ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রসঙ্গীতের সেকাল-একাল
ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রসঙ্গীতের সেকাল-একাল
দেবাশিস মণ্ডল
মানুষের জীবনযাত্রা ও কর্মসূত্রে যেমন সংগীতের সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি মানুষের জীবন যুদ্ধের সঙ্গে যন্ত্রসংগীতের সম্পর্কেও জড়িয়ে আছে। শিকার, আত্মরক্ষা ও শিকারের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে হয়েছিল। এইসব হাতিয়ারগুলি মানুষের প্রথম আবিষ্কার। আর এইসব হাতিয়ার থেকেই পরবর্তীকালে নানা ধরনের যন্ত্র তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে বাদ্যযন্ত্রও অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। টুকরো পাথর বা পাথরের নুড়ি থেকে তৈরি হয়েছে ঘন বাদ্য। ধনুক থেকে হয়েছে ধনুর্যন্ত্র। বান থেকে বীণা। বাঁশ থেকে বাঁশি। পশুর চামড়া কে ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে অবনদ্ধ বাদ্য বা চর্মজ বাদ্য। এইসব বাদ্যযন্ত্র থেকে নানাবিধ শব্দ উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে কৌতুহল ও আনন্দের সঞ্চার করেছিল। সে যতই এলোমেলো হয়ে থাকে ছন্দ থাকুক আর না থাকুক ভালো লাগার সঙ্গে তার আদিম সম্পর্ক ছিল সুগভীর। দীর্ঘদিন ধারাবাহিক ভাবে ব্যবহার করতে করতে তাদের ছন্দ আসে। সুর এর সম্পর্ক গড়ে ওঠে মানুষের জীবন যাত্রার সঙ্গে। একটি ধনুর্যন্ত্রের ছিলাতে আর একটি ধনুর্যন্ত্রের ঘর্ষণে বিতত বা বোয়িং বাদ্যযন্ত্র। ধনুর্যন্ত্রে একটা তন্ত্রী থেকে দুটো তিনটে কিংবা আরো বেশি তন্ত্রী যুক্ত করে নানা ধরনের শব্দ তারা আবিষ্কার করেছে। হয়তো অনেকগুলি তন্ত্রী থেকে শব্দের ভিন্নতা লক্ষ্যকরে প্রতিটি স্বরকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে অপেক্ষাকৃত সভ্য মানুষ।
এই কাজ হয়েছে বৈদিক যুগে বা তার আগে। একটি একটি করে সাতটি স্বরের বিকাশ হয়েছে। সে সময় বেশিরভাগ তন্ত্র বাদ্যকে বীণা বলা হত। শততন্ত্রী বীণা, গোধা বীণা, ক্ষৌনি বীণা, আঘটি বীণা, ঘটলিকা বীণা ইত্যাদি। এই সময়কার বাদ্যযন্ত্রগুলি কিভাবে বাজানো হোতো সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিভিন্ন টীকাকাররা বেদের মন্ত্রগুলি ব্যখ্যা করতে গিয়ে শুধু বলেছেন, শততন্ত্রী বীণা তে ১০০টি তার থাকতো। গোধা বীণা গো সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি হোতো। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বা মাটির বড়ো চর্মাচ্ছাদিত মাটির বাদ্যযন্ত্রকে বলা হত ভূমি দুন্দুভি। বেদের মন্ত্র যখন গানে পরিণত হোলো তখন এসব গানের সঙ্গে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গত করা হোতো। স্বাভাবিকভাবেই থেকে ধরে নেওয়া যায় বাদ্যযন্ত্রগুলি যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল এবং সংগতের উপযোগী ছিল।
বৈদিক যুগ পার হয়ে যখন আমরা গন্ধর্ব যুগে যাই তখন সংগীতের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রগুলিও যথেষ্ট বিকশিত হয়েছে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা ও সেগুলোকে কিভাবে মার্জনা করা হোতো তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তখন আমরা দু’রকম বীণা পেয়েছি। চিত্রা বিনা ও বিপঞ্চি বীণা। পুষ্কর জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের বেশকিছু নাম পাওয়া গেছে। যার মধ্যে মৃদঙ্গ, ঢাক, তুরি, ভেরি ইত্যাদি। ভরত বাদ্যবৃন্দ বা কুতপবিন্যাসের কথা বলেছেন। অর্থাৎ নাটকের প্রয়োজনে বাদ্যবৃন্দ রচনা করা হত। ফলে বাদ্যযন্ত্রের নির্মান, বাদন শৈলী আর নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের সম্মেলকের মতো কর্মকাণ্ডের থেকে বোঝা যায় সে এক অসাধারণ অগ্রগতি। সেই অগ্রগতি উত্তর ভারত থেকে ক্রমেই পূর্বে পশ্চিমে আর দক্ষিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে সঙ্গীতের প্রাসার ঘটত। আর সাধারণের মধ্যেও সঙ্গীতের চর্চা ছিল।
বহুকাল ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে লোকসংগীত যেমন ভাবে বিকশিত হয়েছে তেমনি লোকবাদ্যগুলোও নিজেদের মতো করে বিকশিত হয়ে চলেছে। আমরা দেখেছি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের ভিন্নধারার সঙ্গীত এবং পৃথক ধরনের কিছু বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। তার আকৃতি, বাদন পদ্ধতি এবং এগুলির শব্দ সৌন্দর্য অনেক ক্ষেত্রে পৃথক রকমের। অভিজাত বাদ্যযন্ত্রগুলির বিকাশের ক্ষেত্রে এইসব লোকবাদ্যযন্ত্র গুলির গুরুত্ব কম নয়। এগুলি থেকেও নানা অভিজ্ঞতা ও গঠন কৌশল কে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা হয়েছে অভিজাত বাদ্যে বা উচ্চাঙ্গশ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের গঠনে।
মধ্যযুগে অনেক পারস্য বাদ্যযন্ত্রের আগমন ঘটেছে। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সংস্পর্শে এসে সেগুলি বদলেছে। অথবা বলা যায় ভারতের বিভিন্ন ধরনের বীণাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র পারস্য বাদ্যযন্ত্রের সংস্পর্শে এসে নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে। বিভিন্ন গীতরীতির যেমন উদ্ভব ঘটেছে, তেমনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বদলেছে, বদল হয়েছে তাদের বাদন পদ্ধতিও। সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগীতের চর্চা বেড়েছে অনেকখানি। অভিজাতদের অন্দরমহলে সঙ্গীত অনেক সম্মানের জায়গা পেয়েছে। ক্রমে রাজা মহারাজা, জমিদার ও সাধারণ অভিজাত মানুষদের পরিবারের সঙ্গে সংগীতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। দক্ষিন ভারতে মুশলিম শাসকদের আধিপত্য না থাকায় সেখানে পারস্য বাদ্যযন্ত্রগুলির কোন প্রভাব পড়েনি। সেখানে সনাতন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রগুলির বাদন রীতির স্বাভাবিক ভাবেই উন্নত হয়েছে বা আধুনিক হয়েছে।
‘One of the main differences between North Indian and South Indian music is the increased influence of Persian music and musical instruments in the north. From the late twelfth century through the rise of British occupation, North India was under the control of a Muslim minority that was never able to extend its sphere of influence to South India. During this time, the music of North India began to acquire and adapt to the presence of Persian language, music, and musical instruments, such as the setar, from which the sitar got its name; the kamanche (1998.72) and santur, which became popular in Kashmir; and the rabab (alternately known as rebab and rubab), which preceded the sarod. New instruments were introduced, including the tabla and sitar (1999.399), which soon became the most famous Indian musical instruments worldwide. Legend has it that the tabla was formed by splitting a pakhavaj drum in half, with the larger side becoming the bayan and the smaller side the dahini. The barrel-shaped pakhavaj drum, which was the ancestor of both the tabla and the mrdangam, has been depicted in countless paintings and prints. New genres of music were formed as well, such as khayal and qawwali, that combine elements of both Hindu and Muslim musical practice’.১
ভারতে, মুসলিম শাসকদের আবির্ভাবের সাথে, বিভিন্ন রীতির সঙ্গীত এবং অন্যান্য ঐতিহ্য দরবারী সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। দিল্লীর সুলতানেরা (১২০৬-১৫২৬) তাদের দরবারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে মর্যাদার সঙ্গে স্থান দিয়েছিল। সুলতানরা তাদের ও তাদের লোকজনদের সাথে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রভাব বহন করে এনেছিল তা তাদের অন্তরে রয়েই গিয়েছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮) বিশেষ করে তাঁর দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ভারতে সঙ্গীত শুধুমাত্র দরবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মন্দির এবং উপাসনালয়গুলি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রচার এবং বিকাশে সহায়তা করেছিল। সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে একজন ছিলেন হজরত আমীর খসরু। একজন পণ্ডিত ও সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি নিজাম-উদ-দিন আউলিয়ার (১২৫৩-১৩২৫) শিষ্য ছিলেন এবং সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দরবারে ছিলেন, যিনি ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। তিনি খেয়াল-গানের পথিকৃৎ।
এই সময় পারস্যের বাদ্যযন্ত্র ও ভারতীয় বীণা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের বাদন পদ্ধতি ও গঠনগত দিকগুলি নিয়ে নানা গবেষণা চলতে থাকে। নতুন ধরণের নানা রকম বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়। ভারতীয় বীণা ও পারস্যের তিন তার বিশিষ্ট সেতারের সংমিশ্রনে হয় ভারতীয় সাত তারের সেতার। ‘Setar is a Persian musical instrument with an interesting story. It has a pear-shaped body. Although the word “setar” means three strings in persian, a modern setar has four strings. First setars had three strings but 150 years ago a fourth one was added by a famous setar master Moshtagh Ali Shah. The fourth string gave Persian Setar a better sound and players a possibility of more complex tuning alternatives.২
আফগান রবাব এবং ভারতীয় সুরশৃঙ্গার এর সংশ্লেষণের ফলে সরোদ যন্ত্রটি তৈরি হয়েছিল। আফগান রবাবের রবাবে একটি কাঠের আঙুলের বোর্ড থাকে। আর সরোদ নিকেল করা লোহার পাত বা একটি স্টিলের পাত ব্যবহার করে তৈরি হয়। রবাব যন্ত্রে অন্ত্রের স্ট্রিং ব্যবহার করা হয়। আর সরোদে, সুরশৃগারের মতো ধাতব তার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এভাবেই নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়। লোকসঙ্গীতে ও লোক বাদ্যযন্ত্রেও পারস্য রীতির প্রভাব পড়তে পারে। তবে এ সম্বন্ধে সেভাবে কোন গবেষণা হয়নি।
দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর দরবারে সঙ্গীতজ্ঞদের মর্যাদাপূর্ণ স্থান দিয়েছিলেন। অবশ্যই, হুমায়ুনের পুত্র আকবর, তার দরবারের সমস্ত গৌরব এবং জাঁকজমক সহ, কমপক্ষে ৩৬ জন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞকেও পুরস্কৃত করেছিলেন। আকবরের দরবারে দুটি প্রাচীন সংস্কৃতির একীকরণ ও আত্তীকরণ সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই সময়কার মুঘলরা সকলেই ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা ও তাদের সবার মা ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেরই মানুষ হয়েছিলেন। মুঘল দরবার তখন ভারতীয় রাজদরবার ছিল। তাঁরা ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বহুত্বের সংমিশ্রিত সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছিলেন। আকবরের দরবারের রত্ন ন’জন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। যারা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন এবং তাদের কৃতিত্বের চূড়ান্ত উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
রত্নগুলির মধ্যে একজন ছিলেন মিয়াঁ তানসেন (১৫০০-১৫৮৬) যিনি আজও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রতিভা এবং দক্ষতার উচ্চতার প্রতীক। তানসেন ছিলেন স্বামী হরিদাসের শিষ্য, যিনি ভারতীয় সঙ্গীতের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে একজন। হরিদাস একজন কবি এবং একজন সঙ্গীত রচয়িতা ছিলেন এবং গভীরভাবে আধ্যাত্মিকতায় দীক্ষিত ছিলেন। তিনি কেবল তার সময়ের সঙ্গীতই নয়, সেই যুগের আধ্যাত্মিক সংলাপ ও দর্শনকেও প্রভাবিত করেছিলেন। সমাজে তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে – যা আজও অব্যাহত রয়েছে। তানসেন এক পর্যায়ে ষোড়শ শতকের একজন সুফি সঙ্গীতজ্ঞ মুহাম্মদ গাউসের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রভাবিত হয়েছিলেন। মুহাম্মদ গৌস নিজেও ভারতীয় দর্শন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
সম্রাট আকবরের দরবারে স্থান পেতেন এমন সংগীত গুণীদের মধ্যে অনেকেই বাদ্যযন্ত্রী ছিলেন। শাহজাহানের রজত্বকালে সঙ্গীতের অন্যান্য ধারার সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ধারার ও বৃন্দবাদনের বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল। তখন পারস্য ও ভারতীয় শিল্পকলার মধ্যে মিলনের যথার্থ পরিবেশ রচিত হয়েছিল। ভারতীয় বা পার্সি সঙ্গীত উভয়ই এখানে তার স্বতন্ত্রতা হারায় এবং উভয়ই একত্রিত হয়ে একটি ইন্দো-পার্সিয়ান সঙ্গীতের রূপ নেয়। লক্ষ্যনীয় আকবরের দরবারে যখন অর্ধ ডজনেরও বেশি সঙ্গীতজ্ঞ এবং যন্ত্র-বাদক ছিলেন যাদের মধ্যে দুজন পারস্যের মাশাদ ও হেরাতএর অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের দেশের প্রচলিত বাদন পদ্ধতি অনুসরণ করেই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, শাহজাহানের শাসনকালে, সঙ্গীত যথেষ্ট পরিশীলিত ও সন্মানের জায়গায় পৌঁছেছিল যা অতীতে কখনো ছিলনা। সঙ্গীতের বিকাশের ক্ষেত্রে এই পর্যায়টি সম্রাটের ব্যক্তিগত পরিমার্জিত রুচির প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে হয়। সম্রাট শাহজাহান নিজেকে শিল্পী এবং বিশিষ্ট মানুষদের পরিবৃত হয়ে থাকতে পেরে আনন্দিত ছিলেন ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
শাহজাহান হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের অনুরক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ কণ্ঠশিল্পী। তার খুব মিষ্টি কণ্ঠ ছিল। যা তাঁর শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। সূর্যাস্তের পরে রাজকাজ শেষ করে নিয়মিত গান শোনা তাঁর অভ্যাস ছিল। রাতে খাবার এবং ঘুমের আগে হারেমের মহিলা-গায়িকাদের গান ও বাজনা শুনতেন। প্রতিদিনের রুটিন ছাড়াও আনন্দ এবং উত্সবের একটি অপরিহার্য অংশ ছিল সঙ্গীত। সম্রাটদের সমাদর পাবার জন্য সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে চর্চা বেড়েযায়। নতুন নতুর রাগ, সুর মূর্ছনায় ভরে ওঠে। সাধারণের মধ্যেও সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ও চর্চার বিস্তৃতি ঘটে।
ফকিরুল্লাহর রাগদর্পনেউল্লেখ রয়েছে যে সেসময় নানা ধরণের বাদ্যবৃন্দ রচিত হত। বৃন্দবাদ্যের তিনটি ভাগ ছিল। উত্তম (ভালো), ‘মধ্যম’ (মাঝারি), এবং নিকৃষ্ট (তৃতীয়-শ্রেণির)। একটি উত্তম ধরনের বৃন্দবাদনে প্রথম সারির চারজন, মধ্যম মানের আটজন, বারোজন সুন্দরী নারী, বাঁশির চারজন বাদক এবং চারজন মৃদঙ্গ (পাখাওয়াজ) বাদক থাকতেন। মাঝারি বৃন্দবাদনে দুজন মহিলা সঙ্গীতশিল্পী থাকতেন। আর বাকী সবই থাকত উত্তম শ্রেণীর বাদ্যবৃন্দের মত। হারেমের মহিলা সংগীত শিল্পীদের উত্তম কনসার্টে দুজন মহিলা সংগীত শিল্পী, দুজন মধ্যমানের মহিলা সংগীত শিল্পী, দু’জন মহিলা বাঁশি বাদক এবং তিনজন ‘মৃদংগ’ বাদক থাকতেন। মধ্যম শ্রেণির মহিলা কনসার্টএ একজন দক্ষ মহিলা তন্ত্রবাদ্য বাদক থাকতেন। বাঁশি বাজাতেন চার জন মহিলা বাদক।৩
সে সময় শেখ বাহাউদ্দিন নামের একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। শাহজাহানের দরবারে গান গাইতেন ও বাজাতেন। তিনি ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখেছিলেন। দাক্ষিনাত্যেও গিয়েছিলেন সঙ্গীত শেখার জন্য। তিনি অমৃতবীণ নামের একটি বাদ্যযন্ত্রের বাদক ছিলেন এবং খিয়াল নামক একটি বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যার অদ্ভুত আকৃতি ছিল। তাঁর দুই শিষ্য—রশিদ ও আসাদ—তাঁকে সঙ্গ দিতেন। যখন তিনি গান গাইতেন রশিদ ভগবান (বীণা) নামক একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, যা অন্য কেউ বাজাতে পারত না।
ঔরঙ্গজেব প্রথম জীবনে সঙ্গীত চর্চা করতেন। তখন তিনি ধ্রুপদ ও অন্যান্য সঙ্গীত রচনা করেছেন। তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় প্রচুর সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়েছিল। কিন্তু পরে নানা কারনে তিনি সঙ্গীত চর্চা বন্ধ করে দেন।
‘For several years after this alleged episode, the official Mughal chronicler recorded male and female instrumentalists and dancers dominating the anniversary celebrations of Aurangzeb’s coronation, including rabab, tanbur and flute players, and the emperor’s notable bestowal of 7000 rupees on his principal musician, Khushal Khan Kalawant. A number of dhrupads composed in Aurangzeb’s honor still preserved in oral and written forms bear witness to his active involvement as a patron of music’.৪
ঔরঙ্গজেবের সময়কাল ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস অন্ধকার সময়কে চিহ্নিত করে। ঔরঙ্গজেব তার রাজত্বের শেষের দিকের বছরগুলিতে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিলেন। তবে সঙ্গীতজ্ঞরা নিজেদের মধ্যে চর্চা চালিয়েছেন। আর তাঁদের মধ্যে অনেকে লেখা ও গবেষণার কাজ চালিয়েছেন। এই সময়ে হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের উপর প্রচুর সংখ্যক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, মুঘল অভিজাতদের দরবারী ভাষা ফার্সিতে।
সঙ্গীত চর্চা নিষিদ্ধ করলেও পরে তাঁরই বংশধর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সঙ্গীত চর্চা করতেন। তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। যিনি চার দশক ধরে ভারত শাসন করেছিলেন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৮৩৭-১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন একজন কবি, সঙ্গীত রচয়িতা। একজন রাজনৈতিক নেতার চেয়ে একজন সুমানবিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ভারতীয় সৈন্যদের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা তাকে বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) পাঠায় যেখানে তিনি মারা যান।
বাহাদুর শাহ জাফর নিজেও একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান উর্দু কবি এবং সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি প্রচুর সংখ্যক গজল লিখেছিলেন এবং তার দরবারে মির্জা গালিব, দাগ, মুমিন এবং জাউক সহ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত উর্দু লেখক স্থান পেয়েছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি খুব বেশি উচ্চাভিলাষী ছিলেন না। দেশের রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে সুফিবাদ, সঙ্গীত ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি।
মুঘল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর, লখনউ, পাতিয়ালা, অযোধ্যা, রামপুর ও বেনারসের মতো ছোট ছোট রাজ্যগুলিতে পৃথকভাবে সঙ্গীত বিকেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলিতে সঙ্গীত গুনীদের সমাদর ছিল। সেখানে যথাযথভাবেই সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত ছিল। এই রাজ্যগুলিতে পৃথকভাবে সঙ্গীত চর্চা ও এর ধারাবাহিকতা সঙ্গীত শৈলীর বৈচিত্র্যের জন্ম দেয়। যা আজ ঘরানা নামে পরিচিত।
এরপরেও ইংরেজদের আক্রমন রাজ্যগুলিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সবই তাদের দখলে চলে যায়। অযোধ্যার পরাজিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ (১৮২২-১৮৮৭) কে নির্বাসন দেয় কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। তিনি সঙ্গীতগুনী বলেই কলকাতায় তাঁর সাঙ্গীতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন সঙ্গীতগুনী এভাবেই কলকাতায় ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। তাই, উচ্চাঙ্গসঙ্গীত আরো দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে।
ইংরেজদের আমলে আধুনিক কারিগরী শিল্পের অগ্রগতির ফলে সঙ্গীত ও সংস্কৃতিরও নানা অগ্রগতি ঘটে। রেকর্ডিং শুরু হয়। শুরু হয় গান আর বাজনার ব্যাপক প্রচার-প্রসার আর সংরক্ষনের এক নতুন অধ্যায়। ১৯০৪ সালে প্রথম একক বাদ্যযন্ত্র সেতার রেকর্ড করা হয় ইমদাদ খাঁন এর।৫ এর দুবছরপরে ১৯০৬ সালে প্রথম সরোদিয়া ওস্তাদ ছুন্নু খান (১৮৫৭-১৯১২) এর বাজানো সরোদ রেকর্ড করা হয়।৬
রেকর্ডগুলি শুনলে বোঝা যাবে নানা যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে সেগুলি তত ঝকঝকে ছিলনা। কিন্তু তার গুরুত্ব অসীম। আমরা সেই কলের গান থেকেই অনেক ইতিহাসকে আরো নিখুঁতভাবে পাচ্ছি। যা অন্য কোন ভাবে খুঁজে পাবার সেরকম কোন সম্ভাবনা ছিলনা। যাইহোক, যান্ত্রিক বিকাশ সঙ্গীতের সামগ্রিক বিকাশকে অনেক ত্বরান্বিত করেছে। আধুনিক যুগের সঙ্গীতে ফিউশন মিউজিক, আর ব্যাণ্ডের গানের প্রাধান্য বাড়ছে। আর অন্যদিকে ঘরানার আধিপত্য কমলেও মৌলিক সঙ্গীত হিসেবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা, প্রচার ও প্রসার নিরবচ্ছিন্ন ধারায় এগিয়ে চলেছে ও চলতেই থাকবে। যার কোন বিকল্প এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র–
২। All About Persian Setar | Setar Persian Instrument | Iranian Setar – Sala Muzik
৩। RAG — DARPAN (A Summary) on JSTOR
৪। 2004BrownSchofieldPhD.pdf (kcl.ac.uk)
৫। First Recorded Sound of Sitar/Imdad Khan/1904/Raag Behag/Rashmita Jha – YouTube