মাতৃভাষা বাংলা ও এরাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি
-শক্তি মণ্ডল
খবরে প্রকাশ,বাংলার গর্ব, শিবপুরের আই আই ই এস টি-তে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, সোসাইটি অব মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার -এর উদ্যেগে সেনাদের উদ্দেশে হিন্দিতে একটি শ্লোগান লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা শ্রী পার্থসারথি চক্রবর্তী হিন্দিতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লিখেছিলেন এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে হিন্দির প্রসার ঘটানো উচিত। তিনি হিন্দিতে সইও করেছিলেন। বর্তমান ও প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী এর প্রতিবাদ করেন। সব ভাষায় এটি করার দাবি তোলেন। অধিকর্তা বলেন, “…কেন্দ্রীয় এই প্রতিষ্ঠানে হিন্দি প্রসারের কথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিধিতেই আছে।এরা(প্রতিবাদী পড়ুয়ারা) বাংলার বাইরে যায়নি।তাই এসব নিয়ে ছেলেমানুষি করে যাচ্ছে।”(আ.বা.প./১৪.০৯.২০) সাবাস! তাহলে সব ভাষার সম-অধিকরের দাবি ছেলেমানুষি ?আশ্চর্য এই যে,এখনও পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে একটিও রাজনৈতিক দল বা গণ-সংগঠনের বিবৃতি চোখে পড়েনি।স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েই বাংলার উন্নত চেতনায়, মননশীলতায় ও মুক্তচিন্তায়, শুধু বৃটিশ শাসকরা নয়, জমিদার-পুঁজিপতি শ্রেণিও দারুণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।তাই তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গভঙ্গে সামিল হয়েছিল।বাংলাতে যখন থেকে কংগ্রেস দলে সুভাষ- বিরোধী গোষ্ঠীর প্রাধান্য বেড়েছে, তখন থেকে এখানে অবাধে চলেছে দিল্লির আগ্রাসন। তবু জনগণের আবেগকে মর্যাদা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজ্যের সমস্ত সরকারি কাজে বাংলাভাষাকে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত করার ঘোষণা করা হয়েছিল।১৯৬১ সালে বিধানসভায় এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তা কার্যকর করা হয়নি।
মনে রাখতে হবে, এরাজ্যের উদীয়মান শক্তি বিজেপি কেবল একটি মামুলি রাজনৈতিক দল নয়।এই দলের এবং আর এস এস-পরিচালিত সংঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের অ্যাজেন্ডা হল, বাঙালি জাতিসত্তা, বাংলাভাষা ও বাংলার প্রগতিশীল সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা।যদি তা করা যায়, তবে ভবিষ্যতে আর কেউ রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎ- সত্যজিৎ চর্চা করবে না।তখন সহজ হবে এখানে গো বলয়ের সংস্কৃতি কায়েম করতে।এরই একটি ধাপ হল,সর্বনাশা নাগরিক পঞ্জিকরণ।বিশ্বে বহু ভাষাভাষীদের সম-মর্যাদা দিয়ে সমন্বিত করার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হল লেনিন-স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন।তারই প্রভাবে এদেশের সবকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে দাবি করা হয়েছে,চাষি মজুরদের মাতৃভাষাকেই সরকারের, আদালতের ও শিক্ষার ভাষা করতে হবে।১৯৫৮ সালের ১৯ মার্চ বিধানসভায় কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী বলেন,” যেভাবে অন্যান্য রাজ্যে সেই রাজ্যের ভাষাকে সরকারী স্তরে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, আমরা পশ্চিমবঙ্গে তা যদি না দেই, তাহলে ক্রমশ অন্যান্য ভাষা এসে আমাদের গ্রাস করতে পারে।।এই সংকটের মোকাবিলার জন্য যা যা করা দরকার আমাদের এখনি তার করতে হবে।” কিন্তু দূরদর্শিতা-পূর্ণ একথাকে তখন কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।আমাদের দেশে চাষিদের ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষদের সংগঠিত করার মহান ঐতিহ্য বামপন্থীদের আছে।বস্তুত প্রকৃত বামপন্থাই আর এস এস-এর শ্রেষ্ঠ বিকল্প। কিন্তু তার জন্য তো নিরন্তর এই পন্থার অনুশীলন করতে হবে!
এরাজ্যে বামপন্থী সরকারের আমলে রাজ্যের ৮৬% মানুষের ভাষা বাংলার ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যথার্থভাবেই বলা হয়েছিল,”শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ”। কিন্তু এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল।তার মূল কারণ-১.এই আন্দোলন ছিল সংকীর্ণ বুদ্ধিজীবী-কেন্দ্রিক।একে চাষি,মজুর, জনসাধারণের আন্দোলন হিসাবে গড়ে তোলা হয়নি।২.এটি ছিল দ্বিচারিতায় পূর্ণ।৩.মুনাফালোভী শিক্ষা ব্যবসায়ীরা এবং স্বার্থবাদী বিরোধী দলগুলির ক্রমাগত এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল।পরবর্তীকালে বিভ্রান্ত বামেদের ভাষানীতি যে কী,তা কেউ বলতে পারেন না।এখন অনেক বামপন্থী ‘বাঙালি জাতি’, বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ কথাগুলি শুনলে চমকে ওঠেন। যেন এসব আঞ্চলিকতাবাদীরা বলছেন! অথচ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, গুরুসদয়, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান কতবার এবিষয়ে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।অনেক বামপন্থী মনে করেন,তারা ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’। এসব তুচ্ছ বিষয়ে মাথা ঘামানো তাদের কাজ নয়! কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাকে একটু বদলে বলা যায়- ওরা বিশ্বমায়ের দুঃখে কাতর, নিজের দুঃখিনী মায়ের কান্না ওরা শুনতে পায় না। ওরা গর্জনবিলাসী। যখন থেকে নির্বাচন-সর্বস্বতা বামেদের গ্রাস করেছে, তখন থেকে সুদূরপ্রসারী আন্দোলনের জন্য আত্মত্যাগ থেকে ওরা ক্রমেই দূরে সরছে। নয়া শিক্ষানীতি সম্পর্কে বাম গণ-সংগঠনগুলির বিবৃতিতে ইংরেজির জন্য ব্যাকুলতা আছে। কিন্তু কোথাও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার দাবিতে একটি বাক্যও নেই।
তবে দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বামপন্থীদের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে স্পষ্ট পার্থক্য আছে। ই ভি রামস্বামী পেরিয়ারের নেতৃত্বে ‘আত্মমর্যাদা’-র আন্দোলনের পর তামিলনাড়ুর বাম,ডান, সরকারি, বেসরকারি সব দল মাতৃভাষার পক্ষে এবং হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এককাট্টা। কেরলে স্কুল- স্তরে মালায়লাম বাধ্যতামূলক।মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন স্পষ্ট বলেছেন,”ত্রিভাষা-সূত্র আসলে হিন্দি চাপানোর ষড়যন্ত্র।তা কখনই মানব না।” আর এরাজ্যে বামপন্থীরা সরকারি কাজে এবং বিদ্যালয়ে বাংলাকে এবং একই সঙ্গে যেখানে যেখানে প্রচলিত সেখানে সাঁওতালি,নেপালি প্রভৃতি ভাষাকে আবশ্যিক করার কথা উচ্চারণই করতে পারেন না। আমাদের রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল একটি জনমোহিনী দল। কোনও মৌলিক সমস্যার সমাধান এই দলের সাধ্যের বাইরে।এদের জন্যই রাজ্যে বি জি পি পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাচ্ছে।২০১৭ সালের ১২ মে এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন,রাজ্যের সব সরকারি, বেসরকারি বিদ্যালয়ে একটি বিষয় হিসাবে বাংলা শেখানো আবশ্যিক করা হল। কিন্তু তারপরে এবিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি। বিধানসভাতেও এবিষয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়নি।
এই অবস্থায় কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেয়েও মাতৃভাষা-প্রেমিক যেসব ব্যক্তি ও সামাজিক মঞ্চ দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাভাষার ও অন্যান্য মাতৃভাষার দাবি সোচ্চারে তুলে ধরছেন, তাদের অভিনন্দন জানাই।এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি,’বাংলাভাষাকে ধ্রুপদি ভাষার মর্যাদা’ দেবার দাবি এখন সাংসদ শ্রী অধীর চৌধুরীর মুখে, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শোনা যাচ্ছে।এদেরও অভিনন্দন।সব অগ্রণী চিন্তা যে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাথায় সবার আগে আসবে, এমন কোনও কথা নেই।যেমন নাগরিকপঞ্জি-বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন কিছু সমাজ সচেতন ব্যক্তি ও সংস্থা। তারপর যখন আন্দোলনের জমি তৈরি হল, তখন একে একে সব রাজনৈতিক দল পথে নামল। একইভাবে বাঙালি ও বাংলাভাষার দাবি ক্রমবর্ধমান হলে,জল মেপে দেখে,হয়তো একদিন এই রাজনৈতিক দলগুলি এগুলি নিয়ে পথে নামবে।গড়ে তুলবে বাংলাভাষার জন্য সেল, গণ-সংগঠন।।