Natyasangeet Srijan: Nazrul’s Contribution to Bengali Drama
Dr. Srabani Sen
Abstract:
This paper delves into the profound influence and enduring legacy of Kazi Nazrul Islam, the renowned Bengali poet, musician, and revolutionary, in the realm of Bengali drama. Focusing specifically on Natyasangeet, the musical aspect of theatrical performance, the study explores Nazrul’s unique contributions to this art form. Nazrul, often hailed as the “Rebel Poet” of Bengal, not only revolutionized the literary landscape but also left an indelible mark on Bengali drama through his innovative use of music and lyrics.
The research employs a multidisciplinary approach, drawing on literary analysis, historical context, and musical theory to unravel the nuances of Nazrul’s creative genius. By examining key works, such as his plays, musical compositions, and writings on drama, the paper elucidates how Nazrul seamlessly integrated traditional elements of Natyasangeet with his distinctive poetic expressions.
Furthermore, the study investigates the socio-cultural impact of Nazrul’s contributions, exploring how his progressive ideas and fervent advocacy for social justice resonated within the theatrical realm. The analysis also sheds light on the reception of Nazrul’s Natyasangeet during his time and its continued relevance in contemporary Bengali drama. Kazi Nazrul Islam, a prominent figure in Bengali literature and culture, made significant contributions to Bengali drama through his poignant and dramatic songs. His lyrical compositions not only added depth and emotion to theatrical performances but also became an integral part of the cultural landscape. Nazrul’s ability to blend powerful poetry with melodious tunes created a unique genre that resonated with the masses. His dramatic songs, often addressing social issues and human emotions, played a crucial role in shaping the narrative and atmosphere of Bengali dramas, leaving an enduring impact on the theatrical and musical heritage of the region.
নাট্যসঙ্গীত সৃজন : বাংলানাট্যে নজরুলের অবদান
ড.শ্রাবণী সেন
আ্যসোসিয়েট প্রফেসর, সঙ্গীত বিভাগ, তারকেশ্বর ডিগ্রি কলেজ, তারকেশ্বর,হুগলী
e-mail-srabanisn1@gmail.com Mobile no- 6290242709
বাংলা নাটক তথা রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে নজরুলের গভীর এবং নিবিড় সম্পর্ক। নাট্যের এই বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে বিচার করলে আমরা দেখবো – সৃজনশীলতার প্রাচুর্যে নজরুল এই ক্ষেত্রেও সে যুগের একজন প্রতিভাবান নাট্যব্যক্তিত্বরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলা নাট্যসাহিত্যে নজরুলের দান অকিঞ্চিতকর। নজরুল ইসলাম যে সব নাটক রচনা করেছেন তাতে ফুটে উঠেছে জীবনের ব্যাখ্যা। বাঙালির হাজার বছরের গীত-সুধারসের যে ধারা নজরুলের মানস ভুবনকে প্লাবিত করেছে, তারই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নাটকে। কবি সঙ্গীত রচয়িতা বলেই তাঁর নাটকে সংলাপে কাব্যের আবহ তৈরী হয়েছে এবং একই সঙ্গে নাটকে সঙ্গীতের আধিক্যও ঘটেছে। নজরুল শুধু নাটক রচনাই করেন নি, তিনি একাধিকবার কলকাতার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ও করেছেন। নজরুল বাংলা নাট্য রচনার ধারায় হাজার বছরের বাংলা নাট্যের সংগীতময়তাকে আধুনিক কালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়েছেন। কারণ নজরুলের নাটকের ভাষা গীত ও কাব্যের যুগলবন্দি রূপ।
ঊনবিংশ শতাব্দী রেনেসাঁসে পরিশীলিত এবং ভিক্টোরীয় মূল্যবোধে জারিত নগর কলকাতায় নজরুলের আবির্ভাব ধূমকেতুর মত। নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র ব্রাত্য এবং অবহেলিত গ্রামীণ জনসমাজেরই প্রতিনিধি ছিলেন না, তিনি ছিলেন লোকায়ত সংস্কৃতির প্রতিভূও। বাংলা নাট্যের ক্ষেত্রে নজরুলের ভূমিকা প্রধানত দ্বিবিধ। প্রথমটি অবশ্যই নাট্যসঙ্গীত সৃষ্টি এবং দ্বিতীয়টি কিছু নাটক রচনা। কিশোর বয়সে তথা বয়ঃসন্ধিকালে রাঢ়বাংলার জনপ্রিয় লোকনাট্য “লেটো”র দলে তিনি যোগ দেন। এই ছিল নাট্যকার নজরুলের পথ চলা শুরু। পরবর্তীকালে নজরুল যে প্রধানত গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন, তা পূর্বসূ্ত্রটি এখানেই নিহিত ছিল।
লেটো কবিতা বা ছড়া, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক। ফলে কবি নজরুল এবং গীতিকার-সুরকার নজরুলের শিক্ষানবিশী ঘটেছে লেটোর দলেই। যেহেতু লেটো আসলে লোকনাট্য, তাই নজরুলের নাট্যবোধের উণ্মেষও এই লোকায়ত নাট্যমাধ্যমেই ঘটেছে বলা যায়। নজরুল শুধু লেটোর দলের গান লিখিয়েই ছিলেন না, তিনি ছিলেন পালালেখকও। লেটোর দলে পালা রচনার মধ্যে দিয়ে নজরুলের নাট্যপ্রতিভার উণ্মেষ বলেই সুর ও কাব্য তাঁর পরিণত জীবনে লেখা নাট্য থেকে কখনও বাদ পড়েনি। লেটো গানের পালার মধ্যে সঙ্গীতের যে রূপায়ণ ঘটেছিল, তাঁর পরিণত ও আধুনিক প্রকাশ হল ‘আলেয়া’ (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ),’ ‘ঝিলিমিলি’ (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ), ‘শিল্পী’, ‘সেতুবন্ধ’ (১৯৪০ খ্রীস্টাব্দ), ‘মধুমালা’ (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) প্রভৃতি নাটক। এছাড়াও লিখেছেন ‘রাজপুত্র’, ‘আকবর বাদশা’, ‘চাষার সঙ’, ‘মেঘনাদ বধ’ প্রভৃতি নাট্যপালা। এর মধ্যে –‘রাজপুত্র’ এবং ‘চাষার সঙ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নাট্যকার হিসেবে নজরুলের কালাসিদ্ধি ঘটেছে মূলত গীতিনাট্য জাতীয় রচনায়। গীতিময়তা প্রায় সব ধরণের লোকনাট্যের স্বভাবধর্ম। লেটোর পালার অমার্জিত ও অশালীন বক্তব্য নাগরিক রুচি গ্রহণ করে না। নজরুলের গীতিনাট্যগুলো কোন বিকৃত রুচিকে প্রশ্রয় দেয় নি। ততদিনে শহর কলকাতা তাকে গড়ে-পিটে নিয়েছে। এই গড়া-পেটা শুরু হয় সেনাবাহিনী থেকে ফিরে কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতির মহলে প্রেবশের সময় থেকেই। নজরুলের মানসভুবনেও একধরণের নগরায়ণ চলতে থাকে। তাই গ্রামীণ লোকনাট্যের পালা লেখক ধীরে ধীরে হয় ওঠেন নাগরিক রুচির অনুকূল গীতিনাট্য রচয়িতা। ‘আকবর বাদশার সঙ’ পালা নাটিকাটিতে ‘আয় পাষণ্ড যুদ্ধ দে তুই দেখব আজ তোরে’ – গানটি নাটিকার গান। এই নাটিকায় এছাড়াও আরও তিনটি গান পাওয়া যায় নজরুলের ভণিতায় – ১) দেখে মেলে নয়ন কর্মের অনুরূপ ফল তরু এখনও ২) ধিক ধিক ধিক শত ধিক তোর নির্লজ্জতার প্রাণে।
নাটক হচ্ছে গতিশীল ও পরিবর্তনমান জীবনের বাস্তবপ্রতিম ও অভিনয়োপযোগী প্রতিরূপ। বাঙালির শিল্পমানসে সঙ্গীতের যে অনিবার্যতা, তা থেকে নজরুল বিযুক্ত ছিলেন না বলেই সঙ্গীতকে নাটকের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করে কবি তাঁর নাট্যভাবনার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। করাচির সৈনিক জীবন শেষ করে ১৯২০ সালে কলকাতায় ফিরে এসে শুরু করেন তাঁর সাহিত্য জীবন। প্রথমদিকে উপন্যাস, কবিতা এবং গান রচনাতেই তাঁর অভিনিবেশ ছিল বেশি। নাটক বা নাটকের জন্য গান রচনা তিনি আরম্ভ করেন বেশ কিছু কাল পরে। বহরমপুর জেলে মাদারিপুরের পূর্ণচন্দ্র দাসের শান্তি-সেনা চারণ দলের অভিনয়ের জন্য। জেলে বন্দী পুর্ণচন্দ্র দাস এবং নরেন্দ্রনারায়ণের পরামর্শে নজরুল চারণদলের অভিনয়ের জন্য নাটক লেখেন।
বাংলানাট্যে নাট্যসঙ্গীত রচনা নজরুলের প্রথম অবদান। তাঁর নাট্য রচনার পরিণতি ও সমৃদ্ধি ঘটেছে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে কবির সরাসরি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে, বেতারে এবং রেকর্ডে এই নাট্যসঙ্গীতের ছিল প্রসারণ। বিশের দশকের শেষার্দ্ধ থেকেই নজরুলের পেশাদার রঙ্গমঞ্চ, চলচ্চিত্র, বেতার এবং রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রচার মাধ্যম গুলোর সংস্পর্শে আসার আগেই নজরুলের খ্যাতি তুঙ্গে, শুধু কবি বা সাহিত্যিক খ্যাতি নয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের, এমন কি সাম্যবাদী আন্দোলনেরও অন্যতম প্রধানকর্মী হিসেবে তিনি তখনই দেশের মুক্তিপিয়াসী যৌবনের নয়নমণি হয়ে ওঠেন। গীতিকার নজরুল তখন দেশাত্মবোধক গানে গানে গণ-আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন, দেশের মুক্তিসংগ্রামের তিনি দৃপ্ত চারণ। শুধু দেশাত্মবোধক গান নয়, নানা ধরণের গান তিনি লিখেছেন। ফলে নজরুলগীতির ভাণ্ডার হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় ও সর্বার্থেই বহুমাত্রিক।
কাজী নজরুল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ নাটক হিসেবে আলেয়া, ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ, শিল্পী ও মধুমালার নাম উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে কয়েকটি নাটককে প্রতীকী, রূপক অথবা সাংকেতিক ধারায় চিহ্ণিত করেছেন। ১৯২৯ সালের ২রা জুন মনোমোহন থিয়েটারে শচীন সেনগুপ্তের ‘রক্তকমল’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়। এই নাটকের সমস্ত গানগুলো রচনা করেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন নজরুল। নজরুল ন’খানি গান রচনা করেছিলেন। ‘রক্তকমল’ নাটকের কয়েকটি গান –
১। আসে বসন্ত ফুলবনে (কমল চরিত্রের গান)
২। ফাগুন রাতের ফুলের নেশায় (পূরবী চরিত্রের গান)
৩। নিশীথ স্বপন তোর ভুলে যা (কমল চরিত্রের গান)
৪। মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর (মমতা চরিত্রের গান)
৫। কেমনে রাখি আঁখি বারি চাপিয়া (মমতা চরিত্রের গান)…… প্রভৃতি।…. (১)
‘রক্তকমল’ নাটকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ইন্দুবালার কণ্ঠে নজরুলের গান। নজরুলের গানগুলো শুধুই পরিবেশ সৃষ্টিকারী নয়, নাটকের কাহিনীর সঙ্গে তা ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। যদিও নজরুল-শচীন্দ্রনাথ যুগলবন্দী সার্থকতার তুঙ্গশীর্ষ স্পর্শ করে “সিরাজদৌলা” নাটক।
রক্তকমলের পর মন্মথ রায়ের ‘মহুয়া’ নাটকের জন্য গান রচনা করে এবং সুর সংযোজনা করে নজরুল খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। ‘মহুয়া’ নাটক অভিনীত হয়েছিল মনোমোহন থিয়েটারে। ‘মহুয়া’ নাটকের ভূমিকায় লেখক মন্মথ রায় লিখেছেন- আমার লেখনীর অক্ষমতাকে এমনি করিয়াই সার্থক সুন্দর করিয়াছেন আমার গীত-সুন্দর কবি নজরুল ইসলাম। ‘মহুয়া’র গানগুলো –
১। কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো (বেদে ও বেদেনী দলের গান)
২। ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান (মহুয়ার গান)
৩।খোলো খোলো গো দুয়ার (পালঙ্কের গান)
৪। আমার গহীন জলের নদী (রাধু পাগলির গান)
৫। মহুল গাছে ফুটেছে ফুল (বেদে ও বেদেনী দলের গান)
৬। কোথা চাঁদ আমার (মহুয়ার গান)………..(২)
১৯৩২ সালে কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত মন্মথ রায়ের অপেরাধর্মী নাটক “মহুয়া’’র সব গানই নজরুলের লেখা ও সুর করা। ‘মহুয়া’ নাটকের গানগুলো সুরের দিক থেকে ছিল অভিনব। কোন কোন গানের সুর ছিল একাধিক রাগের দক্ষ মিশ্রণে। ‘ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান’ গানটি বেহাগ ও বসন্ত রাগের মিশ্রণে গঠিত। ‘এক ডালি ফুলে তরে’ গানটি তিলোককামোদ রাগ ও দেশ রাগের মিশ্রণে গঠিত। নজরুল এই নাটকে প্রথম নানা ধরণের লোকগীতির সুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ঝুমুর আঙ্গিকে সুর করেন ‘কে দিল খোঁপাতে’ ও ‘মহুল গাছে ফুল ফুটেছে’ গান দুটি এবং পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি, সাম্পান সুরে রচনা করেন – ‘আমার গহীন জলের নদী’, ‘তোমায় কূলে তুলে বন্ধু’ এবং ‘ও ভাই, আমার এ নাও যাত্রী না লয়’ ইত্যাদি গানগুলো।
মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘জাহাঙ্গীর’ নাটক মনোমোহন থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয় ১৯২৯ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। এ নাটকে নজরুলের একটি গান-‘রংমহলের রংমশাল মোরা’।৩ গজল শ্রেণীর এই গানটিতে সুরের মুন্সিয়ানা রয়েছে ভৈরবী, আশাবরী ও ভূপালী – এই তিনটি রাগের মিশ্রণের মধ্যে কোমল গান্ধারের উপর ষড়জ পরিবর্তন করে তিনি ভূপালীর মিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
যে নাটকটি সে সময়ে সর্বাপেক্ষা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল সেটি হল মন্মথ রায়ের লেখা ‘কারাগার’ নাটক।‘কারাগার’ নাটকে নজরুলের গানগুলো –
১। জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী
২। তিমির বিদারী অলখ বিহারী
৩। কারা পাষাণে ভেদি জাগো নারায়ণ
৪। মন্দিরে মন্দিরে জাগো দেবতা …… প্রভৃতি।……৪
‘কারাগার’ নাটকে নজরুলের গানের সংখ্যা ছিল আটটি। ‘কারাগার’ নাটকে নজরুলের রচিত গান ও তাঁর সুর সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল।
যতীন্দ্রমোহন সিংহ রচিত ‘ধ্রুবতারা’ উপন্যাস অবলম্বনে নাটক ‘ধ্রুবতারা’। এই নাটকে নজরুলের সুরারোপিত গান –
১। বাজাও বুকে তোমার বীণ
২। গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই
৩। মাধবী মোর স্বপন ভোর সুরভি
৪। প্রাণ বাগিচর ভোমরা আমি……৫
১৯৩০ সালে মন্মথ রায় রচিত স্টার থিয়েটারে অভিনীত রূপক নাটক “কারাগার’’কে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাজদ্রোহিতামূলক নাটক হিসেবে। এই“কারাগার’’এ আটটি গানের রচনা ও সুর নজরুলের। বলা যায় সে সময়ে মন্মথ রায়ের নাট্যরচনা যতখানি ক্ষিপ্ত করেছিল ব্রিটিশ রাজশক্তিকে, ঠিক ততখানিই ক্রুদ্ধ করেছিল নজরুলের আগুনঝরা গান। মন্মথ রায়ের তিনটি নাটক নজরুলের গীতিপ্রতিভার স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ১৬ই জ্যৈষ্ঠ নাট্যনিকেতনে প্রথম মঞ্চস্হ হয় মন্মথ রায়ের লেখা নাটক “সাবিত্রী’’। এই নাটকের সমস্ত গানের গীতিকার ও সুরকার নজরুল। নাট্যনিকেতনে অভিনীত তাঁর “সাবিত্রী’’ নাটকের তেরোটি গানের রচনা ও সুর নজরুলের। নাটকে সাবিত্রীর পরম সম্পদ তার গান। গানগুলোর কথা এবং সুরই গীত-সুন্দর সুর-যাদুকর বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সস্নেহ দান। গানগুলো –
১। প্রণমি তোমায় বন দেবতা
২। মৃদুল মন্দে মঞ্জুল ছন্দে
৩। ফুলে ফুলে বন ফুলেলা
৪। কুসুম সুকুমার শ্যামল তনু
৫। ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন …..ইত্যাদি। ……৬
বস্তুত বেতার, রেকর্ড কোম্পানি এবং পেশাদার রঙ্গমঞ্চের চাহিদাতেই নজরুলকে নাটক লিখতে হয়েছিল। নজরুল একাধিক রূপক-সাংকেতিক নাটক রচনা করেছেন। “ঝিলিমিলি’’, ‘সেতুবন্ধ’,‘শিল্প’ ও ‘ভূতে ভয়’- এই চারটি একাঙ্ক নাটিকার সমষ্টি।
বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে লেখা নজরুলের আর একটি নাটক “ঝিলিমিলি’’। বাস্তব জীবনের প্রেম ও বিরহকে কেন্দ্র করে এ নাটকটি লেখা। ১৯৩০ সালে রচিত প্রথম একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। এর কিছুদিন পর পেশাদার রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয় নজরুলের নাটক। ঝিলিমিলি মানব সংসারের সঙ্গে স্বপলোক ও বেহেশতের যোগাযোগের পথের পথিক বা সংকেত হিসেবে উল্লিত হয়েছে।
“আলেয়া’’ নাটক নজরুলের গুরুত্বপর্ণ একটি সাংকেতিক নাটক। আলেয়া নাটক প্রেমের আখ্যানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। “আলেয়া’’ ১৯৩১ সালে নাট্যনিকেতন রঙ্গমঞ্চে প্রযোজিত হয় নজরুলের জনপ্রিয় গীতিনাট্য “আলেয়া’’ – গ্রন্হের ভূমিকায় কবি বলেছেন – এই ধূলির ধরায় প্রেম –ভালোবাসা- আলেয়ার আলো। । মূলনাটকে গানের সংখ্যা আঠাশ। নরনারীর প্রেমের যে রহস্যময় লীলা পৃথিবীকে বিচিত্র সুন্দর করে তোলে তারই সাংকেতিক প্রকাশ ঘটেছে এই নাটিকাটিতে। এই গীতিনাট্যে গানের সংখ্যা অনেক বেশি। গানগুলোর ভাষা আর সুর দুইই অনিন্দনীয়। গানগুলোর সুরবৈচিত্র্য রয়েছে – কখনও মার্চ সং, কখনও গজল, কখনও রাগপ্রধান, কখনও নৃত্যসম্বলিত চটুল সুর – সব ধরণের সুরই ছিল। ‘আধো ধরণী আলো’ গানটিতে তিলোককামোদ ও পিলুরাগের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। বাঙলা সঙ্গীতে নজরুল সম্পূর্ণ একটি নতুন ঢঙ প্রবর্তন করেছিলেন। সাহিত্যের চেয়ে সঙ্গীতে তাঁর দান বেশি ছাড়া কম নয়।
আলেয়া নাটকে দশটি গানের তালিকা পাওয়া যায় –
১।জাগো যুবতী আসে যুবরাজ
২। আধো রমণী-আলো আধো আঁধার
৩। কে এলে গো চিরচেনা অতিথি দ্বারে মম
৪। ঝরা ফুল দলে কে অতিথি
৫। নামিল বাদল
৬। ফুল কশোরী জাগো জাগো….ইত্যাদি।……৭
১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যার ‘কল্লোল’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে – ‘নজরুল ইসলাম একখানি অপেরা লিখেছেন। প্রথমে তার নাম দিয়েছিলেন ‘মরুতৃষা’। তার নাম বদলে ‘আলেয়া’ নামকরণ হয়েছে। এই গীতিনাট্যে গান আছে তিরিশটি। ১৯৩৮ –এর আগেই নজরুলের রেকর্ড নাটক (যাত্রাপালা) “বিদ্যাপতি’’ অভিনয় হয়। ১৯৩৮ সালেই কলকাতা বেতার থেকে প্রথম সম্প্রসারিত হয় নজরুলের প্রথম বেতার নাটক “পুতুলের বিয়ে’’।
“আলেয়া’’র পর সাধারণ রঙ্গমঞ্চে নজরুলের নাটক আবার মঞ্চস্হ হয় ১৯৩৯ সালে। এটিও গীতিনাট্য। নাম- “মধুমালা’’। লোককাহিনীভিত্তিক অপেরা। গানের সংখ্যা সাঁইতিরিশ।এটি ১৯৩৯ সালে নাট্যভারতী রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়। পেশাদার নাট্যমঞ্চেও যে নজরুলের নাটকের (গীতিনট্যের) চাহিদা তৈরী হয়েছিল, এই ঘটনাই তার প্রমাণ। এই গীতিপ্রধান নাটকে গানগুলোর মধ্য দিয়ে নাটকীয় সংঘাতের পরিচয় ব্যক্ত হয়ে। নাটকীয় ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত কতগুলো গান – যেমন-‘যৌবন তটিনী ছুটে চলে ছলছল’’, ‘বেসুর বীণায়’, ‘ব্যাথার সুরে বাঁধব গো’, ‘জাগো নারী জাগো বহ্ণি শিখা, ‘গহীন রাতে- ঘুম কে এলে ভাঙাতে’ ইত্যাদি।
‘মধুমালা’ তিন অঙ্কবিশিষ্ট গীতিনাট্য। এই গীতিনাট্যটি ১৯৪৫ সালে ‘নাট্যভারতীর’ উদ্যোগে অভিনীত হয়। এই নাটকে রূপক নাট্যের একটা আভাস পাওয়া যায়।এই গীতিনাট্যের কয়েকটি গান উপভোগ্য। এই প্রসঙ্গে জারিগান ‘এই কাঞ্চননগরের বাদশা দণ্ডধর’, মণিপুরী গান ‘আমরা বনের পাখি বনের দেশে থাকি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
১৩৩৮ বঙ্গাব্দে ২৮শে কার্তিক নাট্যনিকেতনে মঞ্চস্থ হয় শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘ঝড়ের রাতে’ নাটক। ১৯৪০ সালে ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত শচীন সেনগুপ্তের ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকের সব গান লেখেন ও সুর করেন নজরুল ইসলাম। এই নাটকের অন্তর্ভুক্ত গানগুলো হল-
১। আমরা সবাই এগিয়ে চলি –সমবেত কণ্ঠের গান।
২। গানের গোলাপ ঝরল তোর –বিজলীর গান।
৩। তোমার সাথে দেখা আমার – ঊষার গান।
১৯৩৬ সালে৩০শে মে রঙমহল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় সুধীন্দ্রনাথ রাহার “সর্বহারা’’ নাটক। সর্বহারা নাটকের সাতটি গানও নজরুলের লেখা ও সুর করা। গানগুলো-
১। ওগো চৈতী রাতের চাঁদ যেও না
২। নবীন বসন্ত যে যায়
৩। পাপিয়া আজ কেন ডাকে সখি
৪। মলয় হাওয়া আসবে কবে ফুল ফোটাতে…. প্রভৃতি।…….৮
বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রযোজনায় “সিরাজদৌলা”সম্প্রসারিত হলে সামগ্রিক সুর সংযোজনার দায়িত্ব ছিল নজরুলের। ১৯৩৭ সালে নাট্যনিকেতনে অভিনীত মন্মথ রায়ের “সতী’’ নাটকের জন্য দশটি গান লেখেন ও সুর করেন নজরুল। কলকাতা রেডিওর দৌলতে বীরেন্দকৃষ্ণ ভদ্র ও নজরলের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা হয়। ১১৯৪০ সালে অভিনীত শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের “হরপার্বতী’’র এগারোটি গান নজরুলই লেখেন এবং সুর করেন। যোগেশ চৌধুরীর জনপ্রিয় নাটক “নন্দরানীর সংসারে’’র সব গান লেখেন এবং সুর করেন নজরুল।
১৯৪০ সালে নাটক “অন্নপূর্ণা”র চৌদ্দটি গান নজরুলের লেখা ও সুর করা। যতীন্দ্রমোহন সিংহের “ধ্রুবতারা’’ উপন্যাসের নাট্যরূপের জন্য নজরুল চারটি গান লেখেন এবং সুর করেন। ১৯৪০ এ “বন্দিনী’’ নাটকের অধিকাংশ গান নজরলের সৃষ্টি। ১৯৪১ সালে অভিনীত “ব্ল্যাক আউট’’ নাটকের দুটি গান লিখে দেন এবং সুর দেন স্বয়ং পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অন্যের নাটকের জন্য নজরুলের গান লেখা ও সুর করার তালিকা প্রমাণ করে সে যুগের থিয়েটারে গীতিকার এবং সুরকাররূপে নজরুলের বিপুল জনপ্রিয়তাকে। বেতারে জগৎ ঘটকের গীতিআলেখ্য “জীবনস্রোতে’’র সব গানই নজরুলের সৃষ্টি। “ঝুলন’’ (১৯৩৯) এর সব গানই নজরুলগীতি। ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেতারে “উদাসী ভৈরব’’ গীতিনাট্যটি প্রচারিত হয়। এই গীতিনাট্যটির পরিকল্পনাই শুধু নজরুলের নয়, এর সব কটি গানই নজরুল-সৃষ্ট রাগে গীত হয়।তবে গীতিনাট্য ছাড়াও অন্যজাতীয় নাটকও নজরুল লিখেছিলেন।
কলকাতা বেতারও নজরুলের নাট্যরচনার ক্ষেত্রে অপরিসীম উৎসাহ প্রদান করেছে। ১৯৪০ সালে তাঁর “সুগোপন’’ নাটকটি প্রযোজিত হয় বেতারের “মহিলা মজলিস’’ অনুষ্ঠানে। ১৯৪০ এ কলকাতা বেতারে সম্প্রচারিত নজরুলের “নবরাগমালিকা’’ বেতার জগতে প্রকাশিত হয়েছিল গীতিনাট্যরূপে। নজরুলের বেতারনাটিকা “জাগো সুন্দর চিরকিশোর’’–কিশোর নাটক। কোরাসগান দিয়ে এর সূচনা। শিশু ও কিশোরের স্বপ্ন-কল্পনা অপরূপ প্রকাশ ঘটেছে এই নাটকে কবিতা, গান ও সংলাপের মাধ্যমে।
গীতিনাট্যই ছিল নাট্যকার নজরুলের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র। নজরুল রচিত নাটিকা “বিদ্যাপতি’’ সেযুগে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। বিদ্যাপতি – পালানাটক অর্থাৎ যাত্রাপালা। বস্তুত “পালানাটক’’ বলা হলেও “বিদ্যাপতি’’ আসলে গীতিনাট্যই। ছোটবড় মিলিয়ে গানের সংখ্যা একুশ। সংলাপ কম হলেও তা নাট্যগুণান্বিত। নজরুলের কৃতিত্ব এখানেই এত গান সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত নাটকীয় উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
পরিসমাপ্তিতে বলা যায় নজরুলের নাটককে বিচার করতে হবে নৃত্য-গীত ও কাব্যময় বাংলা নাট্যের পটভূমিতে। ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় নাট্যধারার অনুকৃতির বদলে বাংলা নাটকের সুরধর্মিতা অঙ্গীকরণের ফলে নজরুলের নাটককের সচেতন গীতিবহুলতা তার সংগীতকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে।
তথ্যসূ্ত্র
১। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:-৬।
২। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:-১৩।
৩। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:-১৬।
৪। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:-১৮।
৫। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:-২০।
৬। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:-২১।
৭। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:- ২৪-২৫।
৮। বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান –পৃ:- ৩০-৩১।
গ্রন্হসূত্র
১। ড. সুশীল কুমার গুপ্ত – নজরুল চরিতমানস।
২। সুকুমার সেন- বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড)।
৩। সজনীকান্ত দাস – আত্মস্মৃতি।
৪। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় – কাজী নজরুল।
৫। মুজফ্ফর আহ্মদ – কাজী নজরুল প্রসঙ্গে।
৬।ব্রহ্মমোহন ঠাকুর – বাংলা নাটকে নজরুল ও তাঁর গান।