মন নাকি মনোরঞ্জন : সিনেমা , অভিনেত্রী এবং সত্যজিৎ রায়
মৌ চক্রবর্তী
১.১ মন নাকি মনোরঞ্জন
বাংলা সিনেমার পাহাড়। সিনেমাগুলো শুরুতেই যে পথ ধরে ফেলেছে, তা আদতে মনোরঞ্জনের আয়োজনে তৈরি। তাতেই ব্যবসা। নির্বাক ছবির হাতেখড়ির পরই, বাংলা ছবির অর্থনীতির পারদ চড়া সংস্কৃতির মেজাজে। সিনেমার শর্ত তো বিনোদন। নাট্যচর্চার শিল্পীদের মতন তার শিল্পের মধ্যে আন্দোলনের জোয়ার আনার দরকার হয় না। এমনিতেই বাজার পায়। বেশি দেরি হয় না, সাদাকালোতে নায়িকার ভাব, নায়িকার গান-নাচের দৃশ্যকে একটু রঞ্জিত করতে। সেখানে সত্যজিৎ রায় এলেন এক অতি-বাস্তব নিয়ে। সেখানে মাত্র ৩৭ টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। আর নির্মাণকাল মোটে ৩৬ বছর। উক্ত সিনেমায় চালচুলোহীন সমাজ, বিপন্ন পরিবারের প্রতিনিধিত্বে কি মন টান হতে পারে? এসব সিনেমার শুরুটায় বুঝিয়ে দেয় মন না পেলেও, মনোরঞ্জন কখনই নয়। এইখানেই দ্বন্দ্ব, ছন্দ এবং সিনেমার পাঁচালী, এক অন্য পথ ধরে চলল। এমনকি স্রষ্টার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী- যাঁদের প্রথম ও শেষ চেনার সনদ হয়ে রইল – সত্যজিৎ রায় – এর সিনেমা। এক কথায়, বলা যায় না। বাংলা সিনেমায় কাজ করে, কোনও অভিনেত্রী বিশ্ব সিনেমায় গৃহীত হয়েছেন, নাম খুঁজতে থাকার।
6
১.২ নায়িকা নাকি অভিনেত্রী?
নায়িকাও একপ্রকারের অভিনেত্রী। কিন্তু সব অভিনেত্রীই নায়িকা নন। পেশাদারিত্বে টিকে থাকতে গেলে শুধু চরিত্রাভিনেত্রী হয়ে থাকলেও চলে না। অভিনয়ের খিদে থেকেই বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়েও, লক্ষ্যে থাকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়। নায়িকা। নায়িকা মানে বেশি আর্থিক লাভ। ফলে রোজগার এবং সিনেমায় আরও কাজ। তখনও বিজ্ঞাপনে ছেয়ে থাকার যুগ আসেনি। নায়িকা মানে সর্বত্রগামী নন। নায়িকা মানে সর্বজনসমক্ষে বিজ্ঞাপিত হতে থাকা নয়। অবশ্যই নিয়মমাফিক চলা এক অভিনয়ের চাকরি। তবে এর বৃত্তের পরিধি বাংলা সিনেমার, ভাষা বাংলার চত্বরের। আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার পথ, জানা নেই তার।
সিনেমার সঙ্গে তো এক উপনিবেশকেন্দ্রিক জীবন। যাদের সঙ্গে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা সবই জুড়ে যায়। এবং জীবনের চাহিদায় ঘরের চৌহদ্দিতে থাকা কোনও কোনও মেয়েদের সিনেমায় কাজ খুঁজতে হয়। যেমন, কানন দেবী, যেমন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ওঁদের জীবনের সঙ্গে সিনেমার যোগসূত্র তাত্ত্বিক নয়, ভাবুক হওয়ার নয়। কেবলই প্রয়োজনের খাতিরে পরিবারের অনুমতি পেয়ে কাজ করার। সিনেমার একটা মাধ্যম হয়ে এলেও, বাঙালির সংস্কৃতির ধ্বজা ওড়াবে, এমন কোনও শর্ত টুকরো উদ্বাস্তু জীবনের বাংলার ছিল না।
ফলে, আঞ্চলিক সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভাত-কাপড়ের জোগাড় করতে আসা অভিনেত্রীদের লক্ষ্য হয় রোজগার। সেটা যুক্তিও বটে, জীবন তো শুধু শিল্পের গুণে চলে না। ফলে, সিনেমার পর্দায় ভাল অভিনেত্রীদের থাকাটা বাঙালির অন্তঃপুরে থাকা মেয়েদের মতনই। সেখানেই হাসি-কান্নার জীবন। চোখে গ্লিসারিন, চকচকে মুখ। মুখর সংলাপ। হাততালি। টিকিট বিক্রি। হাউস ফুল শো। এই পর্যন্ত ব্যবসা এবং সিনেমার অন্তর্বর্তীকালে সর্বজয়া-দের শুরু। পড়াশোনা জানা, সার্বিকভাবে নিজস্ব বোধের জন্যে গণনাট্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা এক সত্তার পক্ষে সেকালের বাংলা ছবির আবহাওয়া অচেনা ছিল না। এর বাইরের কিছু হতে পারে, তখনও ভাবতে পারেনি রুচিশীল বাঙালি। জনৈক এক সাংবাদিক সদ্য ৯ মে চলে যাওয়ার সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে লিখেছেন যে, তিনি ফিল্মের মহাকবি। এই দিয়ে পরিচালকের জন্যে ভূমিকাটি সারা হলেও, বাকি থেকে যান, নায়িকা , অভিনেত্রী হতে আসা শিল্পীদের আলোচনা।
7
ছবি ৩ ও ৪
নায়িকার কাজ মনোগ্রাহী হতে হবে। বাণিজ্য দিতে হবে। সেই কর্মধারার উলটোদিকে সত্যজিৎ কি করতে চলেছেন , তা বোঝার জন্যে ১৯৫৫ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এবং, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সেই পরিচালকের দেখা হতে হবে, যাঁর কাছে সিনেমার আগ্রহ জন্ম নেয়। এবং বাংলাছবির দুনিয়া বিশ্বভ্রমণে সামিল হয়। সেখানে তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনার চেয়েও বেশি মন টানে। তাঁর সিনেমায় অভিনেত্রীদের কর্মব্যাপ্তি ঘটে শিল্পের মাধুর্যে।
কিন্তু ঝোঁক এবং দর্শক ঝাঁকের কই হয়ে দেখতে থাকেন সিনেমা রঙ- চঙ – ঢঙ করা নায়িকার বাধ্যতামূলক সূচি। গতানুগতিক নায়িকা- নায়কের মিল-অমিলে চলা চলচ্ছবির সঙ্গে বাংলাভাষাতেই রিলিজ হবে আরেক ধরণের চলচ্চিত্র। নায়িকা একা কেন, বাণিজ্যের জন্যে ব্যস্ত সিনেমা জগতের সমস্ত কলা-কুশলীদের লক্ষ্য কেবলই আর্থিক মন্দা সরিয়ে চলা। সেক্ষেত্রে, ইচ্ছেমূলক নায়িকার পাশ কাটিয়ে যে ছলাকলা এবং নটী – দের অভিনয়, সেখানে বাংলার ক্ষেত্রে তারকাদের উদয় ও অস্ত অনেকটাই ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত। প্রোডিউসারের ইচ্ছেয় কর্ম-নির্ভর করার। গত শতকের হাল- হকিকতের সূত্র ধরে একুশ শতকের দিকটা দেখে নেওয়া যায়।
একটা সজীব , প্রাণবন্ত ফিল্ম কারখানা খুলে দিয়েছে রোজগারের পথ। তাকালেই চোখ ঝলসানো সিনেমা। ব্যাপ্তির সঙ্গত পরিবেশনে অকারণে শট থেকে শটে, নদী নালা খাল বিল ছেড়ে পাহাড় সবজে উপত্যকা। দ্রুত পাল্টে যায়। মনমোহিনী মনেহতে থাকে নায়িকাকে। একটা ডিজিটাল ভ্রমণের ক্লিপিংস উড়ে চলে যায়। সেখানে অভিনয়কে তুড়ি মেরে নায়িকার সাজসজ্জাসমূহের প্রকাশ, সিনেমার ব্যাকরণের সঙ্গে যেন ব্যঙ্গ করে। নায়িকা কেবলই নায়িকা সেজেই পার পেয়ে যান, অনেকটা পুতুলের মতন। এক না-অভিনেত্রীর সঙ্গে সিনেমা শেষের আগেই পালিয়ে যেতে থাকা দর্শকের প্রবণতা থেকেই বিচারের। আন্তর্জালিক মাধ্যমের কল্যাণের সিনেমার প্রাদুর্ভাবের আগেই সত্যজিৎ- এর সিনেমার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। যা রয়ে গেছে, তা হল শিক্ষার।
ছবি ৫
ছবি ৬
8
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার কাজ নিয়ে বিচার করার প্রশ্নই ওঠে না। স্বভাবতই, প্রশ্ন ওঠে তবে উক্ত প্রবন্ধের লক্ষ্য কি, শব্দের প্রাচুর্যয়ের মধ্যে এমন করে ভেসে থাকা। লক্ষ্য বা উদেশ্য হল, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে দেখা অভিনেত্রীদের নিয়ে বিশ্লেষণ করে যাওয়া। যার ফলে, বর্তমানের সঙ্গে গত শতকের এক দফা তুল্যমূল্য বিচার হয়ে যাবে। অর্থাৎ, রঙিন নায়িকাদের সঙ্গে সাদাকালো শিল্পীদের আলোচনা। যেমন ধরা যাক, এক প্রতিযোগিতায় এই দুই ধরণের সিনেমার শিল্পীদের কাজের ক্লিপ্নিং দেখানো হচ্ছে। একুশের উপগ্রহ-নির্ভর একাধিক শিল্পরসিক জনমাধ্যমের সঙ্গে ওদের অস্পষ্ট কথা, যান্ত্রিক ত্রুটির সঙ্গে সিনেমা-গ্রহে কতখানি থাকবেন , কতক্ষণ থাকবেন।
ছবি ৭
উত্তরের এক, অভিনয় দিয়ে শুরু হয়ে নায়িকা না হয়ে ওঠা, কয়েকজন অভিনেত্রীর কথা। তদুপরি ২০২১ সালের নিরিখে তাঁদের শিল্পীর শিরোনামে রেখে দেওয়ার ডজন গল্প।
দুই, যাঁদের সঙ্গে সিম্বলিক সিনেমার যোগমাত্র এই যে, তাঁরা সত্যজিৎ – এর সিনেমার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। উক্ত পরিক্রমায় চূড়ান্ত বিন্দু হয়ে থাকে সত্যজিৎ রায় –এর ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা।
তিন, ছবির সংখ্যা নগণ্য। একটি, দুটি বা চারটি। মুখ্য হয়ে সেখানে একব্যক্তিকেন্দ্রিক গল্প গড়াচ্ছে না। সেটা না জেনেই, উমা দাশগুপ্ত, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় না-বলেছিলেন।
চার, কারণ, বাংলা সমাজের মেয়েদের চিন্তা, ভাবনা, দর্শন এবং উল্লিখিত বাংলা ছবির বাজার, দিখানেপনার ছবির বর্ণাঢ্য বিজ্ঞাপন।
9
পাঁচ, বাছাই করা শিল্পীদের সঙ্গে মনোরঞ্জন, মনকেই প্রাধান্য দিয়ে ছবি করেন তিনি। কিন্তু, ছবি তো চুপ থাকে, সিনেমা কথা বলে। হ্যাঁ, তাঁর সিনেমায় সংলাপ, কথা সীমিত। অল্প। অপ্রয়োজনে নয়। চুপ থাকার মধ্যেই শিল্পের ভাবনা, শিল্পীর ভাবনা ও প্রতিষ্ঠা।
ছয়, নজরকাড়া, মনকাড়া পোশাক নেই। কানন দেবীর অভিযোগ ছিল যে, সাজগোজ করানোর জন্যে জোর করে খোলামেলা পোশাক পরানোর জন্যে চাপ দেওয়া হত। ওরা জানতেন, মানে মালিকপক্ষ যে নায়িকারা থাকতেন একটি বিশেষ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ। ফলে, টাকা নিলে যা বলা, তাই করতেই হবে। আত্মজীবনীতে সিনেমাওলাদের ব্যবসায়িক অমার্জিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন কানন দেবী। অন্যদিকে, সত্যজিৎ রায় –এর সিনেমায় না – মেকআপের বাড়াবাড়ি, না আড়ম্বর, না সাজানো সেট, না আতিশয্যের ছোঁয়া। শুধু কি ফিল্ম দেখে সিনেমা করার ইচ্ছে। নাকি আরও কিছু নিয়ে এসেছিলেন বাস্তববাদী সিনেমা ‘বাইসাইকেল থিবস’- এর নির্মাণ থেকে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের অপর নির্দেশক জা রনোয়ারের বন্ধুত্বের বিষয়টিও উল্লেখ করতে হবে। কলকাতায় পরিচয় ১৯৪৯ সালে। এরপরই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে ভাবতে থাকেন। ইতিমধ্যে তাঁর ঝুলিতে লন্ডনের ৯৯টি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাও যোগ হয়। বিদেশি সিনেমার প্রভাব তাঁর কাজে এসেছিল।
ছবি ৮
২.১ বিশ শতকের সিনেমার সেই ‘আগন্তুক‘
বিশ শতকের সিনেমার ‘আগন্তুক’ পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তিনি সিনেমা করতে এসেছিলেন সিনেমার বইপত্রপত্রিকা পড়ে, অবশ্যই বিদেশি। এবং সিনেমা সরাসরি দেখে শিখেছেন , সিনেমা করার পদ্ধতি। তিনি উক্ত বক্তব্য রাখেন, একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে। পারিবারিক পরিচিতিতে সাহিত্যের সঙ্গেই তাঁর বেড়ে ওঠা। একটি বিদেশি ছবি দেখে, তিনি সিদ্ধান্ত করে ফেলেন, ছবি করবেন। মানে চলচ্চিত্র। মানে সিনেমা। বাংলাভাষার সিনেমা। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিক্ষার মিশেল থেকে চলচ্চিত্রের নির্মাণের যে নতুন দিক তিনি বুঝেছিলেন, তাই দেখতে পাওয়া যায় পর্দায়। তাঁকে অনেকবার কাজ করতে অনিচ্ছুক তা জানিয়ে ছিলেন সর্বজয়া।
10
ছবি ৯
মানে গণনাট্যের সক্রিয় কর্মী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্বন্তর দেখা করুণার আদর্শের সঙ্গে চলা, কমিউন জীবনের পাঁচালী , সিনেমার থেকে অনেকটাই আলাদা বলেই অমত ছিল অনুমান। শিল্পীর গড়ে ওঠার পটভূমি অর্থাৎ সমাজ ছিল যুদ্ধ দাঙ্গা স্বাধীনতা আন্দোলন এবং নাট্যকর্মের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন করার দিকে। সেখানে সিনেমা, শতকরা বাঙালির যা ধারণা, তাঁর ব্যতিক্রম হবেন কেন সর্বজয়া। তবে, পারিবারিক বন্ধুত্ব এবং চেনাজানা এক সদ্য হতে চাওয়া পরিচালকের প্রথম নায়িকা তিনি। ভাগ্যিস তিনি রাজি হয়েছিলেন, নইলে বিশ্ব সিনেমা তার সর্বজয়াটিকে পেত না। আর পেত না ইন্দির ঠাকুরনকে। আর দুর্গা-র পেলবতা সত্যজিৎ সিনেমা না করলে দেখা হত না। আন্তর্জাতিক মানব সভ্যতার সংস্কৃতিতে বাংলার যে পোশাক-আশাকহীন মেকআপের জৌলুসহীন মুখটি এত নির্মল , তা অপরিচিত থেকেই যেত।
ছবি ১০
৩৪ বছর বয়সের মধ্যে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র, ‘পথের পাঁচালী’। সাল ১৯৫৩। ছবির বিষয় গ্রামবাংলার জীবন, হতদরিদ্র পরিবার, মৃত্যু এবং জীবনের চলতে থাকা। এবং এবং উক্ত চলচ্চিত্রের জন্যে মোট ১১ টি পুরস্কার অরজিত হয় তাঁর ঝুলিতে। প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’ –এ , “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” ইংরেজিতে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেনট্রি। সাল ১৯৫৬। এর উপলক্ষ্যে অসীম রেজ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়ে ছিলেন যে, যখন প্রথম কাজ থেকেই কিছুটা সাফল্য পাওয়া গেল। তখন আর থামার প্রশ্ন ওঠে না।
11
স্থানিক ভূগোলে চলচ্চিত্র আলোচনায় তাঁর কাজের মান বিচার হয় যে, ‘ গতিহীন’ ‘ দীর্ঘ দৃশ্যায়ন’, ‘সংলাপহীন’।
12
ততদিনে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ছজন বিদেশি অভিনেত্রীদের মধ্যে উঠে এসেছেন সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে। পুরস্কার প্রাপ্তি। দ্বাদশ ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড , ‘ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্ট’ –এর ছয় অভিনেত্রীর তালিকায় ছিলেন তিনিও। সাল ১৯৫৯। তাঁর সঙ্গে আর যাঁদের নাম ছিল,তাঁরা হলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, তাতিয়ানা সামজলোভা, জোয়ানে উডওয়ার্ড, গুইলেত্তা মাসিনা, আনা ম্যাগনানি।[i]
ছবি ১৩
13
২.২ কিছু চরিত্রেরা তাঁর ফ্রেম ধরেই চিরকালীন
ছবি ১৪
ছবি ১৫
14
ছবি ১৬
এসব তত্ত্বের বিচার করতে করতেই ঠিক এরপরই ১৯৫৯ সালে ‘ অপুর সংসার’ মুক্তি পায়। কারণ, মুক্তি পেল কিশোরী অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর, অভিনয় ক্ষেত্রটিও। তাঁকে নিয়ে লেখার আর কি নতুনতর দিক থাকতে পারে। একটি বিষয় তবুও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তা হল সত্যজিৎ রায় –এর অভিনেত্রী ভাবনার স্বকীয় বোধ। তিনি যাঁদের নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা একুশ শতকের সিনেমার ইতিহাসে সুপরিচিত এবং সফল অভিনয় জগতের মুখ। কিন্তু তাঁর কাজের শুরুর সময়ে এরকম ছিলেন না। তিনিও যেমন সিনেমা পরিচালনায় নবদূত, তেমনই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে আসা অভিনেত্রীরাও। নতুন অভিনেত্রীদের থেকে ববিতা, মাধবীদের নাম বাদ থাকবে। তিনি অর্থাৎ পরিচালক সত্যজিৎ রায় সমাজের উপর তাঁর দর্শনের ড্রোন ক্যামেরা উড়িয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, কি কি গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে সিনেমার সমাজ বয়ে চলছে। এবং তা থেকে বেরোনোর জন্যে সিনেমার ভূমিকা ঠিক হতে পারে।
15
তাঁর ছবির বিষয় নিয়ে তর্ক না করেই, বাঙালি সিনেমা প্রেমী ফিরিয়ে দিয়েছেন অবোধ্য শব্দ। এর বিষয়ে অসীম রেজ – এর নেওয়া আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র-র তরফে সাক্ষাৎকার সাক্ষ্য। তাঁকে বাঙালি সমাজের তীক্ষ্ণ সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
একথা উল্লেখের কারণ হল, সত্যজিৎ রায় – এর ছবি নিয়ে লিখতে গেলে সিনেমার পড়াশোনার প্রাথমিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এদেশে সিনেমার পরিকাঠামো তৈরি হওয়ার আগেই ব্রিটিশদের সঙ্গ-সংস্কৃতি হিসেবে নাটকের চর্চা শুরু এদেশে। কলকাতায় প্রথমদিকের রাজধানী শহর বলে, সেখানেই শুরু হয়েছিল নাটক, থিয়েটার। সিনেমার সময় আসার আগে পর্যন্ত সময়ে, সাংস্কৃতিক ভাবধারার অর্থ ছিল, সাহিত্য এবং নাটক। ততদিনে গণনাট্যের পরবর্তী সময় ধরে ‘ভাল নাটক করার লক্ষ্যে’ এগিয়ে চলেছে গ্রুপ থিয়েটার। মানে কলকাতার নাটকের দলগুলো। পাশাপাশি, সিনেমার বাজার বেশ চড়া। মধ্যবর্তী বিশ শতকের কলকাতার সিনেমা বলতে ছিল মূলত, ছায়াছবির নায়ক-নায়িকা প্রধান ছবি। বাজারিয় হিট-এর দুই অর্থে ভাবা যায়। এক, অর্থ টাকা। অন্য অর্থ নামভূমিকায় অভিনেত্রীদের বাজারদর ওঠে। এবং হিট সিনেমার ফায়দার ফসলে নায়ক – নায়িকার পাশাপাশি সহযোগী, সহকারী, কারু – চারুশিল্পীদের বাজার – সংসার চলে। তথা খাওয়া- পরার সংস্থানের ভূমিকায় বিশ শতকের সিনেমা সংস্কৃতির এক মূল্যবান দিক থেকে আলোচিত হতে পারে।
16
অন্যদিকে, আলোচ্য প্রবন্ধের আলোচনা সত্যজিৎ রায় – নির্মিত ছবির অভিনেত্রীদের নিয়েই। অর্থাৎ, কিনা বাছাই করা কিছুজন। সত্যজিৎ রায় মুনাফামুখী চলচ্চিত্রের ধারার বিপরীতে কাজ শুরু করেন। তাঁর বাছাই করা অভিনেত্রীদের বিশিষ্টতা হল – এক, মধ্যবিত্ত সমাজের স্কুল – পড়ুয়া, দুই, গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেত্রী, তিন, গণনাট্যের অভিযোজিত মেধা, শিল্পত্বের ধারণাজ্ঞান সম্পন্নতা। যা সমাজের নির্ণীত স্টার – কেন্দ্রিক নির্মাণের ধারণার নয়।
অভিনেত্রীদের বর্ণনা দেওয়া যায় নাম ও চরিত্রায়ন হিসেবে। মঞ্চে কাজ করা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। গণনাট্য সংঘের করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশিষ্ট চুনিবালা ওরফে নিভাননী থিয়েটার পাড়ার কাজ না পাওয়া এক শিল্পী। স্কুল – পড়ুয়া উমা দাশগুপ্ত। এঁদের পরিচিতির কতটুকু তিনি নিয়েছিলেন অভিনেত্রী হিসেবে? এবং, তাঁরা কতটুকু পেয়েছেন তাঁর ছবিতে একটিবার একটিমাত্র চরিত্র থেকে। এর মূল্যায়ন তো বাণিজ্যিক মাননির্ভর হয় না। বিশেষত যেখানে গবেষণার বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্পন্ন দিকটি গুণগতমান ও সংখ্যাগতমান নির্ভর হয়ে বিচার্য। এক্ষেত্রে গুণগতমান নির্ভর হতে হবে আলোচনার বিশ্লেষণ।
17
২.৩ একুশ শতকের নারী ম্যাসকট
কেন সত্যজিৎ রায় সমালোচিত। উত্তরে বিশ্লেষক হিসেবে এটাই দর্শান যায়। এক, একুশ শতকের বাণিজ্যিক ধারণার প্রগতির সূচনা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দুই, ঘরের বাইরে বেরোতেই নারী ও শাড়ি অদম্য এক শক্তি। সে গৃহের সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করে ঘর। ঘর ভাড়া? সংসার? বিয়ের পরের সংসার? এসব এক মেয়ের সঙ্গ ছেড়ে দেয়। মর্যাদার মধ্যে থেকে সমাজ – শর্ত করে যে, ঘোমটা দিয়ে পাড়া, ঘর সংসার। আর পাড়ার পর বাইরের দুনিয়ায় মানানসই, আধুনিকা হয়ে ওঠার সূচনা। আধুনিকতা কি সেই প্রসঙ্গের ধার ঘেঁষে নারীর আধুনিক বিষয়টা যুক্তি ও তর্কের। নারীর ঘর, সংসার এবং বাইরের সমাজ দেখাতে থাকার গল্প ক্যামেরার সুবাদে হয়ে যায় আন্তর্জাতিক উপাদান। সমাজের এক নির্দিষ্ট ভূগোলে মেয়েদের কিছু হয়ে ওঠার কারণ হল আর্থিক দুরবস্থা, অসামঞ্জস্যের দিনলিপি। অর্থাৎ, নারীর স্বাধীনতা দেখানেপনা, অনেকটা মিথ্যের সঙ্গে অনেকটা সত্যির যোগসূত্রে ছক। সমাজের ছকে মেয়েরা যেন ব্যাঙের জিভে আটকে পড়া পতঙ্গ। বিশ শতকের এই নারীর বাইরের দুনিয়ার গড়ন একুশ শতকের নারীর প্রগতির পরিকাঠামোর প্রেক্ষাপট। সত্যজিতের সিনেমা ছাড়াও একইভাবে নারীকে ব্যবহার করার ঘটনা ঘটে সমকালীন পরিচালকদের সিনেমায়। তাহলে, রোজনামচার নিম্নবিত্ত বাঙালি সমাজ গায়ে আঁচল, মাথায় ঘোমটা দেওয়া নারীকে মহানগরের ভিড়ে ছেড়ে দেয় গ্রাসাচ্ছদনের শর্তে।
একুশ শতকের নারী ম্যাসকট সেই মেয়ে তথা রোজগেরে নারীদের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে সাহিত্য ও কলার উপাদান। এবং, সিনেমার উপাদানও হয়। কারণ, বিশ শতকের বাজার-নীতির পরিকাঠামোয় সিনেমার স্থান ছিল।সুরক্ষাবিহীন দৃষ্টিতে শুরু হওয়া সমাজের এই পরিবর্তনকে একাধিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রধানতম ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে সমাজের প্রয়োজন । সমাজের আগের কাঠামো অনুসারে চলে আসা দৃষ্টিতে মেয়েদের সুশীল কন্যা, ভাল মেয়ে – তকমার পাশে তৈরি হয় আধুনিকা সত্তা। এই আধুনিক সত্তাকে স্তরভেদে সমাজ নির্ণীত মেয়েদের ভাল হয়ে থাকা আর চলে না। কারণ, আধুনিক সত্তা মানে ঠিক হবে, তা সমাজ নির্ণয় করতে সক্ষম হয় না। কারণ, আধুনিকা সত্তাকে ঘরে ও বাইরে লড়াই করতে হয়। লড়াই অর্থে মেনে না নেওয়া। আর সমাজ প্রতিফলনে একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, মেনে না নেওয়া মেয়েরা পুরুষের কাজ, সিদ্ধান্তই মেনে নেয় না। ফলে, আধুনিকা সত্তাকে নিয়ে বিতর্ক ঘটে।
18
19
এবং তাঁদের নিয়ে ঝাপসা এক উগ্র ভাবমূর্তি দেখান হয়। সেখানে, প্রচ্ছন্নভাবে পুরুষের দিক থেকে আসা সিদ্ধান্ত, না মেনে নেওয়াই কারণ। ফলে, বিশ শতকের স্বাধীন দেশীয় সমাজে মেয়েদের আধুনিক রূপটি অনেক সিনেমাতেই ব্যঙ্গ পুতুল হিসেবে চিহ্নিত। যেহেতু বিশ শতকের সিনেমায় বাস্তব সমাজ – উপাদান নিয়েই সত্যজিৎ – এর কাজ। তাই সিনেমার মধ্যে দিয়ে সমাজের দেখানো সত্যিকারের প্রতিফলন সমাজের বাণিজ্য লক্ষ্যে পৌছয় না। এবং, আরও নির্দিষ্ট হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সমাজে বাংলার সমাজ-চিত্র। সত্যজিৎ যেন আধুনিকা সত্তাকে বিশেষ করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন আগামির জন্যে। একুশ শতকের দিকেও এই আধুনিকা সত্তার মেয়েদের সমস্যা ধেয়ে আসে। এর নির্ণয় করা যায়, তবে সমাজ সমাধান দেখায় না। আর সমাধানের প্রশ্ন তুলে তাই মহানগরের লাজুক গৃহবধূ-টি আন্তর্জাতিক এক কর্মী-নারী হয়ে যায়। বলা যায়, শ্রমিক। কারণ, পরিবার নামক ক্ষুদ্র পরিসরের থেকে সে বা তারা চলতে শুরু করে চাকরি – সংগঠন – অফিস – কাছারির এক বৃহৎ পরিসরে। সেখানেই এক থেকে একক হয়ে সেই চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করে। আন্দোলন করে। সত্যজিৎ এই কর্মীনারীদের লড়াইয়ের সলতে জ্বালিয়ে দেন চিত্রায়নের মাধ্যমে। সে প্রতিনিধি, শুধু ভূগোলের এপাশের নয়, এর ক্ষেত্র হয় বিশ্ব সমাজ, মূলত মেয়েদের সমাজ। নারীসত্তার বিকাশ এবং আত্ম নির্ভরতা যেখানে। সেখানেও দর কষে দেওয়া সমাজের চৌকাঠে মেয়েরা ঘর ও বাইরের টানাপোড়েনে ভুগছে। একুশ শতকের নারী ম্যাসকট বলে মনে করা যায় ‘মহানগর’ – এর আরতিকে।
20
সম্পর্কের দাবিতে নারীর প্রাচীন মূল্যবোধের উদাহরণ তুলে এনে দায়ী করে পারিবারিক কর্তব্যের শিথিলতায়। সমাজ বাইরের কর্মযোগী মেয়েকে আধুনিকা হয়ে ওঠার সূচিতে ফেলছে ঠিকই, কিন্তু আধুনিক হয়ে উঠছে না সমাজ। এবং, মেয়েদের আধুনিকা বাইরের পোশাকটি পরিবর্তন করে ঘরের পোশাক পরতে বাধ্য করে তুলছে। এক, কাজের সুবিধের জন্যে। দুই, ভেতরে সংসারের দিকে টান। তিন, ননদের বিয়ে। চার, শ্বশুরের ওষুধ কিন্তু পুরুষ-প্রচণ্ড মহিমাকে সম্মান। পাঁচ, বউ , ছেলের মধ্যে বাণিজ্যের লক্ষ্মী মানে মেয়ে, লজিক সিম্বল সব মেনে গৃহস্থের কল্যাণের জনেই চাকরি। দুই ভাগে বিভক্ত জীবন। আরও ভাগ হতেও পারত। সেটা সবটা মধ্যবিত্ত সমাজ মানবে না জানতেন সত্যজিৎ রায়।
মহানগর। কেন্দ্রীয় চরিত্র , একটি এমন চরিত্র যার সঙ্গে অনেকগুলো সম্পর্কের শাখা প্রশাখা। মাধবী মুখারজি। এরপর ছবি চারুলতা। কেন্দ্রীয় চরিত্র, রবীন্দ্রনাথের লেখা এক চরিত্র। এই ছবিকে অনেক ফিল্ম – তাত্ত্বিক তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবির বাছাই তালিকায় ফেলেন। … সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে টেক্সট হিসেবে বিশ শতকের সাহিত্য, এবং তার কেন্দ্রের ঘটনা – চরিত্র ধরে চলচ্চিত্র – রূপায়ন। ফলে, একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না, সাধারণ সমাজের একটি মেয়েকে এক্ষেত্রে সিনেমার চরিত্রে দেখা যায়। একজন চরিত্র কেন্দ্র চরিত্র হবে না, অনেকে মিলেই ছবির একটা চরিত্র তৈরি করে।
21
বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী। সিনেমার অফারে এমনই এক লক্ষ্মী – চরিত্রের জন্যে কাস্ট করতে চেয়েছিল স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ওরফে বিমলাকে। বিমলা “ঘরে- বাইরে”র তীব্র ভাল ছবির সঙ্গেই বেছে থাকতে চেয়েছিলেন। ফলত, তাঁর আর ছবিতে কাজ দেখা যায় না। তবে, বাংলা ছবির অ
হিসেবে অনেক নাম তালিকায় এলেও, যে নামগুলো তুল্যমূল্য বিচারে সাধারণ তালিকার অনেক উপরের দিকে, তাঁরা চরিত্রের জন্যেই বাছাই করা, পরিচালকের সনদ এবং চরিত্রের একক হিসেবে আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত হবে।
বাংলা ছবির অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন যে যে শিল্পীরা, তাঁদের তখনও অভিনেত্রী বলা যায় না। অবশ্যই স্বাতীলেখা এর বাইরের। তাঁর ছবিতে অভিনীত অভিনেত্রীদের দু – গোত্রে ভাগ করা যেতে পারে। এক, অনভিজ্ঞ। দুই, অভিজ্ঞ। সিনেমায় না হলেও, অভিনয় বিষয়ে জ্ঞান, চর্চা ছিল থিয়েটার করার মধ্যে দিয়ে। অভিনেত্রী-শিল্পীদের আরেকদিক থেকেও ভাগ করা যায়। এক, নায়িকাকেন্দ্রিক চরিত্র বা প্রধান ভূমিকা। দুই, চরিত্রাভিনেত্রী বা পার্শ্ব চরিত্র। আবার, আরেকদিক থেকেও ভাগ করা যায়। এক, থিয়েটারের । দুই, সিনেমার। তিনি থিয়েটারের অভিনেত্রী। সিনেমার পর্দায় তাঁকে দেখার পর তাঁকে চিনলেন কজন বাঙালি। জানেন। আবার, ঘরে বাইরে-র স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-কে ক্লাসিক অভিনেত্রী হিসেবে বারবার দেখা যায়। কিন্তু মঞ্চে ওঁর অভিনয় কজন দেখেছেন, সেটা ফিল্ম এবং থিয়েটারের পারিভাষিক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-ই বলে দেয়।
ছবি ২৫
22
ছবি ২৭,২৮
23
সত্যজিৎ রায়-কে নিয়ে লেখার জন্যে বেশি ভাবতে হয় না। আবার, খুব ভাবতেও হয়। এক, তো উনি একুশ শতকের কাছাকাছি সময়ের আইকন , বিশেষত সিনেমার। সিনেমার তত্ত্ব না বোঝা বাঙালির জীবনের সবকটি সামাজিক – অর্থনৈতিক স্তর তিনি ধরেছিলেন ফ্রেমে। যদিও, বাঙালির কাছে ফিল্ম মানেটা সত্যজিৎ রায় নন। সত্যজিৎ রায় এমন একজন পরিচালক যিনি মুখ খুঁজে এনে নক্ষত্রে বসিয়েছেন।
24
কখনও পরিবেশ পাল্টে গেলে ছবির দৃশ্য পাল্টে যায় , সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছবির চরিত্রদের নাম, পদবি, এমনকি কাস্টিংও বদলে যেতে পারে, সেটা সত্যজিৎ-এর ছবিতে অনেকবার হয়েছে। যেমন, কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাগানবাড়ি থেকে দৃশ্য সরে পাহাড় , তাই ছবির নাম যেমন পাল্টে গেল। তেমনই পাল্টে গেল – চরিত্রদের পদবি পর্যন্ত।[ii] এই পরিবর্তনের কারণ, মনস্তাত্ত্বিক একপ্রকার সূক্ষ্মতা। যেখানে সমাজ থেকে তুলে আনা চরিত্রদের নিপুণ পদ্ধতিতে নির্মাণ করেন পরিচালক। ঐ যেমন তাঁর খেরোর খাতায় আঁকা মেলে। ঐ যেমন তাঁর স্ক্রিপ্টের পাশে বর্ণিত পোশাক – চরিত্র মেলে হাতে আঁকা। যেমন, জানিয়েছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত , বিমলা – চরিত্রের কাস্টিং হতে আসার সময়ের বর্ণনায়। মনে করা যায়, শিল্পের ব্যাকরণ বোধের নির্মিতি পাঠ তাঁকে সহজিয়া করেছিল। তাঁর চরিত্রায়ন আন্তর্জাতিক মানের একক। যার বিকল্পের সন্ধানে কোন অন্য মুখ মেলে না। কঠিন করে দেখলেও, চরিত্র মানে খোঁজার শেষ বলা যায়। বিশ্লেষণের অতিমাত্রায় তিনি।
সত্যজিৎ রায় –এর ক্যামেরার টেক , শট থেকে অভিনেত্রী হয়ে ওঠাদের তালিকা সাল অনুযায়ী করা যায়। সিনেমার অভিনেত্রী অনঙ্গ বউ ওরফে ববিতা। আন্তর্জাতিক শিল্পী বলতে এককথায় তাই। যাঁকে মিডিয়া চেনে,। এরকমভাবে পদ্মা দেবীর নাম করলে? কতজন জানেন। তিনি “জলসাঘর” ১৯৫৮-এর চরিত্র। শর্মিলা ঠাকুর, “দেবী” ( ১৯৬০); “তিনকন্যা”-র ১৯৬১, মণিহারা – তে কনিকা মজুমদার, চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অপর্ণা দাশগুপ্ত। অনুভা গুপ্ত, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, অলকানন্দা রায় “কাঞ্চনজঙ্ঘা” (১৯৬২) তে। রুমা গুহ ঠাকুরতা “অভিযান” (১৯৬২)।মাধবী মুখোপাধ্যায়, জয়া ভাদুড়ি , শেফালিকা দেবী, “মহানগর”( ১৯৬৩)। মাধবী , গীতালি রায় “চারুলতা” ( ১৯৬৪)। মাধবী মুখোপাধ্যায় “কাপুরুষ ও মহাপুরুষ”(১৯৬৫)। শর্মিলা ঠাকুর, সুমিতা সান্যাল “নায়ক” ( ১৯৬৬)। কণিকা মজুমদার , গীতালি রায় “চিড়িয়াখানা” ( ১৯৬৭)। শর্মিলা ঠাকুর, সিমি, কাবেরি চট্টোপাধ্যায় “অরণ্যের দিনরাত্রি”(১৯৭০) । জয়শ্রী রায়, কৃষ্ণা বসু “প্রতিদ্বন্দ্বী” (১৯৭০)।শর্মিলা ঠাকুর, “সীমাবদ্ধ” ( ১৯৭১)। ববিতা, সন্ধ্যা রায়, “অশনি সংকেত” ( ১৯৭৩)। লিলি চক্রবর্তী, আরতি ভট্টাচার্য “জন অরণ্য”( ১৯৭৫)। সাবানা আজমি, ফরিদা জালাল “শতরঞ্জ কি খিলাড়ী”(১৯৭৭)। অপর্ণা, “পিকু”(১৯৮২)। স্মিতা পাতিল, রিচা মিশ্র” সদ্গতি”( ১৯৮২)। “গণশত্রু ” মমতা শঙ্কর , ( ১৯৮৯) । “শাখা – প্রশাখা, ( ১৯৯০), মমতা শঙ্কর , ( ১৯৯০) ” আগন্তুক” মমতা শঙ্কর , ( ১৯৯১)।
25
২.৪ অতপর, সিন্ধান্তে
, অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীলতা, শৈল্পিক কারুশিল্পের সম্পূর্ণতা এবং যাঁরা কাস্টিং বোঝেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে মেকআপ ধরা চারুলতা, বিমলার চরিত্রায়নের বিভাময়তা স্বীকার করবেন। যদিও, সিনেমা দেখার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের মধ্যে সেই ক্ষমতা এমনিই জন্ম নেয়, যাকে বলা যায়, জন্মগত ক্ষমতা। সমালোচনা করার জন্যে তাঁদের কাছে ফিল্ম স্টাডিজের পাথেয় প্রয়োজন হয় না। হ্যাঁ, তিনি সিনেমার অস্কার “পথের পাঁচালী”র দীর্ঘসূত্র রেখে গেছেন। তাঁর কাজ থেকে কয়েক দশকের পরও গবেষণাধর্মী অভিনেত্রী সত্তার বিশ্লেষণ লিখে ফেলা যায়। সত্যজিৎ রায় একশো বছরের সেই ঋদ্ধ পরিচালক। তিনি সিনেমা শিল্পের অস্তিত্ব। সিনেমার এটাই সুবিধে যে, যত্রতত্র ফিল্মের উপস্থাপনা নিজস্ব স্থান কাল সময়ে করা যায়। কিন্তু, মঞ্চের ক্ষেত্রে এরকম হয় না। মঞ্চের কাছে আসতে হয়।
তাই, লেখা যায় তাঁর অভিনেত্রীরা আন্তর্জাতিক। কারণ, তিনি তাঁদের বঙ্গসমাজের থেকে বের করে দিয়েছেন মুক্তি।
এবং একুশ শতকের সবচেয়ে ধারালো, দৃঢ়, অনিঃশেষ সম্পদ সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর কাজের সার্বিক প্রতিফলনে ঋদ্ধ। যেখানে অভিনেত্রী তথা নারী মানে নতুন ঝলমলে পোশাকের বিভা, যেখানে সিনেমায় দেখানো অর্থেই নয়। আসলে নায়িকা তিনিই যিনি কালোত্তীর্ণ। অভিনেত্রীদের বিপণন, সেই হালফিলের মধ্যে একটি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর বা ইন্দির ঠাকুরনের সঙ্গে একটি অলকানন্দা যদি মেলে,… মানে অর্থের অপচয় হলেও, হে সিনেমাওয়ালা তাঁদের অভিনেত্রী পদে সাজিও। যেখানে আলোচকদের আশঙ্কা এও রয়ে যায় যে, নয়া জেনারেশন ইঙ্গ – বঙ্গ মিশেলের এই সংস্কৃতি থেকে মউন মুখর সত্যজিৎ ঘরানার চলচ্চিত্রের মন আদৌ বুঝবেন তো। নাকি সিরিজ – মনোরঞ্জনে ভেসে যাবেন। এবং আরেকটি প্রজন্মের অপেক্ষার পর বেছে নিতে পারা যাবে সত্যজিৎ রায় নামক উপাদান।
26
তথ্যসূত্র
[i] https://www.anandabazar.com/patrika/article-on-famous-actress-karuna-banerjee-1.1023365
[ii] সেনগুপ্ত সুনীত ; সত্যজিতের ছবি ও খেরোর খাতা; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০০ কলকাতা; গাঙচিল ; পৃষ্ঠা ১৮ – ২০
ওয়েবসূত্র
ছবি ১ থেকে ৩১, সূত্র আন্তর্জালিক মাধ্যম
মৌ চক্রবর্তী । গবেষক, লেখক