January 1, 2022

Jibandevata: Exploring Rabindranath Tagore’s Thoughts and Feelings

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

Dr. Mali Mitra. Asst. Prof. In Music. Memari College. Memari. Burdwan.

Abstract:

Rabindranath was a great man of literary culture. We can see the reflection of his versatile talent in many ways. That makes us rich. He had a new consciousness and the vigour of independent thought. For that, he established the soul of the new in the bosom of all the old. With the arrival of the new came the turn to change direction. He aimed to create appeal to the heart by composing and composing one song at a time. The melody and the melody of the song can create a vibration in the divine consciousness of the person, the melody and the melody make the person a pilgrim to Amrita. Although Rabindranath’s music contains a collection of various topics, the essence of spiritual pursuit is expressed in his songs. In these spiritual pursuits, he can wander indiscriminately. Creation always wants to follow the path of innovation, it does not favour repetition. We see the creation of new thoughts and expressions at every level of the poet’s life, based on which new poems, dramas, songs etc. are created. The connection of Rabindranath’s life with nature is intimate and inseparable. World consciousness made the poet’s life great. The poet’s sense of world-consciousness along with the realization of God-consciousness makes him welcome in the bliss of spiritual life-consciousness. This mysterious theory is Rabindranath’s “Jiwandevata Theory”.

Vocabulary – Rabindranath, Anubhav, Jeevandevata, Puja etc.

রবিঠাকুরের অনুভবে জীবনদেবতা

ড. মলি মিত্র, বিভাগীয় প্রধান – সংগীত বিভাগ,  মেমারী কলেজ; পূর্ব বর্ধমান.

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যেন সীমাহীন অনন্ত সমুদ্র স্বরূপ। তাঁর বহুমূখী প্রতিভার গুণরাশির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই নানান ভাবে। যা আমাদের সমৃদ্ধ করে তোলে। তাঁর  মধ্যে ছিল নতুনতর চেতনা ও স্বাধীন চিন্তার উজ্জীবন; সেই জন্য তিনি সকল-কিছু পুরাতনের বুকে নতুনের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নতুনের আগমনের সাথে সাথে এলো  দিক বদলের পালা। এক একটি গান রচনা ও তাতে সুরযোজনা করে অন্তরের আবেদন সৃষ্টি করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। যে গানের সুর ও কথার বাহুল্য মানুষের দিব্য চেতনার মধ্যে স্পন্দন তৈরি করতে পারে সেই কথা এবং সুর মানুষকে অমৃতের পথযাত্রী করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের সংগীতে বিচিত্র বিষয়ের সমাবেশ থাকলেও আধ্যাত্ম-সাধনার মর্মকথাই প্রকাশ করে তাঁর গানে। এই আধ্যাত্ম-সাধনার ক্ষেত্রে তিঁনি অবলীলাক্রমে বিচরণ করতে  পারেন। সৃষ্টি চিরদিনই নতুনের পথকে ধরে চলতে চায়, পুনরাবৃত্তিকে সে বরদাস্ত করার পক্ষপাতি নয়। কবির জীবনোপোলব্ধির প্রতিটি স্তরে নতুন নতুন চিন্তা ও ভাবের সৃষ্টি দেখি, যার আদর্শে তৈরি হয় নতুন নতুন কাব্য, নাটক, গান প্রভৃতি। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের যোগ নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। বিশ্ববোধ কবির জীবনকে করেছিল মহান; কবির এই বিশ্বচেতনার বোধের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরবোধের উপলব্ধি তাকে আধ্যাত্ম জীবনচেতনার আনন্দরসে সমাদৃত করে তোলেন। এই রহস্যময় তত্ত্বই রবীন্দ্রনাথের “জীবনদেবতা তত্ত্ব”।

 এই জীবনদেবতার উপলব্ধি বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের পরমসন্ধান লাভ করেছিল। তিঁনি বিশ্বচেতনা এক এক সময় একক রকমভাবে অনুভব করতেন। এই অনুভবই কবিকে দিয়েছিল তাঁর সত্যিকারের জীবনরসের পরিচয়। তাঁর গানের মধ্যে এই জীবনরসের পরিচয়ই এক অনির্বচনীয় রসের সঞ্চার করে তোলে। তাই কবির গানের প্রকৃতি ও আদর্শ সম্পূর্ণ পৃথক। কবির সৃষ্টির বহু গান পাওয়া যায় যেখানে নিজের সত্ত্বা হারিয়ে বিশ্বাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কবির কাছে এই জীবনদেবতা বারে বারে নানাভাবে এসে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ধরা দিয়েছেন। কবি তাঁর আধ্যাত্ম সাধনার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করেছেন।  তাই তো কবি বলতে পারেন –    

“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে,

সকল অহংকার হে আমার, ডুবাও চোখের জলে।”

এই গানের মধ্য দিয়ে তিঁনি আত্মনিবেদন করেন ভগবানের চরণে, তিঁনি তাঁর আরাধ্যকে বলতে পারেন “সকল অহংকার হে আমার, ডুবাও চোখের জলে।“ এই নিবেদনে কবির গান জীবন জাগরণের আনন্দরসে রসায়িত হয়ে যায়।

 জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষাধারা এবং ধর্ম আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যকে নবজাগরণের চেতনায় সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। সমস্ত জড়তা, ক্লেদ মুক্ত হয়েছিল সেই আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে একাকার হয়ে গিয়ে ছিল  দেবতা ও মানুষ। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে কখন ওই তিঁনি দেবতাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেননি; মানুষের মধ্যেই দেবতাকে খুঁজে ফিরেছেন, আবার দেবতার স্বরূপকেও মানুষের মত করে দেখেছেন। তাই মাঝে মাঝে প্রাণে দেবতার পরশ পাবার চেষ্টা ছিল তাঁর। ঈশ্বরের মহিমার অন্ত নেই। যুগে যুগে, বারে বারে তাঁর নতুন নতুন লীলা। তাই তো কবি গেয়েছেন –

“তুমি জান, ওগো অন্তর্যামী,

পথে পথেই মন ফিরালেম আমি।।

ভাবনা আমার বাঁধলো নাকো বাসা,

কেবল তাদের স্রোতের পরেই ভাসা –

তবু আমার মনে আছে আশা

তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী”।

রবীন্দ্রনাথের যিঁনি জীবনদেবতা, তিনি অন্তর্যামী ।  তিঁনি তাঁর অন্তর্যামীর কাছে নিজের জীবনসাধনার ইঙ্গিত দিয়ে পুনরায় তাঁর অন্তর্যামীর কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলেছেম যে – “তবু আমার মনে আছে আশা, তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী’– অন্তর্যামী আবার স্বামীও। তিঁনি আবার নতুন করে প্রেরণা দেন। জীবনদেবতার প্রতি ব্যাকুলতা এবং তাঁর আশা জীবনের যত স্খলন, পতন, ত্রুটি সবকিছুকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আর কিছুর পরিশেষে তাঁর পায়ের তলেই এসে ঠেকবে বলে তিঁনি আশা করেন, আর এর ভিতর দিয়েই এক অপার্থিব অনুভূতি প্রকাশ পায়।

রবিঠাকুর তাঁর গানে-কবিতায় সর্বত্রই সবার চেয়ে বড় করে জায়গা দিয়েছেন মানুষকে। তিঁনি তাঁর গানে জীবনসত্যের পরিচয় দিয়েছেন। কবি মনে করতেন এই জীবনসত্যের উপলব্ধিতেই মানুষের সত্যিকারের মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়। অসীম এবং অনন্ত বৈচিত্রের মধ্যে তিঁনি জীবনদেবতার রূপ দর্শন করেছেন। আর তাই তিঁনি বলতে পেরেছেন –

“তাই তোমার আনন্দ আমার’ পর

তুমি তাই এসেছো নীচে,

আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,

তোমার প্রেম হত যে মিছে।”

কাব্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেই সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অনেক উর্দ্ধে কবির বিচরণ। তাই কবি তাঁর মনের প্রকাশ ঘটাতে পেরেছেন সুস্পষ্ট ভাবে। তিঁনি এখানে তাঁর ঈশ্বরকে ত্রিভুবনেশ্বর হিসেবে দেখেছেন। কবির ভগবান বিশ্বপ্রাণ জীবনদেবতা। তাঁর সাথে নিত্যলীলা চলে জীবনদেবতার। তাই, লীলাকে বা বৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে ত্রিভুবনেশ্বরের প্রেমলীলা সার্থক হয়না। তাঁর প্রার্থনায় নীচে নেমে এসেছেন এবং একে অপরের সাথে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন ত্রিভুবনেশ্বর। এ এক পরম পাওয়া।

‘কত রুপে, কত গন্ধে, কত গানে, কত ছন্দে’ – বিশ্বপ্রকৃতির বিচিত্র লীলারূপ। তার মধ্যে সে অসীমের আনন্দ প্রকাশ পায়। কবির জীবনদেবতা বিশ্বজনের দেবতা। কবি তাঁর মনকে বিশ্ব-মনের সাথে একাকার করে তুলেছেন। কবি বলেছেন –

“বিশ্ব যখন নিদ্রামগন গগন অন্ধকার,

কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার।’

গান বারে বারেই কবির অন্তরে রঙিন আশার দীপ্তি জাগায়। কবির মনের সাথে বিশ্ব-মনের যে নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক আছে তা জীবনদেবতা মিলন ঘটাতে সাহায্য করে। কারণ জীবনদেবতার বীণার ঝঙ্কারে কবি জাগ্রত হলেও তাঁর সাথে কবির মিলন সম্ভব হয়নি। এই বেদনায় কবি ব্যাকুল। তাই বলেছেন –

 “নয়নে ঘুম নিল কে রে, উঠে বসি শয়ন ছেড়ে,

মেলে আঁখি চেয়ে থাকি, পাইনে দেখা তাঁর।”

যেহেতু জীবনদেবতা বিশ্বজনের দেবতা, তাঁর একার দেবতা নন তাই তাঁর জীবনদেবতার সাথে মিলন হয়নি। তাই তাঁর হতাশা ও বেদনার আকুলতা লক্ষ্য করা যায়। নিস্ফলতার বেদনায় ‘হৃদয়ভরা আশ্রুভারে’ কবির অন্তর বেদনায় ভারাক্রান্ত।

আগের গানে যেমন আমরা দেখতে পেলাম জীবনদেবতার সাথে কবির মিলন অধরা ছিল। তবে এখন যেই গানটির কথা বলা হবে সেখানে কবির বিশ্ববোধের সাথে বিশ্বপ্রেমের মিলন হয়েছে। জীবনদেবতার প্রতি তার মিলন অধরা থাকার জন্য কবির আকুতি আরও বেড়েছে। তাঁর খোঁজা আরও নিত্যনতুন হয়েছে। সেই খোঁজার মধ্যেও একদিকে যেমন ব্যাকুল বেদনাবোধ দেখতে পাওয়া যায় অন্যদিকে আবার আনন্দ পরিলক্ষিত হয়। কবি নিজেই সে সাধনার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন –     

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো।

 সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও,

নয়কো মনে, নয় বিজনে, নয়কো আমার আপন মনে

সবার যেথায় আপন তুমি হে প্রিয়,

সেথায় আপন আমারও।”

কবি এই নতুন বিশ্বজীবন ও বিশ্ববোধের স্পর্শানুভূতি লাভ করেছেন, বিশ্বের সাথেই যোগ সাধন করে। সৃষ্টিলীলার মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কবি তাই প্রকৃতির রূপের মধ্যেও জীবনদেবতা বর্তমান আছেন, তা উপলব্ধি করেছিলেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ‘নয়কো মনে, নয় বিজনে, নয়কো আমার আপন মনে,’ – বনে নয়, বিজনে নয়, ধ্যানে নয়, বৈরাগ্যে নয় – ‘সবহারাদের মাঝে, সবার পিছে – সবার নীচে’ অন্তর্যামীর সাথে কবির আনন্দ খেলা ও প্রেমলীলা। এই গানে কবির বিশ্ববোধের সাথে বিশ্বপ্রেমের মিলন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও আধ্যাত্ম-সাধন সত্যিই অপরূপ ও অভিনব। কবির অন্তরে সুন্দর, বল্লভ, প্রাণেশ, প্রিয়, বন্ধু প্রভৃতির আহ্বান শোনা যায়। কবির গানে মিলন-তৃপ্তিকে নিরাশ না করার জন্য জীবনদেবতাকে গভীর মিনতি জানাচ্ছেন। তাই তিঁনি বলতে পেরেছেন অবলীলাক্রমে –

“এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,

আনন্দ বসন্ত সমাগমে।।

বিকশিত প্রীতি কুসুম হে,

পুলকিত চিত কাননে।।”

এই গানটিতে কবি তাঁর জীবনদেবতাকে প্রাণেশ বলে অভিহিত করেছেন। একটি কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং প্রসার ঘটেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে। তাঁর মধ্যেও এই ধর্মবোধ অটূট ছিল। তিঁনি এই পরিবেশের মধ্যেই লালিত হয়েছিলেন। তাই হয়তো ঈশ্বরের প্রতি তাঁর ভক্তিমত্তার প্রকাশ পাওয়া যায় নানারূপে। এই গানটিতে কবি প্রাণেশের সাথে আনন্দলীলায় উল্লাসিত। ‘বিকশিত প্রীতি কুসুম হে, পুলকিত চিত কাননে।’ – জীবনদেবতার আবির্ভাবে কবি পুলকিত। তিঁনি তাঁর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন বিরহ-বেদনা দূর করে মিলন তৃপ্তি দেওয়ার জন্য। এ কি মানবিক প্রেম! কবি তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে জীবনদেবতাকে জানিয়েছেন যুগে যুগে পলে পলে দিবা-রাত তাঁর জীবনদেবতার জয়গানেই অতিবাহিত হয়েছে জন্ম-জন্মান্তর। জীবনদেবতা আজ প্রসন্ন হয়ে আছেন কবিকে মিলন-আনন্দ দেওয়ার জন্য। কবি ব্যাথা ও বেদনার চিরপূজারী, কারণ ব্যাথা ও বেদনাই তাকে নিয়ে যাবে তাঁর চিরসাথীর সান্নিধ্যে। কবির জীবনে নিরাশার মাঝে আশা ও আনন্দের রেখাপাত করেছে। কবি বলেছেন –

“ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়,

তোমারই হউক জয়,

তিমিরবিদারী উদার অভ্যুদয়,

তোমারি হউক জয়।

আধ্যাত্মিক আকুতি থেকে তিঁনি বুঝেছেন জীবনে জীবনদেবতার সাক্ষাৎ এক পরম পাওয়া। এইখানে জীবনদেবতা এসেছেন জ্যোতির্ময়রূপে। ওনার জয় তিঁনি প্রার্থনা করেন। কবি জীবনদেবতার সামগ্রিক সচ্ছল রূপ তিঁনি দেখেছেন। ‘তিমিরবিদারী’ সেই ‘জ্যোতির্ময়’ রূপে অখন্ড ও খন্ড, পূর্ণ ও অপূর্ণ, অসীম ও সসীম, মুক্তি ও বন্ধন, এক ও বৈচিত্র একাকার হয়ে গেছে। কবি তাঁর ‘আত্মপরিচয়’-এ গানের মর্মকথা প্রসঙ্গে বলেছেন – “পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার সেই পরিপূর্ণ প্রেমের সম্বন্ধ উপলব্ধিই ধর্মবোধ, যে প্রেমের একদিকে দ্বৈত আর একদিকে অদ্বৈত, একদিকে বিচ্ছেদ আর একদিকে মিলন, একদিকে বন্ধন আর একদিকে মুক্তি। তার মধ্যে শক্তি এবং সৌন্দর্য্য, রূপ এবং রস, সীমা এবং অসীম এক হয়ে গেছে; যা বিশ্বকে স্বীকার করেই বিশ্বকে সত্যভাবে অতিক্রম করে এবং বিশ্বের অতীতকে স্বীকার করে বিশ্বকে সত্যভাবে গ্রহণ করে; যা যুদ্ধের মধ্যেও শান্তকে মনে, মন্দের মধ্যেও কল্যাণকে জানে এবং বিচিত্রের মধ্যেও এক কে পূজা করে।”[1]

‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’ – গানটি কবির জীবন-উপলব্ধির তত্ত্ব এবং এই উপলব্ধির তত্ত্ব বা সত্যই কবির জীবনধর্ম। রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধে বলেছেন – “জগতে সৎ, চিৎ ও আনন্দের প্রকাশকে আমরা জ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বিশ্লিষ্ট করিয়া দেখিতে পারি, কিন্তু তাহারাও বিচ্ছিন্ন হইয়া নাই। কাষ্ঠবস্তু গাছ নয়, তার রস টানিবার ও প্রাণ ধরিবার শক্তিও গাছ নয়; বস্তু ও শক্তিকে একটি সমগ্রতার মধ্যে আবৃত করিয়া যে একটি অখন্ড প্রকাশ তাহাই গাছ – তাহা একই কালে বস্তুময়, শক্তিময়, সৌন্দর্য্যময়।”[2]

রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্ম সাধনার বস্তু উপনিষদ। কবির অন্তরে তাঁর অন্তর্যামী জীবনদেবতার সঙ্গে মিলনের প্রতীক্ষাই লক্ষ্যণীয়। আরও একটি গানের উদাহরণ দেওয়া যাক এই প্রসঙ্গে –

“তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ

ও মোর ভালোবাসার ধন।।

দেখা দেবে ব’লে তুমি হও যে অদর্শন

ও মোর ভালোবাসার ধন।।

ওগো তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের

ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন

ও মোর ভালোবাসার ধন।।”

কবি হৃদয়ে আকুল আকাঙ্ক্ষা ও বিরহের কান্না এই গানটির মধ্যে বর্তমান। কবি যে সাধনার মধ্য দিয়ে বারবার জীবনদেবতাকে খুঁজে ফিরেছেন, সেইখানে কবির প্রাণে বিরহ-বেদনার জাগরণ ও নতুন মিলনে আনন্দের শিহরণ দেখা যায়। এই গানে কবির অন্তরের বেদনা যেন তাঁর অন্তর্যামী জীবনদেবতার সঙ্গে মিলন-প্রতীক্ষারই বেদনা। এই বেদনার মধ্য দিয়েও মিলনের ছায়া পরিলক্ষিত হয় উপনিষদে। এই গানে কবির হৃদয়-বেদনা ও বিরহ-ব্যাকুলতার মধ্যে পাওয়া যায় এক অভিনবত্বের পরিচয়।

সবশেষে বলা যেতে পারে কবি বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে ভাঙা-গড়ার, ধ্বংস-সৃষ্টির সত্যটিকে জেনেছেন, এর আলোকে তিঁনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন জীবনদেবতার চিরশাশ্বত রূপটি। বিশ্বসৃষ্টিকে কবি দেখেছেন বিশ্বস্রষ্টার আনন্দময় প্রকাশ রূপে, এই প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বিশ্বসৃষ্টির চিরন্তন সৌন্দর্য্যকে তিঁনি উপলব্ধি করেছেন বারে বারে। স্বর্গীয় অজিত কুমার চক্রবর্তী লিখেছেন – “রবীন্দ্রনাথের পুর্বেকার ধর্মসংগীত গুলি প্রচলিত ব্রহ্মোপাসনার ভাব অবলম্বন করিয়াই রচিত। তখন কবির স্বকীয় কোন আধ্যাত্ম-অনুভূতি জাগে নাই, – তিঁনি আপনার অভিজ্ঞতাকে আপনি বাণীরূপে প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন নাই। সুতরাং তখনকার গানগুলি প্রচলিত উপাসনার সুরের সঙ্গে সুর মিলাইয়াছে।” [3]

প্রতিটি গানেই কবির জীবন-দর্শন ছড়ানো রয়েছে, যেখানে কবির সাথে বিশ্বমানবের জীবনবোধ সুষ্পষ্ট। তাঁর গানে জীবনবোধের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে জীবনদেবতার সাথে কবির চিরআনন্দের খেলা প্রকাশ পায়। তাঁর ভক্তিসংগীতগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তাতে ঈশ্বর ও ভক্তের নিবিড় ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। বিশ্বজগতের অচিন্ত-শক্তির সঙ্গে কবি চিত্তের যে ব্যক্তিগত মানব-সম্বন্ধ স্থাপন হয়েছে তাঁরই প্রকাশ ঘটে জীবনদেবতার মধ্যে দিয়ে। তিনি তাঁর হৃদয়ের গভীর অনুভূতিটিকে তাঁর অনুপম কবিত্ব-শক্তির যাদুতে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী ঈশ্বর জিজ্ঞাসায় যে স্বাতন্ত্ররূপ দেখা গিয়েছিল তার যথার্থ প্রভাব ভক্তিগীতের “জীবনদেবতায়” সুষ্পষ্ট। কবির বিশ্বাত্মবোধ এবং জীবনসত্যের উপলব্ধি গানের ভিতর দিয়েই প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় এবং নাটকে এই জীবনদেবতার উপলব্ধি করেছিলেন বলেই আনন্দসত্তার  রূপটি প্রাণে প্রাণে জাগরণ তৈরি করেছিলেন। এই জন্যই তাঁর রচনায় ছিল  ভাবমাধুর্য্যে ভরা মধুর ও কলায়াণময়।    

     তথ্যসূত্র     


[1] (আত্মপরিচয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

[2] [সাহিত্যের পথে’ – পৃষ্ঠা ৩১ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

[3] [কাব্য-পরিক্রমা(১৯৪০); পৃঃ – ১১০]

সহায়ক গ্রন্থ

১। ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; গীতবিতান; বিশ্বভারতী প্রকাশনী।

২। ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; আত্মকথা; বিশ্বভারতী প্রকাশনী ।

৩। পাল সন্দীপ; রবীন্দ্রনাথের দর্শনচিন্তা; টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

৪। ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; ধর্মভাবনা; বিশ্বভারতী প্রকাশনী।

৫। দেবনাথ ধীরেন্দ্রনাথ; রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু; রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

৬। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ; সংগীতে রবীন্দ্র প্রতিভার দান; শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা।

৭। চক্রবর্তী সুধীর; গান হতে গানে; পত্রলেখা প্রকাশনী, কলকাতা।