The Multifaceted Maestro Behind the Curtains
Dr. Biswajit Mondol
Abstract: Kumar Roy, often recognized solely as an accomplished actor, transcends the stage as a prolific planner, dramatist, reciter, drama editor, and director. Behind the scenes, he embodies an enviable personality, serving as a disciplined silent organizer, a publicity-averse Kandari, and a compassionate teacher. Tripti Mitra, under his direction, presented a legendary play that left a profound impact. The first review in Anandabazar Patrika noted that what was previously unsaid about his earlier plays now finds expression in the context of the latest production, ‘Legend.’ The simplicity yet effectiveness of the play moves audiences with the sincerity of the chief bridegroom’s grief, while the central theme of freedom from fear resonates universally. Beyond his theatrical prowess, Kumar Roy unveils another facet of his extraordinary talent – an outstanding painter, proficient in creating beautiful images using watercolours and pastels. His artistic expression extends beyond the stage, leaving an indelible mark on multiple creative realms.
নেপথ্য নাট্যশিল্পী কুমার রায়, ড. বিশ্বজিৎ মণ্ডল
সকলেই জানেন তিনি শুধু অভিনেতা নন – একদিকে পরিকল্পক, নাট্যকার, আবৃত্তিকার, নাট্য সম্পাদক, পরিচালক। অন্যদিকে ঈর্শনীয় ব্যক্তিত্ব, নিয়ম-নিষ্ঠ নীরব সংগঠক, প্রচার বিমুখ কান্ডারী, দরদী শিক্ষক। তাঁর কিংবদন্তি নাটক পরিচালনা করলেন তৃপ্তি মিত্র। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রথম অভিনয়ের সমালোচনায় লেখা হল আগের দুটি নাটক (বর্বরবাঁশি, ত্রিংশ শতাব্দী) সম্পর্কে যে কথা বলা সম্ভব হয়নি, বহুরূপীর নবতম প্রযোজনা কিংবদন্তী প্রসঙ্গে তা মুক্তকন্ঠেই বলতে পারব। শুরুতেই তাই লিখে রাখছি কিংবদন্তী একইসঙ্গে আমাদের ভাবিয়েছে এবং আনন্দ দিয়েছে। নাটকটি সরল, কিন্তু সদর্থক। প্রধান পাত্রপাত্রীর দুঃখের আন্তরিকতায় আমরা অনুপ্রাণিত। আর নাটকের যে সমস্যাটা প্রধান, ভয় থেকে মুক্তির সমস্যা, তার আয়নায় আমরা প্রত্যেকে কি নিজেদের মুখ দেখতে পাইনি? তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার আর একটি দিকের কথা হয়ত অনেকের জানা নেই। অসামান্য চিত্রশিল্পী। সুন্দর ছবি আঁকতেন। বিশেষ করে জল রঙ আর প্যাস্ট্রেলের ব্যবহারে।
তাঁর আরও একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল ছবি তৈরি করার ক্ষমতায়। নিজে ছবি আঁকতেন, ষাটের দশকে বহুরূপীর পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধারাবাহিকভাবে। নাটকের রূপসজ্জার কাজে হাত লাগিয়েছেন অনেক সময়ই। নিজেই করতেন নিজের রূপসজ্জা। বিসর্জনে ‘গোবিন্দমাণিক্য’, রাজাতে ‘ঠাকুরদা’ এবং চোপ্ আদালত চলছে নাটকে ‘মিঃ কাশিকার’ চরিত্রে তিনি নিজে রূপসজ্জা করতেন। তাঁর নাটকের চরিত্রদের দেখতে কেমন হয়ে তার পরিকল্পনাও নিজে করতেন। রূপশিল্পীকে তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্ত রূপ দিতে হোত। রূপসজ্জা প্রসঙ্গে অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, –
‘ক্রমশ কুমারদাকে কাছ থেকে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হতে লাগল। অদ্ভুত মানুষ, যার মধ্যে শিরায় উপশিরায় বইছে নিপুণ শৈল্পিক সত্তা। নিরহঙ্কার একজন মানুষ। শুধু অভিনয় কেন থিয়েটারের প্রধান অঙ্গ ‘রূপসজ্জায়’ তিনি ছিলেন অসাধারণ। যখন ‘রাজা’ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ আসে, তখন আমার মুখাবয়ব কোনোমতেই কোনো রাজার মুখ বলে মনে হয় না। সেই মুখকে কুমারদা তাঁর হাতের গুণে যা খাড়া করেছিলেন, নিজেকে আয়নায় দেখে আমি হতবাক হয়েছিলাম। … ‘শকুনির পাশা’ নাটকে মঞ্চসজ্জা এবং সাজসজ্জার জন্যে কুমারদার কাছে দরবার জানাই। অত্যন্ত দ্বিধাহীন চিত্তে, একবাক্যে তিনি সেই কাজ সম্পূর্ণ করেন’।১
যাঁরা ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক দেখেছেন, এর মঞ্চ পরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের শেখায় কেমন করে একটি বিশেষ সময়ের অভ্যন্তরে প্রযোজনা শৈলীকে ঠিক রেখে তাকে আধুনিক সময়ের দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায়। অন্য দলের হয়েও কখনো-কখনো মঞ্চ পরিকল্পনার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেননি। অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চসজ্জার কাজেও যে আগ্রহ, তাঁর বাল্যবয়সের নাট্যচর্চাতেও দেখা গেছে। তার নিজের পৈতৃক অট্টালিকাকে তিনি ‘ঘরে বাইরে’ নাটকের মঞ্চসজ্জার আদলে ধরেছিলেন কিভাবে সে প্রসঙ্গে সৈমিত্র বসু লিখেছেন,
‘ঘরে বাইরে নাটকে প্রথম তাঁকে বহুরূপীর নাটকে মঞ্চসজ্জা করতে দেখলাম আমরা। কাজটা সহজ ছিল না, তৃপ্তি মিত্রের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় এ নাটকে অনেকগুলি ছোটো ছোটো দৃশ্য আলাদা আলাদা স্থানিক পটভূমি। বড়ো একটি জমিদার-বাড়ী করে রেখেছিলেন কুমার রায়, তার দোতলার বারান্দা, বৈঠকখানা ঘর, অন্দরমহলের অন্য অংশ সবটাই ধরাতে পেরেছিলেন একটি পরিসরে। মনে করতে ইচ্ছে হয়, কৈশোরে দেখা দিনাজপুরের জমিদার বাড়ির স্মৃতি চলে এসেছে এই পরিকল্পনার অন্তর্লীন। আগেই বলেছি ছোটোবেলার স্মৃতি কথায় লাল, নীল, কাচের সার্সি দিয়ে আলো পড়ার বর্ণনা দিয়েছেন কুমার রায়। ঘরে বাইরেতেও একটি লাল নীল কাচের সার্সি দেওয়া জানালা ছিল, একটি দৃশ্যে তার মধ্যে দিয়ে আলোও এসে পড়ত।২
মঞ্চসজ্জার পাশাপাশি রূপসজ্জার কাজেও তাঁর দক্ষতা সকলেই স্বীকার করেন, নিজের অংরাগ করা ছাড়াও অন্যদলের ক্ষেত্রেও তিনি সমান সহযোগিতা করেছেন।
কুমার রায়ের মঞ্চ সৃজন প্রসঙ্গে মঞ্চপরিকল্পক খালেদ চৌধুরী বলেছেন,
‘চমক লাগিয়েছিল ‘মৃচ্ছকটিক’ – খুব ভালো লেগেছিল। যখন আভেরী অভিনয় করে আমি তখন দেখেছিলাম। যখন একজন মানুষ ডিরেকশন দেয় তখন তার মাথায় অনেক ছবি থাকে। এরিয়া কী করে ভাগ করা হবে। একটা সামগ্রিক শিল্পবোধ না থাকলে এটা হয় না। যেটা আমি খুব কম দেখেছি আমার কার্যকালে – সামগ্রিকভাবে একটা জিনিসকে ভাবা। শম্ভু মিত্র ভাবতেন আবার ডিপেন্ডও করতেন। আমার ক্ষেত্রে তো বটেই। বসে থাকতেন মডেল করার সময় ডিজাইন করার সময়ে। যখন মডেল তৈরি হত জিজ্ঞাসা করতেন, এখানে কতটা জায়গা আছে – আমি বললাম এতটা আছে – উনি বললেন, বাড়ানো যায়? তাহলে আমার মাথায় একটা জিনিস আছে ওটা পুট (put) করতে পারি। একজন ডিরেকটর যখন ভাবেন তখন ভাবনার মধ্যে সবগুলো বিষয় সার্বিকভাবে আসে। মানে তার মিউজিকটা কীভাবে হবে, সেটটা কীভাবে হওয়া দরকার, লাইটটা কীভাবে হবে – মোটের ওপর সামগ্রিক ধারণা সব ডিরেকটারেরি থাকে। কিন্তু কম-বেশি। কুমারের মধ্যে এটা খুব বেশি ছিল। তার কারণটা হচ্ছে কুমার রায় নিজে ছবি আঁকতেন – সেই জগতের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। যার প্রভাবটা নাটকে এসে পড়েছে, নাটকে কার্যকরী হয়েছে।
তারপর তো অনেকগুলো কাজ করেছেন। ‘যযাতি’র সময় (১৯৮৮-তে অভিনয় হয়, গিরিশ কারনাডের নাটক) আমাকে ছেড়ে দিলেন। কিচ্ছু বলেননি, শুধু কাহিনীটা বললেন। আমি যা যা করেছিলাম ইন-টো-টো এক্সিকিউওট করা হল (execute) করা হল। এটা মস্ত বড় গুণ। আবার ‘নিন্দাপঙ্কে’-র সময় সেট ডিজাইনের পুরো কাজটা করার পর ওর মনে হল দরজাটায় খামতি আছে। আমাকে বললেন, কী করা যায়? আমি করলাম। যেন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আসলে অনেক রঙের বিনিময়ে এই জায়গায় পৌঁছতে হয়েছে। যেখানে গিয়ে ওনার মনে হয়েছে কোথাও একটা আটকে যাচ্ছি তখনই অকপটে সাহায্য নিয়েছেন – আমার ওপর ডিপেন্ড করেছেন। তারপর সেই ছাতাওয়ালা নাটকটা – মানে ‘রাজদর্শন’। এখানে কুমারের অ্যাকটিং যেমন ভালো, পরিকল্পনাও খুব ভালো। রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ বোধহয় আমি দেখিনি। তবে ভালো লেগেছিল নিধুবাবুর ওপর নাটকটা ‘পিরীতি পরমনিধি’। তাতে সংগীতবোধের একটা পরিচয় পাওয়া যায় – ঐতিহাসিকতারও একটা দিক ছিল। নির্দেশনাও ভুব ভালো ছিল। সফল একজন নির্দেশক যিনি সার্বিকভাবে নজর রাখেন সমস্ত কিছুর ওপর। সেই নজরটা পুঁথিপড়া বিদ্যে নয় – অনুভূত বিধ্যা। কুমারের সেটা ছিল। আমি বলছি না একজন সফল ডিরেকটরকে বিরাট মিউজিশিয়ান হতে হবে – কিন্তু মিউজিকের সেন্সটা তার থাকা দরকার। আমি বলছি না যে তাঁকে বড় আর্টিস্ট হতে হবে, তবে শিল্পবোধের দিকটা তার থাকা দরকার। নির্দেশনায় এই শৈল্পিক দিকটা সবসময় থাকত কুমারের’।৩
বহুরূপী, নানামুখী নাট্যচর্চার কাজের মধ্যে অভিনয়পত্রী মুদ্রণের একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছিল। দর্শকের নাট্যরুচি তৈরিতে এই সব বিষয়সার এবং চরিত্রলিপি সম্বলিত অভিনয়পত্রীগুলি পঞ্চাশের দশকের মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে খুবই বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। শম্ভু মিত্রের পছন্দের এই কাজটি কুমার রায়ও চিরকাল অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। ‘রাজা’ ও ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকের মধ্যে পাঁচটি পুরোনো নাটক নিয়ে ১৯৬৪-তে নাট্যোৎসবে অনুষ্ঠিত হয় সে সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করে কুমার রায় লিখেছেন,
‘‘নাট্যোৎসবের স্মারকগ্রন্থে – রাজা অয়দিপাউসের পরিচয়পত্রে গ্রিক অক্ষরে ‘অয়দিপাউস তিবেম্মাস’ এই কথাটি বাংলা রাজা অয়দিপাউসের সঙ্গে ছাপা হবে এটা সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাজের চাপে ওই ডিজাইনটা করা হয়নি, ব্লকও হয়নি। একদিন আগে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন ওটা হয়নি – সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ওটা না ছাপা হলে স্মারকগ্রন্থ অভিনয়ের সময় আনতে হবে না’।৪
ওই অবস্থায় ওই কথাটার জোর কতটা সেটা আমরা জানতাম। এদিকে সমস্ত ছাপা হয়ে গেছে, পরদিন বাইন্ডারের কাছে প্রেস থেকে চলে যাবে। উপায় নেই – ঘন্টা কয়েকের মধ্যে ডিজাইন, ব্লক এবং ছেপে সেটা বাইন্ডারের কাছে গেল – এবং পরদিন অভিনয়ের আগেই নিউ এম্পায়ারে পৌঁছে গেল। এ ঘটনার তাৎপর্যে আমরা বুঝতে পারি নাটকের এরকম ছোটো বড়ো গৌণ কাজের প্রতি তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। কুমার রায় এই পরম্পরায় এতটা অভ্যস্ত যে, পয়লা মে কিংবা মহালয়ার দিন বছরে দু-বার পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো রকম অন্যথা হতে দেননি। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে পূর্বোক্ত স্মারকগ্রন্থটিতে কুমার রায়ের আঁকা অসাধারণ একটি শিল্পকর্ম মুদ্রিত হয়েছিল, লাল-কালোয় আঁকা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধরণের একটি নিষ্ঠুর চিত্ররূপ – রাজা অয়দিপাউস নিজের চোখে তীক্ষ্ণ তরবারি বিদ্ধ করে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্য করছেন।
আরও একটি ঘটনাও উল্লেখ করার মতো ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের নির্দেশকের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি অভিনব এক প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। নাটক মঞ্চায়নের একমাস আগে থেকে বহুরূপীর কিছু নির্বাচিত দর্শকের কাছে – ডাকযোগে একটি সুদৃশ্য প্রচারপত্র পাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেগুলিও রচনা করেছিলেন নির্দেশক কুমার রায় ছাড়া তিনজন বিদগ্ধ মানুষ। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন –
‘সংস্কৃত নাটক ও রবীন্দ্রনাথ’, অমিয় দেবের রচনা ‘নান্দন্তে বেট ব্রেশট’; সুকুমারী ভট্টাচার্যের শিরোনাম – সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’, এছাড়া কুমার রায় লিখলেন ‘রীতিবদ্ধতার সমস্যা’। অভিনব এই উদ্যোগে তদানীন্তন কালে বহুরূপীর আন্তঃসঙ্কট মোচনে কতটা সহায়ক হয়েছিল সে বিষয়ে স্বপন মজুমদার যথার্থই জানিয়েছেন – দূর কালের ও দ্রুততর মানসিকতার নাটকটি বিষয়ে সুলিখিত এই প্রচারপত্রগুলি যেমন অবহিত করে তুলল, সম্ভাব্য দর্শকদের, তেমনি কৌতুহলও জাগিয়ে তুলল। অন্যদিকে ব্যক্তিগত এই যোগাযোগে শুষ্ক হৃদয় বিমুখরাও অন্তত অনূভব করতে পারলেন, বহুরূপী তাঁর কাজ করে যেতে চান তাঁরই স্বক্ষেত্রে নাগর-সংস্কৃতির বিদুষণ-বিদ্যায় তাঁর রুচি নেই, কোনো রসিককেই অনাত্মীয় মনে করেন না তাঁরা, তাঁদের রথযাত্রায় সবারই সাদর আহ্বান।৫
মঞ্চ পরিকল্পনার যে কথাটা – আঁকা জোখার ব্যাপারে তাঁর একটা উৎসাহ ছিল। খালেদ সাহেবের কাজ দেখেছেন। পুতুল খেলা বা রক্তকরবী, পরে কিংবদন্তি করে দিয়েছেন। পাগলা ঘোড়া করেছেন, মানে শেষদিকে পর্যন্ত করেছেন খালেদ সাহেব। এইগুলো দেখার অভিজ্ঞতাও কাজে লাগিয়েছিলেন, বলতেন কেমন করে স্পেশটাকে ব্যবহার করতে হয়। ওটাও যেন কথা বলতে পারে, মঞ্চসজ্জাটাও যেন কথা বলতে পারে। নাটককে সাহায্য করার জন্যই নাটক থেকে আলাদা যেন না হয়। খালেদ সাহেব যে-কটা মঞ্চ সজ্জা করেছেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থেকে কাজটা বোঝবার চেষ্টা করেছেন। লেটারিং কী করে করতে হয় সেটাও চেষ্টা করেছেন এবং নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে রক্তকরবী-র ওই বিশেষ লেটারিং, যেটা প্রায় প্রতিদিন তখন ছাপা হত কাগজে, সেই লেটারিংটাও তাঁর করা এবং পরে আরও অনেক লেটারিং করেছেন। থিয়েটারের সবগুলো কাজ করবার একটা চেষ্টা ছিল তাঁর।
কুমার রায় তাঁর নির্দেশিত নাটকের অভিনয়পত্রীতে নাটকের নামাক্ষরলিপি ও বিষয়সার বাইরের শিল্পী কিংবা নাট্যকারদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু একাজ তাঁর প্রিয় কাজগুলির মধ্যেও অন্যতম – তা বোঝা যায় শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্র নির্দেশিত নাটকের ক্ষেত্রেও একাধিকবার তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নিজের নির্দেশিত নাটকেও অনেক সময় নিজেই এগিয়ে এসেছেন এ-কাজ করতে। নির্দেশকের ভাবনার ব্যাখ্যাকে অভিব্যাপ্ত করে তুলে কুমার রায় অনেকদিন থেকেই একটার পর একটা শিল্পার্থ সৃজন করেছেন। বহুরূপীর এরকম কাজে কী অপরিসীম প্রভাব ফেলেছে ‘দশচক্র’, ‘কিম্বদন্তী’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘চোপ, আদালত চলছে’, ‘অপরাজিতা’, ‘গন্ডার’, ‘মালিনী’, বা ‘মিষ্টার কাকাতুয়া’র মতো নাটকের নামাক্ষর সৃজন দেখলে বোঝা যায়। এমন কী পূর্বোক্ত নাটকগুলির পরবর্তীকালেও যেসব নাটক অভিনীত হয়েছে – তার প্রায় সবকটিই তাঁরই সৃজনের সাক্ষী বহন করে চলেছে আজও। কখনো পুরাতন হরফকে প্রয়োজন মতো অনুসরণ করে, কখনো রাবীন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করে এসব কাজ করেছেন তিনি। শুধু অভিনয় বা নির্দেশনাই নয়।
অনেকের কাছে শুনেছি প্রাচীরে প্রাচীরে বহুরূপীর নাটকের পোস্টার লাগাতেন, থিয়েটারের নেপথ্যের সব রকম কাজে উৎসাহ ছিল। প্রতিটি কাজ করে গিয়েছেন যত্ন নিষ্ঠা ও মমত্ব দিয়ে। এইসব কারণে তিনি শম্ভুমিত্রের খুবই প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।
জন্মকাল থেকে বহুরূপী নাট্যসংস্থায় ভাঙাগড়ার শেষ নেই। মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রধান দুই মানুষ শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র, গঙ্গাপদ বসু, অমর গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক মজুমদার, শোভেন মজুমদার প্রমুখ বিশিষ্ট মানুষেরা কে না বহুরূপী ছেড়েছেন? একমাত্র কুমার রায় বোধকরি একদিনের জন্যও বহুরূপী ছেড়ে যাননি। অতিরিক্ত আত্মপ্রতিষ্ঠা স্পৃহা, দলের মধ্যে গ্রাম্য কোঁদল ইত্যাদিতে কুমারদার কখনও মনোযোগ ছিল না। যা সহজে বিনা ঝগড়াঝাটিতে পাওয়া যায় তাতেই তিনি খুশি। তাই তাঁকে নিয়ে দলে কোনো সমস্যা ছিল না। তাঁকে কেউ তাড়ায়নি, তিনিও অভিমান করে বা কোনো অছিলায় ছেড়ে যাননি, অথচ অভিমান বা রাগ করে কিংবা পোষাচ্ছেনা বলে দল ছেড়ে যাওয়া বহুরূপীর নিত্য ঘটনা। অবশ্য কমবেশি সব বাঙালি নাট্যদলের এটাই ইতিহাস। বহুরূপীতে নাট্য পরিচালক হিসেবে কুমার রায়-এর আবির্ভাব ১৯৫৬ সালে – তুলসী লাহিড়ির চৌর্যানন্দ ও অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের নাট্যকারের বিপত্তি নাটক দুটি নির্দেশনার মাধ্যমে।
১৯৫৭ থেকে তিনি বহুরূপী সংস্থার কোষাধ্যক্ষ পদে বৃত হন এবং দীর্ঘদিন এই কাজ সামলেছেন। নাট্যশিক্ষক হিসেবেও তাঁর প্রতিষ্ঠা সেই ১৯৫৬ সালে। বহুরূপীতে এই সময় দলের সদস্য ও বহিরাগত কিছু নাট্য-আগ্রহীকে প্রশিক্ষণের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষক হিসেবে গঙ্গাপদ বসু, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখের সঙ্গে কুমার রায়ও দায়িত্ব লাভ (গ্রহণ) করেন। ১৯৬৮ সালে মূলত বহুরূপীর উদ্যোগে ও রূপকার, নান্দীকার, গান্ধার প্রভৃতি নাট্যদলের যৌথ উৎসাহে জাতীয় নাট্যশালা স্থাপনের উদ্দেশ্যে বাংলা নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতি গঠিত হয়। সভাপতি বিষ্ণু দে, সহ-সভাপতি গঙ্গাপদ বসু ও তৃপ্তি মিত্র, সম্পাদক শম্ভু মিত্র এবং কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হন কুমার রায়।
বাংলা ভাষায় সুসম্পাদিত পত্রিকাগুলির মধ্যে অন্যতম বহুরূপী পত্রিকা। পত্রিকাটি বহুরূপী নাট্যদলের মুখপত্র হলেও নিতান্তই দলের কথা শোনাবার জন্য এর আত্মপ্রকাশ নয়। পত্রিকাটির সারস্বত সমাজে ও সংস্কৃতির অঙ্গনে আরও অনেক কথা বলার ছিল যা সর্বজনীন। ১৯৫৫ সালে যখন পত্রিকা প্রকাশ করা স্থির হয়, তখন দলের পক্ষ থেকে পত্রিকার পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কুমার রায়কে। মহর্ষি বলেছিলেন,
‘দেখ, তোমাদের কথা জানবার একটা আগ্রহ লোকের হয়েছে, কিন্তু জানবে কী করে? এই জন্যেই কাগজ একখানা থাকা দরকার’।৬
প্রথম তিনটি সংখ্যায় স্বতন্ত্রভাবে কেউ সম্পাদক ছিলেন না। ৪ থেকে ৩৫ সংখ্যা পর্য্যন্ত (১৯৫৭-১৯৭১) সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন অভিনেতা, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক গঙ্গাপদ বসু। তাঁর মৃত্যুর পর ৩৬ থেকে ৫০ সংখ্যা পর্য্যন্ত (১৯৭১-১৯৭৮) সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় শম্ভু মিত্র-এর। ৫১ সংখ্যা (জুন, ১৯৭৯) থেকে আজীবন কুমার রায় সম্পাদক ছিলেন পত্রিকার। মাঝে মাঝে নির্বাহী সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেন চিত্তরঞ্জন ঘোষ এবং সাম্প্রতিককালে প্রভাত কুমার দাস। পত্রিকাটি প্রারম্ভকাল থেকেই খুবই উচ্চ আদর্শ ও মান বজায় রেখে প্রকাশিত হয়েছে, শিক্ষিত পাঠকসমাজ এর কদর করেছে। শুধু মৌলিক বা রূপান্তরিত নাটক নয় সে সঙ্গে নিয়মিত নাট্য-আন্দোলন এবং নাট্যসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নিয়ে মননশীল অথচ খোলামেলা আলোচনামূলক প্রবন্ধ থেকেছে। বহুরূপী পত্রিকার পক্ষ থেকে একসময় অন্যান্য সহযাত্রী নাট্যদলের কাছে আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছিল, কেবল পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে সাহেবদের এঁটোকাঁটা বাছবিচার না করে গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করলেই হবে না। আজকের দিনের লোকায়ত মানস ও পরম্পরালব্ধ শিল্পকে যেন আমরা মেলাতে পারি। সেই কঠিন কাজে আমাদের সকলের এসে মেলা দরকার, তাতে আমাদের সকলেরই সার্থকতা’। এই আবেদন যে খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছিল তা নয়। তবে বিশেষ প্রযোজনা উপলক্ষ্যে সুভেনির প্রকাশ করা ছাড়া নিয়মতভাবে একটি মুখপত্র দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করে যাওয়ার সামর্থ আর কোনো নাট্যদল দেখাতে পারেনি। এই পত্রিকাটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের আকর বলা যায়। এই পত্রিকায় লেখেননি বাঙালি বা ভারতীয় এমন কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি নেই বললেই চলে। এই পত্রিকার পাতায় চর্চিত হননি এমন কোনো দেশি বিদেশি নাট্যকার, নাট্য-সমালোচক নেই। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা থেকে আজ পর্য্যন্ত অঙ্গসজ্জা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনাও উল্লেখযোগ্য। কুমার রায় এর দীর্ঘদিনের সম্পাদক শুধু তাই নয়, এর প্রচ্ছদ অঙ্কনেও তাঁর স্পর্শ রয়েছে। এও এক দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস বাঙালি নাট্যসমাজের। এই কৃতিত্বের সম্মানে ২০০৫-এ ১১ জানুয়ারি লিটল ম্যাগাজিন মেলায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির তরফ থেকে কুমার রায়-কে সংবর্ধনা জানানো হয়। সম্পাদক হিসেবে তিনি আরও একটি মর্য্যাদাযোগ্য প্রকাশন বের করেছেন।
সকলেই জানেন ‘রক্তকরবী’র অনেকগুলি খসড়া রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন। দশটির মতো খসড়া-র পরে রক্তকরবী-র এই চেনা রূপ আমরা পাই। বহুরূপীর সংগ্রহে একটি খসড়া ছিল, তিনি ছেপে ছিলেন পত্রিকায়। পরে ওই অংশটুকু দিয়ে আলাদা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলেন; রবীন্দ্র গবেষকদের কাছে এর মূল্য বলা যায় অপরিসীম।
বহুরূপী পত্রিকায় তাঁর তিনটি নাটক প্রকাশিত হয়। একটি মৌলিক আর দুটি অনুবাদ। মৌলিক হল ‘কিংবদন্তী’ (১৯৫৮), তৃপ্তি মিত্র এই নাটকটি করবেন বলে ঠিক করলেন। শ্রীমতি মিত্রের অনুরোধে ‘কিংবদন্তী’কে পূর্ণাঙ্গ করা হল। ১৯৭০-এ এই নাটকটির মঞ্চায়ন হয়। ১৯৭৮-এ এন এন পিল্লাই রচিত মালয়ালম নাটকের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে ‘প্রলয়’ প্রকাশ পায়। আর Irwin Shaw –এর Bury the Dead অবলম্বনে ‘উজান বেয়ে’ লেখেন পঞ্চাশের দশকে, ১৯৮০-তে লেখাটি বার হয় বহুরূপী পত্রিকায়। ১৯৮২-তে এন.বি.টি. থেকে ‘নটসম্রাট’ নামে অনুবাদ নাটক বেরয়। মূল রচনা কালয় তস্মৈ নমঃ, লেখক শিরভারকর খামোলকর। অনুবাদ করেন কিরনময় রাহার Bengali Theatre, গ্রন্থটি ‘বাংলা থিয়েটার’ নামে ১৯৯৫-তে এন.বি.টি. থেকে প্রকাশিত হয়। পরে তাঁর সম্পাদনায় ‘বাংলা একাঙ্ক নাটক’ সংকলন প্রকাশ করে ওই এন.বি.টি. ১৯৮৮ সাল, বছরটা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের সার্ধসাততম বর্ষ।
‘দেশ’ পত্রিকা সাহিত্য সংখ্যা ‘বঙ্কিম সংখ্যা’ নামে প্রকাশ করলেন। ওই সংখ্যায় কুমার রায়ের একটি প্রবন্ধ বেরল – নাম ‘এ বন্দী আমার প্রাণেশ্বর’। উনিশ শতকের বিস্তৃত ইতিহাস ঘেঁটে রঙ্গমঞ্চের আলোয় তুলে ধরলেন হারিয়ে যাওয়া এক অচেনা বঙ্কিমচন্দ্রকে। তিনি ওই লেখার মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রেক্ষিতে যে সম্মান ও অঞ্জলি নিবেদন করেছেন, অনেকেই তা পারেননি। তাঁর গদ্য লেখনী যথেষ্ট সাবলীল ভাষায় প্রণীত। স্বচ্ছবোধের স্পষ্ট উচ্চারণ। সব থেকে বড়ো বিষয় কোনো রচনাতেই বুদ্ধির দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নেই। তাঁর লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে কাব্যময়তা। বহুরূপীর নাট্য পত্রিকার সম্পাদকীয়, পত্র-পত্রিকায় বিশেষ নিবন্ধ, সংবাদপত্রে গ্রন্থালোচনা এবং তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাদিতে কাব্যরস বিশেষ সম্পদ বলা যায়। কিছু কিছু বিষয় আলোচনার সুবিধার্থে একাধিকবার লেখার মধ্যে চলে এসেছে বিষয়সারের সম্পূর্ণতাকে ধরার প্রয়োজনে। কেবল বহুরূপী নয় – তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমস্ত থিয়েটারের। থিয়েটারের যৌথ পরিবারের দায়িত্বশীল অভিভাবক। থিয়েটারের যে কোনও সমস্যাই যেন হয়ে উঠেছিল তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা। দায়িত্ব নিয়েছিলেন থিয়েটারের দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠানের ‘পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি’ ও ‘মিনার্ভা নাট্যসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের। ফলে চাপ বেড়েছিল তাঁর। বহুরূপীর কাজ সামলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কাজের ধকল তাঁর শরীরে নিতে পারছিল না। তবু তিনি যেমন নিজের কথা না ভেবে সকলের কথাই ভেবে চলেছিলেন, সব সময় তাঁর মনোমতো হয়েছে তা নয়। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজের মতামতকে একটু আড়ালে রেখেই তিনি শুনে গেছেন, বুঝতে চেয়েছেন অন্যের কথা – অন্যের মতামত। নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সম্মিলিত কাজের – সম্মিলিত মতামতের নিরিখে। তিনি পারতেন সকলকে নিয়ে চলতে। তিনি আমাদের থিয়েটার জগতে এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা একথা কে অস্বীকার করবে? নির্দেশনা, মঞ্চচিত্রণ, নাট্য বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা, সর্বোপরি শিক্ষক। এক সুদীর্ঘকাল তিনি বাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তাঁর নিরলস নাট্যচর্চায়। যে কোনও শিল্পের আঙিনায় একটা কথা শোনা যায়, পরিমিতিবোধ। কিন্তু জীবনচর্যায় তার চর্চা না থাকলে শিল্প তার প্রতিফলন কতটা ঘটবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এই পরিমিতিবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর পোশাক-আশাক, জীবনচার্যায়, মতপ্রকাশে, রাগে-দুঃখে-আনন্দে, প্রতিক্ষেত্রেই তাঁর এই পরিমিতিবোধের অসামান্য প্রকাশ এ যুগে ব্যতিক্রম বটে। তাই হয়তো তাঁকে নিয়ে কোনও প্রচার আমরা মিডিয়াতে দেখতে পাইনি খুব একটা। চিরদিনই আড়ালে থেকে নিজের কাজ করে গেছেন। বোধহয় নিজেকে আড়াল করতে ভালোবাসতেন। তাঁর মানে তিনি যে দুর্বল ছিলেন এমন নয়। তাঁর আপাতশান্ত চেহারার মধ্যে ছিল এক অত্যন্ত সাহসী ও স্বাধীনচেতা একটি মন। আমাদের সৌভাগ্য, এই থিয়েটারের আঙিনায় আমরা বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাজ করতে দেখেছি। আমাদের তেমনই একটা গর্বের জায়গা কুমার রায়ের অভিনয়, তাঁর নির্দেশনার কাজ দেখতে পাওয়া, সম্মিলিত কাজে তাঁর নেতৃত্বে থিয়েটারের পরিবারের প্রতি একটা সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া। তিনি অন্য দলের প্রযোজনায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সংগীত কলা মন্দিরের প্রযোজনা ‘রক্তকরবী’র হিন্দি রূপান্তর ‘লালকনের’ নাটকের নির্দেশনা ও মঞ্চ পরিকল্পনাও তাঁর। নান্দীকারের ‘আন্তিগোনে’ নাটকের মঞ্চভাবনা, রঙরূপ প্রযোজিত সীমা মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরক্ষা’ নাটকের মঞ্চও তিনি করেছেন।
বহুরূপী ও অন্যান্য নাট্যদলের মঞ্চ ও পরিচ্ছদ পরিকল্পনার বর্ণানুক্রমিক তালিকা
১৯৮৪ আগুণের পাখি -বহুরূপী – মঞ্চ ভাবনা -কুমার রায়
১৯৭৫ আন্তিগোনে -নান্দীকার – মঞ্চ -কুমার রায়
১৯৭৬ গীত রত্ন – বহুরূপী – মঞ্চ- কুমার রায়
১৯৭৪ ঘরে বাইরে – বহুরূপী – মঞ্চ -কুমার রায়
১৯৭৭ ফুটবল – নান্দীকার – মঞ্চ-কুমার রায়
১৯৯১ মালঞ্চ – অন্য থিয়েটার – পরিচ্ছদ – কুমার রায়
১৯৭৬ যদি আর একবার – বহুরূপী- মঞ্চ – কুমার রায়
২০০৬যোগাযোগ-সাহিত্যিকা–উপদেষ্টা ও মঞ্চ- কুমার রায়
১৯৮২ রাজদর্শন – বহুরূপী – মঞ্চ -কুমার রায়
১৯৮২ রাজা পেন্থউস – নটধা – মঞ্ছ -কুমার রায়
১৯৯৫ শকুনির পাশা – অন্য ছন্দ – মঞ্চ – কুমার রায়
২০০৫ শেষ রক্ষা – রঙরূপ – মঞ্চ -কুমার রায়
১৯৭৫ সুতরাং – বহুরূপী- মঞ্চ-কুমার রায়
১৯৮৩ সোনার মাথাওয়ালা মানুষ –সায়ক– পরিচ্ছদ পরিকল্পনা – কুমার রায়
১৯৮০ – ভ্রান্তি বিলাস – বালিগঞ্জ শিক্ষাসদন,প্রতিশনি-রবিবার প্রধান উপদেষ্টা কুমার রায়, সাধারণ রঙ্গমঞ্চে কুমার রায়ের প্রথম ও শেষ কাজ।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগে অধ্যাপনা করার সময়ে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে রাজা, মুক্তধারা, রক্তকরবী রথের রশির মতো রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনা করিয়েছেন। ১৯৭১-এ তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগের অধ্যাপনায় যুক্ত হন।
প্রাক্তণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে শুনেছি এবং আমি নিজেও ওই বিভাগের ছাত্র হিসেবে তাঁর ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছি, চমৎকার পড়াতেন তিনি। কখনই বিরক্ত হতে দেখিনি। নির্ধারিত সময়ে ক্লাসে ঢুকতেন। আবৃত্তি, অভিনয়-উদাহরণ ও আবেগ-নাটকীয়তায় তাঁর পড়ানোয় প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। ছাত্রদের দিয়ে তিনি অনেকগুলি প্রযোজনাও করিয়েছেন। সেই সব অনুশীলন-ভিত্তিক প্রযোজনাগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের উপকৃত করেছে নাট্যের প্রায়োগিক শিক্ষার দিক থেকে। নাটক বিভাগে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের একটা বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিক্ষকতাকে শুধু চাকুরী হিসেবে গ্রহণ করেননি, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও ছিলেন সমান সচেতন। আশির দশকের প্রথম দিকে তিনি বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনে অতিথি অধ্যাপক হয়ে কিছুকাল কাটিয়েছেন। বিশ্বভারতীর বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রাজা নাটক প্রযোজনা করেছেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্যর প্রযোজনা হত বেশ উঁচু মানের। কিন্তু নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দুর্বলতা ছিল। তাঁর প্রযোজিত রাজা নাটকটি শান্তিনিকেতনের একটি সফল প্রযোজনা। পরবর্তীকালে তাঁর নির্দেশনায় শান্তিনিকেতনের সাহিত্যিকা সংস্থা রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ মঞ্চস্থ করে।
রবীন্দ্রভারতীর নাটক বিভাগে কুমার রায়ের অধ্যাপনা সম্পর্কে তাঁর অনুজ সহকর্মী মনোজ মিত্রর লেখায় –
‘… কুমারদার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেবার দিনটার কথা। সকাল থেকে শিক্ষক ছাত্রছাত্রী আমাদের সকলের মন খুব খারাপ। সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সেটা জুলাই মাস। মনটা খুব খারাপ আমার। আমি ভাবছি আজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব না। মন খারাপ থাকলে আমার ক্লাস করাতে ভালো লাগে না। তারপর ওরকম বর্ষা-বাদল। তারপর কী মনে হল ভাবলাম, যাই ক্লাসটা করাই। নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট পরে ক্লাসের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ গমগম আওয়াজ আসছে পাশের একটা ঘর থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কুমারদা ক্লাস করাচ্ছেন। আমার গালে কেউ একটা চড় মারলেও আমি এতটা চমকে যেতাম না। যার জন্য আমার মন খারাপ, যার জন্য আমি ক্লাসে যেতে চাইছিলাম না – তাঁর মন তো আরও খারাপ হওয়ার কথা। অথচ তিনি ক্লাস করাচ্ছেন। সেই প্রাচীন শিক্ষকদের মতোই কুমারদার নিয়মানুবর্তিতা, নিষ্টা, সমানুবর্তিতা, বিষয়ের প্রতি দরদ – এসব সকলের কাছে শিক্ষণীয়। কুমারদার এসব বিষয় অনেকেই জানেন না। কিন্তু কুমারদার মতো একজন শিক্ষক যে থিয়েটারের লোক, এটা থিয়েটার জগতের একটা গর্ব। থিয়েটার করেছেন তিনি পূর্ণ সময়।
যখন অধ্যাপনা করেছেন তখন তিনি পূর্ণ হৃদয়, পূর্ণ মস্তিষ্ক, পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে তা করেছেন। থিয়েটারের কাজ করতে গিয়ে কখনো কোনো সময় অধ্যাপনার কাজে এতটুকুও অবহেলা করেননি। শেষদিনেও পরপর ক্লাস করিয়ে গেছেন। আমার শিক্ষকদের কথা বাদ দিয়ে বলতে পারি কর্ম জীবনে আমার দেখা অধ্যাপকদের মধ্যে কুমারদাই অন্যতম আদর্শ একজন অধ্যাপক।৪ ১৯৭৯-তে দলের দায়িত্ব নিয়ে শুরু করলেন নতুন প্রজন্মকে নিয়ে নতুন অধ্যায়। ১৯৭৯ থেকে ২০০৬ পর্য্যন্ত প্রায় বাইশটি নাটক পরিচালনা করেছেন।
তাঁর নেতৃত্বে দেখা গেছে অপরিচিত অভিনেতাদের প্রধান ভূমিকায় নিয়ে আসা, দলে প্রধান অভিনেতাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া, নতুন নাট্যকারের নাটক মঞ্চস্থ করা। এর ফলে একটি নাটকে দু-একজন অভিনেতা অভিনেত্রী, নাট্যকার পরিচালক নিজ প্রতিভা পরিচিতি লাভ করেছে। তাঁরা সুনামের সঙ্গে আজও থিয়েটারের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করে চলেছে।৭
কুমার রায় প্রসঙ্গে এই সময়ের থিয়েটারের পরীক্ষায় নিরীক্ষায় মগ্ন সমুন মুখোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরছি –
‘…… কুমার রায় আমার শিক্ষক। কোনোদিন তাঁর পরিচালনায় নাটক করিনি। কিন্তু তাঁর কাজ থেকে আমার অনেক শেখা। প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে একজন নিয়মিত নাট্যচর্চা করেছেন – এ কী কম বিস্ময়ের কথা। কুমার রায়ের নাট্য ভাবনা উদারতা যে কত গভীরে প্রোথিত তার একটি দৃষ্টান্ত দিতে আমার নিজের কথা বলতে হয়। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নাটকটি দেখার পর তাঁর উচ্ছাস আমাকে বিস্মিত করেছে। শুধুমাত্র মুখেই বলেন নি।
ভালোলাগার কথা লিখেছেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধে। এ আমার কাছে এক অনন্য প্রাপ্তি। এও এক মহান শিক্ষা। একজন প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব যখন তাঁর সন্তানপ্রতিম এক পরিচালকের নাট্যকর্ম দেখে প্রায় সমসাময়িকের মর্য্যাদা দিয়ে আলোচনা করেন তখন শ্রদ্ধায় অবনত হয়’।৮
অসামান্য রূপসজ্জা, অনবদ্য মঞ্চসজ্জা ও মঞ্চভাবনায় দক্ষতা, প্রথিতযশা, প্রচ্ছদ শিল্পী, নাট্য পরিচালক, সংগঠক সর্বোপরি তিনি নাট্যশিক্ষক। কুমার রায় নাট্যশিল্পের সেই বিরন ব্যক্তিত্ব, আশি বছর অতিক্রম করেও সৃজনের মধ্যে থাকাকেই একমাত্র অন্বিষ্ট ছিলেন। প্রদর্শনশিল্পের প্রায় সবকটি শাখার বিষয়ে তাঁর আগ্রহ অভিজ্ঞতা অধ্যয়নের সীমা নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায়, তিনি গুরু পরম্পরার এক সার্থক নেপথ্য নাট্যশিল্পীর প্রতিভূ।
তথ্য সূত্র
১। ইলোরা, কুমার রায় সংখ্যা, সম্পাদক – মলয় ঘোষ, প্রকাশ ২০০৬, পৃষ্ঠা – ২৪।
২। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি চরিতমালা, কুমার রায়, সম্পাদনা –প্রভাত কুমার দাস, প্রকাশ – ২০০৬, পৃষ্ঠা – ২৪।
৩। নাট্যচিন্তা, হাবিব তনবীর সংখ্যা, ক্রোড়পত্র কুমার রায়, সম্পাদক – রথীন চক্রবর্তী, প্রকাশ – ২০১০, পৃষ্ঠা – ২০৪-২০৫।
৪। ইলোরা, কুমার রায় সংখ্যা, সম্পাদক – মলয় ঘোষ, প্রকাশ – ২০১০, পৃষ্ঠা – ৮২।
৫। ইলোরা, কুমার রায় সংখ্যা, সম্পাদক – মলয় ঘোষ, প্রকাশ – ২০১০, পৃষ্ঠা – ১২৭।
৬। তদেব পৃষ্ঠা-১২৭
৭। সাক্ষাৎকার –মনোজ মিত্র, অধ্যাপক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
৮। ইলোরা, কুমার রায় সংখ্যা, সম্পাদক – মলয় ঘোষ, প্রকাশ – ২০১০, পৃষ্ঠা ১৩০। সমুন মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার।