রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষা এবং অনুশীলনের গুরুত্ব অনুভূত হয় বারবার।
এছাড়াও একই শব্দের ভিন্ন ভাব এবং সেই ভাব অনুযায়ী তার উচ্চারণ এবং প্রক্ষেপণ তা শিক্ষনীয়। যেমন আয় ,এসো, আঃ ,আহা ,ওগো, কী, না, যাও ,তুই ,তুমি প্রভৃতি শব্দগুলি গানের ভাব অনুযায়ী একেকবার একেক রকম ভাবে প্রকাশ পেয়েছে অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন হৃদয় আবেগে গ্রথিত একই শব্দ যার প্রক্ষেপণ, উচ্চারণ এবং নাটকীয়তা ভিন্ন ভিন্ন রূপে গায়ক-গায়িকা সংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে। তার সঠিক রূপে প্রকাশ করবে, এইতো কর্তব্য। রবীন্দ্রনাথের গানে এই সমস্ত শব্দের সঠিক সুরযুক্ত স্বরভঙ্গি তা গভীরভাবে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের নাটকের গানেরও একটি আলাদা রূপ আছে।যেমন গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের গান প্রকৃতই নাটক নির্ভর। সেখানে লয়ের ওঠানামা সুরের ওঠানামা আরো প্রবল। এখানে গানের নাটকীয়তা আবশ্যক। চরিত্রানুযায়ী গানের নাটকটা সঠিকভাবে জানা চরিত্রকে উপলব্ধি করা,তাকে যাপন করা খুবই প্রয়োজন। এখানে অভিনেতার যা ভূমিকা গায়কেরও ঠিক একই ভূমিকা থাকে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকাকালীন তাঁর রচিত নাটক যখন অভিনীত হত সেখানে যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁরা বেশিরভাগই সঙ্গীতজ্ঞ কিন্তু অভিনয়েও তাঁরা ঠিক সমান ভাবেই পারদর্শী ছিলেন। সেইসব তথ্য আমরা রবীন্দ্র-স্নেহধন্য কিছু মানুষের স্মৃতিকথায় পাই। যেমন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সকল গানের ভান্ডারী’ তেমনি ছিলেন তাঁর ‘সকল নাটের কান্ডারী’। তাঁকে ‘উৎসবরাজ’ আখ্যা দিয়েছিলেন পুরনো আশ্রমিক তথা সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী। দিনেন্দ্রনাথ যখন তাঁর বৃহৎ বপু নিয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হতেন,তাঁর অভিনয়শৈলীতে প্রত্যেকে বশীভূত হয়ে থাকতো এবং তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের গান যা তাঁর চরিত্রকে আরো বহুগুণ উচ্চকিত করে তুলতো। তাছাড়াও রবীন্দ্রনাথ নিজে অসাধারণ অভিনেতা ছিলেন। বাল্মীকিপ্রতিভার বাল্মীকি, ফাল্গুনীর অন্ধ বাউল, বিসর্জনের রঘুপতি বা কখনো জয়সিংহ, ডাকঘরের ফকির ,এছাড়াও বিভিন্ন নাটকে নানা সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অবতারণা করেছেন এবং সেইসব অভিনয়ের সাক্ষী যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেউই আর বেঁচে নেই কিন্তু আজীবন সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এবং সেই স্মৃতি তাঁরা লালন করে গেছেন। সেইসব মূল্যবান স্মৃতি তাঁদের স্মৃতিকথার রঞ্জিত করে গেছেন। সেই সমস্ত লেখা এবং চিত্র দেখলে আমরা আজও শিহরিত হই এবং সেইসময়টা আমাদের চোখের সামনে মুর্ত হয়ে ওঠে। এই সমস্ত কিছু বলার কারণ- একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে কতটা বহুধাবিস্তৃত হতে হয় এবং শুধু গান নয় তার সুপ্ত অভিনয় ক্ষমতার প্রকাশও ঘটাতে হয়। অর্থাৎ একজন প্রকৃত শিল্পী বা শিল্পমানস সম্বলিত ব্যক্তি না হলে বা সেই চর্চা না থাকলে রবীন্দ্রনাথের গান কন্ঠে ধারণ করা,বা গানের সবচেয়ে সুন্দর রূপটা ফুটিয়ে তোলা কঠিন। এই গান শুনতে যতটা সহজ মনে হয় ঠিক ততটাই কঠিন এই গানকে পূর্ণ সুন্দররূপে গায়নের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
যেহেতু রবীন্দ্রনাথের গান বহুমাত্রিক,বহুবিস্তৃত এবং এর বিচিত্রতা এবং গায়কী সম্বন্ধে বলতে গেলে তা বৃহদাকার প্রবন্ধ বা তারও বেশি কিছুতে পরিণত হতে পারে। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে বা এর মুখ্য বক্তব্যটুকু যদি ধরতে চাই তাহলে শান্তিদেব ঘোষের ভাষায় বলতে হয়-“গুরুদেবের যে কোন গানের সুষ্ঠু পরিবেশনের প্রয়োজনে গায়কের আবশ্যকর্তব্য হবে। লিরিক কাব্য হিসেবে সমগ্র গানটির মূলভাবটিকে অন্তরে অনুভব করবার চেষ্টা করা এবং গানের প্রতিটি শব্দ ব্যবহারের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা ।এছাড়া আবশ্যক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগ রাগিনী এবং দেশী সুরের মধ্যে নানা প্রকার লিরিক আবেগ যেভাবে সঞ্চিত আছে তাকে হৃদয় গ্রহণ করবার শিক্ষা।”৭
শেষের উক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। দেশীয় সুর এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের রাগ রাগিনীর যে আবেগ তা উপলব্ধি করার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র গানের সুর যোজনা, তার বৈশিষ্ট্য ,তার স্বকীয়তা ,তার অনন্যতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়।এ ও গায়ক গায়িকার গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার একটি বিষয়।
এছাড়া তাল ও ছন্দের শিক্ষা এবং রবীন্দ্রগানের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগভাবনা অনুধাবন করাও কর্তব্য। এছাড়া গায়নের ক্ষেত্রে সংযম এবং পরিমিতবোধ থাকা গায়ক-গায়িকার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হওয়া উচিত। শেষে বলি, প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ (বুলা মহালানবিশ)-এর সংগীতচর্চা কেন্দ্র ‘গীতালী’র সূচনা দিনে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান সম্বন্ধে বলেছিলেন-“আমার গান যাতে আমার বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে- তাদের মাটি করে দাও না আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি- তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি ।এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য, মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সবকিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম। বুলাবাবু তোমার কাছে সানুনয় অনুরোধ -এদের একটু দরদ দিয়ে ,একটু রস দিয়ে গান শিখিও- এইটাই আমার গানের বিশেষত্ব।”৮
এমন একজন বিশ্বশ্রেষ্ঠ সংগীতস্রষ্টার হৃদয়ে কতটা বেদনা সঞ্চিত হলে তিনি এমন সানুনয় অনুরোধ এবং মিনতি করে জানাচ্ছেন যে তাঁর গান যেন তাঁর মত করে আমরা গাই। একজন স্রষ্টার সৃষ্টিকে যদি প্রকৃত মর্যাদা দিয়ে তার বিশেষত্ব উপলব্ধি করে তা আমরা না প্রকাশ করতে পারি তবে সেই স্রষ্টাকে অবমাননা এবং অবমূল্যায়ন করা ছাড়া কিছুই হয় না।
আমার মনে হয় সমস্ত রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার্থী এবং গায়ক-গায়িকাদের এ বিষয়ে গবেষণা এবং গভীর চিন্তাভাবনার জায়গা থেকেই যাচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রকৃত পরিবেশন তখনই হবে,যখন তা গায়নের মধ্যে স্রষ্টা এবং গায়কের শিল্পভাবনার মিলন উদযাপিত হবে।এই উদযাপন যেন বারবার ঘটে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে-এই আশা রাখি।
তথ্যপঞ্জি:-
১.চক্রবর্তী,সুধীর। গানের লীলার সেই কিনারে। কলকাতা: প্রতিভাস।১৩৯২:পৃষ্ঠা-১৮
২.ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। সংগীত চিন্তা। কলকাতা: বিশ্বভারতী। ১৩৭৩। পৃষ্ঠা-২৫৬
৩.ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ।সংগীত চিন্তা। কলকাতা: বিশ্বভারতী।১৩৭৩:পৃষ্ঠা-২৫৬
৪.ঘোষ, শান্তিদেব। রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতা: বিশ্বভারতী। ১৩৪৯: পৃষ্ঠা-৩০৫
৫.ঘোষ, শান্তিদেব। রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতা: বিশ্বভারতী। ১৩৪৯: পৃষ্ঠা-৩০৫
৬.ঘোষ, শান্তিদেব।রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতা: বিশ্বভারতী। ১৩৪৯: পৃষ্ঠা-৩০৬
৭.ঘোষ, শান্তিদেব। রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতা: বিশ্বভারতী। ১৩৪৯: পৃষ্ঠা-৩০৬
৮. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ।সংগীত চিন্তা। কলকাতা: বিশ্বভারতী।১৩৭৩:পৃষ্ঠা-২৫৬