September 23, 2019

ঝুমুর গানের রূপ ও রূপান্তর

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture
পুরুলিয়ার ঝুমুর নাচ ও গান

ড: সোমা দাস মণ্ডল, অধ্যাপিকা, অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি

আদিবাসী সংস্কৃতির প্রবাহিত ধারায় লালিত ও বিকশিত হয়েছে বাংলা ঝুমুর গান। বাংলা ছাড়াও আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও আরো বিভিন্ন রাজ্যে ঝুমুর নামের গান ও নৃত্য ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে বহুকাল। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে রাঢ় বাংলায় প্রচলিত লোকসংগীতের ধারাগুলির মধ্যে ঝুমুর গান অন্যতম | বহু প্রাচীন কাল থেকেই ঝুমুর গানের অস্তিত্ব রয়েছে | তবে বিভিন্ন সময়ে এই সংগীতের রূপ রেখার নানা পরিবর্তন ঘটেছে | নাগরিক সভ্যতার প্রভাবে গ্রামীন কৃষ্টির যেরূপ বিবর্তন ঘটছে, তাতে করে উল্লেখিত ঝুমুর গান বৈচিত্রপুর্ন হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক |

এই প্রবন্ধে ঝুমুর গানের বৈচিত্র্যের দিকটাই তুলে ধরা হয়েছে | ঝুমুর গানের বিভিন্ন প্রকার গুলি ও তাদের বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সমন্ধেও এই প্রবন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও ঝুমুর গানের উংস এবং স্বতন্ত্রতা সমন্ধেও কিছু আলোচনা এই প্রবন্ধে করা হল |

আদিবাসী সংস্কৃতি হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশেরই আদি সংস্কৃতি বা কৃষ্টির উৎস | লোকসংগীতের আদি অবস্থা আদিবাসীদের নাচ গান বাজনার মধ্যেই সীমিত ছিল | লোকসংগীত হল লোকসমাজ কর্তৃক মুখে মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্ট | লোকসংগীত মাটির গান অর্থাৎ গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা, গ্রামীণ সংস্কার ও আচার ব্যবহার, চিরাচরিত ধর্মীয় বিধি নিষেধ ও অনুষ্ঠান, বৃত্তি, রীতি, ভাষা-ভঙ্গী, জীবিকা নির্বাহ প্রভৃতি ঘটনাবলী জড়িয়ে রয়েছে| এছাড়াও লোক-জীবনের দুঃখ-দুর্দশা ইত্যাদি লোকসংগীতের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে | শুধু তাই নয়, গানের ভাব ও ভঙ্গী, আবেগ প্রভৃতি সবই আঞ্চলিক-ভাবে সীমাবদ্ধ | গানের বিষয়বস্তু ও অঞ্চলের নামানুসারে লোকসংগীতের নামকরণ হয়ে থাকে | এইভাবে লোকসংগীত বিভিন্ন শাখায় প্রসারিত হয়েছে |

রাঢ় একটা প্রাচীন জনপদ | এই জনপদের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয় পুরাতত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকধারার ঐতিহ্য পর্যালোচনা দ্বারা | অতীতে বঙ্গ, বরেন্দ্র, বঙ্গাল জনপদের ভৌগোলিক অস্তিত্ব থাকলেও সামগ্রিক ভাবে রাঢ় সংস্কৃতি বঙ্গসংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে গেছে| প্রাচীন ঐতিহাসিক পর্বে রাঢ় ও বঙ্গ পৃথক জনপদ রূপে আখ্যা লাভ করলেও মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, চতুর্দশ শতক হতে গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সমতট, বঙ্গ, বঙ্গাল, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি পৃথক পৃথক অঞ্চল সমূহের একত্রীকরণের ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বঙ্গ দেশের সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু প্রচলিত বাংলা উপভাষা ও সমাজ বিন্যাসের ক্ষেত্রে আজও বঙ্গ, রাঢ় ও বরেন্দ্রভুমিক পৃথক অস্তিত্ব বজায় আছে | পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের অধিকাংশ ভূ-ভাগ প্রাচীন রাঢ়ভূমির অন্তর্গত ছিল | ‘রাঢ়’ শব্দটি মূলত অস্ট্রো-এশিয়াটিক কোল ভাষাভাষী গোষ্ঠীর দেশনাম | (য চৌধুরী ২008, 3.) মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল হতে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এক বিস্তৃত ভূখণ্ডে বসবাসকারী মুন্ডা, সাঁওতাল, হো, ওরাঁও, লোহার, মালপাহারিয়া, কেওট, ভূমিজ প্রভৃতি উপজাতি গন কোল গোষ্ঠীর বংশধর | ভূভাগে পাথরের অংশ অধিক হওয়ার জন্য কোল ভাষাভাষী গোষ্ঠীর নিকট বসবাসের স্থানটি রৌড়দিশম নাম পরিচিত ছিল | কোল ভাষায় রৌড় শব্দের অর্থ পাথর বা পাথরের নুড়ি | “রৌড়দিশম” বলতে বোঝায় রাঢ় দেশ বা পাথুরে রুঢ়-রুক্ষ মাটির দেশ | (য চৌধুরী ২008, ২.) অনেকে অনুমান করেন যে, রৌড় শব্দ হতে ঝাড়খন্ডী উপভাষায় রড়া বা লড়া শব্দের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে আরও পরে লাড় বা রাঢ় শব্দটি এসেছে |

বোলপুরের খোয়াইতে লোকসংস্কৃতির মেলায় ঝুমুর নাচ ও গান

পরিবর্তিত প্রকৃত রূপ হল রাল বা লাল | প্রকৃত ভাষায় রাল বা লাল শব্দের সংস্কৃত রূপ হল ‘রাঢ়’ | ‘রাঢ়’ শব্দ সংস্কৃত-মূলক নয় | এটি খাঁটি দেশী শব্দ | সাঁওতালী ভাষায় রাঢো শব্দ আছে, তার অর্থ নদী গর্ভস্থ শৈলমালা বা পাথুরে জমি | সাঁওতালি বা দেশী শব্দ হতে সম্ভবত রাঢ় শব্দের উৎপত্তি হয়েছে | (বিশ্বকোষ তারিখ নেই) এখন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নিম্নবর্গের মানুষের কথ্য ভাষার ‘র’ স্থলে ‘ল’, ‘ল’ স্থলে ‘র’, ‘র’ স্থলে ‘অ’, ‘ন’ স্থলে ‘ল’ উচ্চারণ বিধি প্রচলিত আছে | পাথরের ন্যায় শক্ত বা কর্কশ ভূভাগে বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, বাকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলী, সিংভূম, মানভূম, হাজারীবাগ, ধানবাদ, সাঁওতাল পরগণা সহ ভাগলপুর, রাঁচি ও পালামৌ জেলার কিয়দংশ নিয়ে বৃহৎ রাঢ় জনপদ গড়ে উঠেছিল | (য চৌধুরী ২008, 3.) রাঢ় অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমার যে বর্ণনাটি দেওয়া হল, তা সামগ্রিকভাবে রাঢ় অঞ্চলের জনপদকে বোঝায় | এই অঞ্চলগুলির মধ্যে ঝুমুরের প্রচলন বৃহৎ আকারে বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, বাকুড়া, পুরুলিয়া থেকে শুরু করে ওড়িষা হয়ে মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেখা যায় |

কৃষি নির্ভর বাংলার গ্রামীণ জীবনে পালা-পার্বণ, ব্রত, উৎসবের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ | তাকে ঘিরেই সংস্কৃতির সূচনা ও বিস্তার ঘটেছে | ঝুমুর গানের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় না | ঝুমুর গানের বিষয়সূচি করম, জাওয়া, ঝিঙ্গাফুল্যা, ভাদুরিয়া প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত | এই ধারার কিছু গান দাঁইড় নাচ, বুলবুলি নাচ ও মাদলিয়া নাচের মধ্য দিয়ে পরিণতি পেয়েছে | অরণ্য বেষ্টিত এই অঞ্চলের সংগীত সংস্কৃতিতে দেবদেবীর প্রভাব ও লক্ষণীয় | ধরম, করম, বড়পাহাড়ী, সাতবহিনী, টুসু, ভাদু, রঙ্কিনি, দুয়ারসিনি ও বাশলির মাহাত্ম্য প্রভৃতি আচার পরবের অন্ত নাই | এছাড়া টুয়া গান, জাগ্ গান, বাঁধনা কিম্বা অহীরা পরবের গানের মধ্য দিয়েও বৈচিত্র্যের সমারোহ ঘটেছে | এই গান প্রধানত নারী কন্ঠে পরিবেশিত হয় এবং পুরুষেরা নৃত্যে ও বাদ্যে অংশগ্রহন করে থাকে |

রাঢ় বাংলার লোকসংগীতের অন্যতম প্রাণ সম্পদ ঝুমুর গান | শাল, পিয়াল, কেঁদ, করম আর মহুয়ার জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি প্রকৃতি ঘিরে যে গানের প্রভাহমানতা এক সুউচ্চ সংগীত শৈলীর পরিচয় প্রদান করে- তাই ঝুমুর গান নাম পরিচিত | ঝুমুর ছিলো হাঁকা পর্যায়ের শব্দ উদগিরণের একটি কলা মাত্র | ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বর তাল মাত্রা এবং ছন্দের বিভাজনে সুরের বিধিবদ্ধতায় তা সংগীতে উত্তীর্ণ হয়েছে | প্রধানত তিন চারটি স্বর বিশিষ্ট এই গানের ধারাটি ঝুমুর অঞ্চলের সকল শ্রেণীর গানেই ক্রিয়াশীল | উঁচু স্বর থেকে অবরোহণে আসার এই কৌশলটি ঝুমুর গানের আদিম বৈশিষ্ট্য | আদিবাসী সমাজ থেকে উদ্ভূত এই গানের সঙ্গে নৃত্য ধারা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে | পুরুলিয়া জেলার ঝুমুরের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন | এই এলাকার আদিম জনজাতিদের জীবনযাপন ও আচার সংস্কার অনুযায়ী গড়ে উঠেছে এই সমৃদ্ধশালী পরম্পরা | ধামসা, মাদল, কেদ্দরী, বাঁশি, ঘুঙ্গুর প্রভৃতি নৃত্যগীতিবাদ্যে শিল্প সমন্বিত যে রূপ বর্তমানে প্রচলিত, সংগীতগুনীরা তার পূর্ব ইতিহাস ভিন্নতর ছিল বলে মনে করেন|

মোটামুটিভাবে ঝুমুরকে এর সাহিত্য বা বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে | সিন্দুরিয়া, ভাদুরিয়া, আধ্যাত্মিক | ভাদুরিয়া বিভাগটি নির্ভর করে ঝুমুর গানের সাহ্যিতকে কেন্দ্র করে | শ্রীরাধা নানা সাজে সজ্জিত হয়ে কৃষ্ণের দর্শনের অপেক্ষায় বসে আছে কিন্তু তার দর্শন না হওয়ায় যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে, এইরূপ বিষয়বস্তু নিয়ে ভাদুরিয়া ঝুমুর তৈরী হয় | যুবক-যুবতীর প্রেম বিরহের কথাই সিন্দুরিয়া ঝুমুরের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে | সিন্দুরিয়া ভাদুরিয়া ঝুমুরগান ছাড়াও যে আধ্যাত্মিক কাঠামোর উপর গড়ে উঠেছে | সামগ্রিকভাবে ঝুমুর গানের যে অবয়ব, তাকে কেন্দ্র করে যে বিভাজনটি লক্ষ্য করা যায়, তাতে ঝুমুর গানের নানা ভাগ উপভাগ এবং নানান ধারাও লক্ষ্য করা যায় | ঝুমুর প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত | লৌকিক ও দরবারী | লৌকিক ধারাটি শ্রুতি নির্ভর, অন্য ধারাটি শিল্প গুনাত্মিক |

যে কোনো লৌকিক কৃষ্টির মধ্যে ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেই জন্যই প্রাচীনকাল থেকেই লৌকিক সংগীতের কোনো শাস্ত্র তৈরী হয়নি | লৌকিক সংগীতকে কখনও বাধা যায় না, বিভিন্ন অঞ্চলভেদে, সম্প্রদায় ভেদে, জাতিভেদে, যুগ ভেদে পরিবর্তনশীল | লৌকিক ঝুমুরের ক্ষেত্রে এই একই নিয়ম লক্ষ্য করা যায় | খুব সাধারণ মানুষের মধ্যে এই গানগুলি প্রচলিত হই বলে লৌকিক ঝুমুরগুলির মধ্য সাহিত্যের চটুলতা বা লঘু সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় | লৌকিক ঝুমুরের প্রকারভেদ করা হয়েছে – দাঁইড়শালিয়া ধারা ও পাতাশালিয়া ধারা | দাঁইড়শালিয়া ধারাটি দাঁড় ঝুমুর বা টাঁড় ঝুমুর নামে প্রচলিত | টাঁড় শব্দটির অর্থ হল মাঠ | কৃষিকর্মের সঙ্গে সঙ্গে দাঁইড়শালিয়া শ্রেণীর গান মাঠে প্রান্তরে আচার বিধির সঙ্গেও যুক্ত | করম কিম্বা যে কোনো উৎসবেই দাঁইড়শালিয়া ঝুমুর পরিবেশিত হয়ে থাকে | ধামসা, মাদল, ঘুঙ্গুর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র এই গানে বব্যহৃত হয়ে থাকে | পুরুষেরাই নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করে থাকে | রামসীতা, রাধাকৃষ্ণ কিম্বা মানবিক

আবেদন যুক্ত গানই এর বিষয়বস্তু হয়ে থাকে | পাতাশালিয়া ধারাটি পাতা নাচের গান, পাতানাচাড়ী অথবা মাদল নাচের গান নামে পরিচিত | নারী পুরুষ সমবেত ভাবে নৃত্যগীত বাদ্যসহ এই ঝুমুর গান হয়ে থাকে | মূলত: করম উৎসবের মধ্যেই উদযাপিত হয় | করম উৎসবটি ধান তোলার বা ধানের বীজ রোপণ জাতীয় কৃষিকাজ ঘিরে পালিত হয় | ভাদ্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে করম পূজা হয়ে থাকে | নারী পুরুষ উভয় কণ্ঠেই এই গীত শোনা যায় | সম্মিলিত নৃত্য গীতের মধ্য দিয়েই এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে |

কোনো কোনো লোকসংগীত গুণীর মতে নাচনীশালিয়া ধারা নামক আর এক প্রকার ঝুমুরের উল্লেখ পাওয়া যায় | এই ঝুমুর লৌকিক ধারার মধ্যে প্রধানতম পর্যায় | সিংভূম, মানভূম, ধলভুম অঞ্চলে রসিকদের নাচনী পোষা এক করুন কিংম্বদন্তী | নাচনীরা মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য যেখানে নাচ পরিবেশন করেন, সেই জায়গাটিকে বলা হয় নাচনীশাল | নাচনীদের নাচের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত চটুল রসের যে গান হয়, তাকেই বলে নাচনীশালিয়া ঝুমুর | (২0১3 গিরি, 57)

উদাহরণ: “কোমর পাইড়া নীল শাড়ি

আবোল বেড়ি করি

বাজু ঝুলনি, কত গরব নারী বেশভুষনী || “

লৌকিক ঝুমুরের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি বিশেষভাবে স্বতন্ত্রতার দাবী রাখে, তা হল লঘু সাহিত্যের প্রভাব এবং সুর কাঠামো | যেমন সাহিত্যের কথা বলতে গেলে, দৈনন্দিন জীবনের কথা, কর্মজীবনের কথা, দেবদেবীর কথা এবং প্রকৃতির বর্ণনার কথা আমরা এই ঝুমুরে পেয়ে থাকি | লৌকিক ঝুমুরের গানগুলির মধ্যে সাহিত্যের চটুলতা বা লঘু সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় | সুর বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উঁচু স্বর থেকে নিম্নে আসার বা অবরোহণের গতির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় | কয়েকটি তুকে একটি গান বিন্যস্ত থাকে | দেখা যায় প্রত্যেকটি তুকের সুরগুলি একই রকম ভাবে রচিত | স্বর সন্ধর্ভের মধ্যে বেশী জটিলতা দেখা যায় না | শুদ্ধ স্বরগুলির পর পর প্রয়োগের মাঝে অল্প করে কোমল স্বরের প্রয়োগ লৌকিক ঝুমুর গানগুলির মধ্যে এক মাদকতার সৃষ্টি করে | এছাড়া যন্ত্রানুষঙ্গ ধামসা, মাদল, ঘুঙ্গুর, বাঁশী ইত্যাদি সহযোগে লৌকিক ঝুমুর গানটি একটি স্বতন্ত্র সংগীত হিসাবে স্বীকৃতি পায় বলে আমার মনে হয় |

দরবারী ঝুমুর রাঢ় বাংলার ঝুমুর গানের প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ার পরবর্তী সময়ে তা সমাজের গণ্য মান্য ব্যক্তিদের নজরে আসে | কোনো কোনো সংগীত গুণীরা মনে করেন লৌকিক ধারার খেমটি থেকে নাচনী নাচের ঝুমুরে, এর উত্তরণ ঘটেছে | কোনো ওস্তাদ দ্বারা তালিম প্রাপ্ত কোনো নাচনী নাচের ঝুমুর দরবারে স্থান করে নেয়, ক্রমে আরও পরিশীলিত রূপ নেয় এবং মনোরঞ্জনের জন্য সাধারণের প্রচারে আসে | প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন ঝুমুর গান আশ্রয় পেল, তখন থেকে দরবারী ঝুমুরের সৃষ্টি হল | আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের পরবর্তী সময়ে মহারাজের রাজসভায় এই ঝুমুর গান পরিবেশিত হত | কৃষ্ণদাস কবিরাজের “শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত ‘মহাগ্রন্থে চৈতন্যদেবের মথুরা ভ্রমণের সময় দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলার কিয়দংশ পরিক্রমার কথা উল্লেখ করা যায় | (1997 সিংহ, 4) ফলে এই দরবারী ঝুমুরে কীর্তনের সুরের আভাষ লক্ষ্য করা যায় | সুরের বৈচিত্র্যের দিকে নজর করলে দেখা যাবে যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ রাগিণীর প্রভাবও এই দরবারী ঝুমুরে বিশেষভাবে লক্ষণীয় | লৌকিক ঝুমুরে যে সকল বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হত তা অধিকাংশে দরবারী ঝুমুরে ব্যবহৃত হত | কীর্তনের সুর যখন দরবারী গানে ব্যবহৃত হতে লাগলো, তখন সেই গানের ভাবকে যথাযথ বজায় রাখার জন্য খোল, করতাল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতে সুরু হয় |

উদাহরণ: “যাকর ঘুঘী তাকর মাছ মিছাই কর সাতপাঁচ || “

সুতরাং দরবারী ঝুমুরে দেখা যাচ্ছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটু পরিশীলিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরের বৈচিত্র্যর ক্ষেত্রে কীর্তন সুরের ও রাগরাগিণীর প্রভাব ও রয়েছে | যা অন্যান্য অঙ্গের ঝুমুর গানের থেকে সহজেই দরবারী ঝুমুরকে অন্য ভাবে বুঝতে সাহায্য করে | নিম্নে কগুলি বৈচিত্র্যপূর্ণ দরবারী ঝুমুর গানের উদাহরণ দেওয়া হল-

“আসিল বসন্ত ঋতু হরসিত প্রাণ, নবসুরে কোকিলা, কোকিল করে গান “

“ওরে কানা ভ্রমর তুমি নাগর

কইর না আর ছটর ফটর “

উপরোক্ত দুটি দরবারী ঝুমুর গানে দেখা গেছে স্বর কাঠামো একই রকম কিন্তু স্থানভেদে বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ঘটেছে | এছাড়া অন্য কয়েক ধরণের ঝুমুরের প্রচলন বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় |

“কার গরভে কৃষ্ণ দশমাস রইল হরি হায়রে, কার দুধ পিয়ে বড় ভেলায় যমুনা তীরে, বাঁশীয়া বাজায় ধীরে ধীরে || “

রাঢ় বাংলার মধ্যে বিহারের ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশের অস্তিত্ব আছে বলে দেখা যায়, তাই এখানকার ঝুমুর গানে হিন্দি ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় | এই ঝুমুর গানগুলিকে ঝাড়খণ্ডি ঝুমুর বলে আখ্যা দেওয়া হয় |

আবার চা বাগান, কয়লাখনি অঞ্চলে প্রভৃতি কর্মস্থলে বিভিন্ন জাতির মানুষের সমাবেশ হয় বলে অর্থাৎ শ্রমিক বৃন্দের মধ্যে একটা মিশ্র ভাষা যুক্ত ঝুমুর গানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় |

উদাহরণ: “আল কিনারে নাহর গাছে

বগা বগা ফুল

ফুল কে দেখিয়া ছুরি

ধ্যাচাকে চামড়াইল || “

সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, যেকোন প্রকার ঝুমুর গানই হোকনা কেন, তার মধ্যে কখনও অনড় নিয়ম থাকতে পারে না. দেখা গেছে, একটি বিশেষ ঝুমুর গান যার অঞ্চল, জাতি বা সম্প্রদায় ভেদে ভিন্নরূপ গ্রহন করেছে. কোথাও দেখা যায় সাহিত্যের, কোথাও দেখা যায় সুরের ভঙ্গির এবং উচ্চারনের পরিবর্তন ঘটেছে. যাইহোক, রাঢ় বাংলার অন্যান্য গানের ধারাগুলির মধ্যে ঝুমুর গান বিশেষ ভঙ্গি, সাহিত্য, সুরবৈচিত্র্য, যন্ত্রানুসঙ্গ এবং নৃত্যের প্রয়োগে আপন মহিমায় জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রচলিত হয়ে চলেছে. এই ঐতিহ্যপূর্ণ ঝুমুর গানে কোনরুপ বিকৃতি না ঘটে, তার জন্য আমাদের সকলকেই সজাগ থাকতে হবে।


গ্রন্থপঞ্জী:

আশীষ গিরি. আরশী নগর . কলকাতা: রূপশালী, ২০১৩.
আশুতোষ ভট্টাচার্য. “লোকসংগীত রত্নাকর.” নিভা মুখোপাধ্যায় রচিত. কলকাতা, ১৩৭৪.
চিত্তরঞ্জন দেব. বাংলার পল্লীগীতি . কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা: লি: প্রথম মুদ্রণ, ১৯৬৬.
যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী. রাঢ়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস . নবদ্বীপ: নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ, ২০০৮.
দিনেন্দ্র চৌধুরী. “গ্রামীণ গীতি সংগ্রহ.” কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমী, ১৯৯৯.
বিশ্বকোষ . ১ ম প্রকাশন. সংখ্যা ১৬ খণ্ড. কলকাতা.
শান্তি সিংহ. লোকসংগীত সংগ্রহ ঝুমুর . প্রথম সংস্করণ. কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমী, ১৯৯৭.