The Songs of Gramophone Record and Durga Puja in Bengal
দেবাশিস মণ্ডল
Abstract:
The cultural landscape of Bengal is rich with traditions that intertwine music, celebration, and spirituality. This paper delves into the unique intersection of gramophone record songs and the auspicious festival of Durga Puja, two significant facets of Bengal’s cultural heritage.
Beginning with an exploration of the historical context, we trace the evolution of gramophone records in Bengal and their pivotal role in preserving and disseminating traditional Bengali music. These records not only captured the essence of folk, devotional, and contemporary compositions but also served as carriers of nostalgia, invoking memories of bygone eras.
Moving forward, we delve into the vibrant tapestry of Durga Puja, arguably the most celebrated festival in Bengal. We analyze the intricate rituals, elaborate decorations, and the profound spiritual significance associated with the worship of Goddess Durga and her triumph over evil.
Central to our discussion is the fusion of gramophone record songs with the festivities of Durga Puja. We explore how these timeless melodies, often featuring devotional hymns, bhajans, and folk tunes, amplify the festive fervour and evoke a sense of cultural continuity. Through an examination of musical performances, pandal decorations, and community gatherings, we uncover the symbiotic relationship between music and ritual during the Durga Puja festivities.
Furthermore, we examine the role of gramophone record songs as repositories of cultural memory, facilitating intergenerational transmission of traditions and fostering a sense of collective identity among Bengalis worldwide. Drawing on ethnographic research and cultural analyses, we highlight the significance of these songs in shaping the cultural narrative of Durga Puja and Bengal’s cultural ethos at large.
In conclusion, this paper underscores the profound significance of gramophone record songs in enhancing the cultural experience of Durga Puja in Bengal. By elucidating the dynamic interplay between music, ritual, and cultural memory, we offer insights into the enduring legacy of these melodic narratives in shaping the cultural landscape of Bengal.
সারসংক্ষেপ
বাংলার পুজো আর গান হাত ধরাধরি করে চলেছে অনেক বছর ধরে। আগের দিনে রাজা আর জমিদার বাড়ির পুজোতে লোক-গানের আসর বসত। যাত্রা, পাঁচালি, কবিগান, খেউড়, লেটো, আলকাপ, রামায়ন গান, মনসার পালা আরো কত কী ছিল। দূর দূরান্তের লোকজন ভীড় করত এইসব আসরে। রেডিও আর গ্রামোফোনের যুগ শুরু হল বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে। তখন রেকর্ডের গান শোনা, গানের রেকর্ড সংগ্রহ করা ছিল বড়োই আনন্দের বিষয়। দুর্গা পুজোর সময় অনেক নতুন বাংলা গানের রেকর্ড বের হোতো। কলকাতার রেকর্ডের দোকানে ভীড় উপছে পড়ত। সেই সব গান পৌঁছে যেত গ্রামে শহরে সর্বত্র। মাইকের সাহায্যে ধনী, দরিদ্র, দীন-হীন, ছোটো-বড়োরা সবাই সেসব গান শুনতে পেত। আর নতুন গানের জমজমাট আসরে পুজো অনেক বেশি মাত্রা পেয়েছিল। বাংলা রেকর্ডের গানের এক ধারাবাহিক অধ্যায় রয়েছে। সে অনেক দিনের অনেক কালের অনেক স্মৃতির ধারা বয়ে চলেছে। তারই কিছু কথা এখানে লেখা হয়েছে।
উল্লেখ্য শব্দ সমূহ : বাংলা, পুজো, রেডিও, গ্রামোফোন, রেকর্ড, গান ধনী-দরিদ্র, জমজমাট
বাঙ্গালিদের মধ্যে সম্ভবত কলকাতায় প্রথম গ্রামোফোন বাজিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৫ সালে। তাঁর এক বন্ধু তাঁকে গ্রামোফোন দিয়েছিলেন তার আগে কলকাতায় আর কোথাও গ্রামোফোন ছিল কী না তা জানা যায় না। কলকাতায় গ্রামোফোন আসত ইংলণ্ড থেকে। ইংরেজ সাহেবরা গ্রামোফোন আনতেন। হাতে দম দেওয়া কলের গানের মেশিন। বাংলা রেকর্ড ছিলনা। বিদেশী ভাষার গান। ১৯০২ সালে কলকাতায় বাংলা গানের রেকর্ড করা হয়েছিল ঘরোয়াভাবে। প্রথম রেকর্ড কারখানা স্থাপিত হয় ১৯০৮ সালে। বেলেঘাটায়।
বাংলার দুর্গাপুজো আর শারদ উৎসবের গান এখনো বাঙালির মনের মধ্যে তুফান তোলে। বাংলায় রেকর্ড এর গানের যুগ শুরু হয়েছিল বিংশ শতকে প্রথমের দিকে। গ্রামোফোন কোম্পানি কলকাতায় বাংলা গানের রেকর্ড করা শুরু করেছিল বাঙালি শিল্পীদের দিয়ে। শশিমুখিকে দিয়ে বাংলা গানের রেকর্ড করা হয়েছিল মোটামুটি ১৯০৫ সালের কাছাকাছি। খেয়াল গান রেকর্ড করা হয়েছিল গওহরজানের কন্ঠে। এরপর বাঙালি অনেক শিল্পী বাংলা গানের রেকর্ড করেছেন। বাজারে চড়া দামে বিক্রিও হয়েছে সেই সব গান, রেকর্ড। কোনো বাড়িতে গ্রামোফোন বাজলে দলে দলে মানুষ ভীড় করত গান শোনার জন্য। সেই শুরু হয়েছিল গ্রামোফোনের যুগ। মোমের তৈরি চৌঙাকৃতি রেকর্ডএর যুগ পেরিয়ে এসেছে ভিনাইল রেকর্ড। দেখতে প্লেট এর মত বা থালার মত। প্রথমে চাকতির কালো সেই রেকর্ডগুলি খুব জোরে জোরে ঘুরতো। ৭৮ বার প্রতি মিনিটে। গ্রামোফোনএ হাতল ঘুরিয়ে দম দিয়ে রেকর্ড ঘোরানো হত। তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হতো একটা হালকা ছোট হাতল। যার মাথায় একটা ছোট পিন থাকত। অমনি রেকর্ডের গান বেজে উঠত। কি বিষ্ময়ই না ছিল সেদিন। অনেকে ভাবতো গ্রামোফোনের বাক্সের ভেতরে কোনো কোনো মানুষকে ছোট করে রেখে দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে তাদের গলার গান বেরিয়ে আসছে। তা নিয়ে অনেক গাল-গল্প সে যুগে শোনা যেত।
সে সময় খুব কম সংখ্যক বাড়িতেই গ্রামোফোন ছিল।
১৮৭৭ সালে টমাস আলভা এডিসন কথা বলা মেশিন আবিষ্কার করেছিলেন। এরপরে প্রায় ১০ বছর পেরিয়ে এমিলি বার্নিলার তৈরি করলেন প্রথম ডিস্ক রেকর্ড। কলকাতায় গ্রামোফোনের যুগ শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে। কলকাতায় ফ্রেডরিক গেইসবার্গ রেকর্ড করলেন গওহরজানের গান। পাশাপাশি মালকাজান, জানকী বাই প্রমূখ আরো অনেক শিল্পীর কন্ঠে গানও রেকর্ড করা হলো। ‘একদিন এক ধনী বাঙালি বাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে গান শুনলেন সেযুগের কিংবদন্তি শিল্পী গহরজানের কন্ঠে। আর তখনই তারা মনস্থির করে ফেলেছিলেন যে এই গওহরজানের গান দিয়েই শুরু করবেন রেকর্ডিং। গওহরজান গান রেকর্ড করে্ন ১৯০২ সালের ১১ ও ১২ নভেম্বর। ৯টি বিভিন্ন ভাষায় গেয়ে, গান রেকর্ড করে পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন ৩০০০ টাকা। গওহরজানের রেকর্ডিং-এর গান গাওয়ার আগে ৮ নভেম্বর ১৯০২ সালে গেইসবার্গ কলকাতা শহরের একটি হোটেলে পরীক্ষামূলকভাবে রেকর্ডিং শুরু করেন ওয়াল্টার স্ট্যানলে বার্কের এবং ক্লাসিক থিয়েটারের ১৪ ও ১৬ বছর বয়সী শশীমুখী ও ফনীবালার গান দিয়ে। তবে ওই গানগুলি প্রকাশিত হয়নি। গওহরজানের গানই প্রথম বাজারে আসে। সেসময়, গওহরজান ছাড়াও আর যাদের গান রেকর্ডিং করা হয়েছিল, সেইসব শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শৈলী বা শীলাবাঈ, হরিমতি, সুশিলা, মিস আচারিয়া, মিস মহতাল, মিস কিরণ, পান্নালাল সরকার, লালচাঁদ বড়াল, ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।’[i] সে বছরই জুলাই মাসে ওয়াটসন হুড কলকাতায় গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ের একটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা করলেন। দ্য গ্রামোফোন এন্ড টাইপ রাইটার লিমিটেড এর শাখা খুলল কলকাতায়। খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠল এসব রেকর্ড এর গানগুলি।
কলকাতায় রেডিও এসেছিল ১৯২৭ সাল নাগাদ। ১৯৩৫ সাল নাগাদ সবার চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্রের গান সংযোজন করা শুরু হয়েছিল। রেকর্ডের গানগুলিও রেডিওতে বাজতো। ফলে, ঘরে ঘরে কলের গানগুলি আরো সহজে পৌঁছে গেল। সিনেমাতে যে গানগুলি কাহিনীর সঙ্গে সংযোজিত হত, সেগুলি খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এভাবেই একটু একটু করে আধুনিকতা ও গানের জনপ্রিয়তা পাশাপাশি এগিয়েছে। আধুনিক ভাবনা, আধুনিক রুচিবোধ গড়ে তুলেছে কলকাতা থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র।
১৯৩০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত বিস্তৃত পুরো দশকটি বাংলা রেকর্ডের গানের স্বর্ণযুগ। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক চিত্রের শুভ সূচনার পর, হিন্দুস্তান এবং মেগাফোন কোম্পানি ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেনোলা কোম্পানি ১৯৩৫ সালে । এই সময়কালে নতুন গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীদের উত্থান এবং প্রতিষ্ঠার সাক্ষী ছিল। উপরন্তু, এই সময়ে বাংলা গানে আধুনিকতার দিকে বড়ো ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে।[ii]
আগে ঐতিহ্যবাহী কীর্তন, ভক্তিমূলক গান এবং টপ্পা গানের আধিপত্য ছিল। ১৯৩০-এর দশকে বাংলা গান আধুনিক পাশ্চাত্য ভাবনাকে গ্রহণ করেছিল। এই সময় থেকেই গ্রামীণ সুর, পল্লীগীত, লোকগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা এবং চাটকা প্রভৃতি বিভিন্ন নতুন ধারা প্রাধান্য লাভ করে। শ্যামা সঙ্গীত ও ইসলামী সঙ্গীতের প্রচলন বাংলা গানের জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। গজল এবং ভজন গানগুলিও এই সময়ের মধ্যে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল নজরুল ইসলামের “রমজানের এই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” এবং “ইসলামের ওই সাওদা লয়ে” গানগুলি । শ্যামা সঙ্গীতের জগতে মৃণাল কান্তি ঘোষ এবং ভবানীচরণ দাসের মতো শিল্পীরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শ্যামা সঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলামের রচনাগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
এই সময়কালে কাজী নজরুল ইসলাম, প্রণব রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজয় ভট্টাচার্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হেমেন্দ্র কুমার রায়, এবং শৈলেন রায়ের মতো গীতিকাররা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুল প্রসাদ এবং অন্যান্যদের মতো সুরকাররা বাংলা গানের রেকর্ডের বৈচিত্র্যময় অবদান রেখেছেন।
১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে গায়ক জগন্ময় মিত্র এবং ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠ “শাওন রাত যদি” এবং “গুনগুন ভ্রমর আসে” এর মতো গানের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, যখন ১৯৪০ সালে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
‘১৯৪০-এর দশকের পরে বাংলা গানের আসরে যাঁরা প্রবেশ করেন, তাঁরা নজরুলের ভাষা অথবা ভাবের অনুকরণ করলেন না, তাঁরা পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে বাংলা গানের জগতে নতুন একটা যুগের প্রবর্তন করেন। এক কথায়, তাঁদের ভাষা ছিলো ‘গীতবিতান’-নির্ভর অর্থাৎ রবীন্দ্র-অনুসারী। শ্যামল গুপ্ত (১৯২২-২০১০), সলিল চৌধুরী (১৯২৩-৯৫), সুধীন দাশগুপ্ত (১৯২৯-৮২), গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৫-৮৬), নচিকেতা ঘোষ (১৯২৫-৭৬), পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-৯৯) প্রমুখ মিলে এমন একটা যুগ সৃষ্টি করেন, যাকে এক কথায় বলা যায় আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। এঁরা যে-গানগুলো রচনা করেন, সেগুলো ছিলো প্রধানত রোম্যান্টিক এবং প্রেম-বিরহের। এঁদের মধ্যে বিশেষ ব্যতিক্রম ছিলেন সলিল চৌধুরী। প্রথমে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী, কমিউনিস্ট। কারাগার ভাঙার কথা, কাস্তেকে শাণ দেওয়ার কথা লিখেছিলেন বহুবার। ১৯৪৯ সালে ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’ গানটা দিয়ে তিনি এই যুগের আগমন বার্তা ঘোষণা করেন। তারপর অন্যরা যখন প্রেম এবং স্বপ্নের গান রচনায় বিভোর, সলিল চৌধুরী তখনও তাঁর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখেন তাঁর নিজস্ব ভাষা-শৈলী, বিষয়বস্তু এবং ভাব দিয়ে। সিনেমার গান লিখতে গিয়ে তিনি তাঁর ভাব-ভাষার সঙ্গে বারবার আপোশ করেন, তবু তিনি যে কবি, তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করেন।’[iii]
ক্রমে রেকর্ডএর আকৃতি পরিবর্তন হলো গ্রামোফোন মেশিনগুলো আধুনিক হয়ে উঠল। দম দেওয়ার জায়গায় এলো ব্যাটারি বা ইলেকট্রিক চালিত গ্রামোফোন। ৭৮ আরপিএমের জায়গায় ৪৫ আরপিএমের রেকর্ড। ছোট রেকর্ড ঘুরে কম, গান থাকে বেশি। একটা রেকর্ডের দুদিকে দুটো করে চারটে গান। আগের মত আর খসখসে শব্দ রইল না। খুব পরিষ্কার আওয়াজ। গানগুলো শোনা যেত খুব ভালো। আরো কিছুদিন পরে এলো খুব বড় আকৃতির ৩৩ আর পি এম এর রেকর্ড। যাতে একটা রেকর্ডের দুদিকে ছ’টি করে মোট বারোটি গান বাজানো হতো। পুরো যাত্রাপালার কাহিনী একটা রেকর্ড এর মধ্যে দুদিকে রেকর্ডিং করে বাজারে এলো। নবদ্বীপ হালদার, হরিধন মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ প্রমুখর কমেডি ও অজস্র গানে গল্পে মুখরিত হতে থাকলো বাংলার আকাশ বাতাস। পুজো-পার্বণ, বিয়ে বাড়ি, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সব ধরনের অনুষ্ঠানে ভাড়া করে মাইক আনা হতো। মাইকের লোকেরা স্থানীয় মানুষদের রুচি অনুযায়ী গানগুলির রেকর্ড সংগ্রহ করে রাখতেন। সেগুলির মধ্যে থেকে তাদের পছন্দমত গানগুলি বাজানো হতো।
কলের গানের যুগ থেকে রেকর্ডে গান গল্পের প্রচার শুরু হলেও মাইকের যুগে এসে তা অনেক সহজলভ্য এবং সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠল। গ্রামেগঞ্জে শহরে কলকাতায় সর্বত্রই মাইকের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকল। সিনেমার গানগুলি ছাড়া, শুধুমাত্র পুজোর সময়েই বাংলা নতুন নতুন আধুনিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হতো। এইচ এম ভি কোম্পানি রেকর্ড প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই রেকর্ডের শিল্পী, সুরকার, গীতিকার সবারই নাম উল্লেখ করে সম্পূর্ণ গানগুলিকে বই আকারে প্রকাশ করে দিত। এর মধ্যে থেকে গানগুলি পছন্দ করে রেকর্ড কিনতে সুবিধা হত ক্রেতাদের। তাই পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই রেকর্ডের দোকানগুলিতে খুব বেশি রকমের ভীড় হত। আর যারা মাইক বাজাতেন, তারাও বেছে বেছে ভালো গানগুলিকে সংগ্রহ করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন। অনেক বাড়িতেই তখন এইচএমভির বা অন্য কোম্পানির রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। তারাও নিজেদের পছন্দমত পুজোর গান এবং পূর্বে প্রকাশিত নানা ধরনের গানের রেকর্ড ও সংগ্রহ করে নিত।
পুজোর সময়তে জামা কাপড় কেনার চেয়েও রেকর্ডের গান কেনার দিকে আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। পুজোর গানের সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান এসবও কেনা হতো। আর থাকত নাটক, নানা ধরনের কমেডি ইত্যাদি। বলা যায় বাংলা আধুনিক রীতির গানের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে রেকর্ডের যুগেই।
অনেক শিল্পীর গানের রেকর্ড বেরোনোর কয়েকদিনের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়ে যেত। তখন একটা কথা খুব প্রচলিত হয়েছিল গোল্ডেন ডিস্ক। যাদের শত সহস্রাধিক রেকর্ড বিক্রি হয়ে যেত তাদের জন্য গোল্ডেন ডিস্কএর মত অনেক রকম উপহার দেয়া হতো। আমরা ভাবতাম সোনার তৈরি রেকর্ড বোধ হয় শিল্পীদের উপহার দিত রেকর্ড কোম্পানি। কলকাতায় যে সব বড় কোম্পানিগুলি থেকে রেকর্ড বের হতো তার মধ্যে প্রধান ছিল এইচএমভি বা His Masters Voice ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’। এছাড়া কলম্বিয়া, সিম্ফোনি, ইনরেকো ইত্যাদি বেশ কিছু কোম্পানি রেকর্ড বের করত। ‘এই গ্রামোফোন রেকর্ডই প্রথম নিয়ে এল ‘পুজোর গানে’র ধারণা। ১৯১৪ সালে যখন বাঙালিসহ সমগ্র পৃথিবীবাসী দেখছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ঠিক সেই বছরই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হল প্রথম ‘পুজোর গান’-এর ১৪টি রেকর্ড— ‘শারদাবলী’। দাম ৩ টাকা ১২ আনা। সেকালের হিসেবে যেটা অনেকটাই বেশি। প্রথমবারের সেই রেকর্ডে গান করেছিলেন সেকালের সব বড়-বড় শিল্পীরা— কে মল্লিক, মানদাসুন্দরী দাসী, সরলা বাঈ এবং রবীন্দ্রগানে অমলা দাশ।
‘শারদাবলী’-র সেই অভাবনীয় সাফল্য হিন্দুস্তান রেকর্ড, পাইয়োনিয়ার রেকর্ডসহ অন্যান্য সমসাময়িক রেকর্ড কোম্পানিগুলির নজর এড়াল না। অচিরেই তারাও ‘পুজোর গান’-এর রেকর্ড প্রকাশ করতে আরম্ভ করল। অদ্ভুত একটা সমাপতন এই যে, বিশ শতকের এই দ্বিতীয় দশক থেকেই পূজাবার্ষিকী বা শারদীয়ারও আত্মপ্রকাশ ঘটল। যাই হোক, সেই শুরু… তারপর থেকেই পুজোর ঢাকের শব্দ, কাশের বন, শারদ-সাজ ও পূজাবার্ষিকীর সঙ্গে-সঙ্গেই ‘পুজোর গান’-ও বাঙালি জীবনে বিনোদনের একটা অঙ্গ হয়ে উঠল। ধীরে-ধীরে এই পুজোর গান থেকেই জন্ম নিলেন ইন্দুবালা, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, দিলীপকুমার রায় ও কমলা ঝরিয়াদের মতো বিখ্যাত শিল্পী। পুজোর গানের প্রথম যুগে মাতৃবন্দনা বা আগমনী গানের খুব প্রচলন ছিল। ১৯৩১ সালের পুজোর গানের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথ দাসের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে’। এত বছর পেরিয়ে গিয়েছে, তবু আজও অনেক শারদ-বিজ্ঞাপনের পাতায় ক্যাচলাইন হিসেবে ফিরে-ফিরে আসে— ‘জননী এসেছে দ্বারে’। ‘পুজোর গান’-এর রেকর্ডে আগমনী ও ভক্তিমূলক গান গেয়ে একসময় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। অনেক বছর পর সাতের দশকে পুজোর রেকর্ডে তিনি গেয়েছিলেন একটি আগমনী গান— ‘এলো গিরি-নন্দিনী, ল’য়ে সুমঙ্গল ধ্বনি।’[iv]
‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ কোম্পানির রেকর্ডে গ্রামোফোনের চোঙ্গার সামনে কুকুরের বসে থাকা নিয়ে একটি কাহিনী মুখে মুখে ফিরত। ‘কুকুরটি তার প্রভু মারা যাবার পর তাঁকে খুঁজত। পরে, প্রভুর কণ্ঠস্বর বাজতে শুরু করলেই তা শুনতে গ্রামোফোনের চোঙ্গার সামনে বসে পড়ত। এটা তারই ছবি।’ কাহিনীটি অনেকটাই সত্য। পরে তা জেনেছি। এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ফ্রান্সিস ব্যারাউড একজন দক্ষ চিত্র শিল্পী। তার বাবা হেনরি, কাকা উইলিয়াম এবং দাদা মার্ক সকলেই শিল্পী ছিলেন। ব্রিস্টলে বসবাসকারী, মার্ক, প্রিন্স থিয়েটারের দৃশ্যগুলি চিত্রায়নের জন্য পরিচিত নাম। তার পোষা কুকুর ‘নিপার’ তার খুব প্রিয় ছিল। কুকুরটি তার সাথে থিয়েটারে মঞ্চে যেত, পারফরম্যান্সের সময় সে মঞ্চের পাশেই বিশ্রাম নিত। বিনোদন জগতের সাথে ‘নিপার’ ঘনিষ্ঠ সংযোগ কীভাবে হল তারই কাহিনী। ১৮৮৭ সালে মার্কের মৃত্যুর পরেও অব্যাহত ছিল যখন মার্কের ছোট ভাই ফ্রান্সিস নিপার এর মালিক হন এবং তাকে ল্যাঙ্কাশায়ারের লিভারপুলের একটি স্টুডিওতে নিয়ে যান।
ফ্রান্সিসের স্টুডিওতে, মার্কের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত একটি ফোনোগ্রাফ ছিল। ফোনোগ্রাফে মার্কের কণ্ঠস্বর বাজানো হলে নিপার কৌতূহলী হয়ে উঠত। নিপার খুব মনোযোগ সহকারে মেশিনটি পর্যবেক্ষণ করত এবং শুনত। ফ্রান্সিস এই অনন্য মিথস্ক্রিয়াটি চিত্রায়িত করেন ১৮৮৮ সালে। ফোনোগ্রাফের সামনে বসে থাকা নিপার। ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ তারিখে ‘Dog looking at and listening to a Phonograph’ বা “কুকুর একটি ফোনোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে শুনছে” শিরোনামে ছবিটি রেজিস্ট্রেশন করেন। নামটি নিজের মনোমত না হওয়ায়, ফ্রান্সিস ছবিটির নাম বদল করে “হিজ মাস্টার্স ভয়েস” হিসাবে পুণরায় রেজিস্ট্রেশন করেন এবং এটি বিক্রি করার চেষ্টা করেন।
ইংল্যান্ডে তখন চলছে সিলিন্ডার রেকর্ড। বিভিন্ন ফোনোগ্রাফ কোম্পানির বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, ফ্রান্সিস তার এই গুরুত্বপূর্ণ চিত্রটির জন্য ক্রেতা খুঁজে পেতে লড়াই করেছিলেন। গ্রামোফোন যন্ত্রগুলি প্রাধান্য লাভ করার সময়, তাঁর একজন বন্ধু ফোনোগ্রামের কালো চোঙার পরিবর্তে একটি একটি ফোনোগ্রামের সঙ্গে একটি সোনালী রঙের চোঙা যুক্ত করে চিত্রটি পুণর্নিমানের পরামর্শ দেন। এই পরামর্শ মতো, ফ্রান্সিস পরিবর্তিত অঙ্কনটি নবগঠিত গ্রামোফোন কোম্পানির প্রধান উইলিয়াম ব্যারি ওয়েনের কাছে উপস্থাপন করেন। ওয়েন ছবিটি দেখে মুগ্ধ হন। তিনি ছবিটিতে ফোনোগ্রামের পরিবর্তে গ্রামোফোন এঁকে দেবার পরামর্শ দেন। ফ্রান্সিস সেভাবেই নতুন করে আঁকেন ছবিটি। উইলিয়াম এটি একশ পাউন্ডে কিনে নেন।
১৮৯৯ সালে, এই চিত্রটি গ্রামোফোন ডিস্ক রেকর্ডের লেবেলে স্থান পায়। আগে এটি ছিল একটি দণ্ডায়মান পরী। “হিজ মাস্টারের ভয়েস” নামকরণ করা হলে এই ছবিটি দ্রুত রেকর্ড লেবেলের জন্য সাফল্য এনে দেয়। কোম্পানির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তখন বড়ো বড়ো পোস্টার হাতেই আঁকা হত। তাই কোম্পানি ফ্রান্সিসকে কোম্পানিতে নিয়োগ করেন ছবি আঁকার জন্য। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯ তারিখে, কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সিস ব্যারাউডকে একটি প্রশংসা পত্র দিয়ে সম্মানিত করে। ৪ অক্টোবর, ১৮৯৯ তারিখে তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তি করা হয়। ফ্রান্সিস চিত্রকর্মের জন্য ৫০ পাউণ্ড এবং সম্পূর্ণ কপিরাইটের জন্য ৫০ পাউণ্ড পেয়েছিলেন। ১৯০০ সালের জানুয়ারিতে গ্রামোফোন কোম্পানির লোগো হিসেবে এই আইকনিক ছবিটি আত্মপ্রকাশ করে। আমাদের খুব ছোট বেলায় আমরা অনেক বিস্ময় নিয়ে গ্রামোফোন এর সামনে বসে থাকা কুকুরটিকে দেখতাম। নতুন অনেক রেকর্ডে খুব বড়ো করে ছবি বের হতো। আমাদের খুব ভালো লেগেছিল এই কাহিনীটিকে।
বাংলা গানের প্রচার ও প্রসারে গ্রামোফোন এর গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু প্রচারের জন্যই নয় বাংলা গানের আধুনিকতা শুরু হয়েছিল গ্রামোফোনকে কেন্দ্র করেই। ছোট ছোট গান। ঠিক তিন সাড়ে তিন মিনিটের। রেকর্ডের উপযোগী করে রচনা করা শুরু হয়েছিল সেযুগে। এর মধ্যে আবার প্রিল্যুড, ইন্টারল্যুড এর সংযোজন করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হল। যা আগে ছিলনা। গানের সঙ্গেও বর্ণময় করে সঙ্গীত বাজত। যাকে বলা হয় বডি মিউজিক। তারও বর্ণময় রূপ গড়ে উঠল। নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু হল রেকর্ডের গানগুলিকে আরো আরো প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সুরধারার সংমিশ্রন ঘটল রেকর্ডের গানে, প্রিল্যুডে, ইন্টারল্যুডে। আমরা ঝাঁক, ঝাঁক শিল্পীদের পেলাম আধুনিক গানে, রবীন্দ্র সঙ্গীতে, নজরুল গীতিতে, ডি এল রায় এর গানে, অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তের গানে, শ্যামা সঙ্গীতে। আর লোকগীতিতেও যুগান্তকারী পরিবর্তন হল। এই গানগুলিও রেকর্ড হতে থাকল। ছোট হল গান। সেই আড়াই থেকে সাড়ে তিন মিনিট। তারই অনুসরণে ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, সারি জারি ঝুমুর গান। অনেক নতুন শিল্পী লোকগান গাইলেন। প্রচলিত গানগুলিকে অদল বদল করে। সেখানেও প্রিল্যুড ইন্টারল্যুড যুক্ত হল। বাদ্যযন্ত্রগুলি আরো আধুনিক হতে থাকল। মাইক্রোফোনে রেকর্ডিংএ ঝকঝকে সুর দরকার। জোরালো না হলেও চলে। মাইক্রোফোনে ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘকাল ধরে এভাবেই গানের জগতে নিরন্তর গবেষণা চলেছে রেকর্ডের গান শুরু হওয়ার সময় থেকে। আধুনিক প্রেম সঙ্গীতের সূচনাও এই যুগেই। যা পাশ্চাত্য বা আধুনিক ভাবনারই ফল।
তথ্যসূত্র
[i] https://www.lokogandhar.com/অতীতের-পাতা-থেকে-কলের-গান/
[ii] https://bangla.bdnews24.com/arts/30983
[iii] https://bangla.bdnews24.com/arts/30983
[iv] https://unishkuri.in/storydetails/-/unishkuristory/storyId-138278
সহায়ক গ্রন্থ
- বাংলা সংগীতের রূপ – সুকুমার রায়
- The Music Room – Namita Devidayal
- The Gramophone Company’s First Indian Recordings, 1899-1908 by Michael Kinnear
- কবিকণ্ঠ ও কলের গান- সন্তোষকুমার দে
- গানের বাহিরান- হেমাঙ্গ বিশ্বাস
- বঙ্গবাণী (সচিত্র মাসিক পত্রিকা) (বর্ষ-৫) [ভাগ-২]- বিজয়চন্দ্র মজুমদার