March 1, 2025

প্রান্তজনের নবজাগরণ ও মতুয়া সমাজের উত্তোরণ ( ১৮৮০-১৯৯০ ) – টোটন বিশ্বাস

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

শিক্ষক-শিক্ষণ বিভাগ

গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ

নবজাগরণ হল চেতনা ও সংস্কৃতির উন্মেষ; শিক্ষা ও সামাজিক বিকাশ। মতুয়ারা সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি সম্প্রদায়, যারা মূলত নমশূদ্র জাতি ভুক্ত এক প্রান্তিক জনসমাজ। এরা বৃহৎ বঙ্গের অধিবাসী। মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার অনুসারীরা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেছিল; ক্রমে গুরুচাঁদ ঠাকুর ও প্রান্তিক নমঃশূদ্ররা তথা মতুয়া সমাজ নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে সংস্কার আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। মতুয়া আন্দোলন, ধর্ম সংস্কার আন্দোলন হলেও; প্রকৃতপক্ষে তা ছিল প্রান্তজনের সামাজিক বিপ্লব, যা বাংলার প্রান্তজনের নবজাগরণকে সূচিত করেছিল। প্রান্তজনের নবজাগরণের প্রেক্ষিত একদিনে তৈরি হয়নি; পাঠশালা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার প্রসার, শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ, নামকরণের আন্দোলন, রাজনৈতিক পরিসরে প্রান্তজনের আগমন নবজাগরণের পথকে প্রসারিত করেছিল। এখন প্রশ্ন হল সত্যিই কি প্রান্তজনের নবজাগরণ ঘটেছিল? যদি ঘটে থাকে তবে তা কতটা?

ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে নবজাগরণের প্রভাব বাংলার শিক্ষা দীক্ষা সমাজ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো প্রবেশ করলেও; তা ছিল শহরকেন্দ্রিক।¹ ১৮৩৫-৩৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষা বিষয়ক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বাংলার অধিকাংশ টোল পাঠশালা গুলিতেই ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হত। পূর্ব বঙ্গের নমঃশূদ্র অধ্যুষিত প্রান্তিক এলাকা গুলিতে পাঠশালা ছিল না বললেই চলে। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রীয় আধিপত্যের কারণে, সেখানে নিম্ন বর্ণের ছাত্র-ছাত্রী তথা প্রান্তজনের প্রবেশাধিকার ছিল না।² প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৮০১ সালে বাকেরগঞ্জের সমীক্ষার সময়, বুকানন হ্যামিলটন একটাও পাঠশালা দেখতে পাননি।³ নমঃশূদ্ররা প্রান্তিক জনসমাজ তথা প্রান্তজন ছিল শিক্ষা বঞ্চিত এক বিশেষ শ্রেণী। ১৯০১ সালে তাদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৩.৩ শতাংশ এবং ১৯১১ সালে ৪.৯২ শতাংশ; তবে গুরুচাঁদ ঠাকুরের সংস্কার আন্দোলন ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার প্রভাবে নমঃশূদ্র অধ্যুষিত প্রান্তিক অঞ্চলে একাধিক পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে, ১৯২১ সালে শিক্ষার হার ৭.৫০ শতাংশ এবং ১৯৪৮ সালে তা বেড়ে হয় ২১.০২ শতাংশ।⁴ গুরুচাঁদ ঠাকুর ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।⁵ তিনি বলেছিলেন-

“খাও বা না খাও তাতে দুঃখ নাই,

ছেলে মেয়ে শিক্ষা দাও এই আমি চাই।।”⁶

“বিদ্যা বিনা সব বৃথা দেখ মনে ভেবে।

নমঃ শূদ্র জাতি যদি বাঁচিবারে চাও।।”⁷

“নমঃশূদ্র তেলী মালী আর কুম্ভকার

কপালী মাহিষ্যদাস চামার কামার।

পোদ আসে তাঁতি আসে আসে মালাকার।

কতই মুসলমান ঠিক নাহি তার ।।

সবাকে ডাকিয়া প্রভু, বলে এই বাণী শুন

সবে ভক্তগণ আমি যাহা জানি ।

নমঃ শূদ্রকুলে জন্ম হয়েছে আমার

তবু বলি আমি নহি নমঃর একার ।।

দলিত পীড়িত যারা দুঃখে কাটে কাল ।

ছুসনে ছুসনে বলে যত জল চল শিক্ষা

হারা দীক্ষা হারা ঘরে নাহি ধন

এই সব জানি আমি আপনার জন।।

যাক প্রাণ সেও ভালো বিদ্যা শিখে লও ।।”⁸

তার এরূপ কর্মকাণ্ডের ফল স্বরূপ প্রান্তজনের শিক্ষার বিকাশ ঘটেছিল; উত্তোরণ ঘটেছিল প্রান্তিক জনসমাজ তথা নমশূদ্র-মতুয়াদের।

হরিচাঁদ ঠাকুর সমগ্র মতুয়া সমাজের মানুষের কাছে স্বয়ং ঈশ্বর স্বরূপ সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তি বা ধর্মীয় উত্থানের মূর্ত প্রতীক। তাই গুরুচাঁদ পিতার নির্দেশিত শিক্ষা ভাবনাকে মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। গ্রাম বাংলার মানুষেরা শিক্ষা চেতনার চেয়ে বেশী ধর্মভীরু, সেই কারণে তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে শিক্ষা বিস্তার করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রায়শই বলতেন পিতৃপুরুষের আশির্বাদ পেতে হলে নিজ সন্তানকে অবশ্যই বিদ্যা শিক্ষা দিতে হবে। গ্রাম বাংলার সমস্ত লোকের কাছে তিনি প্রচার করেন যে, বিদ্যাহীন লোক কোন কালেই মর্যাদার আসন গ্রহণ করতে পারেনি’। তাই তিনি মৃত্যুকে বাজি রেখে, যে কোন প্রকার বিপদকে অতিক্রম করে প্রতিটি গ্রামে পাঠশালা গঠন করার জন্য সমস্ত মতুয়া সম্প্রদায়কে নির্দেশ দেন। শিক্ষা ছাড়া জাতির কল্যাণ সাধন করা সম্ভব নয়, নিজেদের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য ধন মান ও সম্মান বিসর্জন দিয়েও স্কুল গঠন করতে পারলে সমগ্র জাতির উন্নতি সম্ভব হবে বলে গুরুচাঁদ ঠাকুর মনে করতেন।⁹ অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে গুরুচাঁদ নিজে এবং তাঁর সমসাময়িক মতুয়া গোঁসাই পাগালদের (দ্বাদশ রুদ্র) এই শিক্ষা প্রচার অভিযানকে শুধুমাত্র ‘চণ্ডাল’ বা নমঃশূদ্র মতুয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, সমগ্র বাংলার নিম্ন সম্প্রদায় তথা প্রান্তিক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। গ্রামে গ্রামে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর জন্য তিনি প্রচার করতেন যে, একটি বাড়ীতেও ‘অবিদ্বান পুত্র রাখা যাবেনা। যেকোন রকম অভাব অভিযোগ সত্ত্বেও ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দান করতে হবে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো এই ধরনের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ দানের পরিকল্পনা ব্রিটিশ শাসনকালে এমনকি স্বাধীনতা উত্তর কালেও দেখা যায়নি। সাম্প্রতি ২০০০ সালে ‘সর্বশিক্ষা মিশন’-এ সবার জন্য শিক্ষা দানের সেই পরিকল্পনার চিত্র চোখে পড়ে। সুতরাং শতবছর আগে গুরুচাঁদের শিক্ষা ভাবনা দূরদর্শিতার দাবী রাখে।¹⁰যা প্রান্তজনের নবজাগরণের পথকে প্রসারিত করেছিল।

১৮৮১ সালে খুলনার ঈশ্বর গায়েনের মাতৃ শ্রদ্ধার অনুষ্ঠানে ১৬ টি জেলার নমঃশূদ্র প্রতিনিধিদের নিকট সভাপতির ভাষণে গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের উন্নতির জন্য প্রত্যেক গ্রামে পাঠশালা গঠন এবং সন্তান-সন্ততিদের বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে প্রেরণ করার কথা বলেন। ‘যার দল নেই তার দল নেই’ এই আদর্শ নমঃশূদ্রদের সভা সমিতি গঠনে উৎসাহী করেছিল।¹¹ গুরুচাঁদ ঠাকুর বিভিন্ন সভা সমিতিতে বক্তব্যের মাধ্যমে তৎকালীন আগ্রহী নমশূদ্রদের শিক্ষিত অংশকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, সামাজিক মর্যাদা অর্জনের প্রধান অন্তরায় শিক্ষা হীনতা এবং অর্থনৈতিক দুর্বল অবস্থা। শিক্ষার প্রসার, স্কুল গঠন ও সভা সমিতির মাধ্যমে জনমত গঠন করে সরকারি চাকরি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে চাপ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছিলেন।¹²

বাংলার প্রান্তজনের মধ্যে নমঃশূদ্ররাই প্রথম সচেতনভাবে শিক্ষা ও চাকরি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন। গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ১৯০৭ সালে প্রান্তজন তথা নিম্নবর্গের শিক্ষিত যুবকের চাকরির দাবি, তৎকালীন ছোটলাট লেন্স লট হেয়ার এর সাথে সাক্ষাৎ করে তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯০৮ সালে সেই দাবি অনুসারী নিয়োগ শিক্ষিত যুবকেরা চাকরি পেয়েছিলেন।¹³ ১৯৫০ সালে গণপরিষদে ভারতের যে সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল,সেখানে প্রস্তাবনা, মৌলিক অধিকার ও নির্দেশমূলক নীতি উল্লেখিত একাধিক অনুচ্ছেদে হাজার বছরের জাতি-বর্ণের ভেদ জনিত অস্পৃশ্যতার কারনে পিছিয়ে পড়া জাতি-উপজাতি গুলির প্রতি ঘৃণাও বঞ্চনার প্রতিকারার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও পাবলিক প্লেসে আইন মাফিক (১৭ তম অনুচ্ছেদ) সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তপশিলি জাতি উপজাতি ও পিছিয়ে পড়া জাতিগুলি অর্থাৎ প্রান্তজনের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।¹⁴ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মন্ডল কমিশন সমগ্র দেশে ৩৭৪২ টি অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণী তথা প্রান্তজনের তালিকা প্রস্তুত করেছিল। এক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ সংরক্ষণের প্রস্তাব দেয়; উক্ত প্রস্তাব ১৯৯০ সালে কেন্দ্র সরকার কার্যকর করার নির্দেশ দেয় এবং ১৯৯২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট মন্ডল কমিশনের সুপারিশকে বৈধ জানিয়ে দিয়েছিল।¹⁵ পরোক্ষভাবে বলা চলে যে, গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রান্তজনের মধ্যে শিক্ষিত ব্যক্তিত্বদের চাকরির দাবি যেন স্বীকৃত হল। নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষিত নমঃশূদ্র-মতুয়া সমাজের উত্তরণের পথ আরো প্রশস্ত হল।

একদিকে যেমন শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল, অপরদিকে শিক্ষারপ্রসারের সাথে সাথে ঘটেছিল চেতনার উন্মেষও; ফলস্বরূপ তারা নিজেদের অধিকারকে বুঝে নিতে বাংলার প্রান্তিক সমাজ তথা নমঃশূদ্র-মতুয়ারা নামকরণের আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিসরে উঠে আসে । মতুয়া সমাজের একটা বড় অংশই নমঃশূদ্র, যদিও সব নমঃশূদ্রই মতুয়া নয়।¹⁶ বর্তমানে ‘নমঃশূদ্র’ জনগোষ্ঠী যাদেরকে একসময় ‘চন্ডাল’ নামে অভিহিত করা হতো; সামাজিক দৃষ্টিতে তাদের মর্যাদা ছিল তলানিতে। এই ‘চণ্ডাল’ অভিধামোচনের ইতিহাস সুদীর্ঘ ; প্রায় চল্লিশ বছরের প্রচেষ্টায় তাদের নামকরনের পরিবর্তন ঘটেছিল। ছোটলাটের কাছে বারে বারে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ঢাকা ফরিদপুর বাকেরগঞ্জ, ময়মনসিংহ যশোর এবং পাবনা জেলার পক্ষ থেকেও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছিল। এই স্মারকলিপিতে নিজেদের হিন্দু বলে দাবি করে, ‘চন্ডাল’ এর পরিবর্তে ‘নমঃশূদ্র’ শব্দ ব্যবহারের নির্দেশ দানের অনুরোধ করা হয়েছে। “… kindly pass order the correcting the statements of the code and the hon’ble Mr. Risley’s book so as to draw clear line of separation between Namashudra and Chandals and that their case may in future be designated as Namashudra or Kudar but not as Chandal”,¹⁷  সেন্সাসে আরপিত ‘চণ্ডাল’ নাম পরিবর্তন করে, ‘নমঃশূদ্র’ নামকরণ করার জন্য সেন্সাস কমিশনের নিকট স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছিল। তবে উচ্চবর্ণের পন্ডিতদের বিরোধিতার কারণে সেই দাবি কার্যকর হয়নি। অবশেষে সারা পূর্ববঙ্গ ও আসামের নমঃশূদ্ররা জেলাভিত্তিক প্রচার ও সই জোগাড় করতে শুরু করে ; ১৮৯১ সালের এপ্রিল ও আগস্ট মাসে ফরিদপুর জেলা ও ওড়াকান্দির গুরুচাঁদ ঠাকুর ও তার অনুগামী তথা প্রান্তিক মতুয়া সমাজের উদ্যোগে তৎকালীন গভর্নর ও সেন্সাস কমিশনারকে দুটি স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার রামকিঙ্কর রায় নগরবাসী মজুমদার ও রঘুনাথ সরকারের উদ্যোগে, নামকরণের জন্য যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯১১ সালের সেন্সাসে চন্ডাল নামের পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘নমঃশূদ্র’ নামকরণ হয়।¹⁸ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের বাধা সত্যেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও শক্তিশালী দাবির মধ্য দিয়ে হীন সম্মানজনক ‘চন্ডাল’ নামের পরিবর্তে ‘নম:শূদ্র নামের আইনি স্বীকৃতি অর্জিত হয়। এযেন নামহীনের নাম প্রাপ্তির লড়াই। সহজ কথায় শিক্ষাহীন মানুষেরা শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে, সমাজে উঠে আসতে থাকে, পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় নামকরণেও; এযেন নৈতিক জয়।

রাষ্ট্রের নিকট আত্মমর্যাদার দরবারের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে নমঃশূদ্ররা মাঠে যে আন্দোলন করেছিল সেই ইতিহাস সুদীর্ঘ। ছোটখাটো প্রতিবাদ প্রতিরোধ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে ঘটলেও ১৮৭২-৭৩ সালে নমঃশূদ্র সমাজের কাছে মর্যাদা ও আইনের সাম্যের দাবিতে তীব্র এক আন্দোলন শুরু হয়।¹⁹ অস্পৃশ্যতা ও মর্যাদা বিরোধী এমন তীব্র আন্দোলন বাংলা ব্যতীত ভারতবর্ষের আর কোথাও তদানন্তিন সময়ে সুগঠিত হয়েছে বলে জানা যায়নি। এক ইংরেজ প্রতিবেদক, এই আন্দোলন কে বর্ণনা করেছেন ; এইভাবে – “In the early part of this (1873) the candals made a general strike in the district (Faridpur) resdving not to serve anybody of the upper caste in whatever capacity, unless at bitter position among the Hindu cast then why they at present occupy was given to them “, ²⁰ বরিশালের ফিরোজপুরেও আত্মমর্যাদার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের এর দাবি ছিল সেন্সাস রিপোর্টে তাদের চন্ডালের বদলে জাতির নাম রাখতে হবে ‘নম:’ জাতি হিসেবে। তাছাড়া উচ্চবর্ণ কর্তৃক প্রদত্ত জুতো না পরার ফতোয়া অগ্রাহ্য করে, তারা জুতো পায় দিতে শুরু করে। এর ফলে উচ্চ বর্গীদের সঙ্গে নমঃশূদ্রদের বিবাদ চরমে উঠেছিল। এক্ষেত্রে মুসলমান জমিদাররাও উচ্চ বর্গীয়দের পক্ষ অবলম্বন করেছিল।²¹ ১৯৫৩ সালে সনাতন সরকার, যোগেন্দ্রনাথ দাস, প্রকাশ চন্দ্ৰ  সরকার প্রমুখ ও সমাজ হিতৈষীরা তপশিল ভূক্ত স্থাপন করেন। তাদের উদ্যোগে ত্রিপুরেশ্বরী কালী মন্দিরে নিম্নবর্গদের প্রবেশ করার অধিকার আদায়ের জন্য গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং মন্দির পুরোহিতদের শাস্তির জন্য ত্রিপুরার চিখা কমিশনের নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়। কমিশনার এই ঘটনায় কৈফিয়ত চাইলে, মন্দির কর্তৃপক্ষ নিম্নবর্গদের ডেকে মন্দিরে প্রবেশ করিয়েছিলেন।²² শিক্ষাগত দৃঢ়তা, চেতনার উন্মেষ ও সঙ্গবদ্ধ ঐক্যের মাধ্যমে নবজাগরণের প্রতিফলন স্বরূপ উচ্চবর্গের কর্তৃত্বকে তোয়াক্কা না করে, সমাজে নিজেদের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল প্রান্তজনেরা।

প্রচলিত ধর্ম ভাবনা থেকে বেরিয়ে, প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের অনুষঙ্গের আধারে নিম্নবর্গের দ্বারা সংগঠিত মতুয়া আন্দোলনে নানামুখী সংস্কারের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এই আন্দোলনের অভিমুখ সম্পর্কে বলা হয় যে,- “The Namashudra movement, as a result developed two parallel tendencies in the early twentieth century. A protest against the oppressive domination of the high court landowning indigenous elite ran parallel to an unflattering allegiance to the patronizing colonial elite.”²³  ঊনবিংশ শতকের শেষ দুটি দশক থেকে নমশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষা লাভের সচেতনতা, সভা সমিতি গঠনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চেতনা ও সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। উক্ত বিষয়ে ফরিদপুরের ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক গুরুচাঁদ ঠাকুর, যশোরের রাইচরণ মজুমদার ঢাকার রামকিঙ্কর রায়, রঘুনাথ সরকার, খুলনার রায়চরণ বিশ্বাস প্রমূখ প্রাথমিক পর্যায়ে নমঃশূদ্র-মতুয়া তথা প্রান্তিক সমাজের উত্তরণের ক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।²⁴কোন সমাজ কতটা বিকশিত হল বা উন্নতি লাভ করলো তার এক বিশেষ মাপকাঠি হল, ওই সমাজে নারীর অবস্থান। মতুয়া সমাজের নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না; তারাও পুরুষের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে সমাজের জন্য কাজ করেছেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের পত্নী শান্তি দেবী এবং পরবর্তী সময়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরের পত্নী সত্যভামা দেবী সমাজের বিকাশে তথা জাগরণে কাজ করেছিলেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহায়তা থেকে শুরু করে সামাজিক সংস্কৃতির বিকাশেও কাজ করেছিলেন তারা। পরবর্তী সময়ে পি. আর.  ঠাকুরের পত্নী বড়মা বীনাপানি ঠাকুরের ক্ষেত্রেও সামাজিক সংস্কার ও সংস্কৃতিক উন্মেষের প্রয়াস চোখে পড়ে। এইসব নারীদের কার্যকলাপে শুধু যে মতুয়া সমাজ প্রভাবিত হয়েছিল হয়েছিল এমন নয়, প্রভাবিত হয়েছিল বৃহৎ-বঙ্গের নিম্নসমাজ তথা প্রান্তজনেরা। বিকশিত হয়েছিল সমাজ ও সংস্কৃতি, প্রসারিত হয়েছিল নবজাগরণের পথ।²⁵ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে জানা যায়, পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র আন্দোলনে অনুন্নত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় নিজেদের ‘ডিপ্লেম্ড ক্লাস’ হিসাবে গণ্য করে এবং আন্দোলনকে সংস্কৃতায়ণ প্রক্রিয়া দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না কারণ মতুয়া তথা নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের রক্ষণশীল আদর্শ গুলি বর্জন করে নিজেদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার শিক্ষা ও চাকুরীতে বিশেষ সুযোগ গ্রহণ করে আত্মমর্যাদাশীল সম্প্রদায় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার চেষ্টা করেছে।²⁶ সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সংজ্ঞাধিপতি শ্রীমতি মমতা ঠাকুরের মতে, “সমাজের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষ তথা পতীতের উদ্ধার কার্য করেছেন শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর । তাদেরকে শিক্ষার আলো দেখিয়ে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে উদ্দ্যম তথা সাহস যুগিয়েছেন শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর । অবিভক্ত বাংলায় যেমন মতুয়াদের উদ্ভব ও মতুয়া ধর্মের প্রসার ঘটেছিল ; ঠিক তেমনই দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে তথা বলা চলে পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র ভারতে, মতুয়াধর্মের প্রচার ও প্রসারে চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুরের পৌত্র, প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর। শুধুমাত্র ঠাকুরনগর প্রতিষ্ঠাই নয়, সমাজ কল্যাণে ভক্তদের পাশে থেকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তার অবদান অনস্বীকার্য । বর্তমানে উভয় বঙ্গের ঠাকুর পরিবার ও মতুয়া ভক্তবৃন্দের প্রচেষ্টায়, বিশ্ব মানবতার ধর্ম হয়ে উঠেছে মতুয়া ধর্ম।”²⁷ পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এইচ.ডি. গবেষক তন্ময় মালাকার মহাশয়ের মতে, “মতুয়ারা ওড়াকান্দিতে, ১৯৪৭ এর পূর্বে ব্রিটিশ শাসনকালে একটি সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠে। বেদের চতুরবর্ণ ব্যবস্থার শূদ্রদের থেকেই নমঃশূদ্রদের উদ্ভব। নমঃশূদ্রদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিকএবং ও সামাজিক উন্নয়নে মতুয়ারা এবং তাদের সংগীত বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করলেও তার গতিছিল শ্লথ। তবে শিক্ষার উন্নয়ন করে জাতির মেরুদন্ডকে শক্ত করতে চেয়েছিল। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, এই সম্প্রদায় তথা সমাজের মধ্যেকার অগ্রগতির সাথে সাথে সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছিল; যা ক্রমে পশ্চিমবঙ্গে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের হাত ধরে অগ্রগামী হয়েছে মনে হয়।”²⁸

বাংলার প্রান্ত জন তথা নমশূদ্র মতুয়ারা হরিচাঁদ ঠাকুরের দেখানো পথে ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য নেতৃত্বে শিক্ষা চাকুরী সামাজিক মর্যাদা প্রভৃতি অর্জন করেছে; সহজ কথায় চেতনার উন্মেষ ঘটেছে বিকাশ ঘটেছে, সামাজিক সংস্কৃতিরও;পর্যবসিত হয়েছে নবজাগরণ। পরবর্তী সময়ে সমগ্র ভারতের গুরুচাঁদ ঠাকুরের পৌত্র ও সুযোগ্য উত্তরসূরী পি. আর. ঠাকুরের নেতৃত্বে তা প্রসার লাভ করেছে। প্রান্তজনের ধারায় বাংলার নিম্নবর্গীয় সমাজের জাগরণে মতুয়া সমাজের অবস্থান ও কার্যকলাপ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মতুয়া সমাজের প্রেক্ষিতে প্রান্তজনের নবজাগরণ হোক বা না হোক উত্তরণ ঘটেছে এ কথা অনস্বীকার্য।।

 

 

তথ্যসূত্র:

  1. চিরন্তন দাশগুপ্ত (সম্পাদিত), ইতিহাস পরিচয়, সাতরা পাবলিকেশন প্রা:লি:, কলকাতা, ২০১৯,পৃ.-৩৩,৩৪, ৩৫
  2. Naik ,PJ., A student’s Histoty of Education in India, 1800-1973, MacMillan India Ltd,New Delhi, 1945,p.-17
  3. শাস্ত্রী, শিবনাথ, রামতনু লাহিড় ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৫৫, পৃ. -৪৯
  4. Census of India, 1901-1941,Schedule Caste Schedule tribes,individual cast wise statistical report, West Bengal
  5. মুখোপাধ্যায়,জীবন, স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ,নবভারতী প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২০, পৃ. – ১১৬
  6. হালদার, মহানন্দ,গুরুচাঁদ চরিত,পৃ. – ১৪৪
  7. হালদার, মহানন্দ,প্রাগুক্ত,পৃ. – ১০৮
  8. হালদার, মহানন্দ,প্রাগুক্ত,পৃ. – ১৪৪
  9. বিশ্বাস, মনোশান্ত, বাংলার মতুয়া আন্দোলন :সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি, সেতু প্রকাশনী, কলকাতা,২০১৬, পৃ – ১৬৩
  10. তদেব, পৃ. ১৬৫
  11. বিশ্বাস, মনোশান্ত, ‘তপসিলী জাতি সংরক্ষণ আন্দোলনে নমঃশূদ্রদের অবদান, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত), কলকাতা নমঃশূদ্র থিঙ্কার্স এ্যান্ড এ্যাক্টিভিস্টস্ এ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা, ২০২১, পৃ.-২১৩
  12. বিশ্বাস, সতীনাথ, জাতি তত্ত্ব ও নমঃশূদ্র দর্পণ, ঢাকা, ১৯৩১, পৃ.- ১৫৭
  13. বিশ্বাস, মনোশান্ত, ‘জাতি সংরক্ষণ আন্দোলনে নমঃশূদ্রদের অবদান, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত) কলকাতা নমঃশূদ্র থিঙ্কার্স এ্যান্ড এ্যাক্টিভিস্টস্ এ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা, ২০২১, পৃ. ২০৪
  14. Article 15 (1) and 15 (II), Article -17, Article- 330-342330-342, The constitution of India, (as Modified upto the 1st December, 2007) Government of India. Ministry of Law and justice, http://Lawman.in/coi/coiason29july08-pdf.access on.14-02-2017
  15. চক্রবর্তী, তুষার কান্তি, ‘ভারতের সংরক্ষণ : সাংবিধানিক ব্যবস্থা’, সুজিত সেন (সম্পাদিত), জাত পাত ও সংরক্ষণ : ভারতীয় প্রেক্ষাপট, মিত্রম্, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২৩
  16. সাক্ষাৎকার: নির্মল চন্দ্র বিশ্বাস, সাক্ষাৎকার: ভাদুড়িয়া,০৬-০৬-২০২৩
  17. বিশ্বাস, মনোহর মৌলি, ‘প্রবন্ধে প্রান্তজন অথবা অস্পৃশ্যের ডাইরি’, চতুর্থ দুনিয়া, প্রথম সংস্করণ, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৩৩
  18. বিশ্বাস, মনোশান্ত, বাংলার মতুয়া আন্দোলন : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি, সেতু প্রকাশনী, কলিকাতা, ২০১৬, পৃ. ২২৭-২৩০
  19. হীরা, আশিস, অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলনে নমঃশূদ্র সমাজ’, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত), কত নমঃশূদ্র বিস্তার্স এ্যান্ড এ্যাক্টিভিস্টস এ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা, ২০২১, পৃ-১৮৮
  20. তদেব,পৃ. -১৮৮
  21. ঠাকুর, কপিল কৃষ্ণ, বাংলার অস্পৃশ্যতা মুক্তি আন্দোলনের অনালাকিত অধ্যায়’, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত), দলিত মনোনয়ন, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, চতুর্থ দুনিয়া, কলকাতা, ২০১৩, পৃ-১০০
  22. সরকার, সনাতন, আত্মকথা, প্রথম সংস্করণ, আগরতলা, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৯
  23. হীরা, আশিস, ‘অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলনে নমঃশূদ্র সমাজ’, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত), কলকাতা নমঃশূদ্র থিঙ্কার্স এ্যান্ড এ্যাক্টিভিস্টস্ এ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা, ২০২১, পৃ.-২০০
  24. বিশ্বাস, মনোশান্ত, ‘তপসিলী জাতি সংরক্ষণ আন্দোলনে নমঃশূদ্রদের অবদান, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত), কলকাতা নমঃশূদ্র থিঙ্কার্স এ্যান্ড এ্যাক্টিভিস্টস্ এ্যাসোসিয়েশন, কলকাতা, ২০২১, পৃ.-২১৩
  25. বাইন, রসময়, নারী জাগরণে – শান্তি মাতা ও সত্যভামাদেবী,মতুয়াবার্তা, ঠাকুরনগর,২০২০, পৃ. -৭,৩৮,৪০
  26. বন্দ্যোপাধায়, শেখর – ‘উন্নয়ন, বিভাজন ও জাতি : বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন ১৮৭২ – ১৯৪৭ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস. এবং দাশগুপ্ত, এ (১৯৯৮) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৪৫৬
  27. সাক্ষাৎকার: শ্রীমতি মমতা ঠাকুর,সাক্ষাৎকার: ঠাকুরনগর,১৫-০৭-২০২৩
  28. সাক্ষাৎকার: তন্ময় মালাকার, সাক্ষাৎকার:গোবরডাঙ্গা,১৩-১২-২২